এই বিশ্লেষণমূলক তথ্যবহুল পোস্টটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞা, নুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল, আইকম্যানের বিচার, সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মিলোসেভিচের যুদ্ধাপরাধের বিচার, রুয়ান্ডা ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সে সবের আলোকে বর্তমানের আন্তর্জাতিক আইন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আনুষঙ্গিক পূর্ব ইতিহাস এবং বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটের মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাটিতে।

ভূমিকা

একাত্তর সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকেরা একটি অন্যায় যুদ্ধ এ ভূখন্ডের বাঙ্গালীদের ওপর চাপিয়ে দেন। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ করে তা ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে সমগ্র ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড়ে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙ্গাঁলী জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য হানাদার বাহিনী হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ সমগ্র বাংলাদেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। সেনাবাহিনীর সকল কর্মকান্ডে, যা কিনা ছিল মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ, জামাতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেন। হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের মত কর্মকান্ডে সমর্থন দিয়েই তারা বসে থাকেনি, মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে জামাতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আলশামস ইত্যাদি বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। এসব সহযোগী বাহিনীর সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে পাকিস্তানের সেনা সদস্যদের চেয়ে পিছিয়ে ছিল না।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাঙ্গাঁলী জনগোষ্ঠীর ওপর যে হিংস্রতা ও বর্বরতা করেছে সেটি ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। যুদ্ধাপরাধ, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করার দায়ে পাক সেনাদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বঙ্গঁবন্ধু সরকার এব্যাপারে নানা উদ্যোগ নিলেও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা, কুটনৈতিক চাপ ও সর্বোপরি পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গাঁলীদের কথা চিন্তা করে পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের বিচার সম্ভব হয়নি। তবুও যে ১৯৫ জন সেনা সদস্যকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের বিচার করে শাস্তি দেয়া গেলে সেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি প্রতীকী আবেদন তৈরি করত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গঁনে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে আরও একটি উত্তম দৃষ্টান্ত হত।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ জারি করে। ১৯৭২ সালের ২৯ আগষ্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ-এ তিনটি সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সারা বাংলাদেশ থেকে এ আদেশের অধীনে ৩৭ হাজার ৪ শ ৯১ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে বঙ্গঁবন্ধু সরকার ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। যেসকল মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার মধ্যে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৮শ ৪৮ টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত হয়েছিলেন, ২০৯৬ জন ছাড়া পেয়েছিলেন।

১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর দালাল আইনে আটক যে সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই তাদের জন্য সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। তবে সাধারণ ক্ষমার প্রেসনোটে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে – ‘ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজ-অগ্নিসংযোগের দায়ে দন্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমাপ্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।’ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক ১১ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি এসকল অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। সপরিবারে বঙ্গঁবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে য্দ্ধুাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। দালাল আইন বাতিল হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী গণহত্যার সাথে জড়িত পাকিস্তানিদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আলশামস-এর সদস্যদের বিচার এখনও করা সম্ভব।

এ প্রবন্ধে আমি গণহত্যা, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ কি, কোন্ কোন্ আন্তর্জাতিক আইনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে তা আলোচনা করেছি। এরপর আমি নুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল, আইকম্যান কেইস, কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোশ্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মিলোসেভিচ-ট্রায়াল বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। সবশেষে আমি বলতে চেয়েছি যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যেসকল সহযোগী এখনও বেচে আছে যারা ৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল এখনও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ এর অধীনে অথবা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তাদের বিচার সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সরকারি কার্যকর উদ্যোগ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ

আন্তর্জাতিক অপরাধ বলতে সেসকল অপরাধ বুঝায় যা আন্তর্জাতিক সমাজের ভিত্তিমূল ধরে নাড়া দেয় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি ও ন্যায়পরতার বোধকে মারাত্মকভাবে আহত করে। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে আন্তর্জাতিক আইনের নীতিমালাকে এমন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে তা যুদ্ধ আইন ও যুদ্ধাপরাধীদের সংজ্ঞায়ন ও শাস্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আন্তর্জাতিক আইন কমিশন ১৯৫০ সালে এর দ্বিতীয় অধিবেশনে আন্তর্জাতিক আইনের যেসকল নীতিমালা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের রায়ে বিবৃত হয়েছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত ভাষ্য প্রদান করে। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল তিন ধরণের অপরাধকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য বলে চিহ্নিত করে, সেগুলো হচ্ছে:

১) শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ;

২) যুদ্ধাপরাধ;

৩) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

নুরেমবার্গ চার্টারের ৬ অনুচ্ছেদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও প্রতিশ্র“তি লংঘন করে যুদ্ধ বা আগ্রাসনের জন্য যুদ্ধের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি বা উদ্যোগ গ্রহণ করলে তাকে শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। নুরেমবার্গ চার্টার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, বর্ণ বা গোত্রগত কারণে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর কোন সদস্যকে যুদ্ধের আগে বা যুদ্ধ কালীন সময়ে হত্যা, নির্যাতন, বন্দী, অপহরণ, ধর্ষণ বা অন্য কোন অমানবিক উপায়ে নির্যাতন করা হলে তাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের রিপোর্টের ৪ নম্বর নীতি ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন এর ৩ নম্বর ধারায় যুদ্ধাপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ বলতে যুদ্ধের আইন ও রীতিনীতি লংঘন করে বেসামরিক জনসাধারণকে হত্যা, নির্যাতন বা বাধ্যতামূলক শ্রমের জন্য নির্বাসনকে বুঝাবে। এছাড়া অধিকৃত ভুখন্ডে অথবা সমুদ্রপথে যুদ্ধবন্দি অথবা বেসামরিক লোকজনকে হত্যা বা নির্যাতন, জিম্মি হত্যা, সরকারি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুন্ঠন, নগর বা গ্রামের মারাত্মক ক্ষতিসাধনকে যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য করা হবে।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত জেনোসাইড কনভেনশনের ২ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ এর ৩ ধারায় গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত, ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক কোন সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে নির্মূল করার জন্য ঐ সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা অথবা মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন, অথবা ঐ সম্প্রদায়ের মধ্যে জোরপূর্বক জন্মনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা ঐ সম্প্রদায়ের শিশুদেরকে অন্য সম্প্রদায়ের কাছে হস্তান্তরকে গণহত্যা বলে বিবেচনা করা হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত অপরাধ ও নুরেমবার্গ ট্রায়াল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হয়েছে তা ছিল মানজাতির ইতিহাসে নজিরবিহীন। জার্মানীর সেনাবাহিনী হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেছে যা ছিল মানবাধিকরের চরম লংঘন। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার জন্য মিত্রবাহিনীর সদস্যদের প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী পরবর্তীতে নুরেমবার্গ ট্রায়াল ও টোকিও ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৩ সালের ৩০ অক্টোবর মস্কো সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণায় বলা হয় যে, মিত্রশক্তিভুক্ত সরকারগুলোর যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধান প্রধান যুদ্দাপরাধী, যাদের অপরাধ কোন ভৌগলিক সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, তাদের দণ্ড দেয়া হবে। ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন লন্ডনে ফ্রান্স, সোভিয়েট ইউনিয়ন, বৃটেন ও আমেরিকা সরকারের প্রতিনিধিরা মিলিত হন ইউরোপের প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সাধারণ করণীয় নির্ধারণ করার জন্য। ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট তারা অক্ষশক্তির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যেটির সঙ্গেঁ ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের চার্টায় সহগামী হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল ৪ জন সদস্যকে নিয়ে যাদের প্রত্যেকেরই একজন করে বিকল্প ছিলেন। উল্লেখিত চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকে ট্রাইব্যুনালে একজন বিচারক ও একজন বিকল্প বিচারক নিয়োগ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের চার্টার নুরেমবার্গ ট্রায়ালের এখতিয়ার সংজ্ঞায়িত করে দিয়েছিল। বলা হয়েছিল ট্রাইব্যুনাল সেই সকল ব্যক্তি যারা ব্যক্তিগতভাবে অথবা কোন সংগঠনের সদস্য হিসেবে ইউরোপীয় অক্ষশক্তির স্বার্থে কাজ করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধ ও শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে তাদের বিচার করতে পারবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী, মূলতঃ জার্মান সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচার হয়েছিল নুরেমবার্গে, সেজন্যে যুদ্ধাপরাধীদের এ বিচারটি নুরেমবার্গ ট্রায়াল বলে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। বিচার চলার সময় অভিযুক্তদের পক্ষে অনেক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যে, অপরাধের সময়ে কার্যকর ছিল না এমন কোন আইনের অধীনে অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া যাবে না। এ যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে সেই নীতিটি যেটি পরে প্রণীত কোন আইন দিয়ে পূর্বে কৃত কাজকে অপরাধ বলে গণ্য করে কোন ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানকে বারণ করে। অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনে সরকার ও উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের আদেশের কথা বলেন যেটিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা গ্রহণ করেননি। ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্যগ্রহণ, শুনানী ও আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষ হয় ১৯৪৬ সালের ৩১ আগস্ট।

