‘সেই লেখা লেখা নয় নাহি যার রস।’ কবি ঈশ্বর গুপ্তের এই রায়কে মান্য করলে আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে, রস সৃষ্টিই সাহিত্যের অভীষ্ট লক্ষ্য। তাহলে প্রশ্ন আসে রস কী ? টস টস করে ঝরে পড়ার মতো কোন নিঃসৃত তরল পদার্থ যে নয় তা তো আমরা বুঝতেই পারছি। এ হচ্ছে সাহিত্যের রস। আর কাব্য বিচারে এলে কাব্যরস। তবে রস প্রসঙ্গে জানতে হলে আমাদেরকে তো রসশাস্ত্রে ঢু মারতেই হয় ! প্রাচ্য-অলঙ্কার শাস্ত্রে রস একটি পারিভাষিক শব্দ। যার ধাতুগত মূল অর্থ হচ্ছে আস্বাদন করা। কাব্যতত্ত্বের প্রধান পুরুষ আচার্য ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে নাকি ঘোষণা করেছেন এই বলে যে, “-নহি রসাদ ঋতে কশ্চিদর্থঃ প্রবর্ততে।” (নাট্যশাস্ত্র, -৬/৩৪) অর্থাৎ রস ব্যতিরেকে কোন বিষয়েরই প্রবর্তনা (সূচনা) হয় না। রসের এই সর্বব্যাপী-সর্বগ্রাহী স্বরূপ উপলব্ধি করেই রসের সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ে আত্ম-জিজ্ঞাসায় প্রশ্ন রাখেন- “অত্রাহ, রস ইতি কঃ পদার্থ ?” অর্থাৎ রস কোন পদার্থকে বলে ? উত্তর-অন্বেষার সারাৎসার- “আস্বাদ্যত্বাৎ” (নাট্যশাস্ত্র, -৬/৩৫), যা আস্বাদিত হয়। রসবাদী হিসেবে আরেক খ্যাতিমান চতুর্দশ শতাব্দের বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর ‘সাহিত্য দর্পণ’ গ্রন্থে ভরত-এর কথারই প্রতিধ্বনিত করলেন- রস্যতে ইতি রসঃ। (সাহিত্য দর্পণ, -১/৩) অর্থাৎ যা রসিত বা আস্বাদিত হয়, তা-ই রস। এবং রসের ব্যাপ্তি প্রকাশ করলেন এভাবে- “সর্বোহপি রসনাদ্ রসঃ” (সাহিত্য দর্পণ, -৩/৪২) অর্থাৎ রসন বা আস্বাদন হেতু সবই রস। হাঃ হাঃ, তাহলে তো আস্বাদন হেতু তালের রস আর কাব্যরসে কোন তফাৎ দেখি না ! তফাৎ হয়তো এটাই যে তালের রসের আস্বাদন করতে হলে গাছ বেয়ে আগায় চড়তে হবে। আর কাব্যরসের আস্বাদ পেতে হলে ডুব দেবার নিমিত্তে কাব্যহ্রদে ঝাঁপ দিতে হবে। বিষয়টা যেহেতু কাব্যকেন্দ্রিক, তাই যাঁরা কাব্যসাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, লেখালেখি করেন কিংবা এ থেকে রস আস্বাদনে আগ্রহী বা রসসৃষ্টির সম্ভাব্য নেশায় বুঁদ হতে আকাঙ্ক্ষি, তাঁদের জন্য ওইদিকে ঝাঁপ দেয়া ছাড়া আপাত কোন গতিক দেখছি না। এক্ষেত্রে সাহিত্যের মহাফেজখানায় খুঁজে খুঁজে হয়রান না হয়ে আপাতত যে দুটো অবশ্যপাঠ্য বইকে সঙ্গি করে নিলে পথ খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না, তা হচ্ছে নরেন বিশ্বাসের ‘কাব্যতত্ত্ব-অন্বেষা’ এবং ‘অলঙ্কার অন্বেষা’। এ নিবন্ধে এই বিষয়ক অর্থাৎ প্রাচ্য-অলঙ্কার শাস্ত্র তথা কাব্যতত্ত্ব সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য ও বাচন-বর্ণনার জন্য আমি শ্রদ্ধেয় নরেন বিশ্বাসের কাছে…