মহিউদ্দিন আহমদকে জানি তাঁর একটি লেখার মাধ্যমে, তাও খুব সীমিত পর্যায়ে। গত বছর জুন ২, ২০১৩ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় তাঁর “তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন” [১] রচনাটি চোখে পড়ে। লেখাতে ব্যাপক তথ্যগত ভুল লক্ষ্য করি এবং তার কিছুদিন পর “‘তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন’ – একটি সতর্ক পর্যালোচনা” [২] রচনায় ভুলগুলো বিডিনিউজ২৪-এর পাঠকদের সামনে তুলে ধরি। মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর রচনার শেষে নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন ‘লেখক ও গবেষক’ হিসেবে। মনে মৃদু আশা ছিল জনাব আহমদ আমার লেখার জবাব দেবেন। একজন প্রকৃত গবেষক তাঁর লেখার সমালোচনার জবাব সাধারণত দিয়ে থাকেন কারণ তা সত্য অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার একটি অংশ বলেই বিবেচিত। তিনি জবাব দেননি।

পরবর্তী মাসগুলোতে মহিউদ্দিন আহমদের লেখা আর তেমন পড়া হয়নি। এ বছর জুলাই মাসে প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় জনাব আহমদের রচনা “৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো”[৩] প্রকাশিত হয়। এর পরপরই চলতি বছরের জুলাই ১৫, আগস্ট ১২, ১৩, ১৪ ও ২৫ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় জনাব আহমদের জাসদ-তাহের সংক্রান্ত আরো পাঁচটি লেখা প্রকাশিত হয়। [৪] মনোযোগ দিয়ে সেগুলো পড়েছি। গত বছরের লেখার মত এবারো তিনি বহু ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন। সেগুলোকে চিহ্নিত করাই আজকের লেখার মূল লক্ষ্য। একই সাথে জনাব আহমদ যে একটি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ’ চালু করার উদ্দেশ্যে তাহের ও জাসদ সম্পর্কে উপরে বর্ণিত লেখাগুলো লিখেছেন, সেই বিষয়েও আলোচনা করবো।

মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ সম্পর্কে অনলাইনে অনুসন্ধান চালিয়ে যা জানতে পেরেছি তা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। ফেইসবুকের একটি থ্রেডে ডাকসু’র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ড. মুশতাক হোসেন জানাচ্ছেন যে মহিউদ্দিন আহমদ এক সময় জাসদ করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি গণকন্ঠ পত্রিকা ও বিপ্লবী গণবাহিনীর সদস্য ছিলেন। ৮০’র দশকে জাসদের ভাঙ্গনের পর তিনি সরাসরি রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। আরও জেনেছি তিনি এনজিও-র সাথে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্ত। ‘লেখক ও গবেষক’ জনাব আহমদের ‘গবেষণা’ সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। গত বছর “তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন” রচনায় তিনি রায় দিয়েছেন, “৭ নভেম্বর ও তার আগে ও পরের তাহেরকে আমরা প্রথম পাই লরেন্স লিফশুলজের লেখা বাংলাদেশ অ্যান আনফিনিশড রেভল্যুশন গ্রন্থে। এটাও ইতিহাস নয়। ইতিহাস লেখা খুব সহজ কাজ নয়।” [৫] সম্মানিত পাঠক, লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ‘গবেষণার’ নমুনা দেখুন। জনাব আহমদ একটি বইয়ের নাম উল্লেখ করছেন অথচ তার নামটাও সঠিকভাবে জানেন না। দু’টি পর্বে ভাগ করা লিফশুলজের বইটির নামঃ “বাংলাদেশঃ দি আনফিনিশড রেভোলিউশন”। বইয়ের প্রথম পর্বের নাম “তাহের’স লাস্ট টেস্টামেন্ট” এবং দ্বিতীয় পর্বের নাম “দি মার্ডার অফ মুজিব”।[৬] পৃথিবীর দু’টি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল এবং কেইম্ব্রিজে পড়াশোনা করা সাংবাদিক লিফশুলজের গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্য-উপাত্তকে তিনি ‘ইতিহাস’ মানতে রাজি নন। অথচ এই বইয়ের মাধ্যমে প্রথম প্রকাশ পেয়েছে তাহেরের হত্যাকাণ্ডের পেছনের কাহিনী ও তার সাথে জিয়াউর রহমানের সরাসরি সংশ্লিষ্টার কথা। আমরা জেনেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পেছনে মার্কিন সিআইএ’র জড়িত থাকার কথা। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই ‘ইতিহাস’কে চাপা দিয়ে রাখার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশে তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। লরেন্স লিফশুলজের বিভিন্ন লেখাকে আমাদের বেদবাক্য বলে মেনে নিতে হবে এমন দাবি করছি না কিন্তু এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও তাহের হত্যার প্রশ্নে লিফশুলজের গবেষণা কর্মকে অনেকেই সবচাইতে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।

যাই হোক, কথা হচ্ছিলো মহিউদ্দিন আহমদকে নিয়ে। গুগোলে অনুসন্ধান থেকে জনাব আহমদের একটি ‘Curriculum Vitae’ খুঁজে পাই। তাতে বিস্তারিতভাবে তাঁর অতীত ও গবেষণাকর্ম সম্পর্কে জানতে পারি। [৭] সেখানে উল্লেখ আছে যে, ৭০-এর দশকে জনাব আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। [৮] তাঁর বিশেষজ্ঞ ক্ষেত্র হিসেবে ‘Development and policy planning, research and communication’-এর কথা বলা হয়েছে। [৯] তাই অবাক হইনা না যখন লক্ষ্য করি জনাব আহমদ এনজিও, সুশীল সমাজ, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিবিদ্যা সহ অন্যান্য বিষয়ে (যা তাঁর বিভিন্ন চাকরীর ক্ষেত্রের সাথে জড়িত) লেখালেখি করলেও তাঁর রচনার থলিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক কোনো উল্লেখযোগ্য লেখা নেই। তাই গত বছর জুন মাসে যখন তাঁর “তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন” লেখায় মোট পাঁচটি গুরুতর ভুল খুঁজে পাই এবং সেই একই রচনায় যখন তিনি বলেন যে লিফশুলজের “বাংলাদেশঃ দি আনফিনিশড রেভোলিউশন” বা শাহাদুজ্জামানের“ক্রাচের কর্নেল” আর যাই হোক ‘ইতিহাস’ হয়নি, তখন বিস্মিত হই না। লিফতশুলজ তাঁর বইয়ের ৬৪-৭৪ এবং ১৪৯-১৫৩ পৃষ্ঠায় সর্বমোট ৯৮টি সূত্র দিয়েছেন। শাহাদুজ্জামানও তাঁর “ক্রাচের কর্নেল” বইতে ৩৪৫-৩৫১ পৃষ্ঠায় তাঁর সূত্রগুলো তুলে ধরেছেন। আর অন্যদিকে মহিউদ্দিন আহমদ – যার ইতিহাস নির্ভর গবেষণার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এবং ইতিহাস শাস্ত্রে সঠিক তথ্য তুলে আনার প্রক্রিয়া সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই, তিনি কি সহজেই না অন্যের গবেষণাকর্মকে ‘বিচার’ করছেন। ইতিহাস নির্মাণের পদ্ধতিও জনাব আহমদ নিজের সুবিধামতন ব্যবহার করেন আবার অন্য কেউ যখন সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন তিনি তা মানতে চান না। আজকে ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ সাক্ষাৎকারভিত্তিক গবেষণার উপর নির্ভর করে কর্নেল তাহের ও তাঁর অনুজ মো. আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে বর্তমান সময়ে ব্যাপক মিথ্যাচার চালিয়েছেন। অথচ গত বছর “ক্রাচের কর্নেল” বইটির রচনার গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেনঃ “কারও কারও সঙ্গে আলাপ করে এবং ওই ধরনের আলাপচারিতা কিংবা সাক্ষাতকারের ওপর নির্ভর করে কিংবা সূত্র ঘেঁটে হয়তো লেখাটি তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে। ফলে সুলিখিত হওয়া সত্ত্বেও এটা ইতিহাস হয়ে উঠতে পারেনি।” [১০]

ভণ্ডামির যে কোনো সীমা নেই, তাই আজ স্পষ্ট করছেন জনাব আহমদ। “তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন”রচনায় তিনি জাসদের এককালীন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও মৌলিক পর্যায়ের ভুল তথ্য উপস্থাপন করছেন এবং আপন দাবীকে সমর্থন করে এমন কোন তথ্যসূত্র পাঠকদের দিচ্ছেন না! এই হচ্ছে তাঁর ‘ইতিহাস চর্চার’ নমুনা । একই চিত্র আমরা খুঁজে পাই তাঁর সাম্প্রতিক রচনায়। কোথাও কোনো তথ্যসূত্র নেই। প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত“৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো” রচনার শেষে অবশ্য বলা হয়েছে “স্থানাভাবে তথ্যসূত্র দেওয়া হলো না” ও তার ঠিক নিচে লেখা আছে “প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য বইয়ের নির্বাচিত অংশ”। [১১] আর এদিকে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত জনাব আহমদের রচনা “তাজউদ্দীন খুনিদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন”, “আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি”, “বাকশাল বাদ দিয়ে তাহেরের জাতীয় সরকার”-এর শেষে বলা হয়েছেঃ “প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য বই জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি থেকে নেওয়া অংশবিশেষ।”[১২] আশা করছি ‘লেখক-গবেষক’ সেই গ্রন্থে তথ্যসূত্র উপস্থাপন করবেন। পাঠকরা নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন জনাব মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর লেখার মাধ্যমে ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালের একটি বিশেষ ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ’ চালু করতে চেষ্টা করছেন। তা তিনি করুন। কথা হচ্ছে সেই ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ’ প্রচারে বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা, প্রথমা প্রকাশন ও মানবজমিন মুক্তকচ্ছ হয়ে এগিয়ে এসেছে কেন? এখানে উল্লেখ করা যায় যে প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম ও প্রয়াত শওকত ওসমান এই দুই বরেণ্য মানুষের অসাধারণ দুটো রচনা লেখা থাকলেও তাঁরা প্রথম আলোতে প্রচার পাননি। প্রচার পেয়েছেন জনাব ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ। এই সময়ে? সে বিষয়েও আলকপাত করার চেষ্টা করবো।

কি লিখেছেন জনাব আহমদ? পাঠক, চলুন এক এক করে সেগুলোকে পর্যালোচনা করে তার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করি।

