সম্ভবত নয়-দশ বছর আগের কথা। কোন সাল এখন আর নিশ্চিত করে মনে নেই; তবে দিনটা ছিল অক্টোবর মাসের তেইশ তারিখ। [...] ... শেষ যে-বার সে-বাড়িতে যাই, ড্রইংরুম অব্দি আর যেতে হয়নি। বারান্দাতেই দুটো চেয়ার পাতা ছিল, সেখানে বসেই কথা চলল খানিকক্ষণ। [...] ... অধুনালুপ্ত 'নতুন সাহিত্য' পত্রিকার একেবারে প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার পাতা উল্টাতে গিয়ে একবার চোখ আটকে গিয়েছিল একটি কবিতায় [...]

সম্ভবত নয়-দশ বছর আগের কথা। কোন সাল এখন আর নিশ্চিত করে মনে নেই; তবে দিনটা ছিল অক্টোবর মাসের তেইশ তারিখ। বাসা থেকে বেরিয়ে ফোনের দোকানে পৌঁছতে প্রায় পৌনে ন’টা। ও-পাশ থেকে নারীকণ্ঠ শুনে বুঝে নিই, দেরি করে ফেলেছি। ‘একটু লাইনে থাকুন।’ খানিকক্ষণ পর পরিচিত সেই চপ্পলের আওয়াজ। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে নিজের রুমে পৌঁছলেন তিনি। তিন-চার মিনিট কথা হলো। জানালেন খুব খুশি হয়েছেন ফোন পেয়ে। আমারও খুব খুশি লাগছিল সকালেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরে। আর বিব্রতও লাগছিল। আধঘণ্টা আগে ফোন করলেই তাঁকে কষ্ট করে সিঁড়ি ভাঙতে হতো না। কথা শেষে আবার নিশ্চয়ই ফিরে গেলেন নীচে, চপ্পলে ফট্‌ফট্‌ আওয়াজ তুলে। বই-দিয়ে-ঘেরা সুপরিসর ড্রইংরুমে এরই মধ্যে জড়ো হয়েছেন অনেকে। তাঁরা এসেছেন তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে। আজ তাঁর জন্মদিন।

শেষ যে-বার সে-বাড়িতে যাই, ড্রইংরুম অব্দি আর যেতে হয়নি। বারান্দাতেই দুটো চেয়ার পাতা ছিল, সেখানে বসেই কথা চলল খানিকক্ষণ। চা-ও চলে এল অল্পক্ষণের মধ্যে। আগে বাইরে থেকেই চোখে পড়ত দেয়ালে ঝোলানো মুর্তজা বশীরের ‘এপিটাফ’ সিরিজের একটা ছবি, কয়েক বছর আগে সেটাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া হয়েছে। জানা ছিল না যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে অল্পকাল আগে তাঁর একটা বই বেরিয়েছে — পাণ্ডুলিপি সংস্করণ। দেখলাম। আর জানলাম ছায়ানট ভবনে তাঁর নামে একটা কক্ষ করা হয়েছে। তাঁর সংগ্রহের সবগুলো বই সে-কক্ষে সংরক্ষণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ছায়ানট। তাহলে কি সব বই দিয়ে দেয়া হবে? না, এখনো মত দেয়া হয়নি তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে। দেখা যাক। আগের মতোই কি আছে তাঁর বইগুলো, বিছানা-ঘেরা শেল্‌ফে পরিপাটি সাজানো আর লেখার টেবিলের উপর এলামেলো হয়ে? কিছুই পালটায়নি। যেভাবে রেখে গেছেন ঠিক সেভাবেই রাখা আছে সবকিছু তাঁর ঘরে। ‘দোতলায় গিয়ে দেখে আসবে নিজের চোখে?’ না, থাক। আবার আসব, হ্যাঁ, ফোন করেই আসব। বিদায় নিই তাঁর পুত্রবধূর কাছ থেকে।

অধুনালুপ্ত নতুন সাহিত্য পত্রিকার একেবারে প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার পাতা উলটাতে গিয়ে একবার চোখ আটকে গিয়েছিল একটি কবিতায় — ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগনে’। কবিতাটির নীচে সম্পাদক অনিলকুমার সিংহ একটি টীকা জুড়ে দিয়েছিলেন :

