[‘ভালো আছেন?’ — এই সৌজন্যময় প্রশ্নের উত্তর অনেক সময়ে ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘মোটামুটি’-র মতো একশব্দেও দেওয়া যায়। কখনো হয়তো সামান্য বিশদেই বলতে হয় ভালো থাকা না-থাকার কথা। রবীন্দ্রনাথের “সূক্ষ্ম বিচার” লেখার চণ্ডীচরণবাবুকে এই নিরীহ প্রশ্নটা করেই ভয়ানক বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন কেবলরাম! ওই দুজনের অবিস্মরণীয় সেই সংলাপ মুক্তাঙ্গনের বন্ধুদের জন্য –]
সূক্ষ্ম বিচার
চণ্ডীচরণ ও কেবলরাম
কেবলরাম। মশায়, ভালো আছেন?
চণ্ডীচরণ। ‘ভালো আছেন’ মানে কী?
কেবলরাম। অর্থাৎ সুস্থ আছেন।
চণ্ডীচরণ। স্বাস্থ্য কাকে বলে?
কেবলরাম। আমি জিজ্ঞাসা করছিলেম, মশায়ের শরীর-গতিক —
চণ্ডীচরণ। তবে তাই বলো। আমার শরীর কেমন আছে জানতে চাও। তবে কেন জিজ্ঞাসা করছিলে আমি কেমন আছি? আমি কেমন আছি আর আমার শরীর কেমন আছে কি একই হল? আমি কে, আগে সে’ই বলো।
কেবলরাম। আজ্ঞে, আপনি তো চণ্ডীচরণবাবু।
চণ্ডীচরণ। সে বিষয়ে গুরুতর তর্ক উঠতে পারে।
কেবলরাম। তর্ক কেন উঠবে! আপনি বরঞ্চ আপনার পিতাঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করবেন।
চণ্ডীচরণ। নাম জিনিসটা কী? নাম কাকে বলে?
কেবলরাম। (বহু চিন্তার পর) নাম হচ্ছে মানুষের পরিচয়ের —
চণ্ডীচরণ। নাম কি কেবল মানুষেরই আছে, অন্য প্রাণীর নেই?
কেবলরাম। ঠিক কথা। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর —
চণ্ডীচরণ। কেবল মানুষ ও প্রাণী ছাড়া আর কিছুর নাম নেই? তবে বস্তু চেনার কী উপায়?
কেবলরাম। ঠিক বটে। মানুষ, প্রাণী এবং বস্তু —
চণ্ডীচরণ। শব্দ স্বাদ বর্ণ প্রভৃতি অবস্তুর কি নাম নেই?
কেবলরাম। তাও বটে। মানুষ, প্রাণী, বস্তু এবং শব্দ, স্বাদ, বর্ণ প্রভৃতি অবস্তু —
চণ্ডীচরণ। এবং —
কেবলরাম। আবার এবং!
চণ্ডীচরণ। এবং আমাদের মনোবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির —
কেবলরাম। এবং আমাদের মনোবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির —
চণ্ডীচরণ। এবং অন্তর ও বাহিরের যাবতীয় পরিবর্তনের ও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার —
কেবলরাম। যাবতীয় পরিবর্তনের এবং ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার —
চণ্ডীচরণ। এবং —
কেবলরাম। (কাতরভাবে) এবং না ব’লে এইখানে একটা ইত্যাদি লাগানো যাক-না।
চণ্ডীচরণ। আচ্ছা বেশ। এখন সমস্তটা কী হল বলো তো। কথাটা পরিষ্কার হয়ে যাক।
কেবলরাম। (মাথা চুলকাইয়া) পরিষ্কার হবে কি না বলতে পারি নে, চেষ্টা করি। নাম হচ্ছে মানুষের এবং অবস্তুর, না না — বস্তু এবং অবস্তুর, এবং বাহিরের ও অন্তরের যাবতীয় হৃদয়বৃত্তির, না মনোবৃত্তির, না না — যাবতীয় ভিন্ন ভিন্ন কিংবা পরিবর্তন ও অবস্থার ভিন্ন ভিন্ন যাবতীয় — এ তো মুশকিল হল! কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পারছি নে। এক কথায় নাম হচ্ছে মানুষের এবং প্রাণীর এবং — দূর হোক গে, মানুষের, প্রাণীর এবং ইত্যাদির পরিচয়ের উপায়।
চণ্ডীচরণ। এ সম্বন্ধে তর্ক আছে। পরিচয় কাকে বলে!
