সন্ধ্যার বাতাসে ঝরে যাওয়া জলপাই পাতা তুমি, আলতো করে শয়ান নিলে মাটিতে। পৃথিবীর বুকে পোঁতা হলো আরো একটি শোকের পাহাড়। এখন ঐ মাটি আর ঐ মা পৃথিবী তোমাকে টেনে নেবে তার মায়ার কন্দরে। ঐ বাতাস সব মৃত ভাইদের অন্তিম নিঃশ্বাসের দমক হয়ে আছড়ে পড়বে তোমার কবরে। বিধবা বোনদের হুতাশন মরুর লু হাওয়া হয়ে তোমার শিয়রে জানাবে নালিশ। আর পৃথিবীর বুকের হাপর থেকে উঠে আসবে ঝড়: ইন্তিফাদা। অযুত অযুত হারানো-খোয়ানো মানুষদের হাড়-পিঞ্জিরার ডুগডুগির তালে বেজে উঠবে জেরুজালেমের সকল মিনার, গির্জার সকল ঘণ্টা। রক্ত উগরানো গিরিগর্জনে তারা ডাকবে: মাহমুদ, মাহমুদ!
হ্যাঁ, তারা তোমাকেই ডাকবে। কেননা তুমিই, তুমিই তো দখলের থাবার নীচ থেকে তোমার দেশের আকাশ-মাটি-ঝরনা-জলপাই-শৈশব আর মুক্তির স্মৃতিকে ছিনিয়ে এনে লুকিয়ে রেখেছিলে অক্ষরে-শব্দে-কবিতায়।
যখন পৃথিবীতে তোমার ভাইদের-বোনেদের স্মৃতিও লুপ্ত হবে, যখন থাকবে না কোনো ফিলিস্তিনী গ্রাম; তোমার নামে নাম এমন মানুষ, তখন জগতের খোদা নামবেন আবার। তোমার প্রতিটা কবিতার প্রতিটি হরফ নিংড়ে নিংড়ে তিনি আবার বানাবেন সেই দেশ: সেই স্বপ্নের মতো মায়াবি করুণ নহরসিক্ত প্রতিশ্রুত উপত্যকা।
তোমার কবিতার নামে নাম হবে সেই দেশের: ফিলিস্তিন।
. . .
মাহমুদ দারবিশের দুটি কবিতা থেকে অনুবাদ
বৈরুত
ঘনকৃষ্ণ ধাতব পাতে বানানো প্রকাণ্ড এক গম্বুজ যেন বৈরুতের আকাশ। এক মহাদুপুর হাড়ে হাড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার অবকাশ। আকাশ হিরোশিমাময়। দিগন্ত যেন ঝকঝকে ধূসর এক স্লেট, যে রংই লাগাও খেলুড়ে জেটগুলো আড়াল পাবে না। যদি ইচ্ছা করি, তবে চক ঘষে যা খুশি লিখে ফেলতে পারি আমি সেই স্লেটে। কী এক ঝোঁক চেপে বসে আমার মাথায়। যদি উঠে যেতে পারি খুব উঁচা কোনো দালানের ছাদে, কী লিখব আমি তখন, আকাশে? ‘ওরা তোমাকে যেতে দেবে না’। হ্যাঁ, এটাও তো বলা হয়েছে। ‘হয়তো মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে আমাদের কিন্তু অমর হোক জন্মভূমি’? এও তো আগে বলা। ‘হিরোশিমা’? তাও তো পুরনো কথা। আমার স্মৃতি থেকে, আমার আঙুল থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে শব্দগুলো। আমি ভুলে গেছি হরফ। কেবল স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে ছয়টি অক্ষর: B-E-I-R-U-T .
[Memory for Forgetfulness থেকে]
. . .
বন্দিদশায়
এখানে পাহাড়ের ঢালে, সময়ের কামান আর গোধূলির দিকে চেয়ে
চুরমার হওয়া ছায়াদের বাগিচা ঘেঁষে,
আমরা তা-ই করি, বন্দিরা যা করে
আমরা তা-ই করি, বেকারেরা যা করে :
আমরা ফলিয়ে যাই আশার আবাদ।
*
মেঘকে শুধায় নারী : আমার প্রিয়কে তুমিই ঢেকে রেখো
আমার পোশাক যে সিক্ত তার রক্তে
*
এবং প্রভাতের যা কিছু বাকি, তার মধ্যে আমি হেঁটে যাই আমার বাইরে
এবং রাত্রির যা কিছু রয়, পদশব্দ শুনি আমার ভেতরে।
*
বন্ধুরা কেবলই আমার জন্য সাজিয়ে যায় চিরবিদায়ের সভা,
ওক গাছের ছায়ায় এক কোমল কবর
সময়ের মার্বেল এপিটাফ
এবং সর্বদাই সেই শোকমিছিলে আমি আগাম হাজির :
কে তবে মরে গেল…কে?
