[১. অনুবাদক ও রচয়িতার ভূমিকা, ২. প্রাক্কথন-এর সূচনাংশ, ৩. প্রাক্কথন-এর মধ্যাংশ, ৪. প্রাক্কথন-এর শেষাংশ, ৫. প্রথম অধ্যায়ের সূচনাংশ, ৬. প্রথম অধ্যায়ের শেষাংশ, ৭. দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনাংশ]
(পূর্বানুসৃতি)
২
শি ল্প শা শ্ব ত
মিশর, মেসোপোটেমিয়া, ক্রিট
[দ্বিতীয়াংশ]
এ-রকম একটি সাধারণ ছবির ক্ষেত্রে শিল্পীর পদ্ধতিটি সহজেই বুঝতে পারি আমরা। শিশুদের অনেক ছবিতে একইরকম নীতির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়, কিন্তু এসব পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে মিশরীয়রা শিশুদের চাইতে অনেক বেশি অবিচল। প্রতিটি জিনিসকে সেটার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কোণ থেকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। মানবদেহের প্রতিচ্ছবি তৈরির ক্ষেত্রে এ-ধারণাটি যে কী ফল বয়ে এনেছিল তা-ই দেখা যাচ্ছে চিত্র ৩৪-এ। মাথাটিকে পাশ থেকেই সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা গেছে, কাজেই সেটাকে পাশ থেকেই এঁকেছে তারা। কিন্তু চোখের কথা ভাবলেই সামনে থেকে দেখলে যেমন দেখা যায় সেরকমভাবে সেটার কথা ভাবি আমরা। কাজেই, মুখটির পার্শ্বদৃশ্যে বসিয়ে দেয়া হয়েছে একটি পূর্ণদৃশ্যমান চোখ। দেহের ওপরের অর্ধাংশ, দুই কাঁধ, আর বুক সামনে থেকেই সবচেয়ে ভাল দেখা যায়, কারণ বাহুদুটো কীভাবে দেহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে তখনই সেটা দেখতে পাই আমরা। তবে আন্দোলনরত বাহু আর পদযুগল পাশ থেকেই বেশি ভালো করে দেখা যায়। এসব মিশরীয়কে এতো অদ্ভুতরকমের সাদামাটা আর মোচড়-খাওয়া বলে মনে হওয়ার কারণ এটাই। তাছাড়া, চরণযুগলের একটিকেও বাইরে থেকে দেখা অবস্থায় কল্পনা করা বেশ কঠিন বলে মনে হয়েছিল মিশরীয় শিল্পীদের কাছে। বুড়ো আঙুল থেকে ওপরের দিকে উঠে যাওয়া পষ্ট আউটলাইনটাই তারা পছন্দ করত। কাজেই পায়ের পাতা দুটোকে আঁকা হয়েছে ভেতর থেকে সেগুলোকে যেমন দেখায় তেমন করে এবং রীলিফের লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে তার দুটো বাম পা। এটা কোনোমতেই ধরে নেয়া উচিত হবে না যে মিশরীয় শিল্পীরা মনে করত মানুষকে এরকমই দেখায়। তারা শুধু এরকম একটা নিয়ম অনুসরণ করত, যে-নিয়ম তাদেরকে মানবমূর্তির যে যে অংশ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল তার প্রত্যেকটিকে তাদের শিল্পকর্মের অন্তর্ভুক্ত করার এক্তিয়ার দিয়েছিল। আগেই যেমনটি বলেছিলাম, কঠোরভাবে এই নিয়মটি অনুসরণের সঙ্গে সম্ভবত তাদের জাদুবিষয়ক উদ্দেশ্যের একটি সম্পর্ক ছিল। কারণ ‘সমুখসংকুচিত’ বা ‘কর্তিত’ বাহু সম্বলিত একজন মানুষ কী করে মৃত মানুষটির কাছে প্রয়োজনীয় নৈবেদ্য নিয়ে আসবে বা তা গ্রহণ করবে?
একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে শিল্পী কী দেখতে পাচ্ছেন সেটার ওপর ভিত্তি করে নয় বরং একজন ব্যক্তির বা একটি দৃশ্যে কী রয়েছে বলে তার জানা আছে সেটার ওপর নির্ভর করেই মিশরীয় শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। যে-সমস্ত ফর্ম তিনি রপ্ত করেছেন এবং যেসব সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান রয়েছে সেগুলোর সাহায্যেই তিনি তাঁর কাজ সৃষ্টি করেছেন, অনেকটা সেই আদিম শিল্পীর মতো, যিনি সেইসব ফিগার তৈরি করেছিলেন যেগুলো আঁকা তিনি রপ্ত করেছিলেন। শিল্পী তাঁর ছবিতে কেবল আকার ও আকৃতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানই প্রকাশ করেন না, সেগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানও তিনি প্রকাশ করেন। কখনো কখনো কোনো মানুষকে আমরা ‘গুরু’ বলে আখ্যায়িত করি। গুরুকে মিশরীয়রা তাদের চাকর-বাকর বা এমনকী তাদের স্ত্রীর চাইতেও বড় করে আঁকতো।
এসব রীতি-নীতি আর প্রথা যখন আমরা বুঝে উঠতে পারি তখনই আমরা সেই সব ছবির ভাষাটিকেও বুঝে উঠতে পারি যার মধ্যে মিশরীয়দের জীবনযাত্রার ধারাবর্ণনা রয়েছে। খ্রিস্টের জন্মের ১৯০০ বছর আগের তথাকথিত ‘মধ্য রাজ্য’র একজন অতি উচ্চপদস্থ মিশরীয় কর্তাব্যক্তির সমাধির দেয়ালের সাধারণ বিন্যাস সম্পর্কে চিত্র ৩৫ একটি চমৎকার ধারণা দেয় আমাদেরকে। চিত্রলিপিতে উৎকীর্ণ লেখাগুলো আমাদের জানায় তিনি ঠিক কে ছিলেন এবং জীবদ্দশায় তিনি কী কী উপাধি এবং সম্মাননা লাভ করেছিলেন। আমরা পড়ি, তাঁর নাম ছিল খনুমহোতেপ, ছিলেন তিনি পূর্বাঞ্চলীয় মরুভূমির প্রশাসক, এবং মেনাত চুফুর রাজপুত্র, রাজার বিশ্বস্ত সুহৃদ, রাজপরিবার-বান্ধব, পুরোহিতদের তত্ত্বাবধায়ক, হোরাস-এর পুরোহিত, আনুবিসের পুরোহিত, যাবতীয় স্বর্গীয় গুপ্ত বিষয়ের প্রধান, এবং সবচেয়ে যেটা আকর্ষণীয়, যাবতীয় পোশাক-পরিচ্ছদের নিয়ন্ত্রক। বাঁয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক ধরনের বুমেরাং দিয়ে তিনি বুনো পাখি শিকারে ব্যস্ত, সঙ্গে তার স্ত্রী খেতি, তাঁর উপপত্নী জাট, আর তাঁর পুত্রদের মধ্যে একজন যে কিনা — ছবিতে তাকে এতো খুদে দেখালে কী হবে — ‘সীমান্তের তত্ত্বাবধায়ক’ এই উপাধির অধিকারী। নিচের ফ্রিয-এ ((উঁচু কোনো স্থানে করা নকশার দীর্ঘ, আনুভূমিক, আলংকারিক অংশ — অনুবাদক)) আমরা দেখতে পাচ্ছি জেলেরা তাদের তত্ত্বাবধায়ক মেনতুহোতেপ-এর নেতৃত্বে জাল দিয়ে বিশাল এক ঝাঁক মাছ টেনে তুলছে। দরজার একেবারে ওপরে, খনুমহোতেপকে দেখা যাচ্ছে আবার, এবার জলপক্ষী ধরছেন তিনি জালের ফাঁদ পেতে। মিশরীয় শিল্পীর পদ্ধতিগুলো আমাদের জানা থাকায় খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি কৌশলটা কীভাবে কাজে দিয়েছে। নলখাগড়ার একটা আড়ালের পেছনে লুকানো অবস্থায় বসে আছে