বিষ্ণু দে জন্মশতবর্ষ : ‘কঠিন ব্রতের গৌরব’

বিগত সাত-আট দশকে বিষ্ণু দে-র কবিতা নিয়ে কম বির্তক হয়নি। পাঠকের মুগ্ধতা ও ঔদাসীন্য – দুই-ই জুটেছে এই কবির ভাগ্যে। যাঁর কবিতা ব্যক্তি, সমাজ, শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির সম্বন্ধসূত্রে জড়ানো, তাঁর পাঠক কি কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু কবিতা ভালো-লাগার (বা না-লাগার) অনুভব নিয়ে সন্তুষ্ট (বা অসন্তুষ্ট) থাকবেন, না কি ছুঁতে চাইবেন তাঁর অব্যাহত সমগ্রতাকেও? সেটাই নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত। কিন্তু একালের পাঠকের কাছে কতটা প্রাসঙ্গিক বিষ্ণু দে-র কবিতা? জন্মশতবর্ষে পৌঁছনোর পর, এসব প্রশ্ন নতুন করে ওঠাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে উঠেছেও। বিষ্ণু দে-র কবিতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তেমনি একটি প্রবন্ধ, অরুণ সেনের ‘কঠিন ব্রতের গৌরব’, আমাদের জন্য আলোচনার পরিসর তৈরি করে দিতে পারে। [...]

বিগত সাত-আট দশকে বিষ্ণু দে-র কবিতা নিয়ে কম বির্তক হয়নি। পাঠকের মুগ্ধতা ও ঔদাসীন্য – দুই-ই জুটেছে এই কবির ভাগ্যে। যাঁর কবিতা ব্যক্তি, সমাজ, শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির সম্বন্ধসূত্রে জড়ানো, তাঁর পাঠক কি কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু কবিতা ভালো-লাগার (বা না-লাগার) অনুভব নিয়ে সন্তুষ্ট (বা অসন্তুষ্ট) থাকবেন, না কি ছুঁতে চাইবেন তাঁর অব্যাহত সমগ্রতাকেও? সেটাই নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত। কিন্তু একালের পাঠকের কাছে কতটা প্রাসঙ্গিক বিষ্ণু দে-র কবিতা? জন্মশতবর্ষে পৌঁছনোর পর, এসব প্রশ্ন নতুন করে ওঠাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে উঠেছেও। বিষ্ণু দে-র কবিতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তেমনি একটি প্রবন্ধ, অরুণ সেনের ‘কঠিন ব্রতের গৌরব’, আমাদের জন্য আলোচনার পরিসর তৈরি করে দিতে পারে।

লেখাটি এ বছরের জানুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত বিষ্ণু দে : স্বভাবে প্রতিবাদে নামের বইয়ের অন্তর্গত। বিষ্ণু দে-কে নিয়ে একই লেখকের ইতিপূর্বে প্রকাশিত বইগুলো হলো : এই মৈত্রী এই মনান্তর ; বিষ্ণু দে-র রচনাপঞ্জি ; বিষ্ণু দে, এ ব্রতযাত্রায় ; যামিনী রায় বিষ্ণু দে: বিনিময় ; বিষ্ণু দে-র কথা ; বিষ্ণু দে-র নন্দনবিশ্ব এবং ইংরেজিতে ও বাংলায় জীবনী বিষ্ণু দে । প্রথমোক্ত বইটি উল্লিখিত কয়েকটি গ্রন্থের নতুন বিন্যাস, অবশ্যই নতুন সংযোজন সহ।

বিষ্ণু দে-র শততম জন্মদিনে (নাতি)দীর্ঘ এই লেখাটি পড়ার ও আলোচনায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ রইল সকলের প্রতি।

. . .

‘কঠিন ব্রতের গৌরব’
অরুণ সেন

তিরিশের কবিদের প্রত্যেকেই যখন একে-একে একশো বছরে পৌঁছোচ্ছেন, তখন, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই, এই প্রশ্ন সংগতভাবেই ওঠে : যে-কবির প্রতি আমরা একদা আগ্রহী ছিলাম, সেই কবি আজও কতটা পঠিত? সব কবিরই নিজস্ব পাঠক ছিলেন সমকালে, পরে দীক্ষিত স্থায়ী পাঠকসমাজও গড়ে উঠেছে তাঁদের এক-একজনকে ঘিরে – কিন্তু অনেকসময় পার করে সেই কবি সম্পর্কে নতুন পাঠকের উৎসাহ কি টিকে আছে এখনও? নতুন পাঠকের নতুন আবিষ্কার কি ঘটছে? মনে কি হচ্ছে, আজও সেই কবি জীবিত এবং প্রাসঙ্গিক?

