একটি দেশ, নতুন বছর, পুরোনো স্বপ্ন

গনতন্ত্রে ফিরে যাচ্ছি আবার। ২০০৯ সাল শুরু হচ্ছে নতুন আশা নিয়ে। এই গনতন্ত্রে ফিরে যাওয়া ১৯৯১ সালের মতো নয়, কিংবা ১৯৭২ সালের নব্য স্বাধীন দেশের মতোও নয়। আমরা গত ৩৮ বছরে অনেক তন্ত্র দেখেছি, কিন্তু ১/১১ এর পর আমরা যা দেখেছি তার সাথে কোন কিছুর তুলনা হবে না। আমরা অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য অনেক কিছু দেখেছি গত দুবছরে। অনেক পরাক্রমশালী উজির নাজিরকে পরাভুত হতে দেখেছি গত দুবছরে। হয়তো তারা আবার উঠে দাড়াবেন। কিন্তু আগের মতো করে কী? মনে হয় না। আমরা কী শিখলাম গত দুবছরে? আমরা শিখলাম টাকা, ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি সবকিছুরই একটা শেষ আছে। অসীমতার কোন ধারনা এখানে বাতুলতা মাত্র। যারা অসীম ক্ষমতাবান বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্ঠা করেছে একসময়, তাদের পরিনতি আমরা দেখেছি, দেখে আমরা কিছু শিক্ষা নিয়েছি। আমরা আর সে পথে যাবো না।
আওয়ামী লীগ ইতিহাস বিরল জয় পেয়েছে নির্বাচনে। কেন পেয়েছে সেটা ব্যাপক গবেষনার বিষয়, কোটি মানুষের মনস্তত্বের বিষয়। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে মানুষ বিরক্ত হলে কাউকেই ছাড়ে না। জনগন ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে ৬৩ আসনে নামিয়ে দিয়েছিল বলে আমরা চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই জনতা ২০০৮ সালে আবার বিএনপিকে আছাড় দিয়ে ২৯ আসনে ছুড়ে ফেলেছে। আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম। গণ রায় কখনো কখনো এমন নিষ্ঠুরও হতে পারে!! কিন্তু এমন আছাড় দেয়ার কারন আমরা প্রায় সবাই জানি। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই সিগন্যাল পেয়ে গেছে এর মাধ্যমেই। আশা করা যায় তারা ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে। আমরা কখনো ভুল করিনি, করতে পারি না – এধরনের বাকোয়াজি কথা জনগন গ্রহন করে না। যারা আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়েছে তারাও না। বরং বিজয়ীদের বিনয় পছন্দ করে জনগন। আমরা সে বিনয় আশা করবো আওয়ামী লীগের কাছ থেকে। আর আশা করবো নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতিগুলি একে একে বাস্তবায়ন করবে। কোন ছলচাতুরীর আশ্রয় নেবে না। কোন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে সেটার জন্য যথাযথ ব্যাখ্যা দেবে, কিন্তু বাজে অজুহাতে এড়িয়ে যাবে না কিংবা ঠাট্টার সুরে উড়িয়ে দেবে না।

বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের হতদরিদ্র দেশগুলোর একটা হলেও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বড় ধরনের কোন সমস্যা নেই। যেটা আছে ভারতে, পাকিস্তানে, শ্রীলংকায়, বার্মায়, নেপালে। প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্যাগুলো অনেক কম সহিংস। একটু কম স্বার্থপর, একটু কম অসহিষ্ণু, একটু কম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত, একটু কম ক্ষমতালোভী হলে আমরা অনেক সমস্যার সমাধান বাইরের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই করতে পারি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ অনেক বছর ধরেই মোটামুটি স্থিতিশীল। রপ্তানী প্রতিবছরই বাড়ছে, বিনিয়োগ বাড়ছে, রেমিটেন্স বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। প্রতিবেশী অনেকের তুলনায় এখনো আমরা হয়তো পিছিয়ে, কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রা অনেক স্বচ্ছল হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা বিশ্বের ৪৮তম বৃহত্তম অর্থনীতি। এটাকে হেলাফেলা করা যায়না কিছুতেই। আমাদের নিজেদের অবস্থান নিজেদেরই জানান দিতে হবে। গতবছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের মুখেও বাংলাদেশ টিকে গেছে শেষ পর্যন্ত। খাদ্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ন আমরা। যেটুকু আমদানী করতে হয় সেটাও করতে হবে না, যদি আমরা কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক সমন্বয় ঘটাতে পারি।