১) প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যার “৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো” রচনা দিয়েই শুরু করা যাক। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত হওয়ার পর পর মেজর ডালিমের প্রদত্ত ভাষণ সম্পর্কে জনাব আহমদ বলেনঃ “রেডিওতে ঘোষণা শোনা যাচ্ছিলঃ ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে উৎখাত করা হয়েছে। সারা বিশ্বে কারফিউ জারি করা হয়েছে।”[১৩] মেজর ডালিমের ভাষণ এমন ছিল না। তার ভাষণ আজ ইউটিউবে শোনা যায়। মেজর ডালিমের ভাষণ হুবহু তুলে দেয়া হলোঃ “মেজর ডালিম বলছি। অদ্য সকাল হইতে খোন্দকার মোশতাক আহমদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। শেখ মুজিব ও তাঁর খুনি দুর্নীতিবাজ সরকারকে উৎখাত করা হইয়াছে। এখন হতে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা হলো। আপনারা সবাই আমাদের সাথে সহযোগিতা করুন। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন কোনো অসুবিধা আপনাদের হইবে না। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”[১৪] পাঠক খেয়াল করুন, কোন এক অজ্ঞাত কারণে তথাকথিত গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মেজর ডালিমের প্রকৃত ভাষণ তুলে ধরছেন না। ‘খোন্দকার মোশতাক আহমদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে’ এবং ‘সারা দেশে যে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে’ – মেজর ডালিমের বক্তব্যে উল্লেখিত এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনাব আহমদ পাঠকদের কাছ থেকে গোপন রেখেছেন, যাতে তিনি তাঁর ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ’-এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেন।

এর পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জনাব মহিউদ্দিন আহমদ লিখছেনঃ “ধীরে ধীরে ১৫ আগস্টের ঘটনার বিবরণ প্রকাশ হতে থাকল। জানা গেল, সেনাবাহিনীর একদল জুনিয়র অফিসার এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। তাঁদের নেতা মেজর ফারুক রহমান ও মেজর খোন্দকার আবদুর রশিদ। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েকজন মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেনেন্ট ও জুনিয়র কমিশনড অফিসার। এই দলের অন্যতম সদস্যছিলেন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা।”[১৫] জনাব আহমদ জানাচ্ছেন হুদা জাসদ নেতা আবদুল বাতেন চৌধুরীর কলেজ জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন ছিলেন এবং হুদা নাকি বাতেনকে জানিয়েছিলেনঃ “শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের আকস্মিকতায় অনেকেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে তেমন উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়নি। […] দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এ রকম একটা ঘটনার আশঙ্কা সবাই করছিলেন। শুধুদুটো বিষয়ে তাঁদের অনেকের অজ্ঞতা ছিল। প্রথমত, ঘটনাটি কবে ঘটানো হবে এবং দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে কি না।”[১৬] “আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি” রচনায় জনাব আহমদ খুনি মেজরদের একজন মেজর নূরকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন প্রাক্তন পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ও পরবর্তীতে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির সদস্য হিসেবে। লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী মেজর নূর সিরাজ শিকদার হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং ১৫ই আগস্টের কয়েকদিন পর মেজর নূর নাকি বলেছিলেনঃ “ওরা আমার নেতাকে খুন করেছে, আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি।” [১৭]

পাঠক খেয়াল করুন, জনাব মহিউদ্দিন জাসদের বন্ধুর সাথে মেজর হুদার আলাপ ও মেজর নূরের সাথে আরো কয়েকজনের কথোপকথন তুলে ধরছেন অথচ আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ যে এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী ও সুবিধাভোগী, তা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন! রহস্যজনক আচরণ বটে, কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে মোশতাকের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার কথা আজ প্রমাণিত। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ক্রিমিনাল আপীলে আপীল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন বলেনঃ

“From the forgoing discussions and findings of the evidence of the prosecution witnesses, I am of the view that learned Judges of the High Court Division rightly found that conspiracy was started in March, 1975 Lt. Col. Rashid’s house at cantonment, nurtured in different meetings between Khondker Moshtaq Ahmed and the accused Army Officers at BARD, Comilla and in Mushtaqu’s house at Daudkandi, Dhaka Aga Mashi Lane, Ramna Park, Shahriar Rashid’s residence at Cantonment and Balurghat Parade Ground.”[১৮]

লরেন্স লিফশুলজের গবেষণায় প্রায় কাছাকাছি তথ্য উঠে এসেছে। আগস্ট ১৫, ২০০৫ তারিখে লিফতশুলজ ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত

“The past is never dead – The long shadow of the August 1975 coup” রচনায় বলেনঃ “Mustaque and his political friends had been involved for more than a year in a web of secret planning that would lead to the overthrow and death of Mujib.”[১৯]

জনাব আহমদ শুধু যে খোন্দকার মোশতাককে আড়াল করছেন, তা নয়। তাঁর লেখাতে প্রয়াত আমলা মাহবুব আলম চাষি, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর প্রমুখদের নাম উঠে আসেনি। যেমন আসেনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে মার্কিন সংশ্লিষ্টতা ও প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা। মোশতাক, জিয়া ও মার্কিনীদের প্রসঙ্গে লিফশুলজ তাঁর “Fearing a Leftist challenge, Rightists struck” রচনায় লিখেছেনঃ

“My remarkably well-placed source made a rather interesting comment when he noted that he had been present during two different meetings one with Zia and a separate one on a different day with Mustaque in which Major Rashid independently raised a question concerning what the attitude of the United States would be to the planned coup. “Both Zia and Mustaque independently told us that they had checked with the Americans,” said this former military officer. “Their answers were almost the same. They each said it [the overthrow of Mujib] was ‘not a problem’ for the Americans. I then realized that both had their separate channels to the Americans. After that the subject didn’t come up again.”” [২০]

লিফশুলজ যে ঠিক বলছেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিভিন্ন মার্কিন দলিলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু দলিল ডিক্লাসিফাই করা হয়েছে যা তাদের ন্যাশনাল আর্কাইভসে সকলের জন্য উন্মুক্ত আছে। [২১] সেখান থেকে প্রাপ্ত দু’টি দলিলের প্রতি পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। জুলাই ১৯৭৩ সালের প্রথম দলিলটিতে ১৯৭২-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মার্কিন এম্বেসিতে ইন্টেরিম শার্জ দ্য’এফেয়ার (Interim Chargé d’Affaires) হিসেবে কর্মরত [২২] ড্যানিয়েল ও. মিউবেরি মার্কিন সেক্রেটেরি অফ স্টেইটকে জানাচ্ছেন, জুলাই ১১ তারিখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ব্র্যাঞ্চের মেজর রশিদ মার্কিন এম্বেসির ইকোনোমিক কমার্শিয়াল সেকশনে হাজির হয়ে মার্কিন আর্টিলারির প্রাপ্যতা ও দাম সম্পর্কে জানতে চান।[২৩] পরের দিন ‘আরমার্ড কোরের ডাইরেক্টর’ হিসেবে পরিচয়দানকারী মেজর ফারুক রহমান আসেন এবং হালকা ট্যাঙ্ক সহ অন্যান্য জিনিসের দাম জানতে চান।[২৪] এখানে পাঁচটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, মেজর ফারুক-রশিদ দু’জনই সেনা ইউনিফর্ম পরে এসেছিলেন; দ্বিতীয়ত তারা কেউই এম্বেসির কাছ থেকে আগের থেকে এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসেননি; তৃতীয়ত, মেজর রশিদ মিউবেরিকে আরো জানান যে সেনাবাহিনীর ‘আর্মামেন্টস প্রকিউরমেন্ট কমিটির’ চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে পাঠিয়েছেন; চতুর্থত, মেজর ফারুক একই কারণে মার্কিন এম্বেসিতে তার আগের বছর (১৯৭২ সালে) এসেছিলেন; এবং পঞ্চমত বাংলাদেশ সরকার অস্ত্র ক্রয়ের এই প্রক্রিয়ার সম্পর্কে অবগত এমন তথ্য মেজর রশিদ মিউবেরিকে দিলেও এই সব কাজে সেনা কর্তৃপক্ষ এককভাবে এগুচ্ছে না বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে করছে তা মিউবেরি নিশ্চিত ছিলেন না।[২৫]

মে ১৯৭৪ সালের দ্বিতীয় ডিক্লাসিফাইড দলিলে উল্লেখিত তথ্য আরো মারাত্মক। এখানে ইউজিন বোস্টার মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেইট হেনরি কিসিঞ্জারকে জানাচ্ছেন যে মে ১৩, ১৯৭৪ তারিখে মেজর ফারুক রহমান কোনো অগ্রিম এপোয়েন্টমেন্ট না নিয়ে মার্কিন পাবলিক রিলেশন্স অফিসার জনাব গ্রেশাম-এর বাসায় আসেন। [২৬] তিনি গ্রেশামকে জানান যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘highest ranking army officer’ তাকে পাঠিয়েছেন এটা জানার জন্য যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেয়া হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা কিভাবে গ্রহণ করবে এবং কোনো বৈদেশিক হস্তক্ষেপ প্রতিহত করতে মার্কিনীরা এগিয়ে আসবে কিনা।[২৭] গ্রেশামের জবাবটি ছিল চমকপ্রদ। তিনি মেজর ফারুককে বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো বিষয়ে নাক গলাবে না এবং তার দেশ বর্তমান সরকারকে স্বীকার (recognize) করে। [২৮] পাঠক, আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, মেজর ফারুককে কে পাঠিয়েছিলেন? বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘highest ranking army officer’ তো চিফ অফ স্টাফ কে এম শফিউল্লাহ। অন্যদিকে, এটাও ঠিক যে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ জিয়াউর রহমান ছিলেন জনাব শফিউল্লাহ’র সিনিয়র। ভুলে গেলে চলবে না যে মেজর ফারুকের সাথে জিয়ার একটি সুসম্পর্ক ছিল যা উঠে এসেছে শশাঙ্ক ব্যানার্জি’র “India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan (a political treatise)” [২৯] বইতে এবং ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মেজর ফারুকের প্রদত্ত নির্বাচনী ভাষণে। [৩০] তাছাড়া, অ্যান্থনি ম্যাস্কারেনহাসের নেয়া সাক্ষাৎকারে মেজর ফারুক বলেছিলেনঃ “The first obvious choice was General Zia because at least he was not tarnished. So after a lot of arrangements I managed to see him on 20th of March 1975. General Zia said I am a senior officer; I cannot be involved in such things. If you junior officers want to do it, go ahead.”[৩১] বিষয়টি হয়তো ধোঁয়াশাচ্ছন্নই থেকে যাবে যদিনা এ বিষয়ে জনাব শফিউল্লাহ কিছু বলেন।

তবে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে এই মার্কিন দলিল থেকে উঠে এসেছে যা হলো মার্কিন এম্বেসির সাথে মেজর রশিদের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের যোগাযোগ ছিল।

