প্রথম পর্ব / পূর্ব প্রকাশিতের পর . . .
৫.
অনেকের মতে বিষ্ণুগুপ্ত, চানক্য, কৌটিল্য একই ব্যক্তি। এমনকি কেউ কেউ বলেন কৌটিল্যই বাৎসায়ন। তা যাহোক, এ ব্যাপারে প্রমাণ হাজির করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বাৎসায়ন রচিত কামশাস্ত্র বা কামসূত্র গ্রন্থের বৈশিকাখ্যং অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘রুচি হইতে যে পুরুষগ্রহণপ্রবৃত্তি তা স্বাভাবিক আর অর্থার্জনার্থ যে প্রবৃত্তি তা কৃত্রিম।’ ((বাৎসায়ন-প্রণীত কামসূত্র, পঞ্চানন তর্করত্ন ও মানবেন্দু বন্দোপাধ্যায়, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা, পরিবর্দ্ধিত সংস্করণ, ১৩৯৮)) বাৎসায়ন বর্ণিত অর্থার্জনার্থ এই কৃত্রিম প্রবৃত্তিই নিন্দার্হ। এ প্রবৃত্তিই বর্তমান বিশ্বে এক নম্বরের বাণিজ্যবিষয়, অনেক দেশের রাজকোষের অর্থের এ প্রবৃত্তিই প্রধান উৎস। তবু বিভিন্ন কারণে দেহব্যবসাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলেন কৌটিল্য। অবৈধ নারীসংসর্গ বোঝাতে তিনি ‘বাহ্যবিহার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ‘বাহ্যবিহার’-এর পক্ষে বা বিপক্ষে স্পষ্ট করে কিছুই বলেন নি তিনি। বাৎসায়ন বলেছেন, গণিকা অথবা বিধবাদের সঙ্গে যৌনমিলন সমর্থন করা হয় না আবার নিষিদ্ধও নয়। লেকির মতে, গণিকাবৃত্তি হলো সমাজের মাত্রাতিরিক্ত যৌনকামনা বেরিয়ে যাওয়ার একটি সেফটিভালভ। তাঁর মতে, নিজে মূর্তিমতি পাপ হলেও পরিণামে পুণ্যের জিম্মাদার এই গণিকা। সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত এরা না থাকলে– নানা মত আসে যায় কিন্তু সমাজের বিষ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠী হয়ে রয়ে যায় মানবিকতার এই পূজারিণীরা। বার্ট্রান্ড রাসেল লেকির মত সম্পর্কে বলেন, নীতিবাগীশরা লেকির মুণ্ডুপাত করেছেন। লেকি তাদের কেন ক্ষেপিয়ে তুলেছেন তাঁরা নিজেরাই তা জানেন না। আবার লেকি যা বলেছেন সেটা অসত্য বলেও তাঁরা প্রমাণ করতে পারেন নি। ((কৌটিল্য : প্রেম ও নৈতিকতা, প্রাগুক্ত))
যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা-না-করা প্রশ্নে, পুনর্বাসন প্রশ্নে, নৈতিকতা প্রশ্নে, ধর্মীয় প্রশ্নে, অধিকারের প্রশ্নে আমাদের দেশেও এরকম তর্ক-বিতর্ক আমরা অনেক শুনেছি কয়েকবারের চেষ্টায় কয়েকটি পতিতালয় উচ্ছেদের সময়ে। কিন্তু লক্ষণীয় যে পতিতাবৃত্তি টিকিয়ে রাখবার পক্ষে দেয়া সর্বকালের সকল মতই হলো পুরুষদের। কারণ এ প্রথার ভোক্তা পুরুষরাই। সরাসরি পতিতাবৃত্তির পক্ষে নারীনেত্রীদের সাধারণত মত দিতে দেখা যায় না। তবে এ বিবেচনায় নারীনেত্রীদের মধ্যে দু’টো স্পষ্ট ভাগ আছে। এক ভাগের নেত্রীরা পতিতাবৃত্তিকে পুরোপুরি যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ হিসেবে দেখেন। তাঁরা চান এ প্রথা চিরতরে বন্ধ হোক। এই ভাগের নারীনেত্রীদের চেষ্টায় ১৯৯৯ সালে সুইডেনে একটি আইন করা হয়েছে, যেখানে যৌনতা বিক্রি কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু যৌনতা ক্রয় রীতিমতো অপরাধ। এই আইন ভোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে যৌনসেবা ক্রয়ে। আর ক্রেতা যখন থাকবে না তখন এটি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। আরেক ভাগ এটিকে পতিতাদের অধিকার, নিজস্ব ইচ্ছা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে দেখেন। তাঁরা পতিতাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, যথার্থে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না-করে পতিতালয় উচ্ছেদের বিরোধিতা করেন এবং এই পেশাকে কর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বলেন। দেহব্যবসায়ে নিয়োজিতদের পতিতা, বেশ্যা, গণিকা, খারাপ মেয়েছেলে ইত্যাদি না-বলে যৌনকর্মী এবং তাদের কর্মকে যৌনকর্ম বলার পক্ষে পৃথিবীব্যাপী তাদের আন্দোলনও জারি করা আছে। এই দল জার্মানিতে আইন সংস্কারের জন্য চেষ্টা করার ফলে গত ২০০২-এ সে দেশে যৌনকর্ম একটি নিয়মিত পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও ওই আইনে যৌনকর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত আছে। সারা পৃথিবীতেই এসব দাবিতে আন্দোলন সচল আছে। পশ্চিমবঙ্গের দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি এবং বাংলাদেশের দুর্জয় নারী সংঘও এরকম দাবিতে সক্রিয়।
৬.
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বা হতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা যেভাবেই হোক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন। এক দিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এ পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। একটি বড়ো শহরের সবকটি বড়ো বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে শহরে যেরকম দুর্যোগ নামবে, এটিকেও সেভাবেই দেখা দরকার। ১৮৫৩-য় তৈরি এক পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতার তৎকালীন চীফ ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়ট গোটা কলকাতা শহরে ৪০৪৯টি বেশ্যাগৃহ আছে বলে স্বীকার করেন, যাতে বাস করছিলেন মোট ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। অর্থাৎ গৃহপ্রতি যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল ৩ জনেরও অধিক। ১৮৬৭-তে কলকাতার হেলথ অফিসার ফেভার-টোনার যৌনকর্মীর সংখ্যা ৩০,০০০ জন নির্ধারণ করেন। ১৯১১-র আদশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪২৭১ জনে। ১৯২১ এবং ১৯৩১-এর আদমশুমারিতে উল্লিখিত সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০,৮১৪ এবং ৭,৯৭০ জনে। কিন্তু ১৯৩২-এ বেঙ্গল উইমেনস ইউনিয়নের সভানেত্রী দাবি করেন যে পুলিশের হিসেবে কলকাতার যৌনকর্মীর সংখ্যা ২০,০০০ জন। ((দেবাশিস বসু, ‘কলকাতার যৌনপল্লী’, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ধ্রুবপদ, বার্ষিক সংকলন ৫, কৃষ্ণনগর, কলকাতা, ২০০১)) ১৯৩২-এর পরে অনেক দিন বয়ে গেছে। এর মধ্যে ভারতবর্ষে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। বিশ্বায়নের থাবায় দিকে দিকে দারিদ্র্য আরো বেড়েছে, বেড়েছে পাচার, বেড়েছে উন্মত্ততা। ফলে বর্তমানে কলকাতা শহরে যৌনকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে বৈ তো নয়। দেবাশিস বসুর দেয়া তথ্য মতে, ১৯৯৩-এ অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের মহামারীতত্ত্ব বিভাগ যে জরিপ চালায় তাতে কলকাতা ও হাওড়া শহরে মোট ১৯টি যৌনপল্লি চিহ্নিত হয়। প্রতিটি পল্লিতে যদি গড়ে ২০০ করে গৃহও ধরা হয়, তাহলে মোট গৃহ দাঁড়ায় ৩৮০০টি, এবং গৃহপ্রতি ৩ জন করে ধরলে যৌনকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১,৪০০ জন। ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা যদি ৮,৬০০ ধরা হয় তবে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২০,০০০ জনে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির হিসেবটা ঠিক এরকমই। তাদের মতে, কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে ব্রথেল-বেসড ১২,০০০ জন এবং ফ্লটিং ৮,০০০ জন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই অঙ্কে আবাসিক হোটেল এবং ফ্লাটবাড়িভিত্তিক যৌনকর্মীদের চিত্রটি নেই। এই ভাগে আরো ২০,০০০ জন থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এটি ধরা হলে কলকাতা শহরে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০,০০০ জনে। আমরা অন্য দেশের একটি শহরের হিসেবটি এত নিখুঁতভাবে দেখতে চেষ্টা করছি এ কারণে যে এখানকার যৌনকর্মীদের একটি বড়ো অংশই বাংলাদেশের নারী ও শিশু। রয়টারের একটি সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৩০ হাজার মেয়েশিশু আছে কলকাতার বিভিন্ন পতিতালয়ে এবং ১০ হাজার আছে মুম্বাই এবং গোয়ার পতিতালয়ে। ((Trafficking Watch Bangladesh, “Human Smuggling from Banglsdesh at alarming level,” Reuters, 26 may 1997)) এসব নারী ও মেয়েশিশুর সবাই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছেন। এক হিসেবে দেখা যায়, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ২০০,০০০ নারী পাচার হয়েছেন। এছাড়া এসময়ে মোট ৬০০০ মেয়েশিশু পাচার বা অপহৃত হয়েছে কিংবা হারিয়ে গেছে। ((Center for Women and Children’s Study report, Zahiduzzaman Faruque, “Women, children trafficking in Bangladesh,” Kyodo, 5 May 1998)) ইন্টার প্রেস সার্ভিস (৮ এপ্রিল ১৯৯৮) সূত্রে জানা যায়, পাচারকৃত এই দু’লক্ষ নারীর সবাই ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে যৌনকাজে ব্যবহৃত হচ্ছেন। একটি বিদেশী সংস্থার বাংলাদেশ সম্পর্কিত কান্ট্রি নেরেটিভ পেপারের ভাষ্য অনুযায়ী, বৈধভাবে যেসব নারী গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করবার জন্য কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদিআরবে যান, প্রায়শ তাঁদেরও অনিচ্ছাকৃত যৌনদাসত্বকে মেনে নিতে হয়। ওই পেপারের মতে, বার্মিজ মেয়েদের পাচারের রুট হিসেবেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খ্যাতি পেয়েছে।
৭.
রয়টারের তথ্য সঠিক হলে কলকাতায় কর্মরত মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা ৪০,০০০ এর বেশি হতে বাধ্য। একটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে সর্বমোট যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি। ((“Trafficking and Prostitution in Bangladesh – Contradictions in Law and Practice”, Sigma Huda, The Coalition Against Trafficking in Women, February 1999)) কিন্তু শুধু ঢাকা শহরে কর্মরত মোট যৌনকর্মীর সংখ্যাসূচক কোনো বিশ্বাসযোগ্য হিসেব আমাদের হাতে নেই। জনসংখ্যা, জনঘনত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পেশাবৈচিত্র্যে ঢাকা-কলকাতা প্রায় একইরকম। সে বিবেচনায় ঢাকা শহরের বর্তমান মোট যৌনকর্মীর সংখ্যাও কলকাতার সমান ৪০,০০০ জন হতে পারে। যাদের মাথায় এই তর্ক উসকে উঠছে যে, ঢাকা শহরে বর্তমানে একটিও স্বীকৃত যৌনপল্লি নেই, সুতরাং এ সংখ্যা আরো কম হবে– তাদের উদ্দেশ্যে এই তথ্যটি