অবশ্য তফাত একটা হয়েই যায়, সময়-বদলের সঙ্গে-সঙ্গে। পাঠ্যসূচির প্রশ্রয় না থাকলে মাইকেল কতখানি পড়া হত? গান বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথই-বা কতটা? বিদেশেও কি তা-ই নয়? সমকালের পরে পাঠক তো ক্রমশ সংকুচিত হয়েই যায় – এমনকি যাদের ক্লাসিক বলি, তাদের ক্ষেত্রেও কি তা সত্যি নয়? তা ছাড়া আধুনিক কবিতার পাঠক তো প্রথম থেকেই সংকুচিত। পরে সমকালের উত্তাপ কমে গেলে তার জগৎ আরও ছোটো হয়ে যায়। ব্যতিক্রমও আছে নিশ্চয়ই। কেউ-কেউ বলবেন জীবনানন্দের কথা। কিন্তু জনপ্রিয়তারও আছে ওঠানামা। সমকালের জনপ্রিয়তা ও সময় পেরিয়ে যে-জনপ্রিয়তা তার মধ্যে একটা পার্থক্য থাকেই – পাঠ ও পুনঃপাঠের মধ্যে।

জনপ্রিয়তা শব্দটিও তো বেশ গোলমেলে। কোনোসময়েই তেমন জনপ্রিয় হননি এমন লেখকও তো বড়ো লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পান। আবার জনপ্রিয় হয়েছেন এমন লেখক জনপ্রিয়তার কারণেই অগ্রাহ্য হবেন এমনও নিশ্চয়ই নয়। তা ছাড়া জনপ্রিয় কার কাছে, কতটা? পাঠকের মধ্যেও তো কত ভেদ, কত স্তর, কত মান! কার প্রতিক্রিয়াকে গ্রাহ্য করব? এমন অনেক লেখাও তো আছে, যেটা কোনোসময়েই সে-অর্থে হয়তো জনপ্রিয় হবে না, কিন্তু প্রস্তুত কোনো পাঠকের আছে তার গ্রাহ্যতাও কমবে না।

সবচেয়ে মুশকিল হয়, যখন দেখি কোনো কবির স্মরণ-অনুষ্ঠানে এমন আচরণই করা হতে থাকে, যেন সেই মানুষটি অদ্বিতীয়। আশেপাশে আর কেউ নেই। সহযাত্রী বলে কেউ নেই। অবশ্য শুধু স্মরণ-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেই নয়, সাহিত্যপাঠের সামগ্রিক রুচিতেও এই একদেশদর্শিতায় আমরা অভ্যস্ত। বিষ্ণু দে-র ক্ষেত্রেও একসময়ে লক্ষ করা যেত, তাঁর একনিষ্ঠ ভক্তরা তাঁকেই একমাত্র আলোচ্য মনে করছেন। ঠিক যেমন পাশপাশি দেখা যেত অন্যরা অনেকে বিষ্ণু দে-কে বিবেচনার যোগ্যই মনে করছেন না। এমনকি কখনও তাঁকেই একমাত্র বর্জনীয় মনে করছেন।

বস্তুত এভাবে প্রথম থেকেই বিষ্ণু দে এক বিতর্কিত কবি। তাঁর কবিতার দুরূহতার কথা উঠেছে বারবার। তবু, তখনও, তাঁর কবিত্বের জোর বা স্বাতন্ত্র্য অস্বীকৃত নয়। ‘মিথ’ বনে গেছেন, যাঁরা তাঁর তত অনুরাগী নন তাঁদের কাছেও। তা ছাড়া তাঁর প্রবল অনুরাগী পাঠকেরাও দীক্ষিত প্রথম থেকেই এবং সারা জীবন। তাঁর সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া যেন দুই মেরুতে। হয় সম্পূর্ণ গ্রহণ, না হয় সম্পূর্ণ বর্জন। রুচির একদেশদর্শিতার চরম উদাহরণ ছিল সেটাই।

আজকের পাঠক বোধহয় অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝতে শিখেছে, সাহিত্যের গ্রহণ বা বর্জন ঠিক তত্ত্ব বা তথ্যের গ্রহণ-বর্জনের মতো নয়। হয়তো গত কয়েক দশকের সামাজিক বা রাজনৈতিক মতামত বা বিশ্বাস বা ধারণার জগতে যে ওলট-পালট ঘটেছে, সেটাই শেষপর্যন্ত নান্দনিক রুচির ক্ষেত্রে উদারতার রাস্তা ক্রমশ পরিষ্কার করে দিচ্ছে। আমরা বুঝতে শিখেছি, জীবনানন্দ বা বিষ্ণু দে-র অনুরাগী পাঠক একসঙ্গে হওয়া সম্ভব। আজকে ‘জীবনানন্দ-সর্বস্বতা’র কথা বলছেন কেউ, সেরকমই আমরা বলতে পারি, ‘বিষ্ণু দে-সর্বস্বতার’ও কোনো দরকার ছিল না কখনও।