২) কর্নেল তাহের সম্পর্কে জনাব আহমদ প্রচুর বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে খোন্দকার মোশতাকের কাছে তাহেরের সামরিক শাসন জারি করার প্রস্তাবটি ছিল তাঁর একান্ত নিজস্ব এবং জাসদ তাহেরকে এই প্রস্তাব দিতে ম্যান্ডেট দেয়নি। জনাব আহমদের এমন অবাস্তব আবিষ্কার সত্যিই হাস্যকর। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে রেডিওতে সামরিক শাসন জারির ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর ডালিম (ডালিমের পুর্নাঙ্গ বক্তব্য এই লেখায় আগেই উল্লেখ করেছি), তাই মহিউদ্দিন আহমদের দাবি তাহেরের পরামর্শের কারণে মোশতাক সামরিক শাসন জারি করেছিলেন তা মোটেই সঠিক নয়। তাহের ১৫ই আগস্ট সকালে কি করেছিলেন? ২০১২ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত “মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের” বইতে মো. আনোয়ার হোসেন সেই দিনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাহের তাঁর নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে মো. আনোয়ার হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ বেতারে পৌঁছান ১৫ই আগস্ট সকাল ৯টায়। [৩২] পথে ঢাকার একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে বর্তমান জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে তুলে নেন এবং তাঁর সাথে আলোচনা করেন। [৩৩] নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা হওয়ার আগে তাহের জাসদের নেতৃবৃন্দের সাথেও টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। [৩৪] তাই জনাব আহমদ যে ভাষ্য দিচ্ছেন তা সঠিক নয়। অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে বা জাসদ রাজনীতির সাথে সামরিক শাসন সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলনা। কিন্তু জনাব আহমদ ভুলে যাচ্ছেন যে ১৫ই আগস্ট সকালে যখন তাহের বাংলাদেশ বেতারে পৌঁছান তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং জাতির পিতা সপরিবারে নিহত। এই ঘটনা কে ঘটিয়েছে তাহের ও জাসদ তা জানতে শুরু করেছে মাত্র। অন্যদিকে মাথার উপর রয়েছে মার্চ ১৯, ১৯৭২ সালে সই করা ‘India-Bangladesh Friendship Treaty’, যেখানে বলা আছেঃ “In case if either party is attacked or threatened to be attacked, the contracting parties shall immediately enter into mutual consultations in order to take necessary measures to eliminate the threat and thus ensure the peace and security of their countries;”[৩৫] শহীদ কর্নেল আবু তাহেরের মাথায় কি কাজ করছিল তা আর জানা যাবে না কিন্তু এই চুক্তির ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিল। ধারণা করি তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে এই পরিস্থিতিতে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করাকে যদি ভারত “বাংলাদেশকে আক্রমণ” হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা কিছু একটা করতে পারে। শেষ পর্যন্ত সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত না নিলেও ভারত যে তা বিবেচনা করেছিল তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার হিসেবে কর্মরত জে এন দীক্ষিত রচিত “Liberation and beyond Indo-Bangladesh Relations” বইতে। দীক্ষিত বলেনঃ

“I was told by some colleagues in the Ministry of External Affairs that the initial Indian reaction to the murder of Sheikh Mujibur Rahman and the military coup was of stunned disbelief. There were some suggestions that perhaps India could intervene to neutralise the conspirators under the provisions of the Indo-Bangladesh Treaty of Peace, Friendship and Cooperation. Perhaps Dr. Kamal Hussain’s presence outside Bangladesh could be utilised to ask him whether he would send such a request for intervention.” [৩৬]

আপাতদৃষ্টিতে ভারতীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে খোন্দকার মোশতাকের সরকারের উৎখাতকে ইতিবাচক মনে হলেও, বাস্তবে স্বাধীন দেশে একটি স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ তখন চরমভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হতো।

এমন একটি চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতেই তাহের মোশতাককে সামরিক শাসন জারির কথা বলেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরো কয়েকটি প্রস্তাব মোশতাককে দেন। এ সমস্ত দাবীর মধ্যে তাহের সবচেয়ে জোর দিয়েছিলেন রাজবন্দীদের মুক্তিদানের উপর। জাসদের বহু কর্মী তখন জেলখানায় আটক। ১৯৭৭ সালে লরেন্স লিফশুলজ Economic and Political Weekly-তে ১৯৭৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে প্রদত্ত তাহেরের জবানবন্দি প্রথম বারের মত প্রকাশ করেন। সেখানে তাহের বলেনঃ “I insisted that the release of all political prisoners must be done immediately before any firm future course of action could be decided.” [৩৭] তাই মোশতাককে তাহের যা যা বলেছিলেন, জাসদের ম্যান্ডেট নিয়েই বলেছিলেন এবং মোশতাক তাহেরের কোনো কথাই গ্রহণ করেননি।

সর্বোপরি তাহেরের একমাত্র লক্ষ্য ছিল এই বিশৃঙ্খল ও তরল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। সেকারণেই তিনি ১৫ই আগস্ট সকালে বাংলাদেশ বেতারে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রমাণও মেলে তাহেরের জবানবন্দিতেঃ “On that day early in the morning an officer from the Second Field Artillery rang me up and gave me a message which he said came from Major Rashid. He asked me to go Bangladesh Betar (Bangladesh Radio). He also informed me of the killing of Sheikh Mujib. I turned on the radio and came to know that Sheikh Mujib had been killed and that Khondakar Mushtaque had taken power. This was shocking news to me. I thought it would create political instability and that in this situation we could even lose our independence. Meanwhile, several telephone calls came urging me to go to Bangladesh Betar. I thought I should go and see the situation. […] I had a brief discussion with Khondakar Mustaque and emphasized that the need of the hour was to protect the country’s independence.”[৩৮]

১৫ই আগস্টে আলোচনাকালে মেজর রশিদ তাহেরকে মন্ত্রীপরিষদে যোগ দিতে অনুরোধ করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সকাল ১১.৩০ টায় তাহের বাংলাদেশ বেতার থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তাঁর মনে তখন গভীর শঙ্কা। সে সময়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেনঃ “At 11-30 I left Bangladesh Betar with a feeling of deep concern. I sensed that some outside power was involved in the killing of the father of the nation.”[৩৯] আগস্ট ১৬ তারিখে তাহের বুঝতে পারেন যে মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুক তাঁর নাম ব্যবহার করে সিপাহীদের এমন ধারণা দিচ্ছে যে তাহের তাদের সাথেই আছেন। এ প্রসঙ্গে তাহের বলেনঃ “On August 17, it became clear to me that the whole game was backed by the United States of America and Pakistan. I also understood that Khondakar Mustaque was directly involved in the killing of Sheikh Mujib. This group, it was also clear, had a pre-determined course set for themselves.”[৪০]

প্রকৃত সত্য হচ্ছে যে কর্নেল তাহের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই খোন্দকার মোশতাক আহমেদকে তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন। ১৫ই আগস্টে তাহের ও মোশতাকের কথোপকথনের সাক্ষী পিটার কাস্টার্স ২০১১ সালে প্রকাশিত রচনায় বলছেনঃ “On the morning of August the 15th, I happened to be a silent witness to a confrontation which took place at the Dhaka radio, between Colonel Taher and Mustaque Ahmed, leader of the pro-American wing of the Awami League.” [৪১] পাঠক খেয়াল করুন, ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ পিটার কাস্টার্সের এই মন্তব্য তাঁর লেখায় স্থান দিচ্ছেন না কারণ তিনি যে মিথ্যাচারের ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ’ এবং তথাকথিত ‘ইতিহাস’তৈরি করতে চাচ্ছেন, তার সাথে পিটার কাস্টার্সের সাক্ষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। লেখায় কিছু আধা সত্য তুলে ধরে বড় বড় মিথ্যাকে সত্য হিসেবে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা পুরো লেখা জুড়ে করেছেন জনাব আহমদ। তাই তিনি বলছেন যে খুনি মেজরদের অনুরোধে তাহের ছুটে গেছেন বাংলাদেশ বেতারে, তাহেরের পরামর্শে সশস্ত্র বাহিনীর তিন বাহিনী প্রধানকে বেতারে ডেকে নিয়ে এসে অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে বিবৃতি দেয়ানো হয় এবং মোশতাকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহের উপস্থিত ছিলেন। তিন’টি তথ্যই সম্পূর্ণরূপে বানোয়াট ও মিথ্যা।

১৫ই আগস্টের পর কর্নেল তাহের খোন্দকার মোশতাক ও খুনি মেজরদের প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির মাঝে একটি ব্যাপক ঐক্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাহের মো. আনোয়ার হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে একদিন ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম-এর ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে খালেদ তাঁর নিজস্ব অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তাহেরের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁর আস্থাভাজন অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাসির উদ্দিনকে পাঠান। আগামী প্রকাশনী থেকে ১৯৯৭ প্রকাশিত “গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী” বইতে মেজর নাসির উদ্দিন জানাচ্ছেনঃ “মেজর হাফিজের বাসায় কর্নেল তাহেরের সঙ্গে আমার দীর্ঘ সময় আলাপ হলো। তিনি জাসদের অনুসৃত লাইনে তাঁর কথা বলছিলেন। তবে খোন্দকার মোশতাকের অপসারণে তাঁর জোরালো সমর্থন তিনি ব্যক্ত করলেন। অভ্যুত্থানের দিন ক্ষণ আগেভাগেই জানাবার তাগিদ দিলেন কর্নেল তাহের। এর কারণ তিনি এভাবে দেখালেন যে ঐ বিশেষ দিনে জাসদের সর্বস্তরের কর্মীরা রাজপথ দখল করে অভ্যুত্থানের অনুকূলে সমর্থন জানাবে।” [৪২] দুঃখজনকভাবে খালেদ ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে একাই এগিয়ে যান। পেছনে ফিরে তাকালে আজ দুঃখভরা মনে প্রশ্ন জাগে যে খালেদ আর তাহের যদি যৌথভাবে ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থান সংগঠিত করতেন এবং জাসদ তাতে রাজনৈতিক সমর্থন দিতো তাহলে বাংলাদেশের দৃশ্যপট আজ কেমন হতো। যাই হোক, এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি ভবিষ্যতে।

তাহের যে শুধু খালেদকে নিয়ে এগুতে চেয়েছিলেন তা নয়। ১৫ই আগস্টের পর তিনি যখন জানতে পারেন যে কাদের সিদ্দিকি তাঁর কাদেরিয়া বাহিনী নিয়ে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন তিনি মো. আনোয়ার হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও একই বিভাগের শিক্ষক প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা নুরুন নবীর মাধ্যমে কাদের সিদ্দিকির কাছে একটি বার্তা পাঠান এই মর্মে যে কাদেরিয়া বাহিনী ও তাহেরের বিপ্লবী গণবাহিনী বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলুক, ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কাদের সিদ্দিকি সে প্রস্তাবে রাজি না হয়ে ভারতে চলে যান। যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. নুরুন নবী আজও বেঁচে আছেন। তিনি আমার এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারবেন।

