নারী কর্মকর্তাদের পোশাক বিধি বিষয়ক বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রত্যাহারকৃত বিধি এবং ইরাণ বিপ্লবের আগে-পরে  

গত ২১শে জুলাই, ২০২৫ বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের মানব সম্পদ বিভাগ-২ থেকে ইস্যু হওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক তাঁর সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং বিশেষত: নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য যে পোশাক ও আচরণ বিধি জারি করেছিলেন তা বিভিন্ন নারী অধিকার কর্মী ও গোষ্ঠি, মানবাধিকার কর্মী বা গোষ্ঠি, মূলধারা ও বিকল্প ধারার সমাজ মাধ্যমে তুমুল প্রতিবাদের পর বাতিল করা হয়েছে।

Dress Code Bangladesh Bank and Iran Revolution

গত ২১শে জুলাই, ২০২৫ বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের মানব সম্পদ বিভাগ থেকে ইস্যু হওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক তাঁর সব কর্মকর্তা কর্মচারী এবং বিশেষত: নারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য যে পোশাক আচরণ বিধি জারি করেছিলেন তা বিভিন্ন নারী অধিকার কর্মী গোষ্ঠি, মানবাধিকার কর্মী বা গোষ্ঠি, মূলধারা বিকল্প ধারার সমাজ মাধ্যমে তুমুল প্রতিবাদের পর বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে শঙ্কিত হয়ে পড়ে গত জুলাইয়ে যে ‘বাম’রা বাংলাদেশ কখনোই ইরাণ বা আফগানিস্থান হবে না’ এসব বলেছেন বা শার্টট্রাউজার পরা নারী বোরখা পরা নারীর হাত ধরে একই সাথে ‘ফ্যাসিবাদী সরকারকে হঠানোর আন্দোলনে ‘বৈচিত্র্য পোস্টার কার্ড হয়েছেন, সেই শার্টট্রাউজার পরা নারীরা এখন কেমন আছেন? 

নাবাংলাদেশে অবশ্যই এখনো পুরোপুরি ইরাণ বা আফগানিস্থানের মত কিছু হয়নি। কিন্তÍ, যে হারে ঢাকার মূল সড়ক থেকে অলিগলিতে জামাতের পোস্টার ছেয়ে যাচ্ছে, তাতে খানিকটা ভয় পাওয়া অমূলক নয়।  বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের বিধিতে মেয়েদের জন্য শাড়ি, সালোয়ারকামিজ সহ শালীন পোশাক পরা এবং ছোট হাতা, লং ড্রেস, লেগিংস এবং উজ্জ্বল রঙের ঝলমলে পোশাকের পাশাপাশি ছেলেদের জন্য জিন্স এবং গ্যাবার্ডিন প্যান্টও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বলে কি? ছেলেদের জন্যও নিষিদ্ধ? তা জিন্স? সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হলো ‘হিজাব যেন খুব উজ্জ্বল বা রঙচঙে না হয়, সে কথা এই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল। ঠিক আজকের ইরাণে ‘গুড হিজাব এবং ‘ব্যাড হিজাবএর মত। বাইশের মেয়ে মাহসার কয়েকটি চুল তার স্কার্ফের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছিল বলে সেটা ছিলব্যাড হিজাব। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রজ্ঞাপনে মেয়েদের অসমতল বা চপ্পল পরা তথা হাই হিল পরার বিরুদ্ধে বলা হয়। কর্মজীবী জন নারী  হিল পরে রোজ অফিসে যেতে পারেন? স্বাস্থ্যগত সুবিধা কাজের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অধিকাংশ নারীই আজকাল অসমতল জুতোই পরেন  

যাকআপাতত: বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রজ্ঞাপন বাতিল হয়েছে। কিন্তÍ এই লেখাটিতে ইরাণে ইসলামী বিপ্লবের আগেপরেযে ‘বাম নারীরা ‘একনায়ক শাহে বিরুদ্ধে খোমেনীকে সমর্থন দিয়েছিলেন, সেই ‘একনায়ক শাহ নারীমুক্তির জন্য কি কি করেছিলেন এবং ইরাণ বিপ্লবের পরে ‘বাম উদারপন্থী নারীÕদের কাঙ্খিত খোমেনী সরকার তাদের জন্য কি করলো, সেটাই গ্রথিত হয়েছে।  

