‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি পড়তে শুরু করার পর যখন কিছুদূর এগিয়ে গেলাম তখন এ উপন্যাসটিকে ঘিরে একটি সমালোচনা দাঁড় করানোর সাড়া জাগল মনে… এবং মনের মাঝে একখানি বাক্য গড়ে উঠল ধীরে, সাহিত্যের বিবেচনাতে – “এর আগে আর কোনো বাংলা উপন্যাস পড়তে গিয়ে এমন করে ভালো লাগেনি।” কিন্তু সংকোচে যেন আর এগিয়ে যেতে পারছি না, এই ভালো লাগা সে তো হলো, তারপর বক্তব্যের আয়োজনের সাধ নিয়েও কাজটি আর হয়ে উঠছে না।
কাজটি থেমে আছে কেন? — উপন্যাসের প্রাসঙ্গিক বোধের বিকাশ নিয়োজন পায়নি কি আমার পাঠাভ্যাসে?
এ উপন্যাসের যে মেয়েটি কুমুদিনী, সে মেয়েটির সত্তার যে বিশেষত্ব, তার চরিত্রের যে কোমলতা ভক্তি ও বেদনা, এবং পারিপার্শ্বিকতার বলয়ে যে নিস্তাপ ও প্রবলতাহীন জীবনপ্রসঙ্গ, যে বৈরাগ্যবিধুরতা, সময়ের যে নির্জনতা, নীতিসৌন্দর্যের সাধনার প্রত্যয় ও প্রাণময়তা — উত্তাল বিবেচনাময় ও শক্তিমান মানসিক প্রয়োগে অস্তিত্বের আবেদন উৎকণ্ঠিত ও উজ্জীবিত প্রেরণায় খোদাই করা হয়নি, (একটি পাতে তার অস্তিত্বের গোপনীয়তাকে দাগ টেনে বিধৃত কার হয়নি), এখানে একজন গুনী কবি তার গুনের চ্ছটায় একটি মানবিক সম্পর্ককে, সমাজের একটি বহু পুরাতন মৈত্রীর নারীপুরুষের বিবাহ প্রসঙ্গের পরিচয় দিতে দিতে, তামার পাতের উপর আঙ্গুলে আঁকা তার গোপন দাগ—সম্পর্কের সাধনা ও বেদনাকে উপস্থাপন করেছেন — আর এভাবে ধরা পড়েছে সামাজিক ও আত্মিক নিযুক্ততার ও সম্পর্কের “যোগাযোগ”।
কাহিনীর যে চরিত্রটি ঘটনার বেগ-ও-অনুসন্ধানকে সচলতা স্পন্দন ও স্থাপত্য দান করে, সে হলো : মধুসূদন, যার শক্তি-ও-ঐশ্বর্যের প্রতিভা একটি অতি নিবিড় মানসিক আন্দোলনে বিস্ময় ও বিস্তার পেয়ে, সম্পর্কের ঐশ্বর্যের জগতে ধীরে ধীরে নিজের অধিকারের বাসনার প্রবলতাকে আচরিত করতে থাকে, তার ঈর্ষা তার জীবনের মানসিক দুর্বলতার ও বুদ্ধি-বিষয়-ও-দায়িত্ব-গত সকল সবলতার দ্বন্দ্বকে উপস্থাপন করে।
‘তার সেই দাদা’ — কুমুদিনীর দাদা, যা “যোগাযোগ” উপন্যাসের সবচেয়ে তাৎপর্যধন্য চরিত্র : এই বিপ্রদাস, যার আত্মনিবেদনে কুমুদিনীর মানসিক স্বচ্ছতা পারষ্পরিক আলাপে ও সম্পর্কের বেদনায় উদবোধিত এবং তার আত্মার নিবেদনের তপস্যা প্রতি মুহূর্তে দায়িত্ববান; তাকে উপন্যাসটির মনোগত কর্মপন্থার, কুমুদিনী ও মধুসূদন দুজনের জন্যই, কেন্দ্র বিবেচনা করা যায় — এ ক্ষেত্রে মধুসূদনের সত্তার উৎকেন্দ্রিকতা এবং কুমুদিনীর সত্তার কেন্দ্রমুখী মানসিক ভাবনা-বেদনা উপন্যাসের বিকাশ-ও-বন্ধনকে নিগূঢ় ও বিবৃত করেছে।