তার মানে এই নয় যে, কোনো পাঠক কোনো একজন লেখককে আর-একজন লেখকের বা আরও অনেক লেখকের চেয়ে বেশি পছন্দ করতে পারবেন না – একজনের তুলনায় আরেকজনের প্রতি পক্ষপাত থাকবে না। কিন্তু আমরা শুধু তাঁর লেখাই পড়ব এমনও হতে পারে না। একজন পাঠকের একজন লেখকই থাকবেন – সেটা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক নয়। তবে ভিন্ন-ভিন্ন ধরণের লেখার প্রতি মনোযোগ ও আকর্ষণ থাকলেও তারই ভেতর থেকে একজন সম্পর্কে বেশি আগ্রহ থাকাটাও স্বাভাবিক। সেটা সেই পাঠকের নান্দনিক রুচির ব্যাপার। দুজন ভিন্ন রুচির লোক যখন দুই পৃথক কবির প্রতি পক্ষপাত দেখান, তখন কার নির্বাচন ঠিক, তা সহজে বলা যায় না – আদৌ বলা যায় কিনা জানি না, কিন্তু কাছাকাছি সময়ে যে বলা যায় না, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। বলা যায়, দূরের সময় ভালো বিচারক। কিন্তু কত দূরের? এমনও তো দেখা গেছে, একসময়ে যিনি নন্দিত, পরে তিনি অবহেলিত, আরও পরে ঘটে যাচ্ছে আবার তার পুনর্বিচার ও নতুন করে প্রশংসা। অবশ্য যখন এভাবেই প্রশংসা ফিরে আসে, তখন হয়তো দেখা যায় ‘কারণ’টাই বদলে গেছে, অর্থাৎ আগে যে-কারণে প্রশংসা করা হত, এখন আর শুধু সে-কারণে নয়, নতুন কিছু খুঁজে পাচ্ছেন নতুন যুগের পাঠক। বিভূতিভূষণ বা জীবনানন্দ নিয়ে আজ যে আবার নতুন করে উৎসাহ, তার পেছনেও কি নেই নতুন পাঠকের নতুন আবিষ্কার?

পাশাপাশি আজ বিষ্ণু দে কতখানি পঠিত হচ্ছেন, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি যখন হতে হয়, তখন আরও একটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন লেখককে যখন কোনো উপলক্ষ্যে আমরা স্মরণ করি, তখন নেই উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে সেই লেখককে নিয়ে যতটা সমারোহ হয়, তাতে তাঁকে গ্রহণ করার দিক কতটা তাৎক্ষণিক বা খণ্ডিত বা বহিরঙ্গ, এবং কতটাই-বা সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ। দৃষ্টান্তস্বরূপ এ-প্রশ্নও কেউ-কেউ করেছেন, সামগ্রিকভাবে জীবনানন্দই বা কতটা পঠিত, বাইরের হইচইয়ের তুলনায়। এ কথা তো সকলের সম্পর্কেই বলা যায়। অবশ্যই দীক্ষিত স্থায়ী পাঠক এঁদের সকলেরই আছেন এবং থাকবেন।

বিষ্ণু দে-র কবিতার ভিন্ন চারিত্র্য যদি একদা বহু পাঠককে স্পর্শ করে থাকে – তাঁর কবিতার বিস্তার ও সমগ্রতা, তাঁর কবিতার ভাষা ও বাচনের স্বরূপকে ভর করে সেই পাঠকের প্রস্তুতি যদি একসময়ে তৈরি হয়ে যায় – আজ সমাজ রাজনীতি বা সংস্কৃতির পরিবেশের নিঃস্বতায় যদি সেই প্রস্তুতি আড়ালে চলে গিয়েও থাকে সাময়িকভাবে – কবিতার সেই উচ্চারণ কি আবার শোনা যাবে না, যদি তার মধ্যে আবহমান ও অবিনাশী সত্য কিছু থেকে থাকে। পাঠকের অপ্রস্তুতি বা অন্যমনস্কতার দায় কেন বহন করতে হবে সেই লেখককে যিনি সমগ্রের সঙ্গে অবিরল সংলগ্নতা ছাড়া বাঁচেন না? কেন অপেক্ষা করতে হবে সীমাবদ্ধ সেই দীক্ষিত পাঠকের জন্যই শুধু?

অবশ্য সেই দীক্ষিত পাঠকের পক্ষপাত মানে এই নয় যে, সেই লেখকের সব লেখা সম্পর্কেই তাঁর সমান প্রশ্নাতীত অনুরাগ থাকতেই হবে। কিংবা, উলটো করে বলা যায়, যে-লেখক সম্পর্কে কোনো পাঠক তুলনায় উদাসীন, সেই লেখকের কোনো লেখাই ভালো লাগবে না বা লেখার কোনো গুণই ধরা পড়বে না – তাই বা হবে কেন? বিষ্ণু দে-র কবিতার অনুরাগী পাঠকও তাঁর সব কবিতা সম্পর্কে সমান আগ্রহী হবেন, এমন তো নাও হতে পারে। সমকালীন পাঠক যেমন, তেমনই পরবর্তীকালের পাঠকও – তিনি যখন বিষ্ণু দে-র কাব্যসম্ভাবে উদ্দীপ্ত তখনও কবির কোনো কোনো কবিতায় সাড়া নাও দিতে পারেন।

