শহীদ কিশোর জামাল

ছেলেটার নাম জামাল… দারুন ডানপিটে… চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে…[..]

ছেলেটার নাম জামাল…

দারুন ডানপিটে…

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে…

 

ফেব্রুয়ারীর শুরুর দিকে এক বিকেলে বাসায় ফেরার পথে ঈদগা কাঁচারাস্তার ওই দিকটায় দেখে, বাঙালী এক ছেলে দৌড়াচ্ছে, পিছনে দা হাতে দশ-বারোজন বিহারী যুবক…

ছেলেটা আছাড় খেয়ে পড়ে যায়…আর উঠতে পারেনি…দা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে বিহারীরা…

ছেলেটা কিছুক্ষণ বিকট শব্দে চিৎকার করে…এরপর সব চুপচাপ…

কিছুক্ষণ পর বিহারীগুলো কাঁধে রক্তাক্ত দা রেখে তৃপ্ত মুখে ধীরে ধীরে বড় পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়…ওদের সারা গায়ে রক্ত লেপটে আছে…

 

কিশোর জামাল কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরে আসে…

হালিশহর এলাকায় থাকার কারণে বাঙালী-বিহারী, পূর্ব পাকিস্তান-পশ্চিম পাকিস্তান দ্বন্দ্বগুলো কিছুটা বুঝত…

কিন্তু ওই বিকেলের ঘটনা কিশোর জামালকে যেন যুবক বানিয়ে দিল…

জীবনের সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায়…

চট্টগ্রাম নিউক্লিয়াসের কিছু বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয় ছিল…

তাদের সাথে শুরু হলো উঠা-বসা…

মিছিল-স্লোগান-মিটিং, দেশচিন্তা হয়ে গেল জীবনের একমাত্র কাজ…

 

মার্চ মাস… যুদ্ধ শুরু হলো…

চারপাশে শুধু অশান্তি, আতঙ্ক আর হানাহানি…

হালিশহরে প্রতিদিনই দশ-বারোজন বাঙালীকে বিহারীরা জবাই করছে…

চুনা ফ্যাক্টরীর মোড়টা যেন বাঙালী জবাইখানার উঠোন…

 

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কিশোর জামাল…

সে যুদ্ধে যাবে…

কিন্তু বাবা-মা যেতে দিবে না…

এদিকে নিউক্লিয়াসের বড় ভাইগুলোর সাথে কথা পাকা হয়ে গেছে…

যুদ্ধে যাবেই সে…

 

মে মাসের তিন তারিখ মাঝরাতে বাড়ি থেকে পালালো জামাল…

পালানোর আগমুহুর্তে ঘুমন্ত মা-বাবাকে শেষবারের মত দেখে নিল…

টেবিলের উপর একটা চিঠি রাখলো…

 

আব্বা,

সালাম নিবেন।

পুত্রস্নেহের কারণে আপনারা আমায় যুদ্ধে যেতে দিতেন না।

তাই, আপনাদের না বলে চলে গেলাম।

জানোয়াররা এত মানুষ মারছে, আমি কি করে ঘরে বসে থাকি?

আমি একদিন ফিরবো, আপনাদের জন্য স্বাধীন একটা দেশ নিয়ে ফিরবো, ইনশাল্লাহ।

আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।

আম্মার খেয়াল রাখবেন। উনাকে একটু বুঝাবেন।

শারুকে বাইরে বেরুতে দিবেন না। পরিস্থিতি অনেক খারাপ।

আমার জন্য দোয়া করবেন, দেশের জন্য দোয়া করবেন।

আমি আপনাদের যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারিনি।

আমায় মাফ করে দেবেন।

ইতি,

মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন।

 

বাড়ি থেকে পালালো জামাল…কিন্তু ভাগ্য বিশ্বাসঘাতকতা করে…

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এ.কে. খান মোড়ে পাকি, রাজাকার ও বিহারীদের যৌথ টহল বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে কিশোর জামাল…

 

হালিশহর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হল…

পাকিরা জামালকে তাঁর সঙ্গীদের নাম জিজ্ঞাসা করে…

সারা রাত চলল ভয়ংকর টর্চার…

পাকি জানোয়াররা কিশোর ছেলেটার আঙুলে পিন ঢুকালো, হাতে-পায়ের তালু আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল, বুটের লাথিতে সারা শরীর রক্তাক্ত করে দিল…

জামালের কিশোর কন্ঠের চিৎকার নরপশুগুলোর মনে কোন দয়ার সৃষ্টি করল না…

কিশোর জামাল মুখ খুলল না…হাল ছেড়ে দিল খানরা…

কিন্তু কিশোর জামালের জন্য ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করছিল…

 

পরদিন ভোর সকালে জামালের বাবা আর ছোট ভাইকে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো…

 

সকাল দশটা…

হালিশহর চুনাফ্যাক্টরির মোড়ে খান সেনারা বিহারীদের দিয়ে ১৪ বছরের কিশোর জামাল, তাঁর বাবা ও ১১ বছর বয়সী ছোট ভাইকে জবাই করে…

 

……শহীদ কিশোর জামালরা ফিরেননি কিন্তু আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে ভাবি, জামালদের এই আত্মত্যাগের কতটুকু মূল্যায়ণ আমরা করছি?

সাব্বির হোসাইন

মানুষ, বাঙালি, মুক্তমনা... মুক্তিযুদ্ধের বই-দলিল-ভিডিও-ডকুমেন্টারী-মুভি-অডিও-ছবি নিয়ে "মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভের" কাজ করছি। সবার প্রতি "মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ" ঘুরে আসার নেমতন্ন রইল। মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভ: http://www.liberationwarbangladesh.org/ বাংলাদেশে সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীদের নানান অপকর্ম নিয়ে "একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি" থেকে প্রকাশিত "শ্বেতপত্রের" চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের একজন তথ্য সংগ্রাহক। ব্যাক্তিগত ব্লগ: http://www.sabbir-hossain.com/

১ comment

  1. মন্জু হাসান - ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ (৬:১০ অপরাহ্ণ)

    শহীদ জামালের সৃম্তির প্রতি শ্রদ্ধা…

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.