লাতিন ভাষার কথা : ৭

|| জনগণের জন্য থিয়েটার || সংরক্ষিত হয়েছে এমন সবচাইতে পুরানো লাতিন সাহিত্য বলতে আমরা প্লতাস নামের এক ভদ্রলোকের বেশ কিছু নাটককেই বুঝি। খৃষ্টপূর্ব ২০০ সালের দিকে লেখা হয়েছিল সেসব, আর মঞ্চস্থ হয়েছিল রোমেই। প্লতাসেরই অনুবাদ করা সমসাময়িক কিছু গ্রীক নাটককে সামনে রেখে রচিত হয়েছিল সেগুলো; রোমান পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী বদলে নেয়া হয়েছিল স্থান-কাল-পাত্রী-পাত্র। [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

 

জনগণের জন্য থিয়েটার

সংরক্ষিত হয়েছে এমন সবচাইতে পুরানো লাতিন সাহিত্য বলতে আমরা প্লতাস নামের এক ভদ্রলোকের বেশ কিছু নাটককেই বুঝি। খৃষ্টপূর্ব ২০০ সালের দিকে লেখা হয়েছিল সেসব, আর মঞ্চস্থ হয়েছিল রোমেই। প্লতাসেরই অনুবাদ করা সমসাময়িক কিছু গ্রীক নাটককে সামনে রেখে রচিত হয়েছিল সেগুলো; রোমান পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী বদলে নেয়া হয়েছিল স্থান-কাল-পাত্রী-পাত্র। আমরা যাকে সচ্ছল মধ্যবিত্ত বলি তাদের জীবন নিয়েই রচিত এই নাটকগুলো। বণিক, ভূস্বামী আর তাদের স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও দাসেরাই ছিল সেসবের চরিত্র। শেষ অব্দি পুনর্মিলিত হওয়া প্রেমিক-প্রেমিকা, বা হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ের অপ্রত্যাশিতভাবে উদয় হওয়া, এসব বিষয় ঘিরেই ঘুরপাক খেতো তাঁর নাটকের প্লট। আর সেটিং বা ঘটনাস্থল হিসেবে সবসময়ই থাকত কোনো বন্দর, যেখানে নানান জায়গা থেকে জাহাজ এসে ভিড়ছে। আসলে এরকমই এক বহুজাতিক বা কসমোপলিটান সমাজ হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল তখন রোম, কাজেই নাটকগুলো বেশ দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

আমরা দেখতে পাই, দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছে এ-ধরনের নাটক। শেক্সপীয়র তাঁর বহু নাটকের বিষয় ও প্লট প্লতাসের কাছ থেকেই নিয়েছিলেন; যেমন, দ্য কমেডি অভ এরর্স হচ্ছে Menaechmi-র আদলে রচিত; আর এমনকি আমাদের সময়ের Dallas-এর মতো দীর্ঘ দিন ধরে চলা সোপ অপেরার কেন্দ্রেও রয়েছে একই মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু প্লতাস ছিলেন আরো মজার। প্লট নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না তিনি, তাঁর নজরটা থাকত মূলত বুদ্ধিমান দাস ও কৌতুকপ্রদ ভুল বোঝাবুঝি আর হামবাগ সেনাপতি ও দাপুটে পিতাদের নিয়ে মজা করার দিকে।

9780862922399এই নাটকগুলোতে দাসেরা প্রায়ই নানান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং এমন সমস্ত আচার-আচরণ করে যা করা নিষিদ্ধ ছিল রোমে। একটি নাটকে প্লতাস নান্দীপাঠে (prologue) বলছেন নাটকের এক পর্যায়ে দুই দাস-দাসী বিয়ে করবে, এবং তিনি বেশ বুঝতে পারছেন যে কেলেঙ্কারিটা সহজভাবে নেবে না দর্শকেরা। অথচ অন্যস্থানে কিন্তু কাজটি বৈধ — ‘in Graecia et Carthagini, et hic in nostra terra, in Apulia’ (গ্রীস ও কার্থেজে, এবং আমাদের নিজেদের দেশে, আপুলিয়া-তে)। আপুলিয়া-তে, (অধুনা পাগলিয়া-য়), ইতালির দূর দক্ষিণে, যা তখন কেবলই রোমক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, রীতি-নীতি ছিল গ্রীসের মতন, কিন্তু রোমকরা দাসেদের এমন কিছু করতে দিত না যা তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসে, যেমন জমি কেনা, টাকা ধার নেয়া, বা বিয়ে করা। এসব কাজের অনুমতি দিলে দাস মালিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারত।

