যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি থেকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ সরানোর জন্য খুব পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের সার্বিকভাবে অন্যদিকে ব্যস্ত করে তোলার চেষ্টা চলছে। ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের শক্তি। যদিও তা একেবারেই সফল হয়নি। সারাদেশে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে জনস্রোত তা-ই প্রমাণ করে। [...]

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি থেকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ সরানোর জন্য খুব পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের সার্বিকভাবে অন্যদিকে ব্যস্ত করে তোলার চেষ্টা চলছে। ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের শক্তি। যদিও তা একেবারেই সফল হয়নি। সারাদেশে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে জনস্রোত তা-ই প্রমাণ করে। উৎসবপ্রিয় বাঙালিকে ঘরে আটকে রাখবে কার সাধ্যি! সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মজাত হলেও, সে-সবই এখন ঐতিহ্যের মাপকাঠিতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আত্মীকরণ হয়েছে। ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কখনো কখনো  বিরোধ প্রমাণের চেষ্টা চললেও তা খুব একটা ধোপে টেকে না।

এদেশের মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি এদেশের মানুষ কখনোই স্বাগত জানায়নি। কোনো উগ্র মতবাদ সাধারণ মানুষের প্রশ্রয় পাবে না। উগ্রতা কোনো ধার্মিক মানুষের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ সব ধর্মের প্রকৃত অনুসারীরা সবসময় শান্তিপ্রিয়। কোনো ধর্মেই সংঘাতের কথা বলা হয় নি। আর কেউ ধর্মে বিশ্বাস না করলে, তার বিচারের দায়িত্বও কোনো ধর্মেই মানুষের উপর অর্পণ করা হয়নি। ধর্মে অবিশ্বাসীদের বিচারের ক্ষমতা পুরোপুরি স্রষ্টার। যে-যে যার-যার দায়িত্বে ধর্মে বিশ্বাস-অবিশ্বাস বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এই বিষয়ে বল্ প্রয়োগের কোনো অধিকার কারো নেই। কাউকে ধর্ম পালনে বাধা দেওয়া অথবা কোনো ধর্মকে অবমাননা নিশ্চয়ই অনুচিত। আর তা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই  প্রযোজ্য। ধর্মের প্রতি ভালোবাসার দোহাই দিয়ে মন্দির ভাঙা, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, মানুষের উপর আক্রমণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যারা ইন্ধন দেয়, শাস্তি প্রাপ্য তাদেরও। ‘নাস্তিক’ বিতর্ক একেবারেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ‌এই বিষয়টা নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার তরুণ প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা সফল হবে না। সাধারণ মানুষকে অতো বোকা আর বোধহীন ভাববার দিন শেষ হয়েছে।

69398_509353085788943_851063671_n

‘ব্লগার’, ‘শাহবাগ’, ‘নারী’ শুধুমাত্র এই বিষয়গুলো নিয়ে যে পরিমাণ তালগোল পাকানো পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে, তাতে এটা একেবারেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কী কারণে এসব হচ্ছে। কারণ এই বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই  সম্পৃক্তিটা নষ্ট করে দেওয়ার জন্যই একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত কিংবা আওয়ামী লীগ যে দলই সাধারণ জনমতের বিরুদ্ধে ঔদ্ধ্যত্যপূর্ণ আচরণ করুক, তা তাদের রাজনৈতিক বিপন্নতাই ডেকে আনবে। এসব ষড়যন্ত্রে যুদ্ধাপরাধের বিচাররের দাবি লক্ষভ্রষ্ট হবে, এমন নয়। আর হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড তো পুরোপুরি আরোপিত বিষয়। ভ্রান্তি ছড়িয়ে, নৃশংস কর্মকাণ্ড করে তারা নিজেদেরকে ইতিমধ্যেই প্রমাণ করে দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি গ্রাহ্য করার কিছু নেই। তারা এটা  উত্থাপন করেছে, আলোচিত হবার জন্যই। গণমাধ্যমে তারা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে গেছে, এই দাবি উত্থাপনের পর। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আলোচনা ঢাকা পড়ে গেল। তারা তো এটাই চেয়েছিল। টিভি চ্যানেলগুলোর টকশো-তে যেভাবে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের এনে  বক্তব্য প্রচারের সুযোগ করে দেওয়া হলো, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে একটা কথা মনে রাখা উচিত, গণমাধ্যমের সব প্রচার সবসময় জনমতের প্রতিফলন নয়। তবে জনমত তৈরিতে এটার ভূমিকা থাকে বটে। গণমাধ্যমের কিছু নিজস্ব প্রচার কৌশল থাকে, তারা সে-মতেই প্রচার করে থাকে। গণমাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আলোচনা কমে যাওয়া মানে বিচারের দাবি থেকে জনমত কমে যাওয়া নয়।

যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের শক্তি হিসেবে জামায়াত ইসলামী চিহ্নিত। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে ছদ্মবেশী সুবিধাবাদী কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। এদেরকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করাটা কঠিন। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকাটা জরুরি। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য বিরাট অঙ্কের টাকার খেলা চলছে, এটা এখন আর কারো অজানা নয়। চলছে নানারকম বেচাকেনা। তবে এই বেচাকেনার দৌড় একটা পরিধির বাইরে আর যেতে পারবে না। অভিযোগ আছে, সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তি এর সাথে জড়িত। কিন্তু আপামর জনতার বোধকে কখনো টাকায় কেনা যায় না। এটা অতীতে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও প্রমাণিত হবে।

একদিন কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরছিলাম রিকশায়। বৃদ্ধ রিকশা চালক আমাকে প্রশ্ন করলেন, ফাঁসি কবে হবে?

আমি বললাম, কার?

রিকশচালক একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, রাজাকারগুলার বিচার চলতাছে, আফনে কিছু জানেন না!

আমি বললাম, নিশ্চয় খুব তাড়াতাড়ি ফাঁসি হবে রাজাকারের। তবে ঠিক কখন তা হবে, এখনো জানি না।

আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, রাজাকারের বিচার হলে কী হবে?

রিকশাচালক চট্ করে উত্তর দিলেন, বিচার হইলে রাজাকারের শাস্তি হইবো! বাস্। আমি অপরাধ করলে মাফ হইবো? রাজাকারের মাফ কিয়ের?

রিকশাচালকের এমন সপ্রতিভ উত্তরে আলোড়িত হতেই হয়!

উচ্চশিক্ষিত মানুষের চিন্তাচেতনার কথা প্রচারের কতো মাধ্যম! পত্রিকা-টিভি-ইন্টারনেট সবকিছু সরব তাদের মত প্রকাশের উচ্চকণ্ঠে। কত জটিল সব আলোচনা পত্রিকার পাতায়! যুদ্ধাপরাধের বিচারের  আলোচনা নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে কতশত টকশো’র আয়োজন! তবু একটা সহজ কথা যেভাবে এক রিকশা চালক স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারেন, তা ক’জন পারে! প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ ডিগ্রি নেই ওই রিকশাচালকের, বুদ্ধিকে বৃত্তি করে জীবিকা অর্জন হয়তো তিনি করতে পারেন না, তবু তাঁকেই বলা যায় প্রকৃত শিক্ষিত, সচেতন মানুষ।

সুমিমা ইয়াসমিন

কোনো কোনো যুদ্ধে জয়-পরাজয় থাকে না। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটাই বড় অর্জন।

৮ comments

  1. রায়হান রশিদ - ২২ এপ্রিল ২০১৩ (৬:১২ অপরাহ্ণ)

    সহজ কিছু কথা, সাধারণ কান্ডজ্ঞানের কিছু কথা, অথচ সেটা বুঝতে আর বোঝাতেই এতো কান্ড! লেখককে অনেক ধন্যবাদ।

    • সুমিমা ইয়াসমিন - ২২ এপ্রিল ২০১৩ (৯:১৩ অপরাহ্ণ)

      সোজা কথায় যখন আমরা বলি, যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই। কেউ কেউ বলে, আগেই ফাঁসি দাবি করলে বিচারের দরকার কী? তারা বোঝে না, বিচারের দরকার অপরাধ প্রমাণের জন্য। অপরাধ প্রমাণ না করে তো আর শাস্তি দাবি করছি না আমরা। খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, ঘরবাড়ি জ্বালানো, পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তাসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হবার পরও যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না, তা হতে পারে না।
      আপনাকেও ধন্যবাদ, রায়হান রশিদ।

  2. অদিতি কবির - ২২ এপ্রিল ২০১৩ (১০:২৭ অপরাহ্ণ)