মুশতাক আবু মুনাফ তাঁর Women’s Dress in Iran: From the Islamic Sitr to the Political Hijab প্রবন্ধে  জানাচ্ছেন যে, মূল আরবি ভাষায়হিজাববলতে নিজেকে লুকনো, আড়ালে রাখা বা বিচ্ছিন্ন করাকে বোঝায়।  হিজাব শব্দটি কোরাণে তুলনামূলক বিমূর্ত অর্থে বা দেয়াল/আড়াল, পর্দা বা অবগুণ্ঠন কি অন্তরাল অর্থে যতটা ব্যবহৃত হয়, ততটা নারীর দেহ আবৃত করার লক্ষ্যে বিশেষ প্রকৃতির কোন পোশাক পরাকে কিন্ত বোঝায় না এবং বহু প্রাকআধুনিক পর্বের ইসলামী আইনবেত্তারাফিকাহথেকে উদাহরণ দিয়েসিতরবাসাতির’ (চাদর) শব্দটিকেইহিজাব’-এর বদলে নারীর পূর্ণ আচ্ছাদনের জন্য ব্যবহার করতেন। তবে, মুসলিম নারীদের প্রার্থনা বা নামাজের সময় কেমন পোশাক পরতে হবে, সে বিষয়ে ইবন তাইমিয়ারপ্রার্থনার সময় মুসলিম নারীর পর্দা বিষয়কনিয়ম’- হিজাবের কথা বলা হয়েছে।  

হিজাবমূলত: নারীকে সমাজের মূল তরঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, ঘরে থাকার কথা বলে। অন্যদিকে, ‘সিতরবলতে অন্যের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে ভাল ভাবে নিজেকে আচ্ছাদনকরা বোঝায় বিশেষত: যখন সমাজে নারীপুরুষকে নানা কাজে মিশতে হয় বা যখন কাজের জন্য বের হতে হয়। যেমন, কোরাণেই বলা হয়েছে: ’এবং বিশ্বাসী পুরুষদের তাদের দৃষ্টি নত রাখতে বলোএবং বিশ্বাসী নারীদের তাদের দৃষ্টি নত রাখতে বলো’ (২৪:৩০৩১) এই নিষেধাজ্ঞা কিন্ত নারীপুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান।   

পারস্যে যখনহিজাবপ্রথম ঢুকলো, এর একই অর্থ ছিল। আধুনিক ফার্সি ভাষার প্রথম কবি আবু আব্দুল্লাহ রুদাকি (৮৫৮৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে শুরু করে নাসির খুসরো, আত্তার নিশাপুরী, খাকানী, রুমি, সাদি, হাফেজ, উনসুরি এবং সাইব তাব্রিজিএঁরা প্রত্যেকেই হিজাব’-কে নারীর পরিধেয় বদলে বিমূর্ত অর্থেই ব্যবহার করেছেন। ইরাণী শিয়া ধর্মীয় আইন থেকে শুরু করে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর লেখাতেওহিজাবঅর্থেআড়ালবাঅন্তরালযতটা বোঝায়, ততটা একজন নারীর পরিধেয় বা পরিচ্ছদকে বোঝায় না।  

খোমেনীর দীর্ঘ গ্রন্থ তাহরির আলওয়াসিলাহ (Exegesis on the Means of Salvationমুক্তির পথের ব্যখ্যা)’- নারীর পোশাক হিসেবে ‘হিজাব’-এর অনুপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মত। আরবিতে লেখা এই বইয়ে ইসলামী আইনশাস্ত্রের ,৫০০টি বিষয় আলোচিত হয়েছে। অন্যান্য আইনবিদদের মত, খোমেনী অবশ্য এই বইয়ের নানা ধারায়সিতর’ (আচ্ছাদন বিষয়ক) এবং কিভাবে ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ পরষ্পরের দিকে তাকাবে, সে বিষয়ে আইনী বিধানের কথা আলোচনা করেছেন। এই বইয়ে মৃতদেহ ধৌতকরণ (খন্ড , পৃষ্ঠা ৬৫), শবদেহ কাফনে মোড়ানো এবং প্রার্থনা (খন্ড , পৃষ্ঠা ৭৩), প্রার্থনা বা নামাজের সময় কী করতে হবে এবং ভুল হলে কী করণীয় (খন্ড , পৃষ্ঠা ১৩৫), হজ্ব পালনের সময় এবং কাবাকে প্রদক্ষিণের আগে ইহরাম প্রবেশ করার পবিত্র মূহুর্ত, নিকাহ বা বিয়ের চুক্তির কিছু ধারা (খন্ড , পৃষ্ঠা ২৩৬ এবং ২৪৫) বিষয়ে বিশদ আলোচনা আছে। তবে নারীর চুল ঢাকার জন্যহিজাব’-এর কথা কোথাও বলা হয়নি।  

