সময়-ব্যবস্থাপনায় ট্রাইবুনাল-১-এর সময়োপযোগী পদক্ষেপ

গতকাল (৬ জুলাই ২০১২) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ তার আদেশের মাধ্যমে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত এবং পদ্ধতিগত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে। [...]

১৯৭১-এ সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর বিচারের গতি ত্বরান্বিত হোক, বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বিস্তৃত হোক, এটা সম্ভবত শুধু আসামীপক্ষ ছাড়া আর বাকি সকলেরই চাওয়া। এই বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার বিষয়টি মাথায় রেখে নানা ধরণের প্রস্তাব ও সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তেমনই একটি প্রস্তাব ছিল পৃথক এবং নতুন ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠা করা। নাগরিক সমাজের একাংশের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার এই বছরের শুরুতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে, যা প্রথম ট্রাইবুনালের পাশাপাশি কাজ করছে। দ্বিতীয় ট্রাইবুনাল গঠনের পরিকল্পনাটি যখন সরকারের বিবেচনাধীন ছিল, তখনই আইসিএসএফ-এর পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছিল এভাবে পৃথক একটি ট্রাইবুনাল (দ্বিতীয় ট্রাইবুনাল) প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য সমস্যাগুলো। এর পরিবর্তে আইসিএসএফ এর পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছিল – ‘পৃথক ট্রাইবুনাল’ গঠন না করে বিদ্যমান ট্রাইবুনালের আওতায় প্রয়োজন একাধিক ‘বেঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা করা। সাথে আরও কিছু পন্থা সুপারিশ করা হয়েছিল যেগুলোর মাধ্যমে বিদ্যমান ট্রাইবুনাল ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও বিচারে কালক্ষেপণের যে-কোনো চেষ্টাকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে। কারণ, অহেতুক কালক্ষেপণের বিষয়গুলো একটি ট্রাইবুনাল হলে সেখানে যেমন ঘটতে পারে (এবং ঘটেছেও), সেটা একাধিক ট্রাইবুনাল হলেও সেখানেও সমানভাবে হতে পারে এবং হচ্ছেও।

এই সমস্যাগুলোকে বিবেচনা করে, সেগুলোকে সরাসরি মোকাবিলার কথা মনে রেখেই, গতকাল (৬ জুলাই ২০১২) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ তার আদেশের মাধ্যমে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত এবং পদ্ধতিগত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে। ট্রাইবুনাল ঘোষণা করেছে যে এখন থেকে প্রথম ট্রাইবুনালে সাক্ষীদের জবানবন্দী এবং জেরার সময় নির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া হবে, এবং মামলার প্রসিকিউশন এবং আসামীপক্ষের আইনজীবীদের সেই বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই সাক্ষীর জবানবন্দী এবং জেরার কাজ সম্পন্ন করতে হবে। [সূত্র: http://bit.ly/OFmKAd]

প্রথম ট্রাইবুনালের এই সুচিন্তিত সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এর দরকার ছিল। কারণ, গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা লক্ষ করেছি – ট্রাইবুনালে প্রতিটি সাক্ষীর ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের জবানবন্দী গ্রহণে সময় ব্যয় হচ্ছিল গড়ে ১-২ দিন। অন্যদিকে আসামীপক্ষের আইনজীবীরা যখন সেই সাক্ষীদের জেরা করছিলেন, সেখানেও গড়ে প্রতিটি সাক্ষীর জেরায় ব্যয় হচ্ছিল ৩-৫ দিন। অর্থাৎ, জেরা এবং জবানবন্দী মিলিয়ে প্রতিটি সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণে ব্যয় হচ্ছিল গড়ে কমপক্ষে ৩-৬ দিন। এটা নিশ্চয়ই কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়বে না যে, কোনো একটি মামলায় যদি ৬০ জন সাক্ষী থাকে তাহলে কেবল সাক্ষ্যগ্রহণেই সেখানে খরচ হয়ে যাবে প্রায় ৩৬০ দিন অর্থাৎ এক বছর সময়। আর তার ওপর তো রয়েছে শতাধিক পিটিশন এবং অন্যান্য শুনানির জন্য নির্ধারিত সময়। প্রথম ট্রাইবুনালের এই সিদ্ধান্ত বিদ্যমান মামলাগুলোর সময় ব্যবস্থাপনায় মৌলিক অগ্রগতি সাধন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা আশা করব নবগঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালও প্রথম ট্রাইবুনালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দৃষ্টান্ত নিজেদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করার বিষয়টি বিবেচনায় আনবে।