৩) আগস্ট ১৩, ২০১৩ প্রথম আলোতে প্রকাশিত “আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি” রচনায় জনাব আহমদ দাবি করেছেন, ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট সকালে ‘ঢাকা নগর গণবাহিনীর অন্যতম সদস্য’ [৪৩] মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু আরো কয়েকজনকে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে বাচ্চু তাজউদ্দীন আহমদকে নাকি বলেছিলেনঃ “আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে”। [৪৪] বার বার তাঁকে একই কথা বললে তাজউদ্দীন বলেনঃ “কোথায় যাব? কেন তোমাদের সঙ্গে যাব?” [৪৫] বাস্তবে প্রয়াত বাচ্চু মোটেই গণবাহিনীর নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সাধারণ কর্মী যিনি পরবর্তীতে নভেম্বর ২৬, ১৯৭৫ তারিখে ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করার অভিযানকালে নিহত হন। তাই ‘লেখক ও গবেষক’ জনাব আহমদ যখন ‘ইতিহাস’ লিখতে গিয়ে বলে ফেলেন যে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে আনতে জাসদ বা গণবাহিনীর কোনো নেতৃস্থানীয় কেউ নয় বরং একেবারেই তরুণ বাচ্চু গিয়েছিল এবং তাঁকে নির্দেশ করছিল এই বলে যে “আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। যেতেই হবে।”[৪৬], তখন অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখি জনাব মহিউদ্দিনের আবিষ্কার কোন পর্যায়ে গেছে।

৪) মহিউদ্দিন আহমদ জানাচ্ছেন যে ১৭ই আগস্ট সকালে ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসভবনে গেলে তাহের তাকে বলেনঃ “ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া।”[৪৭] আগস্ট ১৭, ১৯৭৫ তারিখে তাহেরের অনুজ মো. আনোয়ার হোসেন তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আনোয়ার ছিলেন ১১ নং সেক্টরের স্টাফ অফিসার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ “নঈম জাহাঙ্গীর নামের কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তাহের ভাইয়ের বাসায় কখনো দেখিনি। খবর নিয়ে জানলাম, বিভিন্ন সময়ে বিএনপি এবং নানা সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। আমার ভাবি সংসদ সদস্য লুতফা তাহেরও তাঁর কথা কিছুই জানেন না। সর্বোপরি আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সাংসদ ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক প্রথম আলোর সংবাদ পড়ে মোবাইল ফোনে তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে নঈমও বলেন এসব ‘লুজ টক’। বিশদ কিছু না বলে তিনি ফোন কেটে দেন।”[৪৮]

৫) “৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো” রচনায় জনাব আহমদ আবুল হাসিব খানের বরাত দিয়ে জনাব আহমদ জানাচ্ছেন যে ঢাকা নগর গণবাহিনী প্রধান মো. আনোয়ার হোসেন ১৫ই আগস্ট সকালে একটি চিরকুট সংগঠনের উপপ্রধান আবুল হাসিব খানকে পাঠান। [৪৯] চিরকুটের বাহক ছিল মুহসিন হলের ছাত্র নূর মোহাম্মদ (পরবর্তীতে বাংলাদেশ পুলিশের আইজি)। এবং তাতে নাকি হাসিব খানকে জানানো হয় যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ কক্ষে ঢাকা নগর গণবাহিনীর জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হবে। হাসিব খানের বরাত দিয়ে জনাব আহমদ জানিয়েছেন যে সেই সভায় উপস্থিত হয়ে মো. আনোয়ার হোসেন বলেনঃ “ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘…- এর মেজর হয়েছ, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না।’ জানো, কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছিল? দে আর মাই বয়েজ।” [৫০] মো. আনোয়ার হোসেন মহিউদ্দিন আহমদের লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আবুল হাসিব খানকে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে হাসিব খান তাঁকে জানান যে এই সব বিষয়ে তিনি নিজেকে জড়াতে চান না। বেশ কিছু কাল আগে মহিউদ্দিন আহমদের সাথে এক আড্ডায় দেখা হয়েছিল। সেখানে কিছু ‘লুজ টক’ হয়েছিল। পাঠক, কি মারাত্মক কথা! ‘লুজ টক’-এর উপর নির্ভর করে ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ ‘ইতিহাস’ লিখতে বসেছেন! এ প্রসঙ্গে আগস্ট ২১, ২০১৪ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত “তাহেরকে নিয়ে কেন এই মিথ্যাচার” রচনায় মো. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেনঃ “গণবাহিনীতে আমার সক্রিয় অবস্থান কোনো অজানা বিষয় নয়। ইতোমধ্যে প্রকাশিত দু’টি পুস্তকে (মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশিত তাহেরের স্বপ্ন এবং আগামী প্রকাশিত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের) তার অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে। সামান্য বিচার-বুদ্ধি থাকলে জনাব মহিউদ্দিন আমার প্রকাশিত পুস্তকের ভাষ্য থেকে জানতেন গণবাহিনীর মতো গোপন সংগঠনে ভাই, ভাইজান—এসব সম্বোধনের এবং তাঁর উক্তি উদ্ধৃত করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।” [৫১] এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মো. আনোয়ার হোসেন যে কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই তা ঢাকা শহর গণবাহিনীর নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাড়া কেউ জানতেন না। নিরাপত্তার জন্য তা জরুরিও ছিল। সে কারণে এবং একই সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে আনোয়ার হোসেনের স্বল্প পরিচিত থাকায় ঢাকা নগর বিপ্লবী গণবাহিনীর মত গোপন সংগঠনে তাঁকে নেতৃত্বের ভার দেয়া হয়।

জনাব আহমদ পরবর্তীতে প্রকাশিত “তাজউদ্দীন খুনিদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন” রচনায় দাবি করছেন যে মো. আনোয়ার হোসেনের নির্দেশে গণবাহিনীর সদস্যরা ১৪ই আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি বোমা ফাটায়। গণবাহিনী সংক্রান্ত জনাব আহমদের মনগড়া দাবি প্রসঙ্গে আনোয়ার বলেনঃ “এই নির্জলা মিথ্যা তিনি অবলীলায় বলে দেন কোনো তথ্য–প্রমাণ ছাড়াই।” [৫২]

৬) মহিউদ্দিন এমনই আরেক নির্জলা মিথ্যা লিখেছেন আমার আরেক প্রয়াত চাচা সাখাওয়াত হোসেন বাহার বীর প্রতীককে নিয়ে। বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন সমর সেন অভিযানে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আমার আরেক চাচা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক এবং বাহারুল হাসান সবুজ। জনাব আহমদ বলছেনঃ “বেলা ১১টার একটু পরে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান সেখানে আসেন। মৃতদেহগুলোর পাশে তিনি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর চোখে অশ্রুবিন্দু। বাহারের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে তাহেরের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। ছুটির দিনে তিনি প্রায়ই সস্ত্রীক নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় চলে যেতেন। বাহার ছিলেন জিয়ার খুবই প্রিয় এবং ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে সৎ ও সাহসী। জিয়া ও বাহার পরস্পরকে ‘দোস্ত’ বলে সম্বোধন করতেন। অসম বয়সী এই বন্ধুর মৃত্যুতে জিয়া খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন।”[৫৩] আমার চাচা সাখাওয়াত হোসেন বাহার ছিলেন একাত্তরের অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তিনি ২০০’র বেশী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংগঠিত একটি কোম্পানিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং নভেম্বর মাসের মধ্যে নেত্রকোনার একটি বড় অংশ মুক্ত করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে দুই দুইবার বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। তাই তাঁর সাহসের ব্যাপারে জনাব মহিউদ্দিনের ‘স্বীকৃতি’ না দিলেও চলবে। কিন্তু তিনি যখন বলেন যে বাহার ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের মধ্যে সখ্য ছিল এবং তাঁরা একে অপরকে ‘দোস্ত’ বলে সম্বোধন করতেন তখন মনে হয় বাংলাদেশে মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতাকে মহিউদ্দিন কি পরিমাণ অপব্যবহার করেছেন। অবলীলাক্রমে মিথ্যা বলে চলেছেন। আমাদের পরিবারের সকলেই জানেন যে বাহারের সাথে জিয়ার কোনো কালেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না, থাকার কথাও নয়। ‘দোস্ত’বলে সম্বোধন করার তো প্রশ্নই আসে না। জিয়া নিজে বা সস্ত্রীক কখনও নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় আসেননি। [৫৪]

৭) কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে নভেম্বর ৭, ১৯৭৫ তারিখে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থান সম্পর্কেও জনাব মহিউদ্দিন আহমদ পাঠকদের বিভ্রান্ত করছেন ভুল তথ্য উপস্থাপন করে। তাঁর মতে তাহের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা জাসদ নেতৃবৃন্দের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। গত বছর জনাব আহমদ “তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন” রচনায় বলেছিলেনঃ “জাসদ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত ছিল ১০ নভেম্বর হরতাল হবে, ১০ লাখ ছাত্র-শ্রমিকের সমাবেশ ঘটিয়ে একটা গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করা হবে।”[৫৫] ১০ নভেম্বরের হরতালের তথ্যটি ভুল ছিল। সে প্রসঙ্গে আমি গত বছর লিখেছিলামঃ “চাঞ্চল্যকর এ তথ্যটি নতুন। গত ৩৮ বছরে তাহেরের প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনলেও এমনটি কখনও করেনি। মহিউদ্দিন এ দাবিটিই পর্যালোচনা করা যাক। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্যু হলে জাসদ নেতৃবৃন্দ ৪ নভেম্বর একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। সে পরিকল্পনার প্রেক্ষিতেই জাসদ ১০ নভেম্বরে নয় বরং ৯ নভেম্বরে হরতাল ডেকেছিল।”[৫৬] যেখানে উন্মুক্ত রাজনীতির কোন সুযোগ ছিল না বহুদিন ধরে, দেশে জরুরী অবস্থা ও সামরিক শাসন জারী আছে, সেখানে মহিউদ্দিন বলছেন ‘১০ লাখ ছাত্র-শ্রমিকের সমাবেশ’-এর কথা – পাঠক ভেবে দেখুন গবেষক মহোদয়ের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা কোন পর্যন্ত যেতে পারে! মো. আনোয়ার হোসেন ওই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “জাসদের সামনে তখন দু’টি পথ খোলা ছিল। হয় নিষ্ক্রিয় থাকা কিংবা ঘটনাপ্রবাহকে দলীয় লক্ষ্যে পরিচালিত করার চেষ্টা করা। ড. আখলাক সহ কয়েকজন প্রথমোক্ত পথ বেছে নিতেই ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের তাঁদের পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর মতে, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যাপক আংশকে কাজে লাগিয়ে সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান সংগঠনের এমন সুবর্ণ সুযোগ অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত। তিনি বোঝাতে চাইলেন, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরকম অবস্থায় আমাদের ক্ষমতা দখলের সুযোগ হাতছাড়া করা হবে ভুল। সে ভুলের কারণে আমাদের হয়তো ভবিষ্যতে একটি পুনর্গঠিত শক্তিশালী বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। তাহের আরও বলেন, জাসদ নিষ্ক্রিয় থাকলেও সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটবেই এবং তার ফলাফল অধিকতর নেতিবাচক বাস্তবতারও জন্ম দিতে পারে। তাহের বোঝালেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসা মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তিকে হঠানোর এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। জাতীয় জীবনের এক তাৎপর্যপূর্ণ সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছিল বলে জাসদ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সেদিন দ্বিধাদ্বন্দ্বের কমতি ছিল না। যথেষ্ট বিতর্কের পর মুখ্য নেতা সিরাজুল আলম খান একটি বিপ্লবী উদ্যোগ গ্রহণের পক্ষেই মতামত দেন এবং সে ভিত্তিতে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।”[৫৭]

