বাংলাদেশের ইতিহাস কৃষক নিপীড়নের ইতিহাস (দুই)

(আগের পর্বের পর)

ইন্ট্রো-৫. পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্যমুক্ত বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই ঘোষণা দিলেন দেশ পুনর্গঠনের। জাতীয় চার মূল স্তম্ভের অন্যতম ঘোষণা হলো সমাজতন্ত্র। বাংলার কৃষকের কাছে সমাজতন্ত্র মোটেই কোনো পরিচিত বিষয় ছিল না। বাম রাজনীতির গোপনীয়তাবাদের কারণে ওই রাজনীতির খোলামেলা আলোচনা হলো না। ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকগুলো অস্পষ্ট হয়ে রইলো। বাংলার কৃষক যে যেমন পারে বুঝে নিলো। জমিদার, জোতদারের অবশেষ সামন্তপ্রভু যারা হিন্দু সামন্তদের জমি দখল করে রাতারাতি মুসলমান সামন্ত হয়ে উঠলো তারা প্রচার করতে লাগলো সমাজতন্ত্র মানে তোমার জমি জিরেত থাকবে না। সব রাষ্ট্র নিয়ে নেবে। তার বদলে রাষ্ট্র তোমায় দুমুঠো খাবার দেবে! এই জনপদের আদি এবং অকৃত্রিম প্রবণতা হলো জমির মালিকানা স্বত্ব। এক বিঘে জমি যার সেও নিজেকে গর্বিত জমির মালিক মনে করে। ভূপৃষ্ঠের খুব সামান্য অংশ হলেও তার মালিক ভেবে গর্ববোধ করে। সেই জমি কেড়ে নেওয়া হবে? বাংলার কৃষক সমাজতন্ত্র ব্যাপারটাকে গোড়া থেকেই সন্দেহ করে আসছিল। তারপর যখন কেড়ে নেওয়ার বিষয় এলো তখন সে প্রকৃত অর্থেই সমাজতন্ত্রের বিরোধী হয়ে উঠলো।

তৎকালীন আওয়ামী লীগের বামধারা এবং অন্য বাম শক্তিগুলো কৃষকের সেই ভুল ভাঙাতে ব্যর্থ হলো পুরোপুরি। এই সময়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাফ, জনমনে খুব একটা প্রভাব ফেললো না। ‘বাংলার এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না’ এই ঘোষণাটাও কৃষকের মনে কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করলো না। বরং সকল বড়ো বড়ো কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত হয়ে যাওয়ায় ছোট কৃষকরা দলে দলে শিল্প শ্রমিক হতে লাগলো। নতুন স্বাধীন দেশে কৃষকের যে স্বপ্ন ছিল (আসলে কোনো স্বপ্নই ছিল না) সেটা বাস্তবায়নের জন্য দরকার ছিল মাঠে ঘাটে লাঙল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু রেডিও সিনেমা হলে লাগাতার আবাদের ঘোষণা শোনার পরও কৃষক কৃষিকাজে কোনো নতুন বৈপ্লবিক চেতনা কাজে লাগলো না। চাষার জমির স্বপ্ন তার আজীবনের স্বপ্ন। চাষা কলে কাজ করে বেতন পেয়ে সেই টাকা জমিয়ে জমি বন্ধক রাখে। পরে ক্রমান্বয়ে সেই জমি কিনে নেয়। ফলে সে আর সর্বহারা শিল্প শ্রমিক থাকতে পারে না। শ্রেণীগত বিশ্লেষণে সমাজতন্ত্রের প্রধান চালিকাশক্তি শিল্প শ্রমিক। কিন্তু যেহেতু বাংলার শিল্প শ্রমিকরাও কোনো না কোনোভাবে দুএক বিঘা জমির মালিক। সেহেতু তার মনে মালিকানার স্বপ্ন আরো ডালপালা মেলতে থাকে। এতে করে সে না থাকে জমির মালিক না হয় শিল্প শ্রমিক। পুরোপুরি সর্বহারা হতে না পারায় তার মধ্যে কৃষকের দোদুল্যমানতা কাজ করে। আবার বেশ কয়েক বিঘা জমির মালিক না হতে পারায় তার মধ্যে হতাশা ভর করে। আর শ্রেণীগত এই মারাত্মক দোদুল্যমানতার জন্য বাংলায় না হলো কৃষি বিপ্লব না হলো শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