দেয়া যায় যে, ঢাকা শহরে দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মেয়েশিশুর সংখ্যাই ১৫ থেকে ২০ হাজার, যারা এ কাজ শুরু করেছে তাদের বয়স ১২ বছর হবারও আগে থেকে। ((BNWLA survey, police estimates, Fawzia Karim Firoze & Salma Ali of the Bangladesh National Women Lawyers’ Association,” Bangladesh Country Paper: Law and Legislation”)) তাদেরকে অনুরোধ করা যায় যে, স্বীকৃত যৌনপল্লি না-থাকায় সারা ঢাকার পার্কে-উদ্যানে-রাস্তার পাশে-বড়ো বড়ো ইমারতের দেয়াল ঘেঁষে, নির্মাণাধীন ভবনের নিচে, নদীতীরে, রেল ও বাস স্টেশনে রাত্রিবেলা শরীর কেনাবেচার কী জমজমাট হাট বসে একটু খবর লাগিয়ে দেখুন! তাছাড়া কজন জানেন জানি না যে হাতেগোনা দুয়েকটি বাদ দিয়ে ঢাকা শহরের শত শত আবাসিক হোটেলের সবকটিই এখন একেকটি যৌনপল্লি। যৌনপরিষেবা গ্রাহকদের জন্য আবাসিক হোটেল পতিতালয়ের চেয়ে অনেক বেশি সহজগম্য এর গায়ের সঙ্গে পতিতালয় নামটি সাঁটা নেই বলে। ((Khairun Nessa, Shama-A Waris, Zafar Sultan, Shirajum Monira, Maqsud Hossain, Shamsun Nahar, Habibur Rahman, Mahbub Alam, Pam Baatsen, and Motiur Rahman : Epidemiology and Etiology of Sexually Transmitted Infection among Hotel-Based Sex Workers in Dhaka, Bangladesh, International Centre for Diarrhoeal Disease Research, Bangladesh, Family Health International, and SRISTI, Khilgaon, Dhaka, Bangladesh, JOURNAL OF CLINICAL MICROBIOLOGY, Feb. 2004, p. 618–62)) সে কারণে পতিতালয় ও রাস্তাঘাটের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করেও যৌনপরিষেবা ক্রয়ের জন্য শহরের আবাসিক হোটেলসমূহে ২৪ ঘণ্টা ধরেই কী ভয়ানক চাপ পড়ে তা হঠাৎ হঠাৎ পরিচালিত পুলিশ রেইডে ধরা পড়া যৌনকর্মী ও ক্রেতা-গ্রাহকের সংখ্যার দিকে তাকালেই অনুমান করা যায়। আর ফ্লাটবাড়ির আশ্রয়ে পরিচালিত হওয়া যৌনব্যবসার চিত্রটি আমাদের কাছে আড়ালেই থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে, থেকে যাবে। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অভিযোগ না-উঠলে কিংবা ওসব স্পটে কেউ খুন না-হলে সাধারণত সেগুলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের আড়ালেই থাকে। উল্লেখ্য, এসব স্পটের গ্রাহকরা প্রায়শই হন উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তেরা।
৮.
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে সমাজই যৌনকর্মীদের এ ধরনের নিকৃষ্ট পেশায় ঠেলে দিয়েছে। দেশের অসম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি অংশকে এমনই মানবেতর পর্যায়ের দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে দেয় যে তাদের পেটের ক্ষুধা মেটাবার আশু দাবির কাছে ভালো একটি কাজ করবার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম শিক্ষাটা তাদের আর অর্জন করা হয়ে ওঠে না। এর উপরে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হয়ে জন্মানোর অভিশাপ। শৈশবেই ধর্ষিত হওয়া থেকে শুরু করে বাল্যবিয়ে এবং স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা বা অকাল বিধবা হয়ে শিশু বাচ্চা ও নিজের পেটের আগুন নেভাতে অনন্যোপায় হয়ে এ পথে আসা ; কিংবা যৌতুকের দাবি মেটাতে না-পারায় বিয়েই না-হওয়া এবং প্রেমিকের বেশে আসা কোনো প্রতারকের হাত ধরে বাড়ির বাইরে এসে সাক্ষাৎ নরকে পতিত হওয়া ; কিংবা নিয়মিত উপোসের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে কাজের সন্ধানে শহরমুখী হওয়া এবং ভালো কাজের প্রলোভনে পাচারকারীর পাল্লায় পড়ে ভেড়ার পালের একজন হয়ে বিদেশে বিক্রি হয়ে যাওয়া– এরকমই একেকটি নেপথ্য কাহিনি দিনের পর দিন বয়ে চলছে রেড লাইড এরিয়ার সকল সদস্যনারী।
