সিঁড়ির শেষপ্রান্তে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি মায়ের চোখে আষাঢ় মাসের বৃষ্টি বান ডাকছে। ছুটে নেমে আসতে চাইলে মা হাত নেড়ে বারণ করল। আমি আবার এগিয়ে গেলাম। পিছনে মায়ের চোখের জল আর সামনে আকাশ ফুঁড়ে উড়ে যাবার রথ। [...]

কোনো এক আষাঢ়-সন্ধ্যায় মা এসেছিল আমাকে এগিয়ে দিতে। এয়ারপোর্টের কোলাহল শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা সব কিছুর মধ্যে আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। মা তখন ভীষণ ধীর স্থির, পাশে বসে কেবল আমার দীর্ঘ যাত্রাপথের ভাবনায় অন্যমনস্ক। মাকে পেছনে রেখে আমি যখন সিঁড়ি ভাঙছি মা আমার তরতর করে উঠে যাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। সিঁড়ির শেষপ্রান্তে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি মায়ের চোখে আষাঢ় মাসের বৃষ্টি বান ডাকছে। ছুটে নেমে আসতে চাইলে মা হাত নেড়ে বারণ করল। আমি আবার এগিয়ে গেলাম। পিছনে মায়ের চোখের জল আর সামনে আকাশ ফুঁড়ে উড়ে যাবার রথ। চার বছর আগের সেই আষাঢ় মাসের বর্ষণহীন সন্ধ্যা আজও মাঝে মাঝে ভিজিয়ে দেয়। দেশে যখন মাস জুড়ে বৃষ্টির উৎসব এখানে তখন কনকনে ঠাণ্ডা। এদেশে গ্রীষ্মে বৃষ্টি হয় না। পুরো শীতকাল এখানে বৃষ্টি মাখানো। বরফের কণার মতো কনকনে ঠাণ্ডা বৃষ্টিতে এখানে কেউ ভেজে না। বর্ষাতি ভুলে গেলে যদি-বা ভিজতে হয় মাঝেসাঝে, সে-ভেজায় আনন্দের বালাই থাকে না, বরং শরীর খারাপ করার উৎকণ্ঠা মাথা চাড়া দিতে থাকে। এদেশে আবহাওয়ার খবরে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয় না। এরা বরং শতকরার হিসেবে জানিয়ে দেয় বৃষ্টির সম্ভাবনা। তবু বৃষ্টি হলেই পুরনো দিন, বৃষ্টি হলেই সমস্ত নিষেধাজ্ঞা গুঁড়িয়ে দিয়ে ভেজার উল্লাস। মনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান – ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়/ ও সেই...’ বর্ষণহীন খটখটে রোদের দিনেও ভিজিয়ে দেয়। যেমন করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আর সমস্ত গানের ভিতর দিয়ে ভিজিয়ে দিতে চান। বর্ষার গান নয়, তবু কোনো কোনো মেঘলাদিনে ট্রামের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে গুনগুন করি – ‘এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে/ তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,/ গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে/ তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে/ জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে...।’ আপনা থেকেই চোখের পাতা ভারী, বুকের ভিতর বৃষ্টি। ট্রামের ভিতর একটা পুরো সিটের দখল নিয়ে বসি। হেলেদুলে ট্রামটা আমায় পৌঁছে দেয় সমুদ্রের কাছে। সামনের বিশাল বিক্ষিপ্ত জলারাশি, মাথার উপর অসীম আকাশ, তার নীচে দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র আমি, দীন আমি নিজের না হয়ে-ওঠাকে উল্টেপাল্টে দেখি। রবীন্দ্রনাথ তখনও পিছু ছাড়েন না, মনের ভিতরটা, চোখের কোলটা ভিজিয়ে দিয়ে আমাকে দিয়েই গাইয়ে নিতে চান – ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে...’। এই রকমের অজস্র…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.