২২ জন ব্যক্তিকে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিচারিক কার্য শেষ হওয়ার পর রায় দেয়া হয় ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর। ২২ জনের মধ্যে ১ জনকে শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং ২জনকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার দায়ে শাস্তি প্রদান করা হয়। বাকীদের শাস্তি দেয়া হয় যুদ্ধাপরাধ ও চার্টার বর্ণিত অন্যান্য অপরাধ করার জন্য। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল এর রায়ে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করে। ৩ জনকে মুক্তি প্রদান করা হয়। রায়ে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিচারকগণ অভিযুক্তদের পক্ষের যুক্তিতর্ক প্রত্যাখ্যান করে বলেন, নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যা, নির্যাতন, অঙ্গঁহানি, অপমান ইত্যাদি সকল সভ্য জাতির মূল্যবোধ দ্বারা নিন্দিত এবং জাতীয় আইন ব্যবস্থা দ্বারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিচারকগণ বলেন, যারা উল্লেখিত কর্মকান্ডগুলা করেছে তাদের জানা উচিত ছিল যে, তারা যা করেছে তা অন্যায় যা কখনোই শাস্তি কাঠামোর বাইরে থাকতে পারে না। মানব ইতিহাসের ভয়ংকরতম অপরাধ যারা করেছে তাদের যদি শাস্তি দেয়া না হয় তবে সেটি হবে অন্যায় ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিচারকগণ বলেন, ট্রাইব্যুনাল যে বিধি বিধানগুলো প্রয়োগ করেছে সেগুলি এর পুর্বে কার্যকর আন্তর্জাতিক আইন না হলেও, সেগুলো সকল জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য কার্যকর নৈতিকতা বলে স্বীকৃত। ট্রাইব্যুনাল এর রায়ে বলে যে, ১৯২৮ সালের প্যারিস চুক্তি ভঙ্গঁ করে অন্যান্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসী যুদ্ধ পরিচালনার জন্য জার্মানী দায়ী। এজন্য দায়ী ব্যক্তিদের ট্রাইব্যুনাল শাস্তি প্রদান করে। ঊর্ধŸতন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের আদেশ সম্পর্কে বলা হয় যে, সরকার বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ একজন ব্যক্তিকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে দায়মুক্ত করে না।

