ডারউইন-জার্নাল : কালান্তরের ঋণবিবরণ ১

তাকাই, দেখি, কাচঘেরা বাক্সটার মধ্যে দুশো বছর আগে জন্মানো এক মানুষের সংগ্রহ করা মকিংবার্ড দুটি শুয়ে আছে রূপকথার খাঁচাবাসী পাখির মতো। যেন বাণিজ্য থেকে ফিরে এসে পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সওদাগর তাদের শুনিয়েছে বনবাসী পাখিবন্ধুর হালসংবাদ। আর তা শুনে খাঁচার পাখি যেমন, মকিংবার্ড দুটিও কাচের বাক্সের মধ্যে আকাশের দিকে পা তুলে শুয়ে আছে মড়ার মতো। মৃত ভেবে কেউ ছুঁড়ে ফেললেই তারা ডানা মেলে উড়াল দেবে আকাশপথে।

সেইসব মকিংবার্ড, যা নতুন চিন্তার পথ খুলে দিয়েছে

সেইসব মকিংবার্ড, যা নতুন চিন্তার পথ খুলে দিয়েছে

খুব কি শীত আজকে? নভেম্বরে যেমন হয়, তার চেয়ে একটু বেশি? নাকি শীতগ্রীষ্মনিরপেক্ষ নীরবতা সারা ঘরে? কাচের স্বচ্ছতা পেরিয়ে চোখ দুটো বার বার স্পর্শ করছে মকিংবার্ডগুলির ধূসর পালক। প্রাচীনতার লাবণ্য মেখে যতটুকু উজ্জ্বল হওয়া সম্ভব তার সবটাই ধরে রেখেছে তাদের প্রতিটি পালক। হঠাৎ সামনে-পড়া কোনো সাময়িকীতে যেমন কোনো কোনো অলস মুহূর্তে পাশাপাশি ছাপানো প্রায়-অবিকল দুটি আলোকচিত্রের পাঁচটি বা নয়টির পার্থক্য খুঁজে বের করার উদ্যম পাই, তেমনি এক অলসতা ভরা চোখে এখন খুঁজতে ইচ্ছে করে, কী এমন পার্থক্য আছে এই দুই মকিংবার্ডের মধ্যে, যা দেখে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সৃষ্টির অভিজ্ঞান সম্পর্কে একদিন এক মানুষের মনে সংশয় জেগেছিল? কী করে তাঁর ধারণা হয়েছিল প্রকৃতিই অনিবার্য করে তোলে একেকটি নতুন প্রজাতির উদ্ভব? কী করে তাঁর মনে হয়েছিল, বদলে-যাওয়া প্রতিবেশের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার দুঃসাহস দেখালেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে মানিয়ে চলারই চেষ্টা করে পৃথিবীর সব প্রজাতিই? এবং তাই প্রতিটি প্রজাতিরই শেষ লক্ষ্য মূলত আপোশ করে, নিজেকে ক্রমশ পালটে ফেলে পরিবর্তিত প্রতিবেশের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার?

এ সবই ঘটে এই মকিংবার্ডদের ভালভাবে দেখতে গিয়ে। প্রশ্ন জাগে, প্রশ্ন বাড়তেই থাকে এবং প্রশ্নের উত্তরের সূক্ষ্ম এক উত্তরও লুকিয়ে থাকে মকিংবার্ডদের ঠোঁটের আশপাশের অঞ্চলে। আপেল কেন মাটিতে পড়ে, সরল সহজ প্রশ্নটি যেমন পৃথিবীর গভীর এক রহস্যের পাশাপাশি আরও অসংখ্য রহস্য সমাধার পথ খুলে দিয়েছিল, ধূসররঙা ওই দুটো মকিংবার্ডের ঠোঁট দুরকম কেন প্রশ্নটিও তেমনি এক রহস্যের সমাধান করে বসে, মেলে ধরে জ্ঞানের অপার রহস্যভাণ্ডার। তার পরও জ্ঞানের এ-ধারা মানতে আজও অনেকে দ্বিধা করেন, বিশেষত ধর্মে প্রগাঢ় আস্থা যাঁদের। একটি মকিংবার্ড পাওয়া গিয়েছিল সান ক্রিস্টোবালে, আরেকটি ফ্লোরিয়ানা আইল্যাণ্ডে। কিন্তু সংগ্রহের সময়ও মানুষটি বুঝতে পারেননি ঘরে ফেরার পর এই মকিংবার্ড দুটি তাঁকে বাধ্য করবে বার বার তাদের দিকে ফিরে তাকাতে। বিগল জাহাজে দিনের পর দিন চার্লস লয়েল-এর লেখা প্রিন্সিপল অভ জুওলোজি বইটিও কখনো ওই চিন্তার অনুভূতি আনেনি। ওই চিন্তা জাগেনি নিজের দাদা ইরাসমাস ডারউইনের এপিক কবিতার পাদটীকায় লেখা অদ্ভুত এক বাক্য পড়ার পরও : ‘পৃথিবীর সব মানুষই এসেছে মেডিটারানিয়ানের তীরবর্তী এক বানরের বংশ থেকে’! এমনকি বিগল সমুদ্রভ্রমণ থেকে ফেরার পথেও এরকম কোনো চিন্তা জাগেনি তাঁর। কিন’ তার পরই কোনো-একদিন দীর্ঘ সমুদ্র ও দ্বীপভ্রমণে পাওয়া বিভিন্ন নমুনা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে মকিংবার্ড দুটি তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল নতুন এক চিন্তার মুখোমুখি।
তখন নিশ্চয়ই তাঁর মনে একসঙ্গে ভিড় করেছিল আরও অনেক স্মৃতি। একদিন অস্ট্রিচের মাংস মুখে দিতেই আস্বাদনের নতুন অভিজ্ঞতায় পেটভর্তি দাউদাউ ক্ষুধা থমকে গিয়েছিল। আর প্রশ্ন জেগেছিল, দেখতে প্রায় একরকম, অথচ এ তো আরসব উটপাখির মাংসের মতো নয়; তা হলে কেমন উটপাখি এটি? এইভাবে তিনি দক্ষিণ আমেরিকায় খুঁজে পেয়েছিলেন অস্ট্রিচের আর-এক প্রকরণ রিয়্যা। কিংবা খুব ক্ষুধার্ত ছিলেন এক সকালে, ছোট ছোট কী এক আরমল্ড ধরে মজা করে খেয়েছিলেন সহযাত্রীর সঙ্গে, তারপর আরেকদিন বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন সেটিরই অনেক বড় সংস্করণ গ্লিপটোডোনের ফসিল পেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর প্রিয় ছিল গুবরেপোকা খোঁজা। আর তাই তাঁর মাথা খারাপ হওয়ার দশা হয়েছিল তখন, যখন সামান্য এক দ্বীপাঞ্চলে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বিভিন্ন প্রজাতির ৬৯টি গুবরেপোকা। এইসব সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্য যে জীবজগতের তালিকা তৈরি করতে যাওয়া এক তরুণের পূর্বচিন্তায় ছন্দপতন ঘটাবে আর জন্ম দেবে নতুন এক ধারণার, তা কি আর তখন জানতেন সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন ফিট্‌জ্‌রয় ক্রিসটেনড? ক্যাপ্টেন কি আর জানতেন, জাহাজে নিজের সাংস্কৃতিক নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্যে যে-তরুণ প্রকৃতিবিদকে তিনি সঙ্গী করেছিলেন, যাঁর সম্পর্কে বন্ধুর কাছে সপ্রশংস চিঠি লিখেছিলেন জাহাজ থেকে, বেশ কয়েক বছর পর সেই একই মানুষ সম্পর্কে তাঁকে ডেইলি টাইমস পত্রিকায় চিঠি লিখতে হবে যে, অরিজিন অভ স্পেসিস লেখার মধ্যে দিয়ে ডারউইন বুক অভ জেনেসিস-এর বিরোধিতা করছেন’? ডারউইনের গুরু ও কেমব্রিজের উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক জন স্টিফেনস হেন্সলো, যিনি এই সমুদ্র অভিযানে যাওয়ার জন্যে দূতিয়ালি করেছিলেন ডারউইন ও ফিট্‌জ্‌রয়ের ভেতর, তিনিও কি অনুমান করতে পেরেছিলেন মকিংবার্ড ডারউইনকে ঠেলে দেবে এই চিন্তার দিকে যে, এক প্রজাতি রূপান্তরিত হতে পারে আর-এক প্রজাতিতে?