ফার্সি ভাষায় খোমেনীর লেখা একইরকম আর একটি সঙ্কলণে (প্রশ্ন বিষয়ক ব্যখ্যা) পোশাকের বিষয়েসিতর’, নারীপুরুষের ভেতর দৃষ্টি বিনিময় সংক্রান্ত নিয়ম এবং দেহেরব্যক্তিগত এলাকা (আওরা)’ বিষয়ক আলোচনাতেও তিনিহিজাব’-এর কথা তোলেননি।  

কীভাবে ইরাণে রাজনৈতিক ধারণা হিসেবেহিজাব’-এর উদ্ভব হলো? 

তবে ধর্মীয় আলোচনায় ‘হিজাব’-এর প্রসঙ্গ না তুললেও রাজনৈতিক বক্তৃতায় খোমেনী নারীর পোশাক বিষয়ে বলতে গিয়ে ‘হিজাব’-এর কথা তুলেছেন। তাঁর রাজনৈতিক ধর্মীয় রচনার ভেতর এই পার্থক্যই পরবর্তী সময়ে ইরাণী সমাজে নারীর ‘হিজাবকিভাবে আরো বেশি রাজনৈতিক মিকা রাখবে, তাপরিষ্কার করে।  

ফাতিমা বারাঘনি, যিনি কুররাত আলআইন (১৮১৪৫২) নামেই পরিচিত, সম্ভবত: প্রথম মুসলিম নারী যিনি পুরুষদের সামনে মুখ খোলা রেখেই উপস্থিত হন। ইরাণে ইসলাম ধর্মের সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত বাহাই সম্প্রদায়ের ‘বাদাশত সম্মেলনেতিনি অবগুণ্ঠন খুলে সামনে আসেন। এই সম্মেলন খোরাসানের নিকটবর্তী এক এলাকায় ১৮৪৮ সালে আয়োজিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বাহাই বিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে তাঁকে খুন করা হয়।  

পৃথিবীর অন্য ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতেও মেয়েদের এই পর্দা খুলে সামনে আসা এবং সমাজের বৃহত্তর কাজে তাদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে আলোচনা শুরু হয়, অনেক চিঠিপত্র এবং কবিতায় এই বিষয়ে দাবি উত্থাপিত হয়। বিশেষত: মিশরে অন্ত্য উনিশ এবং বিশ শতকের শুরুতে ‘আলহিজাব (পর্দা করা)’ এবং ‘আলসুফুর (পর্দা না করা)’ নিয়ে তর্ক শুরু হয়। মিশরীয় উদারপন্থী রাজনীতিক কাসিম আমিনের লেখা দুটো বই ‘দ্য লিবারেশন অফ ওমেন’ (প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি , ১৮৯৯) এবং ‘দ্য নিউ ওম্যান’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯০০) ইরাণে পৌঁছালে আহমেদ মুহাদাদিব আলদৌলা বই দুটো ফার্সিতে অনুবাদ করেন এবং ইরাণী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বই দুটো প্রকাশ করে। তদানীন্তন ভারত, তুরষ্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম থেকেও জেন্ডার বিধি পুনর্মূল্যায়ণ এবং সমাজে নারীর বিষয়ক ভাবনা সমূহের সংমিশ্রণ এই বইয়ে ছিল। 

হিজাববাদ দেবার প্রচেষ্টা 

প্রথম মহাযুদ্ধের পর, বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এসব দেশের ভেতর কিছু রাষ্ট্রে অন্তত: নারীর পোশাক বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ন্ত্রিত এবং রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠে যা ইরাণকেও প্রভাবিত করে। উদাহরণ স্বরূপ, তুরষ্কে কামাল আতাতুর্ক নারীকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বা এমনকি স্কুল বা ভার্সিটিতেও মুখ বা চুল ঢাকতে নিষেধ করেন। ইরাণে রেজা শাহ পাহলভি তুরষ্কের উদাহরণে উদ্দীপিত হন। এই দুই রাষ্ট্রনায়কই নতুন, ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন অতীতে যা অটোমান এবং কাজার সালতানাত তথা রাজবংশ কর্তৃক শাসিত হয়েছে এবং এই দুই দেশেই ধর্মীয় ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থা মিলেমিশে ছিল। ১৯২৮ সালে ফাতেমা মাসুমেহর বেদিতে পারসিক নববর্ষ বা নওরোজ উদযাপনের সময় রেজা শাহের পরিবারের নারী সদস্যরা প্রথম মাথা বা চুল না ঢেকে অংশ নিলে, এই আচরণে সবাই ধাক্কা খায় এবং ধর্মীয় নেতারা বিক্ষুব্ধ হন।  

