ক্যাপ্টেন কাদেরদের সহজ হিসাব এখনও প্রাসঙ্গিক

১৯৭২ সালের কিছু পুরোনো সংবাদপত্রের রিপোর্ট ঘাটতে ঘাটতে একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল। মন চলে গেল সেই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ বাঙ্গালী অফিসার ক্যাপ্টেন কাদের। ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন বিয়ে করতে। হাতের মেহেদির রং তখনো উজ্জ্বল, ঠিক এমনই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে দেশ জুড়ে। প্রতিরোধের যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। মাতৃভূমির এই চরম দুর্দিনে নিজের পক্ষ ও কর্তব্য স্থির করতে ক্যাপ্টেন কাদের এক মুহুর্তও দেরী করেননি। সাথের ছয় জন বাঙ্গালী সৈনিক নিয়ে রামগড় এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। অত্যন্ত অসম সে যুদ্ধ, সবাই তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু ক্যাপ্টেন কাদের সিদ্ধান্তে অটল। এই অদ্ভুত “পাগলামী”র পেছনে ক্যাপ্টেন কাদের এর যুক্তিটি তাহলে শুনুন।

তিনি বললেন – এক একটি পশ্চিমা সেনা যদি কয়েক শ করে বাঙ্গালী হত্যা করে তাহলে এক একটি শত্রু সেনা খতম করার অর্থ হচ্ছে পুরো যুদ্ধের সময়টায় কয়েক হাজার বাঙ্গালীর জীবন রক্ষা করা। [সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১৪ জানুয়ারী ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৮]

নাম না জানা ছয় জন সহযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন কাদের ঠিকই রামগড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করে তার পতন ঘটান। অসম সে যুদ্ধে নিজেরাও প্রাণ দিয়েছিলেন, কিন্তু বেঁচে থাকবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন আরও কয়েক হাজার মানুষকে। সেইসাথে রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন এই দেশটি স্বাধীন হবেই।

(দৈনিক বাংলা, ১৪ জানুয়ারী ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৮)

(দৈনিক বাংলা, ১৪ জানুয়ারী ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৮)

এবার একটু বর্তমানে ফিরি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ভিন্ন আরেক ধরণের যুদ্ধে জড়িয়ে আছে এই প্রজন্ম। এই যুদ্ধ সবসময় চোখে দেখা যায় না, কিন্তু আর সব যুদ্ধের মতো এখানেও জড়িয়ে আছে ত্যাগ, সংগ্রাম আর পরিশ্রম। আর আছে ক্যাপ্টেন কাদেরের মতো সহজ কিন্তু পাগলামী কিছু যুক্তি আর হিসাব।

যদি ভেবে থাকেন – ২২ জন যুদ্ধাপরাধীর তো রায় হয়ে গেছে, ৪ জনের তো ফাঁসী হয়ে গেছে, কয়েকজন তো বিচারাধীন অবস্থাতেই মরে গেছে – অতএব বিজয় অর্জিত হয়ে গেছে – তাহলে ভুল ভাবছেন। যুদ্ধটা এবার নতুন লেভেলে উন্নীত হয়েছে মাত্র। প্রতিটি যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধেও সহযোদ্ধাদের উপস্থিতি দরকার। আপনি আমি সবাই জানি – আমাদের এই সহযোদ্ধারা কেউ বেতনভূক একটিভিস্ট বা কর্মচারী/কর্মকর্তা না, সবাই স্বেচ্ছাসেবক মাত্র। শুধু প্রাণের তাগিদে তারা এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। কিন্তু সে পথও কম পিচ্ছিল, এ দাবীও নিশ্চয়ই করবো না আমরা। সেখানেও অন্তর্ঘাত আছে, অন্তঃকোন্দল আছে, ব্যক্তির ভালো-লাগা মন্দ লাগা আছে, নিজ নিজ জীবনের পরিবারের ক্যারিয়ারের দাবী আছে। থাকবেই, থাকতেই হবে, কারণ সেটাই জীবন।

এবার বর্তমানের কিছু সহজ হিসাব কষি চলুন।

১৯৭১ সালে এক অদ্ভুত ‘প্রয়োজনীয়তার গণিত’ ক্যাপ্টেন কাদেরের মতো মানুষরা আমাদের শিখিয়েছিলেন। তাই তো দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। সুতরাং, সহযোদ্ধাদের কাজগুলো থেকে, স্বেচ্ছাসেবক প্রকল্পগুলো থেকে যে কারণেই আপনি দূরে থাকতে ‘বাধ্য হন’ না কেন – আপনার দশটা মিনিট কম সময় দেয়া মানে আপনারই সহযোদ্ধা অন্য কারও দশটা মিনিট বেশী দিতে বাধ্য হওয়া। আপনার সেই সহযোদ্ধার জীবন, পরিবার, কিংবা ক্যারিয়ারের দাবীগুলোও কিন্তু আপনার চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অথচ আপনার অনুপস্থিতিতে এখন আপনার সেই সহযোদ্ধাকেই সেই অতিরিক্ত সময়টা নিজে খেটে পুষিয়ে দিতে হবে। এবং সেটা তিনি হয়তো পোষাবেনও, খুব কষ্টে সৃষ্টে। পোষাবেন শুধু নিজের জীবন থেকে সময় দিয়েই না, পোষাবেন এই সংগ্রামের আরও অন্য কোনও জরুরী কাজ থেকে সময়টুকু এনে। অথচ সহযোদ্ধার পাশে দাঁড়ানোর, কিংবা এই সংগ্রামের একজন হওয়ার দায়িত্ব আর প্রতিজ্ঞা দু’টোই কিন্তু আসলে আপনারও ছিল। আপনিই তো তাই বলেছিলেন এক সময়, বলেননি?

এখানেই শেষ না। আমাদের এই প্রতিরোধ যুদ্ধে আপনার দশটা মিনিট কম দেয়ার অর্থ – শত্রু পক্ষের দশটা মিনিটের কাজ বাঁচিয়ে দেয়াও। কারণ আপনি যে প্রতিরোধটুকু সৃষ্টি করতে পারতেন – তা আর তাদের মোকাবিলা করতে হবে না এখন। আর সেই সময়টুকু আর শক্তিটুকু শত্রুপক্ষ এখন বিনিয়োগ করতে পারবে আপনারই সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, তাদের সামষ্টিক কাজের বিরুদ্ধে।

এই সহজ হিসাবটুকু মনে রাখার অনুরোধ থাকলো। ক্যাপ্টেন কাদেররা আজ নেই। সময়ের প্রয়োজনে তাঁরা যে অদ্ভুত নিষ্ঠুর গণিতকে রক্ত দিয়ে চিনেছিলেন – সেই প্রয়োজন কিন্তু এখনো ফুরায়নি।

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

১ comment

  1. নীড় সন্ধানী - ২৬ জানুয়ারি ২০১৬ (১২:৪৪ অপরাহ্ণ)

    ক্যাপ্টেন কাদের ও তাঁর মতো মানুষদের কথা পড়ে বিস্ময়ের শেষ হয় না। বুঝতে পারি আমাদের রক্ত ও তাঁদের রক্ত একই উপাদানে তৈরী না।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.