প্রথমদিকে বিষ্ণু দে-র কবিতায় দুরূহ শব্দ ও দেশবিদেশের পুরাণ থেকে উল্লেখ ছিল খুবই বেশি – রাবীন্দ্রিক যুগের পর প্রয়োজনও ছিল হয়তো আধুনিকের নন্দনে, কবিতাকে সংহত ও তীব্র করে তোলার জন্য। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক প্রয়োজন মিটে গেছে। এখন তা পাঠককে অনেকসময়েই বাধাগ্রস্ত করে। অবশ্য কবিরও কি মনে হয়নি তা অহেতুক – না হলে তাঁর কবিতা কেন ক্রমশই সেই কঠিনের পথ ছেড়ে সহজের দিকে, কঠিন সহজের দিকে যেতে চাইবে? নিজের পথ খোঁজার দুরন্ত তাগিদেই হয়তো পুনরাবৃত্তি ঘটেছে – শব্দের পুনরাবৃত্তি, ভাবনার পুনরাবৃত্তি, বাক্প্রতিমার পুনরাবৃত্তি। কবিস্বভাবের এই লক্ষণ বোধহয় সব কবির কবিতাতেই কমবেশি থাকে। এবং সেই কবিতাগুলো পরবর্তীকালে হারিয়ে যেতে চায়। কোথাও-বা, পাঠকের মনে হয়, তাঁর কবিতায় তথ্যটা বড়ো হয়ে উঠেছে, নিষ্প্রভ আপ্তবাক্য শোনা যাচ্ছে – সেকালের অবিশ্বাসী পাঠককে শুধু নয়, একালের সহৃদয় পাঠককেও যা স্বস্তি দিতে পারছে না।

কিন্তু সেটাই তো সব নয়। কবির কোনো-কোনো কবিতার খুচরো বিচারে নয়, কবিস্বভাবের সামগ্রিকতাতেই জুটে যায় তাঁর কবিতার স্থায়ী অনুপ্রাণিত পাঠক। বিষ্ণু দে-র সেরকম স্থায়ী পাঠক আজও আছেন অনেক। এবং আছে তাঁদের নিরন্তর এই আত্মজিজ্ঞাসা – কেন এই কবি আজও তাঁদের কাছে জীবন্ত, কেন এত জরুরি, কেন মনে হয় সমকালীন? এই কবিতার উত্তরাধিকার ঠিক কোথায়? সব কবি সম্পর্কে যেমন, তেমনই বিষ্ণু দে সম্পর্কেও তাঁর পাঠককে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এবং সব জবাবই যে এক হবে তা নয়। আজকের জমিতেও বিষ্ণু দে-র প্রাসঙ্গিকতার সূত্রগুলিও হবে অন্যদের থেকে আলাদা, বলাই বাহুল্য।

আমরা সবাই জানি, বিষ্ণু দে-র কবিতার একটা মূল ব্যাপারই হল, সেখানে সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়টা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলন ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের ঘটনাবহুল জীবন ও আন্দোলন তাঁর কবিতায় সরাসরি ছায়া ফেলে।

এখন প্রশ্ন, আজকের যে-পাঠক সেসব ঘটনা থেকে দূরবর্তী, যাঁদের কাছে সেসব কানে শোনা বা বইয়ে পড়া শুধু, কিংবা বয়স্ক পাঠক, যাঁর কাছে ধূসর স্মৃতি, তাঁদের কাছেও কি সে-সময়ের ঘটনার প্রত্যক্ষ চাপে বা প্রেরণায় লেখা কবিতাগুলি সমান সাড়া জাগাবে আজও? তা ছাড়া ওইসব ঘটনা বা আন্দোলনের ব্যাপারে যে ব্যাপক সম্মতি ছিল, আজ অনেকক্ষেত্রেই তো তা আর নেই। মূল্যায়ন বদলেছে। যে-মতবাদের প্রেরণায় বিষ্ণু দে তাদের দেখছেন, তা নিশ্চয়ই অতীত হয়ে যায়নি, কিন্তু অর্থান্তর ঘটেছে। এইসব ঘটনা বা মতবাদের বাতাবরণে যে-কবিতা লেখা হয়েছে, সেই কবিতাগুলো আজ নতুন পরিস্থিতিতে আজকের পাঠককে কীভাবে নাড়া দেবে?

রাজনীতি ও কবিতার সম্পর্ক-সূত্রে বিষ্ণু দে-কে জীবিতকালে দুটো অভিযোগই শুনতে হয়েছে একইসঙ্গে। কেউ বলেছেন, তাঁর কবিতায় বড়ো বেশি রাজনীতি। কেউ বলেছেন, রাজনীতির অভাব। যদি রাজনীতির লক্ষ্য ও কার্যক্রমের বদলের সঙ্গে-সঙ্গে কবিতা অবান্তর হয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে, রাজনীতির সঙ্গে কবিতার সম্পর্কের মধ্যে গোলমাল ছিল – অথচ সেই রাজনীতিই চেয়েছিলেন বিষ্ণু দে-র কোনো কোনো বিরুদ্ধ-সমালোচকেরা। কিন্তু, বিষ্ণু দে-র কবিতায় রাজনীতি যে-আগুন জ্বালিয়েছিল, তা কখনও রাজনীতির সংকীর্ণ চাওয়া-পাওয়াকে তৃপ্ত করতে নয় – রাজনীতি জীবনের যে-মাধুকরী ব্রতের সঙ্গে জড়িত, তারই সম্বন্ধসূত্রে সেই নির্ভরতা। রাজনীতির পালাবদল ঘটলেও সেই ব্রতটা মিথ্যে হয়ে যায় না।