শিকারী, তার হাতে একটা দড়ি, যেটা (ওপর থেকে দেখা) একটা খোলা জালের সঙ্গে যুক্ত। পাখিগুলো টোপের ওপর এসে বসতে সে দড়িটা টান দেয় আর অমনি জালটা বন্ধ হয়ে গিয়ে তাদের আটকে ফেলে। খনুমহোতেপ-এর পেছনে রয়েছে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নাখট্, আর তাঁর ধনদৌলতের তত্ত্বাবধায়ক; কবরের ফরমায়েশ দেবার দায়িত্বও ন্যস্ত তাঁর ওপর। ডানে, খনুমহোতেপ, যাঁকে বলা হয় ‘মৎস্যশিকারে তুখোড়, বুনোপাখিতে সমৃদ্ধ, মৃগয়াপ্রেমী’, বল্লম ছুঁড়ে মাছ মারছেন (চিত্র ৩৬)। আবারো লক্ষ করতে পারি আমরা মিশরীয় শিল্পীর প্রথাগুলো। তিনি পানিকে নলখাগড়ার ওপরে উঠে আসতে দিয়েছেন যাতে করে সেই পরিষ্কার পানির মধ্যে মাছগুলোকে দেখাতে পারেন তিনি আমাদের। উৎকীর্ণ লিপি বলছে, ‘প্যাপিরাসশয্যায়, বুনোপক্ষীর জলাশয়ে, জলাভূমি আর নদ-নদীতে ডিঙি নৌকা চালিয়ে দুই কাঁটাওয়ালা বল্লম ছুঁড়ে তিরিশটি মাছ বিদ্ধ করেছেন তিনি; জলহস্তী শিকারের দিনটি কতই না চমৎকার।’ নিচে দেখা যাচ্ছে একটা মজার ঘটনা। পানিতে পড়ে যাওয়া এক জেলেকে তার সঙ্গীরা মাছ ধরার মতো করে টেনে তুলছে, দরজার চারপাশের উৎকীর্ণ লিপিতে লিখিত রয়েছে কবে মৃতের উদ্দেশে নৈবেদ্য নিতে হবে সেসব দিনের কথা, তার সঙ্গে রয়েছে দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনাও।
এসব মিশরীয় ছবি দেখতে আমরা যখন অভ্যস্ত হয়ে পড়ব তখন সেগুলোর অবাস্তবতা দেখে আমরা কেবল ততটুকুই অস্বস্তি বোধ করব যতটুকু অস্বস্তি আমরা অনুভব করি কোনো আলোকচিত্রে রঙের অনুপস্থিতি দেখলে। এমনকী মিশরীয় পদ্ধতির চমৎকার সুবিধের দিকগুলোর কথাও উপলব্ধি করতে শুরু করব আমরা। এসব ছবির কোনো কিছুতেই কোনো বিশৃঙ্খলার পরিচয় পাওয়া যায় না, কোনো কিছু দেখেই এমনটি মনে হয় না যে তা অন্য জায়গাতেও থাকতে পারত। একটি পেন্সিল নিয়ে এসব ‘আদিম’ মিশরীয় ড্রইং-এর কোনো একটির অনুলিপি তৈরি করার চেষ্টা করলে মন্দ হয় না কিন্তু। আর যাই হোক সেটা পণ্ডশ্রম হবে না।
আমাদের প্রচেষ্টার ফল সবসময়ই তালগোলপাকানো, ভারসাম্যহীন আর তেড়াবাঁকা বলে মনে হয়। অন্তত আমার নিজেরগুলো তো বটেই। কারণ প্রতিটি খুঁটিনাটিতে মিশরীয় শৃঙ্খলাবোধ এতো শক্তিশালী যে ছোটখাটো একটা পরিবর্তনই পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলে সেটাকে। মিশরীয় শিল্পী তাঁর কাজ শুরু করেছেন দেয়ালের গায়ে একসারি সরল রেখা এঁকে, এবং তাঁর ফিগারগুলেকে তিনি সাধারণ এসব রেখা বরাবর বিন্যস্ত করে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও এই পুরো জ্যামিতিক শৃঙ্খলাবোধটি প্রকৃতির নানান খুঁটিনাটি আশ্চর্যরকমের সঠিকভাবে লক্ষ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রতিটি পাখি বা মাছ এমন বিশ্বস্ততার সঙ্গে আঁকা হয়েছে যে এখনো প্রজাতিগুলোকে চিনে নিতে জীববিজ্ঞানীদের অসুবিধে হয় না। চিত্র ৩৫-এর এরকমই একটি ডিটেইল দেখা যাচ্ছে চিত্র ৩৭-এ — খনুমহোতেপ-এর পাখি ধরার জালের পাশের গাছের পাখিদের দেখা যাচ্ছে ছবিটিতে। আমরা উপলব্ধি করি, শিল্পীকে যে কেবল তাঁর অগাধ জ্ঞানই পরিচালিত করেছে তা নয়, সেই সঙ্গে নকশার ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টির তীক্ষ্ণতাও পথ দেখিয়েছে তাঁকে।