কিন’ শেষ পর্যন্ত এসবই ঘটেছে। তাঁর লাল নোটবুকটি সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৮৩৬-এর অক্টোবরে সমুদ্রযাত্রা থেকে ফেরার পর ১৮৩৭ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়েই ডারউইনের মধ্যে পল্লবিত হয়েছে ওই চিন্তা এবং তিনি তা টুকে রেখেছেন সেখানে। তারপর এই শ দেড়েক বছরে কেউ উদ্দীপ্ত, কেউ আবার উত্তপ্ত হয়েছেন তাঁকে নিয়ে। সেইসব উদ্দীপনা আর উত্তাপের আড়ালে চুপচাপ পড়ে থাকে মানুষটির সংগ্রহ করা টুকরো টুকরো এবং অবশেষে সমন্বিত এক ধারণার সাক্ষী স্মৃতিময় অগণিত নমুনা। একশো বছর পেরয়, দেড়শো বছর পেরয়, তারপর একদিন সেগুলো একসঙ্গে উঠে আসে গ্যালারির আলোআঁধারিতে। আর আমরা দেখি মকিংবার্ডসমেত সেই প্রাণহীন নমুনাগুলি। শীতার্ত জানুয়ারিতে কিংবা শীত পেরুতে গিয়েও একটু থেমে বরফ-নামানো মার্চে মকিংবার্ডগুলির দুটির সামনে দাঁড়িয়ে আমি পাখি দুটির শরীর খুঁজি, অনেক কষ্টে জড়ো করি স্কুল-কলেজের জীববিদ্যা পাঠের জ্ঞান, তারপর সেই হাতুড়ে জ্ঞানে তাদের মেলাতে চাই একটি পার্থক্যের সঙ্গে : ঠোঁটগুলো আলাদা ওদের। একটির ঠোঁট পোকামাকড় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাওয়ার উপযোগী, আর আরেকটির ঠোঁট নাটের মতো শক্ত জিনিস পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে আছড়ে-আছড়ে ভেঙে ফেলার উপযোগী। এখনই যদি প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া যায়, তা হলে ঠিক ওরকম কাজই করতে শুরু করবে ওরা দুজন।

তা হলে এই আপাতসামান্য পার্থক্যই অসামান্য এক চিন্তার উৎস? প্রাকৃতিক নির্বাচনের বা ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে বিবর্তনের আভাস মিলেছিল এই স্তব্ধ ঠোঁটে? আর চার্লস ডারউইন সেই স্তব্ধতার অনুবাদ করেছিলেন বিশ বছর ধরে একটানা প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে? এমন এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী মকিংবার্ড, গ্লিপটোডন, আরমাডিল্লো, উটপাখির দল, বিশালাকৃতির সব কচ্ছপ,-যেগুলির উপর ঘোড়াচড়ার ভঙ্গিতে বসতে ডারউইন ভালোবাসতেন, বসে বসে দূরে কিংবা দূরবিনে চোখ রাখতেন,-অনেক অনেক গুবরেপোকা আর প্রজাপতি-এরকম যা-কিছু তিনি সংগ্রহ করেছিলেন বিগল সমুদ্রযাত্রায়, যত নোট নিয়েছেন সারা জীবনে, লিখেছেন চিঠি আর পেয়েছেন প্রত্যুত্তর,-যা কিছু ছিল এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে এমনকি খোদ ব্রিটেনেই, সেসবের অনেক কিছু নিয়েই এ-প্রদর্শনী। চার্লস ডারউইনের দুশোতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ-প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে তাঁর জন্মস্থান ব্রিটেনের ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। লণ্ডনের এই মিউজিয়াম এমনিতেই জমজমাট, ‘ডারউইন : বিগ আইডিয়াস অ্যাণ্ড লাইফ’ প্রদর্শনী সেখানকার ভিড়কে বাড়িয়ে তুলেছে আরও কয়েক গুণ।

এমন এক প্রদর্শনীকক্ষের দরজায় এইচএমএস বিগল জাহাজের মডেল দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকতে-না-ঢুকতেই দেখা হয় এই মকিংবার্ডগুলির সঙ্গে। যদিও, এখন কেইবা বলতে পারবে, ডারউইনের চোখে পড়ার সময় তারা কোথায় ছিল! হয়তোবা আকাশে। নাকি দ্বীপের মাটিতে? লাফিয়ে লাফিয়ে তারা তখন ঠোঁট দিয়ে এটাসেটা ঠোকরাতে ঠোকরাতে খুঁজছিল প্রিয় খাবার? অথবা তারা কি বসেছিল কোনো-এক গাছের ডালের পাতার ফাঁকে ডানা গুটিয়ে? কেউ কি বলতে পারবেন, কীভাবে সেগুলিকে কবজায় এনেছিলেন ডারউইন? তিনি কি তখন গুলি ছুঁড়েছিলেন একটুও না-কেঁপে দক্ষ হাতে? নাকি ফাঁদ পাতা হয়েছিল,-পাখি ধরার ফাঁদ? এইসব বোধহয় ডারউইনের জার্নালেও লেখা নেই। ইতিহাস কিংবা মানুষের স্মৃতি কোনোটাই খুঁটিনাটি এত কিছু মনে রাখে না। তবু এত যে মকিংবার্ড উড়ে বেড়িয়েছে এই পৃথিবীর উপরে, আর আরও অজস্র মকিংবার্ড এখনও প্রতিদিন উড়ছে, মরছে, জন্ম নিচ্ছে আবারও নতুন করে মরবার জন্যে,-তাদের চেয়ে এ-দুটি মকিংবার্ড একেবারে আলাদা। তারা দুয়ে মিলে বেঁচে থাকবে ইতিহাসের শেষ দিন অবধি। ডারউইন যেমন মৃত্যুর পরও পেয়েছেন অনন্ত জীবন, মকিংবার্ডগুলিও পেয়েছে তেমনি অনন্ত জীবন।

আর ডারউইনের একটি পূর্ণ ভাস্কর্যও ঠাঁই পেয়েছে বিখ্যাত এ-জাদুঘরের একেবারে দর্শনীয় স্থানে। জাদুঘরে ঢুকতেই দুর্লভ দীর্ঘ ডাইনোসরের ফসিল, তার পেছনে ওপরে ওঠার সিঁড়ির মুখে পর্যাপ্ত পরিসরে ঠাঁই পেয়েছে ডারউইনের এ-ভাস্কর্য। অথচ ডারউইনের ১৫,০০০ নমুনা সংরক্ষণ করার পরও এ-মিউজিয়ামে এতদিন ডারউইন ছিলেন অবহেলিত। কারণ ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম যিনি আন্তরিক দরদ দিয়ে গড়ে তুলেছেন, বিকশিত করেছেন সেই রিচার্ড ওয়েন ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তরুণকালে অবশ্য ডারউইনেরই বন্ধু ছিলেন তিনি। এমনকি ডারউইনের প্রথম সমুদ্রভ্রমণে সংগৃহীত সব নমুনা পরীক্ষা করার কঠিন ও কষ্টকর কাজটিও করেছিলেন তিনি। প্রদর্শনীর একটি পরিপত্র জানাচ্ছে সবাইকে, এ-কাজ করতে গিয়ে ডারউইনের সংগ্রহ করা ফসিলগুলির মধ্যে ওয়েন দেখতে পান দুর্লভ ম্যামাল টক্সোডোনের খুলি। নিও নিগ্রো থেকে ডারউইন আবিষ্কার করেন এটি। দুর্লভ ও আগে একদম অনাবিষ্কৃত এ-ফসিলটির নামকরণ করেন ওয়েন ডারউইনেরই নামে। কিন্তু প্রবাদ আছে, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।’ তাই ডারউইন যখন জানালেন, মানুষ পৃথিবীর কোনো বিশেষ আহামরি সৃষ্টি নয়, সৃষ্টির সেরা জীবও নয়, তখন ওয়েনের তা সহ্য হল না। ডারউইন যখন বললেন, প্রকৃতির আর দশটা পশুপ্রাণী যেমন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে টিকে আছে, মানুষও একই প্রক্রিয়ায় টিকে আছে, তখন ওয়েনের মনে হল ধর্মের বুকে ডারউইন ছুরি বসিয়ে দিলেন। দুই বন্ধুর মধ্যে গড়ে উঠল দূরত্বের এক কঠিন প্রাচীর, যা আর কখনোই দূর হয়নি। তাই ওয়েনের মৃত্যুর পরও কখনো ডারউইন ঠাঁই পাননি ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে।

এতদিন পর মিউজিয়ামের একেবারে প্রবেশপথেই ঠাঁই করে নেয়ার মধ্যে দিয়ে ডারউইন যেন প্রতীকী অর্থে ওয়েনের সেই ধর্মান্ধতাকেই কবর দিলেন। প্রকৃতি ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে মানুষের চিরজিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে নতুন করে জাগিয়ে তুললেন তিনি তাঁর ধারণার স্মৃতিসমূহ প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে। আর নতুন এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন সারা পৃথিবীতে থাবা-বসানো ধর্ম ও ধর্মজ অজ্ঞানতা ও সহিংসতার প্রতি।

