খাঁচার পাখির নাম

পরাধীনতার প্রতি স্কটিশদের অনুরাগ দেখে মনে এল বুদ্ধদেব বসুর ‘অনাম্নী অঙ্গনা’র কথা; রানি অম্বিকার পরিচারিকা অঙ্গনাও চেয়েছিল এক বিহ্বল অথচ আত্মস্থ পরাধীনতার সুখ। [...]

পরাধীনতার প্রতি স্কটিশদের অনুরাগ দেখে মনে এল বুদ্ধদেব বসুর ‘অনাম্নী অঙ্গনা’র কথা; রানি অম্বিকার পরিচারিকা অঙ্গনাও চেয়েছিল এক বিহ্বল অথচ আত্মস্থ পরাধীনতার সুখ। ঋষি ব্যাসদেবের সঙ্গে নাটকীয় রাত্রিযাপনের পর তার জীবনে বা মননে আসে পর্বান্তর, যদিও শুরুতে সে মুক্তিই কামনা করেছিল :

আমি চাই আমার আপন ঘর, আপন কাজ, আমার নিজের

তেঁতুলতলার ছায়া।

―কিন্তু আমরা উত্তম দাসী, তাই অর্ধেকমাত্র নারী।

তার সখি বলছে :

যাঁরা বলেন দাসত্বের মতো দুঃখ নেই, তাঁরা সত্যবাদী।

Onamni Ongona
অকালপ্রয়াত রাজা বিচিত্রবীর্যের পত্নী অম্বিকা; ইতিপূর্বে ব্যাসদেবেরই ঔরসে তাঁর গর্ভে এসেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র, কিন্তু তিনি জন্মান্ধ―রাজপুত্র বিকলাঙ্গ হলে অধিকার থাকে না সিংহাসনে। তাই শাশুড়ি সত্যবতী পুনরায় আহ্বান করেছেন ব্যাসদেবকে আর প্ররোচিত করতে চাইছেন পুত্রবধূকে। বিধবা অম্বিকার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে নারীসত্তার অপমানে যত নয়, তার চেয়ে বেশি ‘সেই রুক্ষ জটাজুট―দুর্গন্ধ―রক্তিম, ঘূর্ণিত লোচন’ তপস্বীর শয্যাশায়িনী হওয়ার আশঙ্কায়; তিনি চান অন্তত একজন কন্দর্পকান্তি ‘পরিশীলিত পুরুষ’। সত্যবতীকে তখন খুলে বলতে হয় প্রথম যৌবনের বৃত্তান্ত : ছিলেন তিনি ধীবরকন্যা, শূদ্রাণী; একদিন যমুনা নদীতে ঋষি পরাশরকে নৌকোয় পার করিয়ে দিতে গিয়েই বদলে গেল তাঁর জীবনের চরাচর। মুনি কামমোহিত হয়ে প্রার্থনা করলেন মৎস্যগন্ধার তনুশ্রী। মুনির বরে সত্যবতী পেলেন পুত্র ব্যাসদেবকে যিনি বিদ্যায় জগৎশ্রেষ্ঠ।

শাশুড়ির প্রণোদনায় অম্বিকা সম্মত হলেও আশ্রয় নিলেন ছলনার। দাসী অঙ্গনা শুধু সুশ্রীই নয়, বিনীতা ও সুভাষিণী; তাকেই প্রস্তাব দিলেন একরাত্রির রাজেন্দ্রাণী হওয়ার জন্য, তাঁরই ছদ্মবেশে। বিনিময়ে অঙ্গনা পাবে প্রার্থিত স্বাধীনতা আর সেই তন্তুজীবী যুবাকে যে তার জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু দাসী হলেও অঙ্গনা লোভী নয়, বরং ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে বলেই সে ফিরিয়ে দেয় প্রতারণার প্রস্তাব, সবিনয়ে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়ে না সে। রানির মুখে নিজের ব্যাজস্তুতি শুনেও তাই সে বলতে পারে, ‘আমার বিষয়ে আপনার উচ্চ ধারণায় আমি কৃতার্থ!’ অম্বিকা তখন বলেন ‘শান্ত, ঈষৎ বিষণ্ন স্বরে’ :