বহু মুসলমান শরণার্থী আজ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দাক্ষিণ্যে পরিত্যক্ত ও অকেজো রেলওয়ে ওয়াগনে দিন যাপন করছে। উপরোক্ত কবিতাটি বিহারের তেমনি একটি হতভাগ্য বাস্তুহারা পরিবারকে কেন্দ্র করে লেখা।

প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে-তে তো নয়ই, এমনকী কবির পরবর্তী কোনো কাব্যগ্রন্থেও এ কবিতাটি দেখিনি! পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম কবিতাটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন, সে-কারণেই কখনো আর গ্রন্থভুক্ত হয়নি।

সেই কবিতা রচনার পটভূমি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে (কালের ধুলোয় লেখা, ২০০৪) :

পরীক্ষায় কৃতিত্বের ঝলক দেখাতে না পারলেও কবিতা রচনার ক্ষেত্রে আমার কিছু সাফল্য ধরা পড়েছিল সে-সময়ে কারও কারও কাছে। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী আমার লেখায় একজন ভালো কবির আভাস পেয়েছিলেন — এ কথা আমি বুঝতে পারি তাঁর উদার আচরণে। মনে পড়ে, একদিন দুপুরে তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে তাঁর বাসার দিকে রওয়ানা হন। তাঁর বাসা ছিল ওয়ারিতে। তিনি সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতেন। তিনি সেদিন সাইকেলে সওয়ার না হয়ে পুরো রাস্তাই সাইকেল হাতে করে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাসায় পৌঁছেন। চলার পথে তিনি ফুলবাড়িয়া স্টেশনের রেললাইনে রাখা কিছু বাতিল রেলওয়ের ওয়াগনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাকে বলেন, ‘দেখ মানুষের কী দুর্ভোগ।’ আমি ওয়াগনের দিকে তাকিয়ে দেখি ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ক’জন নারী, পুরুষ এবং শিশু ওয়াগনের ভিতর বসে আছে। এরা সবাই রিফিউজি, যারা বিহার থেকে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব ওয়াগনের ভিতরেই এরা দিনরাত কাটাচ্ছে। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী বললেন, ‘এসো আমরা দু’জনই এদের নিয়ে কবিতা লিখি।’

পরবর্তী ঘটনাও এ কালের পাঠকের পক্ষে কৌতূহল-উদ্দীপক :

… অধ্যাপক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর ড্রইংরুমে একদিন স্বয়ং গৃহকর্তা এবং আমি ওয়াগন বিষয়ে কবিতা পড়লাম। আমার কবিতাটির নাম ছিল ‘কয়েকটি দিন, ওয়াগনে’। সৈয়দ নূরুদ্দিন সে-কালে একটি উঁচুদরের সাহিত্যপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই সম্ভাব্য পত্রিকার জন্যে তিনি লেখা সংগ্রহ করছিলেন। সম্পাদক সৈয়দ নূরুদ্দিন স্যারের কবিতাটি চাইলেন। কিন্তু স্যার কবিতা দিলেন না। তিনি সম্পাদককে আমার উপস্থিতিতেই বললেন, ‘শামসুর রাহমানের কবিতাটি আপনার পত্রিকার জন্যে নিন। ওর কবিতা আমার কবিতার চেয়ে অনেক বেশি ভালো হয়েছে।’ স্যারের এই বিরল ঔদার্যে আমি স্তম্ভিত তো হলামই, আমার চোখও ছলছলিয়ে উঠল। সৈয়দ নূরুদ্দিন আমার কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ কবিতাটি চেয়ে নিলেন এবং মানিব্যাগ থেকে পঁচিশ টাকা বের করে আনাড়ি, তরুণ কবিকে দিলেন। সেকালে একটি কবিতার জন্যে পঁচিশ টাকা পাওয়া ছিল মস্ত ব্যাপার। দুঃখের বিষয়, সেই পত্রিকা কখনও দিনের আলো দেখে নি। পরে আমি পঁচিশ টাকা ফেরত দিতে চাইলেও সৈয়দ নূরুদ্দিন সেই টাকা কিছুতেই নিতে চান নি। তারুণ্যের ভোরবেলায় লেখা সেই কবিতা অনিল সিংহ সম্পাদিত এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত উন্নতমানের প্রগতিশীল পত্রিকা ‘নতুন সাহিত্যে’ প্রকাশিত হয়েছিল। আমার এই কবিতায় সোৎসাহে সুর সংযোজন করেছিলেন বন্ধু হামিদুর রহমান। পরে হামিদের ভাই সাঈদ আহমদ সেই সুরটি সেতারে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে বাজান।

