Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর
ইতিহাসের ভাষা
রোমকদের ইতিহাস সম্পর্কে এখানে বেশ খানিকটা আলোচনা করেছি আমরা, একেবারে তাদের প্রাচীনকাল থেকে পরবর্তী বেশ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত। আমরা যে এসব সম্পর্কে কিছু জানি তার কারণ নিজেদের ইতিহাস লিখে রাখার ব্যাপারে আগ্রহের কমতি ছিল না রোমকদের। ইতিহাস লেখার এই ধারণাটিও তারা পেয়েছিল আসলে গ্রীকদের কাছ থেকেই, যারা রোমকদের বহু শত বছর আগেই নিজেদের ইতিহাস লিখে রাখতে শুরু করেছিল। আর, মজার বিষয় হলো রোমের ইতিহাস বিষয়ে আমাদের কাছে এখনো যেসব উৎস রয়েছে তার অনেকগুলোই গ্রীক ভাষায় লেখা। তবে একবার শুরু করার পর রোমকরা বেশ কিছু উৎকৃষ্ট মানের লেখার জন্ম দিয়েছে। রোমের ইতিহাস যাঁদের আগ্রহের বিষয় তাঁদের জন্য বেশ কিছু রোমক ঐতিহাসিকের লেখা আজও পাঠযোগ্য বলে বিবেচিত।
সাধারণত প্রথমেই যাঁর নাম আসে তিনি সালাস্ত (Sallust; লাতিন ভাষায়, Sallustius) — সিযারের ঘনিষ্ঠতম কর্মকর্তাদের অন্যতম, নিজেও সিনেটর হয়েছিলেন, আর প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন নুমিদিয়ার (মোটামুটি বর্তমান আলজেরিয়া বলা যেতে পারে জায়গাটিকে)। সম্ভবত, নিজের প্রদেশটিকে ভালোই শোষণ করেছিলেন তিনি, কারণ রোমের সেরা এলাকায় বিশাল এক বাগানসহ একটা বাড়ি কিনেছিলেন তিনি নিজের জন্য। অবশ্য চল্লিশ বছর বয়েসে অবসর নিয়ে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
সেসব লেখার মধ্যে যা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে তা ছোট দুটি বই, যার একটি সেই ক্যাতিলিন সম্পর্কে, যাঁকে সিসেরো আক্রমণ করেছিলেন। পড়তে বেশ ভালো বইটা, স্কুলে পাঠ্য-ও ছিল বেশ কয়েকশ বছর। ছাড়া ছাড়া রচনা শৈলীতে বেশ ভালোই লেখেন সালাস্ত, এবং তাঁর বর্ণনায় পাওয়া যায় মানুষজন কেমন, কেমন তাদের হওয়া উচিত সে-সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বলা তাঁর নিজস্ব ভাবনা চিন্তা: যেমন, তিনি বলছেন, “Régibus boni quam mali suspectiores sunt”, অর্থাৎ, ‘রাজার কাছে মন্দ লোকের চাইতে ভালোরাই বেশি সন্দেহজনক।‘ (লাতিন থেকে আক্ষরিক ইংরেজি করলে দাঁড়ায় — To kings, good than bad more suspected are)। ইতিহাসের ঘটনার বর্ণনার মাঝে নৈতিক শিক্ষা খোঁজ করবার একটা প্রবণতা চালু করেছিলেন তিনি রোমক ইতিহাসবিদদের মাঝে।
আধুনিক আর রোমক ইতিহাসবিদদের মধ্যে একটা পার্থক্য হলো, তাঁরা তাঁদের চরিত্রদের দিয়ে কোনো বক্তৃতা করিয়ে নিতেন। তবে, এটা এক অর্থে ঐতিহাসিকভাবেও সত্য, তার কারণ রোমকরা সিনেটে বা কোনো সংগঠিত ও পূর্ব-পরিকল্পিত যুদ্ধের আগে, বা কোনো সংকটকালে এলেই জনসাধারণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতেন, সাদা কথায়, বক্তৃতা দিতেন। অবশ্য এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশেষ সেই