কোনো নিন্দার অর্থে কথাটা আমি বলিনি;
বরং আমি নিজেই লজ্জিত
আমার ভীরুতা আমার ধর্মাচরণের অন্তরায় হচ্ছে ব’লে।
আর হয়তো এই ধারণাও ভুল
যে শূদ্রজন্ম অধম। মহৎ কর্মে পাত্রভেদ নেই,
যে-কোনো ইন্ধনে অগ্নিশিখা সমান উজ্জ্বল।

সত্যবতী যেভাবে সম্মতি আদায় করেন অনিচ্ছুক অম্বিকার, তেমনি অম্বিকাও উদ্দীপিত করে তোলেন কুমারী অঙ্গনার মন। ব্যাসদেবের সঙ্গে অঙ্গনার মিলনের পর, সকালবেলায়, অম্বিকা বেশ আগ্রহ নিয়েই জানতে চান খুঁটিনাটি। ‘ঋষিগাত্রে উৎকট দুর্গন্ধ’ যতই বলুন অম্বিকা, শূদ্রাণীর স্পর্শে ঋষি তুষ্ট হলে যেন সূক্ষ্ম কোনও বেদনা এসে বিঁধে যায় অম্বিকার বুকে। অঙ্গনার সম্মোহিত কণ্ঠে তখন লেগেছে অন্য সুর :

দেবী, তাঁর গন্ধে আমি বিবশ হয়েছিলাম―
এক মিশ্রিত গন্ধ―
যেন তৃণময় প্রান্তর থেকে উত্থিত,
মুঞ্জা, ইষিকা, বন্য পশুর, অরণ্যের,
কোনো দূর সমুদ্রের লবণাক্ত গন্ধ যেন,
সেই মাটির ঘ্রাণ, যা এইমাত্র হলকর্ষণে দীর্ণ হ’লো।

এবার অম্বিকার বিস্ময়ের পালা। কেবল বিস্মিত নন, অম্বিকা তখন রীতিমতো ঈর্ষাতুর। সম্রাজ্ঞীর প্রসাধন পেয়েই কি অঙ্গনার এই মতিভ্রম? না কি কোনও কূটবুদ্ধি খেলছে তার মনে? স্বপ্নাবিষ্ট অঙ্গনা আর ফিরে যেতে চায় না তার আপন ভুবনে, চায় না মুক্তির স্বাদ। ঋষি তাকে বর দিয়েছেন : তার পুত্র হবে ধীমান, প্রাজ্ঞ, মৃদুভাষী। নাম তার বিদুর, ‘কেননা বিদ্যা হবে তার স্বভাবসিদ্ধ’। ব্যাসদেব আরও বলেছেন :

ঘোর যুদ্ধ আসন্ন : তিনি নিজে থাকবেন দূরে,
আর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র―ঘটনাস্থলে উপস্থিত―
তবু থাকবে শান্ত, শান্তির সাধক, নির্লিপ্ত,
যেন সিন্ধুবিহারী হংস, তরঙ্গ যাকে সিক্ত করে না।

দাসীবৃত্তি মেনে নিয়েও তাই অঙ্গনা থেকে যেতে চায় হস্তিনাপুরের রাজেন্দ্রাণীর কাছেই, স্বচক্ষে দেখতে চায় তার গৌরবের জয়ধ্বজা :

না, দেবী, পুত্রের জন্য নয়―
আমার নিজেরই জন্য। আমি দেখতে চাই দূরযাত্রীকে তীরে

দাঁড়িয়ে,

দেখতে চাই আকাশে আমার জয়ধ্বজা―
একমাত্র ধবলতার সংকেত―
ঘোর যুদ্ধে পৃথিবী যখন রক্তাক্ত।
সে :
নম্র, মুদুভাষী, ধীর―

(তার মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত)