উর্বশী ও আর্টেমিসচোরাবালি পার হয়ে বিষ্ণু দে যখন পূর্বলেখ বইতে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার দিকে গেলেন, তখন থেকেই তাঁর কবিতায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার স্পষ্ট ছাপ পড়ল – কিন্তু সেসবের মধ্যে যে-পথসন্ধান যাকে তিনি বলেছেন ‘সহস্রবাহু নীড়ে খুঁজি ভাষা’ তা তো মানুষেরই ধর্ম হিসেবে উচ্চারিত। যে-রাজনৈতিক প্রেরণায় তাঁর কবিজীবনের বাঁকবদলের কথা এই বইয়ের অজস্র কবিতায় আছে, তাকে তাঁর নিজস্ব সমস্যা না ধরে, ব্যক্তিগত থেকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে মানবযাত্রার রূপক হিসেবে স্পষ্ট চেনা যায়।

আন্তর্জাতিক কোনো ঘটনায় বা দুর্ঘটনায় হয়তো তিনি লিখতে পারেন বার্ধক্যভারে অক্ষম অর্জুনকে পরাজিত করে ‘প্রচণ্ড কিরাত’-এর আবির্ভাবের কথা – কিন্তু পুরাণের রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকে ছাপিয়ে পাঠক তো একে গ্রহণ করতে পারেন নতুনের আবাহন হিসেবেই। সেই আবাহনই ‘জন্মাষ্টমী’ কবিতাতেও – ভাঙাচোরা কলকাতায় সমস্ত আকাশ থেকে ঝরে পড়া ‘আনন্দসংগীত’।

পরে সেই দায়বদ্ধতায় আরও চড়া সুর লাগে। সাত ভাই চম্পা-তে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লড়াই, সে-সময়ের সোভিয়েতের উজ্জ্বল ভূমিকা, এ সবই তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে প্রেরণা জোগায়। এলুয়ার-আরাগঁ-নেরুদার প্রায় সমান্তরালে তিনি লেখেন প্রতিবাদের কবিতা, লড়াইয়ের কবিতা। কিন্তু তারই মধ্যে মঙ্গলকাব্য-রূপকথা-লোককথার অনুষঙ্গে স্বদেশি কবিতার হাওয়া বইতে থাকে – চিরকালের বাংলাকে স্পর্শ করে।

কোনো-কোনো রাজনৈতিক কর্মীকে বন্দিত করে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখেছেন বিষ্ণু দে। সেসব কবিতার লক্ষ্য কারা তা হয়তো তাঁর সে-সময়ের বন্ধুরা ভালো বলতে পারবেন, কিন্তু আজ যখন পড়ি তখন সেই কবিতার মধ্য দিয়ে পৌরুষের একটা আবহমান ছবি ফুটে ওঠে :

বাধাবিপত্তি অনেক, তবুও মুহ্যমান
বারেকও নয় সে, প্রবল ঢেউয়ের লবণাঘাত
অবিরাম চলে, অসীম ধৈর্যে বেঁধেছে গান
জোয়ারে ভাটায় রৌদ্রে রাত্রে হাতে দুহাত
পাহাড়ে পাথরে, বালির চড়ায়, সাগরজল
অতি প্রত্যয়ে হঠাৎ হতাশে নয় বিকল,
আশ্বিনে-মেঘে ভাসে ভাদ্রের বৃষ্টিজল
চেতনার নীলে গত আগামীর গভীর গান।

দাঙ্গার সময়েই লেখা দাঙ্গা-প্রতিরোধেরও লেখা পড়তে-পড়তে কেউ কেউ অন্ধকার সময়ের দৈনন্দিনকে খুঁজে পাবেন, কিন্তু সেইসঙ্গেই আবার উপলক্ষ্যকে ছাপিয়ে তার মধ্য দিয়ে চিনে নেবেন মানুষের জীবনের অর্থহীন অপঘাত এবং তার বিরুদ্ধে চিরকালীন বীরত্বেরও প্রতিমা।

