আমার ছয় বছর বয়েসী মেয়ে পড়ে ১ম শ্রেণীতে। দেশের গানগুলো কেন যেন তার কাছে খুব প্রিয়। প্রায়ই তার অনুরোধে আমাকে জাতীয় সংগীত গেয়ে শোনাতে হয়। তার সঙ্গে অন্যান্য দেশের গান আর রবীন্দ্র সংগীত। আজ ২৬শে মার্চ ২০১৩। দেশের গানে ঘুম ভেঙেছে আমাদের। বিছানা ছেড়ে, শোলায় বানানো শহীদ মিনারটায় দুটো গোলাপ রেখে শহীদের জন্য প্রার্থনা করলাম আমরা দু’জন। তারপর দু’জনে মিলে একে একে গাইলাম অনেকগুলো গান। গান গেয়ে মন ভরছিল না, ভাবলাম মেয়েকে গল্প বলি। যুদ্ধের গল্প, স্বাধীনতার গল্প। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব ? ব্রিটিশ শাসনের শুরু ? নাহ্, তার আগের পটভূমি থেকে শুরু করাই বোধ হয় ভাল হবে। তৎকালীন রাষ্ট্র আর তার শাসন ব্যবস্থা, শাসকদের ভূমিকা, প্রজা, অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে রাজা-প্রজার সম্পর্ক, দেশের সম্পদ, ব্যবসা বাণিজ্য আরো কত কী! তারপর আসবে ব্রিটিশ আগ্রাসন। নাহ্, মাথাটা গুলিয়ে উঠল একেবারে। “ফকির মজনু শাহ্” ছবিটা নেট থেকে নামানোর ফরমায়েশ করলাম ছোটকে। আমি “ফকির মজনু শাহ্” দেখেছিলাম – যখন ১ম শ্রেণীতে পড়ি। ঢাকায় বিমান বাহিনীর শাহীন সিনেমা হলে। শৈশবের পড়ন্ত বেলাগুলো মায়ের কোলে শুয়ে ‘সোভিয়েত নারী’ পত্রিকার শিশু পাতার গল্প শুনে কাটিয়েছি। এই চালশে বয়েসে এসে যখন ভাবি তখন উপলব্ধি করি, ন্যায়-অন্যায় বোধ আর ভালো-মন্দ বিচারের যে-ক্ষমতা আমার ভেতর ‘কিশলয়’ থেকে ‘মহীরূহ’ হয়ে উঠেছে, তার পেছনে বড় একটা অবদান ঐ গল্পগুলোর। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বইপত্র পড়বার প্রত্যয়টা ঐ পথেই শুরু হয়েছিল। আজ হঠাৎ করেই যেন আমাদের দেশের শিশুতোষ পত্রিকা আর বইপত্রগুলোর ভোল্ পালটে গেল! শওকত ওসমান, আবদার রশীদ, আলী ইমাম – এঁদের লেখা শিশুতোষ গল্পগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। রুশ-বাংলা বইপত্রগুলো ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে আশির দশকেই। মাধ্যমিক ক্লাসে বাংলা পড়াতেন রিফাত আরা ম্যাডাম আর আখতার জাহান ম্যাডাম। শীত, গ্রীষ্ম আর উৎসবের ছুটিতে যখন স্কুল বন্ধের নোটিশ আসত ক্লাসে – একই সঙ্গে আমাদের এই দুই শিক্ষিকা নোটিশ করতেন – বন্ধে যেন কিছু প্রবন্ধ আর সাহিত্য পড়া হয়। ছুটি শেষে ক্লাস শুরু হলে, খোঁজ নিতেন – কী পড়েছি। আজকাল শুনছি স্কুল শিক্ষকেরা কেবল ‘এ+’ এর খোঁজ খবরই নেন। চকোলেট কারখানার চকোলেটের মতো তাঁরা ‘এ+’ পাওয়া মেধাবী ছাত্রছাত্রী উৎপাদন করেন মাত্র, মেধা বিকাশের খোঁজখবর রাখার সময় কোথায়!…
মেয়েকে ইতিহাসের গল্প শোনাতে গিয়ে যখন হোঁচট খাচ্ছিলাম তখন কেবলই ভাবছিলাম -- গল্পটা একটা নতুন প্রজন্মের জন্য কতটা জরুরি। এই কম্পিউটার ডিজিটাইজেশনের যুগে ইতিহাসকে কত সহজে আর কত দ্রুতই-না ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। [...]