৮) জাসদের তাত্ত্বিক গুরু ও প্রধান নেতা সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদের বিশ্লেষণ পড়লে মনে হয় লেখক যেকোনো মূল্যে জনাব খানকে বিতর্ক ও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখতে চাচ্ছেন। নভেম্বর ৭, ১৯৭৫ তারিখের ভোরের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলছেনঃ “ভোরে তাহের ও ইনু সেনানিবাসে গিয়ে জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। জিয়া জানতে চান, সিরাজুল আলম খান কোথায়? জিয়া জাসদের মূল নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। সিরাজুল আলম খান তখন কোথায়, তা কেউ জানেন না। তাঁর এই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে ধারণা করা হয়, তাহেরের এই উদ্যোগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং তিনি এর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাননি।”[৫৮] বাস্তবে সিরাজুল আলম খান ‘অদৃশ্য’ হয়ে যাননি। তাঁর ডিকটেশন অনুযায়ী অভ্যুত্থানের ঘোষণা নিয়ে আনোয়ার হোসেন গণকন্ঠের শামসুদ্দিন আহমেদকে (বর্তমানে অবসার্ভার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক) নিয়ে বেতার কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। [৫৯] ৭ নভেম্বর সম্পর্কে মো. আনোয়ার হোসেন বলছেনঃ “৭ নভেম্বর সকালে শহীদ মিনারে জিয়ার না আসা এবং বিকেলে রাষ্ট্রক্ষমতার এই হাতবদলের পর সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ায় জাসদ ভূমিকাহীন অবস্থানে চলে যায়। জাসদের সামনে তখন দু’টি পথ খোলা ছিল। একটি হলো, বাস্তব সে অবস্থায় ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে পশ্চাদপসরণকরা। এছাড়া দ্বিতীয় পথ ছিল, বিপ্লবী অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখা। ৬ নভেম্বর রাতে সিপাহী গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও যেখানে জাসদ নেতৃবৃন্দ ক্যান্টনমেন্টের বাইরে অভুত্থানী শক্তিকে সংগঠিত করতে বিশেষ কোনো উদ্যোগী ভূমিকা নেননি, সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে এ পর্যায়ে নেতৃত্ব প্রথম করনীয়ের বদলে বিপ্লবী অগ্রাভিযান চালিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলেন। এ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে তখনই জাসদের পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে লিফলেট প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হলো। আগে যেমনটা শোনা গিয়েছিল, তেমনই কিংবদন্তির যাদুকরী নায়কের মত সিরাজুল আলম খান তখন তার সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে কাজে নামলেন।”[৬০] পরিষ্কারভাবেই জনাব মহিউদ্দিন আহমদ সিরাজুল আলম খানকে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে সচেষ্ট বলে মনে হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু সংবাদ শুনে “সিরাজুল আলম খান হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন”বা “সুখে-দুঃখে বিপদে আপদে তিনি শেখ মুজিবের ছায়াসঙ্গী ছিলেন ইতিহাসের একটা বিশেষ পর্বে […] বেগম মুজিবও তাঁর উপর আস্থা রাখতেন। শেখ মুজিবযখন জেলে, বিশেষ করে ১৯৬৬-৬৯ সালে, বেগম মুজিবের মাধ্যমে শেখ মুজিব ও সিরাজের যোগাযোগ হতো।” [৬১] – জনাব খানের ব্যাপারে মহিউদ্দিন আহমদের এমন সব ‘অন্তরঙ্গ’কথা পড়ে যে কোন সাধারণ পাঠকের মনে হতে পারে সিরাজুল আলম খানই লেখককে এই সব জানিয়েছেন কিনা। কথাগুলো ঠিক হতেই পারে এমন ধরে নিলে মনে আরেক বড় প্রশ্নের উদয় হয়। ১৫ই আগস্ট ও ৭ নভেম্বর নিয়ে ইতিহাসের বিকৃতি কি জনাব সিরাজুল আলম খান মহিউদ্দিন আহমদকে দিয়ে লেখাচ্ছেন? কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়! আশা করি সিরাজুল আলম খান আমাদের এই শঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করবেন।

৯) জনাব মহিউদ্দিন আহমদের শেষ মিথ্যাচার কর্নেল তাহেরের ফাঁসি নিয়ে। প্রাক্তন জাসদ সভাপতি প্রয়াত মেজর জলিলের সাথে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি কথিত আলাপ তুলে দিয়েছেন জনাব আহমদ। জলিল তখন ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জনাব আহমদের ইতিহাস অনুযায়ী মেজর জলিল যখন জিয়ার কাছে জানতে চান কেন তিনি তাহেরকে ফাঁসি দিলেন, জিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাঁকে বলেনঃ “আমার ওপর প্রেশার ছিল। আমার কোনো চয়েস ছিল না, সবাই এটা চেয়েছিল।” [৬২] জনাব আহমদের মতে সেই কথোপকথনের সময় উপস্থিত ছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী ও কলাবোরেটর প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। পাঠক, যাদেরকে নিয়ে জনাব আহমদ কথা বলছেন তারা সকলেই মৃত। তিন মৃত ব্যক্তির আলাপচারিতার মাধ্যমে বাংলার নব্য ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ বোঝাতে চাচ্ছেন তাহেরকে ফাঁসি দেয়ার প্রশ্নে জিয়াউর রহমানের কোনো ‘চয়েস’ ছিল না।

আর কি চাতুর্যের সাথেই জনাব আহমদ আমার প্রয়াত চাচা বাহারের মৃত্যুতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের চোখ দিয়ে পানি ফেলালেন। এই সব ঘটনার মধ্য দিয়ে এক ভিন্ন জিয়ার সাথে আমরা নতুন করে পরিচিত হচ্ছি। যেই জিয়া ‘মানবিক’, যার চোখ দিয়ে পানি পড়ে এবং যিনি চাপে পড়ে তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছেন। জনাব আহমদ, আপনি কি জানেন তাহেরকে বিচার করার জন্য গঠিত স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনালে কোনো মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বসতে রাজি হননি? আপনি কি জানেন কর্নেল তাহেরের অবৈধ বিচার ও হত্যা সংক্রান্ত মামলার পুর্নাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী কি বলেছিলেন? ১৮৭ নম্বর পৃষ্ঠাটি পড়ুন। সেখানে লেখা আছেঃ “Can the execution of the death sentence, be termed as anything other than a cold blooded murder as some of those who appeared before us have posited? The answer in our brooding must be in the affirmative for three reasons; firstly when an execution is carried out barren of legal sanction, that is nothing but murder, secondly, and that is irrespective of the validity of the tribunal, it was a murder because even on the date of the commencement of the so-called trial, none of the charges prescribed death sentences and finally, and indeed most importantly, as pointed out by Mr. Maudud Ahmed in printed form and then verbally before us, the death sentence was pre- determined by General Ziaur Rahman well before even the tribunal was constituted, at the meeting of the formation commandars, […]” [৬৩] আপনি কি জানেন প্রয়াত জেনারেল মঞ্জুর তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে লরেন্স লিফশুলজকে কি জানিয়েছিলেন? মাননীয় সুপ্রিম কোর্টে পেশকৃত হলফনামায় লিফশুলজ লিখেছেনঃ “Although many of us had suspected it, Manzur’s representative told me that General Manzur also wanted me to know one thing above all else: Manzur knew with absolute certainty that Zia had personally taken the decision before the “so called trial” even began that Taher would be hanged. Subsequently, this fact was also confirmed to me by two high ranking military officers who were close to Zia at that time.”[৬৪]

গত বছর “‘তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাতকাহন’- একটি সতর্ক পর্যালোচনা” লেখায় তাহেরের ফাঁসির ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলামঃ “জিয়া কেন এমনটা করতে গিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো তাহের জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য কেন এবং কীভাবে এমন প্রচণ্ড হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন?”। [৬৫] আজকে উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান জানতেন তাহেরকে হত্যা না করলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর ও বিপ্লবী গণবাহিনীর প্রধান তাহের হতেন বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারতেন। সেই পরিস্থিতিতে তাই জিয়া যা করেছিলেন, বুঝে শুনেই করেছিলেন ঠাণ্ডা মাথায়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে জেনারেল জিয়াউর রহমান শুধু তাহেরকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেননি। ১৯৭৬ এর পর তিনি আরো শত শত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জেলখানার ভিতরে সামরিক আদালতের মাধ্যমে ফাঁসি দেন। ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রখ্যাত আইরিশ মানবাধিকার সংগঠক ও এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শন ম্যাকব্রাইড এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি দল নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। পরবর্তীতে তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ “Since this report was sent to President Ziaur Rahman on 23 June 1977, disturbing developments have taken place in Bangladesh. After 2 October 1977, at least 130, and perhaps several hundred, military men have been executed following trial by martial law tribunals for alleged involvement in abortive military uprisings which occurred in September/October 1977. Amnesty International is gravely concerned about these executions, particularly in view of the absence of legal safeguards in the military trial procedures, as described in this report.”[৬৬] এমনই এক নৃশংস চিত্র ফুটে উঠেছে ১৯৭৮ সালে Economic and Political Weekly-তে প্রকাশিত লরেন্স লিফশুলজের “Murder in Dacca: Ziaur Rahman’s Second Round” [৬৭] রচনায় এবং জায়েদুল আহসানের “রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি”[৬৮] ও আনোয়ার কবিরের “সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১”[৬৯] নামের গবেষণামূলক গ্রন্থে।