সেই কবিতা আখেরে কোথায় হারিয়ে যায়, আমার কোনও কাব্যগ্রন্থেই ওর ঠাঁই হয় নি।

নতুন সাহিত্য-র দ্বিতীয় বর্ষ অষ্টম সংখ্যায় (অগ্রহায়ণ ১৩৫৮) প্রকাশিত সেই কবিতাটি আজ তাঁর জন্মদিনে পড়া যাক আবার। দু-একটি শব্দের বানান আমাদের পালটে নিতে হবে এখন। কিন্তু সেই সঙ্গে লক্ষ করব, এক তরুণ কবির একুশ-বাইশ বছর বয়সে লেখা কবিতাটির গায়ে, অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পরেও, এতটুকু মরচে পড়েনি!

কয়েকটি দিন : ওয়াগনে

ধূসর বাতাস। ঝাঁঝালো রৌদ্র। ক্ষীণ আকাশ।
সকাল সন্ধ্যা লোহার খাঁচায় দিন কাটাই।
অচিন শহর। ভিন্ন জীবন। নতুন মুখ।
ধোঁয়াটে মনের স্যাঁৎসেঁতে কোণে নড়ছে মাছি,
বোনের কান্না! বৃদ্ধ পিতার ভীষণ কাশি!
বিষণ্ণ দিনে সহসা তাকাই : কোথায় আছি?

ধূসর বাতাস। ঝাঁঝালো রৌদ্র। ক্ষীণ আকাশ।
সকাল সন্ধ্যা লোহার খাঁচায় দিন কাটাই।

বাড়িঘর সব পুড়ে হল ছাই : আমার বাড়ি!
দস্যুর হাতে প্রাণ দিল ভাই : আমার ভাই!
চোখের সামনে মরেছে অনেক আপনজন।
তারপর বহু মৃত্যু এড়িয়ে, ‘বিহার’ ছেড়ে
রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে গাছতলাতে
কাটিয়েছি দিন, এমনি করেই দিন কেটেছে!

আহা সে কত না ভুট্টার ক্ষেত ভালোবেসেছি,
আহা সেই কত নীল শালবন আমার চোখে
ছায়া ফেলে আজও! বান্ধবী কত যত্ন করে
চুল দিত বেঁধে : সেই কথা আজ পড়ছে মনে।
কোনো কোনো দিন কালো সন্ধ্যায় মা-র কবরে
দাঁড়াতাম গিয়ে : সেই কথা আজ পড়ছে মনে।
আহা সেই পথ! ধু ধু শাদা পথ! গ্রামের পথ!
আহা সেই মাঠ! ফসলের মাঠ! গমের শিষ!

এখানে এখন নিঃসাড় চাঁদ। মৃত আকাশ।
বহু রাত ধরে ঘুম হয়নিকো, হয়নি ঘুম।
বোনের কান্না! বৃদ্ধ পিতার ভীষণ কাশি!
ক্লান্ত রাত্রে ট্রেনের শব্দে ঘুম আসে না!
কয়লার গুঁড়ো আকাশে ছড়ায়। ক্ষীণ আকাশ।
অনেক স্বপ্ন ঢাকা পড়ে গেছে ধুলার চাপে।

ধূসর বাতাস। ঝাঁঝালো রৌদ্র। ক্ষীণ আকাশ।
সকাল সন্ধ্যা লোহার খাঁচায় দিন কাটাই।

এই নিয়ে আমি অনাহার আর ব্যাধির সাথে
লড়েছি অনেক; তপ্ত দুপুরে লোহার মেঝে
আমার বোনের কচি দুটি পা পুড়ে গেছে!
বোনের কান্না! বৃদ্ধ পিতার ভীষণ কাশি!
ঝাঁঝালো রৌদ্রে সহসা তাকাই : কোথায় আছি?