ঐতিহাসিকের জানার কথা নয় আসলেই ঠিক বলা হয়েছিল, যদিও গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাগুলোয় কি কি বলা হয়ে থাকতে পারে সেটা কল্পনা বা অনুমান করে নিয়ে তা নিজের লেখায় উপস্থাপন করাটা ইতিহাসবিদ হিসেবে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তাঁর। এটা টেলিভিশনে ইতিহাসভিত্তিক ডকুমেন্টারিতে স্ক্রিপ্ট রাইটাররা যে কৌশলে কাজ করেন ঠিক তার মতো। ভবিষ্যৎ বাগ্মীদের প্রশিক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে প্রায়ই ব্যবহার করা হতো ইতিহাসের এই বইগুলোকে।
সালাস্ত-এর অধিনায়ক এবং পৃষ্ঠপোষক সিযার নিজেই ছিলেন এক চমৎকার লেখক। তাঁর যেসব লেখা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে সেগুলো এক অর্থে ইতিহাসভিত্তিক লেখাই। গঅলে তিনি যে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন তার বিবরণ তিনি নিজেই লিখে গেছেন। সাত সাতটা বই লেগেছে তাতে (তবে ভুললে চলবে না যে সেসব রোমক বই বা ‘liber’ আধুনিক বইয়ের চাইতে ছোট ছিল বেশ)। এবং আরেকটা — যেটা তিন বই দীর্ঘ — সেটা ছিল সেই যুদ্ধের ফলে বেধে যাওয়া গৃহযুদ্ধ নিয়ে, যে-যুদ্ধ তাঁর নিজেরই সৃষ্টি। এই দুটি বই-ই আপাত নিরপেক্ষ, নির্মোহ ধরনে লেখা, ভাবখানা যেন যা ঘটেছে সে সম্পর্কে নিরীহ প্রতিবেদন ছাড়া আর কিছু নয় সেটা। তাঁর লেখার এই শৈলীর একটা বিশেষ দিক হচ্ছে, সিযার নিজের সম্পর্কে কখনো উত্তম পুরুষে কিছু বর্ণনা করেননি, বরং নিজেকে তিনি ‘সিযার’ বলে সম্বোধন করেছেন, যেন অন্য কারো সম্পর্কে কথা বলছেন তিনি, নিজের ব্যাপারে নয়। কিন্তু সিযার কি লিখেছেন সেটা যদি ভালো করে খেয়াল করা যায় তাহলে আমরা দেখবো সেটা আসলে অনেকটাই তিনি যা করেছেন তার ব্যাখ্যা বা সমর্থনমূলক প্রচার বা প্রোপাগান্ডা। সেই বইয়ের বেশিরভাগ জুড়েই আমরা দেখতে পাই তিনি তাঁর সৈন্য পরিচালনা করছেন, যুদ্ধ করছেন, যেগুলো সংগঠিত ও পূর্ব- পরিকল্পিত। একঘেয়ে সব বর্ণনা; আর সেটা সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছে সম্ভবত লাখ লাখ স্কুল পড়ুয়ারা, কারণ সনাতন লাতিন সিলেবাসে সিযারের লেখা গঅল যুদ্ধের বিবরণ অন্যায্যভাবে প্রচুর জায়গা দখল করেছে।
যাই হোক, সেটার প্রথম বাক্যটির দিকে নজর দেয়া যাক :
Gallia est omnis divisa in partes tres, quarum unam íncolunt Belgae, áliam Aquitani, tértiam qui ipsorum lingua Celtae nostra Galli appellantur.
সমগ্র গঅল তিন ভাগে বিভক্ত, তার একটিতে থাকে বেলজীয়রা, অন্যটিতে একুইতানীয়রা, আর তৃতীয়টিতে তারা যাদেরকে তাদের ভাষায় বলা হয় কেল্ট, আর আমাদের ভাষায় গঅল।
(The whole of Gaul is divided into three parts, of which the Belgians inhabit one, the Aquitanians another, and the third is inhabited by those who in their own language are called Celts, and in ours Gauls.)