ইন্টারন্যাশনাল এইডস সোসাইটির ১৫তম আন্তর্জাতিক এইডস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১১-১৬ জুলাই ২০০৪-এ থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। ওই কনফারেন্সে ঢাকা শহরের হোটেলে দেহব্যবসা করে এমন ১৫০ জন যৌনকর্মীর ওপরে পরিচালিত একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, এঁদের ৩৩ শতাংশ অন্যদের দ্বারা ভুলপথে পরিচালিত হয়ে এ পেশায় এসেছেন, ১৩ শতাংশ এসেছেন আরো ভালো জীবনযাপন করবার আশায় এবং ১০ শতাংশ প্রেমিকের দ্বারা ধর্ষিত ও প্রতারিত হয়ে। ((AEGiS-15IAC Factors leading to Hotel based sex work in Bangladesh)) ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’ কলকাতায় আয়োজিত যৌনকর্মীদের প্রথম জাতীয় সম্মেলনে ‘এ-লড়াই আমাদের জিততেই হবে’ নামে যে জবানবন্দি দেয় তাতে মেয়েদের যৌন ব্যবসায় আসার কারণ জানাতে তাঁরা বলেন, ‘অন্য আর পাঁচটা পেশায় মানুষ যে কারণে যায়, সে-ভাবেই যৌন ব্যবসায় অধিকাংশ মেয়েই আসে পেটের তাড়নায়। যে বিহারী মজুর কলকাতায় রিকশা চালায় অথবা যে বাঙালী শ্রমিক বম্বেতে মিলে ঠিকা কাজ করে আমাদের গল্প তার থেকে আলাদা নয়। কেউ কেউ বিক্রি হয়ে চলে আসে। বেশ কিছু বছর মালকিনের দাসী হয়ে শ্রম বিক্রি করে ধীরে ধীরে ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা পায়। আবার বেশ কিছু মেয়ে জীবনের নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এখানে এসে পৌঁছায়– অনেক সময় পুরোপুরি সব না-জেনে, পুরোপুরি নিজের ইচ্ছেতে নয়।’ ((সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ধ্রুবপদ, প্রাগুক্ত)) অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ৪৯.১০ শতাংশ যৌনকর্মী এ পেশায় এসেছেন সীমাহীন দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে, ২১.৫৬ শতাংশ এসেছেন পারিবারিক ডামাডোলের শিকার হয়ে, ১৫.৫৬ শতাংশ অন্য জীবিকার মিথ্যা আশার হাতছানিতে, ৮.৬৭ শতাংশ জেনেশুনে স্বেচ্ছায় এসেছেন এবং বলপূর্বক ধরে এনে এ ব্যবসায় লাগানো হয়েছে ০.৪৪ শতাংশকে। যারা মনে করেন যৌনকর্মীরা কেবল বংশপরম্পরায়ই এ পেশায় আসে, তাদের জন্য এই তথ্যটি দেয়া যায় যে কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে সে হার মাত্র ৪.৬৭ শতাংশ। ((দেবাশিস বসু, প্রাগুক্ত)) উল্লিখিত চিত্রে যৌনকর্মীদের এ পেশায় আসার কারণ জানা গেল। পাশাপাশি কৌতূহলী পাঠকদের জন্য এখানে আরেকটি চিত্র তুলে ধরা যায়, যে-চিত্রটি ধারণা দেবে যে এদের এ পেশায় আসার মাধ্যম কারা। এসব যৌনকর্মীর ৬০.৬৭ শতাংশই এ পেশায় এসেছেন বন্ধু ও প্রেমিকের প্রতারণার শিকার হওয়ার মাধ্যমে, ৭.১১ শতাংশ দালালদের মাধ্যমে, ৭.৩৩ শতাংশ দালালদের দ্বারা বিক্রিত হয়ে, ৪ শতাংশ আত্মীয়দের মাধ্যমে, ২.২২ শতাংশ আত্মীয়দের দ্বারা বিক্রিত হয়ে এবং নিরুপায় হয়ে নিজেরাই এ পেশায় আত্মসমর্পণ করেছে ১৮.৬৭ শতাংশ। ((দেবাশিস বসু, প্রাগুক্ত))
৯.