শুনেছি এখানে মদের পাত্রে খুনের স্বাদ!
শুনেছি এখানে পরীর মতো মেয়েরা সব
আমি তো অবাক : নৈশ আসরে ঘুরে বেড়ায়!
পরীদের মতো মেয়েদের সব মদির চোখ!
এই তো এখন রুগ্‌ণ বোনটি জ্বরের ঘোরে
তপ্ত দুপুরে ছট্‌ফট্‌ করে লোহার মেঝে!
চটের পর্দা সরিয়ে তাকাই : কোথায় আছি?

সকাল সন্ধ্যা লোহার খাঁচায় দিন কাটাই।
প্রতিদিনকার দুঃসহ ব্যথা বেড়েই চলে।
বোনের কান্না! বৃদ্ধ পিতার ভীষণ কাশি!
ক্লান্ত রাত্রে ট্রেনের শব্দে ঘুম আসে না।
স্বপ্ন মলিন, তবুও আকাশে হাত বাড়াই!
সোনালি বিকেলে হঠাৎ সেদিন পথ-চলতি
একটি ছেলের উজ্জ্বল চোখে দেখেছি যেন
ঘৃণ্য দিনের মৃত্যুর কথা রয়েছে লেখা।

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

৭ comments

  1. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৩ অক্টোবর ২০০৯ (১০:৫৫ অপরাহ্ণ)

    এ তো সরাসরিই বোঝা যায় যে, লেখাটিতে কবি শামসুর রাহমানকেই স্মরণ করা হচ্ছে। তবে লেখাটির বড়ো মজার দিকটি হচ্ছে, এতে একধরনের কাব্যিক ল্যাবিরিন্থ আছে। আমার তো ধারণা করতেই ভালো লাগছিল যে, আমরা অতঃপর এক প্রেমের জগতে অবগাহন করতে যাচ্ছি। এতে প্রেম অবশ্যই আছে, তবে তা গুরুতর কামজ প্রেম নয়। তবে সব মিলিয়ে তাতে কাব্যগল্পের আবহ আছে, স্মৃতিকথার জ্যান্ত রূপ প্রতি পরতে পরতে মিশে আছে।
    কবিকে স্মরণে রাখার এমন আয়োজন খুবই প্রয়োজনীয় এক ব্যাপার।
    সুমনকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

  2. মুয়িন পার্ভেজ - ২৪ অক্টোবর ২০০৯ (১১:২৬ পূর্বাহ্ণ)

    ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগনে’ কবিতাটি প্রথম পড়ার সুযোগ পেয়েছি প্রথম আলোয়, শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পরেই (হাতের কাছে পত্রিকাটি না থাকায় তারিখ জানানো যাচ্ছে না); যদ্দূর মনে পড়ছে, রেজাউল করিম সুমনের নাম ছাপা হয়েছিল যেভাবে সাধারণত চিঠিপত্র কলামে ছাপা হয়ে থাকে। বর্গীকরণের এও এক উদাহরণ। কবিতাটি তখনই খুব ভালো লেগেছিল, এখনও প’ড়ে ঠিক নতুন কবিতাপাঠেরই স্বাদ পেলাম আবার। রাহমানের বহু সফল জনজীবনঘনিষ্ঠ কবিতারই সহচর এ-কবিতা এবং দেখা যাচ্ছে, কবিসত্তাবিকাশের প্রথম পর্যায়েও তিনি এ-বিষয়ে সচেতন : কেবল আত্মরতিময়তায় নিমগ্ন থাকতে চাননি (যদিও আমার মনে হয়, আত্মরতি ও নার্সিসিজম থেকেই সমস্ত শিল্পের প্রণোদনা, উদ্ভব ও বিকাশ)।

    মাত্রাবৃত্তে ৬+৬+৫ মাত্রার চালে রচিত দীর্ঘ কবিতাটির ৩৩-সংখ্যক পঙ্‌ক্তির গড়ন কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমী :

    আমার বোনের কচি দুটি পা পুড়ে গেছে!

