গিরীন্দ্রকুমার দত্ত (১৮৪১–১৯০৯) : মৃত্যুশতবর্ষে স্মরণ

ঠিক একশো বছর আগে, ১৯০৯ সালের ২৭ আগস্ট, আটষট্টি বছর বয়সে কলকাতায় গিরীন্দ্রকুমার দত্তের জীবনাবসান হয়। সাহিত্য, ব্যঙ্গচিত্র, শিল্পশিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। মৃত্যুশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করা হলো এই লেখায়। [...]

ঠিক একশো বছর আগে, ১৯০৯ সালের ২৭ আগস্ট, আটষট্টি বছর বয়সে কলকাতায় গিরীন্দ্রকুমার দত্তের জীবনাবসান হয়।

সাহিত্য ও চিত্রকলা – উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমসাময়িক ঔপন্যাসিক। শ্রীগজপতি রায় ছদ্মনামে তাঁর লেখা ‘ঐতিহাসিক নবন্যাস : অঙ্গখণ্ড : মাধবমোহিনী’-র সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ফাল্গুন ১২৭৯ সংখ্যায় এবং অমৃতবাজার পত্রিকায় ১৮৭৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে। তাঁর লেখা আরো দুটি উপন্যাসের নাম জানা যায় : ‘চন্দ্ররোহিণী’ (১৮৭৫) এবং ‘হীরালাল’ (১৮৭৭)।

রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত সচিত্র মাসিকপত্র ‘রহস্য সন্দর্ভ’ এবং প্রাণনাথ দত্ত সম্পাদিত রঙ্গ-ব্যঙ্গমূলক সচিত্র মাসিকপত্র ‘বসন্তক’-এ গিরীন্দ্রকুমার নিয়মিত লিখতেন। প্রাণনাথ (১৮৪০-১৮৮৮) আর গিরীন্দ্রকুমার দুজনই ছিলেন কলকাতার হাটখোলার দত্তবাড়ির ছেলে; প্রাণনাথ গিরীন্দ্রকুমারের জেঠতুতো অগ্রজ। গিরীন্দ্রকুমার রাজেন্দ্র দত্তর তৃতীয় পুত্র, তাঁর জন্ম হয় ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ ১২৪৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে।

‘বসন্তক’ (১৮৭৪-১৮৭৬) পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে। সে-সময়ে দুই তুতো ভাইয়ের বয়স ৩৩/৩৪। দুজনের আঁকা ব্যঙ্গচিত্রের লিথোগ্রাফ ছাপা হতো পত্রিকাটিতে। ‘বাংলা বইয়ের ছবি’ প্রবন্ধে কমল সরকার লিখেছেন, “‘বসন্তক’ সম্পাদক প্রাণনাথও ছিলেন শিল্পী। কিন্তু গিরীন্দ্রকুমারের চিত্রাঙ্কন প্রতিভা ছিল অনন্যসাধারণ।”

দেবীপদ ভট্টাচার্যের ‘বাংলা সাময়িকপত্র’ প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, ডাকমাশুল সমেত ‘বসন্তক’-এর বাৎসরিক চাঁদা ছিল তিন টাকা ছয় আনা। ‘এই পত্র সম্বন্ধীয় পত্রাদি’ পাঠাবার ঠিকানা ছিল ‘চিৎপুর রাস্তার ৩৩৬ নং ভবন’; পত্রিকাটি মুদ্রিত হতো গরাণহাটা ৩৩৬ সুচারু যন্ত্রে।

‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘সংবাদ ভাস্কর’ প্রভৃতির মতো ‘বসন্তক’ শিরে একটি সংস্কৃত শ্লোক বহন করত :

নব পরিণয়যোগাৎ স্ত্রীষুহাস্যাভিযুক্তং
মদবিলসিত নেত্রং চারুচন্দ্রার্দ্ধমৌলিং
বিগলিত ফণিবন্ধং মুক্তবেশম্ শিবেশং
প্রণমতি দিনহীনঃ কালকূটাভ কণ্ঠং।।

