অণুগল্পের অধীশ্বর বনফুলের (১৮৯৯—১৯৭৯) এই সাক্ষাৎকার ছাপা হয় ১৯৭১ সালে, কলকাতার ‘প্রসাদ সিংহ পরিকল্পিত’ ও মনোজ দত্ত-সম্পাদিত চলচ্চিত্রপত্রিকা উল্টোরথ-এর পৌষ সংখ্যায় [...]

অণুগল্পের অধীশ্বর বনফুলের (১৮৯৯―১৯৭৯) এই সাক্ষাৎকার ছাপা হয় ১৯৭১ সালে, কলকাতার ‘প্রসাদ সিংহ পরিকল্পিত’ ও মনোজ দত্ত-সম্পাদিত চলচ্চিত্রপত্রিকা উল্টোরথ-এর পৌষ সংখ্যায় (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১০, ১৮৯৩ শকাব্দ, পৃ. ১৮৭―১৯০)। অমিতাভ বসুর সঙ্গে বনফুলের এই নাতিদীর্ঘ কথোপকথনে মূর্ত হয়ে উঠেছে বনফুলের দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি যা হয়তো লেখকের মনোজগৎকেও উন্মোচিত করে অনেকখানি। তাঁর প্রয়াণদিবসে (৯ ফেব্রুয়ারি) শ্রদ্ধা জানিয়ে সাক্ষাৎকারটি তুলে রাখলাম এখানে, বনফুল-প্রিয় পাঠকদের জন্য।   দৈনন্দিন জীবনে সাহিত্যিক বনফুল   বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা ছোটগল্পে একক বৈশিষ্ট্যে একটি উজ্জ্বল নাম বনফুল বা শ্রী বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। অবশ্য উপন্যাসেও বনফুলের দক্ষতা সে রীতিমত বিরাট। এখানে তিনি অভিজ্ঞতাবাদী, রীতিবাদী। তাঁর অগ্নি, নির্মোক, জঙ্গম, ডানা বা স্থাবর উপন্যাস অন্তত যারা পড়েছেন তারা অকপটে একথা স্বীকার করবেন যে উপন্যাসের চরিত্রচিত্রণের সঙ্গে তার ধারাবাহিকতা রক্ষায় বনফুল এক সার্থক শিল্পী। আর ছোটগল্পে তাঁর জীবনদর্শন এবং একটি চমৎকার চমক প্রতিটি গল্পের শেষে পাঠককে কিছুক্ষণের জন্যে এক মোহের রাজ্যে ঠেলে দেয়। আর তার সঙ্গে বহু গল্পের অবয়বগত সংক্ষিপ্ততা, ভাব, উদ্দেশ্যের ঐক্য―বহু বিদেশী ছোটগল্পের রচনাকারকেও কোন কোন ক্ষেত্রে টেককা দিয়ে যায়। কোন কোন ছোটগল্পে ও হেনরি বা শেখভের রচনাশৈলীর একটা ছাপ বনফুলে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু আশ্চর্য। মহৎ শিল্পীদের চিন্তাধারা হয়ত কখনও এক হয়। নয়ত যখন তিনি ও হেনরি বা শেখভ পড়েন নি―তখন থেকেই তাঁর ছোটগল্পে এই লেখকদের শিল্পকর্মের স্বাধর্ম লক্ষ্য করা গিয়েছে। এবং রবীন্দ্রনাথ একদা বনফুলকে―ও হেনরি, শেখভ এবং মোঁপাশা পড়বার পরামর্শ দেন। তা বলে বনফুলের আধুনিক ছোটগল্প কোন ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্ত্য আদর্শানুযায়ী ধরা-বাঁধা নিয়মে আবদ্ধ নয়। ক্ষুদ্রতম পরিসরে অভূততম ভাবনা পরিবেশনের বৈশিষ্ট্যে বনফুল ছোটগল্পের রাজা। চন্দ্রায়নের শেষ বজ্রাঘাত বা নিমগাছের শেষবাক্য প্রমাণ করে বনফুল ছোটগল্পে জীবনের ভাষ্যকার। বনফুল একজন বিরাট কবি। এবং জীবনীভিত্তিক নাটক রচনায় তিনি পথিকৃৎ। রবীন্দ্রোত্তর যুগের এই বিরাট শিল্পীর মুখোমুখি বসে সেদিন দৈনন্দিন জীবন-পর্যায় এক সাক্ষাৎকার করলাম। এবং এই সাক্ষাৎকারে আমার প্রশ্নের ভিত্তিতে বনফুলের উত্তরগুলো সাজিয়ে দিলাম। এর মধ্য দিয়ে পাঠক বনফুলকে অনেক সহজভাবে অনেক বেশি জানতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। এই সাক্ষাৎকারে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, সকালে আপনি কখন ওঠেন? উত্তরে বললেন, সকালে ওঠার কোন ঠিক নেই। সাধারণত ছটা থেকে আটটার মধ্যে উঠি। আগের দিন…

শিবরাম চক্রবর্তীর (১৯০৩–১৯৮০) এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অমিতাভ বসু, কলকাতার ‘উল্টোরথ’ পত্রিকার জন্য। লেখকের প্রয়াণদিবস (২৮ আগস্ট) উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। [...]