    ৩৭-সংখ্যক পঙ্‌ক্তিতেও দেখি :

    শুনেছি এখানে পরীর মতো মেয়েরা সব

    কৌতূহল এই : প্রথম উদ্ধৃতিতে দুই মাত্রার ও দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে এক মাত্রার কোনো শব্দ কি খোয়া গেছে, না এমনই ছিল মূল কবিতায়?


    চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত কবিতাপত্র চর্যাপদ-এর (সম্পাদক : সাইদুল ইসলাম, নায়েম লিটু ও অঞ্জন সরকার জিমি) একটি সংখ্যা শামসুর রাহমানের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত হয়েছিল; এর প্রথম কবিতাটি, যা রাহমান-প্রাসঙ্গিক, রেজাউল করিম সুমনের লেখা। অক্ষরবৃত্তারোহী এ-কবিতা রাহমানের স্বরভঙ্গিকেই এমন নিখুঁতভাবে আত্মস্থ করেছে যে প’ড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম — স্মৃতিতর্পণের অনন্যসুন্দর উদাহরণ হয়ে থাকবে এটি। ‘মুক্তাঙ্গন’-এর পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি এখানে :

    প্রতিপক্ষ

    ‘প্রত্যেক সপ্তাহে তাঁকে দু’-এক ফর্মা কাগজের
    সফেদ নগ্নতা জুড়ে এঁকে দিতে হবে কালশিরে
    তীক্ষ্ণ নিবের ঘায়ে — এই দিব্যি কে দিয়েছে, জানো?’
    ব’লে সেই মেধাবিনী বিপর্যস্ত তরুণের দিকে
    অপাঙ্গে তাকাল। ‘কাকে যেন ডেকে ডেকে
    কবি আজ রক্তচক্ষু কোকিলের প্রায়, তুমি কোনো
    খোঁজটোজ রাখো?’

    টেলিফোন ইনডেক্স খুলে
    একটা নম্বর টুকে তরুণের অনিচ্ছুক হাতে
    চিরকুট গুঁজে দিল : ‘এ নম্বরে তুমি তাঁকে পাবে,
    অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিয়ো। শ্যামলী যাবার আগে
    আমাকেও ব’লো।’ … স্বরভঙ্গি পাল্টে যায় তার,
    স্নিগ্ধ কৌতুকে সে দয়িতকে জিজ্ঞেস করে : ‘কবি
    না কি এই আমি — কে তোমার অস্তিত্বের গান?’

    (চর্যাপদ, বর্ষ ৪, সংখ্যা ১১, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ. ৩)

    মনে মনে একটু আক্ষেপও হয় — সেই ‘মেধাবিনী’র দেখা হয়তো পাব না এ-জীবনে, যে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে রাহমানের কবিতা, যার ভ্যানিটি ব্যাগে কবির ব্যক্তিগত ফোন নম্বর! না পাই, তবু এই আশ্বাস তো আছে : ‘আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কপোতাক্ষ আছে’।

  3. votto kamal - ২৬ অক্টোবর ২০০৯ (১২:১১ অপরাহ্ণ)

    এই লেখকের লেখা ব্যক্তিক স্মৃতিময় আরো কিছু লেখা মুক্তাঙ্গনে দেখা গেছে। লেখাগুলেরার উদ্দেশ্য যেন কারকার সাথে অত্র পোস্টের লেখকের পরিচয় ছিল এসব জানানো। সাহিত্যপাড়ায় কিছু বালক থাকে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পিছু পিছু দৌড়ানো যাদের জীবনের লক্ষ্য। অত্র লেখককে সেরম অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাবতে ভাল লাগছেনা। লেখা থেকে আমিত্বকে যতটা বহিস্কার করা যায় মনে হয় ততটা লেখাটা সম্মৃদ্ধ হয়। এ কথাটি যে সব স্মৃতি কথাও মহত সাহিত্য হয়ে উঠেছে তা দেখলে বুঝা যায়। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা আমার উদ্দেশ্য না, একজন সম্ভাবনাময় লেখককে তার সম্ভাবনার কথা স্মারণ করিয়ে দেয়ার জন্য এ দোহাই।