‘প্লানচেট’ যন্ত্রকে শিখণ্ডী করে ‘বসন্তক’ তখনকার বাঙালী রাজনৈতিক নেতাদের, রাজপুরুষদের (অ্যাশলি ইডেন, রিচার্ড টেম্পল, স্টুয়ার্ট হগ প্রভৃতি) নিয়ে রঙ্গকৌতুক করত, ‘প্লানচেটে’র আসল উদ্দেশ্য তার মতে ‘প্ল্যান টু চীট’। ‘মানভঞ্জন’, ‘হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী’, নিরেট গাধা’ প্রভৃতি কার্টুন খুবই উপভোগ্য। তখনকার দিনের প্রাচীন গ্রন্থ প্রকাশ সম্পর্কেও কৌতুককর কটাক্ষ আছে। ‘প্লানচেটে’ বাল্মীকির পর কৃত্তিবাস-কাশীদাস এলেন, বললেন :

“আমাদের সকল দোষ নহে, যা দেখ তাহা আমাদের হাত-পা ভাঙ্গা কন্ধাকার মাত্র। কতকগুলো উপাধিধারী প্রকাশকেই আমাদের এ দশা করেছে – যদিও কপিতলার আক্রমণে হাড়গোড় রক্ষা পেয়েছিল, বটতলার কুষ্মাণ্ডগুলো তাও শেষ করেছে।…”

‘বসন্তক’-এ সমকালীন রাজনৈতিক প্রসঙ্গের গান ও প্যারডি ছাপা হত।

মাসিকপত্র ‘বসন্তক’ প্রকাশের আগে থেকেই তাঁরা মুদ্রণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরে দুলাল’-এর দ্বিতীয় সংস্করণে (১৮৭০) ছাপা হয়েছিল গিরীন্দ্রকুমারের ছয়টি লিথোচিত্র – প্যারীচাঁদ মিত্রের জীবদ্দশাতেই। এই সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন প্রাণনাথ দত্ত; ছাপা হয়েছিল ১৬ নং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রীটের ‘সুচারু প্রেস’ থেকে। সুকুমার সেনের অনুমান, প্রাণনাথ আর গিরীন্দ্রকুমারই ছিলেন এই প্রেসের মালিক।

কলকাতায় অমৃতবাজার পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয় ১৮৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে। সে-সময়ে শিশিরকুমার ঘোষকে গিরীন্দ্রকুমার নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। পারিবারিক জীবনে তাঁরা ছিলেন বৈবাহিক।

প্রাণনাথ দত্ত ও গিরীন্দ্রকুমার দত্তের চিত্রকলা অনুশীলনের ইতিবৃত্ত জানা যায় না। গিরীন্দ্রকুমার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন না, কিন্তু তাঁর ছবি আঁকার হাত যে বেশ ভালো ছিল তাতে সন্দেহ নেই। কমল সরকার একটি সমকালীন সাক্ষ্য উদ্ধৃত করেছেন :

বিগত যুগের অগ্রণী গবেষক মন্মথনাথ ঘোষ গিরীন্দ্রকুমারের চিত্রাঙ্কনী প্রতিভা সম্পর্কে লিখেছেন “মহারাজা স্যর যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহোদয়ের পুণ্যশীলা জননীর জন্য গিরীন্দ্রকুমার অনেকগুলি দেবদেবীর চিত্র অঙ্কিত করিয়াছিলেন। আত্মীয় প্রতাপচন্দ্র ঘোষের ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়ে’ বর্ণিত অনেক বিষয় অবলম্বনে তিনি বৃদ্ধ বয়সেও কতকগুলি কালিকলম দিয়া ছবি আঁকিয়াছিলেন। টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলালে’র দ্বিতীয় সংস্করণ গিরীন্দ্রকুমার চিত্রদ্বারা বিভূষিত করিয়াছিলেন। আমরা ইঁহার অঙ্কিত চিত্রগুলি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি।”

মন্মথনাথ বলেছেন যে, “মাইকেলের একখানি গ্রন্থের প্রচ্ছদপটে গিরীন্দ্রকুমার একটি সুন্দর চিত্রের পরিকল্পনা করিয়াছিলেন। তাহার নিম্নদেশে একটি কোট-প্যান্ট পরিহিত কৃষ্ণকায় ব্যক্তি (কবি) নেশায় বিভোর হইয়া শয়ন করিয়া আছেন, নিকটে পানাধার ও পানপাত্র এবং সেই নিদ্রিতপ্রায় কবির মস্তকের নিকট বাগ্দেবী আসিয়া কল্পনার আলোকরশ্মি প্রেরণ করিতেছেন। শুনিয়াছি, মাইকেল স্বয়ং এই চিত্র সন্দর্শন করিয়া চিত্রকরের সুখ্যাতি করিয়াছিলেন।” কোন বইয়ের প্রচ্ছদ পরিকল্পনার কথা উপরে বলা হয়েছে তা জানা যায় না।