তবে পাহলভির প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৯৩৫ সালেহিজাব থেকে নারীকে মুক্ত করা জন্য একটি সমিতি গঠন করেন। পরের বছরে, পাহলভিকাশফহিজাবনামে একটি ডিক্রি জারি করেন যেখানে চাদও সহ যাবতীয় অবগুণ্ঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনচাদর দিয়ে নিজেকে ঢাকা ইরাণে খুবই প্রচলিত ছিল। এই দিনটি ছিল পারসিক বর্ষপঞ্জির ১৭তম দিন বা ৭ই জানুয়ারি। এটাকেনারী মুক্তি দিবসহিসেবেও ঘোষণা করা হয়। পাহলভির বিরুদ্ধে যেনপশ্চিমের দাসহবার অভিযোগ না ওঠে, এজন্য তিনি বলেন যে ইরাণে বহু আগে থেকেই নারীরা স্বচ্ছন্দ পোশাক পরেও চলাচল করেছে।  

তবে পাহলভি বংশের শাসনকালের শেষদিকে হিজাব নিয়ে তর্কবিতর্ক চরমে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী তাদের জন্মেরও কয়েক দশক আগে বাতিল বা নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজাব পরেরাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদহিসেবে ক্যাম্পাসে যাওয়া শুরু করে। যেন বা হিজাব পরলেইইসলামী আচরণসম্পন্ন হয় এবংহিজাবখুললে শাহের পশ্চিমাকরণের বিরোধিতা করা হয়।  

 

ইরাণী বিপ্লব হিজাব চাপিয়ে দেয় 

খোমেনীর ক্ষমতায় আসার সময়ের প্রেক্ষিতটা ছিল এমনটাই যা উপরে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। ‘বিপ্লবেÕ- একদম শুরুর দিনগুলো থেকে খোমেনী বারবার জোর দিয়েছেন যে ‘আমাদের ধর্মই আমাদের রাজনীতির মূলে এবং এভাবেই নারীর পর্দাকে ইসলামী রাষ্ট্রের একটি মূল বিষয় করে তোলা হয়েছে। ধর্মীয় বক্তৃতা বা খুতবাগুলোয় হিজাবকে শুধু শরীয়া আইনের একটি শর্ত হিসেবে নয়, বরং ‘বিপ্লবের অস্ত্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যার জন্য শহীদদের রক্ত ঝরেছেএই প্রতীককে উপেক্ষা করা কঠিন।  

ইরাণের বামউদারপন্থীদেরও অংশগ্রহণে সাধিত এই বিপ্লবের পর, বিদ্যমান সরকার ধীরে ধীরে কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ‘হিজাব’ পরার নিয়ম চালু করে। ১৯৮৩ সালের ৯ই আগস্ট, এই নিয়মকে রাজপথ অবধি প্রসারিত করা হয়। বলা হয় যে, মেয়েরা চুল না ঢাকলে তাদের চাবুক মেরে শাস্তি দেওয়া হবে। পরবর্তী চার দশক ধরে পোশাকের বিশেষ কিছু দিক এবং ব্যক্তিগত আচরণ, পারিবারিক জীবন, শিল্পকলা, নাটকসহ নানা বিষয় নিয়ে ‘বিপ্লবী ইসলামী সরকার নানা বিধিব্যবস্থা জারি করে।  