কেবলরাম। (জোড়হস্তে) আমি কাউকেই বলি নে। মশায়ই বলুন।
চণ্ডীচরণ। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের প্রভেদ অবগত হয়ে তাদের স্বতন্ত্র করে জানা। এই ঠিক তো!
কেবলরাম। এ ছাড়া আর তো কিছু হতেই পারে না।
চণ্ডীচরণ। তা হলে তুমি অস্বীকার করছ না?
কেবলরাম। আজ্ঞে না।
চণ্ডীচরণ। যদিই অস্বীকার কর তা হলে এ সম্বন্ধে গুটিকতক তর্ক আছে।
কেবলরাম। না না, আমি কিছুমাত্র অস্বীকার করছি নে।
চণ্ডীচরণ। মনে কর, যদিই কর।
কেবলরাম। (ভীতভাবে) আজ্ঞে না, মনেও করতে পারি নে।
চণ্ডীচরণ। তুমি না কর, যদি আর কেউ করে।
কেবলরাম। কারও সাধ্য নেই যে করে। এত বড়ো দুঃসাহসিক কে আছে!
চণ্ডীচরণ। আচ্ছা বেশ, এটা যেন স্বীকারই করলে, তার পরে — নামই যদি পরিচয়ের একমাত্র উপায় হবে তবে কি আমার চেহারা পরিচয়ের উপায় নয়? আর আমার অন্যান্য লক্ষণগুলো —
কেবলরাম। আজ সম্পূর্ণ বুঝেছি নাম কাকে বলে তার নামগন্ধও জানি নে, আপনিই বলে দিন।
চণ্ডীচরণ। ভাষার দ্বারা স্বতন্ত্র পদার্থের স্বাতন্ত্র্য নির্দিষ্ট করবার একটি কৃত্রিম উপায়কে বলে নামকরণ — যদি অস্বীকার কর —
কেবলরাম। না, আমি অস্বীকার করি নে —
চণ্ডীচরণ। কেবল তর্কের অনুরোধেও যদি অস্বীকার কর —
কেবলরাম। তর্কের অনুরোধে কেন, বাবার অনুরোধেও অস্বীকার করতে পারি নে।
চণ্ডীচরণ। এর কোনো একটা অংশও যদি অস্বীকার কর।
কেবলরাম। একটি অক্ষরও অস্বীকার করতে পারি নে।
চণ্ডীচরণ। এই মনে করো, ‘কৃত্রিম’ কথাটা সম্বন্ধে নানা তর্ক উঠতে পারে।
কেবলরাম। ঠিক তার উলটো, ঐ কথাতেই সকল তর্ক দূর হয়ে যায়।
চণ্ডীচরণ। আচ্ছা, তাই যদি হল, মীমাংসা করা যাক আমার নাম কী।
কেবলরাম। (হতাশভাবে) মীমাংসা আপনিই করুন, আমার খিদে পেয়েছে।
চণ্ডীচরণ। নাম আমার সহস্র আছে, কোনটা তুমি শুনতে চাও?
কেবলরাম। যেটা আপনি সব চেয়ে পছন্দ করেন।
চণ্ডীচরণ। প্রথমে বিচার করতে হবে কিসের সঙ্গে আমার প্রভেদ জানতে চাও — যদি পশুর সঙ্গে আমার প্রভেদ নির্দেশ করতে চাও —
কেবলরাম। আজ্ঞে, তা চাই নে —
চণ্ডীচরণ। তা হলে আমার নাম মানুষ। যদি শ্বেত পীত পদার্থের সঙ্গে আমার প্রভেদ জানতে চাও তবে আমার নাম —
কেবলরাম। কালো।
চণ্ডীচরণ। শামলা। যদি ছেলের সঙ্গে প্রভেদ জানতে চাও তবে আমার নাম —
কেবলরাম। বুড়ো।
চণ্ডীচরণ। মধ্যবয়সী।
কেবলরাম। তবে চণ্ডীচরণ কার নাম মশায়?