তিনটি চরিত্রকে বিশেষ একটি পরিবেশে প্রত্যয় ও প্রসঙ্গের সাথে উপস্থাপিত যখন করা গেল তখন তাদের পারষ্পরিক সম্পর্কের বিরোধ ও বেদনা তাদের মানসিক অস্তিত্বের নিয়োজনের নাটকীয়তায় বিস্তৃত ও ঘনীভূত হয়ে উঠল।
“সিঁড়ির তলা থেকে মধুসূদন ফিরল, বুকের মধ্যে রক্ত তোলপাড় করতে লাগল”, তার কুমুদিনীর কাছে এসে মানসিক উৎকণ্ঠা ও অন্যদিকে কুমুদিনীকে পাওয়ার যে শক্তিমান লোভ ও তীব্র প্রভুত্বের চেতনা : এসব মিলে মধুসূদনের সে সময়ের বোধের সংজ্ঞা, গ্রহনের আবেগ ও মানসিক দুর্বলতা, রাতের চরিত্রের এই বিপর্যয়, আর নির্জন কেরোসিনের লণ্ঠন-জ্বলা তেলবাতির কুঠুরিতে “ সেই মাদুরের উপর গায়ে একখানা চাদর দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন, (কুমুদিনী)—বাঁ হাতখানি বুকের ওপর তোলা। দেয়ালের কোণে লণ্ঠন রেখে মধুসূদন” কুমুদিনীর মুখখানি যেই দেখল অমনি “মুখের মধ্যে একটি অনির্বচনীয় সম্পূর্ণতা” দেখতে পেল, সে মুখের স্তব্ধতায় কোনো বিরোধ নেই — কিন্তু কেন বিরোধ? না, বিরোধ তার নেই, তার নিজের জীবনে উদ্যত নিরন্তর সংশয় তো ছিল না, সুপরিণতির এক অপূর্ব গাম্ভীর্য ছিল, সেই তার ফেলে আসা দাদার ঘরে মানবিক এক উদারতা ছিল তাদের সমগ্র পরিবারে, — এর ফলে, এবং কুমুদিনীর নিজের নিবেদনের সহানুভূতির ও মর্যাদার যে বোধ, তাও তাকে মধুসূদনের বিরোধের অন্দরে দুর্বল ও পূর্বজীবন-পরায়ণ বিকলতায় পর্যবসিত করেনি। কুমুদিনী তার সময়কে তার সত্তার নূতন প্রতিবেশে সংস্থাপন করেছে এবং তার সময়ের অস্তিত্বকে সংবেদনশীল করে তুলেছে।
“টেলিগ্রামটা পড়ে দেখলে, তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, ‘আমার জন্য উদবিগ্ন হোয়ো না; ক্রমশই সেরে উঠছি; তোমাকে আমার আর্শীবাদ।’ কঠিন উদবেগের নিরতিশয় পীড়নের মধ্যে এই সান্ত্বনার কথা পড়ে এক মুহূর্তে কুমুর চোখ ছলছল করে উঠল।” সেই তেলবাতির কুঠুরির মধ্যে অভিমানী কুমুদিনী বাস করছিল না, সেখানে যে বাস করছিল সে মানবিক সত্তার ও মনের অনুসন্ধানক্ষম কুমুদিনী, সে কিছু পায়নি বলে, সেই কিছুকে পাবে মনে করে তেলবাতির কুটুরিতে যায়নি , বরং একটি নূতন প্রতিবেশে (মধুসূদনের শোবার ঘর তার মানবিক স্বাধীনতাকে, তার বোধের স্বচ্ছতাকে প্রতিহত করছিল বলেই) নিজেকে বদ্ধ করে নিজের সন্ধানেই সে লিপ্ত ছিল, তার দাদার বর্তমান রুগ্নতা তাকে ভাবিয়েছে, সেখানে সংসার বিষয়ে কোনো খেদ নিয়ে ফিরে যেতে চায়নি “ঐ আকাশটা কেমন একটা মলিনতার বোঝা নিয়ে মাটির দিকে নেমে পড়েছে, তেসনি দাদার জন্য একটি দুশ্চিন্তার দুঃসহ ভার কুমুর মনটাকে যেন নীচের দিকে নামিয়ে