উনিশ শতকের অভিজাত সমাজে সাড়া-জাগানো গ্রন্থ অবলম্বনে চিত্ররচনা এবং তা দিয়ে গৃহসজ্জার রীতিও প্রচলিত ছিল। গিরীন্দ্রকুমার ও প্রাণনাথ দত্তের যুগ্ম-প্রচেষ্টায় রচিত সে যুগের এমন কয়েকটি চিত্র রচনার উল্লেখও করেছেন মন্মথনাথ। মাইকেলের সাহিত্যকর্মের এ রূপায়ণ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন “প্রাণনাথ ও গিরীন্দ্রকুমার উভয়ে মিলিয়া মাইকেল মধুসূদন সত্তের গ্রন্থাবলীর কাল্পনিক বর্ণনাগুলি অবলম্বন করিয়া যে ৪ খানি রঙ্গীন ছবি (water colour pictures) আঁকিয়াছিলেন সেগুলি আমরা দেখিয়া সর্বাপেক্ষা মোহিত ও আনন্দিত হইয়াছি। এই চিত্রগুলি না দেখিলে চিত্রকরগণের প্রতিভার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায় না। অনেক য়ুরোপীয় চিত্রকরও এই চিত্রগুলি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছেন। এই চিত্রগুলির প্রতিলিপি এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নাই। মহারাজা স্যর যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এই চিত্রগুলি দেখিয়া এরূপ মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে তিনি গিরীন্দ্রকুমারকে অনুরোধ করিয়া তিলোত্তমা সম্ভব কাব্যের কতকগুলি চিত্র তাঁহার দ্বারা অঙ্কিত করাইয়া লইয়াছিলেন।”

শিল্পশিক্ষার প্রসারেও গিরীন্দ্রকুমার দত্তের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ‘ভারতের ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী’ গ্রন্থে কমল সরকার লিখেছেন,

প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত ভ্রমণের সময় কলকাতায় ‘অ্যালবার্ট টেম্পল অব সায়েন্স অ্যান্ড স্কুল অব টেকনিক্যাল আর্টস’ নামের যে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয় (১৮৭৬) তার অন্যতম উদ্যোক্তাও ছিলেন তিনি। এই শিক্ষায়তনের চারুকলা বিভাগ তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হয় এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি এই বিদ্যালয়ের অছি পরিষদের সভাপতি ছিলেন। পরে এই শিক্ষায়তন ‘অ্যালবার্ট টেম্পল অব সায়েন্স অ্যান্ড স্কুল অব আর্টস’ নাম গ্রহণ করেন।

চিত্রবিদ্যা অনুশীলনের জন্য তিনি এক গ্রন্থও রচনা করেন। সম্ভবত, এ গ্রন্থই বাংলা ভাষার প্রথম চিত্রবিদ্যা শিক্ষার উল্লেখযোগ্য পূর্ণাঙ্গ পুস্তক।

‘অ্যালবার্ট টেম্পল অব সায়েন্স অ্যান্ড স্কুল অব আর্টস’ ছিল কলকাতার দ্বিতীয় চারুকলা শিক্ষায়তন। আর গিরীন্দ্রকুমারের বইটির নাম : ‘চিত্রবিজ্ঞান/ চিত্র অঙ্কিত করিবার চলিত প্রথা/ Practical Lessons on Drawings and Paintings’ (১৯০১)। বইটি পরবর্তীকালে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল কি না জানা যায় না। চিত্রবিদ্যা শিক্ষার অন্তত একটি বই ‘চিত্রবিজ্ঞান’-এর আগেই বেরিয়েছিল, চারুচন্দ্র নাগের সে-বইয়ের নাম ছিল ‘চিত্রবিদ্যা’ (১৮৭৪)। সে-বইটিও এখন দুষ্প্রাপ্য।

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

১১ comments

  1. মোহাম্মদ মুনিম - ২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:১০ পূর্বাহ্ণ)