সত্য যে, এই বিপুল পরিমাণ যৌনকর্মীর অধিকাংশই যৌনদাসত্বের ফাঁদে আটকে গেছেন এবং এ জীবন থেকে তাঁরা যেকোনো মূল্যে ছুটি চান। কিন্তু ছুটি-পরবর্তী জীবনে সম্মানের সাথে টিকে থাকবার নিশ্চয়তা তাঁদের কেউই দেয় না। এমনকি সরকারও না। ‘সমাজের বিষ ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে যাওয়া মানবিকতার পূজারী’ হিসেবে তত্ত্বীয়ভাবে উচ্চস্থান যৌনকর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা হলেও আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি সমাজ এঁদের খুবই খারাপ চোখে দেখে। সমাজের ৯৯ শতাংশ মানুষই এঁদের অস্পৃশ্য জ্ঞান করে। মরলে এঁদের সৎকারে পর্যন্ত সামাজিকভাবে বাধা দেয়া হয়। আমরা দেখেছি কার্যকর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না-করেই ঢাকার ইংলিশ রোড ও নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের পতিতাপল্লি ধ্বংস করে দেয়ায় উচ্ছেদ হওয়া যৌনকর্মীদের ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়তে। এঁদের একটা অংশ দেশের অন্যান্য পতিতালয়ে জায়গা নিয়েছেন, একটা অংশ শহরের বিভিন্ন হোটেলে ও বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ব্যবসা করছেন আর বাদবাকি সবারই পথবেশ্যার মানবেতর জীবন বেছে নিতে হয়েছে। পুনর্বাসনের নামে তখন সরকার যেসব খেলা দেখিয়েছিল তাতে সকলেই বুঝেছে যে পুনর্বাসন শব্দটি ব্যবহার করে সরকার যৌনকর্মীদের সঙ্গে প্রতারণাটিই করেছিল মাত্র। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার পৌর-কর্তৃপক্ষ ১৯৯২-এ শহরের যৌন বিনোদন কেন্দ্রগুলো ভেঙে দেয়ার পরও একইভাবে সেখানকার যৌনকর্মীরা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর থেকে ওদেশে বিভিন্ন ধরনের যৌনরোগ ও এইচআইভির সংক্রমণ অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।
অর্থশাস্ত্র মতে, বাজারে যদি কোনো পণ্যের চাহিদা থাকে তাহলে সে পণ্যের উৎপাদন রহিত করা যায় না। প্রকাশ্যে না-হলেও গোপনে তার উৎপাদন চলতেই থাকে। সমাজে যৌনকর্মী তৈরি হবার যেসব কারণ বিদ্যমান, সেগুলোকে অপনোদন করা না-গেলে এবং যৌনপণ্যের বাজারচাহিদা কমানো না-গেলে চিহ্নিত রেড লাইড এরিয়াগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে দিলেও অন্য কোনো ছদ্মআবরণে এ ব্যবসা চলতেই থাকবে। তাতে মাত্র একদল যাবে, একদল আসবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
এ গেল যৌনবাণিজ্যের এক দিক। বিশ্বায়নের ছোঁয়া লাগার সাথে সাথে যৌনবাণিজ্যের আরো নানা রূপচেহারা স্পষ্ট হয়েছে। তার বড়ো ক্ষেত্র সেক্সট্যুরিজম এবং পর্নোগ্রাফি। প্রতিদিনই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপরিণত ও পরিণত বয়েসি নারী পাচার হয়ে আন্তর্জাতিক এসব যৌনবাণিজ্যের কবলে পড়ছে। পাচারকারী ও যৌনবাণিজ্যের হর্তাকর্তা শ্রেণির নেটওয়ার্ক এতই বিস্তৃত ও শক্তিশালী যে তাদের শক্তিমত্তার সাথে পেরে ওঠবার চেষ্টা প্রায়ই রাষ্ট্রগুলো করে না, কারণ অনেক রাষ্ট্রের মোটা আয়ই নির্ভর করে এ পেশার ওপরে, বিশেষ করে, সেক্সট্যুরিজম তথা যৌনপর্যটন যেসব রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস।
(চলবে)