স্বাভাবিকভাবেই, আসামী পক্ষের আইনজীবীরা প্রথম ট্রাইবুনালের এই সিদ্ধান্তে খুশি নন। তাঁরা বলে বেড়াচ্ছেন যে, এতে তাঁদের মক্কেলের অধিকার লঙ্ঘিত হবে। সম্ভবত অনির্দিষ্টকাল ধরে একজন সাক্ষীকে জেরা করাকে তাঁরা মক্কেলের অধিকার ভেবে এতদিন ভুল করে আসছিলেন। তাঁদের জেনে রাখা ভালো – এ ধরণের সময় বেঁধে দেয়া কিন্তু এখানেই প্রথম নয়। আন্তর্জাতিক অন্যান্য ট্রাইবুনালে এভাবে সময় বেঁধে দেয়ার প্রচুর নজির রয়েছে, এবং আদালতের মূল্যবান সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটা এক ধরণের গ্রহণযোগ্য পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। কারণ, সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে জবানবন্দী যেমন জরুরি, জেরা করবার অধিকারও তেমনই জরুরি – কিন্তু তার মানে এই নয় যে অনির্দিষ্টকাল ধরে দু’পক্ষের আইনজীবীরা সাক্ষ্যগ্রহণ করতে থাকবেন। ইতোমধ্যেই আসামী সাকা চৌধুরী তাঁর পক্ষে সহস্রাধিক সাক্ষী পেশ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে গোলাম আযম মামলার আইনজীবীরা তো আরও এককাঠি সরেস, তাঁরা ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন গোলাম আযমের পক্ষে দুই সহস্রাধিক সাক্ষী ট্রাইবুনালে হাজির করার। দুটোই বিচারের ইতিহাসে নজিরবিহীন। প্রথম ট্রাইবুনালের দৃঢ় পদক্ষেপ এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত সময়োচিত বলে আমরা মনে করি।

এবার আসা যাক শুরুর প্রসঙ্গে। দ্বিতীয় ট্রাইবুনাল মাত্র কয়েক মাস হল তার কার্যক্রম শুরু করেছে। সুতরাং, এখনও এর পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করবার সময় আসেনি। তবে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমাদের সবারই তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। দ্বিতীয় ট্রাইবুনাল গঠনের প্রাক্কালে কিছু বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে আইসিএসএফ এর পক্ষ থেকে সরকারকে জানানো হয়েছিল, একটি বিস্তারিত গবেষণানির্ভর অবস্থানপত্রের মাধ্যমে (নীচে গবেষণাপত্রটির লিংক দেয়া হয়েছে)। আইসিএসএফ নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো হয়েছিল যে, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইনে প্রয়োজনে একাধিক ট্রাইবুনাল গঠনের বিষয়টির উল্লেখ থাকলেও একাধিক ট্রাইবুনাল নির্বিঘ্নে পাশাপাশি কাজ করার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সরকারকে আগে নিষ্পত্তি করতে হবে। যেমন, কীভাবে একাধিক ট্রাইবুনাল পাশপাশি তাদের কাজ পরিচালনা করবে, কী হবে তাদের ভেতরকার সম্পর্ক, ইতোমধ্যে আমলে নিয়ে নেয়া মামলাগুলো এক ট্রাইবুনাল থেকে আরেক ট্রাইবুনালে কী প্রক্রিয়ায় স্থানান্তরিত হবে, পুরো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারিক চেইন অব কমান্ড-এর বিষয়টি কীভাবে নির্ধারিত হবে, কীভাবে বিচারিক বিষয়গুলোর আইনি সামঞ্জস্য রক্ষা হবে উভয় ট্রাইবুনালে, প্রতিটি ট্রাইবুনাল নিয়ম অনুযায়ী পৃথক পৃথক কার্যবিধি প্রণয়ন করা শুরু করলে সৃষ্ট জটিলতার নিরসন কীভাবে হবে, কয়টি প্রসিকিউশন টিম এবং তদন্ত সংস্থা হবে, ট্রাইবুনালের সংহতি এবং স্বাধীনতার বিষয়গুলো কীভাবে নিরূপিত হবে ইত্যাদি। এসব বিবেচনা করেই আইসিএসএফ-এর পক্ষ থেকে বিকল্প পন্থা হিসেবে ‘একাধিক বেঞ্চ’ গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩ এর ৬(১) ধারায় মাত্র কয়েকটি শব্দে ন্যূনতম পরিবর্তন এনেই আনা সম্ভবপর ছিল।