প্রিয় পাঠক, ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদের সর্বমোট সাতটি লেখায় বিবৃত বহু ভুল তথ্য ও অসঙ্গতি তুলে ধরেছি। শুরুতেই বলছিলাম জনাব আহমদ তাঁর লেখার মাধ্যমে একটি মিথ্যা ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ’ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কি সেই ন্যারেটিভ? ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও ডানপন্থী শক্তির সংশ্লিষ্টতার কথা পাশ কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জাসদ নেতা আবদুল বাতেন চৌধুরীর সাথে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং মেজর নূরের সাথে আরো কয়েকজনের তথাকথিত কথোপকথন নিয়ে ফলাও করে লিখেছেন। প্রকৃত হোতাদের নাম উল্লেখ না করে জাসদ ও সর্বহারা পার্টির প্রসঙ্গ টেনে জনাব আহমদ যেন এমন একটি আবহ সৃষ্টি করতে চাইছেন যাতে তাঁর পাঠকরা ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সাথে জাসদ ও সর্বহারা পার্টির যোগসাজশ খুঁজে পান। জনাব আহমদ হয়তো ভুলে গিয়েছেন যে এই দুটি দল যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িতই থাকতো তাহলে তাদের সদস্যরা খোন্দকার মোশতাঁকের মন্ত্রীসভাতেই যোগ দিতো বা কোনো না কোনো ভাবে ক্ষমতার অংশীদার হতো। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এমন কিছুই ঘটেনি ১৫ই আগস্টের পর। একটি আদর্শিক প্রেক্ষাপটে জাসদ বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিরোধিতা করেছিল। ৬০-এর দশক থেকে ১৯৭২ সালের ঘটনাবলি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ থেকে জাসদের বেরিয়ে আসার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জাসদ নেতা ও তাত্ত্বিক মনিরুল ইসলাম আমাদেরকে জানাচ্ছেন তাঁর “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র”[৭০] বইতে। বিডিনিউজ২৪-এর মতামত কলামে প্রকাশিত “কর্নেল তাহের কেন জাসদে যোগ দিয়েছিলেন” রচনাতেও মো. আনোয়ার হোসেন এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করেছেন। [৭১] জনাব আহমদকে সতর্ক করবো, রাজনৈতিক আদর্শের উপর ভিত্তি করে একটি দলকে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা এক জিনিস আর গোপনে ষড়যন্ত্র করে একটি দলকে উৎখাত করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারী খোন্দকার মোশতাক তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনের ডানপন্থী অংশকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করে। আপনি যতই তা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন, লাভ হবে না।

জনাব আহমদ একটি মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে একজন বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম ক্যু প্রচেষ্টা প্রতিহত করেছিলেন কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। সেই সময়কার ষড়যন্ত্রকারীদের (যাদের একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সদস্য) বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি – বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে তাহেরের পদত্যাগ করার একটি অন্যতম কারণ ছিল এটি। [৭২] তাহের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতির চরম বিরোধিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও তাহেরের কার্যকলাপ সম্বন্ধে জানতেন। কিন্তু তাহের বঙ্গবন্ধুকে ঘৃণা করতেন এ কথা শুধু বিকৃত মস্তিষ্কের ব্যক্তিরাই বিশ্বাস করবেন। এই দু’ জন মহান মানুষের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে “বঙ্গবন্ধু ও তাহের: ঔদার্য, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক”রচনায়। [৭৩] আগস্ট ২৫, ২০১৪ তারিখে জনাব আহমদ মো. হোসেনের আগস্ট ২১, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত “তাহেরকে নিয়ে কেন এই মিথ্যাচার” রচনার প্রত্যুত্তরে লিখেছেনঃ “পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট অনেকে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাবে এবং আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে একটা সমীকরণ তৈরি হবে। রাজনীতিতে এ ধরনের সমীকরণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে জোর করে আবু তাহেরকে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ বানানোর তো প্রয়োজন নেই।” [৭৪] নিঃসন্দেহে কর্নেল তাহেরকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন তাঁর অনুজ মো. আনোয়ার হোসেন। তাঁর একটি লেখাও খুঁজে পেলাম না যেখানে তাহেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ হিসেবে। বরং বাস্তবে বঙ্গবন্ধু ও তাহেরের সম্পর্ক কেমন ছিল সে কথা সহ আরো অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় উঠে এসেছে তাঁর বিভিন্ন লেখাতে। ১৫ই আগস্টের পর পর এমনই একটি ঘটনা সম্পর্কে মো. আনোয়ার হোসেন বলেনঃ “কর্নেল তাহের ও জাসদের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে মোশতাকের আড়াই মাসের শাসনামলে জাসদের উপর নেমে আসে হত্যা, নির্যাতন ও গ্রেপ্তার। ড্রেজার সংস্থায় কর্মরত তাহেরও খুনিচক্রের হয়রানি থেকে রক্ষা পান না। সে সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন জনাব আসাফউদ্দৌলা (সচিব হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত)। তিনি খোন্দকার মোশতাকের খুবই ঘনিষ্ঠ। আবার তার ভাই ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তা। একদিন কর্নেল তাহেরকে টেলিফোন করে জনাব আসাফউদ্দৌলা কয়েকটি অভিযোগ শোনান। তার মধ্যে প্রধান অভিযোগ ছিল ড্রেজার সংস্থার প্রমোদতরীতে শেখ কামালের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন তাহের। প্রতিটি অভিযোগ ছিল ডাহা মিথ্যা; তাহেরকে হয়রানি ও তাঁর উপর চাপ প্রয়োগের অপচেষ্টা। বঙ্গভবনে তাহেরকে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় মোশতাকের সঙ্গে। মোশতাক বারবার বঙ্গবন্ধুকে ‘মুজিব’ বলে সম্বোধন করছিলেন। এই নরাধম বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকাকালে কী নতজানুই না ছিল! তাহেরের সহ্য হয়নি। হাতের লাঠিটি উঁচিয়ে কঠিন কণ্ঠে তাহের বললেন, “বলুন বঙ্গবন্ধু”। তাহেরের উচ্চকণ্ঠ শুনে উদ্যত পিস্তল হাতে মেজর ডালিম কক্ষে প্রবেশ করে। কিন্তু তাহেরের কড়া ধমকে সে দ্রুতই কক্ষ ত্যাগ করে। চতুর মোশতাকও তাহেরের সঙ্গে কথা শেষ করেন এই বলে যে, অভিযোগ বিষয়ে তিনি ভুল তথ্য পেয়েছিলেন। এমন বহুজন যারা বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকাকালে তাঁর নাম জপ করেছেন শয়নে-স্বপনে, তারাই ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর খুনিদের কাছে নতজানু হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু উচ্চারণে ভীত হয়েছেন, বঙ্গভবনে ছুটে গেছেন মোশতাকের কৃপাভিক্ষা পেতে। আর কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম যিনি কোনো তোষামোদি করেননি; অটল থেকেছেন আপন অঙ্গীকারে, সেনাবাহিনী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নীতি-কৌশলের চরম বিরোধিতা করেছেন, তিনি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেছেন জাতির জনককে। তাই খুনি মোশতাকের ক্ষমতার দুর্গ বঙ্গভবনে গিয়ে অকুতোভয়ে উচ্চারণ করতে পেরেছেন ‘বঙ্গবন্ধু’।” [৭৫]

১৯৭৬ সালে তাহের তাঁর জবানবন্দিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘father of the nation’ বলার প্রসঙ্গে জনাব আহমদ লিখেছেনঃ “লরেন্স লিফশুলজের গ্রন্থ বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভল্যুশন (জেড প্রেস, লন্ডন, ১৯৭৯) থেকে আমি অনেক তথ্যের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি। আবু তাহেরের জবানবন্দিটি এই গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। এই জবানবন্দির কোথাও বঙ্গবন্ধু কিংবা জাতির পিতা (ফাদার অব দ্য নেশন) শব্দাবলির উল্লেখ নেই।” [৭৬] অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি কিভাবে ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ সত্য কে আড়াল করার চেষ্টা করে চলেছেন। জনাব আহমদ খুব ভালো করেই জানেন যে মো. আনোয়ার হোসেন ১৯৭৯ সালে লিফশুলজের প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতিটি নেননি। মো. আনোয়ার হোসেন স্পষ্টভাবেই “তাহেরকে নিয়ে কেন এই মিথ্যাচার” লেখায় উল্লেখ করেছেন যে তিনি কথাগুলো নিয়েছেন ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত Economic and Political Weekly’র ৩৩/৩৪ ভলিউমের ১৩৫০-১৩৫১ পৃষ্ঠা থেকে, যেই সংখ্যায় লিফশুলজ তাহেরের জবানবন্দি প্রথম বারের মত প্রকাশ করেন। তাহের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতির চরম বিরোধিতা করলেও তাঁকে তাঁর জবানবন্দিতে ‘Father of the nation’ বলতে দ্বিধা করেননি এই তথ্যটি আমাদের এতোদিন অজানা ছিল। তাহেরের জবানবন্দির প্রথম প্রকাশের পর তার তরজমার দায়িত্ব পড়েছিল দুই জন ব্যক্তির উপর, গণকন্ঠ পত্রিকার প্রাক্তন সাংবাদিক রায়হান ফেরদৌস মধু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক আফতাব আহমদ। জনাব আফতাব আহমদের পীড়াপীড়িতে তরজমাকালে তাহেরের বাংলা সংস্করণ থেকে ‘Father of the Nation’ কথাটি বাদ দেয়া হয় এবং লিফশুলজের ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত গ্রন্থেও তা বাদ পড়ে। কিছুদিন আগে রায়হান ফেরদৌস মধু মো. আনোয়ার হোসেনকে এই তথ্যটি জানালে আমি আগ্রহী হয়ে ১৯৭৭ সালে লিফশুলজ প্রকাশিত তাহেরের জবানবন্দি Economic and Political Weekly’র ওয়েবসাইট থেকে জোগাড় করি [৭৭] এবং প্রমাণ পাই যে তাহের ‘father of the nation’ কথাটি ঠিকই বলেছিলেন। পাঠক, গত বছর আমি লিখেছিলামঃ “বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে আজ যেই পারস্পরিক সম্মান ও সৌজন্যবোধ অনুপস্থিত, তা প্রবলভাবেই উপস্থিত ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাহেরের মধ্যে।”[৭৮] সেই কথা আজও প্রবলভাবেই বিশ্বাস করি, কারণ গত কয়েক দশক ধামাচাপা দেয়া প্রকৃত ইতিহাস ধীরে হলেও বেরিয়ে আসছে। প্রমাণস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রয়াত এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কথা বলি। তাহেরের ফাঁসি প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ “কর্নেল (অবঃ) তাহেরের এই ফাঁসির সংবাদে আমি একাধারে হতভম্ব ও মর্মাহত হই দারুণভাবে।” [৭৯] তার মানে তো এই নয় যে তিনি তাহেরের রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী হয়ে উঠেছিলেন।

কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার! পাঠক খেয়াল করুন, গত ৩৯ বছরে “বঙ্গবন্ধুর লাশ বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া উচিৎ ছিল”তাহেরের এই তথাকথিত মন্তব্য নঈম জাহাঙ্গীর কোথাও প্রকাশ করেননি। অথচ কিছুদিন আগে মহিউদ্দিন আহমদের সাথে ‘লুজ টক’ করতে গিয়ে তিনি তা বলেছেন আর সেই কথাকে ‘ইতিহাস’ মেনে জনাব আহমদ পত্রিকায় ছাপিয়ে দিচ্ছেন! আর, এর পরবর্তীতে আমরা কি দেখেছি? বিদ্যুৎ গতিতে সেই খবর প্রথম পাতায় ছাপিয়ে দিচ্ছে মানবজমিন পত্রিকা আর সেই পত্রিকার স্ক্রিন-শট ফেইসবুকের “বাশেরকেল্লা” থেকে শেয়ার করা হচ্ছে [৮০], ডেইলি স্টার পত্রিকা উক্ত মন্তব্যের সত্যতা যাচাই না করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে নেমেছে [৮১], জামায়াতে ইসলামীর বন্ধু পথভ্রষ্ট কাদের সিদ্দিকি এমন মন্তব্য লুফে নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় তার নিজের কলামে তুলে ধরছেন [৮২] এবং বিএনপি’র সভাপতি বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র কণ্ঠ মেলাচ্ছেন জনাব মহিউদ্দিন-এর সাথে। এই পরিস্থিতিতে যদি আমরা বলি যে একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, তাহলে কি ভুল বলা হবে?