এই বাক্যে সিযার আমাদেরকে নতুন দেশটির অধিবাসীদের সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দেন। উত্তর পুবে ছিল বেলজীইয়রা, দক্ষিণে একুইতানীয়রা, আর এই দুইয়ের মাঝখানের বিশাল এলাকায়, অর্থাত আধুনিক ফ্রান্সের বেশিরভাগ জুড়ে বাস করত গঅলবাসীরা।
বাক্যটির অনেক শব্দই সহজে চিনতে পারি আমরা। ‘divisa’ মানে, ‘divided’ — ইংরেজি শব্দটার সঙ্গে সেটার সম্পর্ক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে; ‘partes tres’ মানে, ‘three parts’ (‘one part’ হবে ‘una pars’)।
‘unam’, ‘aliam’ আর ‘tetrium’ স্পষ্টতই ‘one’, ‘another’, অর্থাৎ ‘দ্বিতীয়’ — ‘second’ ও ‘তৃতীয়’ — ‘third’।
‘’language’ বোঝাচ্ছে যে-শব্দটা সেটা ‘lingua’, আর, ‘lingua nostra’ মানে ‘আমাদের ভাষা’ — ‘our language’।
‘Appellantur’ হলো, ‘they are called’, যা, যাঁরা ফরাসী জানেন তাঁদের মনে করিয়ে দেবে ক্রিয়াপদ ‘appeller’, মানে, ‘to call’-এর কথা।
সিযার আর সালেস্ত -এর পর আরো অনেক ইতিহাসবিদই এসেছেন। তাঁদের মধ্যে সেরাদের একজন লিভি (Livy)। যীশু খৃষ্টের সময়কার মানুষ তিনি, নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ৭৫৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দ থকে রোমের ইতিহাস লেখার কাজে, যে-বছরটিতে শহরটি স্থাপিত হয়েছিল। তাঁর সেই কাজটির নাম ‘Ab urbe cóndita’ (From the Foundation of the City), যাতে রয়েছে ১৪২টি বই, এখনকার ৬,০০০ ছাপা পৃষ্ঠার সমান, যদিও সেটার মাত্র এক চতুর্থাংশ এসে পৌঁছেছে আমাদের কাছে। প্রাচীনকালেও সম্ভবত সেটার পূর্ণাঙ্গ কপি খুব বেশি ছিল না, কারণ, আগেই বলা হয়েছে, এক একটি আলাদা কপি তৈরি করা ছিল খুব ব্যয়বহুল।
যে-অংশটুকু টিকে গেছে সেটিতে রয়েছে রোম নগরটির প্রথম দিকের বর্ণনা। সাহসী আর ন্যায়পরায়ণ রোমক সৈন্যদের বেশিরভাগ গালভরা গল্প-কাহিনী এই লিভির কাছ থেকেই পেয়েছি আমরা। একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে উত্তরপুরুষদের কাছে একটা উদাহরণ হাজির করাটাকে তিনি নিজের কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছিলেন। কাজেই, সেসব গল্প সত্যি কি মিথ্যা তা যাচাই করা, বা সেসবের সমালোচনা করার ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ ছিল না ভদ্রলোকের, যদিও নিজে তিনি মিথ্যে কথা বলেননি বা বানিয়ে বানিয়ে কিছু লেখেননি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রোমকদেরকে তাদের ইতিহাসের একটা দুর্দান্ত, গৌরবময় সংস্করণ উপহার দেয়া, যা আবার সেই সঙ্গে সুখপাঠ্যও বটে। সে-কাজে অবশ্য সফল হয়েছিলেন তিনি। ওস্তাদ এক গল্পকথক তিনি, তার বর্ণনায় নানান ঘটনা, পরিস্থিতি যেন প্রাণ পেয়ে ওঠে একেবারে। প্রথম অংশটা পড়তে সবচে’ মজা; সেখানে বর্ণিত কাহিনীর বা ঘটনার সূত্র তেমন একটা দেয়া নেই, আর ভাষা বেশ কল্পনাপ্রবণ; লিভি সেখানে নিজের কল্পনার বেশ খানিকটা ব্যবহার করে গল্পগুলোকে সুন্দর করে তুলেছেন। কার্থেজীয়দের সঙ্গে রোমকদের যুদ্ধের অংশটুকু স্কুলের ছেলেমেয়েদের পাঠ্য ছিল, আর সেখানেই আমরা পাই হানিবলের আল্পস পার হওয়ার মতো কিছু ঘটনার অনিন্দ্যসুন্দর বর্ণনা। দুর্ভাগ্যক্রমে, পূর্ব-পরিকল্পিত বেশ কিছু যুদ্ধ ও শত্রুকে প্রতারণা বা ফাঁকি দেয়ার কলাকৌশলের বেশ কিছু বর্ণনা রয়েছে সেখানে, যা সামরিক ইতিহাস সম্পর্কে উৎসাহী লোকজন ছাড়া অন্য কারো পড়ার সম্ভাবনা কম।
(ক্রমশ)
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
আরাফ - ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ (৩:৫২ অপরাহ্ণ)
ভালো লাগলো, বাকিটার অপেক্ষায় রইলাম। বেশ কষ্টসাধ্য কাজ করছেন বলতে হবে। শুভকামনা।
Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ১১ | জি এইচ হাবীব