ওই প্রদর্শনীকক্ষে মকিংবার্ড থেকে একটু এগুতেই হাতের বাম দিকের দেয়ালে প্রদর্শনের জন্যে রয়েছে একগুচ্ছ চিঠি; সেসবের একটি অসম্মতিপত্র,-বাবা কিছুতেই রাজি নন ডারউইনকে এভাবে সমুদ্রযাত্রায় যেতে দিতে। অতএব একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন তিনি তাঁর পত্রে, ডারউইনের এই সমুদ্রযাত্রাকে যদি তাঁর গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি সমর্থন করেন তা হলে তিনি সম্মতি দিতেও পারেন! ডারউইনের বাবার কাছে এরকম এক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন তাঁর শালা জোসিয়া উইগউড (Josiah Wedgwood)। এই জোসিয়ার সুপারিশে শেষ পর্যন্ত ডারউইন বাবার কাছ থেকে অনুমতি পান সমুদ্রযাত্রা করার। জোসিয়ার সেই যুক্তিতপ্ত চিঠি এবং তাতে কুপোকাত ডারউইনের বাবার সম্মতিপত্র,-এসবও আছে সেখানে। নিষ্প্রাণ কাগজের কালো কালো অক্ষর জীবন্ত করে তুলছে একটি পরিবারের শান্ত, নিস্তরঙ্গ পরিসরে সৃষ্ট অতীতের সেই তীব্র উত্তেজনা। আর এসবকে পেছনের দেয়ালে রেখে টেবিলবাক্সে ছোট এক পিস্তল, একটি হাতুড়ি ও বাইনোকুলার,-যেসব ডারউইন নিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। ডারউইনের এ-সমুদ্রযাত্রা কত বৈচিত্র্যময় ও দীর্ঘ ছিল তার খানিকটা অনুমান করা যায় দেয়ালে টাঙানো দীর্ঘ এক মানচিত্র থেকে, যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে, কোন ঘাট থেকে কোন ঘাটে, কোন দ্বীপ থেকে আর কোন দ্বীপে কতদিন পরে ভিড়েছে বিগল, কতদিনই-বা অবস্থান করেছে সেখানে। ডারউইন নামের মানুষটির সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে বিগল জাহাজটিকে এখন যত গুরুত্বপূর্ণই মনে হোক-না কেন, ডারউইন নিজেই প্রথমে বেশ হতাশ হয়েছিলেন মাত্র ৯০ ফুটের এই জাহাজ দেখে। যে-জাহাজটি দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ সমুদ্র উপকূলীয় বিভিন্ন দ্বীপ আর সমুদ্রাঞ্চলের অনুসন্ধানে যাচ্ছে, বিভিন্ন দ্বীপের মানচিত্র আঁকতে আর প্রাণীবৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করতে যাচ্ছে, সে-জাহাজের এই সামান্য আকৃতি খুশি করেনি তাঁকে।
ডারউইন তাঁর ছোট পিস্তলটি কিনেছিলেন জাহাজে চড়ার আগে, যৎকিঞ্চিৎ নিরাপত্তা বোধ করতে। ক্যাপ্টেনের চিঠিতে চোখ বুলাই, যাতে তিনি বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন, অনেকটা আদেশের মতো করেই, একটি পিস্তল কিনে নিতে। আর তা কেবল নিরাপত্তার জন্যে কেন, নমুনা শিকারের জন্যেও তো দরকার হতে পারে; যেমন দরকার হয় হাতুড়ির,-পাথর ভেঙে ফসিল বের করে আনতে; যেমন দরকার হয় কম্পাসের,-দিক চিনে নিতে। অতএব ডারউইন সমুদ্রযাত্রার আগে ৫০ পাউণ্ড দিয়ে একটি পিস্তল কিনেছিলেন, যে-পিস্তলটিকে দেখে মনে হয় খেলনা অস্ত্রের চেয়েও অধম এক হাতিয়ার। আর কিনেছিলেন পাঁচ পাউণ্ড দিয়ে একটি টেলিস্কোপ ও কম্পাস।
হয়তো ওই পিস্তল দিয়েই শিকার করা হয়েছিল কোনো কোনো ছোট্ট মকিংবার্ড। এবং আরও অনেক প্রাণী। হত্যা কিংবা অন্য যে-প্রকারেই হোক-না কেন, পাখিগুলি পেতে হয়েছে তাঁকে। আর ওটুকু নিষ্ঠুরতা দেখাতে পেরেছিলেন বলে তিনি একেবারে কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিলেন একটি পাখির খুব সুচালো ঠোঁট, দেখতে পেয়েছিলেন আরেক পাখির ঠুকরে ঠুকরে পাথরভাঙার উপযোগী তীক্ষ্ণ মোটা ঠোঁট। তার পরও তো তিনি প্রথমদিকে মকিংবার্ডগুলিকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন ফিঞ্চের সঙ্গে। মনে মনে অযথাই ছোট্ট এই অধম পিস্তলটির নাম রাখি হারপার লি’র সেই বিখ্যাত ফিকশন টু কিল এ মকিংবার্ড-এর নামে। অনেক আগে বাংলা এক উপন্যাসে পড়া একটি বাক্যও মনে পড়ে এই সুবাদে, ‘অসহায় অস্ত্র শত্রু মিত্র বোঝে না’।

ভাবি, সত্যিই কি ডারউইন হত্যা করেছিলেন মকিংবার্ডগুলিকে?

দুই
এই মকিংবার্ড ও ডারউইনের সংগ্রহ-করা দুর্লভ সব নমুনা তো বটেই, আমার মনে হয় এ-প্রদর্শনীতেই প্রথমবারের মতো তুলে ধরা হল আর-এক চাপাপড়া ইতিহাস : ডারউইন ও তাঁর স্ত্রীর হৃদয়ের নীরব রক্তক্ষরণের ইতিহাস।

শিল্পী জি রিচমন্ডের তুলিতে চার্লস ডারউইন

শিল্পী জি রিচমন্ডের তুলিতে চার্লস ডারউইন

ডারউইনের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রচারিত বিবিসি-র এক প্রামাণ্যচিত্রে খুব জোর দিয়েই বলা হয়েছে, ডারউইনের এ-সাফল্যের পূর্বশর্ত ছিলেন এমা উইগউড ডারউইন। লণ্ডন থেকে দূরে নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে কেণ্টের ডন হাউজে টানা ২০ বছর ডারউইন যে নীরব একাগ্রতায় গবেষণা করতে পেরেছেন, তা সম্ভব হয়েছে এমার মতো সঙ্গিনীর কারণে। বিয়ে করতে দ্বিধা ছিল তাঁর। তালিকা করেছিলেন বিয়ের সুবিধা ও অসুবিধার। সেই সুবিধার তালিকাতে দেখি তিনি লিখেছেন, ‘বৃদ্ধকালে নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গী ও বন্ধু পাওয়া… যেমনই হোক-না কেন, কুকুরসঙ্গের চেয়ে অনেক ভালো।’ এর বিপরীতে বিয়ের নেতিবাচক দিকের তালিকায় লিখেছেন, ‘বই কেনার জন্যে টাকার বরাদ্দ কমে যাওয়া …সময়ের ভয়াবহ অপচয়।’ কিন্তু এমার সান্নিধ্য তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল। অসুস্থ ডারউইনের প্রয়োজন ছিল পরিচর্যার। বিয়ের আগে অসুস্থ শরীর নিয়ে ডারউইন যখন লণ্ডনে ভাড়াবাসা খুঁজছেন, তখন এমা তাঁর কাছে চিঠি লেখেন, ‘So don’t be ill any more my dear Charley till I can be with you to nurse you’। বছরের পর বছর ধরে এমা পরিচর্যা করেছেন ডারউইনের দুরারোগ্য ব্যাধির, যে-ব্যাধির নাম এখন পর্যন্ত আমাদের অজানা। অনেকে মনে করেন, দক্ষিণ আমেরিকার এক প্যারাসাইটের কামড়ে এই রোগ হয় তাঁর, সারাজীবন এই রোগের কারণে সারা শরীরে প্রচণ্ড এক দাহ, আর সেই দাহেরও অধিক অস্থিরতা, অশান্তি ও মানসিক দুর্বলতা মৃত্যু অবধি তাড়িয়ে ফেরে তাঁকে। এই রোগ, পাশাপাশি নিজের পরীক্ষানিরীক্ষাগুলি যাচাই-বাছাই করার জন্যে তাঁর প্রয়োজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন, নীরব এক প্রাকৃতিক পরিবেশের। ১৮৪২ সালে ডারউইন তাই চলে যান লণ্ডনের বাইরে কেণ্ট-এর গ্রাম ডনে, যেখানে তিনি নিভৃতে, এবং নিরাপদেও বটে, ট্রান্সমিউটেশানের তত্ত্বকে নিরীক্ষা করার সুযোগ পাবেন। এর আগে ১৮৩৯ সালে তিনি বিয়ে করেন এমাকে।

এমা ডারউইন

এমা ডারউইন

প্রদর্শনীর দেয়ালে এমা আর ডারউইনের সম্পর্কবিষয়ক সারসংক্ষেপণে পড়ি, ডারউইনের বাবা ডারউইনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, অন্তত ঈশ্বর আর ধর্ম সম্পর্কে তোমার ধারণাগুলো স্ত্রীর সঙ্গে ভাগাভাগি কোরো না। ততদিনে, ১৮৩৭ সাল থেকেই, ডারউইনের মনে বিভিন্ন প্রজাতি উৎপত্তির ক্ষেত্রে ঈশ্বরের ভূমিকা সম্পর্কে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ওই চল্লিশের দশকের দিকে ট্রান্সমিউটেশন ছিল সামাজিক বিপ্লবঘেঁষা এক রেডিক্যাল ধারণা। সেজন্যেই তিনি চিন্তিত হয়েছিলেন ছেলের পারিবারিক জীবন নিয়ে, ঘরের শান্তি নিয়ে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার আগেই ডারউইন তাঁর নিবেদিত খ্রিষ্টান চাচাতো বোন এমাকে জানিয়ে দেন ট্রান্সমিউটেশান ধারণা ও গবেষণার কথা। এরপর ১১ নভেম্বর, ১৮৩৮-এ আনুষ্ঠানিক বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার সময় আবারও এমাকে বলেন তাঁর ট্রান্সমিউটেশান চিন্তার কথা। এমা রাজি হন বিয়ের প্রস্তাবে। ডারউইনের কাছে লেখা এমার চিঠিতে দেখছি, গভীর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তিনি ডারউইনের প্রশংসা করেছেন বিয়ের আগেই তাঁদের মধ্যেকার চিন্তার দূরত্ব নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলায়। পাশাপাশি এমা তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসের কথা লিখেছেন; লিখেছেন তাঁর ভয় শুধু এখানেই যে, ডারউইনের এই সৎ-অবিশ্বাসের কারণে মৃত্যুর পর তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। মতদ্বৈধতা নিয়েও দুর্নিবার এক আকর্ষণে ডারউইন ও এমা এসেছিলেন পরস্পরের কাছে।