    • মুয়িন পার্ভেজ - ২৬ অক্টোবর ২০০৯ (২:২২ অপরাহ্ণ)

      এই লেখকের লেখা ব্যক্তিক স্মৃতিময় আরো কিছু লেখা মুক্তাঙ্গনে দেখা গেছে। লেখাগুলেরার উদ্দেশ্য যেন কারকার সাথে অত্র পোস্টের লেখকের পরিচয় ছিল এসব জানানো। সাহিত্যপাড়ায় কিছু বালক থাকে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পিছু পিছু দৌড়ানো যাদের জীবনের লক্ষ্য।

      উদ্ধৃত অংশটুকু যথেষ্ট মাত্রায় আক্রমণাত্মক এবং সে-কারণেই আপত্তিকর, যদিও আপনি জানিয়ে দিয়েছেন যে ‘কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা আমার উদ্দেশ্য না’। কে কার পশ্চাদ্ধাবন করেছেন সে-তথ্য আমাদের জন্য আদৌ প্রয়োজনীয় নয়, বরং কেউ সমুদ্রমন্থন ক’রে আমাদের কী-কী উপহার দিয়েছেন সেগুলোই দেখার বিষয়। প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে দ্বিমত থাকতেই পারে এবং পাঠবস্তু নিয়েই কেবল আমাদের মতামত (যদি থাকে) ব্যক্ত করা উচিত, কিন্তু তা না ক’রে ব্যক্তির স্বভাবচারিত্র্যের কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করা মোটেই সুচেতনার লক্ষণ নয়।

      লেখা থেকে আমিত্বকে যতটা বহিস্কার করা যায় মনে হয় ততটা লেখাটা সম্মৃদ্ধ হয়।

      আপনার বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত; কিন্তু তা কেবল নৈর্ব্যক্তিক লেখার ক্ষেত্রে — স্মৃতিচারণমূলক লেখা থেকে কি ‘আমিত্ব’কে ‘বহিষ্কার’ করা সম্ভব? এ তো কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো ব্যাপার! রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি বা বুদ্ধদেব বসুর আমার যৌবন বা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর কল্লোল যুগ বা এ-কালের নির্মলেন্দু গুণের আমার কণ্ঠস্বর-এর কথাই ধরুন — ‘আমির আবরণ’ থাকা সত্ত্বেও এসব গ্রন্থ কালজয়ী হয়ে আছে। ভেবে দেখুন। রেজাউল করিম সুমন যদি না তুলে দিতেন, আমরা কি পেতাম শামসুর রাহমানের হারিয়ে যাওয়া ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগনে’র মতো একটি অসাধারণ কালস্মারক কবিতা?

    • রায়হান রশিদ - ২৬ অক্টোবর ২০০৯ (৭:০১ অপরাহ্ণ)

      @ votto kamal

      লেখাগুলেরার উদ্দেশ্য যেন কারকার সাথে অত্র পোস্টের লেখকের পরিচয় ছিল এসব জানানো। সাহিত্যপাড়ায় কিছু বালক থাকে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পিছু পিছু দৌড়ানো যাদের জীবনের লক্ষ্য। অত্র লেখককে সেরম অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাবতে ভাল লাগছেনা।

      বোঝাই যাচ্ছে ভিন্ন নামের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণের উদ্দেশ্য থেকেই আপনি এই মন্তব্যটি করেছেন। লেখা থেকে ‘আমিত্ব দূর’ করার বিষয়টি আপনার এই আক্রমণকে জায়েজ করার ভাণ মাত্র। মুয়িন পার্ভেজ এর ব্যাখ্যার পর সেটা বুঝতে কারও আর বাকী থাকে না। এ ধরণের আক্রমণকারী একটা শ্রেনীকে ব্লগমন্ডলের ইতিউতি প্রতিনিয়ত প্রজ্জ্বলিত হীনমন্যতা নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। আমাদের চারপাশে এই সব উপাদান রয়েছে বলেই জীবন এতো বর্ণিল। এই ব্লগে তাদেরও মন্তব্য করার সুযোগ দেয়া হয়। কেন দেয়া হয়, সেটা ‘ভত্ত কামাল’-কে কে বোঝাবে?