খামেনী যখন ক্ষমতায় এলেন, তখন আর ইরাণী রাজনৈতিক আলোচনায় শাহের আমলের উদারনৈতিক বিতর্কগুলো, যেমন: চাদর আসলে আরবদের আবেয়ার অনুকরণ বা পর্দা শুধুই ধর্মীয় শর্তএসব বলাও বন্ধ হয়ে গেছে। হিজাব ততদিনে ইরাণের জাতীয় প্রতীক হয়ে উঠেছে যদিও বহু সরকারী গবেষণা সংস্থাই দিন দিন বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, ইসলামী সরকার সে কথা শুনছে না। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ‘মন্দ হিজাববা ‘ব্যাড হিজাবনামে একটি ধারণা চালু হয়েছে। এর অর্থ যে হিজাবে সব চুল ঢাকে না, সেটা ‘ভাল হিজাবÕ নয়। এই ‘মন্দ হিজাবগুলোই রাষ্ট্র উপড়ে ফেলতে চায়। খামেনী এমনকি এমন ফতোয়াও দেন যে কার্টুন বা এ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রগুলোতেও মেয়েদের হিজাব পরা দেখাতে হবে।  

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইরাণের মেয়েরা ‘হিজাব প্রশ্নে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাচ্ছে। যে ইরাণের ছাত্রীরা এবং তথাকথিত বামউদারনীতিক নারীরাও শাহর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে মাথায় হিজাব পরেছিলেন, আজ তাদেরই কন্যা বা দৌহিত্রীরা হিজাব খুলে ফেলার জন্য প্রাণ দিচ্ছে। ২০১৮ সালে ‘গার্লস অফ রেভল্যুশন স্ট্রিট আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে প্রচুর নারী গ্রেপ্তার হয়। ২০২২ সালে মাহসা আমিনীর মৃত্যুর পর হিজাব বিরোধী বিক্ষোভে সরকারী বাহিনীর দমনপীড়নে পরবর্তী এক বছরে অন্তত: ৫৫১ জন নারীকিশোরতরুণ নিহত হয়, আরো ২২ জনের সন্দেহজনক মৃত্যু হয়েছে    

নারীর পাশাপাশি কেমন আছে ইরাণের সুন্নী মুসলিম সহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা? 

বাংলাদেশে যে বাম তাত্ত্বিকরা ইরাণ বিপ্লবকে তাদের মডেল মনে করেন, তাদের জ্ঞাতার্থে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হলেও জানিয়ে রাখি যে, শাহের আমলে অগ্নিউপাসক, খ্রিষ্টান, ইহুদি, বাহাইসহ সুন্নী মুসলিমদেরও যতটুকু অধিকার ছিল, বিপ্লব পরবর্তী ইরাণে তা নেই এবং সুন্নী মুসলিমদের অবস্থা এমনকি অগ্নিউপাসকদের চেয়েও করুণ।  

ইন্টারন্যাশনাল কোরাণ নিউজ এজেন্সি তথ্যানুযায়ী, তেহরানের ,৪৩৯টি মসজিদের ভেতর একটিও সুন্নী মসজিদ নেই। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় ইরাণে ১০,০০০ সুন্নী মসজিদ রয়েছে। জাহেদান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মৌলভি আব্দুল হামিদ এর সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে বলেন যে সেগুলো ‘সাময়িক প্রার্থনা কক্ষ এবং মসজিদ নয়। তাঁর মতে, ইরাণে সুন্নী জনসংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ হলেও রাষ্ট্র মাত্র ১০ শতাংশ বলে দেখায়।  

বিপ্লবপরবর্তী ইরাণী সংবিধানের ১০৭ ধারা অনুযায়ী সুন্নী মুসলিমরা সর্বোচ্চ নেতার পদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি (ধারা ১১৫) এবং প্রধান বিচারপতি (ধারা ১৫৭) পদে দাঁড়াতে পারবেন না। ইসলামী ইরাণের সংবিধান অনুযায়ী শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে মানা হয় এবং রাষ্ট্রস্বীকৃত সংখ্যালঘু হিসেব, অগ্নিউপাসক, ইহুদি এবং ইরাণী খ্রিষ্টানদের স্বীকৃতি দিলেও সুন্নী, ইয়ারেসান (আহল হক), এরফানে হালঘে অথবা বাহাইরা ইরাণের ইসলামী সংবিধানের ন্যূণতম নিরাপত্তা এবং স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত।  

তথ্য সূত্র: 

https://www.opendemocracy.net/en/north-africa-west-asia/irans-ongoing-war-against-its-religious-minorities/ 

https://networkbangladesh.com/bangladesh-bank-enforces-new-dress-code-and-conduct-guidelines-for-staff/ 

https://iranhrdc.org/state-of-coercion-the-situation-of-sunni-muslims-in-iran/ 

https://iranwire.com/en/fact-checking/71310/  

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

1 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
1
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.