তো, এভাবেই প্লতাসের নাটক রোমকদের শেখাত বা জানিয়ে দিত বাইরের জগতে কি ঘটছে। প্রাচীন রোমক গুণাবলী খুব একটা পছন্দের ছিল না তাঁর, যদিও — বা, ঠিক এই কারণে যে — তিনি ছিলেন কাতোর প্রায় সমসাময়িক। প্রাচীন রোমকদের তিনি বলতেন ‘pultíphagi’ বা ‘পরিজ-খেকো’, কারণ তারা তখনো রুটি সেঁকতে বা বানানো শেখেনি। পুব আর দক্ষিণের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা মানব সভ্যতার যে-সমস্ত অবদান গ্রহণ করেছে এই রুটি সেঁকার বিষয়টা তার অন্যতম।

প্লতাসের নাটকগুলোর বিষয় প্রধানত পারিবারিক চক্রান্ত। এর মধ্যে একটি চাবিকাঠি অবশ্যই ‘amor’, ‘প্রণয়’ বা ‘ভালবাসা’ (love), এবং ‘amare’ ‘ভাল বাসা’ (to love), কিন্তু আরেকটি বিষয়ও কম জরুরি নয়, আর তা হলো পারিবারিক ভাগ্য বা সমৃদ্ধি, বা অর্থ-কড়ি। এই অর্থ-কড়ি বা ‘money’ বোঝাতে লাতিনে সাধারণত ‘pecúnia’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়; এসেছে ‘pecus’ বা বেচা-কেনার জন্যে পালন করা গবাদিপশু (livestock) থেকে, কারণ মুদ্রার ব্যবহার প্রচলিত হওয়ার আগে পশু বিনিময়ের মাধ্যমে নানান বেচা-বিক্রি হতো। তবে রোমকদের রৌপ্য (argentum) ও স্বর্ণের (aurum) মুদ্রাও ছিল। আর তাই, ফরাসিতে টাকা-কড়ি হচ্ছে ‘argent’, এসেছে রুপোর লাতিন থেকে, আর সোনা হলো ‘öre’, যা আবার সুইডেন, ডেনমার্ক, আর নরওয়ের ক্ষুদ্রতম এককের মুদ্রার নাম — মোটামুটি এক পেনির এক-দশমাংশ মূল্যমান সেটির। আমরা সবাই জানি, টাকার মান-ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে।

ভাগ্য বা বরাত বা সমৃদ্ধি বোঝাতেও প্রায়ই ‘res’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো; ‘res’ ‘pública’ শব্দবন্ধে আগেই সেটির সঙ্গে দেখা হয়েছে আমাদের। লাতিন এই ‘res’ শব্দের মূল অর্থ ‘জিনিস’ (thing, বিষয়, ব্যাপার), আর, মানুষের যা কিছু জিনিস থাকে তাই-ই তার বরাত বা ভাগ্য বা সমৃদ্ধি। প্লতাসের এক নাটকে একটি চরিত্রকে আমরা বলতে শুনি ধনী মানুষের বন্ধুর অভাব থাকে না, কিন্তু যখন সে নির্ধন হয়ে পড়ে তখন আর কোনো বন্ধুর দেখা পাওয়া যায় না; এবং পুরো বিষয়টি সে ছোট করে এই নীতিবাক্য বা তত্ত্বকথার মাধ্যমে প্রকাশ করে : ‘res amicos facit’ — সুসময়ে অনেকে বন্ধু বটে হয়… (the fortune makes the friends)। এ-ধরনের ছোট, সারগর্ভ প্রবচন বেশ পছন্দ করত রোমকরা। মাঝে মাঝে সেসব বেশ নীতিবাগীশ ধরনের হলেও, কখনো কখনো — এই যেমন আগেরটির মতো — সেগুলোর মধ্যে আবার একটা হতাশ্বাস বা সব কিছুতেই খারাপ কিছু দেখবার মতো উদাসীন বা বৈরাগ্যসুলভ ব্যাপারও থাকত। তো, নাটকের কৌতুকপূর্ণ গোলমেলে পরিস্থিতি আর প্র্যাক্টিকাল জোকের মধ্যে এ-ধরনের নৈতিক ফোঁড়ন কাটতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন প্লতাস।

 (ক্রমশ)

 

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

২ comments

  1. Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ৬ | জি এইচ হাবীব

  2. Sports Info24 - ৫ নভেম্বর ২০১৪ (২:৫৯ অপরাহ্ণ)

    Good staff. Great post, thanks for all your hard work in compiling it.

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.