গত বছর অরুণ সোমের কাছ থেকে দূরভাষে জেনেছিলাম, তিনি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, কেননা তাঁর ছোটভাই বেশ কিছুদিন ধরে তখন রোগশয্যায়। ততদিনে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে দুরারোগ্য কর্কটরোগ। পরে একবার খবর নিয়ে জেনেছি, চিকিৎসা চলছে, কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এরপর গড়িয়ে গেছে অনেকটা সময়। ক’দিন আগে দূরভাষে কুশল জানতে চাইলে অরুণ সোম মাসুদ করিমকে জানান, তল্‌স্তোয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’-র অনুবাদের পাণ্ডুলিপি অনেকদিন ধরেই পড়ে আছে সাহিত্য অকাদেমিতে, দস্তইয়েভ্‌স্কি-র ‘কারামাজোভ্ ভাইয়েরা’-র অনুবাদও অনেকটা এগিয়েছে, আর তাঁর ছোটভাই মারা গেছেন জুলাইয়ের ১১ তারিখে। [...]

গত বছর অরুণ সোমের কাছ থেকে দূরভাষে জেনেছিলাম, তিনি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, কেননা তাঁর ছোটভাই বেশ কিছুদিন ধরে তখন রোগশয্যায়। ততদিনে শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে দুরারোগ্য কর্কটরোগ। পরে একবার খবর নিয়ে জেনেছি, চিকিৎসা চলছে, কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এরপর গড়িয়ে গেছে অনেকটা সময়। ক’দিন আগে দূরভাষে কুশল জানতে চাইলে অরুণ সোম মাসুদ করিমকে জানান, তল্‌স্তোয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’-র অনুবাদের পাণ্ডুলিপি অনেকদিন ধরেই পড়ে আছে সাহিত্য অকাদেমিতে, দস্তইয়েভ্‌স্কি-র ‘কারামাজোভ্ ভাইয়েরা’-র অনুবাদও অনেকটা এগিয়েছে, আর তাঁর ছোটভাই মারা গেছেন জুলাইয়ের ১১ তারিখে।

ভদ্রলোককে প্রথম দেখি ২০০৬-এর ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে। অরুণ সোম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমার ছোট ভাই’। শ্মশ্রুময় মুখ; সৌম্যদর্শন মাঝারি গড়নের একজন মানুষ। অল্পদিন আগে কলেজের অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়েছেন।

অগ্রজের গড়িয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি ফিরে যাবেন পার্ক সার্কাসে; আমি যাব আশুতোষ চৌধুরী এভিনিউর সিমা আর্ট গ্যালারিতে। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে, যোগেন চৌধুরীর প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়ে গেছে ততক্ষণে। আমাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য ট্যাক্সি (ক্যাব) নিতে চাইলেন প্রথমে। অনেকটা পথ হেঁটেও পাওয়া গেল না। অগত্যা চেপে বসতে হলো বাসে। পুরো পথ জুড়েই কথা চলল। নিজের কথা কিছুই বললেন না, কিন্তু প্রশ্ন করে করে জেনে নিতে লাগলেন আমাদের খবর, বাংলাদেশের খবর। তাঁর শৈশবের প্রথম কয়েক বছর কি ঢাকায় কেটেছে? কেমন ছিল সেইসব দিন? এসব প্রশ্ন করা হয়নি সেদিন। যদিও দ্বিজেন শর্মার কাছ থেকে আগেই জেনেছিলাম, অরুণ সোমের আদিবাড়ি পূর্ববঙ্গে, তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর তাঁর বাবা সপরিবারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

বাস থেকে নেমে খানিকটা পথ হাঁটতে হয়। যতদূর মনে পড়ে রাস্তার পাশেই ছিল বড়ো একটা শাদা মন্দির, আর তার অল্প পরেই সিমা আর্ট গ্যালারি। আমার বর্ষীয়ান সঙ্গীকে জানাই, কয়েক দিন আগেই একবার এসেছি, চিনতে অসুবিধে হবে না। আমার আপত্তি সত্ত্বেও সিমা যে-দালানে সেই সানি টাওয়ারের নীচতলা অবধি আমাকে পৌঁছে দিয়ে তবেই বিদায় নিলেন ভদ্রলোক।

‘তোত্তোচান’-এর সূত্রে বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ নিয়ে কথা হচ্ছিল বইটির অনুবাদক মৌসুমী ভৌমিকের সঙ্গে, শেষ প্রচ্ছদে যাঁর পরিচয় দেয়া হয়েছে একালের ‘বিশিষ্ট পপশিল্পী’ হিসেবে। কথায় কথায় উঠে পড়ল মস্কোর প্রগতি ও ‘রাদুগা’ প্রকাশনের মনকাড়া অনুবাদ বইগুলোর কথা, সেই সূত্রে অরুণ সোমের কথাও। তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী ছোটভাইয়ের কথা তুললেন মৌসুমীদিই, আর এই প্রথম জানতে পারি যে, ভদ্রলোকের নাম অমল সোম।