এই বিষয়ে আইসিএসএফ ‘Think it Through, Benches is the Answer’ – A Legal and Strategic Analysis of the Government’s Stance on Setting up Additional Tribunals (ই-লাইব্রেরি থেকে ডাউনলোড লিংক : http://bit.ly/wus5di) – এই শিরোনামে একটি অবস্থানপত্র প্রণয়ন করেছিল।

১৯৭৩ সালের আইনটি এবং নতুন ট্রাইবুনাল গঠনের ক্ষেত্রে – সরকারের প্রাথমিক অবস্থান ছিল কোনোভাবেই আইনটি পরিবর্তন না করার পক্ষে। তাই বেঞ্চ গঠনের আমাদের প্রস্তাবিত পথে না গিয়ে সরকার আইনটির বিদ্যমান ৬(১) ধারার সীমিত বিধানের মধ্যে থেকেই নতুন ট্রাইবুনাল গঠনের পথ বেছে নিয়েছিল। সমস্যা হল, বিদ্যমান ধারা ৬(১)-এর আওতায় নতুন ট্রাইবুনাল গঠন করার কথা বলা থাকলেও বিধানটি আর সকল সমস্যা (যেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে আমাদের গবেষণাপত্রে) সমাধানে অপারগ। এ কারণেই কিছুদিন আগে, আন্তঃট্রাইবুনাল মামলা স্থানান্তরজনিত জটিলতা অনুধাবন করে সরকার শেষ পর্যন্ত আইনটি সংশোধন করেছেন। ঠিক এই বিষয়টিই অনেক জোর দিয়ে বলা হয়েছিল আইসিএসএফ এর গবেষণায় আগেভাগেই। সরকারের যে প্রাথমিক অবস্থান ছিল আইনে আর কোনো সংশোধন না করার, তা থেকে সরকার ইতোমধ্যেই সরে এসেছে। কিন্তু এখনো আমাদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা বাকি সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান হয়নি, আইনটিতে নতুন সংশোধনের পরও।

আমি মনে করি আইসিএসএফ-এর গবেষণাপত্রে উত্থাপিত বিষয়গুলো এখনও প্রাসঙ্গিক এবং সতর্ক পর্যবেক্ষণ দাবি করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এবং এই বিচারের ভবিষ্যৎ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করবে বলে মনে করি।

++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

স্বীকৃতি:

আইসিএসএফ সদস্য রায়হান রশিদের এই লেখাটি আইসিএসএফ-এর ফেসবুক পাতায় ৭ জুলাই ২০১২ তারিখে স্টেটাস-পোস্ট হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.