যৌনকর্মীর কর্ম অথবা কে তোরে পতিতা বলে মা! (প্রথম পর্ব)

The upper part of the stele of Hammurabi’s code of laws

The upper part of the stele of Hammurabi’s code of laws

ধারণা করা হয়, নারীজাতি একসময় স্বাধীন ছিল। নারী-পুরুষ উভয়ে তখন জীবিকার জন্য মিলিতভাবে খাদ্যদ্রব্যের সন্ধান করত এবং যথেচ্ছ ভোগ করত। ভোগে-ত্যাগে উভয়ের অধিকারই তখন ছিল সমান। ক্রমে উৎপাদনের উপায়সমূহ ব্যক্তি মালিকানায় (অবশ্যই পুরুষদের হাতে) চলে যাবার মাধ্যমে সামাজিক শ্রম বিভাজন শুরু হয় এবং তখন থেকেই উৎপাদিত দ্রব্য পণ্য বলে বিবেচিত হতে থাকে। আজ অবধি উৎপাদিত দ্রব্য পণ্য বা কমোডিটি বলেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পণ্যদ্রব্য কেবল ‘প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক প্রয়োজন মেটানো’ হলেও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটা মুনাফার দিকে হেলে পড়া। এ অর্থব্যবস্থায় শ্রমশক্তির উৎপাদনই কেবল পণ্যদ্রব্য পদবাচ্য নয়, এমনকি শ্রমশক্তিও সেখানে পণ্যদ্রব্য। এই সংজ্ঞাভাষ্যের সীমাকেও অতিক্রম করে নারী যখন বাধ্য হয়ে বা স্বেচ্ছায় ভোগ্যা হিসেবে নিজের মহিমা থেকে অবনত, তখন গোটা নারীমানুষটিই পরিণত হয় পণ্যে। এখানে সে শ্রম দিয়েও প্রচলিত অর্থে শ্রমশক্তি হিসেবে স্বীকৃত হয় না, হয় ভোগ্যবস্তুরূপে। ((‘নারীপণ্য’: মুজিব মেহদী, জেন্ডারকোষ (১ম খণ্ড), সেলিনা হোসেন ও মাসুদুজ্জামান সম্পাদিত, মাওলা ব্রাদার্স ২০০৬)) এই প্রবন্ধে নারীর এরকম ভোগ্যপণ্য হয়ে ওঠার ইতিহাস এবং ভোগবাণিজ্যের বর্তমান গতি-প্রকৃতি অনুসন্ধানেরই চেষ্টা করা হবে।

আমরা জানি, ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার এক নবতর সৃষ্টি হলো বিশ্বায়ন ধারণা। কাভালজিৎ সিংয়ের মতে, বিশ্বায়ন এমন এক বিশ্বের ধারণাকে তুলে ধরে যেখানে জটিল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াগুলির ক্রিয়াশীলতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত বা জাতীয় সীমারেখার কোনো ভূমিকা থাকবে না। ((বিশ্বায়ন : অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন, কাভালজিৎ সিং (মনোয়ার মোস্তফা অনূদিত), বিএনপিএস ও ইউপিএল, ২০০৫)) বিশ্বায়নের আওতা এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যবস্থার প্রধান মনোযোগের কেন্দ্র অর্থনীতি অর্থাৎ মুনাফা। আর তাই এই ব্যবস্থা সবকিছুকেই পণ্যীকরণের দিকে নিয়ে যেতে চায়– বস্তুকে তো বটেই, এমনকি মানুষকেও। বস্তুর নিজের ভালোমন্দ কোনো কিছুই ভাববার-বলবার নেই, কিন্তু মানুষের আছে। মানুষ নিজে পণ্য হবার ব্যাপারে আপত্তি জানাতে পারে এবং পণ্যসংস্কৃতি বা পণ্যীকরণ প্রথাকে প্রতিরোধের লক্ষ্যে আন্দোলনও করতে পারে– কিন্তু কোনো-না-কোনোভাবে পণ্য ব্যবহার ব্যতিরেকে টিকে থাকতে পারে না। মানুষই পণ্যীকরণ প্রথা চালু করেছে ও টিকিয়ে রেখেছে। মানুষই পণ্য সরবরাহকারী এবং মানুষই এর ভোক্তা, যদিও সকল পণ্য সকল মানুষের প্রয়োজনে লাগে না, সকল পণ্যের প্রতি সকলে আকর্ষণ বোধ করে না এবং সকল পণ্যের সুবিধা ভোগে সকলে সক্ষমও হয় না।

আমরা দেখতে পাই, এই পণ্যদুনিয়ায় পণ্য হবার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে বিপ্লব-বিদ্রোহ যেমন জারি করা আছে, তেমনি তার চতুর্গুণ শক্তিতে মানুষ, বিশেষ করে নারীমানুষকে পণ্য করবার নেটওয়ার্কসমূহের জোয়ার সুনামির মতো প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। আর এই সুনামির মূল প্রতিপাদ্য যৌনবাণিজ্য ও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফা। এর তীব্রতা এতই প্রবল যে সেটি গোটা সভ্যতাটিকেই যেন আজ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত।

২.

অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পবিত্র পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হিরোডেটাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪-খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র পতিতাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হতো এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসেবে একজন বিদেশীর সাথে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হতো। একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হতো সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতেও সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও। ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল, যদিও কয়েকজন প্রফেট, যেমন ইজাকেইল, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে পতিতারা ছিল স্বাধীন এবং তারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করা ও কর দেবার ব্যাপারে আদিষ্ট ছিল। গ্রিক হেটায়েরার মতো জাপানে ছিল জেইসার।

পাশ্চাত্য সভ্যতার জতুগৃহ প্রাচীন গ্রিকের এথেনাইয়ের কবি সোলোন (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩০-খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯০), যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসেবে গণ্য হতেন, খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম পতিতালয় স্থাপন করেন। এই পতিতালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে ব্যাপকভাবে পতিতাবৃত্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং পৌরসভার মাধ্যমে পতিতালয়সমূহ পরিচালিত হতে থাকে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর জীবৎকাল নিয়ে পণ্ডিতে-পণ্ডিতে মতদ্বৈধতা আছে। তবে অনেকের মতে কৌটিল্য বেঁচেছিলেন মৌর্য শাসনামলে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, তিনি প্রথম মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কাউন্সেলর ও উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত অর্থশাস্ত্রের মতে, দেহব্যবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপন নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এর অনুমোদন করে এবং সংগঠকের ভূমিকা নেয়। ঋগ্বেদ এবং জাতকেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পণ্ডিতরা। এমনকি কৌটিল্যের সময় দেহব্যবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এ শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। ((কৌটিল্য : প্রেম ও নৈতিকতা, ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, ২০০০))

কৌটিল্য জানান যে, তখন দেহব্যবসা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রীক। নগরজীবনের অবশ্যঅঙ্গ ছিল এটি। রাজকোষের আয়ের যে বিভিন্ন উৎস ছিল তার মধ্যে ‘দুর্গ’ নামক বিভাগটিতে বেশ্যা, জুয়াখেলা ও আবগারী বিভাগের পরিদর্শকের কথা বলেছেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রে এমনকি গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে। তাঁর কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করা। পৃথিবীর অনেক দেশ, যাদের প্রধান আয় পর্যটন শিল্প নির্ভর, সেসব দেশে এখনো সরকারি তত্ত্বাবধানেই দেহব্যবসা পরিচালিত হয়। এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রও এখনো এ প্রথাকে অনুমোদন করে যাচ্ছে পতিতাবৃত্তিতে আগ্রহী যেকোনো আঠারো বছর বয়সোত্তীর্ণ নারীকে দেহব্যবসা চালাবার জন্য লাইসেন্স দিয়ে, সারাদেশে ১৪টি পতিতালয় পরিচালনা করে এবং সেখান থেকে ট্যাক্স গ্রহণ করে। ((প্রাগুক্ত))

৩.