    গুগলে ‘গিরীন্দ্রকুমার’ (বাংলায়) সার্চ দিয়ে কেবল তোমার এই লেখাটিই পেলাম। ইংরেজীতে সার্চ দিয়ে একটিমাত্র পুরোনো বইয়ে তাঁর উল্লেখ পাওয়া গেল। তোমার লেখাটি পড়তে পড়তে চলে গেলাম ১৯ শতকের কোলকাতায়। বাংগালী রেঁনেসাসের কর্মবীরেরা কাজ করে চলেছেন, পত্রিকা প্রকাশ করছেন, উপন্যাস লিখছেন, ছাপাঘর বানাচ্ছেন, কি অদ্ভূত স্বপ্নময় একটি কাল গেছে। কিছুদিন আগে ‘বইয়ের দেশে’ পড়ছিলাম, কোলকাতায় এখন নাকি বাংলা বই ১ হাজার কপির বেশী বিক্রি হয় না, ছেলেমেয়েরা হালকা ইংরেজী বই ছাড়া কিছুই পড়ে না।

  2. মুয়িন পার্ভেজ - ২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:০৯ অপরাহ্ণ)

    শিবনাথ শাস্ত্রী কিংবা কমল সরকারের মতো কারও-কারও বইয়ে উনিশ শতকের ‌বাঙালির নবজাগরণের বিবরণ পাওয়া যায়। কিছু বই ইতিমধ্যেই উঠে গেছে দুষ্প্রাপ্যের তালিকায়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নীরস গবেষণা ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তথ্যবিলাস ছাড়া এসব বইয়ের বোধহয় কোনো উপযোগিতা নেই আর!

    মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেই তো আমাদের জানা দরকার ছিল হিন্দু কলেজ সম্পর্কে, রামমোহন সম্পর্কে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে ‘নবজাগরণ’-এরই কোনো নামগন্ধ ছিল না সে-সময় (১৯৮৯-১৯৯৩)। শকুন্তলা-র লেখক বিদ্যাসাগরের নাম শুনলেও বিধবাবিবাহ-আন্দোলনের নায়ক বিদ্যাসাগরের কথা কেউ বলেননি। বইয়ের মানুষ থেকে চেতনার মানুষই তো হয়ে উঠতে চান গীরিন্দ্রকুমারেরা, আর চেতনার এই ‘প্ল্যানচেট’ বসানোর দায় প্রত্যেকেরই — ব্যক্তির, রাষ্ট্রের, ব্যক্তির।

    রেজাউল করিম সুমনকে ধন্যবাদ, তাঁর এই তথ্যঋদ্ধ প্রবন্ধের জন্য।

    • রেজাউল করিম সুমন - ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৯:২৪ অপরাহ্ণ)

      মুয়িন, তোমার সঙ্গে একমত — বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে যে-ধারণা আমরা পাই, তা খুবই খণ্ডিত। আমাদের শিক্ষক জাবেদ আলী বিশ্বাস সপ্তম শ্রেণীর এক ক্লাসে (১৯৮৬) ইতিহাসের নানা তথ্য-উপাত্তকে ডিমভাজির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন! ডিমভাজি দেখে লালাক্ষরণ স্বাভাবিক, কারো দিকে চামচে করে একটা ডিমভাজি এগিয়ে দিলে তার মুখ হাঁ হবারই কথা। কিন্তু মুখ বন্ধ করার পর দেখা যাবে, কামড় পড়েছে জিভেই, কেননা প্রথমে লোভ দেখালেও পরে ডিমটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে! গভীর উষ্মার সঙ্গে স্যার বলতেন, আমাদের ছাত্রপাঠ্য ইতিহাস-বইগুলো এরকমই করে থাকে।


      বলাই বাহুল্য, গিরীন্দ্রকুমারকে নিয়ে ছোট এই লেখাটা কোনো অর্থেই প্রবন্ধ নয়। এখানে তথ্য যা আছে সবই দুটি মাত্র বই থেকে সরাসরি নেয়া – কমল সরকারের ভারতের ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী (যোগমায়া প্রকাশনী, ১৯৮৪) এবং চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন (আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮১)। চারুচন্দ্র নাগের চিত্রবিদ্যা (১৮৭৪) বইটির কথা জানতে পেরেছি তপতী গুহঠাকুরতার Monuments, Objects, Histories: Institutions of Art in Colonial and Postcolonial India (Columbia University Press : 1994) থেকে, ১৮৭৪ সালেই প্রকাশিত শ্যামাচরণ শ্রীমানীর সূক্ষ্ম শিল্পের উৎপত্তি ও আর্য্যজাতির শিল্পচাতুরী নিয়ে চমৎকার আলোচনা আছে এ বইয়ে। শ্যামাচরণের লেখা বাংলা ভাষার প্রথম শিল্পসমালোচনার এ বই সংকলনভুক্ত হয়ে পরে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে, ফলে পড়ার সুযোগ পেয়েছি আমরা; তবে সে-সংকলনটি এখন আর ছাপা নেই। ভারতের ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী-র নতুন পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হলে আমরা উপকৃত হতাম, কিন্তু সে-বইও সম্ভবত দ্বিতীয়বার ছাপা হয়নি। এখন আর পাওয়া যায় না দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন নামের অসামান্য সংকলনটিও।

  3. Pavel - ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:৪৮ অপরাহ্ণ)

    Sumanda, emon akti tathasamridha lekhar jonno donnobad..

