সদ্যপ্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' বই থেকে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি এখানে তুলে দিলাম। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও ভারতে মওলানা ভাসানীর অঘোষিত গৃহবন্দিত্ব নিয়ে ফয়েজ আহমদের এই অনবদ্য রচনাটি আমার খুবই প্রিয় -- অসাধারণ গদ্য এবং রাজনৈতিক কাহিনী ও মুহূর্তের প্রকাশের এক অনন্য দলিল এই লেখাটি। মওলানা ভাসানীর ভারত আবিষ্কার ফয়েজ আহমদ মওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালেই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লন্ডনে বিপ্লবী অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরিকল্পিত এই বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই তিনি একাত্তর সালের আটই এপ্রিল লন্ডনের পথে আত্মগোপন করে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। ভারত থেকে লন্ডন পৌঁছানোর সহজ পথ বেছে নেবার সিদ্ধান্তটি ছিল ভ্রান্ত। এই রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের ফলেই তিনি ভারত সরকার কর্তৃক অঘোষিত গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। এবং তাঁর বিপ্লবী সরকার গঠনের পরিকল্পনাটি স্বাভাবিকভাবেই বানচাল হয়ে যায়। জীবনে তাঁর সবচাইতে বেদনাদায়ক ঘটনা ছিল এই ব্যর্থতা। দেশ স্বাধীন হবার পর তিয়াত্তর সালে সন্তোষে সগৃহে অঘোষিত অবস্থায় বন্দী থাকার পরবর্তীকালে মওলানা ভাসানী একটি দৈনিকের সাক্ষাৎকালে এই বেদনার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন : তেসরা ডিসেম্বর (১৯৭০) পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আমিই প্রথম দিয়েছিলাম। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তব কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে! আর একবার তিনি মর্মাহতই শুধু হননি, ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি দেরাদুনে আদর আপ্যায়নের মধ্যে আটকাবস্থায় আগস্ট মাসেই জানতেন যে, ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। ভারত সরকারের বৈদেশিক দফতরের উচ্চপদস্থ অফিসার মিঃ নাগ্রানী একবার মওলানা সায়েবের সঙ্গে দেরাদুনে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সে সাক্ষাতের সময় মওলানা ভাসানী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপনার সরকারের সুস্পষ্ট ভূমিকা কি? মিঃ নাগ্রানী ইঙ্গিতবহ উত্তর দিয়ে বলেন : ডিসেম্বরের দিকে। মওলানা সায়েব পরবর্তীকালে নানা ঘটনার সূত্র ধরে ভারতে আটক অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করতেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনটাই ছিল বিদ্রোহ ও অভিযানের। ঐতিহাসিকভাবে এ কথা সত্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তিনি প্রথম ছাপ্পান্ন সালে কাগমারী সম্মেলনে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকাশ্য হুমকী দিয়ে বলেছিলেন : শাসন-শোষণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমরা তোমাদের আচ্ছালামো আলাইকুম বলতে বাধ্য হব। অর্থাৎ পূর্ব…
তিনি যদি ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত না নিতেন, তবে হয়তো তাঁর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই নেন। সে সময় মওলানা সায়েব নিজের বাড়ি হারিয়ে (পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর সন্তোষের বাড়ি ইতিমধ্যেই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল।) ব্রহ্মপুত্র নদে নৌকার মধ্যে বাস করতেন। নৌকায় আত্মগোপন কালে নিজ পার্টি ন্যাপ-এর সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিল না।[...]