এরপর তেভাগা-আন্দোলন, কাশ্মীর-ত্রিবাঙ্কুর-তেলেঙ্গানার অভিজ্ঞতা, নৌ-বিদ্রোহ – একের পর এক আন্দোলনগুলি কবিকে সেই দাঙ্গার নরক থেকে মুক্তি দিল। সন্দ্বীপের চর বইয়ের দীর্ঘ কবিতাগুলিতে সেই মুক্তির আবেগ প্রকাশ পেল আকাশভাঙা বৃষ্টির উপমায়, খরস্রোত নদীর সমুদ্রের দিকে চলার উপমায়। প্রকাশ পেল কবিতার ছড়ানো শরীরে। এ তো যে-কোনো বদ্ধতা থেকেই মানবিক মুক্তির ভাষ্য – যা চিরকাল মানুষ খুঁজে বেড়ায়। তেভাগা-আন্দোলনের কৃষাণ বা কৃষাণবউ ‘দীপ্ত বাহু, দৃপ্ত ঊরু, পূর্ণসাধ মানুষ’-এরই প্রতিমা। তাদের শুধু বালুরঘাটে, কাকদ্বীপে, সুসং পাহাড়েই নয়, শুধু তেভাগার দিনগুলিতেই নয়, খুঁজে ফেরা হবে সর্বত্র এবং চিরকাল। বামপন্থী রাজনীতির অন্তর্কলহ ও আক্রমণের চাপ থেকে লেখা কবিতা কীভাবে সাম্প্রতিককে ছাপিয়ে জীবনের সাতরঙা সিমফনির সুর শোনাতে পারে, আমরা তো দেখেছি তাঁর অন্বিষ্ট-তে। দাঙ্গা-দেশভাগের বিপর্যয়ে তাড়িত মানুষও তো তাঁর পাঠক। আর এই সবকিছু ঘটনাকে জড়িয়ে নিয়েই তিনি এনে দিতে পারেন সেই পাঠকের মনে, তার অভিজ্ঞতারই পথ ধরে, নবজন্মের আনন্দ।

তোমাতেই বাঁচি প্রিয়া
তোমারই ঘাটের গাছে
ফোটাই তোমারই ফুল ঘাটে ঘাটে বাগানে বাগানে।
জল দাও আমার শিকড়ে।

তারপর দেখেছি স্বাধীনতার পরের স্বদেশ – সমাজ ও রাজনীতির গঠন ও পুনর্গঠনের সাফল্য ও ব্যর্থতা, ব্যক্তির আশা ও নিরাশা কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর কবিতায়, অনুভবের পুঙ্খানুপুঙ্খে ও বিস্তারে। তাকে তথ্য দিয়ে যেমন চেনা যায়, তেমনই আবার তথ্যের পরোয়া যিনি করেন না, তিনিও শুনতে পান ত্রিকালের বোল, ‘পৃথিবীর ছয় রাগ’ – ‘মাটিতে জীবনে প্রতিদিন’।

নাম রেখেছি কোমল গান্ধার, আলেখ্য, তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ, স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত – প্রত্যেকটি বইতে আছে সময়ের আঘাত ও শ্রশ্রূষা। তা থেকেই বেরিয়ে এসেছে কবির আত্মপরিচয় – তাঁর স্নায়ুর ঘাঁটিতে অম্লান পিপাসা, ইন্দ্রিয়ের হর্ষ, যৌবনের উচ্ছ্বসিত দীপ্তি। আশা আর নিরাশা, আলো আর অন্ধকার, আনন্দ আর বিষাদ দ্বন্দ্বেমিলনে পৌঁছে দেয় পাঠকের কাছে মানবিক অস্তিত্বের সেই সত্য, যা দেশ ও কালের যেমন, তাকে ছাড়িয়েও।

এমনকি শেষ পর্বের কবিতা, যখন ক্লান্তি আর অবসাদ আর বার্ধক্য তাঁকে ছেয়ে ফেলেছে, চারপাশের ভঙ্গুরতার মধ্যে তাঁর আশাবাদকেও যান্ত্রিক মনে হচ্ছে – তখনও হঠাৎ-হঠাৎ কোনো উচ্চারণে আমরা তাঁর কবিত্বের সেই পরাক্রান্ত স্বরূপকেই খুঁজে পাই, যেখানে প্রেমের ব্যক্তিগত সম্ভাষণেও দেশ ও কালের রূপক।

এভাবেই যে-কোনো একটি উপলক্ষ্য, কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিক্ষোভের এক-একটি অধ্যায় কীভাবে বাস্তবের বা খণ্ডিত সময়ের সীমাকে ছাপিয়ে যায়, কবিতার সেই রহস্যকেই খুঁজে পাই বিষ্ণু দে-র মধ্যে। ওই উপলক্ষ্যের কারণেই কোনো কবিতা সমকালীন পাঠককে এক রকমের তৃপ্তি দিয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তাদের মধ্যে যেগুলি উপলক্ষ্যকে ছাপিয়ে বড়ো ও স্থায়ী কোনো সত্যের কথা বলেছে, সমকালের অনুভবের সমান্তরালে পরবর্তীকালের কোনো অনুভবকে টেনে আনতে পারছে, সেগুলোও কবি হিসেবে বিষ্ণু দে-কে আজও প্রাসঙ্গিক করে রাখবে।