    • রেজাউল করিম সুমন - ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৯:২৬ অপরাহ্ণ)

      পাভেল, তোমাকেও ধন্যবাদ মুক্তাঙ্গন পড়ার জন্য। এখনো দামান-এই আছ, না কি বদলি হয়েছ অন্য কোথাও?

  4. অবিশ্রুত - ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১১:১৪ অপরাহ্ণ)

    গিরিন্দ্রকুমার দত্তের মৃত্যুশতবার্ষিকী উপলক্ষে কোনও বিশেষ সংকলন বাংলা ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে কি? অথবা বেরুনোর কোনও সম্ভাবনা? কোনও লিটল ম্যাগে বিশেষ ক্রোড়পত্র? তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক লক্ষণগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাকে নিয়ে কোনও লেখা আছে কি? সুমন অথবা অন্য কারও জানা থাকলে জানানোর অনুরোধ করছি।

    • রেজাউল করিম সুমন - ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৯:৩১ অপরাহ্ণ)

      @ অবিশ্রুত
      না, এরকম কোনো সংকলন, সংখ্যা বা ক্রোড়পত্র প্রকাশের (বা তার সম্ভাবনার) খবর আমার জানা নেই। কখনো সুযোগ পেলে কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক সন্দীপ দত্তকে জিজ্ঞেস করে নেব।

      ‘তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক লক্ষণগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাঁকে [গিরীন্দ্রকুমার দত্ত] নিয়ে কোনও লেখা’ থাকাই সম্ভব; অন্তত থাকা উচিত। থাকলেও, সে-লেখার খোঁজ জানা নেই।

      কমল সরকারের ভারতের ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী (যোগমায়া প্রকাশনী, ১৯৮৪) বইয়ে যে-তথ্য আছে তার প্রায় সবই এই পোস্টটিতে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন (আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮১) সংকলনের কয়েকটি প্রবন্ধেও প্রসঙ্গত গিরীন্দ্রকুমারের কথা এসেছে; এ লেখায় সেসব তথ্যও গৃহীত হয়েছে। এছাড়া তাঁর উল্লেখ চোখে পড়েছে পার্থ মিত্রের Art and Nationalism in Colonial India 1850-1922 (Cambridge, 1994) গ্রন্থে। এ বইয়ের ‘The Power of the Printed Image’ অধ্যায়ের ‘Cartoon traditions in the vernacular’ অংশে বাংলা পত্রপত্রিকায় কার্টুন চর্চা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ‘বসন্তক’ এবং সেই সূত্রে গিরীন্দ্রকুমার ও প্রাণনাথ দত্তের কথাও এসেছে। পত্রিকাটির প্রচ্ছদ ও কয়েকটি কার্টুনের ছবি ছাপাও হয়েছে বইটিতে, তবে এসব অস্বাক্ষরিত ব্যঙ্গচিত্রের শিল্পী কে — গিরীন্দ্রকুমার না প্রাণনাথ — তা বলা নেই।

  5. রেজাউল করিম সুমন - ১৬ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:৩৮ অপরাহ্ণ)

    সুখবর! বসন্তক পত্রিকার সব ক’টি (মোট চব্বিশটি) সংখ্যাই এখন পাওয়া যাচ্ছে দুই মলাটের মধ্যে! সংকলনটি এখনও হাতে পাইনি, তবে এর আলোচনা পড়লাম বইয়ের দেশ-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায় (অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০০৯, পৃ ১২১-১২৫)। পুরো লেখাটিই উদ্ধৃত করছি।