প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস প্রথম মৌর্যশাসক চন্দ্রগুপ্তের সময়ে ভারতে এসেছিলেন। তিনি তাঁর রচিত গ্রন্থে এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যারা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের ওপর গণিকাদের সহায়তায় নজর রাখতেন এবং রাজার কাছে গোপন রিপোর্ট দিতেন। স্টার্নবাকের মতে, গণিকা মানে সরকারি কর্মচারী। অন্য যেকোনো সরকারি কর্মীর মতোই এরা। কৌটিল্য এই অর্থেই ব্যবহার করেছেন শব্দটি। ((প্রাগুক্ত)) অর্থশাস্ত্রে গণিকারা ছাড়াও সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যারা দেহব্যবসা করতেন তাদের একটি তালিকা দেয়া আছে– যথা পুংশালী অর্থাৎ সাধারণ দেহব্যবসায়ী, সুরাসুন্দরী অর্থাৎ পানশালার ওয়েটার, বন্ধকী অর্থাৎ ঘটনাচক্রে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়া গৃহবধূ, বেশ্যা অর্থাৎ কারুকুশীলব বা গুপ্তচর, সাধ্বি-ব্যঞ্জনা অর্থাৎ সতীত্বের ভান করে থাকা পুলিশের গুপ্তচর, দেবদাসী অর্থাৎ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র বারাঙ্গনা, পরিব্রাজিকা অর্থাৎ আড়কাঠি বা দালাল। এঁদের সামাজিক মর্যাদা ছিল রাজঅনুগ্রহপুষ্ট গণিকাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। যুদ্ধক্ষেত্রে, শিকারে এবং আরো অনেক সময় রাজার সঙ্গে গণিকাদের থাকবার কথা লিখেছেন গ্রিক লেখকরা। মহাভারতেও গণিকাদের বর্ণময় জীবন ও রাজকীয় জাকজমকের বর্ণনা আছে। যেমন উদ্যোগপর্বে কৌরবপক্ষের বেশ্যাদের কাছে যুধিষ্ঠির শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণ যখন শান্তির জন্যে দৌত্য করতে আসেন তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানান গণিকারা। রামায়ণে দেখা যায়, রাম ভরতকে জিজ্ঞাসা করছেন যে তিনি গণিকা, ঘোড়া ও হাতির ব্যাপারে সন্তুষ্ট কি না। জৈন লেখক হেমচন্দ্রের লেখায় একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ আছে যে, রাজা নন্দ গণিকার গর্ভজাত এক নাপিতের সন্তান। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে বিখ্যাত গণিকা অম্বাপালী, সালাবতী, সামা, সুলমা ছাড়াও এমন অনেকের কথা বলা আছে, যারা বুদ্ধি ও শিল্পীত দক্ষতার গুণে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ তৎকালীন গণিকা নারীরা সমাজে-রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান পেতেন এবং সাধারণ সভ্যসমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়া রাজরাজড়ারাও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। তাদেরকে যখন তখন যে কেউ ভোগার্থে ব্যবহার করতে পারত না কিংবা মন্দ কথা বলতে পারত না। এমনকি গণিকাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিরও অধিকার ছিল। রাজকোষ থেকে বেতন ছাড়াও তাঁরা অলংকার, পোশাক-আশাক, অন্যান্য উপঢৌকন, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি লাভ করতেন। কোনো গণিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে বা তাঁর অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে বলপূর্বক দেহমিলনের চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ আর্থিক সাজা হতো।

৪.

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেশ্যাবৃত্তি হলো স্বামী বা বন্ধুকে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে নগদ অর্থ বা মূল্যবান অন্যকিছুর বিনিময়ে বাছবিচারহীনভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই বেশ্যাবৃত্তি এখন আর শিল্পের পর্যায়ে নেই। তবে নারীর রূপ, যৌবন ও শরীরের বাণিজ্যিক ব্যবহার, যেমন পর্নো ওয়েবসাইট তৈরি, পর্নো সিডি তৈরি, ফ্যাশন শো, অশ্লীল চলচ্চিত্র নির্মাণ, পর্নো ম্যাগাজিন প্রকাশ, বিজ্ঞাপনচিত্রে উদ্ভট ও অশ্লীল কায়দায় নারীমডেল ব্যবহার ইত্যাদি মাধ্যমেও নারীত্ব প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছে, যদিও এগুলো শিল্প নামধেয়। সরাসরি দেহব্যবসা দিয়ে তো বটেই, এমনকি এসব শিল্পমাধ্যমে নারীকে অশ্লীল কায়দায় ব্যবহার করেও বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা করা হচ্ছে। কৌটিল্যের সময় থেকে আমরা প্রায় আড়াই হাজার বছর অতিক্রম করে এসেছি। দাবি করি যে আমরা সভ্যতার চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছি। আর তার নমুনা হলো এই যে, এখন বলপূর্বক গণিকাসঙ্গ করলে কারো কোনো শাস্তি হয় না। আর এ কারণেই সাধারণ-সতীসাধ্বী কোনো অসহায় নারী ধর্ষিত হলেও আদালতে তাঁকে দুষ্টচরিত্রের নারী অর্থাৎ পতিতা প্রমাণ করবার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবী যদি এটি প্রমাণ করতে পারেন, তবে আসামির কোনো শাস্তি হয় না অথবা শাস্তি হলেও তা হয় নামমাত্র। গণিকাধর্ষণ সভ্য সমাজের আদালতে বড়ো কোনো অপরাধ হিসেবেই গণ্য হয় না। বরং উলটো ঘটনা আমরা আমাদের গ্রামসমাজে হামেশাই ঘটতে দেখি যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীকেই প্রধান অপরাধী হিসেবে বিচার করা হয়। বলা হয়, ধর্ষিতা ধর্ষককে প্রলুব্ধ করেছেন। তাই তাঁকে ১০১ দোররা মারা হয়, মাথা মুড়িয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয় কিংবা মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হয়। যারা এসব ফতোয়ায় কাজির দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা অবশ্যই হন পুরুষ, এবং তাঁরা সেরকম পুরুষ, খোঁজ নিলে যাঁদের বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসঙ্গের একাধিক ঘটনার প্রমাণ মিলবে। এমনকি ইতঃপূর্বে যাঁরা হয়ত দুয়েকটা ধর্ষণ ঘটনারও নায়ক ছিলেন। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় সে খোঁজ নেবার অবস্থা সত্যিকারার্থেই এখনো তৈরি হয় নি। কারণ সমাজ সেটার কোনো প্রয়োজনই বোধ করে না। যেহেতু আমাদের সমাজে পুরুষের একাধিক নারীসঙ্গ করাকে কোনো দোষের ব্যাপার বলেই মনে করা হয় না।

এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বাইবেলের একটি গল্প তুলে ধরা যায়– ‘যীশু জৈতুন পর্বতে গেলেন। আর প্রত্যুষে তিনি পুনর্বার ধর্মধামে আসিলেন ; এবং সমুদয় লোক তাঁহার নিকটে আসিল ; আর তিনি বসিয়া তাহাদিগকে উপদেশ দিতে লাগিলেন। তখন অধ্যাপক ও ফরীশীগণ ব্যভিচারে ধৃত একজন স্ত্রীলোককে তাঁহার নিকটে আনিল, ও মধ্যস্থানে দাঁড় করাইয়া তাঁহাকে কহিল, হে গুরু, এই স্ত্রীলোকটি ব্যভিচারে, সেই ক্রিয়াতেই ধরা পড়িয়াছে। ব্যবস্থায় মোশি এই প্রকার লোককে পাথর মারিবার আজ্ঞা আমাদিগকে দিয়াছেন ; তবে আপনি কী বলেন ? তাহারা তাঁহার পরীক্ষাভাবেই এই কথা কহিল, যেন তাঁহার নামে দোষারোপ করিবার সূত্র পাইতে পারে। কিন্তু যীশু হেঁট হইয়া অঙ্গুলি দ্বারা ভূমিতে লিখিতে লাগিলেন। পরে তাহারা যখন পুনঃ পুনঃ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল তিনি মাথা তুলিয়া তাহাদিগকে কহিলেন, তোমাদের মধ্যে যে নিষ্পাপ, সেই প্রথমে ইহাকে পাথর মারুক। পরে তিনি পুনর্বার হেঁট হইয়া অঙ্গুলি দিয়া ভূমিতে লিখিতে লাগিলেন। তখন তাহারা ইহা শুনিয়া, এবং আপন আপন সংবেদ দ্বারা দোষীকৃত হইয়া, একে একে বাহিরে গেল, প্রাচীন লোক অবধি আরম্ভ করিয়া শেষ জন পর্যন্ত গেল, তাহাতে কেবল যীশু অবশিষ্ট থাকিলেন, আর সেই স্ত্রীলোকটি মধ্যস্থানে দাঁড়াইয়াছিল। তখন যীশু মাথা তুলিয়া, স্ত্রীলোক ছাড়া আর কাহাকেই দেখিতে না পাইয়া, তাহাকে কহিলেন, হে নারী, যাহারা তোমার নামে অভিযোগ করিয়াছিল, তাহারা কোথায় ? কেহ কি তোমাকে দোষী করে নাই ? সে কহিল, না, প্রভু, কেহ করে নাই। তখন যীশু তাহাকে বলিলেন, আমিও তোমাকে দোষী করি না ; যাও এখন অবধি আর পাপ করিও না।’ ((বাংলা ইলেক্ট্রনিক বাইবেল, যোহন, ৮ম অধ্যায়, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ২০০৫)) এই গল্পের মর্মার্থ ব্যাখ্যা করবার দরকার নেই। বাইবেলের যুগের অধ্যাপক ও ফরিশীগণের মতো আমাদের ফতোয়াবাজরাও নিষ্পাপ নন। তাঁদের থেকে এখনকার ফতোয়াবাজদের সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকু এই যে, তাঁরা আপন সংবেদ দ্বারা তাড়িত হলেও এঁরা তা হন না।

(চলবে)

মুজিব মেহদী

ভাবি অনেক কিছু, লিখি কম, বলি আরও কম।

১ comment

  1. শাহীন - ২৩ মার্চ ২০০৯ (১১:৪৮ অপরাহ্ণ)

    আপনার লেখায় “ইস্রায়েল” নাম নিয়ে আমার একটু সংশয়। প্রাচীনকালে জায়গাটাকে (যা বর্তমান প্যাল্যাস্তাইনের সাথে আনেকখানি overlap করে) মনে হয় জুডায়(Judae) নগর বলা হোত।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.