রেখে দিল।” এই তার মনের বেদনার বোধ — আর কিছু নয়। আর তাই টেলিগ্রামটি পড়ার পর তার মনটি তার দাদার মানসিক অবস্থাকে আরো স্পষ্টভাবে জানার আকুতি নিয়েই প্রশ্ন করেছে, মানবিক বোধের দায়িত্বঘটিত এ প্রশ্ন “দাদার কি চিঠি আসেনি?” কিন্তু মধুসূদনের সঙ্গে কুমুদিনীর বিবাহিত জীবন, সে জীবন নিয়ে কুমুদিনী কি সচেতন নয়? কিন্তু কেন নয়? না, অবশ্যই সে সচেতন, সে তাদের পারষ্পরিক জীবন বিষয়ে সচেতন, সে মাত্র একটি স্বামীর একজন স্ত্রী রূপে মধুসূদনের ঘরে আসেনি, তার সত্তার সত্য বিষয় ছিল মানবিক সম্পর্কের সম্ভাবনা ও সমবেদনা : কিন্তু মানসিক বিস্ময়ের দ্বন্দ্ব নিশ্চিহ্ন নয় তার মনে, অতএব মধুসূদন যেমন করে কুঠুরিতে এলো এবং তার পাশে সারারাত বসে থাকার সংকল্প বেঁধে তুলত, তার সাথে একাকার ছিল না কুমুদিনীর মনের সমর্পণ, তার বিনয় তার চিন্তা তাকে যে ব্যক্তিত্ব দিয়েছে তার সাথে সহাবস্থান ছিল তার দাদার তাই “ক্রমশ সেরে উঠছি, তোমাকে আমার আর্শীবাদ” এই নিস্তাপ কথায় যে বেদনা জাগে কুমুদিনীর প্রাণে, “বড়োবউ, ঠাণ্ডা লাগবে, ঘরে এসো” এই সহানুভূতিশীল উষ্ণ কথায় তেমন প্রাণের বন্দনা জাগে না, একে তার অপরাধীর আত্মগ্লানি মনে হয় — তার মনে বরং একথা আলোড়ন তোলে, তার নিজের অন্তরের বিপর্যয়কে সে দেখতে পায় “অন্তরের মধ্যে কুমু যে বাণী শুনতে চায়, তার সঙ্গে এ কণ্ঠের সুর তো মেলে না। এই তো তার পরীক্ষা, ঠাকুর আজ তাকে বাঁশি দিয়েও ডাকবেন না। তিনি রইবেন ছদ্মবেশে।”
মধুসূদন আর কুমুদিনীর মাঝে এমন একটি সম্পর্কের নিগড় লাগল যাকে আর অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু এই সম্পর্ককে উপভোগ করবার ও দায়িত্ববোধের গভীরতায় বিশ্বাস করবার সম্ভাবনা সচলতা ও ফুল্লতা নিয়ে প্রত্যয়-ও-আসঙ্গের ভালোবাসায়, সংসর্গে ও আলাপে দুটি মনের স্বাধীনতাকে উদবোধিত করে সে আনন্দসুধার মিলিত বাঁধনকে ব্যক্ত করতে পারেনি। এদের দুজনের নিজ নিজ ইতিহাস যেমন এদের সামাজিক বৈরিতাকে প্রকট করেছে, এদের দুজনের নিজ নিজ কর্মভাগ্যও এদের মনোধর্মে পার্থক্যের প্রকটতাকে স্পষ্টতর করে তুলেছে, আর তাদের দুজনের মাঝখানে যে আলাপ যে কথোপকথন তাই বারবার তাদের জীবনসুখের রসভঙ্গ করেছে।