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৭ comments
রণদীপম বসু - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১:২৬ অপরাহ্ণ)
ভালো লাগলো লেখাটা, ফারুক ভাই।
বিশেষ করে মাহমুদ দারবীশের এই পঙক্তিটা ছুঁয়ে গেছে-
ফারুক ওয়াসিফ - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (২:৪৮ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ রণদীপম।
মুজিব মেহদী - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৪৪ অপরাহ্ণ)
কবিতার অনুবাদ খুব সুন্দর হয়েছে।
মাহতাব - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৭:৩৮ অপরাহ্ণ)
ভাল লাগল
রেজাউল করিম সুমন - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:২১ অপরাহ্ণ)
কবিতার অনুবাদ ভালো লেগেছে। কিন্তু তার চেয়েও ভালো লেগেছে ফারুক ওয়াসিফের লেখা শোকলেখন। অসামান্য।
দারবিশ মারা যাওয়ার পর থেকেই একটা কথা ভাবছিলাম; এই সুযোগে বলি। বাংলায় তাঁর নির্বাচিত কবিতার একটা সংকলন পেতে চাই আমরা। কারো একক অনুবাদ দিয়ে হতে পারে, আবার অনেকের অনুবাদ বাছাই করেও করা যেতে পারে ওই সংকলন। নতুন করে অনুবাদ করার বা করিয়ে নেয়ার প্রয়োজনও হবে নিশ্চয়। কোনো যোগ্য অনুবাদক/সম্পাদক দায়িত্ব নিলেই কেবল কাজটা সম্ভব।
ফারুক ওয়াসিফ - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ)
নানান জায়গায় যেসব অনুবাদ হয়েছে, সেসব একত্র করলেও একটা কাজ হয়। কাজটা আপনিই ব্লগে লেখা আহ্বান করে শুরু করেন না কেন, সুমন?
রায়হান রশিদ - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১১:১৬ পূর্বাহ্ণ)
আমরা সময়ের এক অদ্ভুত মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। মুক্তির বাণী শোনানো কন্ঠগুলো একে একে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিবেকবান মানুষগুলোও কেমন বদলে যাচ্ছে দিনদিন। অসাধারণ অনুবাদ হয়েছে, বিশেষ করে এই অংশটা:
সুমনের প্রস্তাবটা দারুন। এই পোস্টেই পছন্দের কবিতার অনুবাদগুলো দেয়া যেতে পারে একে একে মন্তব্য আকারে। অনুবাদের যে মান (যেমন: ওয়াসিফ) দেখছি, আমাদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে মনে হয়। আর এর পরও যেটুকু সীমাবদ্ধতা থাকবে – তা না হয় নিজ তাগিদে কবির প্রতি ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে নেব।
মুজিব মেহদী - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১:৫৭ অপরাহ্ণ)
উত্তম প্রস্তাব।
সৈকত আচার্য - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৩৬ অপরাহ্ণ)
ফারুক ওয়াসিফ কে বিশেষ ধন্যবাদ এই কারনে যে, তিনি মাহমুদ দারবিশের মত একজন শক্তিমান ও প্রতিবাদী কবির প্রয়াণে একটি অসামান্য শোকগাঁথা রচনা করেছেন।এবং অন্যদিকে, কেবল মাত্র নিজ বিশ্বাসে ধারন করলেই বুঝি এত সুন্দর অনুবাদ সম্ভব হতে পারে।
ছয় বছর বয়সে তিনি বাস্তভিটা থেকে উৎখাত হয়েছিলেন তার পরিবারের সাথে, দেখেছিলেন, ইসরায়েলী সেনাবাহিনীর বর্বরতা। দেখেছিলেন, খুব কাছ থেকে একটা জাতিকে, একটা স্বপ্নকে কি ভাবে ট্যাংক দিয়ে ধুলিস্যাৎ করে দেয়া হচ্ছে, সেই থেকে শুরু…। কারাবরন, গৃহবন্দীদশা ও সামরিক রক্তচক্ষুর চাহনী তাকে থামাতে পারেনি, সাহস দিয়ে গেছেন একটা নিপীড়িত জাতিকে তার কাব্য ও লেখনী দিয়ে সারাজীবন।
তিনি মারা যাওয়ার পরপরই গার্ডিয়ান পত্রিকায় তাঁর স্মরনে একটি ফিচার করা হয়। সেখানে তার কবিতা নিয়ে পিটার ক্লার্ক মন্তব্য করেছেনঃ “His poems have been taught in schools throughout the Arab world and set to music; some of his lines have become part of the fabric of modern Arabic culture.”