হয়তো কথাটা এভাবেও বলা যায়, কোনো-কোনো সময়ের অভিজ্ঞতা যে পরবর্তীকালেও প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারছে, সে তো কবিরই মহত্ত্বের স্মারক। কবিকে ‘ক্রান্তদর্শী’ বা ‘দ্রষ্টা’ যে বলা হয়, সে তো এই কারণেই। ভবিষ্যতের আভাস পাওয়া যায় বলেই তো সাম্প্রতিককে ছাড়িয়ে তা টিকে আছে। আজ যখন প্রায়ই সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত নিশ্বাস গায়ে লাগে কারো-কারো একক বা দলবদ্ধ চলনে-বলনে, তখন মনে পড়ে যায় সন্দ্বীপের চর-এ কত আগে পাওয়া গিয়েছিল ‘ঘৃণার সমুদ্র নীল নীল জল আকণ্ঠ ঘৃণায়’। কবি লিখেছিলেন একসময়ে, ‘যেখানে রয়েছি আজ সে কোনো গ্রামও নয়, শহরও তো নয়’ – ভুল পরিকল্পনার কয়েক দশক পার হয়ে তাকে আরও রূঢ় সত্য মনে হয়। পোখরান-বিস্ফোরণের পর একজন পাঠকের মনে হয়েছিল, চল্লিশ বছর আগের লেখা ‘কিবা গ্রিস কিবা ট্রয়’ কবিতাটি আজ নতুন একটা মাত্রা পেয়ে যাচ্ছে – ‘বিশ্বব্যাপ্ত লজ্জা’ এখন সম্পূর্ণ ঘরেই দাঁড়িয়েছে ‘সোনায় বোমায় উচাটনে’। আজকের রাজনৈতিক হত্যার পরিবেশেই কি মনে পড়ে না, এই রাজনৈতিক সংঘর্ষের সূচনাতেই আহত কণ্ঠে কবি জিজ্ঞাসু হয়েছিলেন, ‘কোথা সেই ঐক্যতান?’ বলেছিলেন, প্রত্যেকেই কেন ‘আজও স্বস্ব তন্ত্রে থামে?’

তবে নৈরাশ্যময় অন্ধকারে সাক্ষীই শুধু তিনি নন, কবি যে অনেকদিন ধরে শোনাচ্ছেন, ‘অন্য অন্ধকার’ চাই – ‘লক্ষ লক্ষ জীবন-মৃত্যুর ক্ষিপ্র দিব্য অন্ধকার’ – সত্যিকারের আলো-কে পেতে সেই ‘সৃষ্টিময়’ অন্ধকারকে খোঁজা প্রয়োজন তো আরও বেশি। কুটিল অন্ধকারের সঙ্গে আপস করে যে-বানানো ঝাপসা আলোয় আমাদের এখন বসবাস, তার চেয়ে বাস্তবের নিশ্ছিদ্র ঘন অন্ধকারের মুখোমুখি হয়েই বরং ‘সাবালক চৈতন্যের সত্যে দীপ্ত’ ‘আরেক’ আলো-কে পাওয়া যাবে। কবি তারই জন্য এই ‘অলৌকিক’ অন্ধকারকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মার্কসবাদী ‘অন্ধকার’কে খুঁজছেন তা নিয়ে বিস্ময়ও প্রকাশ করেছিলেন কেউ – কিন্তু সে-প্রশ্ন ছাড়েননি আমাদের কবি : ‘এ অন্ধকারে কী দেখো সুরঙ্গমা?’

এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে তাই আমাদের দেরি হয় না, বিষ্ণু দে তাঁর দীর্ঘ কাব্যজীবনে – তাঁর রচনার অজস্রতায় ও প্রবহমানতায় ও সমগ্রতায় – কবিতাকে একটা বড়ো জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন। স্মৃতি আর সত্তা আর ভবিষ্যৎকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন এমন এক জায়গায়, স্বদেশ ও স্বকালের পূর্ণ রূপ দেখার অভিযান যেখানে চালানো যায়। কবি হিসেবে তাঁর গরিমা প্রতিষ্ঠিত হয় নিশ্চয়ই এখানেও। কবিতারও গরিমা।

কিন্তু, মহত্ত্বের বিশেষণে তাঁকে মাথায় তুলে রাখলেই তো বাঁচিয়ে রাখা যায় না। শুধু কল্পনার বিশালতা অনুধাবন করেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। তিনি তাঁর উচ্চারণের স্বকীয়তায় কীভাবে পরের যুগের একজন পাঠকের উচ্চারণে ঢুকে যেতে পারছেন, সেটাও মনে রাখার দরকার হয়। তাঁর ওই কবিতার বাচন যদি সেদিনের পাঠকের মতো আজকের কোনো তরুণ পাঠকের ব্যক্তিগত অনুভবের মুহূর্তে স্মরণীয় মনে হয়, তবে সেখানেই তিনি বেঁচে থাকবেন, তাঁর কবিতা বেঁচে থাকবে।

শুধু রাজনীতির কবিতা নয়, শুধু দেশ ও কালের কবিতা নয় – তাঁর কবিতা তো ব্যক্তিরও কবিতা – প্রেমের কবিতা, প্রকৃতির কবিতা। তবে এককভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সবার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সবাই। কখনও ব্যক্তিগত কবিতাই স্পর্শ করে নৈর্ব্যক্তিককে , কখনও-বা পুরাণ প্রতিমাতেই পেয়ে যাই ব্যক্তিগতের ইশারা। তা আমরা জেনেছিলাম ‘ওফেলিয়া’ বা ‘ক্রেসিডা’ লেখার সময় থেকেই। ‘ঘোড়সওয়ার’কে যৌন-আকাঙ্ক্ষার রূপক বলা হয়েছিল তা তো আমরা জানি, সে-সময়েই তার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে একজন ইংরেজ বিদগ্ধ পাঠকের মনে হয়েছিল, ঘোড়সওয়ার বিপ্লবের বার্তাবহ। কয়েকদিন আগে শুনলাম আজকের কোনো পাঠক প্রশ্ন তুলেছেন, প্রেমের কবিতাই-বা নয় কেন?

