মারগুরিত দ্যুরাজ সর্ম্পকে প্রাসঙ্গিক

ফরাসি নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র গোষ্ঠীর অন্যতম মেধাবী চলচ্চিত্রকার আলা রেনের 'হিরোশিমা মন আমুর' মুভিটা দেখে জন্মানো আগ্রহ থেকে প্রথম জানতে পারি মারগুরিত দ্যুরাজ সর্ম্পকে [..]

ফরাসি নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র গোষ্ঠীর অন্যতম মেধাবী চলচ্চিত্রকার আলা রেনের ‘হিরোশিমা মন আমুর’ মুভিটা দেখে জন্মানো আগ্রহ থেকে প্রথম জানতে পারি মারগুরিত দ্যুরাজ সর্ম্পকে। দ্যুরাজ ছবিটার লেখক ছিলেন। ছবিটার লেখক হিসেবে কানে ও বার্লিনে তিনি যথেষ্ট সম্মানও পেয়েছেন। পরে তিনি নিজেও বেশকটি ছবির পরিচালনা করেছেন। যদিও তাঁর পরিচালিত কোনো ছবি দেখার এখনব্দি সৌভাগ্য হয় নাই। L’Amant ( লাঁম বা প্রেমিক) তার আত্মজীবনী মুলক এই ফিকশনটার গোপনে গোপনে প্রতীক্ষায় ছিলাম বলা চলে। বইটির খোঁজ কারো কাছে পাই নাই। জানতামও না কলকাতার এবং মুশায়েরা থেকে বইটার অনুবাদ বেরিয়ে গেছে। যাইহোক নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের মুল ফরাসী থেকে অনুদিত এই ছোট বইটি শাহবাগে পেয়ে গেলাম। দ্যুরাজের  প্রতি দুর্দান্ত টানের কারণে বইটা কিনলেও পাতা উল্টিয়ে দেখা গেল প্রথম পৃষ্ঠাটা টানছেনা। যে বই প্রথমেই তার সঙ্গী করেনা তার কাছে ফিরে আসতে সময় লাগে। কেননা একসাথে বেশকটি বই পড়ার লিস্টে থাকে।
লামঁ-মারগুরিত দ্যুরাসের এই বইটি কেনার পর তিন তিনবার ব্যর্থ হয়ে ভেবেছি টাকাটা জলে গেল নাতো। বইটা এতো সুন্দর ছোট মনে হয় সব কাজকামের আগে এইটা শেষ করে নেই। কিন্তু তিন তিনবার ব্যর্থ হবার পর দেখা গেল ইতোমধ্যে বাকী বইগুলো খতম। পয়সা হাসিল করার মানসিকতা নিয়ে আবার পড়তে থাকি।
এবার  মারগুরিতের ভাষায় বলতে হয় এযে নিরাকার সমুদ্র।
সেটা ছিল ফরাসিদের উপনিবেশ বিস্তারের সময়কাল। ইন্দোচীন তথা বর্তমানের ভিয়েতনাম এ নভেলের পটভূমি। উপনিবেশ শেষ হয়ে যাবার পরও বিভিন্ন সমস্যায় আটকে থাকা একটি পরিবার। দায় দেনায় জর্জরিত। মাষ্টারনি গৃহকর্ত্রী যার স্বামী সদ্যগত। দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলেটি মায়ের প্রশ্রয়ে নস্ট, যে নিজের ভাইবোনের কাছে সবসময় অত্যাচারী সম্রাট। আর পনের বছরের তুলতুলে মিষ্টি মেয়েটি যে কিনা বেরিয়ে পড়তে চাইল এই অসহ্য এক ঋতুর গ্রীষ্মের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও অথবা ফ্রান্সের দিকে। মা তাকে জিজ্ঞেস করে কি তুমি করতে পারো? আর সে বলে।

তাকে আমি বলেছিলাম যে লিখতে চাই। যা কিছু চাই তার মধ্যে সব চাইতে বেশী চাই লেখক হতে আর কিছু হতে চাইনা।
তার সহ্য হলোনা। একনজর থাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল। কাধের একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি। ভোলা যায়না। আমিই প্রথমে চলে গেলাম। আমাকে খোয়াবার আগে আমার মাকে আরও বছর খানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমাকে খোয়াবার জন্য এই বাচ্চাটাকে হারাবার আগে। ছেলেদের জন্য তার ভয় ছিল না। কিন্তু এটা সে জানত চলে যাবে, এ বেরিয়ে যেতে পারবে। ক্লাসে ফরাসিতে ফার্স্ট। মাস্টার মশাই মাকে বলেছিলেন-ক্লাসে আপনার মেয়ে ফরাসিতে সবচাইতে সেরা। আমার মা কিছু বলল না। কিছু না। মোটেই খুশি নয় সে কারন তার তার ছেলেরা ফরাসিতে প্রথম হয়না। নোংরা আর মিষ্টি মা আমার জিজ্ঞাসা করল, আর অংকে? উত্তর হল- এখনও নয় তবে হবে। মা জিজ্ঞাসা করল: কবে হবে?
উত্তর হল- ও যখন চাইবে।