ডারউইন তাঁর গ্রামের বাড়ির প্রাকৃতিক পরিবেশে ১৮৪৪ সালের শেষদিক থেকে শুরু করেন স্যাণ্ডওয়াক। আমৃত্যু প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, একেবারে ঘড়ি ধরে সেই গ্রামের পথে হাঁটতেন তিনি দীর্ঘ সময় ধরে। ঘুরতেন, দেখতেন আর চিন্তা করতেন তিনি। স্যাণ্ডওয়াকের ওই পথ এখন পরিচিতি পেয়েছে থিংকিং পাথ হিসেবে। ডারউইনের এই স্যাণ্ডওয়াক আর গ্রামের বাড়ির অনিঃশেষ প্রকৃতি নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখি প্রদর্শনীকক্ষে, তারপর আবারও পথটির অনুকৃতি দেখি ব্রিটিশ লাইব্রেরির ‘ডারউইন অ্যাণ্ড দ্য স্টোরি অব ইভোল্যুশান’ প্রদর্শনীতে। নয় বছর ধরে প্রতিদিন তিনি যে ট্রান্সমিউটেশন নিয়ে চিন্তা করেছেন, নোট নিয়েছেন তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে এই স্যাণ্ডওয়াক। তাঁর সেইসব ছোট ছোট লালরঙা ট্রান্সমিউটেশন নোটবুকগুলির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পাতাগুলি খোলা রয়েছে প্রদর্শনীকক্ষে, কোথাও কোনো মার্জিন নেই, ডারউইন তাঁর নোট নিয়েছেন কাগজের কোনো অপব্যয় না করে। দেয়ালে টাঙানো হয়েছে তাঁর টোকা চিন্তার খোলা পাতা, যেখানে তিনি প্রথম লিখেছেন ট্রান্সমিউটেশন নিয়ে তাঁর অনুমিত সিদ্ধান্তের কথা। কাচের ঘরে মেলে রাখা হয়েছে ‘বি’ নোটবুকের সেই পাতাটি, যেখানে তিনি নিজের হাতে টানারেখার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন ‘ট্রি অভ লাইফ’-এর ভাবনা।
ফ্রান্সের কোনো কোনো যুক্তিবাদী দার্শনিক অবশ্য এরকম ধারণা আগে থেকেই পোষণ করতেন, যদিও তাঁদের কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না সেই ধারণার। এমনই এক দার্শনিক জাঁ ব্যাপটিস্ট লামার্ক। ডারউইনের জন্মের আট বছর আগে ১৮০১ সালে এই প্রকৃতিবাদী দার্শনিক লেখেন,

জীবন স্থির কিছু নয়, যখন পরিবেশের বদল ঘটে তখন অর্গানিজমও টিকে থাকার প্রয়োজনে তাঁদের আচরণ পালটায়।

স্কটিশ এক ভূমিমালিক প্যাট্রিক ম্যাথু ১৮৩১ সালে টিম্বার ফরেস্ট্রি নিয়ে এক বই লিখতে গিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের ধারণা তুলে ধরেছিলেন। ১৮৬০ সালে দ্য গার্ডেনার্স ক্রনিকল-এ ডারউইনের বইটির আলোচনা পড়ে তিনি চিঠি লিখে জানান নিজের বইয়ের কথা। এর উত্তরে ডারউইন ম্যাথুর বইটি সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার কারণে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। আর এখন তো নতুন করে অধ্যাপক আবু উথম্যান আল-জাহিথ দাবি করছেন যে, বিবর্তন ও পরিবেশের মধ্যেকার সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রথম ধারণা প্রদান করেছেন বাগদাদের এক বিজ্ঞানী সেই নবম শতাব্দীতে!

ডারউইনের এই প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তাই অনেকটা মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বের ইতিহাসের মতো। মার্কসের আগেও অনেকে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁর সমালোচকদের সমালোচনার উত্তরে মার্কস লিখে গেছেন, এক্ষেত্রে তাঁর অপরাধ বড়জোর এতটুকু যে তিনি সেটিকে প্রতিস্থাপন করেছেন ইতিহাসের নিরিখে, দর্শনের নিরিখে। ডারউইনও ঠিক তেমনি প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে উপস্থাপন করলেন অকাট্য যুক্তির নিরিখে। মিলটনের ‘প্যারাডাইস’ থেকে শুরু করে ইরাসমাস ডারউইন ও জাঁ ব্যাপটিস্ট লামার্কদের মতো বিবর্তনবাদীদের চিন্তাজগৎ মন্থন করে ডারউইন তুলে আনলেন তাঁর নতুন ধারণাকে। লামার্ক কিংবা ম্যাথু আলোচিত না হলেও ডারউইনের ধারণা তাই ঝড় তুলল। আর সেই ঝড় স্পর্শ করল অর্থনীতিবিদ থেকে প্রাণীপ্রজননবিদ সবাইকে।

ব্রিটিশ লাইব্রেরির প্রদর্শনীতে বিশেষ দ্রষ্টব্য ছিল ডারউইনের মহান পূর্বসূরি চার্লস লিয়েল-এর বই,-যিনি তাঁকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, পৃথিবীর এই উপরিতল গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে অগণিত যুগ ধরে। কিন্তু ডারউইনকে তাঁর ধারণার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার সুবর্ণ মুহূর্তটি এনে দিয়েছিলেন রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাস। ওই স্বীকারোক্তি দেখছি নিজের হাতেই লিখে গেছেন তিনি, অক্টোবর ১৮৩৮-এ, মানে পদ্ধতিগতভাবে আমি আমার অনুসন্ধান শুরু করার ১৫ মাস পর, জনসংখ্যার ওপর ম্যালথাসের লেখাটি পড়ি।
আর ওই লেখাই তাঁকে তাঁর ধারণার ভিত্তি খুঁজে পেতে সাহায্য করে, জনসংখ্যার তত্ত্ব তাঁর কাছে হয়ে ওঠে প্রবৃদ্ধির সীমারেখা। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রচুর দার্শনিক ছিলেন, যাঁরা বলতেন, মানুষের প্রগতির কোনো সীমাপরিসীমা নেই। কিন্তু ম্যালথাস বললেন, না, ওরকম বলা যায় না, আসলে আমরা খাদ্য খুব সীমিতই পেয়ে থাকি। ম্যালথাসের এই ধারণাকে ডারউইন তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ১৮৪৪ সাল থেকে বিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করতে লাগলেন।

অবশ্য বেশ কয়েকটি ছেলেমেয়ের পিতামাতা হিসেবে ডারউইন আর এমা নিজেরাই তাঁদের ব্যক্তিজীবনে হয়ে উঠেছিলেন ম্যালথাস-তত্ত্বের গবেষণার উপাদান। অরিজিন অভ স্পেসিস-এর পাণ্ডুলিপিটির খসড়া যখন ডারউইন শেষ করছেন, তখন তাঁদের শিশুসন্তান মেরি ইলিয়েনর জন্মের মাত্র এক মাসের মধ্যে মারা গেছে, এমা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন পঞ্চমবারের মতো। তাঁদের প্রথম দুই ছেলেমেয়ে উইলিয়াম ও অ্যানি তখন বাড়ছে তরতরিয়ে। ইটি তখন মায়ের কোলে।

ডারউইন তাঁর বইয়ের শেষ প্যারাগ্রাফ লিখলেন ১৮৫৯-এর গ্রীষ্মের শেষদিকে; ততদিনে তাঁর জানা হয়ে গেছে, তিনি আসলে নাড়াচাড়া করছেন বুদ্ধিবৃত্তিক এক বিস্ফোরক নিয়ে। একটি চিঠিও লিখলেন তিনি এমার কাছে পাণ্ডুলিপি শেষ করার পরে। নিজের হাতে লেখা তাঁর সেই চিঠিও দেখি; দেখি তিনি লিখেছেন, এখনই এ-বই ছাপতে চান না তিনি। তাঁর ইচ্ছা মৃত্যুর পর যেন ছাপানো হয় এ বইটিকে। আর বইটি ছাপানোর জন্যে এমা যেন কয়েকশো পাউণ্ড আলাদা করে রাখেন।

আপাতদৃষ্টিতে খুবই রোমাণ্টিক স্বামী-স্ত্রীর এই সম্পর্ক, সংসারের অনেকটা পথ পেরুনোর পরও প্রাথমিক প্রেমপর্বের মতো এইসব চিঠি দেয়ানেয়া। কিন্তু এর তলদেশে ছিল প্রবল এক ঘূর্ণি। পাণ্ডুলিপি শেষ হয়েছে জেনে এমা চাইলেন সেটি পড়ে দেখতে। এক শীতল অনুভূতি নেমে এল ডারউইনের সারা শরীরে। ঠিক এ-ভয়টিই করছিলেন তিনি মনে মনে। তিনি জানতেন, এমার জন্যে এটি পড়া মোটেও স্বস্তিকর হবে না। শেষ পর্যন্ত সেটিই হল। যদিও পাণ্ডুলিপির কোনোখানে ডারউইন সরাসরি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেননি, তার পরও এমার পক্ষে বুঝতে কষ্ট হল না, মানুষকে যে খোদা বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন, বিশ্বাসের এই মূল জায়গাটিকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন তাঁর স্বামী। প্রথানুগত ধর্মীয় ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁর স্বামী। যে-কঠোর সামাজিক ও প্রগাঢ় ভালোবাসার সম্পর্কে তিনি ডারউইনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, সেই সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ততাই তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তোলে ডারউইনের পাপমুক্তির ব্যাপারে। এমা ভীত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, ধর্ম নিয়ে তাঁর স্বামীর এত সংশয়ের অর্থ হল কখনোই তাঁর পাপক্ষালন হবে না এবং পরকালে তাঁদের আর মিলনও ঘটবে না।

ডারউইনকে লেখা চিঠিতে এমা বলেছিলেন,
When I am with you all melancholy thoughts keep out of my head, but since you are gone some sad ones have forced themselves in, of fear that our opinions of the most important subject should differ widely. My reason tells me that honest and conscientious doubts can not be a sin, but I feel it would be a painful void between us.

দাম্পত্যের শুরু থেকেই এমাকে কখনো কখনো কী দুঃসহ সময় পেরুতে হয়েছে, এ-বাক্যগুলিতে তারই আভাস মেলে। সব মিলিয়ে মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং সম্পর্ক মানুষকে কত ক্ষতবিক্ষত করতে পারে, তারই এক অনালোচিত আখ্যান রচনা করে রেখে গেছেন ডারউইন ও এমা। মাঝে মাঝে এমার তখন মনে হত, তাঁরা কি হৃদয়ের দিক থেকে একই জীবনযাপন করেন? হঠাৎ-হঠাৎ তাঁর মনে হত, যখন তিনি মারা যাবেন, কিংবা ডারউইন-ও, তখনও কি এমন অবস্থাই থাকবে? অথবা এমনটি কি হবে-যে, একজন বাস করবেন আরেকজন থেকে অনেক দূরে?