চণ্ডীচরণ। একটি মনুষ্যের মধ্যে, একটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মনুষ্য-বিশেষের মধ্যে, একটি পূর্ণপরিণত মনুষ্যের মধ্যে তার জন্মকাল হতে আজ পর্যন্ত যে-সকল পরিবর্তন অহরহ সংঘটিত হচ্ছে এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত হবার সম্ভাবনা আছে, সেই পরিবর্তন ও পরিবর্তনসম্ভাবনার কেন্দ্রস্থলে যে-একটি সজ্ঞান ঐক্য বিরাজ করছে, তাকেই একদল লোক অর্থাৎ সেই লোকদের সজ্ঞান ঐক্য চণ্ডীচরণ নামে নির্দেশ করে।
কেবলরাম। সর্বনাশ! মশায় বেলা হল। অত্যন্ত ক্ষুধানুভব হয়েছে, আহারও প্রস্তুত, এবার তবে —
চণ্ডীচরণ। (হাত চাপিয়া ধরিয়া) রোসো — আসল কথাটার কিছুই মীমাংসা হয় নি। সবে আমরা তার ভূমিকা করেছি মাত্র। তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে আমি ভালো আছি কি না; এখন প্রশ্ন এই, তুমি কী জানতে চাও, আমার অন্তর্গত প্রাণী কেমন আছে জানতে চাও, না মনুষ্য কেমন আছে জানতে চাও —
কেবলরাম। গোড়ায় কী জানতে চেয়েছিলুম তা বলা ভারি শক্ত। কিন্তু আপনার সঙ্গে এতক্ষণ কথা কয়ে এখন অনুমান হচ্ছে আপনার সজ্ঞান ঐক্য কেমন আছেন এইটে জানাই অজ্ঞান আমার অভিপ্রায় ছিল।
চণ্ডীচরণ। অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলে।
কেবলরাম। তা হলে মাপ করবেন — অপরাধ করেছি, এখন অনুতাপে এবং পেটের জ্বালায় দগ্ধ হচ্ছি। আহারের পূর্বে এরকম প্রশ্ন আমি আর কখনো আপনাকে জিজ্ঞাসা করব না।
চণ্ডীচরণ। (কর্ণপাত না করিয়া) আমি ভালো আছি কি না জিজ্ঞাসা করলে প্রথম দেখা আবশ্যক ভালোমন্দ কাকে বলে। তার পরে স্থির করতে হবে আমার সম্বন্ধে ভালোই বা কী আর মন্দই বা কী। তার পরে দেখতে হবে বর্তমানে যা ভালো তা —
কেবলরাম। মশায়, আপনার পায়ে ধরছি এখনকার মতো ছুটি দিন। বরং ‘আপনি কেমন আছেন’ এই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্নের উত্তর আপনি কবে দিতে পারবেন একটা দিন স্থির করে দিন — আমি যে নিতান্ত ব্যস্ত হয়েছি তা নয় — নাহয় উত্তর পেতে কিছুদিন দেরিই হবে, নাহয় উত্তর নেই পাওয়া গেল। কিন্তু আজ আমার অপরাধ ক্ষমা করুন, ভবিষ্যতে আমি সতর্ক হব।
বৈশাখ ১২৯৩
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১২ comments
ফারুক ওয়াসিফ - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১:২৩ অপরাহ্ণ)
সুকুমার রায়েরও বোধহয় এরকম একটা রম্যগল্প আছে, তাই না?
