একজন মন্ত্রী ছাড়া এই বৃত্ত অসম্পূর্ণই থাকে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বৃত্ত অসম্পূর্ণ এবং এই অসম্পূর্ণতা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কাঙ্ক্ষিত সচলতা দেয় না – নাগরিকদের নিয়ত আলোচনার গণ্ডী থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে অনতিক্রম্য দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখে – তাই জনগণ ও রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বৃত্তের পরিবর্তে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী হয়ে ওঠে সেনা, নৌ, বিমান ঘাঁটি আর সম্মিলিত সামরিক গোয়েন্দা ঘাঁটি।
কিন্তু এরকম কথার ভিত্তি কী? বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মন্ত্রীহীন কখন ছিল? বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়কে যদি চারটি পর্বে ভাগ করি – মুক্তিযুদ্ধকালীন পর্ব, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ও এর পরবর্তী বাকশাল সরকারের পর্ব, স্বৈরশাসকদের সরকারের পর্ব ও স্বৈরশাসন পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের পর্ব (যার ভেতরে কয়েকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ও একটি সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপর্ব আছে)। আমরা দেখি, স্বৈরশাসকদের সরকারের পর্বটি ছাড়া অন্য তিন পর্বেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশে ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদই ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ও বাকশাল সরকারের আমলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রী ও পরে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের হাতে থাকলেও একজন প্রতিমন্ত্রীও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। স্বৈরশাসকদের সরকারের পর্বে অবিকল্পভাবেই জিয়া ও এরশাদের হাতেই ছিল এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ১৯৯১-এর পরে দুবারের খালেদা সরকার ও একবারের হাসিনা সরকারের দুই প্রধানমন্ত্রীই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের হাতেই পূর্ণ মেয়াদে রেখে দিয়েছিলেন। ২০০৭-০৮এর সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টার হাতেই ছিল এবং ২০০৮এর নির্বাচনে নির্বাচিত হাসিনা সরকারও এখনো পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এককভাবে তার নিজের হাতেই রেখে দিয়েছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে ও জরুরী অবস্থায় সরকার প্রধানের হাতেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্বাভাবিকভাবে ন্যাস্ত থাকে – কারণ সেসময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী আসলে যুদ্ধমন্ত্রী ও জরুরী অবস্থার সর্বোচ্চ প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। তো আমরা দেখতে পাচ্ছি একমাত্র শেখ মুজিবের সময়ে একজন প্রতিমন্ত্রী ছাড়া আর কেউই আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আজো ঠাঁই নিতে পারেননি। এই ভিত্তিতেই আমি বলছি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মন্ত্রীহীন এবং তাই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বৃত্ত অসম্পূর্ণ।
একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় হল : অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা। এই চারটি মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি ও ধরন এমন যে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে এই চারটি মন্ত্রণালয়ের কোনো একটির দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা অসম্ভব। তাহলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীরা কী অসীম কর্মপরিধিকে অনায়াসে সামলাতে পারেন – নাকি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি তেমন বিস্তৃত নয় এবং এর কাজের ধরনেও কোনো বিশেষত্ব নেই – তাই হয়তো টানা কুড়ি বছর সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা অনায়াসেই এককভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন।
আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিরক্ষা বিষয়ক কনফারেন্স ‘সাংগ্রি-লা ডায়লগ’-এ ২০০৯ সালে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, ২০১০ ও ১১তে উপস্থিত ছিলেন তার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা এই তিন বছরে একবারও এই কনফারেন্সে অংশ নিতে পারেননি – শুধু সময়ের অভাবেই এমনটি ঘটেছে তা নয় – একজন সরকার প্রধানের এভাবে প্রতিরক্ষা বিষয়ক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য অস্বস্তিকর, কারণ কোনো শীর্ষ সম্মেলন ছাড়া সরকার প্রধানের উপস্থিতি তার নিজের জন্য যেমন যথাযথ নয় আয়োজকদের জন্যও অস্বস্তির। অথচ এধরনের কনফারেন্সে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপস্থিতি অবশ্য কর্তব্য এবং সেসাথে কৌশলগত কারণে এই কনফারেন্সের নানা সংলাপে অংশগ্রহণ দেশের প্রতিরক্ষার কূটনীতিতে অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আর দিনের পর দিন সবদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিকতা যেভাবে বাড়ছে তাতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষার মেলবন্ধন খুবই গুরুত্বের সাথে প্রতিভাত হচ্ছে। আর এজন্যই একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাকে ওই কাজ না করিয়ে পরবর্তীতে দুবারই দীপু মনিকে দিয়ে ‘সাংগ্রি-লা সংলাপ’ সামলাতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে।
দেশের ভেতরেও তিনবাহিনীর সব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরাসরি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা সুবিস্তৃত হয় না। প্রতিনিয়ত এসব বিষয় নিয়ে কাজ করা প্রধানমন্ত্রীর জন্য দুঃসাধ্যও হয়ে পড়ে। এছাড়া বাংলাদেশে ‘সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ’ বা Armed Forces Division নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াও প্রধানমন্ত্রী দ্বারা পরিচালিত হয় – ফলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সরকার প্রধানকে আবার ‘সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ’কেও প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে পরিচালনা করতে হয়। আর এটাও ঠিক বোধগম্য নয় সশস্ত্রবাহিনীর জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়া আবার সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ একটা কেন থাকবে?
তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন ঠিক শুধু নিজের দেশের সশস্ত্রবাহিনীর ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করার জন্য নয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন এশিয়া জুড়ে এবং আরো বড় পরিসরে পৃথিবী জুড়ে সামরিক কূটনীতির মূল চালিকাশক্তি। কাজেই পৃথিবীব্যাপী প্রতিরক্ষা থেকে প্রতিরক্ষা কার্যক্রমে সার্বক্ষণিক ও নিবিড় অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রীর নিয়োগ এখন খুবই প্রয়োজনীয়।
শেখ হাসিনার হাতে দুটি উপায় আছে। তিনি এমন কাউকে খুঁজে বের করতে পারেন যার উপর তিনি সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারবেন এবং মন্ত্রী হিসেবেও ওই ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করবে। আবার তিনি এও করতে পারেন মন্ত্রীত্ব নিজের হাতে রেখে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। তবে দুক্ষেত্রেই তাকে খেয়াল রাখতে হবে এরা যেন কেউ সশস্ত্রবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি না হন। পূর্ণমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে কারো নাম প্রস্তাব ঠিক করতে পারছি না, কিন্তু প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সোহেল তাজের নাম প্রস্তাব করা যায়।
সশস্ত্রবাহিনী নিয়ে শেখ হাসিনার একটা ভাল দিক আছে, তিনি নিয়মিত তিনবাহিনীর প্রধানদের সাথে বৈঠক করেন এবং তার চেয়েও বড় ব্যাপার প্রধানমন্ত্রীর পদাধিকার বলে তিনি সবসময় দেশের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর সাথে নিয়মিত মতবিনিময় করেন। শুধু তাই নয় দেশের অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি নিয়মমাফিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এই অভ্যাসগুলোর কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে প্রতিরক্ষা বৃত্তকে সম্পূর্ণ করে নিজের অবস্থানকে আরো উন্নত করার স্বার্থে শেখ হাসিনাই পারেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রীর বা নিদেনপক্ষে একজন প্রতিমন্ত্রীর অনুপ্রবেশ সম্ভব করে দিতে।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৯ comments
মাসুদ করিম - ২৫ জানুয়ারি ২০১২ (১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ)
অসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষাবৃত্ত সম্পূর্ণ করার এখনই সময় — অন্তত একজন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী।
মাসুদ করিম - ২৮ মে ২০১২ (২:৪৫ অপরাহ্ণ)
আরেকটি Shangri-La Dialogue 2012 সমাগত। আগামী ১-৩ জুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও কমকর্তাদের এই বৈঠকের জন্য সবকিছু প্রস্তুত। এবার কে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আবারো দীপু মনি? নাকি প্রতিরক্ষা সচিবের নেতৃত্বে শুধু প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা? এখনো কিছু জানি না।
মাসুদ করিম - ২ জুন ২০১২ (২:৫২ অপরাহ্ণ)
হ্যাঁ, দীপু মনিই গেলেন সাংগ্রি-লা ডায়লগ ২০১২তে।
মাসুদ করিম - ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ (৬:০১ অপরাহ্ণ)
মন্ত্রিসভার শাফল-রিশাফল তো বেশ হল, কিন্তু একজন অন্তত প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী এখনো জুটল না।
মাসুদ করিম - ১১ ডিসেম্বর ২০১২ (১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
পাকিস্তানের ইসলামবাদী আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী একে অপরের পোস্টার বয়। জিয়া বাংলাদেশের ইসলামবাদী আর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে সেপথেই পরিচালনার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। তার পরবর্তী এরশাদ খালেদাও তাই করেছেন। শেখ হাসিনা কতটুকু পেরেছেন বাংলাদেশের ইসলামবাদী আর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে একে অপরের পোস্টার বয় হওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে? কিন্তু এর উপরই নির্ভর করছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের রাজটীকাই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আজো তার যেটুকু মহিমা অর্জিত হয়েছে তার রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রগতির পথে একে ইসলামবাদীদের বিরুদ্ধে সংহত করতে কতটুকু করতে পেরেছেন হাসিনা, কতটুকু করতে পারবেন হাসিনা — এটাই এই সময়ের বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
মাসুদ করিম - ৬ জুন ২০১৩ (১:২৪ অপরাহ্ণ)
হাসিনা প্রশাসনের এমেয়াদের শেষ সাংগ্রি-লা ডায়লগ ২০১৩তেও দীপু মনিই সই। দীপু মনি কি কোনোভাবে এমেয়াদের দ্বিতীয় বছর থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পোর্টফোলিও শেয়ার করছিলেন অলিখিত ভাবে? দেখেশুনে তো তাই মনে হয়েছে আমার।
মাসুদ করিম - ১৪ জানুয়ারি ২০১৪ (১২:৩২ অপরাহ্ণ)
আরেকটি মন্ত্রিসভা হয়ে গেল, যথাবিহিত সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক এবারও প্রতিরক্ষা + সশস্ত্রবাহিনি বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর হাতেই ন্যাস্ত থেকে গেল।
মাসুদ করিম - ৪ জুলাই ২০১৪ (৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
সাংগ্রি-লা ডায়লগ ২০১৪তে বাংলাদেশের পক্ষে উপস্হিত ছিলেন গওহর রিজভী। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বলছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন শেখ হাসিনা। আজকের ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রথম কলামের একটি খবরের এক পর্যায়ে বলা হচ্ছে
সত্যিই কি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে? যদি তাই হয় তাহলে তো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রী ব্যতিত অন্য কাউকে মন্ত্রী হিসেবে পেল।
মাসুদ করিম - ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ (৫:৫৮ অপরাহ্ণ)