    পথিকৃৎ বাংলা কার্টুন পত্রিকা
    দেবাশীষ দেব

    ভারতে সর্ব প্রথম কার্টুন আঁকার উদ্যোগ শুরু হয় ইংরেজদের হাতেই, ঊনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময় থেকে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘পাঞ্চ’ পত্রিকার অনুকরণে এখানে ১৮৫০ থেকে ১৮৭২-এর মধ্যে একের পর [এক] প্রকাশিত হয়েছিল ‘Delhi Sketch’, ‘Indian Punch’ কিংবা ‘Indian Charivari’র মতো বেশ কিছু পুরোদস্তুর কার্টুন পত্রিকা। যেহেতু এই কাগজগুলি সব লাল-মুখোরাই চালাতেন ফলে তৎকালীন ইংরেজ শাসকদের শতমুখে গুণকীর্তন করে যাওয়াটাই ছিল তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য। হাজার অন্যায় করা সত্ত্বেও ওই সব লাটসাহেবদের দিকে আঙুল তোলার মতো বুকের পাটা কারও ছিল না। বরং উল্টে এই ইংরেজি পত্রিকাগুলি লাগাতার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে গিয়েছে এ দেশের সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রাকে। ভারতীয় পাঠক এর ফলে মনে মনে যথেষ্ট চটলেও, কিল খেয়ে হজম করা ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় ছিল না। কার্টুনের পাল্টা জবার দেওয়া যাবে কার্টুন দিয় এই ধরনের স্বদেশি পত্রিকা তখন কোথায়! এই অভাবটা মিটিয়ে দিয়েছিল ‘বসন্তক’ – ভারতীয় ভাষায় প্রথম কার্টুনে ভরা পত্রিকা যার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮৭৩ সালে এই কলকাতা শহরে। বিশেষ কারণে নাম ব্যবহার না করলেও তখনকার দিনে সবাই জানতেন এই বাংলা পত্রিকাটির সম্পাদক আর প্রধান লেখক হলেন প্রাণনাথ দত্ত। কার্টুনগুলি আঁকতেন তিনি ও তাঁর ছোট ভাই গিরীন্দ্রনাথ। রীতিমতো উদ্যমী পুরুষ এই প্রাণনাথ জন্মেছিলেন ১৮৪০ সালে উত্তর কলকাতার এক বনেদি পরিবারে – সাহিত্যচর্চা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে পরে ১৮৭১ সালে সম্পাদক হন ‘রহস্য সন্দর্ভ’ পত্রিকার, পাশাপাশি ব্যবসার দিকেও উৎসাহ ছিল তাঁর, ইউরোপে দিশি জিনিস রপ্তানি করবেন বলে চালু করেন নিজস্ব কোম্পানি – কিনে ফেলেন ছাপাখানা এবং এখান থেকেই প্রকাশিত হতে শুরু করে ‘বসন্তক’। যদিও মাত্র দু’বছর চলার পর কাগজটি উঠে যায় তবু লেখা আর কার্টুনের মধ্যে দিয়ে ‘বসন্তক’ যে সে যুগের ইংরেজ শাসিত কলকাতা (নাকি বঙ্গদেশ?) শহরের অতি মূল্যবান একটা ডকুমেন্ট তৈরি করে দিয়েছে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তার চেয়েও বড় কথা হাসি-ঠাট্টার ছলে দিনের পর দিন ইংরেজ শাসনব্যবস্থার কড়া সমালোচনা করে যাওয়ার মতো বিরাট দুঃসাহস দেখিয়েছিল ‘বসন্তক’। সেদিক থেকে এই বাংলা পত্রিকাটিকে পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকার করে নিতেই হয়।

    প্রায় দেড়শো বছর আগে ছাপা হওয়া এই বসন্তক-এর সবক’টি সংখ্যাকে (মোট চব্বিশটি) একত্র করে সম্প্রতি একটি আনকোরা নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছেন ‘নিউ-এজ’ সংস্থা। উদ্যোগটি রীতমতো প্রশংসনীয়। ইতিহাস পুনরুদ্ধার করার এই দুরূহ কাজটি সম্ভব হয়েছে প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ীর সৌজন্যে। অনেকেই জানেন, কার্টুন আঁকার পাশাপাশি কার্টুনের ইতিহাস নিয়েও অক্লান্তভাবে গবেষণা করে চলেছেন এই বর্ষীয়ান শিল্পী। বসন্তক-এর এই সংখ্যাগুলি গত ত্রিশ বছর ধরে তাঁরই ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল।