মূলত, এই কুমুদিনী, যার সরলতা, বিশেষ একজন মানুষের চাপিয়ে দেয়া পরাধীনতায়, বারবার বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছে; সেখানে কুমুদিনী যে প্রচেষ্টায় নিয়ত নিজের মনকে অবাস্তব এক মহিমার নিকট নিজেকে নিবেদিত করে দিয়েছে, তাকে ঔপন্যাসিক প্রকাশ করেছেন এভাবে (ঔপন্যাসিক ঠাকুরের গদ্য এমন একটি বেদনাকে প্রকাশ করে, যা তার চরিত্রের মনোজগতের চেতনা-স্পন্দন-ও-স্মৃতিকে অন্তঃকরণের সাতত্যের সচলতা দান করে, এই সচলতা — ঝর্ণার এই শীতল প্রবাহমান ক্ষীণধারা, যা মানবিক চেতনার প্রসারকে, সম্ভোগকে ও জাগতিক বোধের মহাবিশ্বকে দৃষ্টির আলোতে উদ্ভাসিত করে তোলে; এই প্রতীকী ঝর্ণা : এর গতি-ও-তরঙ্গের বিনয়, আমাদের মানবিক ভূমাকে অচ্ছোদ আবেদনে অগ্রসরমান রাখে। অন্যদিকে বঙ্কিমের কাজের ঘরের গদ্য তার বিবৃত রেখাঙ্কন তার প্রত্যয় ও প্রতিদান তার বিস্ময় ও বিকাশ তার পরিবেশ ও প্রণয় তার পরিচয় ও সময় মানবিক লক্ষ্যের অন্যতর সাহিত্যিক ও মানসিক সমাজ-ও-সাধনাকে বিবৃত করে — সে গদ্যের সুষমা আমাদের পাঠাভ্যাসকে যেমন নিবিড় ও নিকষ করে তোলে, সে গদ্যের স্পষ্টতা আমাদের মানবিক নৈকট্যের আবেদনকে চিরমুখর রাখে।) “যেখানে কুমু ব্যক্তিগত মানুষ সেখানে যতই তার মন ধিককারে ঘৃণায় বিতৃষ্ণায় ভরে উঠছে, যতই তার সংসার সেখানে আপন গায়ের জোরের রূঢ় অধিকারে তাকে অপমানিত করছে ততই সে আপনার চারি দিকে একটা আবরণ তৈরি বরছে। এমন একটা আবরণ যাতে করে নিজের কাছে তার ভালো-লাগা মন্দ-লাগার সত্যতাকে লুপ্ত করে, অর্থাৎ নিজের সম্বন্ধে নিজের চৈতন্যকে কমিয়ে দেয়। এ হচ্ছে ক্লোরোফরমের বিধান। কিন্তু এ তো দু-তিন ঘণ্টার ব্যবস্থা নয়, সমস্ত দিনরাত্রি বেদনাবোধকে বিতৃষ্ণাবোধকে তাড়িয়ে রাখতে হবে। এই অবস্থায় মেয়েরা যদি কোনোমতে একজন গুরুকে পায় তবে তার আত্মবিস্মৃতির চিকিৎসা সহজ হয়; সে তো সম্ভব হল না। তাই মনে মনে পূজার মন্ত্রকে নিয়তই বাজিয়ে রাখতে চেষ্টা করলে। তার এই দিনরাত্রির মন্ত্রটি ছিল—
তস্মাৎ প্রণম্য প্রণিধায় কায়ং
প্রসাদয়ে ত্বাম্ অহমীশমীড্যম্
পিতেব পুত্রস্য সখেব সখ্যুঃ
প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম্।
হে আমার পূজনীয়, তোমার কাছে আমার সমস্ত শরীর প্রণত করে এই প্রসাদটি চাই যে, পিতা যেমন করে পুত্রকে, সখা যেমন করে সখাকে, প্রিয় যেমন করে প্রিয়াকে সহ্য করতে পারেন, হে দেব, তুমিও যেন আমাকে তেমনি করে সইতে পারে। তুমি যে তোমার ভালোবাসায় আমাকে সহ্য করতে পার তার প্রমাণ এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, তোমার ভালোবাসায় আমিও সমস্ত ক্ষমা করতে পারি।”