উল্টোরথ পত্রিকার একটি নিয়মিত বিভাগ ছিল অমিতাভ বসুর ‘দৈনন্দিন জীবনে’; প্রতি সংখ্যায় একজন সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিয়ে সাজানো হতো এই বিভাগ। প্রশ্নগুলো পরিকল্পিত বা ছকবাঁধা থাকলেও উত্তরগুলো উপভোগ্য হয়ে উঠত ব্যক্তিবৈচিত্র্যের কারণেই। ১৮৯৩ শকাব্দের মাঘ সংখ্যায় (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১১, জানুয়ারি, ১৯৭২) ছাপা হয় শিবরাম চক্রবর্তীর (১৯০৩–১৯৮০) সাক্ষাৎকার। অল্প কথার উত্তরেও চাপা থাকেনি সুরসিক শিবরামের আত্মপরিহাসপ্রিয়তা, যাঁর আহারনিদ্রার ধরনও পাঁচজন লেখকের চেয়ে আলাদা : রিকসাওয়ালা যেমন রিক্সা না টানলে খেতে পাবে না, আমারও প্রায় সেই দশা। লেখকদের ভেতর আমি এক মজুর, মেহনতি মানুষদের একজন। মোট নামিয়ে পয়সা কুড়নো, মোটের উপর আমার উপায়, মোটামোটি বলতে গেলে। লিখি আমি পরের দিন, কেননা আমি ভালই জানি, পরের দিন কোন লেখাই আমার টিকবে না। লেখকের প্রয়াণদিবস (২৮ আগস্ট) উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। শুনুন হর্ষবর্ধন-স্রষ্টা শিবরামের ‘অশ্বভাবিক’ কথাবার্তা। দৈনন্দিন জীবনে সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী সেটা ছিল অঙ্কের ক্লাস। আর এই অঙ্ক সাবজেক্টটা আমার কোনদিনই ভাল লাগতো না―সেই ছোটবেলা থেকে। তাই অঙ্কের ক্লাস এলেই আমি আমার ক্লেশ দূর করতে অন্য কিছুতে মনোনিবেশের চেষ্টা করতাম। আর সেদিনও সেই অঙ্কের ক্লাসেই সোজা ব্যাক-বেঞ্চে আত্মগোপন করে কিছু করছিলাম। আমার সামনের লম্বা ছেলেটা কখন যেন উঠে গিয়েছিল। তাতে পরিষ্কার আমি মাস্টারমশয়ের নজরে পড়ে গেলাম। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন―ইউ বয়। আমি চমকে সোজা দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম―‘ইয়েস স্যার।’ মাস্টারমশয় তেমনি রাগত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন―‘হাতে কি?’ বললাম―‘মালাই বরফ স্যার।’ আমার কথা শুনে তিনি আরো চটে গেলেন―রসিকতা হচ্ছে? হাতে দেখছি একটা বই আর বলছো কিনা মালাই বরফ। মিথ্যে কথা বলা! এদিকে এস। সোজা চলে এলাম। মাস্টারমশয় আমার হাত থেকে বইখানা সজোরে টেনে নিলেন। আর দেখলেন সত্যিই মালাই বরফ। বইখানার নাম। এবারে হয়তো তিনি একটু অপ্রস্তুত হলেন। কারণ দেখলেন আমি মিথ্যে কিছু বলিনি। অন্যদিক দিয়ে তাই আক্রমণ করলেন―ক্লাসে বসে গল্পের বই পড়া! যাও, পেছনে গিয়ে ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাক। আমি চলে এলাম। তিনি বইখানা রেখে দিলেন। অবশ্য সেদিন আমাকে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয়নি। একটু বাদেই মাস্টারমশয় বললেন―‘বোস। বসে ক্লাসের কাজ কর।’ তাহলে মালাই বরফেই বুঝি মাস্টারমশয় গলে গিয়েছিলেন। কারণ, দেখেছিলাম তিনি নিজেই তখন বইটার অনেকটা পড়ে ফেলেছেন। আর এই হল আমার শিবরাম-পাঠের প্রথম অভিজ্ঞতা।…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.