[মুক্তি মজুমদারের কথা আছে আমার আগের একটি লেখায়: ‘ওরা আসবে চুপিচুপি’।] * * * ১২ নভেম্বর ২০১৫। মারা গেছেন তিনি। তিলেতিলে একটি গাছ নিজের ফুল পাতা, ডালপালা, মূল, বাকল, তাঁর শান্তিশ্রী দিয়ে যেভাবে ধারণ করে, বন্ধুত্ব দেয়, বিন্দুমাত্র কিছু পাবার আশা না ক’রে, নিজের সমস্ত সম্পদ খরচ ক’রে (গাছের উপমা তিনি আগেও এই অর্থে ব্যবহার করতেন), তেমনি তাঁর নিঃশেষিত, জীর্ণ শরীর দেখে আমাদেরও ‘The Giving Tree’ গল্পটি মনে পড়ে যায়। তাঁর বাড়িতে একটিও শাড়ি পাওয়া যায় না তাঁর কফিন ঢেকে দেবার। সব দিয়ে দিয়েছেন। মনে পড়ে তাঁর শেখানো গান: ‘আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে/ ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে।...’ সেই অবহেলিত বাড়ি ‘আরণ্যক’-এ তবু এখন শিশুদের হাসি, পোষা শালিকের ডাক; আমাদের শিশু সারা দিন খড়ি ঘষে সেই মাটিতে, আঁকিবুকি কাটে। কিছু বোঝে না সে, চিতার আগুন দেখে। আমাদের জানায়, সে খুলনা ভালোবাসে। এখানেই থাকতে চায়। আরণ্যকের গাছগাছালি, আমি নিশ্চিত, নিঃশব্দে কাঁদে। তিনি চলে গেছেন – এখন কে তাদের প্রাণ দিয়ে আগলাবে? গাছ কি কেউ ভালোবাসে? গাছ তো সবাই কেটে নিয়ে বিক্রি করতে চায়। অন্তত বাংলাদেশে, বাংলায়, তো তাই নিয়ম। ছুটুমার এই সবুজ সন্তানদের কী হবে? আরণ্যককে তাঁরা করতে চেয়েছিলেন মুক্তবুদ্ধি চর্চার আদর্শ জায়গা – বনানীময় একখণ্ড আশ্রয় – সবার। মানুষ চলে গেলে তাঁদের ভিশন, তাঁদের পরিশ্রম, তাঁদের দর্শন, তাঁদের ত্যাগ আর আদর্শ কি আর আদর পায়? আমার সন্তান আমাকে জিগ্যেস করেছিল, ‘মা এই বাড়িটা কার?’ ছুটুমা থাকলে যে-উত্তর দিতেন সেটাই আমি দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, ‘সবার।’ শিশুর সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি। আগুনের শিখা আকাশে ওঠে। ছাই মিশে যায় ভৈরবের জলে। নিরন্তর যে গানটি গাওয়া হয় সেটি: ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ-জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।/ আমার এ দেহখানি তুলে ধরো/ তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো...।’ গানটি আগে অজস্রবার গাওয়া। আজ যখন সব দেওয়ার শেষে এক অনন্ত জীবন খোলস ছেড়ে আরও অনন্ত হচ্ছে, আগুনের শিখা আকাশে উঠছে, আর সেই জীবন মিশে যাচ্ছে জলে, বাতাসে, মেঘে, আমাদের মনের, চেতনার আকাশে তারা জ্বালাচ্ছে নতুন করে, তখন গানটি আজ সম্পূর্ণ অন্যভাবে পাই, আগে তো ভাবিনি এমনটা সম্ভব। চলে গিয়ে আবার গান চিনিয়ে…
রবীন্দ্র-সঙ্গীতশিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার (১৯৩৮–২০১৫) প্রয়াত হয়েছেন অল্প ক’দিন আগে – ১২ নভেম্বর। আজ, ২৮ নভেম্বর, তাঁর জন্মদিন। অসামান্য মানুষটিকে নিয়ে এই শোকলেখন।