      যাই হোক, রেজাউল করিম সুমনের ব্যাপারে এই মন্তব্যটি যে কতখানি অন্যায্য, তা তার পরিচিতমাত্রই জানেন। আর সেই পরিচিতদের মধ্যে (ভত্ত কামাল এর জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি) দুই বাংলায় এবং তারও বাইরে কেবল তার লেখক-কবি-শিল্পী বন্ধুরাই নন, আছেন এমন আরও অনেকে যাঁরা অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন সে সব কাজের কথা যে সবের বাস্তবায়নে তিনি উল্লেখযোগ্য/প্রধান ভূমিকা রেখেও লেখক-নামের তালিকায় নিজের নামটি উহ্য রেখেছেন সবিনয়ে (নিজেকে আরও তুলে ধরতেই বোধ হয়!!)। রেজাউল করিম সুমন এর ওভাবে নিজেকে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই, সেটা বহু মানুষই জানেন। আপনার জানায় বিশাল ঘাটতি আছে ‘ভত্ত কামাল’। ‘নেমড্রপ’ করা বড় মানুষদের পেছনে ছোটা শ্রেনীটিকে দেখেছেন আপনি (স্বীকার করছি এই শ্রেনীটিও বাস্তব), কিন্তু এর বাইরেও মানুষ আছেন। প্রশ্ন হল – আপনি সেই পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা রাখেন কি না!!

      এ ধরণের আক্রমণ ভবিষ্যতে স্বনামেই বরং করুন। কামড়ে দেবে না কেউ, আশ্বাস দিচ্ছি।

  4. অবিশ্রুত - ২৮ অক্টোবর ২০০৯ (৪:০২ পূর্বাহ্ণ)

    লেখাটির প্রতিক্রিয়া-মন্তব্যের ঘরে আলোচনার ধারাকে ‘ভুট্টো কামাল’ কিংবা ‘ভত্ত কামাল’ ভিন্নপথে ঠেলে দিতে চেয়েছেন, তাতে কোনও ভুল নেই।
    ধরা যাক, রেজাউল করিম সুমন খুবই সাধারণ মানুষ; কিন্তু তারপরও কি এ কথা বলা চলে যে, তাঁর এ লেখার উদ্দেশ্য নিজেকে জাহির করা?
    ১. ভুক্তির অন্তর্নিহিত বার্তাটি খেয়াল করুন : কবি যে অসাধারণ মাপের মানুষ, তাই মুখ্য এ বর্ণনাতে। রেজাউল করিম সুমন সাধারণ মানুষের সারিতে দাঁড়িয়ে অপরাধবোধে ভুগেছেন, আর খানিকক্ষণ আগে ফোন করলেই কবিকে কষ্ট করে পুনরায় নিচ থেকে উপরে উঠে আসতে হতো না। কবি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু জন্মদিনের শুভেচ্ছা নেয়ার জন্যে নিচের ড্রয়িং রুম থেকে দোতলায় উঠে এসেছেন।
    ২. ভুক্তির বার্তা দেখুন : সেখানে মূলত বর্ণিত হয়েছে কবি অসুস্থ এবং নিচে নেমে আসার মতো অবস্থা নেই। কিন্তু তারপরও পরিবারের পক্ষ থেকে সাদর আমন্ত্রণ উপরে তাকে দেখতে যাওয়ার। আরও একটি বার্তা, কবির সব গ্রন্থসংগ্রহ ছায়ানটে রাখবার উদ্যোগ।
    আর এরপরের পুরোটাই তো কবির কবিতা নিয়ে।
    কামাল সাহেব বলতেই পারেন, রেজাউল করিম সুমন কে শামসুর রাহমানের ভালো মন্দ বর্ণনা করার? মানে, উনি তো বলেই ফেলেছেন প্রকারান্তরে। তার এই প্রশ্নের অন্যার্থ হলো, তিনি স্মৃতিচারণার বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী। স্মৃতিচারণার এই বর্ণপ্রথা অন্তত আমি বিশ্বাস করি না।

