একাত্তরের সেই বিশাল বিপুল মুক্তিযুদ্ধ। সে কেয়ামতের এক প্রায়-অজানা দিক আছে। মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমণে ছিন্নভিন্ন বাংলা, রক্তে আর্তনাদে ভেসে যাচ্ছে দেশ। বহু মাইল স্রেফ পায়ে হেঁটে সীমানা পেরোচ্ছে আতংকিত গ্রামবাসীরা বুড়ো বাবা-মা’কে নিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে। গ্রামবাংলার ধুলিধুসরিত পথে হাতে মাথায় ঘটি-বাটি নিয়ে গরু-ছাগলের রশি ধরে হাজার হাজার পথযাত্রীর ভীড়ে রাস্তায় বৃদ্ধার মৃত্যু রাস্তায় জন্মানো বাচ্চা। কে বিশ্বাস করবে সেই দাবানলের মধ্যে একাত্তরের এপ্রিলে রাজশাহীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শরণার্থী শিবিরে এক কাপড়ে উপস্থিত এক পাঞ্জাবী তরুণ! চারদিকে তুমুল হৈ হৈ, ছুটে এসেছে ভারতীয় সৈন্যেরা। কি? না, আমার বাড়ী লাহোর কিন্তু আমি শরণার্থী, আমাকে খেতে দাও থাকতে দাও। ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলছে সে। ততক্ষণে চোখ কপালে উঠে মুখ হা’ হয়ে গেছে ভারতীয় সেনাধ্যক্ষের, - পড়িমরি করে টেলিফোন ছুটল মুর্শিদাবাদ থেকে কোলকাতা - কোলকাতা থেকে একেবারে দিল্লীর প্রতিরক্ষা দপ্তরে। পাকিস্তানী পাঞ্জাবী এসেছে উদ্বাস্তু শরণার্থী হয়ে, একে নিয়ে এখন কি করি? ‘‘তারপরে কেটে গেছে কত শত কাল, তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল’’। সাঁইত্রিশ বছর আগে ঘটনার ঘনঘটায় উন্মত্ত জীবন আজ গল্প হয়ে গেছে। বয়সের সব ঝড় বোধহয় এভাবেই থেমে যায় একদিন। ১৯৬৭ সাল। কাঁচা সোনা রঙ্গের কটা বেড়াল-চোখ সুঠাম সুদর্শন তরুণ আনোয়ার শাহিদ খান। যেন বলিউডের নায়ক ভুল করে ইÏটারউইং স্কলারশীপ নিয়ে লাহোর থেকে ফিজিক্স-এ অনার্স পড়তে এসেছে। কাব্যময় সংবেদনশীল মন, শের শায়েরী আর গজলের আধার। থাকত ফজলুল হক হলে। আমিও থাকি সেখানেই। কি করে যেন বন্ধুত্ব হল নিবিড়, নিবিড় থেকে নিবিড়তর। খেয়াল করতাম অনুসন্ধিৎসু চোখে সে নিরীক্ষণ করছে আমাদের ওপরে পশ্চিমের নিপীড়ন আর শোষণ। কাছে থেকে থেকে দেখে দেখে আনোয়ার বুঝতে পারছে কেন ওদের এত উন্নতি আর আমাদের এত অবনতি, কেন আমাদের ছয় দফা। তার শের-শায়েরীর কাব্যিক মন ঠিকই ধরেছে ইসলামের নামে পাকিস্তানী রাজনীতির বিভৎস ঠকবাজী। স্বচক্ষে সে দেখল পঁচিশে মার্চে হঠাৎ নিরস্ত্র জনতার ওপরে সামরিক বাহিনীর অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষন গণহত্যা গণধর্ষন, সময়ের জঠরে তখন জন্ম-যন্ত্রণায় নড়ে উঠছে পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বাস্য ভ্রূণ। বাজপাখীর আক্রমণে মুরগীর বাচ্চার মতন ছিটকে উঠে শহর ছুটল গ্রাম-জননীর সুবিশাল আশ্রয়ে, জননীও আগ্রহী হাত বাড়িয়ে কোটি সন্তানকে তুলে নিল তার সস্নেহ কোলে। কিন্তু আনোয়ার যাবে কোথায়?…
মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমণে ছিন্নভিন্ন বাংলা, রক্তে আর্তনাদে ভেসে যাচ্ছে দেশ। বহু মাইল স্রেফ পায়ে হেঁটে সীমানা পেরোচ্ছে আতংকিত গ্রামবাসীরা বুড়ো বাবা-মা’কে নিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে। গ্রামবাংলার ধুলিধুসরিত পথে হাতে মাথায় ঘটি-বাটি নিয়ে গরু-ছাগলের রশি ধরে হাজার হাজার পথযাত্রীর ভীড়ে রাস্তায় বৃদ্ধার মৃত্যু রাস্তায় জন্মানো বাচ্চা। কে বিশ্বাস করবে সেই দাবানলের মধ্যে একাত্তরের এপ্রিলে রাজশাহীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শরণার্থী শিবিরে এক কাপড়ে উপস্থিত এক পাঞ্জাবী তরুণ! চারদিকে তুমুল হৈ হৈ, ছুটে এসেছে ভারতীয় সৈন্যেরা। কি? না, আমার বাড়ী লাহোর কিন্তু আমি শরণার্থী, আমাকে খেতে দাও থাকতে দাও। ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলছে সে। ততক্ষণে চোখ কপালে উঠে মুখ হা’ হয়ে গেছে ভারতীয় সেনাধ্যক্ষের [...]