২৫ বিঘা জমির খাজনা মাফ সুযোগটা গেলো তাদের ঘরে যাদের অঢেল জমি আছে, যার দুবিঘা তার কিছুই এসে গেলো না ওই ঘোষণায়। ওই ২৫ বিঘা খাজনা মাফ ছাড়া কৃষিতে আর কোনো রিফর্ম হলো না। এক সময় কলে-কারখানায় কাজের সুযোগও সীমিত হয়ে পড়লো। এক ফসলি দুফসলি জমিতে উৎপাদন করে চাষার চলা দুষ্কর হয়ে উঠলো। ক্রমে ক্রমে চাষা তার জমিজমা বিক্রি শুরু করলো। সে সময় বাংলায় ভূমিহীনের সংখ্যা অনুমান করা যায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ক্রমে ক্রমে সেই সংখ্যা বাড়তে লাগলো ১৯৭৩-৭৪ এর দিকে এসে জমিহীনের সংখ্যা বেড়ে ৪০/৪৫ শতাংশ হয়ে গেলো। ঘরে খাবার নেই। জমিতে ধান নেই। বড়ো কৃষক জমি পতিত রাখে, তবুও তিন ফসলি করার চেষ্টা করে না। কেননা তখনো ইরি নামক ধানের আবাদ শুরু হয়নি। চাষারা ছিন্নমূল হয়ে শহরে আশ্রয়ের জন্য ছুটলো। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির ছেলে, ইপিআর-পুলিশের ছেলে, সেনা সদস্যদের ছেলে, জোতদারের ছেলেদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকলেও লাঙল ফেলে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া চাষা, দিনমজুর মুক্তিযোদ্ধারা এস্টাবলিশমেন্টের গলি ঘুচট চিনতে পারলো না। তাদের ছেলেদের কোথাও সুযোগ নেই। তাদের চূড়ান্ত গতি হলো ঢাকার দিনমজুর। ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে এঁদো বস্তি গড়ে উঠলো। সেখানেই ঠাঁই হলো জমিজিরেতহীন ছিন্নমূল চাষার। হু হু করে এই সংখ্যা বাড়তে লাগলো।
এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। চাষা আর কৃষক এক নয়। যে কৃষক, সে চাষাও নয়, আবার মজুরও নয়। বাংলার কবি-সাহিত্যিক আর চিন্তাবিদরা গড়ে বলে বসেন, বাংলার সমাজস্থপতিরা হলেন কৃষক। কৃষিই বাংলার বর্তমান, কৃষিই বাংলার ভবিষ্যৎ। উদাহরণস্বরূপ তারা দেখান, বাংলাদেশের জজ-ব্যারিস্টার, পুলিশ-আমলা, সেনাসদস্য, কেরানি, বড়ো কর্তা, মন্ত্রী-মিনিস্টার সবাই কৃষকের সন্তান। ‘উর্দি খুলে নিলেই সকল সৈনিক কৃষকের সন্তান’ লেনিনের এই মহান উক্তি সাংঘাতিকভাবে প্রামাণ্য হয়ে উঠলো বাংলাদেশে। আর ইতিহাস নির্মাণের চিন্তাগত সবচেয়ে বড়ো ভুলটা হয়ে গেলো এখানেই। সে সময়ের ৪০ ভাগ ভূমিহীন বাদে বাকি ৬০ ভাগ জমির মালিকদের প্রায় অর্ধাংশ জমিজমা চাষ করতেন না। তারা শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি করতেন। ২৫ থেকে ৩০ ভাগ জমির মালিক তথা কৃষক গ্রামে থেকে চাষবাস করতেন। তাদের এবং শহুরে সাহেবদের (যাদের চূড়ান্ত বিচারে কৃষকের সন্তান বলা হয়) ছেলেরা চাকরি-বাকরি পেলেও ওই যে ৪০ ভাগ ভূমিহীন চাষা বা মজুর যাদের এক সময় জমি ছিল, বাড়ি ছিল, যারা ৭১-এ জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করে, ট্রেইন্ড না হওয়ায় যারা কাতারে কাতারে মরেছে, যারা ৭১ পরবর্তী সময়ে সবার আগে অস্ত্র জমা দিয়েছে তাদের এবং তাদের
সন্তানদের কোনো গতি হলো না। তাদের বাঁচার একমাত্র উপায় হয়ে উঠলো শহরে এসে দিনমজুরি করা, রিকশা চালানো, মাটিকাটা এবং যে কোনো ধরনের গতরখাটা কাজ করা। বাংলাদেশের সেই সময়কার প্রায় অর্ধেক মানুষ এই শ্রেণীর। জমির মালিকের কেবল জমি আর লাঙল-বীজ, বাকি পুরো ফসল ওই চাষার হাতে। শহরের পুরো গতরখাটা শ্রমিক ওই চাষার ছেলে। একাধারে গ্রাম এবং শহরে নতুন গতরখাটা শ্রেণী হিসেবে উন্মেষ হলো চাষার ছেলের।