    নতুন এই সংস্করণটির প্রকাশও চণ্ডীবাবুর তত্ত্বাবধানে হয়েছে – মলাট ও ভিতরের পাতায় দেখা যায় তাঁর নামের আগে ‘সংগ্রহ ও টীকা’ – এই দু’টি শব্দকে। প্রতিটি লেখার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ঠিকমতো চিনিয়ে দেওয়ার জন্য টীকা খুবই জরুরি। বইতে চণ্ডীবাবুর লেখা একটি ভূমিকাও আছে – সেখানে তিনি স্বীকার করেছেন, এই বই একমাত্র গবেষক ছাড়া খুব বেশি লোক পড়বে না। কথাটা খুব ভুল নয়।

    বসন্তক-এর আমলে ভাষার প্রয়োগ অথবা বাক্য গঠনের যে-স্টাইলটা চালু ছিল তার সঙ্গে এ যুগের পাঠক কতখানি স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন বলা শক্ত। একই কথা কার্টুন-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চণ্ডীবাবুর লেখা অনুযায়ী কাঠের ব্লক-এ ছাপা এই সব ছবির (যদিও অনেকের মতে এগুলো আসলে তামার পাতের ওপর ‘এচিং’ পদ্ধতি) নান্দনিকভাবে সঠিক মূল্য দিতে গেলে আর্ট-এর পরম্পরাকে ভালভাবে জানা দরকার। বসন্তক-এর আঁকার মান অবশ্য সব জায়গায় সমান নয়। বেশ কিছু কাজের মধ্যে চর্চা বা অভিজ্ঞতার অভাব চোখে পড়ে। বোঝা যায় কার্টুনগুলি এক হাতে হয়নি। তবু জায়গাবিশেষে এগুলি যে শেষ পর্যন্ত দারুণভাবে উতরে গিয়েছে সেটা শুধুমাত্র আঁকিয়েদের পর্যাপ্ত রসবোধ থাকার জন্যেই।

    তখনকার ব্রাহ্মসমাজ, ইংরেজ সরকার এবং বিশেষ করে কলকাতা পৌরসভার দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে রচিত বসন্তক-এর বেশির ভাগ লেখাই ছিল কিছুটা ফিচারধর্মী। কার্টুনগুলিও আঁকা হয়েছে মূলত এই সব রচনার ইলাস্ট্রেশন হিসেবে। লেখা আর ছবির এই যুগলবন্দিই মনে হয় বসন্তক-এর প্রধান সম্পদ। যেমন ‘খ্রিষ্টম্যাস ডে’ শীর্ষক লেখাটির কথাই ধরা যাক – যেখানে কলকাতা শহরে সাহেবদের এই পরব উদ্‌যাপন নিয়ে চুটিয়ে রসিকতা করা হয়েছে। এর একটা অংশের বর্ণনা এই রকম – ‘সাহেবদের তো কতাই নাই, জামাস জামাস ক’রেই অজ্ঞান; নাচ, খানা, ইয়ারকী দে পাগলা হাতির মত বেড়াচ্চেন। দোয়াসলা রাঙ্গামুখ ফিরিঙ্গীরা পাছে দেশী ব’লে ধরা পড়েন, এই জন্য আহেলা বেলাত গোরাদের বজনিস নকল ক’চ্চেন, আর কালামুখো পেঁদরুস সকলের আনন্দের সীমা নাই, “মোদের কিচমিচ মোদের কিচমিচ” ব’লে মুটে মজুরদের কাছে সাহেবী দেখাচ্চে,…’। এই ভাষা একেবারে খাঁটি বসন্তকের ভাষা – শব্দের বিশেষ বিশেষ ব্যঞ্জনাগুলি এখানে লক্ষ করার মতো।

    এই লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কার্টুনটির একটা ভারি মজাদার ক্যাপশন রয়েছে, ‘দেখি খৃষ্ণাষ্টমী উৎসব’। পাঠকও দেখেন, এক মজাদার দৃশ্য – টিকিওলা বামুন বোতল থেকে মদ ঢেলে দিচ্ছে সাহেবের গ্লাসে, ঈষৎ মত্ত সাহেবদের মাথার চুল এলোমেলো, পিছনে বসা তার ইয়ার দোস্ত-এর হালও তথৈবচ। জনৈক দোআঁশলা ফিরিঙ্গি আবার মাটিতে তাকিয়া ফেলে তার ওপর বসে গড়গড়ায় টান দিচ্ছে – এক পাশে বাইজ আর বাজনদারেরা মিলে মেহফিল বেশ জমিয়ে তুলেছে। পরিবেশটাকে সুন্দরভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন শিল্পী, কাজ চালানোর মতো ড্রইং তিনি জানতেন। সেটাকেই সম্বল করে প্রতিটি চরিত্রের হাবভাব আর মুখভঙ্গিগুলো সাধ্যমতো ফুটিয়ে তুলেছেন – বাংলায় কার্টুন আঁকার একেবারে সূচনাপর্বে এই ধরনের প্রচেষ্টা কিছু কম কথা নয়।