আমাদের জীবনের সম্পর্ক-ও-বিশ্বাসে ‘অপরূপ আর্বিভাব’কে আমরা মনের বেদনায় ও বন্দনায় একাকার করে দেখি, এ হলো আমাদের সত্তার অলৌকিকতা, ব্যক্তিগতের মরণ সেখানে। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের মধুসূদনের যে পরিবেশগত ব্যক্তিকতা, যার কঠোর প্রয়োগে মানবিক সম্পর্কের স্বাধীনতা-সম্ভাবনা-গোপনীয়তা-ও-প্ররোচনাকে সে জানতে বা পারেনি, এই যে একটি অতি সৎ অজ্ঞতা, যা তার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়ার ফলাফল, সে একজন ভালোমানুষই বটে, সে একজন সফল মানুষ, সে এমন একজন যার মধ্যে স্ববিরোধীতার সচেতনতা বিবৃত ও বিকশিত হয়ে ওঠেনি, সে মানব সমাজের মানুষ নয়, সে সমাজের মানুষ, সে পরিস্থিতির প্রভাব ও অনুভবে নিয়োজিত নয় — লীলায়িত নয়, সে তার পরিবেশের পরিচয়কে প্রদান করছে মাত্র। এমন একটি সামাজিক আয়োজনে কুমুদিনীর মানসিক সংবাদ-সাধনা-প্রত্যয়-ও-প্রয়োজন তাকে মানব সমাজের করে তুলেছে, কুমুদিনীর সচেতনতার সৌন্দর্য আর্বিভাবের মতোই উদবোধিত ও সচল : এদুয়ের সম্মিলিত বোধ ও অগ্রগতিকে যদি বলি সন্ধান এবং মানবিকতার গূঢ়তম অবদানও যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এমনি অস্তিত্বের সাত্ত্বিক চরিত্রটিকে নিয়ে কর্মে জড়িত থেকেই মানবের চারিত্রিক কীর্তির অবয়বকে নিভৃত একটি সাহিত্য-গড়নে মূর্ত-রূপে পাওয়া যায়।
“এরকম অযাচিত দান মধুসূদনের দ্বারা জীবনে কখনো ঘটেনি।”
“এতক্ষণ পর চমকে উঠে ধিককার হল নিজের উপরে। উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘কাজ আছে, আসি’।”
“পথের ধারে শ্যামাসুন্দরীর ঘরের সামনে এসে বেশ প্রকাশ্য কণ্ঠস্বরেই বললে, ‘ঘরে আছ’?”
“কী ঠাকুরপো?”
“পান দিলে না আমাকে?”
কাহিনীর এই অতি সহজ বাঁকটি মধুসূদনের সাদামাটা চারিত্রিক সত্যকে নিঃসংশয়িত করে তোলে — এই চরিত্রটির প্রতি ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ কোনো মমতা প্রদর্শন করেননি, এবং এও বলা যায় এর মাঝে তিনি তার কোনো সাহিত্যিক-মানসিক-ও-মানবিক প্রলোভনকে উজ্জীবিত করে তুলবার প্রয়াস নেননি। চরিত্রটি নির্মমভাবে অজ্ঞ, ক্ষমতাবান ও নিয়মের নিগড়ে বাঁধা, সংকীর্ণচিত্ত অর্থবান, চায় প্রভাবশালী হতে বাইরে যেমন তেমনি একই প্রক্রিয়ায় ঘরে। আর একটি নিদারুণ বাঙালি চরিত্র বলা যায় একে, অহরহ প্রাপ্য, একচ্ছত্র ও নিত্য, ঠিক এ চরিত্রটির সাথেই বাঙালির অন্য একটি চরিত্ররূপ ‘কুমুদিনী’র সামাজিক সংযোগ-অমিল-সম্পর্ক-ও-সংকটের নাট্যের জন্মলাভ, বাঙালি সমাজকে উনবিংশ শতাব্দীর রবীন্দ্রনাথ এইভাবে দ্বিধাবিভক্ত করে দেখিয়েছেন, ভবিষ্যতে সমগ্র বাঙালির সামাজিক-মানসিক বলয়কে এককথায় পরিচিত করবার প্রসঙ্গে এ দুটি নামের উল্লেখ যথেষ্ট হবে : ‘কুমুদিনী’, ‘মধুসূদন’—এ দ্বন্দ্ব অব্যাহত : সামাজিক প্রকৃতি ও সামাজিক সম্পর্কের মানসিক দিক একে আমাদের সমাজ ধর্মে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। বন্ধুত্বের ও বেদনার বিষয়ে এক নির্মম অজ্ঞতা — সম্পর্কের সৌহার্দ্যের ও সচলতার একাকীত্বে অবারিত মাধুর্য ও করুণতা : এ দুটি দিক বাঙালির সম্পর্কের দুই বিপরীত মেরু — বাঙালি সমাজের দুই স্বতঃসৃজন। আর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি বাঙালির এই অজ্ঞতা ও একাকীত্বের প্রকাশ্য বিবরণ।
কিন্তু এও তো ঠিক, সম্পর্কের নিবিড়তার মাঝেই আবার পৃথিবীর কাজকর্ম করে যেতে হয়, সেখানে বুদ্ধির ও নিয়োজনের যে নিরলস নৈতিকতা তার মাঝে আত্মস্থ থেকে ব্যক্তি-দ্বারা-সম্ভব রচনাশক্তিকে দক্ষতার সহিত উপস্থাপন করতে হয়। এই যে কাজের ঘর, যেখানে মানুষের শক্তি সম্মিলিত হয়েও একাকীত্বের আজ্ঞাকে বহন করে, — যেখানে মানুষের চিন্তার প্রচেষ্টা কর্মের সংযোগ-সংকট অনুষ্ঠিত ও আচরিত, সেখানে তার দায়িত্বের আদি-অন্ত তার বুদ্ধির কারুকার্যে দৃঢ় ক্ষমতার বিশ্বাসকে পায়। মধুসূদনের চরিত্রের এমন একটি দিককে পর্যবেক্ষণ করা গেল “মাদ্রাজের এক বড়ো ব্যাঙ্ক ফেল করেছে” সেই সূত্রে তার ব্যবসায়িক সংকটের বিষয়ে কথা উঠল যখন। “… ব্যবসা সম্বন্ধে মধুসূদনের সেইরকম মনের অবস্থা। এ যে তার নিজের সৃষ্টি; এর প্রতি তার যে দরদ সে প্রধানত টাকার দরদ নয়। যার রচনাশক্তি আছে, আপন রচনার মধ্যে সে নিজেকেই নিবিড় করে পায়, সেই পাওয়াটা যখন বিপন্ন হয়ে ওঠে তখন জীবনের আর-সমস্ত সুখদুঃখকামনা তুচ্ছ হয়ে যায়।”
বিপ্রদাস দুঃখ ও অপমান নিয়ে কুমুদিনীকে বিদায় দিয়েছিল তার আপন সংসারের সীমানা হতে — মধুসূদনের সাথে যাকে ঘর করতে হবে সে কুমুদিনী তার স্বাধীনতা-ও-স্বকীয়তার সমস্ত সচেতনতা নিয়ে বিতৃষ্ণা-ও-বেদনার মধ্য দিয়ে তার সময়কে অতিবাহিত করবে বলেই ‘মধুকুঞ্জে’ আবার প্রবেশ করল — কিন্তু এইভাবে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে কুমুদিনী এক অপ্রতিহত একাকীত্বের রাজ্যে নিজেকে সমর্পণ করে দিল, এই সমর্পণ মূলত তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বের মূলসুর – তার পারিপার্শ্বিক সামাজিক প্রক্রিয়ার এই ছিল প্রস্তাবিত ব্যবস্থা, কিন্তু কুমুদিনীর মনের গতি তার আত্মার আর্তি ও সর্বোপরি তার সত্তার স্বাধীনতা এই প্রস্তাবিত ব্যবস্থার দুঃখ ও অপমানের মাঝেও নিজের নির্মল পরিপূর্ণতাকে নিয়ত উদবোধময় রেখে, উদযাপিত লোকায়ত জীবনের নিবেদিত মঙ্গলময়তায় একে সঞ্চালিত করে যাপিত অস্তিত্বের ভালোবাসার গুণময় মধুরতাকে ‘অচঞ্চল শান্তিতে’ প্রকাশিত ও আচরিত করে তুলবে বলেই আপন সীমানায় নিজের অপ্রমত্ত অধিকারকে স্বীকার করেছিল। বিপ্রদাসের ঘরে এ সম্ভব হতো না, বিপ্রদাসের ঘর আর কুমুদিনীর নিয়তির ঘর নয়, আর নিয়তি ব্যতিরেকে জীবনের সাধনার সত্যকে মহৎ ও বিশদ করে তোলা যায় না। সেই নিয়তির ঘরে তার একাকীত্ব, সেই একাকীত্বের সবল স্বচ্ছতা তার জীবনকে জীবনঘনিষ্ঠতার সাতত্য দান করেছে।