১৯৭৬ ও ১৯৮০ সালে প্রকাশিত শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং মো. আনোয়ার হোসেনের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক দুটো রচনার প্রতি পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করবো। আগস্ট ১, ১৯৭৬ তারিখে আবদুল গাফফার চৌধুরীর “লেঃ কর্নেল তাহেরকে কি সত্যই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে?” রচনাটি যুক্তরাজ্যের একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। প্রকাশনার তারিখ আগস্ট ১ হলেও লেখার কন্টেন্ট পড়ে বোঝা যায় যে তাহেরের ফাঁসির রায়ের ঠিক পর পর তিনি এই লেখাটি তৈরি করেছিলেন। লেখায় প্রকাশ পেয়েছে যে আবদুল গাফফার চৌধুরী ধারণা করেছিলেন তাহেরের ফাঁসির রায় জিয়ার একটি রাজনৈতিক চাল মাত্র এবং জিয়া তাহেরকে ফাঁসি দিবেন না। সেই পরিস্থিতিতে জীবিত তাহেরকে মাথায় রেখে জনাব চৌধুরী জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় বসা মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তিকে কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সে সম্পর্কে বলেনঃ “নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী চক্রান্তের এই জোটকে হঠানো যাবে, আমি আর তা বিশ্বাস করি না। সুতরাং এবারের প্রস্তুতি সশস্ত্র গণ-সংগ্রামের প্রস্তুতি। জাসদের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব, বাকশাল ও বাঘাসিদ্দিকীর গণবাহিনীর মধ্যে এই ব্যাপারে ব্যাপক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং কর্মসূচিগত সমন্বয় সাধন হওয়া প্রয়োজন।” [৮৩] এদিকে জুলাই ২১, ১৯৮০ তারিখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রকাশিত “ইশতেহার”-এতাহের দিবস সংখ্যায় “ বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তন প্রত্যাশীদের প্রতি -” রচনায় মো. আনোয়ার হোসেন বলেনঃ “আজ বিপ্লবী আবেগের সংগে যুক্ত হোক কর্মসূচি। তাহলেই কেবল এদেশের বিপ্লব প্রত্যাশী অগ্রসৈনিকরা ২১শে জুলাইর চেতনা আর আবেগে সম্পৃক্ত হয়ে শুধু মাত্র সংগঠন সমূহের মধ্যে সৃষ্ট বন্ধ্যাত্ব নয়, পুরো দেশ, জাতি ও জনগণের দৈন্যদশা খুঁচিয়ে দেওয়ার বিপ্লবী অভিযাত্রায় পুণর্বার সামিল হতে পারবে, পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস আর স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে। গতিময় এই অভিযাত্রার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে আদর্শ, লক্ষ্য, কর্ম পদ্ধতি আর শৃঙ্খলার সচেতন জীবন্ত ঐক্য। একদেহ একপ্রাণ হয়ে, সম্মিলিত বিপ্লবী শক্তি ধাবিত হবে সমুখ পানে প্রচণ্ড গতিতে কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ। এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে হলে চাই সমগ্র দেশের শোষিত জনসাধারণের ঐক্য। আর তার জন্য প্রতিটি দল, গোষ্ঠি ও ব্যক্তির সাথে এ নিম্নতম কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা ও আন্দোলনের মাধ্যমে এক ব্যাপক ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের মানুষের মঙ্গল প্রত্যাশী প্রত্যেককেই ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এ কর্মসূচির চূড়ান্ত বিজয়ের জন্যে। তাহলেই বিজয় সুনিশ্চিত।” [৮৪]

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়কালে সম্ভবত কোনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলই ভাবেনি যে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি এতো দ্রুত শক্তি অর্জন করে তাদেরকে হটিয়ে দিবে। যার কারণে দেখা গিয়েছে জাসদ আওয়ামী লীগকে বিরোধিতা করেছে আদর্শিক লাইনে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আর এদিকে আওয়ামী লীগ জোর দিয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে। কিন্তু ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল নীতিগুলো খোন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার মাধ্যমে বিসর্জন দেয়া হয় এবং আজও সেই মূলনীতি যেখানে বাস্তবায়িত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির মধ্যে ঐক্য ঘটবে, এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ৮০ ও ৯০ দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও জাসদের কার্যকর ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে তৎকালীন জাসদের কার্যকরী সভাপতি প্রয়াত কাজী আরেফ আহমেদ এবং কর্নেল তাহেরের অনুজ প্রখ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাইদ আহমেদের সক্রিয় উদ্যোগের কথা সচেতন মহল নিশ্চই ভুলে যাননি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল নির্মূল কমিটির তীব্র আন্দোলন সৃষ্টিতে উপরোক্ত দুই জন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এমন একটি ঐক্যের কথাই শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী ও মো. আনোয়ার হোসেনের মত মানুষরা বলে আসছেন বহুকাল ধরে। সেই ঐক্য কি এতই ঠুনকো?

তাই ‘লেখক ও গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ যখন বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত হোতাদের আড়াল, কর্নেল তাহেরকে বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী হিসেবে উপস্থাপন, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সংগঠন প্রক্রিয়া থেকে সিরাজুল আলম খানকে বিচ্ছিন্ন এবং জিয়াউর রহমানকে ‘মানবিক’ রূপে উপস্থাপন করেন, তিনি আওয়ামী লীগের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা মোশতাকপন্থী শক্তি, জামায়েত ইসলামীর কোলে বসা বিএনপি ও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তিকে তৃপ্ত করেন, এবং অস্বীকার করেন যে তিনি যুদ্ধাপরাধ-বিরোধী আওয়ামী লীগ-জাসদ ঐক্যে ফাটল ধরাতে চাচ্ছেন না। আমাদের প্রতিপক্ষ যে মহিউদ্দিন আহমদের ইতিহাস রচনায় প্রচণ্ড পরিমাণে তৃপ্ত তা বোঝা যায় তারেক রহমানের সাম্প্রতিক মন্তব্যে। এমন একটি ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ’-এর জন্যই যেন তিনি অপেক্ষা করছিলেন। জনাব আহমদরা যদি সফল হন তাহলে বুঝে নিতে হবে অতীত থেকে থেকে আমরা একটুও শিক্ষা নেইনি।

মহিউদ্দিন আহমদ নিজেকে ‘লেখক ও গবেষক’ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালবাসেন। তিনি খুব সহজে কোন লেখাটি ‘ইতিহাস’ হয়েছে আর কোনটা হয়নি, তা বলে দিতে পারেন। আর নিজে ইতিহাস রচনার প্রকল্প হাতে নিয়ে নির্ভর করেন ‘লুজ টক’-এর উপর। তাই জনাব আহমদ যাদেরকে নিয়ে লিখছেন, তাদের অনেকেই জীবিত থাকলেও নিরপেক্ষ গবেষণার স্বার্থে তাদের মতামত বা পূর্বে প্রকাশিত বক্তব্য আমলে নেন না, কারণ তা করতে গেলে তাঁর সৃষ্ট ‘রাজনৈতিক ন্যারেটিভ’ ধোপে টেকে না। মহিউদ্দিন আহমদের ‘একাডেমিক’ আলোচনার ধরণ দেখে, প্রকৃত ‘একাডেমিকরা’ লজ্জা পাবেন নিঃসন্দেহে। এভাবেই তিনি নিজেকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রেখেছেন। জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকতে তিনি পছন্দ করতেই পারেন, কিন্তু তাহলে তাঁর ‘ইতিহাস’ লেখার প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। আমার আজকের লেখা পড়ে সকল পাঠক মহিউদ্দিন আহমদের ‘ইতিহাস’কে অবিশ্বাস করবেন সে আশা আমি রাখি না। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস বিনির্মাণ কঠিন শ্রমসাধ্য বিষয়। সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে অনেক কিছুর উপর। সেখানে সাক্ষ্যের বস্তুনিষ্ঠতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন তাঁর অতীত কর্ম যা নির্ধারণ করে দেয় মানুষের মাঝে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে। আমরা কি হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একজন তথাকথিত ‘লেখক ও গবেষক’ -এর কথা মানবো? মোটেই না। জনাব মহিউদ্দিন, আপনি আপনার “সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় কেন” এমন চটকদার শিরোনামে তথাকথিত ‘ইতিহাস’ লিখতে থাকুন, তাতে প্রকৃত ‘ইতিহাস’ বদলে যাবে না। কারণ যাদেরকে আপনি সত্যের মুখোমুখি হতে বলছেন তাঁরা সত্য প্রকাশ করে আসছেন শুরু থেকেই। আপনার কাছ থেকে সত্য উচ্চারণের শিক্ষা তাঁদের গ্রহণ করতে হবে না। আপনার কথা আপনাকেই স্মরণ করিয়ে দেইঃ “ইতিহাস লেখা খুব সহজ কাজ নয়।” মনে রাখবেন, বাংলাদেশে ‘শাহবাগ’ ঘটে গেছে আর লক্ষ তরুণের সাথে আমারও ‘জন্ম’ হয়েছে শাহবাগের গণজাগরণে। আপনি যতবার মিথ্যা কথা বলবেন, আমরা ততবার কলম ধরবো।

(*) দৃষ্টব্যঃ এই লেখাটি আগস্ট ২৯, ২০১৪ তারিখে প্রথম প্রকাশিত হয় বিডিনিউজ২৪ থেকে। লিঙ্কঃ http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/20237