পিতার মতো বিদ্বান, মাতার মতো নেপথ্যচারী,
মাতার মতো দীনতায় ধন্য, পিতার মতো উদাসীন,
ক্ষত্রিয় নয়, ব্রাহ্মণ অথবা শূদ্র নয়,
নয় শত্রু বা মিত্র, সংসারী বা সন্ন্যাসী :
এক অখণ্ড স্থির ভাবনায় মগ্ন,
ভুক্তভোগী, তবু সুদূর―
আমার স্মরণচিহ্ন, আমার প্রমাণ, আমার অভিজ্ঞান।
তাই, দেবী,
আমার পক্ষে দাসীত্ব আজ বরণীয় গুণ্ঠন,
নামহীন অস্তিত্ব এক দুর্গধাম,
যার অন্তরালে আমার বীজময় রাত্রি―
বিনা বিক্ষেপে, বিনা অপব্যয়ে―
ফ’লে উঠতে পারে গুচ্ছ-গুচ্ছ সোনালি ধানের মতো,
আমারই মধ্যে উৎপন্ন, কিন্তু ভোক্তা যার ভবিষ্যৎ।
―দয়াময়ী, আমাকে আশ্রয় দিন।

এই হলো অঙ্গনা, অম্বিকার কথায়, ‘অদ্ভুত মেয়ে’ যে ‘নিজের মুক্তি নিজেরই মধ্যে রচনা ক’রে’ নিয়েছে। আর বিদুর যেন হয়ে ওঠে সেই মননদীপ্র মুক্তিরই প্রতীক, অন্তরালব্যাপ্ত অথচ সুদূর।

‘অনাম্নী অঙ্গনা’ ও ‘প্রথম পার্থ’―বুদ্ধদেব বসুর এই দুই কাব্যনাট্য একমলাটে প্রকাশ করেছে দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯১ সালে। প্রথম প্রকাশ ১৯৭০-এর নভেম্বরে, যার ছোট্ট ভূমিকায় বুদ্ধদেব লিখেছেন :

বহু যত্ন নিয়ে বহুবার প্রুফ দেখা সত্ত্বেও বইটিতে একটি মুদ্রণবিভ্রাট ঘ’টে গেছে; সেটি নিচে উল্লিখিত হ’লো। পাঠককে অনুরোধ, তিনি যেন এই ভুল সংশোধন ক’রে নেন।

৫৮ পৃষ্ঠায় ‘ঋষির কিছুটা ভক্ত হয়ে পড়েছিল―তা-ই কি?’―এই উক্তির ‘পড়েছিল’ হবে ‘পড়েছিস’। তবে একটি নয়, চোখে পড়ে আরও কিছু বানানচ্যুতি : ‘ধীরবকন্যা’ (‘ধীবরকন্যা’, পৃ. ৪৯), ‘ঘাণ’ (‘ঘ্রাণ’, পৃ. ৫৭), ‘যমন’ (‘যেমন’, পৃ. ৫৭) ইত্যাদি, এমনকী অঙ্গনার একটি গানও বসে গেছে অম্বিকার গলায় (পৃ. ৫৩)। এই মুদ্রণবিভ্রাট কি দে’জ-কৃত? প্রথম প্রকাশের (১৯৭০) বই হাতে না থাকায় নিশ্চিত হতে পারছি না। বানানের ব্যাপারে যে-বুদ্ধদেবের মনোযোগ ও যত্ন প্রবাদপ্রতিম, তাঁর মৃত্যুপরবর্তী কোনও সংস্করণে এরকম মুদ্রণস্খলন পীড়াদায়ক নিশ্চয়ই।

মুয়িন পারভেজ

জন্ম চট্টগ্রামে। লিখে সময় কাটি, পড়ে জোড়া লাগিয়ে দিই আবার। ভালোবাসি মেঘবৃষ্টিজ্যোৎস্না আর ঝরনাকলম। প্রকাশিত কাব্য : ‘মর্গে ও নিসর্গে’ (ঐতিহ্য, ২০১১)।

১ comment

  1. আরাফাত রহমান - ১১ অক্টোবর ২০১৪ (৯:০১ অপরাহ্ণ)

    ভাল লাগল ধন্যবাদ

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.