নতুন সরকারের কিছু করনীয় বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই।
– জনজীবনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে সর্বপ্রথমে। আইন-শৃংখলা সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রনে থাকতে হবে।
– পুলিশের সাথে চোর-চ্যাচ্ছর সন্ত্রাসীদের ভালোবাসা বন্ধ করতে হবে। দলীয় গডফাদার-সন্ত্রাসীর উত্থান গোড়াতেই রোধ করতে হবে।
– শিক্ষার হার বাড়াতে হবে। বাংলা-ইংরেজী-মাদ্রাসা এই তিন ধরনের শিক্ষাকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।
– বিদ্যুত উৎপাদন বাড়াতে হবে। ছোট ছোট বিদ্যুত প্রকল্প প্রাইভেট সেক্টরে গ্রামগন্জে ছড়িয়ে দেয়া যায়।
– খনিজসমূহকে বিদেশী শকুনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। দেশবিরোধী কোন গোপন চুক্তি যেন না হয়।
– কৃষককে আর কৃষিজমিকে রক্ষা করতে হবে। বিদেশী হাইব্রীডের চেয়ে দেশী হাইব্রীডে জোর দিতে হবে।
– জঙ্গীবাদ বা যে কোন অশুভ শক্তির উত্থান রোধ করতে হবে। কঠোর আইন করতে হবে। কোন কোন সন্ত্রাসীর জন্য বিনা বিচারে ক্রসফায়ার চালু রাখতে হবে।
– স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, বিচার না করার জন্য কোন বিদেশী চাপ থাকলে জনগনকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে।

– অপ্রয়োজনীয় আমদানী নিরুৎসাহিত করতে হবে। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে হবে।
– বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের সমস্যার ব্যাপারে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। সবচেয়ে বেশী ডলার যোগানদাতা এই শ্রেনীকে সম্মানের সাথে সাহায্য করতে হবে।
– দেশে বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানাগুলো চালু করতে হবে, নাহয় বিক্রি করে নতুন কারখানা করতে হবে। বন্ধ কারখানা হলো সম্পদের অলস অপচয়।

আফ্রিকার ক্ষুধা-সন্ত্রাস পীড়িত দেশগুলোর দিকে যখন তাকাই, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের আগুন ঝরানো শহরগুলো, বাংলাদেশকে মনে হয় সোনার বাংলা। আমাদের তেমন কোন বড় সমস্যা নাই। অনেক বেশী শান্তিতে আছি আমরা এখনো। খুড়ে খুড়ে নতুন সমস্যা আবিষ্কার না করে পুরোনোগুলোকে আগে সমাধান করি। সবাই মিলে মিশে কাজ করি। নিজের দেশকে ভালো বাসি। আমরা নিশ্চয়ই ভালো থাকবো।

নীড় সন্ধানী

অদেখা স্বপ্নের ব্যাপ্তিটা প্রতিদিন বিস্তৃত হতে থাকে.........

৫ comments

  1. mohammed abdul quddus - ১ জানুয়ারি ২০০৯ (৮:৪৮ অপরাহ্ণ)

    We may add these items if the writer agrees:

    1.Student politics should be banned
    2.All kinds of (political & non political) muscle power
    should be controlled immediately.
    3. Any kind of murder in the country should be followed by proper investigation and the victims should get justice which is missing in our country.

    • রায়হান রশিদ - ১ জানুয়ারি ২০০৯ (৯:৪১ অপরাহ্ণ)

      @মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস # ১

      আপনি প্রস্তাব দিয়েছেন: “Student politics should be banned”

      এবারের নির্বাচনে ভোটারদের ৩২%-ই ছিলেন নবীন, যাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ছিলেন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। তাঁরা ইতোমধ্যেই ভোট দানের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে ফেলেছেন, যা দেশব্যাপী প্রশংসিতও হয়েছে। এই তরুণ ভোটারদের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও অংশগ্রহণ না থাকলে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের নির্বাচনে এই ভরাডুবি হতো কি না সন্দেহ। কারণ এই তরুণরাই সারা দেশ জুড়ে গত মাসাধিককাল ধরে যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন এই ইস্যুগুলো নিয়ে সোচ্চার ছিলেন, যার প্রতিফলন আমরা নির্বাচনের ফলাফলে দেখেছি।

      ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিষয়টি খুব সাদা-কালো নয় বলেই এই মন্তব্যটি করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার সহজ বোধে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির দুটো ধারা বিদ্যমান। একটি সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-টেন্ডার-দখলদারিত্বের নীতিহীন রাজনীতি, যাতে অনেক সময় বড় দলগুলোর ছাত্র সমর্থকরা সামিল হয়। আরেকটি ধারা হল নীতি আদর্শনির্ভর, গণমুখী, দেশপ্রেমী ছাত্র আন্দোলনের ধারা। পরের ধারাটিও প্রথমটির মতোই বাস্তব ও শক্তিশালী। পরের ধারাটি যদি না থাকতো, তাহলে আমরা ‘৬৯ পেতাম না, ‘৭১ পেতাম না, ‘৯০ পেতাম না। এমনকি ২০০৯-এ যুদ্ধাপরাধীমুক্ত সংসদও পেতাম না।