এই অসমাপ্ত উপন্যাসটির আদি-ও-অন্তের বিস্তৃত পরিসরে লেখক তার কালের সাংসারিক অবয়বের প্রাসঙ্গিক বোধের ও সংসার-যাপনের প্রাজ্ঞ পর্যবেক্ষণের দক্ষতায় প্রকাশিত ধারনার যে বিবরণ বিশ্লেষণ ও অনুভূতির রহস্য-নিবিড়তার সঞ্চালন-সন্ধিৎসার অবতারনা করেছেন তা উপন্যাসের একটি সামগ্রীক রূপের সম্পাদনায় তার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে।
যে চরিত্রটির মধ্য দিয়ে আমি ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের পঠন কাজে আমার নিজের মানসিক নিয়োজনের নিত্যতা বর্ণিত করতে চেয়েছি, সে কুমুদিনী : তার সময়ের সম্পর্কের বদ্ধতার মধ্যে অসম্মানের অশান্তির মধ্যে স্বাতন্ত্রবোধের দুর্গতির মধ্যে তার জীবনকে লীলায়িত হতে দেখেছে আর নিজেকে এমন এক ধ্রুব স্বামীর কাছে, এমন এক নৈর্ব্যক্তিক স্বামীর কাছে সমর্পণ করতে চেয়েছে, যার ফলে বারবার ওই মধুসূদনের রুচি-প্রবৃত্তির নীচতায় তার মন বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে, এবং এই বিতৃষ্ণার বিষন্নতায় তার দাদা বিপ্রদাসের কাছে গিয়ে তার চিরদিনের আশ্রয় ও কর্তব্যের ক্ষেত্রকে খুঁজে নিতে গিয়েছে, আর এর সময়কালটি উপন্যাসের মূল গল্পের এমন এক পরিণতি নির্ধারন করেছে যা সামাজিক দিক থেকে বিপ্রদাসকে সম্পূর্ণ মুক্তির দিকে অগ্রসর করে দিয়েছে সেই সামাজিক অবস্থার প্রতি তার তীব্র অসম্মতি-ঘৃণা-শঙ্কা-ও-সাহসকে উন্মোচিত করে দিয়েছে — আর কুমুদিনী পেয়েছে তার চিরজীবনের সাংসারিক বিষাদকে শ্যামার সঙ্গে মধুসূদনের সম্পর্ক আর দাদা বিপ্রদাসের কথাবার্তায় বাঙালি সমাজে নারীদের বিরাজিত অসম্মানের প্রতি তীব্র ক্ষোভ-দুঃখ-ও-লজ্জার পরিচয়ে কুমুদিনী এক নিবিড় অবসাদের মাঝে তার নিয়তির ঘরে সংশয়হীন চিত্তে এক নিস্তাপ নিঃশঙ্ক বেদনার রাজ্যে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছে। সে সমাজে জন্মগ্রহন করে কুমুদিনীর এ চিরজীবনের বিষাদই সত্যতম রূপে রূপায়িত হল — অনাদৃত রুচির-শুচিতায়-মুগ্ধ প্রাণের সেইসব দিনের অমন মেয়েরা সমাজের এমনতরো নিস্তরঙ্গতায় ও নিষ্ঠুরতায় আবদ্ধ হয়ে পড়ত যা কোনো চরিত্রের আত্মজীবনীকে সম্ভবপর করে তুলতে পারেনি, কারণ এ সমাজটি ভদ্র মধুর রুচিবান সভ্য এ ধরনের