এক অদ্ভুত বিষণ্নতায় এমা তাঁর এই চিঠিতে ডারউইনের প্রতি লিখেছেন :
এসব নিয়ে তোমার কাছ থেকে আমি কোনো উত্তর প্রত্যাশা করি না। এটি যে তোমাকে লিখছি, এটুকুই আমার জন্যে স্বস্তিকর। এটা ভেবো না যে, এটি আমার বিষয় না এবং আমার কাছে এটি তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, তোমাকে যা-কিছু উদ্বিগ্ন করে আমাকেও সেসব উদ্বিগ্ন করে। এবং আমি সবচেয়ে অসুখী হব যদি আমার মনে হয় যে আমরা একজন আরেকজনকে চিরজীবন বইতে পারব না।
(I do not wish for any answers about all this. It is a satisfaction for me to write it. Don’t think it’s not my affair and does not signify much to me. Everything that concerns you concerns me. And I would be most unhappy, if I thought that we would not belong to each other forever)।

এমার শেষ আশাটুকুও উবে যায়, যখন ডারউইনের এই পাণ্ডুলিপিকে প্রত্যাখ্যান করে অ্যাডাম সেজউইগ তাঁর কাছে চিঠি লেখেন। সেজউইকের মতামতকে খুবই গুরুত্ব দিতেন এমা, তাই তাঁর সমর্থনই ছিল এমার শেষ ভরসা। কিন্তু সেজউইকও যখন ডারউইনের ২০ বছরের গবেষণার উপসংহারকে প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন এই পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা আর বাকি থাকল না, যেখানে তিনি মানসিক সান্ত্বনা পেতে পারেন।

এইভাবে, প্রাত্যহিক জীবনযাপনে যত কাছাকাছিই থাকুন-না কেন, মানুষ ও প্রকৃতির সৃষ্টিতত্ত্ব এমা আর ডারউইনের সম্পর্কের মধ্যেকার এক অমীমাংসেয় ও অসমাপ্ত বিষয়ে পরিণত হয়। খুবই স্বাভাবিক যে, বহুবার এই বিভেদের আগুনের তীব্র আঁচ অনুভব করতে পেরেছেন তাঁরা দুজনেই। কিন্তু স্বামী যেখানে অসুস্থ, আর সন্তানও অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে, সন্তানেরা নিবিড় করে পেতে চাইছে বাবা আর মাকে, তখন সেই আগুনের আঁচ যতই স্পর্শ করুক, সম্ভবত চিঠিতে লেখা নিজের এই বাক্যটিকেই সারা জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এমা :
‘এবং আমি সবচেয়ে অসুখী হব, যদি আমার মনে হয় যে আমরা একজন আরেকজনকে চিরজীবন বইতে পারব না।’
আর ডারউইন? তিনি কেমন ছিলেন ‘অরিজিন অভ স্পেসিস’ লেখার পর সারাজীবন? তাঁর বুকের ওপর চেপে-বসা জগদ্দল ব্যথাকেও খানিকটা অনুভব করতে পারি, যা তিনি লিখে রেখে গেছেন বউয়ের লেখা চিঠির একেবারে নিচে, সেই একটিমাত্র বাক্য থেকে :
‘যখন আমি মারা যাব, জেনো, কতবার যে আমি চুম্বন করেছি, কতবার যে কেঁদেছি এর ওপরে!’
(When I am dead, know how many times I have kissed and cried over this.)।

তিন
এরপর আর কী লিখতে পারি? লেখা কি যায়, মানুষের সশব্দ উত্থান এবং নিভৃত হৃদয়ক্ষরণ দেখার পরও তবু আমি দেখি স্কুলবালিকার দল ছটফটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রদর্শনী কক্ষে? কাচবন্দি মকিংবার্ডের পেছনে হাতের ডানদিকে আরও বড় এক কাচঘরে সেই যে গ্রিন ইগোয়ানা, সবুজ সরীসৃপ নিজেকে উপচিয়ে ধরেছে গাছের মরা কাণ্ড আর সবুজ লতাপাতার মধ্যে থেকে, সেটিই তাদের প্রচণ্ড আগ্রহের বিষয়। যা-কিছু ডারউইনকে আগ্রহী করেছিল, যা-কিছু ছিল ডারউইনের দেখার বিষয়, তার সবই এখানে ফসিল। জীবন্ত এবং এ-যুগের বলতে এই সবুজ সরীসৃপ আর আরেকটি তুলতুলে ছোট বালিশের মতো অরনেট হর্নড ফ্রগ। আর কোনো পাখি নয়, আর কোনো প্রাণী নয়,-কেন কেবল এই জীবন্ত দুটি প্রাণীকেই এখানে রাখা হয়েছে বুঝতে পারি না। তবে তারা অপলক কিন্তু কৌতূহলহীন চোখে তাকিয়ে থাকে বিচিত্র সব মানুষের দিকে। আর মানুষও তাকায়। মানুষের সেই চাহনির প্রচণ্ড কৌতূহল ও কৌতুক বোঝা যায় খুব সহজেই। কয়েকদিন পর চলতি পথে এক মেট্রো থেকে জানতে পারি, ইতালির বিজ্ঞানীরা নাকি খুঁজে পেয়েছেন এক ‘লুপ্ত’ সরীসৃপকে। গবেষণার সময় ডারউইন গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে এরকম রংচোরা কোনো সরীসৃপের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। এবং এই না-খুঁজে পাওয়াটা তাঁর মনে গেঁথে ছিল। এই ধরনের সরীসৃপ দেখতে দেখতে ডারউইনের ধারণা হয়েছিল, প্রতিবেশের সঙ্গে প্রাণীর গায়ের রং ও চরিত্রের সম্পর্ক আছে। এখন, ডারউইন যদি বেঁচে থাকতেন, যদি জানতেন, তেমন এক সরীসৃপ শত বছর পরে খুঁজে পাওয়া গেছে আর্চিপেলাগোর এক আগ্নেয়গিরিতে, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই আনন্দিত হতেন এক ‘লুপ্ত সংযোগ’ খুঁজে পাওয়ার আনন্দে। নতুন এই ‘লুপ্ত সংযোগ’ ইগোয়ানা সবুজ রঙের নয়, বরং গোলাপি রঙের। বর্ণচোরা ইগোয়ানার খোঁজ না পেলেও অন্যরকম দুধরনের ইগোয়ানা দেখেছিলেন ডারউইন দ্বীপাঞ্চলে। এর একটি মেরিন ইগোয়ানা, ডাঙা থেকে সমুদ্রে নামে সে হাঁটুজলে নেমে হাঁটু মাজন করা কন্যার মতো, সামুদ্রিক ঘাস খায়, খায় তার প্রিয় জলজ খাবার, তার পরই ফের উঠে আসে ডাঙাতে। কিন’ এর সঙ্গে কোনো মিল নেই আর এক ইগোয়ানার, এটি থাকে শুকনো ভূমিতে আর দিনের পর দিন পার করে দেয় পানি না-খেয়েই। ওই কর্মটি তারা সেরে নেয় ক্যাকটাস খাওয়ার মধ্যে দিয়ে। ডারউইন ক্যাকটাস ভেঙে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তাদের দিকে। আর দেখেছিলেন, ক্ষুধার্ত কুকুরের দল যেমন একখণ্ড হাড়কে ঘিরে হামলে পড়ে, ঠিক তেমনি ক্যাকটাসের খণ্ডাংশ নেয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে ইগোয়ানাদের মধ্যে।

প্রদর্শনী কক্ষের গ্যালাপাগোস দ্বীপপূঞ্জ

প্রদর্শনী কক্ষের গ্যালাপাগোস দ্বীপপূঞ্জ

স্কুলবালিকারা ঘিরে রাখে সবুজ সরীসৃপকে, ছটফটিয়ে দেখতে থাকে গ্যালারির মধ্যে নির্মিত মৃত, খণ্ডিত ও সামান্য গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ। বিগলযাত্রায় ব্রাজিলের এক উপকূলে জাহাজ নোঙর ফেলার পর ছোট্ট এক এলাকার মধ্যে ডারউইন খুঁজে পেয়েছিলেন ৬৯টি বিভিন্ন প্রজাতির গুবরেপোকা। একজন কীটতত্ত্ববিদের মনের গড়নকে এলোমেলো করে দেয়ার জন্যে কেবল এই এক ঘটনাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি, গ্যালাপাগোস-এ তিনি পেয়েছিলেন উড়বার ক্ষমতা হারানো সামুদ্রিক পেটুক করমোর‌্যাণ্ট। সবুজ সরীসৃপের দলকে না পেলেও ডারউইন সেখানে পেয়েছিলেন অক্টোপাসের দল। আর উচ্ছ্বসিত হয়ে চিঠি লিখেছিলেন এক প্রিয় বন্ধুর কাছে। তখনও তিনি জানতেন না, সমুদ্রযাত্রীরা সবাই কম-বেশি পরিচিত এই ভয়ানক সামুদ্রিক প্রাণীটির সঙ্গে। এখন ডারউইনের প্রথম উচ্ছ্বাসের সবটুকু শুষে নেয়ার পরও কাচের জারে অক্টোপাসটি বাধ্য হয়েছে তার সব কটি শুঁড় গুটিয়ে নিতে, এখন সে মৃত, নিষিক্ত তরল রসায়নে। কয়েকটি সরীসৃপ, বড় বড় কচ্ছপ, গ্লিপটোডোন, বিশাল গ্লিপটোডোনের ইঁদুর-সংস্করণ আরমাডিলো, নীল পাওয়ালা পাখি বুবি,-পরিত্যক্ত না হলেও মরতে মরতে ফসিল হয়ে গেছে। এসবের মাঝে ডারউইনের ডায়েরি, চিঠির পাতা, ছড়ানো ছিটানো জার্নাল, লাল নোটবুক মৃত্যুগন্ধী হলেও জীবনের স্বাদ লেগে আছে তাতে। কোনো-একদিন এসব ফসিলই জীবন্ত ছিল, জীবনের উত্তাপে কখনো হিংস্র, কখনো আবার বিশ্রামরত ছিল। আরমাডিলো দেখতে দেখতে বিভ্রান্ত হই, মনে হয় ক্লান্ত ডারউইন বসেছেন সকালের নাস্তায়। ইঁদুরের মতো ছোট অদ্ভুত এই শুয়োরাকৃতির আরমাডিলোর বিশাল সংস্করণ গ্লিপটোডোনের পাশে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘টাচ’। গ্যালারিতে পেইণ্টিং-এর পাশে লেখা থাকে, ডোণ্ট টাচ; আর এখানে ঠিক তার উলটো। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করি সেই বিশাল গ্লিপটোডোনের শক্ত খোলস, টোকা দিই তর্জনী বাঁকা করে; টক করে আওয়াজ ওঠে আর সেই টংকারে ছড়িয়ে-পড়া ঝংকারে এতক্ষণের ভয় ও ইতস্তত ভাব দূর করে স্কুলপড়ুয়া এক মেয়ে অনেক সাহস নিয়ে হাত দিয়ে সেটাকে স্পর্শ করেই খসখসে খোলস থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে হাসাহাসি করতে থাকে।