      মাথাব্যথা থাকলে সেটির চিকিৎসা করতে হবে, মাথা কেটে ফেলা মনে হয় না এর কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান। আর ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিলেই প্রথম ধারাটি যে নিষ্ক্রিয়/নির্মূল হয়ে যাবে, সে আশাবাদেরও মনে হয় না কোনো যৌক্তিক ভিত্তি আছে। কারণ, যারা প্রথম ধারাটির অনুসারী, তারা কি আসলে “ছাত্র”? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আস্তানা গাড়লেই কি কেউ “ছাত্র” হয়ে যায়? আজ যদি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হয়, আমার মনে হয় না তাদের কর্মকাণ্ড কোনো দিক থেকে বাধাগ্রস্ত হবে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে আস্তানা গেড়ে তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তখন না হয় বাইরে থেকেই চালাবে। এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার জন্য এখনও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষা করতে হয় না, তখনও হবে না।

      আর প্রথম ধারাটিকে নির্মূল করার নামে (যা আদৌ এভাবে নির্মূল হবে কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে) দ্বিতীয় ধারাটিকেও যদি আমরা নির্মূল করে দিই, তাহলে কি আমরা এ জাতিকে আরো সর্বনাশা ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবো না? কারণ, কর্মহীন আদর্শহীন নীতিহীন রাজনৈতিক চেতনাবিহীন অন্ধকার স্যাঁৎসেঁতে পরিবেশে যারা বৃদ্ধি লাভ করে তারা হল পরজীবী আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর কিছু প্রাণী। আমাদের উজ্জ্বল তরুণ সমাজকে কি আমরা সেই পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে চাই?

      তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি আমাদের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গর্বিত। এর ধরণ ও প্রক্রিয়ায় কোনো সংস্কার আনা যায় কিনা, সে এক ভিন্ন বিতর্ক। তবে আপনার ২ এবং ৩ নম্বর প্রস্তাবের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত।

      • নীড় সন্ধানী - ৪ জানুয়ারি ২০০৯ (১১:০৮ পূর্বাহ্ণ)

        ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সংজ্ঞাগত একটা ভুল বোঝাবুঝি কাজ করে সবসময়। আসলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ বলতে কী ছাত্রদের রাজনীতি করা নিষিদ্ধ করতে চাই নাকি শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ চাই সেটা পরিষ্কার করা উচিত সবার আগে।

        আমি চাই শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ হোক। সেটা ছাত্র কিংবা শিক্ষক অথবা কর্মচারী যাই হোক। শিক্ষার পরিবেশ নিরুপদ্রপ রাখার জন্য ক্যাম্পাসকে সবরকম রাজনৈতিক হাতিয়ারমুক্ত রাখা জরুরী।

        রাজনীতি যেন হল দখলের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
        ছাত্রসমাজ যেন রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিনত না হয়।
        উন্নত দেশ থেকে আমরা সিনেমা নাটক পোষাক মোবাইল কম্পিউটার সবকিছু আমদানী করি, কিন্তু সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেন আমদানী করতে পারি না?
        উন্নত দেশের ছাত্রসমাজ কীভাবে রাজনীতি করে? ক্যাম্পাসে করে না রাজপথে?
        কেউ কী আলোকপাত করবেন অন্য দেশের ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে?

    • মুক্তাঙ্গন - ১ জানুয়ারি ২০০৯ (৯:৪৭ অপরাহ্ণ)

      @ mohammed abdul quddus

      সাইটে বাংলা লেখার সুবিধার্থে বেশ কয়েকটি বাংলা কীবোর্ড (বিজয়, ইউনিজয়, ফোনেটিক, প্রভাত, ইনস্ক্রিপ্ট) সংযুক্ত করা আছে। এছাড়াও আপনি চাইলে মাউস ক্লিক করেও বাংলা লিখতে পারবেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত সাহায্য এই লিন্কটিতে দেয়া আছে। এরপরও কোন প্রশ্ন থাকলে বা সাহায্য দরকার হলে জানাতে দ্বিধা করবেন না।
      আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

  2. রেজাউল করিম সুমন - ১ জানুয়ারি ২০০৯ (৮:৪৯ অপরাহ্ণ)

    ভালো লাগল আপনার এই গঠনমূলক লেখাটা। ধন্যবাদ আপনাকে।

    নতুন সরকারের কিছু করণীয় বিষয়ের প্রতি আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। আমি দুটি বিষয়ে আপনার ভাবনাটা একটু বিশদে জানতে চাইব :

    […] বাংলা-ইংরেজী-মাদ্রাসা এই তিন ধরনের শিক্ষাকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।

    […] কোনো কোনো সন্ত্রাসীর জন্য বিনা বিচারে ক্রসফায়ার চালু রাখতে হবে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.