    চমৎকার লিখেছেন সুমিমা। সাধারণ রিকশাওয়ালা যে কথা বলে ফেলতে পারেন অনায়াসে, শিক্ষিত বহু লোক তা পারে না। কেননা তাকে আগে হিসাব করতে হবে ওটা হলে সে কি পাবে।
    ১৯৭১ আমাদেরকে শারিরীকভাবে মুক্তি দিয়েছে, কিন্তু আমরা নিজেদের মনের ভেতর বন্দী।

    • সুমিমা ইয়াসমিন - ২৩ এপ্রিল ২০১৩ (১:১২ পূর্বাহ্ণ)

      মনের মুক্তিটা সত্যি খুব জরুরি।
      সমাজের চোখে যারা ‘অশিক্ষিত’ তারা অনেক সময় তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষের চেয়ে বেশি সচেতনতার পরিচয় দেয়।
      অদিতি কবির, আপনার মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম।

  3. নীল - ২২ এপ্রিল ২০১৩ (১১:০৮ অপরাহ্ণ)

    একাত্তরের পর ৪২ বছর ধরে নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠেছে জামাতে ইসলামী নামক ভাইরাসটি
    তখনি ওটাকে শেষ করে দিতে পারলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আর কোন সমস্যাই হত না, তৈরি হত না হেফাজতে ইসলাম নামক হেফাজতে রাজাকার
    এবার একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে আমাদের দেশটাকে আবর্জনা ও ভাইরাস মুক্ত করার, আমি বিশ্বাস করি আমরা সফল হব

    চমৎকার একটি পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ

    • সুমিমা ইয়াসমিন - ২৩ এপ্রিল ২০১৩ (১:১৯ পূর্বাহ্ণ)

      সময়ের কাজ সময়ে না করলে তার মাশুল দিতে হয় বেশি। দেরীতে হলেও অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে হবে। নিশ্চয় সফল হবো আমরা। এই আশাবাদই একটা বড় শক্তি।
      ধন্যবাদ, নীল।

  4. মাসুদ করিম - ২৩ এপ্রিল ২০১৩ (১:৪২ পূর্বাহ্ণ)

    সহজ উত্তরটাই জটিল হয়ে যায় বা জটিল হয়ে থাকবে আমাদের দেশের শ্রেণীবর্ণনির্বিশেষে ধর্মের প্রতি দুর্বলতায় অভ্যস্ত মানুষগুলোর জন্য। পাকিস্তানের রাজনীতি ও আর্মিনীতি নিয়ে একটা কথা খুব ঘনঘন বলা হয় — বিপদে পড়লেই এরা সবাই কোনো ডাকসাইটে হুজুরের দাড়ি ধরে ঝুলে পড়ে। আমাদের ব্যাপারেও নির্মম হলেও একথা সত্য এবং সেই মোগল আমল থেকে এই সত্যের ব্যত্যয় কখনো হয়নি। কাজেই বিপদ আমাদের ঘাড়ে ঝুলে আছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামাত-শিবিরের নিষিদ্ধ করার বিচার আমাদের বিক্ষত মৌলবাদকে বিদায় জানাতে সাহায্য করবে — এতে কোনো সন্দেহ নেই — এবং তার জন্য শক্তিসঞ্চয়ও আমরা করব আমাদের সাধারণ মানুষের সহজ উত্তর থেকেই। কিন্তু মুসলিম সমাজের যে সহজাত মৌলবাদ তার বিরুদ্ধে আমাদের পথ চলা হবে আরো দীর্ঘ, হয়তোবা অন্তহীন।

    • সুমিমা ইয়াসমিন - ২৩ এপ্রিল ২০১৩ (৪:১০ অপরাহ্ণ)

      এটাই দুঃখজনক, রাজনৈতিক দলগুলো মৌলবাদের আশ্রয় খোঁজে স্রেফ নির্বানী বৈতরণী পার হবার আশায়। এরচেয়ে ভণ্ডামি আর কী হতে পারে!
      তবে উগ্র মৌলবাদের উস্কানীতে যত সংঘাতমূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এপর্যন্ত, তা নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর তাণ্ডব। মূল জনগোষ্ঠির বড় অংশ এটাকে সমর্থন করে না বলেই আমার বিশ্বাস।
      ধন্যবাদ, মাসুদ করিম, লেখা পাঠ করে মূল্যবান মন্তব্য জানিয়েছেন।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.