‘কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে’; বাংলার ইতিহাস কৃষকের ইতিহাসের মতো মিথ্যা ধাপ্পা দিয়ে যাদের পুনর্বাসিত করা হলো, নতুন নগরের, নতুন শ্রেণীর গোড়াপত্তন করা হলো তাদের কোথাও চাষা নেই, আছে কৃষক। ক্ষুদেকৃষক,মাঝারি কৃষক, এবং বড়ো কৃষক। সেই তখনই এই যে বিশাল জনগোষ্ঠী (প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী) তাদের কথা সরকার ভাবলো না। পরিকল্পনাবিদরা ভাবলো না, কবি-সাহিত্যকরা ভাবলো না, বুদ্ধিজীবীরা ভাবলো না। জমির স্বপ্ন বুকে নিয়ে জমি বেচে জীবন হাতে করে সেই যে তারা শহরমুখী হয়েছিল, আজো সেই ছোটা চলছে অবিরাম। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কোনো এক ধাপ্পাবাজি চিন্তা অথবা অজ্ঞতাপ্রসূত অজ্ঞানতা দিয়ে আমাদের বাবুদের সমাজ নো বডি করে দিয়েছে। (চলবে)

মনজুরাউল

আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

৩ comments

  1. সৈকত আচার্য - ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (২:২৮ অপরাহ্ণ)

    দারুন একটা আলোচনা শুরু করেছেন আপনি। এই সময়ে এই ধরনের আলোচনা বেশ সময়োপযোগী। সামনের দিনে বড় বড় দলগুলো ক্ষমতায় যাবে। এদেশের ভুমি সংস্কার নিয়ে তাদের কি কমিমেন্টমেন্ট আছে, এদেশের ফসলি জমির আবাদ বাড়ানো এবং ফসলি জমি রক্ষা করা নিয়ে তাদের ভাবনা বা কর্মসূচি কি, কৃষক এখানে তার কৃষি উপকরন যথাসময়ে এবং স্বল্পমূল্যে কখন থেকে পাবে কিংবা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মজুরী পাওয়ার জন্য সরকারী কি ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনার অভাব তারা দেখেছেন অতীতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে এবং সেই দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে কি তারা শিখেছেন এবং শিখে থাকলে আমাদের সাধারন কৃষককুল এবং জনতাকে তারা কি আশ্বাস দিতে চান বা আদৌ তারা এ ব্যাপারে কিছু ভাবছেন কিনা এই সব প্রশ্নের উত্তরগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার আগে তাদের বলে যেতে হবে।

    আমি মনে করি, আমাদের এই কৃষি প্রধান দেশে, একটি শক্তিশালী কৃষিব্যবস্থা এবং একটি স্বনির্ভর কৃষি অর্থনীতি গড়ে তোলার মূল অন্তরায়গুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। বাঁধাগুলো কি তাও আলোচনায় আনতে হবে। যাদের এই বিষয়ে এক্সপার্টিজ আছে তাদের প্রতি আহবান থাকবে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে মতামত দেয়ার। তাহলে এই ব্লগে আমরা একটা কালেক্টিভ ধারনা গড়ে তুলতে পারব এমন একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে। পরে আরো আলোচনার ইচ্ছে রইল।

  2. মনজুরাউল - ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৯:৫৩ অপরাহ্ণ)

    “যাদের এই বিষয়ে এক্সপার্টিজ আছে তাদের প্রতি আহবান থাকবে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে মতামত দেয়ার। তাহলে এই ব্লগে আমরা একটা কালেক্টিভ ধারনা গড়ে তুলতে পারব এমন একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে। পরে আরো আলোচনার ইচ্ছে রইল।”

    আপনার এই আহ্বান আমি প্রথমেই রেখেছিলাম।বাকি দুই পর্ব পোস্ট করার পর আবারো আহ্বান রাখব। তার পর মোট চার পর্ব নিয়ে একটা সারসংকলন দাঁড় করাতে চাই।
    আপনার পরামর্শ এ্যাড বরে রাখলাম। পরে একসাথে দেখি কিছু দাঁড় করানো যায় কী না।
    ধন্যবাদ চমৎকার মন্তব্য করার জন্য।

  3. Pingback: বাংলাদেশের ইতিহাস কৃষক নিপীড়নের ইতিহাস (তিন) | মুক্তাঙ্গন : নির্মাণ ব্লগ

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.