  5. রেজাউল করিম সুমন - ৩০ অক্টোবর ২০০৯ (৫:২৭ অপরাহ্ণ)


    শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগনে’ কবিতাটি প্রথম আলো-য় পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত নির্জনতা থেকে জনারণ্যে : শামসুর রাহমান (মাওলা ব্রাদার্স, জানুয়ারি ২০০৬) সংকলন থেকে। সংকলনভুক্ত ‘একটি হারিয়ে যাওয়া কবিতা’ শিরোনামের লেখাটিতে নতুন সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাটির হুবহু প্রতিলিপিও ছাপা হয়েছিল। মিলিয়ে নিয়ে দেখা যাচ্ছে, আদিপাঠের সঙ্গে এই পোস্টে উদ্ধৃত পাঠের – এমনকী মুয়িন-নির্দেশিত পঙ্‌ক্তি দুটিরও – কোনো অমিল নেই। ১৯৫১ সালে মুদ্রিত পাঠে মাত্রা-চ্যুতি কবির না কম্পোজিটরের অসতর্কতায় হয়েছিল এখন বলা অসম্ভব। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করায় মুয়িন পার্ভেজকে ধন্যবাদ।

    ‘আমার বোনের কচি দুটি পা পুড়ে গেছে!’ এবং ‘শুনেছি এখানে পরীর মতো মেয়েরা সব’ — এই দুই পঙ্‌ক্তির নিকটতম বিকল্প-পাঠ কল্পনা করে নিতে পারেন কোনো পাঠক —
    আমার বোনের কচি দুটি পা-ই পুড়ে গিয়েছে!
    এবং
    শুনেছি এখানে পরীদের মতো মেয়েরা সব


    এই পোস্টের ১ ও ২ চিহ্নিত টুকরো গদ্য কারো কারো হয়তো সংগতভাবেই ভাবালু মনে হতে পারে। তবে বিখ্যাত কবির সঙ্গে অখ্যাত পাঠকের পরিচয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরাই এ লেখার উদ্দেশ্য ছিল না; সেক্ষেত্রে আরো মোক্ষম ঘটনা/স্মৃতি উল্লিখিত হতে পারত। যাই হোক, পোস্টলেখককে আত্মসমীক্ষার সুযোগ করে দিয়ে votto kamal ধন্যবাদের যোগ্য কাজ করেছেন।

    শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধকালীন কবিতার পাণ্ডুলিপি-সংস্করণটি ছাপা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর। পোস্টের দ্বিতীয় টুকরোয় তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী একটি দিনের কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে। বর্ণনাভঙ্গির অস্পষ্টতা (‘গোলকধাঁধা’) বিষয়ে ভবিষ্যতে সর্তক হব।


    মাহে নও পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতা – যা শামসুর রাহমানের কোনো কাব্যগ্রন্থেই স্থান পায়নি – একবার আমাদের চোখে পড়ে এবং আমরা একটি ছোটপত্রিকায় ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগনে’-র সঙ্গে সে-কবিতাটিও পুনর্মুদ্রণের আগ্রহ প্রকাশ করি। তখন জানতে পারি, আরো অনেক কবিতার মতো মাহে নও-এর কবিতাটিও কবি ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছেন এবং চান না যে সে-লেখা এতদিন পর আবার কোথাও ছাপা হোক। কবির মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর সে-কবিতাটি পুনরুদ্ধার করে সাজ্জাদ শরিফ প্রথম আলো-র ঈদ সংখ্যায় প্রকাশ করেন। ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগনে’ ছোটপত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়নি, এর কপি দীর্ঘদিন বাদে আবার খুঁজে পাবার পর সে-কবিতাটি কবির জীবদ্দশাতেই একটি সম্মাননা-সংকলনে ছাপা হয়, যার উল্লেখ আগেই করেছি।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.