নির্বিচারে সবকিছু খাওয়ার ক্ষমতা যোগ্যতমের উদ্বর্তনের জন্যে সবচেয়ে জরুরি গুণই বটে; আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনতত্ত্ব খুঁজে পাওয়ার আগে থেকেই ডারউইনের ছিল সেই সহজাত গুণ। কেমব্রিজে পড়ার সময়েই ডারউইন বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন গারমেট ক্লাব নামে ছোটখাটো এক সংঘ,-যে-ক্লাবের সদস্যদের কাজই ছিল পৃথিবীর এমন সব অদ্ভুত বস্তু খুঁজে খুঁজে খাওয়া, যা কোনো বাসা বা হোটেলের খাদ্যতালিকায় নেই, যা কেউ দুঃস্বপ্নেও খেতে চায় না! তবে সবকিছু যে খাওয়া যায় না সে-সিদ্ধান্তে পৌঁছন একটা বুড়ো বাদামি প্যাঁচা খাওয়ার চেষ্টা চালানোর পরে। তবে ইঁদুরের মতো ছোট শুয়োরাকৃতির প্রাণী আরমাডিলোকে অবশ্য নিবিড় নিষ্ঠা ও পরিতৃপ্তি নিয়েই খেয়েছিলেন তিনি। পড়াশুনায় ভালো ছিলেন না, কিন্তু খাওয়াদাওয়ায় খুব ভালোই ছিলেন, স্পষ্ট বুঝতে পারি। আর সর্বভুক ছিলেন এজন্যে প্রজাতির সুলুকসন্ধানের কাজেও এগিয়েছিলেন বেশ কয়েক ধাপ। বিভিন্ন প্রাণীর দূর-সম্পর্কের অনুসন্ধানও তিনি করে গেছেন তাঁর খাদ্যাস্বাদনের মধ্যে দিয়ে। সাধারণ এক উটপাখিকে (অস্ট্রিচ) খেতে বসে সেটার আস্বাদন থেকে তিনি তাই খুঁজে পেয়েছিলেন দুর্লভ আরেক উটপাখিকে (রিয়্যা)। আর আরেকবার দুহাতে দুই বিচিত্র গুবরেপোকা, কিন্তু চোখের সামনে আরেকটি নতুন গুবরেপোকা পড়তেই একটিকে মুখের মধ্যে চালান করে তিনি যে খালি হাতটায় লুফে নিতে পেরেছিলেন নতুনটিকে, তাও ওই সর্বভুক হওয়ার ফলেই। এইসব গুবরেপোকা, এরকম সব প্রজাতি এখন উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল আলোর নিচে শুয়ে আছে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের নজরদারির ভেতর। তাদের একটু দূরেই বিগল-এর ক্যাপ্টেনের লগ-বই, ক্যাপ্টেনের চিঠি, সেই চিঠিতে এক বন্ধুর কাছে তিনি বাধ্য হয়েছেন মুক্ত হাতে ডারউইনের অনুসন্ধিৎসুতার প্রশংসা লিখতে।

উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল আলোয় আমি ফসিলের পর ফসিল দেখি, স্পর্শ করি, নাম পড়ি,-যদিও জানি ভুলে যাব এইসব নাম, তবে হয়তো কোনো-একদিন গভীর রাতে, কোনো একদিন একাকী সন্ধ্যায় এই স্পর্শ ফিরে আসবে মনের ভেতর আর আমি সেই স্পর্শের নাম মনে করার চেষ্টা করতে করতে আকুল হব। হয়তো কোনো একদিন পেঙ্গুইনের বই হাতে নিয়ে আনমনে মনে হবে, এতদিন যে পেঙ্গুইনের নাম শুনলেই মনে হত অ্যাণ্টার্কটিকার কথা,-আসলে পেঙ্গুইনের দল তো অনেক বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অ্যাণ্টার্কটিকার চেয়েও ডারউইনের দেখা দক্ষিণ আমেরিকার দ্বীপগুলিতে। মৃত্যুর আগে লুপ্ত স্মৃতি ফিরে পাওয়ার মতো একদিন আমার মনে হবে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে এক শরতের দুপুরে আমি দিনমজুরদের সঙ্গে বসে বসে হালটের ক্ষেতের মাটিতে বসে যাওয়া কচুরিপানা সরানোর ছলে তাঁদের বলা কেচ্ছা শুনছিলাম আর সেই কেচ্ছা শোনা ভেস্তে গিয়েছিল হঠাৎ এক দিনমজুর মাটি খুঁড়ে আস্ত এক কচ্ছপ তুলে আনায়।

পলিপড়া মাটিতে শরীর লুকানো সেইসব ছোট ছোট কচ্ছপের তুলনায় ডারউইনের এইসব কচ্ছপের ফসিল অনেক বড়। কত বড় তার খানিকটা বোঝা যায় এই ঘটনা থেকে : ডারউইনের নাকি খুবই ভালো লাগত এসবের ওপর ঘোড়াচড়ার মতো করে বসে থাকতে। তাঁর অজস্র নোটপত্রের মধ্যেকার নির্বাচিত সেইসব নোটপত্র দেখি, যা পৃথিবীকে আজ পালটে দিয়েছে, পৃথিবীর রহস্য জানবার দুয়ার খুলে দিয়েছে। সমুদ্র থেকে ফিরে আসারও অনেক পরে অনেক চিন্তা ও ভাবনা, অনেক কাটাছেঁড়ার মধ্যে দিয়ে ফুলসক্যাপ সাদা কাগজে টুকে-রাখা বিবর্তন নিয়ে তাঁর প্রথম ভাবনাগুলো আর সমুদ্রের তলদেশ থেকে জেগে-ওঠা সব মৃত প্রবাল, বালিতে মুখ-না-গোঁজা বুকচিতানো উটপাখি, একটি-দুটি কম্পাস এবং ম্যাগনিফাইং গ্লাস, দূর সমুদ্র থেকে একঘেয়ে সাদা ঢেউ দেখতে দেখতে আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিত কারও কাছে লেখা বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর চিঠি, এসব কিছুর পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াই আমি, হেঁটে চলে সব দর্শনার্থী, যাঁদের সংখ্যা কোনোদিনই শেষ হবে না। সেটি বেশ টের পাই প্রথম দিনেই; দেখি, এক তরুণ পিতা তাঁর স্কুল-পড়ুয়া ছোট্ট ছেলেমেয়েকে খুব যত্ন করে ফিসফিসিয়ে ট্রান্সমিউটেশন নোটবুকের সেই ট্রি অভ লাইফ ফ্যামিলি চেনাচ্ছেন। চেনাচ্ছেন পরম মমতায় ডারউইনের স্টাফ করা একেকটি বৃক্ষপাতা, দুহাতের দু তর্জনী দিয়ে শূন্যে আঁকিবুকি করে বোঝাচ্ছেন বিভিন্ন কঙ্কালের আকার। বাচ্চা মেয়েটি তখন উবু হয়ে দাঁড়িয়ে কাচের খাঁচার কাচে হাত বুলিয়ে স্পর্শ পাওয়ার চেষ্টা করছে লালরঙা ছোট ছোট ট্রান্সমিউটেশান নোটবুকগুলোর। আর ছেলেটা প্রাচীন এক প্রাণীর বাঁকানো পাঁজরের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে যে মনে হচ্ছে, ওটা ওরই হারানো পাঁজর।