    তবে বসন্তক-এর আসল গর্বের জায়গা হল সরাসরি ইংরেজদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করার ঝুঁকি নেওয়া। কার্টুনের মধ্যে দিয়ে এটা মনে হয় সোচ্চার হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বেশি। বলতে গেলে একরকম জোর করে ব্রহ্মদেশ (এখন মায়ানমার) দখল করেছিল ইংরেজ সরকার – এটা নিয়ে বসন্তক কার্টুন আঁকল, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এক নেকড়ে লাফ দিতে যাচ্ছে ভেড়ার ওপর, ভেড়ার মাথায় রয়েছে বার্মিজ টুপি আর নেকড়েটির মাথায় ব্রিটিশ মুকুট – ভাবা যায়?

    হাইকোর্ট-এ নতুন ‘জজ’ হয়ে এলেন জনৈক স্যার রিচার্ড কৌচ – বসন্তক সুযোগ ছাড়ল না, দেশের আইনব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে মজা করল ‘কৌচ’ শব্দটাকে নিয়ে। জজ সাহেবকে আঁকা হল একদিকের দুটো পায়া ভাঙা কৌচ-এর মতো করে, উপরে একটা টানা পাখা যাতে লেখা ‘হাইকোর্টের নূতন আসবাব’ আর নীচে ক্যাপশন – ‘কৌচ সাহেবী গৃহসজ্জার অন্যতম আসবাব’।

    ইতিহাস বলে তৎকালীন কলকাতা পৌরসভাকে চালাতে গিয়ে পদে পদে ইংরেজ সরকারের ব্যর্থতা কলকাতাবাসীকে চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন প্রাণনাথ। পুর কমিশনের নির্বাচনে সাধারণ নাগরিকের ভোটাধিকার কায়েম করার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন তাঁরা – ১৮৭৪ সালে পুর আইন সংশোধন করা হয় – প্রথম নির্বাচিত কমিশনারদের একজন হয়ে প্রাণনাথ ক্ষমতায় আসেন। পৌরসভার রাজনীতিতে তাঁর এই প্রভাব বিস্তারের পেছনে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল এই বসন্তক।

    এই বইয়ের শেষে যে-টীকাগুলি দেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট তথ্যপূর্ণ হলেও শুধুমাত্র বাছাই করা কিছু লেখার প্রসঙ্গই এখানে এসেছে, কার্টুনের কথা প্রায় নেই বললেই চলে। অন্তত নব্বুইভাগ কার্টুনের ক্ষেত্রে পাঠককে ক্যাপশন বা সঙ্গের লেখা পড়ে মানে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যথাযথ ক্যাপশনের অভাবে সেটা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নাও হতে পারে, এটাই আপসোস। টীকাগুলির মধ্যেও আবার কিছু কিছু অসংলগ্নতা মনে খটকা জাগায়। উদাহরণ, ‘টীকা ৪’ পৃষ্ঠা, এখানে প্রথম খণ্ড, প্রথম সংখ্যা, পৃ. ১৯-এর কার্টুনটি সম্পর্কে বলা হয়েছে – চৌরঙ্গিপাড়ায় হগসাহেবের উদ্যোগে নতুন বাজার তৈরি করতে গিয়ে মতিলাল শীলের ছেলে হীরালাল শীলকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়। অথচ এর পরেই ‘প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা পৃ. ৩২-৩৩’-এর লেখা ও কার্টুনের ক্ষেত্রে টীকা জানাচ্ছে – মতিলালের ছেলে হীরালাল হগের বাজার বানাবার উদ্যোগে বাধা দেন, স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি উদ্যোগী হয়ে মিটমাটের চেষ্টা করেন। সাত লাখে রফা হয়। কোন টাকার অঙ্কটা তাহলে ঠিক?

    বইটির ছাপা বা পেজ লে-আউট খুবই পরিচ্ছন্ন, শুধু প্রাণনাথ আর গিরীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেটগুলি কোনও আর্টিস্টকে দিয়ে লাইন ড্রইং করিয়ে নিলে বোধহয় ভাল হত।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.