মানুষের সাথে ভদ্রতা-না-জানা কঠোর তৎপর অন্যধরনের মানুষের সাথে বসবাস করেছে মাত্র—কিন্তু যে দ্বন্দ্ব-প্রবৃত্তি-প্রলোভন-ও-দর্শনের মাধ্যমে বাঁচার ফলে আত্মজীবনী সম্ভবপর হয়ে ওঠে তাকে আমরা বিংশ শতাব্দীর রচনাই বলব, সে ধরনের চরিত্রের সমাহারকেও আমরা বিংশ শতাব্দীর সৃষ্টি বলে অবহিত করব। তাই এ উপন্যাসটি পড়বার সময় আমি যে প্রশ্নটি আমার প্রবৃত্তির কাছ থেকে খুঁজে পেয়েছি তা হল এই : “কুমুদিনীর মতো একটি মেয়ে কী করে জীবনে সম্ভবপর?”—আর মূলত সে প্রশ্নের প্রতি আমার নিয়ত ঝোঁকের বশবর্তী হয়েই আমি ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটিকে উপায় হিসেবে নিয়ে আমার ধ্যানের প্রসঙ্গকে বিধৃত করতে চেয়েছি। আর রবীন্দ্রনাথের ও তার সময়-ও-সমাজের প্রতিও আমার সে দৃষ্টির বিশিষ্টতা কাজ করেছে “সত্যিই আমাদের জীবনের সাথে তার জীবনের মূল পার্থক্য কি দ্বন্দ্ব-প্রবৃত্তি-প্রলোভন-ও-দর্শনের মাধ্যমে আমাদের বাঁচবার অভীপ্সা থেকে?”
‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি আমার কাছে তাৎপর্যময় হয়ে রইল আমার বিচারপদ্ধতির প্রাথমিক অবস্থার কীর্তি বলে : এ উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে আমি দুটি ক্রমিক শতাব্দীর জীবনকে উপলব্দি করবার দিকে অগ্রসর হয়েছি — জীবনের সম্পর্কের সংসর্গে একটি দৃষ্টি-বিশিষ্টতার পর্যবেক্ষণ করেছি।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৫ comments
ইমতিয়ার - ২৫ আগস্ট ২০০৯ (১২:০৭ পূর্বাহ্ণ)
শুনেছি, রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল, যোগাযোগ-এর আরও একটি খণ্ড লেখার। বইটি পড়ার পর অনেকবার আমি চিন্তা করেছি, কী হতে পারত এর দ্বিতীয় খণ্ডের চেহারা? কোনও কূল পাইনি। এমন কোনও লেখাও চোখে পড়েনি, যাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দ্বিতীয় খণ্ডের কাহিনীর কোনও পূর্বাভাস বা নোট রেখে গেছেন… আমরাও কি চিন্তা করতে পেরেছি এতদিনে, কী হতে পারে তারপর কুমু, বিপ্রদাস কিংবা মধূসুদনের?
যোগাযোগ নিয়ে সুন্দর একটি ছোট বই পড়েছিলাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা, মুক্তধারা থেকে ছাপা হওয়া কুমুর বন্ধন। যোগাযোগকে নতুন করে উপলব্ধি করেছিলাম সেটি পড়ার পর।
Pingback: মুক্তাঙ্গন | চীনে অপমানিত রবীন্দ্রনাথ | মাসুদ করিম
Pingback: মুক্তাঙ্গন | রবীন্দ্রনাথ | মাসুদ করিম
Pingback: হন্যতে : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন ডায়েরি | মাসুদ করিম
মাসুদ করিম - ২৭ জুন ২০১৫ (১১:০০ পূর্বাহ্ণ)