মিশরীয় শিল্পের মহত্তম বিষয়গুলোর একটি এই যে, সব মূর্তি, চিত্রকর্ম, এবং স্থাপত্য বিষয়ক ফর্ম একই পারস্পরিক সূত্রে গাঁথা, যেন সেগুলো সব একটি বিধি অনুসরণ করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ-ধরনের বিধিকে — কোনো জাতির সমস্ত সৃষ্টিকর্ম যে-বিধি মেনে চলে বলে মনে হয় — আমরা বলি শৈলী (স্টাইল)। শৈলী কিসে তৈরি হয় সেটা ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন, তবে তা দেখা অনেক কম দুরূহ। যেসব নিয়মনীতি মেনে সমস্ত মিশরীয় শিল্প তৈরি হয়েছে সেগুলো প্রতিটি স্বতন্ত্র কাজকে ভারসাম্য এবং অনাড়ম্বর সুসঙ্গতিপূর্ণ একটি পরিণতি দান করেছে।
মিশরীয় শৈলী তৈরি হয়েছে অত্যন্ত কঠোর একগুচ্ছ বিধির সাহায্যে, এবং প্রত্যেক শিল্পীকে একেবারে নবীন বয়স থেকেই শিখতে হতো সেগুলো। বসে থাকা মূর্তিগুলোর হাত দুটোকে রাখতে হতো হাঁটুর ওপর, পুরুষদের আঁকতে হতো নারীদের চেয়ে ধূসর গাত্রচর্মবিশিষ্ট ক’রে; প্রতিটি মিশরীয় দেবতার চেহারা কেমন হবে তা লেখা থাকত অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে : সূর্যদেবতা হোরেসকে দেখাতে হতো বাজপাখি হিসেবে বা বাজপাখির মাথাসহ, মৃত্যুর দেবতা আনুবিসকে খেঁকশেয়াল হিসেবে বা খেঁকশেয়ালের মাথাসহ (চিত্র ৩৮)। সেই সঙ্গে প্রত্যেক শিল্পীকে শিখতেই হতো চমৎকার হাতের লেখা রপ্ত করার কলাকৌশল। পাথরের গায়ে চিত্রলিপির প্রতিচ্ছবি এবং প্রতীকগুলোকে স্পষ্ট করে এবং সঠিকভাবে উৎকীর্ণ করতে হতো তাঁকে। এসব রীতিনীতি শেখা হয়ে গেলে তবেই শেষ হতো তাঁর শিক্ষানবিসী। কেউই ভিন্ন কিছু চাইতো না, কেউই তাঁকে মৌলিক হতে বলতো না। বরং যিনি তাঁর মূর্তিগুলোকে যত বেশি অতীতের নন্দিত এবং প্রিয় মূর্তিগুলোর মতো করে গড়তে পারতেন তাঁকেই সম্ভবত গণ্য করা হতো সেরা শিল্পী হিসেবে। কাজেই তিন হাজার বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় পরেও মিশরীয় শিল্প খুব সামান্যই বদলেছে। পিরামিডের কালে যা ভাল এবং সুন্দর বলে বিবেচিত ছিল তার সবই এক হাজার বছর পরেও ঠিক একই রকম অত্যুৎকৃষ্ট বলে গণ্য হতো। একথা সত্যি যে নতুন নতুন ফ্যাশনের আবির্ভাব ঘটেছে, শিল্পীদের কাছ থেকে নতুন নতুন বিষয় বস্তুর বায়না এসেছে, কিন্তু মানুষ এবং প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলার পদ্ধতি তাঁদের মূলত রয়ে গেছে একই।
(ক্রমশ)
জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।