রেজাউল করিম সুমন - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৬:১৯ অপরাহ্ণ)
“অবাক জলপান”? অন্য কোনো লেখাও আছে কি না খোঁজ নেব।
মুজিব মেহদী - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:১৫ অপরাহ্ণ)
পেটে ক্ষুধার দোহাই দিয়ে কেবলারামের রক্ষা হলো, নইলে এ আলাপ আরো দূর গড়াতে পারত, আরো শোনা যেত কিছু ঝনঝনানি যুক্তি-তরবারির।
রবীন্দ্রনাথ এ পন্থায় নিজে বাঁচলেন, না কেবলারামকে বাঁচালেন, না পাঠককে রক্ষা করলেন তা বোঝা মুশকিল।
রেজাউল করিম সুমন - ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:০১ অপরাহ্ণ)
চণ্ডীচরণবাবুর বিচার আরো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হয়ে উঠলে বেচারা কেবলরামের যে কী দশা হতো, ভাবতেও ভয় হয়! ভাগ্যিস খিদের কথা বলে কোনোমতে পালাতে পেরেছিল।
যুক্তি-তরবারির ওই ঝনঝনানি সত্যিই উপভোগ্য। কিন্তু যদি লেখাটা পড়তে গিয়ে হাসি না পেয়ে থাকে, তাহলে তো সব পরিশ্রমই মাটি — লেখকের ও কম্পোজিটরের!
মুজিব মেহদী - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (২:০২ অপরাহ্ণ)
লেখাটিতে হাসির উপাদান নেই, তা নয়। কিন্তু আগে পড়া থাকায় নতুন করে হাসবার চেয়ে এ যাত্রায় লেখাটির কথার মারপ্যাঁচই বেশি মনোযোগ কেড়েছে।
পরিশ্রম মাটি হয় নি, পিপাসায় প্রয়োজনীয় জল হয়েছে।
রেজাউল করিম সুমন - ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ)
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অলকেশ - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১২:২১ পূর্বাহ্ণ)
একা একা সত্যিই অনেকক্ষন হেসেছিলাম। লেখককে অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর একটা লিখা নির্বাচন করার জন্য।
রেজাউল করিম সুমন - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ আপনাকেও। আশা করি `ভালো আছেন’!
Shahadat Sabuz - ২৯ অক্টোবর ২০০৮ (১:৪৩ পূর্বাহ্ণ)
সুমন ভাই, লেখা পড়ে খুবই ভাল লাগল। কিন্তু মন্তব্য করতে যেয়ে দেখি হযবরল লিখা হচ্ছে!!! তাই বেশী দুর গেলাম না!! দুলালদাকে ধন্যবাদ মুক্তাঙ্গনের খবর দেবার জন্য।
সবুজ
নিউ ইয়র্ক
সৈকত হাবিব - ১০ নভেম্বর ২০০৮ (৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
প্রিয় সুমন, রবীন্দ্রনাথ তো পেরেছেনই, আপনিও উপস্থাপনাটা ভালোই পারেন। পড়া শেষ করার পর মাথাটা ঝাঁঝাঁ করছে। বাপরে বাপ! এখন মনে হচ্ছে কাউকে খবরাখবর জিজ্ঞেস করার আগেই এ ব্যাপারটা মনে পড়বে! বুঝুন অবস্থা?
এমন একটি মাথা খারাপ করার কিন্তু মজাদার জিনিস ব্লগে দেওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
নির্মাণকে গত কদিন ধরে বেশ ঝকঝকে লাগছে। এজন্য সকল প্রশংসা…
অনেক দিন আপনার দেখা নেই? সব মিলিয়ে কেমন আছেন?
রেজাউল করিম - ২৯ নভেম্বর ২০০৮ (৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ)
মানব মনের সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতির বৈচিত্র্যকে রবীন্দ্রনাথ
যেভাবে খুলে খুলে দেখেছেন তাঁর দেখা তেমন একটি
বিষয়কে সুমন ডূবুরীর মত খুঁজে এনেছেন নির্মাণের পাঠকদের
জন্য। এজন্য তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মাহতাব - ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (৮:১২ অপরাহ্ণ)
সুমন,
ধন্যবাদ।
এখন কথা উঠতে পারে, ধন্যবাদ কী বস্তু। শুধু কি মানুষ মানুষকে ধন্যবাদ দেয়, না পশুরাও… হাহাহাহা…