তাঁর হাতে গড়া ‘মানস’ নামের প্রতিষ্ঠানটির কথাও কিছু কিছু জানলাম সেদিন। আরো জানা গেল পরে, দ্বিজেন শর্মার কাছ থেকে। ‘মানস’ মানসিক প্রতিবন্ধীদের সেবায় নিয়োজিত একটি নামকরা প্রতিষ্ঠান। অমল সোমের ছোটবোনও শৈশব থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী, বেশির ভাগ সময়ে সুস্থ থাকলেও মাঝে মাঝে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই অমলবাবু ও তাঁর স্ত্রী নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিঃসন্তান থেকেছেন; মানসিক প্রতিবন্ধীদের সেবা ও চিকিৎসার জন্য আরো ক’জনের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন ‘মানস’-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান।

কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও অপবিজ্ঞান-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন অমল সোম। তাঁদের বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের সংগঠন ‘উৎস মানুষ’ তো উভয়বঙ্গেই পরিচিত। প্রয়াত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যে গল্পের শেষ নেই’-এর একটি নতুন সংস্করণ বছর কয়েক আগে ছাপা হয়েছিল ‘উৎস মানুষ’ থেকেই, পরে বইটির পুনর্মুদ্রণও হয়েছে। একটা সময়ে দেবীপ্রসাদের বাড়িতে যে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল, তা কথাপ্রসঙ্গে জানতে পেরেছিলাম অমলবাবুর কাছ থেকেই। ষাট-সত্তরের দশকের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার একটা ইঙ্গিত মেলে এখানে।

অমল সোমের মতো একজন অসামান্য মানুষ সম্পর্কে অন্যদের কাছ থেকে আরো তথ্য পাবার আশাতেই লিখতে হলো এই সামান্য শোকলেখনটি। তাঁর স্বল্প সময়ের সান্নিধ্যই আমার জন্য এক বড়ো সঞ্চয়।

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

৪ comments

  1. মুয়িন পার্ভেজ - ২৮ আগস্ট ২০০৯ (৬:২৩ অপরাহ্ণ)

    ধন্যবাদ, রেজাউল করিম সুমন। এ-লেখাটি না পড়লে আমার কখনও হয়তো জানা হত না অমল সোমের মতো একজন অসাধারণ মনের মানুষকে, যিনি সস্ত্রীক ‌‌`সিদ্ধান্ত নিয়েই নিঃসন্তান থেকেছেন’ `মানসিক প্রতিবন্ধীদের সেবা ও চিকিৎসার জন্য’! একটি `মানস’ গ’ড়ে তুলতে গেলে যে অনেকখানি মানসিক জোরের দরকার হয়, তার প্রমাণ রেখে গেলেন অমলবাবু।

  2. মাহতাব - ২৮ আগস্ট ২০০৯ (১০:২৭ অপরাহ্ণ)

    অসংখ্য ধন্যবাদ সুমন ।

  3. জাহেদ সরওয়ার - ৩০ আগস্ট ২০০৯ (১২:১০ অপরাহ্ণ)

    তল্‌স্তোয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’-র অনুবাদের পাণ্ডুলিপি অনেকদিন ধরেই পড়ে আছে সাহিত্য অকাদেমিতে এই খবরটা জানতাম না। দস্তইয়েভ্‌স্কি-র ‘কারামাজোভ্ ভাইয়েরা’-র অনুবাদও অনেকটা এগিয়েছে এটার জন্য হা করে বসে আছি বলা যায়। আমার মতো বঙ্গদেশী নাদানদের বইপড়ার পিছনে শ্রী অরুণ সোমের অবদান আজ স্বীকৃত। অরুণ সোমের প্রত্যকটা অনুবাদই নতুন এক অভিজ্ঞতা। সম্প্রতি তার রুশ সাহিত্যের ইতিহাসটা পড়া হল। আহা এযে দেখি নীরব সমুদ্দূর এই ব্যাপক সাহিত্য সমুদ্দূরকে তার কী রসময় উপস্থাপন।
    অমল সোমকে জানতাম না সুমনের সূত্রে জানা হল। সে ক্ষেত্রে ধন্যবাদ তার প্রাপ্য।

    • রেজাউল করিম সুমন - ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৬:৪৯ অপরাহ্ণ)

      ‘যুদ্ধ ও শান্তি’-র আগে অরুণ সোম ‘কারামাজোভ্ ভাইয়েরা’ অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। খানিকটা অংশ সে-সময়ে কলকাতার একটি ছোট পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। সাহিত্য অকাদেমি ‘অপরাধ ও শাস্তি’-র পর আবারও দস্তইয়েভ্‌স্কি ছাপতে চাননি, তাঁরা তল্‌স্তোয়ের উপন্যাস অনুবাদের প্রস্তাব দিলে অরুণবাবু ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ শুরু করেন। ‘যুদ্ধ ও শান্তি’-র মতো মহাগ্রন্থ – তাও আবার মূল রুশ থেকে অরুণ সোমের অনুবাদ — দীর্ঘদিন ধরে ‘রিভিউয়ার’-এর ছাড়পত্রের অপেক্ষায় দিন গুনছে! জানি না, কে সেই মহাব্যস্ত রুশ-সাহিত্যবিশারদ!

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.