ইটির বাক্স

ইটির বাক্স


অ্যানি ডারউইন

অ্যানি ডারউইন

সেইদিন এইসব দেখার পর কতদিন পেরিয়ে গেছে! তার পরও, এখন, একটি ইটির বাক্স আমাকে কোনো কোনোদিন তাড়িয়ে ফেরে। তাড়িয়ে ফেরে আরেক মেয়ে অ্যানি, মাত্র ১০ বছর বয়সে ১৮৫১ সালে যে মারা যাওয়ার পর শোকাহত ডারউইন চার্চে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দেন। এই এক মেয়ে ডারউইনের, প্রায়দিনই সে সঙ্গী হত ডারউইনের চিন্তা-পথে (থিংকিং পাথ), ডারউইনের স্যাণ্ডওয়াকে। আর ডারউইনও তা উপভোগ করতেন। না-করার কোনো কারণও তো ছিল না। এমনকি নিজের ছেলেমেয়েরাও ছিল তাঁর কাছে তাঁর কাজের অনুষঙ্গ। তাঁদের বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গিমার ছবি তুলতেন তিনি। তুলতেন কান্নার ছবি, হাসির ছবি। আবার একই প্রকাশভঙ্গিমার ছবি তুলতেন বিভিন্ন জীবজন্তুর। নিজের সন্তানের হাসিকান্নার ছবির সঙ্গে কুকুরের হাসিকান্নার ছবি পাশাপাশি নিজেই ব্যাখ্যা করে গেছেন তিনি, কতটুকু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য মানুষ আর জীবজন্তুর, ব্যাখ্যা করেছেন কতটা পথ পেরিয়ে আসার পরও মানুষ আসলে মানুষ নয়, মানুষ আসলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফসল। এইভাবে ডারউইন তাঁর পরিবারকে দেখেছেন মানবপরিবারের অংশ হিসেবে আর মানবপরিবারকে দেখেছেন ম্যামাল পরিবারের অংশ হিসেবে। মানবসত্তা তাঁর কাছে প্রাণজগতের (লিভিং ওয়ার্ল্ডের) দূরবর্তী কিছু নয়, বরং অপরিহার্য অংশবিশেষ। এই নিয়ে দিনের পর দিন নিরীক্ষা চালাতে চালাতে একদিন দেখা মিলেছিল আলোকরেখার। সেদিন তিনি লিখেছিলেন,
‘অবশেষে আলোর রেখা দেখা দিয়েছে এবং আমি প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিত যে কোনো প্রজাতিই অপরিবর্তনীয় নয়।’

কিন্তু এই যে দিনের পর দিন ধরে নিরীক্ষা করা, লেখা, পড়া, নোট নেয়া,-প্রদর্শনীকক্ষের মধ্যেই স্থাপন করা ডারউইনের রিডিংরুমটি দেখতে দেখতে হঠাৎ গা ছমছমিয়ে ওঠে। ওই যে একটা উঁচু চেয়ার, টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ডারউইন এবার একটি বই খুললেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কোত্থেকে ছুটে এল এক দস্যি পিচ্চি মেয়ে, সে সেই দরকারি বইটি অথবা হাতে-ধরা বৃক্ষপত্রটি নিয়ে আবার দৌড়ে বেরিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিচে নেমে গেল। কেবল সিঁড়িই তো ভাঙল না, ভেঙে ফেলল ডারউইনের সমস্ত গাম্ভীর্য; ছুটে গিয়ে হঠাৎ করেই কামড় বসাল তার মায়ের হাতে আর দৌড়ে দৌড়ে অনেক সামনে চলে গেল ডারউইন থেকে তাঁর প্রিয় স্যাণ্ডওয়াকের সময়। তার পর এত চঞ্চলতা নিয়ে মেয়েটি একদিন চিরতরে ঘুমিয়ে গেল। লোকদেখানো যতটুকু ঈশ্বরবিশ্বাস ডারউইন তাঁর বাহ্যিক জীবনে পুষে রেখেছিলেন অসুস্থ অ্যানি মৃত্যুর সময় সেটুকুও সঙ্গে নিয়ে গেল।

অ্যানির বাক্স ছিল না অথবা তা খুঁজে পাওয়া যায়নি; কিন্তু ইটির বাক্স খুঁজে পাওয়া গেছে। এই ইটিই বড় হয়ে, হেনরিয়েটা ডারউইন হয়ে ওঠার পরে তাঁর মায়ের চিঠিগুলি সব প্রকাশ করেন ১৯০৪ সালে। অনেক পরে বিশাল বাড়িটির জমানো জিনিসপত্রের মধ্যে এই মেয়েটির পুরানো এক বাক্স খুঁজে পেয়েছেন ডারউইনের এক উত্তরাধিকারী র‌্যানডাল কেইন্স। ডারউইনের পাঠকক্ষের একটু আগে এককোণে গিয়ে বাক্সটির কাছে দাঁড়াতেই খুবই আস্তে ইথার থেকে ভেসে আসে কেইন্সের কণ্ঠস্বর। তিনি বলতে থাকেন এটি খুঁজে পাওয়ার স্মৃতি। বলতে থাকেন ইটির কথা। বাক্সের মধ্যে রাখা হয়তোবা ইটির জন্মদিনে পাওয়া খাতার কথাও শোনান তিনি। খুব নিরালায় মেয়েটির ছবি আঁকার চিকন খাতায় জেগে থাকে কিছু রঙিন ছবি, ভিক্টোরিয়ান যুগের পোশাকপরা কোনো নারীকে রংপেন্সিলে রং করেছে সে। আর আমি এ-ও মনে করতে পারি, ওখানে ছিল ছোট্ট একটি খাম, যে-খামটির মধ্যে ছোট্ট ইটি তুলে রেখেছিল বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে পাওয়া এলোমেলো কিছু দাড়ি। পেয়েছিল? নাকি সে নিজেই টেনে তুলেছিল? কন্যা তার পিতার দাড়ি টেনে তুলছে, জানি মিথ্যা, তবু ওই কল্পনায় হাসতে থাকি।

(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য।)

ইমতিয়ার শামীম

আপনারে এই জানা আমার ফুরাবে না...

১৪ comments

  1. মুয়িন পার্ভেজ - ১০ ডিসেম্বর ২০০৯ (১:৩৩ অপরাহ্ণ)

    ধন্যবাদ ইমতিয়ার শামীম, ডারউইন-স্মরণে যথাসময়ে একটি সুখপাঠ্য লেখা উপহার দেওয়ার জন্য। পরবর্তী পর্বটির অপেক্ষায় থাকলাম সাগ্রহে। বিবর্তন-প্রাসঙ্গিক শিক্ষানবিসের কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘সচলায়তন’-এ, দু’দিন আগে পড়লাম এ-লেখাটি : ‘‘জাকির নায়েকের মিথ্যাচার: প্রসঙ্গ ‘বিবর্তন”

    • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১১ ডিসেম্বর ২০০৯ (১০:১৭ পূর্বাহ্ণ)

      যেন ডারউইনের সহযাত্রী হয়ে তার কাজের সাথে, ভাবনার নানান প্রলেপের সাথে নিজেকে জারিত করে ফেলছি। এমনকি স্যান্ডওয়াকের আমিও যেন এক পথিক হয়ে গেলাম। আর ইমতিয়ারের লেখার যে সৌন্দর্য, মাধুর্য, লালিত্য, নান্দনিক স্ফুরণ তা সত্যি অসাধারণ। ইমতিয়ার তার দায়বদ্ধতার জায়গাটি সরেজমিনে চিহ্নিত করে দিলেন। বিজ্ঞানকে ছিন্নভিন্ন করার এই কালে এটা যে কত দরকারি পাল্টা এক লেখা, তা আমি বোধ হয় সেই ভাবে প্রকাশই করতে পারব না। এটি সর্বত্র ছড়িয়ে-পড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের যার-তার জায়গা থেকে করা উচিৎ। আমি অন্তত তীব্র-আগ্রহে এর পরবর্তী অংশটুকু পাঠ করার জন্য বুভুক্ষু হয়ে থাকলাম।
      এর সাথে মিউজিয়াম, স্যান্ডওয়াক, স্যাম্পল ইত্যাদির ছবি দেখতে পেলে আরও কৃতার্থ হবো।

      • ইমতিয়ার - ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:২৯ পূর্বাহ্ণ)

        ছবি কিছু দেয়া সত্যিই প্রয়োজন ছিল জাহাঙ্গীর ভাই, দেয়াও যেত; কিন্তু প্রথমত আমি ছবি আপলোড করতে পারলেও মনঃপুত হয় না, দ্বিতীয়ত. বিষয়টি আমার জন্যে সময়সাপেক্ষ। কখনও সময় হাতে বেশি থাকলে কাজটি নিশ্চয়ই করব। আপনাদের মন্তব্য পড়ে দ্রুত বাকি অংশ তুলে দিতে আমিও আগ্রহী হয়ে পড়েছি।
        প্রসঙ্গত বলি, প্রদর্শনীটি কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। এটি ২০০৮-এর নভেম্বর থেকে ২০০৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিল। তবে সবার আগ্রহের কথা চিন্তা করে ওরা এখন মিউজিয়ামটিতে একটি ডারউইন কর্নার করেছে। সেখানে দ্রষ্টব্য সব কিছু রাখা আছে। ধন্যবাদ আপনাকে সদয় মন্তব্যের জন্যে।

        • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৭:০৬ পূর্বাহ্ণ)

          থ্যাংকস্

    • ইমতিয়ার - ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:২৩ পূর্বাহ্ণ)

      আপনার দেয়া লিংক-এর লেখাটি আগেই একবার পড়েছিলাম, মুয়িন পার্ভেজ। আর প্রিন্টও নিয়েছিলাম, জাকিরের দু’চার ভক্তকে পড়ানোর জন্যে। কিন্তু কাউকে পড়তে দেয়ার আগেই টেবিল থেকে আগ্রহী কেউ নিয়ে গেছে…
      এই সুযোগে আর একবার চোখ বুলালাম। মকিংবার্ড আর ফিঞ্চ-এর ব্যাপারটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে বলে নিচের আরও একটি লিংক দিয়ে রাখছি :ফিঞ্চ নয়, মকিংবার্ড ডারউইনকে বিবর্তনসংক্রান্ত চিন্তার দিকে নিয়ে গিয়েছিল, বিষয়টি সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা আছে।
      ধন্যবাদ আপনাকে।

  2. মাসুদ করিম - ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ (১:১২ পূর্বাহ্ণ)