এই সময়ে তাঁকে স্মরন করা আরেকটি কারনে জরুরি বলে মনে করি। এই দেশের সময়টা ভাল যাচ্ছে না। গায়ের জোরে রাজ্য শাসনের আলামত স্পস্ট। আইনের শাসনের কথা বলে মানুষের উপর অত্যাচার দৃশ্যমান। জরুরী আইনের শাসনে আমাদের অভ্যস্ত করে ফেলা হচ্ছে যাতে করে ভবিষ্যতে “কেবল মাত্র মার্শাল’ল ছাড়া অন্য কোন অপশন নাই” এই বাণী টুকু শোনানো যায়। এই দুঃসময়ে মাহমুদ দারবিশের সংগ্রামী চেতনা আমাদের মধ্যে জাগরুক থাকুক। তিনি আমাদের সংগে থাকুন ।
monjuraul - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১০:২১ অপরাহ্ণ)
প্রিয় ফারুক,
একটা পরামর্শ,আপনি কিছু কিছু ল্যাটিন কবিতা অনুবাদ করুন।আমি অনেক কষ্টে কিছু তামিল,কন্নড়,মালায়ম কবিতা অনুবাদ করেছি।সাবস্ক্রাইবার হলে পোস্ট দেব।
zifran khaled - ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ)
অনুবাদে আছি। ফারুক ভাই কিছু দরকার হলে জানায়েন…
ফারুক ওয়াসিফ - ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ)
দারুণ, এইবার একটা কাজ তাহেল করাই লাগে। কাজটা যেৌথভােব হোয়াই ভাল।
রেজাউল করিম সুমন - ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৬:৩২ পূর্বাহ্ণ)
ফারুক ওয়াসিফ,
কাজটা যৌথভাবে হতে পারে। তবে মূল দায়িত্ব আপনিই নিন।
রায়হানের সঙ্গে আমি একমত — “এই পোস্টেই পছন্দের কবিতার অনুবাদগুলো দেয়া যেতে পারে একে একে মন্তব্য আকারে।”
মাহমুদ দারবিশের নির্বাচিত কবিতার সংকলন হয়তো এটা হবে না। তবে একসঙ্গে-যে প্রিয় কবির অনেকগুলো কবিতার অনুবাদ আমরা পড়তে পারব, সেটাও একটা বড়ো প্রাপ্তি।
অন্যত্র প্রকাশিত কবিতার অনুবাদও একইভাবে মন্তব্য আকারে পোস্ট করার জন্য কবিতাপ্রেমীদের প্রতি অনুরোধ রইল। উৎস-নির্দেশ থাকলে ভালো হয়।
সৈয়দ তাজরুল হোসেন - ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৫৮ অপরাহ্ণ)
ফারুক ওয়াসিফকে অসংখ্য ধন্যবাদ । অসাধারণ এলিজি এবং অনুবাদ, বিশেষ করে ‘বন্দিদশায়’।
এই লেখার ধারাবাহিকতায়, মাহমুদ দারবিশের কবিতার অনুবাদের সংকলনের প্রস্তাব চমৎকার, সুমনকে অনুরোধ করছি সংকলনের কাজটি এগিয়ে নিতে ।
রেজাউল করিম সুমন - ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:১১ অপরাহ্ণ)
বিডিনিউজ-এর আর্টস পাতায় মাহমুদ দারবিশের কয়েকটি কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, জুয়েল মাজহার, বদরে মুনীর, অজয় দাশগুপ্ত এবং অবনি অনার্য। এখানে দেখুন।
Pingback: শরণার্থী নামটি যেভাবে পেয়েছে ফিলিস্তিন | মুক্তাঙ্গন : নির্মাণ ব্লগ
রেজাউল করিম সুমন - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১০:১২ অপরাহ্ণ)
হায়াৎ মামুদ কয়েক দফায় দারবিশের বেশ কয়েকটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। অতি সম্প্রতি ঢাকার ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ থেকে তাঁর অনুবাদে আমাদের প্রিয় এই কবির ২৮টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত মাহ্মুদ্ দার্বিশ্।