‘চাই না তুমি বিনা শান্তিও’ উচ্চারণ করতে-করতে একদা একজন মনে করেছিলেন তাঁর সঙ্গিনীকে শোনাবার যোগ্য এই গান – তিনিও সে-সময়েই কি টের পাননি ভবিষ্যতের জন্য একটা বড়ো স্বপ্নের ইশারা আছে এই শব্দগুলির আড়ালে? তা না হলে শেষ হবে কেন কবিতাটি এইভাবে?

তোমাকে জেনেছে যে শান্তি নেই
জীবনে তার আর, সেই হীরার।

প্রেমের সমুদ্রে ‘পূর্ণিমার নীলিমা অগাধ’ খুঁজতে-খুঁজতে যদি বলা যায় :

আমার মেটে না সাধ, তোমার সমুদ্রে যেন মরি
বেঁচে মরি দীর্ঘ বহু আন্দোলিত দিবস-যামিনী,
দামিনী, সমুদ্রে দীপ্র তোমার শরীরে …

সেই দামিনীই তো তাঁর কবিতার স্বপ্নসম্ভব। তাই তো এর অনেকদিন পরেও তাঁর কণ্ঠে শুনতে পাই :

বহুদিন দেখেছে সে, দেখে শুনে মেটে কি এ-সাধ?
বহুদিন দেখে-দেখে হয়ে গেল মরমী সাধক।

এরকমই যে-কবিতাগুলি ঘরোয়া উচ্চারণে দৈনন্দিনকে স্পর্শ করে, তা চকিতে ছুঁয়ে যায় একটা বড়ো অভীপ্সাকে, পৌঁছে দেয় ঊর্মিল স্বপ্নবীজের জগতে। এক কিশোরীর লঘুলাবণ্যের ছোটাছুটি দেখতে-দেখতে, তার কোমল শরীরের তরল স্রোতের ছন্দ কবিকে নিয়ে যায় প্রতীক্ষার এই গাঢ় কিন্তু অনায়াস অনুভবে :

এই লাবণ্যে এই নিশ্চিত ছন্দে
আমরা সবাই কেনই বা পার হব না
সামনের এই পাহাড়ের খাড়া খন্দ?

বিষ্ণু দে-র কবিতাই আজও স্বরে ও স্বরান্তরে উচ্চারণ করতে পারেন যদি কোনো পাঠক, বিষ্ণু দে বেঁচে থাকবেন, বেঁচে আছেন সেই পাঠের মধ্যেই।

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

১ comment

  1. মুয়িন পার্ভেজ - ২৪ জুলাই ২০০৯ (৬:০১ অপরাহ্ণ)

    প্রাসঙ্গিকতা দিয়ে কি কবিতাবিচার সম্ভব বা এর প্রয়োজন আছে কি আদৌ? ভাবের ও ভাষার স্থানিক ও কালিক দাবি মিটিয়েও একটি মহৎ কবিতা বেঁচে থাকতে পারে রসব্যঞ্জনার গুণে — এ-কারণেই, রবীন্দ্রনাথের `নিরুদ্দেশ যাত্রা’র সঙ্গে বিষ্ণু দে-র `ঘোড়সওয়ার’ বিমলানন্দে পাঠ করা যায়। সমাজতন্ত্রদীক্ষিত না হয়েও চিরন্তন এক জনাভীপ্সার জায়গা থেকে অবলীলায় ছোঁয়া যায় ঈষৎবঙ্কিম এই `বৈষ্ণব’ পঙ্‌ক্তিগুচ্ছ :

    লেকে আজকাল সকলেই যায়
    তুমি মিশে গেলে সাধারণে, হায়!
    … … …
    সঙ্গে কি ঐ চৌধুরী বয়?
    … … …

    কবিতাটি আমার সংগ্রহে নেই; কেউ কি একটু লিখে দেবেন `মুক্তাঙ্গন’-এর পাতায়?

    বিষ্ণু দে ছড়াও লিখেছেন বেশকিছু, যেমন বন্ধু অন্নদাশঙ্কর রায়ের মেয়ের জন্য লেখা ধাঁধাঁর ছড়াগুলোর কথা মনে পড়ছে। তাঁর এই স্বল্পখ্যাত রাজ্যটির খোঁজখবরও নেওয়া দরকার। উপলক্ষময় (ব্যক্তিতও বলা যায়) কিন্তু তীক্ষ্মমধুর এসব রচনাও কি কেবল প্রাসঙ্গিকতা দিয়ে বিচার্য?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.