    ‘স্যান্ডওয়াক’, সত্যিই নয় বছরের ওই জীবনে, চিন্তার ও প্রশান্তির কী এক প্রক্রিয়া ! আমাদের আজকের জীবনে এমন একটি পথ খুঁজে পাওয়া তো এখন দুঃসাধ্য ! একসময় চট্টগ্রামের সিআরবির পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এমন কিছু ‘বালিপথ’ ছিল, অলস বিকেলে সেখানে গাছগাছালির ভেতরে হেঁটেছি, সকালে ফুটবল খেলায় পায়ের জোর বাড়ানোর জন্য দৌড়েছি। অনেকদিন হলো সে ‘বালিপথ’গুলো নষ্ট হয়ে গেছে, প্রধান কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে ঢালাও বিজাতীয় ইউক্যালিপটাস লাগানো। এরকম আরো কিছু ‘বালিপথ’ ছিল জেমস ফিনলে ও বাংলাদেশ চা বোর্ডের পাহাড়ে, সেগুলোও এখন আর নেই, এ অঞ্চলে দায়ী অপরিকল্পিতভাবে আবাসিক এলাকা নির্মাণ। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ডারউইনের ‘স্যান্ডওয়াক’-এর জায়গাটি। প্রজাতি-চিন্তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আমার নেই, কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্যের ভেতর বসবাসের অভ্যাস আছে, তাই ‘স্যান্ডওয়াক’-এর এই তথ্যাটি জানার পর থেকেই মন কেমন করছে। ডারউইন সত্যিই প্রকৃতি ও সৃষ্টির ধারনাই পাল্টে দিয়েছেন, আমাদের সুযোগ করে দিয়েছেন ঈশ্বরের ইচ্ছার পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে, প্রকৃতি ও প্রজাতির বিজ্ঞানের ভাবনায় অনন্ত প্রগতির দিকে এগিয়ে যেতে : আশা করি ঈশ্বর প্রেরিত ‘বুশ’গুলো আমাদের কোনো ভাবেই আর ডারউইন পূর্ব বিশ্বাসে ফিরিয়ে নিতে পারবে না।

    • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ (৬:১১ পূর্বাহ্ণ)

      ডারউইন সত্যিই প্রকৃতি ও সৃষ্টির ধারনাই পাল্টে দিয়েছেন, আমাদের সুযোগ করে দিয়েছেন ঈশ্বরের ইচ্ছার পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে, প্রকৃতি ও প্রজাতির বিজ্ঞানের ভাবনায় অনন্ত প্রগতির দিকে এগিয়ে যেতে : আশা করি ঈশ্বর প্রেরিত ‘বুশ’গুলো আমাদের কোনো ভাবেই আর ডারউইন পূর্ব বিশ্বাসে ফিরিয়ে নিতে পারবে না।

      নিত্যস্মরণীয় এই উপলব্ধির জন্য মাসুদ করিমকে ভালোবাসা।

  3. রেজাউল করিম সুমন - ১৬ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:৫৪ অপরাহ্ণ)

    ইমতিয়ার ভাই, খুবই ভালো লাগল এই লেখাটা। দ্বিতীয় পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।


    আপনার এই লেখার সূত্রেই অনেকদিন পর আজ মনে পড়ে গেল আমার বালকবয়সের খুব প্রিয় একটা বইয়ের কথা। স্কুলে একে-ওকে ধার দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত আর টিকিয়ে রাখা যায়নি বইটাকে। শিশু একাডেমী থেকে পরে আর নতুন করে ছাপাও হয়নি! সে-বইয়ের নাম ছিল জ্ঞানের কথা (১ম খণ্ড)। সম্ভবত কখনোই বেরোয়নি পরিকল্পিত পরবর্তী খণ্ডগুলো!

    জ্ঞানের কথা-র একটা অংশে ছিল অল্প পরিসরে নানান মনীষীর চমৎকার সব জীবনী। আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছিল সক্রেটিসকে, কয়েক বছর পর তাঁকে নিয়ে একটা পদ্য লিখেছিলাম; আর, মনে আছে, প্রথম পাঠের সময়েই অপটু হাতে খাতায় কপি করেছিলাম মার্ক্স-এঙ্গেলসের শ্মশ্রুময় মুখের ছবি। আর হ্যাঁ, ডারউইনের সঙ্গেও প্রথম পরিচয় হয়েছিল সে-বইয়ের মাধ্যমেই। যাই হোক, শিশু একাডেমীর ওই প্রকল্পের অকালমৃত্যুর মূলে না কি ছিল সাঈদীর আন্দোলন, সে-সময়ে শুনেছিলাম। আপনার কি জানা আছে কিছু?

    • ইমতিয়ার - ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ)

      জ্ঞানের কথা বইটি আমারও খুব প্রিয়, সুমন।
      কিন্তু বইটিকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; যারা বাজেয়াপ্ত করার আন্দোলন করেছিল, প্রচারণা অনুযায়ী তাদের মূল আপত্তি ছিল মনীষীদের তালিকায় অক্ষরক্রম অনুযায়ী নবী মুহম্মদের নাম পরে আসার ব্যাপারে। কিন্তু মূল আপত্তি নিশ্চয়ই বইটির সব বিষয়েই, যা থেকে শিশুদের বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। ধর্ম ও স্বৈরাচারের এক বড় শত্রু কৌতূহল আর প্রশ্ন- জ্ঞানের কথা বইটির সেই কৌতূহল আর প্রশ্ন জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা আছে। স্বৈরাচারী এরশাদেরও তা পছন্দ হয়নি, তাই বইটি নিষিদ্ধ করা হয় এবং সে কারণে পরবর্তী খণ্ডসমূহের প্রকাশও বাতিল অথবা স্থগিত হয়ে যায়।
      বইটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্যে কি কেউ মামলা করেছিল? না বোধহয়। শিশু একাডেমির পক্ষ থেকে তো মামলা করার প্রশ্নই আসে না, বোধহয় অন্য কেউ-ও আগ্রহ দেখায়নি। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। মামলায় নিশ্চয়ই জয় হবে।
      এই সুযোগে কিছু ছবিও সংযুক্ত করা হলো ইন্টারনেট থেকে, আমার নিজেরও অনেক কিছু জানা হলো এসব ছবি খুঁজতে গিয়ে…

      • রেজাউল করিম সুমন - ২২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৪:৩৪ অপরাহ্ণ)

        অনেক ধন্যবাদ ইমতিয়ার ভাই, ছবির জন্য এবং ‘জ্ঞানের কথা’ নিয়ে আপনার মন্তব্যের জন্য। ঠিক, বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। আমার বাবার কাছে সে-রকমই শুনেছিলাম তখন।

        প্রথমে নিশ্চিত হওয়া দরকার ‘জ্ঞানের কথা’র ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য আদৌ কোনো মামলা হয়েছিল কি না। যদি মামলা না হয়ে থাকে, এ বিষয়ে অবশ্যই চিন্তাভাবনা করা উচিত। আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

  4. Pingback: মুক্তাঙ্গন | ডারউইন-জার্নাল : কালান্তরের ঋণবিবরণ ২ | ইমতিয়ার শামীম

  5. মুয়িন পার্ভেজ - ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১০:৩০ পূর্বাহ্ণ)

    লেখাটি আবার পড়লাম। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় বলা যায়, ‘কী ভালো আমার লাগলো’ এই লেখা, ‘কেমন ক’রে বলি’! যতবারই পড়ি, নতুন মনে হয় — প্রাণের উত্তাপ দিয়ে লেখা তথ্যময় এ-বিবরণী ফসিলেও ফুল ফোটাতে পারে। যেমন গবেষণা, তেমনি স্ত্রীর প্রতিও কতটুকু নিষ্ঠা আর মমতা ছিল ব’লেই না এমার আশঙ্কাদীর্ণ চিঠির নীচে লিখেছিলেন ডারউইন :

    When I am dead, know how many times I have kissed and cried over this.

    ডারউইনের অকালমৃতা কন্যা অ্যানির জন্যও মনখারাপ হতে থাকে, যে ছিল পিতার ‘স্যান্ডওয়াক’-এর কৌতূহলী সঙ্গিনী। ছেলেবেলায় আমিও হারিয়েছি ছোটবোনকে এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায়; তার সঙ্গে আমার আত্মিক যোগাযোগ গ’ড়ে ওঠারও সুযোগ হয়নি।

  6. মোহাম্মদ মুনিম - ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (৭:২৯ অপরাহ্ণ)

    ‘জ্ঞানের কথা’ বইটির কথা আমারও আবছা মনে আছে। পরে শুনেছিলাম এরশাদ স্বয়ং বইটি বাজেয়াপ্তের বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু তাঁর উপদেষ্টাদের চাপে তাঁকে বাজেয়াপ্তের পক্ষে মত দিতে হয়েছিল। আমরা যে বছর নবম শ্রেণীতে উঠলাম, সে বছর বিজ্ঞান বই নতুন করে লেখা হলো, আগের বিজ্ঞান বইয়ের একেবারে প্রথমে ডারউইনের একটা বড় ছবি ছিল, তাঁকে নিয়ে বিতর্কের কথাও লেখা ছিল, কিন্তু তিনি জীববিজ্ঞানে যে irreversible পরিবর্তন এনেছিলেন, সেটা স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল। আমাদের বিজ্ঞান বইয়ে সে ছবিটা ছিল না। এর প্রায় দশ বছর পরে যখন আমার প্রাইভেট টিউশনির ছাত্ররা নবম শ্রেণীতে উঠল, তখন দেখলাম বিজ্ঞান বই আরো পালটে গেছে, উদ্ভিদের আলোক সংবেদনশীলতা অধ্যায়ে বলা আছে, “ইহা মহান আল্লাহর কুদরত বই আর কিছুই নয়”।

  7. রায়হান রশিদ - ২৩ জুলাই ২০১২ (১০:১৩ পূর্বাহ্ণ)

    সচলায়তনে অণু তারেক এর লেখা: ডারউইন তীর্থে

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.