তথ্যসূত্রঃ

[১] মহিউদ্দিন আহমদ, ‘তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাত-কাহন’ দৈনিক প্রথম আলো (জুন ০২, ২০১৩)
[২] এম সানজীব হোসেন, “‘তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বরের সাত-কাহন’ – একটি সতর্ক পর্যালোচনা” বিডিনিউজ২৪ (জুন ১১, ২০১৩)
[৩] প্রথম আলো ঈদ সংখ্যা ২০১৪
[৪] মহিউদ্দিন আহমদ, ‘পঁচাত্তরের পালাবদল এবং জাসদের দায়’ দৈনিক প্রথম আলো (জুলাই ১৫, ২০১৪) এবং ; মহিউদ্দিন আহমদ, ‘তাজউদ্দীন খুনিদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন’ দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ১২, ২০১৪) এবং ; মহিউদ্দিন আহমদ, “‘আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি’” দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ১৩, ২০১৪) ; মহিউদ্দিন আহমদ, ‘বাকশাল বাদ দিয়ে তাহেরের জাতীয় সরকার’ দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ১৪, ২০১৪) এবং ; মহিউদ্দিন আহমদ, ‘সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় কেন?’ দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ২৫, ২০১৪) এবং ।
[৫] দেখুন তথ্যসূত্র [১]
[৬]
[৭]
[৮] দেখুন তথ্যসূত্র [৭]
[৯] দেখুন তথ্যসূত্র [৭]
[১০] দেখুন তথ্যসূত্র [১]
[১১] দেখুন তথ্যসূত্র [৩]
[১২] দেখুন তথ্যসূত্র [৪]
[১৩] দেখুন তথ্যসূত্র [৩] পৃষ্ঠা ২৪১
[১৪] ২ মিনিট ২৮ (২ঃ২৮) থেকে ২ মিনিট ৫২ (২ঃ৫২) সেকেন্ড পর্যন্ত শুনুন।
[১৫] দেখুন তথ্যসূত্র [৩] পৃষ্ঠা ২৪২
[১৬] দেখুন তথ্যসূত্র [৩] পৃষ্ঠা ২৪২
[১৭] দেখুন তথ্যসূত্র [৪] মহিউদ্দিন আহমদ, “‘আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি’” দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ১৩, ২০১৪)
[১৮] পৃষ্ঠা ২২৯
[১৯] Lawrence Lifschultz, ‘The past is never dead The long shadow of the August 1975 coup’ The Daily Star (August 15, 2005)
[২০] Lawrence Lifschultz, ‘Fearing a Leftist challenge, Rightists struck’ The Daily Star (August 20, 2005)
[২১]
[২২]
[২৩]
[২৪] দেখুন তথ্যসূত্র [২৩]
[২৫] দেখুন তথ্যসূত্র [২৩]
[২৬]
[২৭] দেখুন তথ্যসূত্র [২৬]
[২৮] দেখুন তথ্যসূত্র [২৬]
[২৯] Sashanka S Banerjee, India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan (a political treatise) (1st edn, Ms. Sanchita December 2011) pp. 160-163
[৩০] ৮ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড (৮ঃ৫৫) থেকে শুনুন।
[৩১] ১ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড (১ঃ৩৪) থেকে শুরু করে দেখুন ২ মিনিট ২০ সেকেন্ড (২ঃ২০) পর্যন্ত শুনুন।
[৩২] মো. আনোয়ার হোসেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের’ (আগামী প্রকাশনী, ২০১২) পৃষ্ঠা ৮১
[৩৩] Ibid.
[৩৪] Ibid.
[৩৫]
[৩৬] J N Dixit, Liberation and Beyond Indo-Bangladesh Relations (The University Press Limited 1999) p. 211
[৩৭] Lawrence Lifschultz, ‘Abu Taher’s Last Testament: Bangladesh: The Unfinished Revolution’ [Special Number August 1977] Economic and Political Weekly, Vol. 12, No. 33/34, p. 1350
[৩৮] দেখুন তথ্যসূত্র [৩৭] পৃষ্ঠা ১৩৪৯-১৩৫০
[৩৯] দেখুন তথ্যসূত্র [৩৭] পৃষ্ঠা ১৩৫০
[৪০] দেখুন তথ্যসূত্র [৩৭] পৃষ্ঠা ১৩৫০
[৪১] Peter Custers, ‘Colonel Abu Taher’s Uprising’ [2011] Frontier Weekly, Vol. 44, Nos. 11-14
[৪২] নাসির উদ্দিন, গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী (আগামী প্রকাশনী ১৯৯৭) পৃষ্ঠা ১১৫
[৪৩] দেখুন তথ্যসূত্র [৪] মহিউদ্দিন আহমদ, “‘আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি’” দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ১৩, ২০১৪)
[৪৪] Ibid.
[৪৫] Ibid.
[৪৬] Ibid.
[৪৭] দেখুন তথ্যসূত্র [৪] মহিউদ্দিন আহমদ, ‘বাকশাল বাদ দিয়ে তাহেরের জাতীয় সরকার’ দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ১৪, ২০১৪) এবং
[৪৮] মো. আনোয়ার হোসেন, ‘তাহেরকে নিয়ে কেন এই মিথ্যাচার’ দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ২১, ২০১৪) এবং
[৪৯] দেখুন তথ্যসূত্র [৩] পৃষ্ঠা ২৪২
[৫০] Ibid.
[৫১] দেখুন তথ্যসূত্র [৪৮]
[৫২] Ibid.
[৫৩] দেখুন তথ্যসূত্র [৩] পৃষ্ঠা ২৫১
[৫৪] দেখুন তথ্যসূত্র [৪৮]
[৫৫] দেখুন তথ্যসূত্র [১]
[৫৬] দেখুন তথ্যসূত্র [২]
[৫৭] দেখুন তথ্যসূত্র [৩২] পৃষ্ঠা ৮৮
[৫৮] দেখুন তথ্যসূত্র [৩] পৃষ্ঠা ২৪৭
[৫৯] দেখুন তথ্যসূত্র [৩২] পৃষ্ঠা ৯৫
[৬০] দেখুন তথ্যসূত্র [৩২] পৃষ্ঠা ১০১
[৬১] দেখুন তথ্যসূত্র [৪] মহিউদ্দিন আহমদ, ‘বাকশাল বাদ দিয়ে তাহেরের জাতীয় সরকার’ দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ১৪, ২০১৪)
[৬২] দেখুন তথ্যসূত্র [৩] পৃষ্ঠা ২৫৩
[৬৩] pp. 187-188
[৬৪] ‘Affidavit of Lawrence Lifschultz’ p. 4
[৬৫] দেখুন তথ্যসূত্র [২]
[৬৬] Amnesty International, Report of an Amnesty International Mission to Bangladesh (4-12 April 1977) (AI Index: ASA 13/03/78) p. Foreward
[৬৭] N.M.J., ‘Murder in Dacca: Ziaur Rahman’s Second Round’ [March 25, 1978] Economic and Political Weekly, Vol. 13, No. 12, pp. 551-558 (লরেন্স লিফশুলজ ‘N.M.J’ ছদ্মনাম দিয়ে এই লেখাটি রচনা করেন)
[৬৮] জায়েদুল আহসান, রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি (পাঠ্যসূত্র ২০০৮)
[৬৯] আনোয়ার কবির, সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ (সাহিত্য প্রকাশ ২০১০)
[৭০] মনিরুল ইসলাম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র (জ্যা পাবলিকেশন্স – পরিবেশকঃ পাঠক সমাবেশ)
[৭১] মো. আনোয়ার হোসেন, ‘কর্নেল তাহের কেন জাসদে যোগ দিয়েছিলেন’ বিডিনিউজ২৪ (নভেম্বর ৩০, ২০১২)
[৭২] জিয়াউল হক মুক্তা (সম্পাদিত), শহীদ কর্নেল তাহের রচনা সংগ্রহ – ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে (বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, পরিবেশকঃ পাঠক সমাবেশ ১৯৯৬) পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭
[৭৩] মো. আনোয়ার হোসেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও তাহের: ঔদার্য, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক’ বিডিনিউজ২৪ (আগস্ট ১৪, ২০১৪)
[৭৪ ] দেখুন তথ্যসূত্র [৪] মহিউদ্দিন আহমদ, ‘সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় কেন?’ দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ২৫, ২০১৪)
[৭৫] দেখুন তথ্যসূত্র [৭৩]
[৭৬] দেখুন তথ্যসূত্র [৪] মহিউদ্দিন আহমদ, ‘সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় কেন?’ দৈনিক প্রথম আলো (আগস্ট ২৫, ২০১৪)
[৭৭] দেখুন তথ্যসূত্র [৩৭]
[৭৮] দেখুন তথ্যসূত্র [২]
[৭৯] এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ ( ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ১৯৯৩) পৃষ্ঠা ২৭৭
[৮০]
[৮১] ‘Who Said What After August 15’ The Daily Star (August 17, 2014)
[৮২] কাদের সিদ্দিকি, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অপদার্থদের কি ক্ষমা করা যায় না?’ বাংলাদেশ প্রতিদিন (আগস্ট ১৯, ২০১৪)
[৮৩] আবদুল গাফফার চৌধুরী, ‘লেঃ কর্নেল তাহেরকে কি সত্যই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে?’ (আগস্ট ১, ১৯৭৬)
[৮৪] মো. আনোয়ার হোসেন, ‘বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তন প্রত্যাশীদের প্রতি -’ (ইশতেহার, জুলাই ২১, ১৯৮০)

এম সানজীব হোসেন

১৯৮৫ সালের ১ এপ্রিল জাপানের কিয়োটো শহরে জন্মগ্রহণ করি। বর্তমানে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের সাহায্যে যুক্তরাজ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ক্রিমিনলজি ও ক্রিমিনাল জাস্টিস বিষয়ে এমএসসি সম্পন্ন করেছি। কর্মজীবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটরের রিসার্চার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) ও একাত্তর বাংলাদেশ-এর সদস্য এবং কর্নেল তাহের সংসদ-এর গবেষণা সম্পাদক।

৩ comments

  1. রায়হান রশিদ - ৩১ আগস্ট ২০১৪ (৫:৫৬ অপরাহ্ণ)

    সবকিছুতে শর্টকাটের যুগে অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য লেখাটার জন্য লেখক সানজীব হোসেন এর প্রতি শ্রদ্ধা। আবেগের নিশ্চয়ই মূল্য আছে, কিন্তু ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে তা খুব একটা কার্যকর কিছু না। সেখানে এমন বিশদ গবেষণা সমৃদ্ধ কাজগুলোই সঠিক পথ দেখাতে পারে।

    প্রথমআলো আর মহিউদ্দিন আহমেদ-দের এধরনের ইতিহাস প্রকল্পের নিন্দা জানাই। প্রথম আলোর একটা দু’টো বিচ্ছিন্ন লেখায় এমনটা হলে কথা ছিল না, কিন্তু এখানে একটা সুস্পষ্ট প্যাটার্ণ দেখা যাচ্ছে। এমন সর্বনাশা মতলববাজির বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে।

    আবারও ধন্যবাদ লেখককে।

  2. এম সানজীব হোসেন - ৩১ আগস্ট ২০১৪ (১১:৪৬ অপরাহ্ণ)

    অনেক ধন্যবাদ, রায়হান ভাই। দেখা যাক, জনাব মহিউদ্দিন আহমদ কোনো জবাব দেন কিনা।

  3. নীড় সন্ধানী - ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ (২:৫৬ অপরাহ্ণ)

    মহিউদ্দিন সাহেবের কোন জবাব কি পেয়েছেন? না পেলে অবাক হবো না। কারখানায় যখন ইতিহাস তৈরী করা হয় সেই ইতিহাসের নির্মাতা/মালিক একজন থাকে না। আপনার উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর তৈরী করার জন্য স্পনসরশীপ না থাকারই কথা। তবু কারখানার ইতিহাসবিদদের পরবর্তী পদক্ষেপ জানার জন্য অপেক্ষা করবো।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.