বেসরকারি খবর অনুযায়ী এই পোস্টটি লেখার সময় পর্যন্ত মহাজোট ২১২ ও চার-দল ২৪ টি আসন পেয়েছে। খবরটি দেখে হাঁফ ছাড়ার সাথে সাথে মনে জেগে উঠেছে হাজার প্রশ্ন। সারাদিন অনেককেই ভোট কেন্দ্র থেকে চোখে মুখে এক করুণ অসহায় ভাব নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছি। যখন তাদের কাছে জানতে চাইলাম কাকে ভোট দিয়েছেন, সকলেই করুন হেসে এক শব্দে জবাব দিল ‘নৌকা’। মনে মনে তাদের অনুভূতি বুঝি আর চুপ করে থাকি। এতদিন যারা অধীর আগ্রহে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন স্বৈরাচার আর যুদ্ধাপরাধীর মধ্য থেকে একটাকে বেছে নিতে বলায় তাদের বিমর্ষ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আজকের ফলাফলই প্রমাণ করে মহাজ়োট তৈরীর নামে মৌলবাদ ও স্বৈরাচারকে দলে টানা কতটাই না অপ্রয়োজনীয় ছিল। “লাঙল আর নৌকায় এখন আর কোন ভেদাভেদ নেই” এই কথা এরশাদ যখন তার নির্বাচনি প্রচারণায় বুক ফুলিয়ে বলার সুযোগ পায়, তখন মনে হয় আসলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শরীর থেকে শেষ আদর্শের সুতাটুকুও ঝেড়ে ফেলে এক উলঙ্গ উল্লাসে মেতে উঠেছে। খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্য দেহ পসারিণীরা যেভাবে নিজেদের অনাবৃত করে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেভাবে তাদের শরীরে কাপড়ের পরিমাণ কমতে থাকে ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগের মত একটা বড় পুরোনো দলের জন্যেও এই একবিংশ শতাব্দিতে আদর্শ যেন একটা বাহুল্যে পরিণত হয়েছে। নিজের গাঁটের পয়সা(?) খরচ করে যারা দেশ সেবার(?) ব্রত নিয়েছেন ক্ষমতার লিপ্সায় তারা যেন সব কিছুই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। তাও আবার দেশ আর দশের কল্যাণের নামে। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে সংসদে থেকে কি দেশ সেবার কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই? অবশ্য এ কথাও ঠিক যে ত্যাগী বলে যারা নিজেদের পরিচয় দেন আদর্শ ত্যাগে তাদের অপরাধটাই বা কোথায় !
যারা এতদিন এসব পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গেয়ে গাদা গাদা রাজনৈতিক যুক্তি দেখিয়ে lesser of two evils এর ইংরেজী তত্ত্বটার সাথে সাথে নানাবিধ রাজ-অনৈতিক কৌশল আমার এই দূর্বল মস্তিষ্কে ঢোকানোর চেষ্টা করেছেন হয়ত তাদের অনেকেই এখন বিজয় উৎসবে এতটাই মগ্ন যে কি পেলাম আর কি হারালাম সেই লাভ ক্ষতির হিসেব করার অবকাশই পাচ্ছেন না। ঘর ফিরতি ভোটারদের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে অবশেষে আমার সেই ইংরেজী তত্ত্বটা বোধগম্য হল, তবে তারা যে অর্থে শেখাতে চেয়েছিলেন সেই অর্থে নয়।
বাংলার বিপুল জনগোষ্ঠী কিন্তু বহু আগেই এই তত্ত্বটি ঠেকে শিখেছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ দিকে প্রশাসনের দলীয়করণ, দুর্নীতি আর অরাজকতার যে অঙ্কুরোদগম হয়েছিল তার জবাবে ২০০১ সালে জনগণ এই তত্ত্বের আশ্রয় নিয়ে জোট সরকারকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী করেছিল, আবার সেই জনগণই এবার মহাজোটকে জয়ী করলো বিএনপির শাসনামলে সেই একই কারণের বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রতিবার নির্বাচনেই কি এই অভাগা জাতির সেই একই তত্ত্বের শরণাপন্ন হতে হবে? আর প্রতিবারই কি এর কারণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে? এই চক্রের শেষ কোথায়? কিভাবে?
আওয়ামী লীগের এই নিরঙ্কুশ বিজয় সংসদে তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছে। এমনকি সংবিধান পরিবর্তন করতেও তাদের কারো তোয়াক্কা করার প্রয়োজন নেই। এমতাবস্থায় মহাজোটের অন্যান্য অংশীদারদের কদর আওয়ামী লীগের কাছে ধীরে ধীরে কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়ত আগামী নির্বাচন বা তারো আগে এই সব অংশীদারদের অনেককেই আমরা বিএনপির সাথে জোট বাঁধতে দেখবো। সেরকম অবস্থার সৃষ্টি হলে আমরা এরশাদকেই দেখব সবার আগে ভোল পাল্টাতে, কেননা গাছেরটা খাওয়া আর তলারটা কুড়োনোতে তার জুড়ি মেলা ভার। তাহলে বলতে হয় পরিস্থিতি যাই দাঁড়াক না কেন তা এরশাদের অনুকূলেই যাবে। আর যদি আওয়ামী লীগ তার অঙ্গীকার (?) রক্ষা করে, সে তো হবে আরো ভয়ানক, আমরা পূনরায় এক স্বৈরাচারী, বিশ্ব লম্পটকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে পাব।
লেখাটা কেমন জানি নৈরাশ্যবাদীদের মত হয়ে গেল। কিন্ত কি করবো বলুন, সময়টাই যে এমন। অঙ্গীকারের প্রতিফলন স্বরূপ যদি দেখতাম আওয়ামী লীগের মধ্যে দলীয় সংস্কার বা দলীয় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়েছে তাহলে নির্বাচনের এই ফলাফলে আশার আলো খুঁজে পেতাম। কিন্তু প্রার্থী মনোনয়নে আভ্যন্তরীণ বিপুল বিরোধিতা সত্বেও যে স্বেচ্ছাচারীতার আভাস মেলে তাতে আশাবাদী হওয়া মুশকিল। আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে নির্বাচনের পরে জয়ী প্রার্থীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অতীত কর্মকান্ড বিচার/বিবেচনা করে মনে হতে পারে যে এদের অধিকাংশের কাছ থেকেই কোনো ব্যাপারে মতামত না নেয়াই শ্রেয়।
আসুন আমরা সবাই একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি আর প্রার্থনা করি আওয়ামী লীগ এবার যে সুবর্ণ সুযোগ হাতে পেয়েছে গণতন্ত্র তথা দেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার হাতিয়ার হিসেবেই তা যেন তারা সদ্ব্যবহার করে।