কিন্তু না সে অংকে সেরা হতে চায়নি। সে চেয়েছিল লিখতে, লেখক হতে। মা বলেছিল লেখাটা কোনো কাজই না। আর সে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ী থেকে। এরপর মেকং নদী পার হবার বজরায় এক চিনের সাথে তার পরিচয় যে কিনা কিছু দিন আগে ফ্রান্স থেকে ফিরেছে। বজরা ডাঙ্গায় ভিড়লে সে বলেছিল আমার লিমুজিনে যাবে তোমাকে পৌঁছে দেব। মেয়েটি তাকে অনুসরণ করলো। এরপর তার সাথে জড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। এরপর ক্রমে সে আসক্ত হয়ে পড়ে মাদকে আর সমকামিতায়। মোট কথা সমস্ত প্রথা ভেঙ্গে সে ক্রমে ব্যক্তি হয়ে ওঠে। মোট কথা ৬০ পৃষ্ঠার ছোট এ উপন্যাসটা উপন্যাসেরও সমস্ত ফর্ম ভাঙ্গার উপন্যাস হয়ে ওঠে। কিন্তু অদ্ভুত আন্তরিক আত্মা ও রক্ত দিয়ে লেখা। চৈতন্যকে এক জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
ফরাসী লামঁ শব্দের অর্থ প্রেমিক। মারগুরিত জন্মেছিলেন ইন্দোচীনে ১৯১৪ সালে। মৃত্যু ১৯৯৬ সালে। এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। এ উপন্যাস শুধু যে ফরাসি বিখ্যাত পুরস্কার গঁক্যুর বাগিয়ে নিল তা নয়। দ্যুরাসকে দিয়েছে ৩ মিলিয়ন বিক্রিত বইয়ের লেখিকার সম্মান। পৃথিবীর অন্তত ৪০ টি ভাষায় অনুদিত। জাঁ জাক আনো এটি চলচ্চিত্র রূপ দেন। বলা যায় এটি নিয়ে শুরু হয় ফরাসি সাহিত্যের NOUVEAU ROMAN বা নব-উপন্যাস আন্দোলন। পুরা উপন্যাসটায় কোনো ধারাবাহিকতা নাই। কিন্তু কেমন যেন গুছানো। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার বহু বহু দিন পর চিনে লোকটি তার নববধূ সহ পারিতে এলে একদিন ফোন করে মেয়েটিকে বলে: আমি শুধু তোমার কন্ঠস্বর শুনতে চেয়েছিলাম। যদিও তাদের প্রেমটায় দেহ ছাড়া অন্য কিছু ছিলনা। অনেক পরে তারা বুঝতে পারে সে আসলে তারা পরস্পরের প্রেমে পড়েছিল। সার্ত্র আর মালার্মে সহ তৎকালীন পারির লেখকরা ওঠে আসে বিভিন্ন অধ্যায়ে।

৪ comments

  1. মাহতাব - ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:৩৭ অপরাহ্ণ)

    লেখাটা ভাল লাগল। লেখককে ধন্যবাদ ।

  2. nizam udin - ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১১:৪০ অপরাহ্ণ)

    boi’ta kiney rekhechi onekdin hoy.mrittu niye’o boudhoy Douraser arekti uponnash ache amar songrohe.
    ekhoni boi duto khuje nichchee.

  3. অবিশ্রুত - ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:৪০ পূর্বাহ্ণ)

    মারগুরিত দ্যুরাজ সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করানোর জন্যে ধন্যবাদ জাহেদ সরওয়ারকে। যতদূর জানতে পারছি, পঞ্চাশের দশকের ফ্রান্সে নব-উপন্যাস আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এবং NOUVEAU ROMAN এই শব্দ-যুগলকে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন এমিল হেনরিয়ট ফ্রান্সের বিখ্যাত দৈনিক লাঁ মাঁদ-এর ১৯৫৭ সালের কোনও এক সংখ্যায়। তবে এটি সত্যিকার অর্থে একটি আলাদা স্থান তৈরি করে নেয় অ্যালেন রব-গ্রিলেট-এর প্রচেষ্টাতে,- যিনি ধারাবাহিকভাবে এ নিয়ে প্রবন্ধ রচনা অব্যাহত রাখেন এবং বিভিন্ন উপন্যাসকে ওই সংজ্ঞার নিরিখে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করে চলেন; এইভাবে সমালোচনা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পায় NOUVEAU ROMAN, পাঠকদের তিনি দেখিয়ে দেন, কীভাবে কতিপয় উপন্যাসের ভাষা, বিষয় ও স্টাইলের মধ্যে দিয়ে নতুন এক পর্বের সূচনা ঘটেছে ফ্রান্সে। ব্যক্তিকেই উপজীব্য করে তোলা ছিল এইসব উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
    বাংলাদেশে সমালোচনা সাহিত্যের বিকাশ ও তুলনামূলক সাহিত্যতত্ত্বের দুর্বলতার কারণে অনেক সাহিত্যই যথাযথ পরিচিতি পায়নি, নতুন একটি যুগপর্বকে ধারণ কিংবা ইঙ্গিত করছে, বিকশিত করছে এরকম চিহ্ন বিভিন্ন উপন্যাসে থাকার পরও ব্যক্তি এখনও এখানকার উপন্যাসে যথেষ্ট দুর্বলই মনে হয়। আর যে-সব উপন্যাসে ব্যক্তির উপস্থিতি আমরা টের পাই, সেগুলিকে অনেকেই পশ্চিম-প্রভাবিত বলে উড়িয়ে দেন (হয়তো এর পেছনে ব্যক্তি শিল্প-উন্নত পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ফসল, বিচ্ছিন্নতাবোধ পুঁজিবাদী সমাজের সৃষ্টি এই ধারণা কাজ করে এই প্রবণতার পেছনে); তারপরও বলব, ব্যক্তির উপস্থিতি ও ব্যক্তিচৈতন্য অনেক উপন্যাসেই এখানে ধরা পড়েছে; বরং সাম্প্রতিক সময়ে তা লোপাট হওয়ার পথে।

  4. জাহেদ সরওয়ার - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১২:২১ অপরাহ্ণ)

    অনেক তথ্য অবিশ্রুতকে ধন্যবাদ।

    আর nizam udin কে বলছি,mrittu niye বইটার একটু খোঁজ খবর দিলে উপকৃত হবো।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.