টোকিও ট্রায়াল

যেসকল নীতিমালার ভিত্তিতে জার্মানীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছিল ঐ একই নীতিমালার ভিত্তিতে জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য টোকিও ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভকারী রাষ্ট্রগুলো ১৯৪৫ সালের ২০ জুলাই পটসডামে গৃহীত ঘোষণা অনুযায়ী টোকিও ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ১৯৪৫ সালের ১৯ জানুয়ারি “ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দি ফার ইস্ট”-এর চার্টার অনুমোদিত হয়। ১৯৪৬ সালের ৪ জুন টোকিওতে জাপানের য্দ্ধুাপরাধীদের বিচার কাজ আরম্ভ হয়। ১১জন বিচারক নিয়ে গঠিত টোকিও ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্যার ইউলিয়াম ওয়েব। এ ট্রায়ালে ২৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল যাদের মধ্যে ২ জন মামলা চলাকালে মারা যায় এবং ১ জনকে মানসিক ভারসাম্য হারানোর ফলে ছেড়ে দেয়া হয়। অভিযুক্তদের যেসকল অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, সেগুলো হচ্ছে: য্দ্ধুাপরাধ, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ।

বিচার চলার সময়ে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের গঠন সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করে বলা হয় যে, যেসকল বিচারক এ ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে বিচারিক দায়িত্ব পালন করছেন তারা নিরপেক্ষ নন, কেননা তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে জয়লাভকারী রাষ্ট্রগুলোর বিচারক ও আইনজ্ঞদের মধ্য থেকে। বিচারকগণ এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এটা সত্য যে তারা জয়লাভকারী বিভিন্ন রাষ্ট্রের সদস্য, তবে তারা ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন ব্যক্তিগত যোগ্যতায়। ১৯৪৮ সালের নবেম্বর মাসে ট্রাইব্যুনাল এর রায় ঘোষণা করেন এবং যারা যুদ্ধ সংঘটিত ও পরিচালিত করেছিলেন তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন এবং যারা যুদ্ধাপরাধ, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিলেন তাদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করেন।

নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের গঠন, কার্যপদ্ধতি ও রায় নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য সমালোচনা রয়েছে। বিশেষ করে বিজয়ী শক্তি নিজেই বিচারক সেজে পরাজিতদের শাস্তি দেয়ার (the victors acting as judges in their own causes) অভিযোগটি গুরুতর। ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও এ দুটি ট্রাইব্যুনালের অর্জন মানবজাতির ইতিহাসে তুলনারহিত। কেননা ট্রাইব্যুনালের বিচারকগণ সকল জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য কিছু আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যারা হত্যা, নির্যাতন, অত্যাচার ও ব্যাপক ধবংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতের যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে এটি একটি শক্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এছাড়া যেসকল নীতিমালার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালগুলো তাদের রায় প্রদান করে পরবর্তীতে সেগুলো আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিধানে পরিণত হয়।

আইকম্যানের মামলা

জার্মানীর শাসক হিটলারের শাসনামলে আইকম্যান (Eichmann) শত শত ইহুদীকে হত্যা করেন অথবা তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আইকম্যান একদেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। অবশেষে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আর্জেন্টিনায় আইকম্যানকে ধরে ফেলে এবং সেখান থেকে তাকে অপহরণ করে ইসরাইলে নিয়ে আসে, কেননা তাদের আশংকা ছিল আর্জেন্টিনার সরকার আইকম্যানকে ইসরাইলের কাছে হস্তান্তর করতে সম্মত নাও হতে পারে। ইসরাইলের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব জেরুজালেম বিচারের পর আইকম্যানকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আইকম্যান ইসরাইলের সুপ্রিম কোর্টে একটি আপীল দায়ের করেন (Adolf Eichmann V. Attorney General of the Government of Israel, Supreme Court of Iserael, ILR 36 (1962) P. 277)। ইসরাইলের সুপ্রিম কোর্টে আইকম্যানের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তার কৃত কর্মকান্ডের বিচার করার এখতিয়ার ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব জেরুজালেমের নেই, কেননা সেই সময়ে ইসরাইল রাষ্ট্র ও বিচারকি আদালতের কোন অস্তিত্ত্ব ছিল না। আইকম্যান আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যা করেছেন সেটি রাষ্ট্র ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে করেছেন। তিনি আরও বলেন যে, তাকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে ইসরাইলে আনা হয়েছে। তিনি বিচারিক আদালতের এখতিয়ার ও কার্যপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ইসরাইলের সুপ্রিম কোর্ট আইকম্যানের যুক্তিতর্ক প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আইকম্যান যে অপরাধগুলো করেছেন সেগুলো বিশ্ববিবেক কর্তৃক নিন্দিত এবং সকল রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থা কর্তৃক অপরাধ বলে স্বীকৃত। আদালত বলেন যে, যারা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অপরাধ করেছে (যেমন যুদ্ধাপরাধ), বিশ্বের যে কোন দেশের যে কোন আদালত তাদের অপরাধের বিচার করতে পারে। কেননা এক্ষেত্রে আদালতের এখতিয়ার বিশ্বজনীন।

সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল

১৯৯২ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সাবেক যুগোশ্লাভিয়া ভুখন্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিশন গঠন করে। কমিশন এর রিপোর্টে ১৯৯১ সাল থেকে সাবেক যুগোশ্লাভিয়াতে যারা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লংঘন করেছে তাদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে বলে। কমিশন উল্লেখ করে যে তাদের কাছে হাজার হাজার পাতার তথ্য প্রমাণ রয়েছে কিভাবে জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লংঘিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৯৩ সালের ২২ ফের্রুয়ারী একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের মহাসচিবকে পরিষদের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য তার মতামত প্রদানের অনুরোধ জানায়। পরবর্তীতে নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৯৩ সালের ২৫ মে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সিদ্ধান্তে ট্রাইব্যুনালের ৩৪টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত সংবিধিটি অনুমোদিত হয়। সংবিধিতে বলা হয় যে, ট্রাইব্যুনাল নিরাপত্তা পরিষদের একটি সহায়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। কোন রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই ট্রাইব্যুনাল তার কর্মকান্ড পরিচালনা করবে এবং নিরাপত্তা পরিষদ কোনভাবেই ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ কর্তৃক “ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল” গঠন এটাই প্রথম। এ ট্রাইব্যুনালকে সাবেক যুগোশ্লাভিয়া ভু-খন্ডে যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল তাদেরকে বিচারের এখতিয়ার দেয়া হয়। গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনাল বসনিয়ার সার্ব নেতৃবৃন্দ ও সামরিক কমান্ডারদের অভিযুক্ত করে। বিদ্রোহী সার্বদের নেতৃবৃন্দ যারা যাগনাব ও ক্রোয়েশিয়ায় ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করেছিল তাদেরও অভিযুক্ত করা হয়। বসনিয়া ও বোসানস্কি সানাকের বন্দী ক্যাম্পগুলোতে যারা অপরাধ করেছিল তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।

১১ সদস্য বিশিষ্ট সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ১৯৯৩ সালের ১৭ নবেম্বর নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে উদ্বোধন করা হয়। উল্লেখ্য, এ ট্রাইব্যুনালটি দুটি ট্রায়াল চেম্বার, একটি আপীল চেম্বার, প্রসিকিউটর ও রেজিস্ট্রি নিয়ে গঠিত হয়েছিল। ইতালীর বিচারক এ্যান্টোনিয়া ক্যাসেসি (Antonia Cassese) আন্তর্জাতিক এ ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ভেনেজুয়েলার রোমান এস্কভার সালাম (Roman Escvar Salam) ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালের ১৭ থেকে ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত দু’সপ্তাহ ধরে এ ট্রাইব্যুনালের প্রথম অধিবেশন চলে। ১৯৯৫ সালের ১২ ফেব্র“য়ারী সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম বহিঃ সমর্পণ করা হয়। ১৩ ফেব্র“য়ারী বসনিয়ার একজন সার্ব জেনারেল ও কর্ণেলকে নেদারল্যান্ডসের কারাগারে নিয়ে আসা হয়।

সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসেভিচের যুদ্ধাপরাধের বিচার

সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লে­াবোদান মিলোসেভিচ তার শাসনামলে মুসলমানদের ওপর যে গণহত্যা ধর্ষণ, নির্যাতন চালিয়েছেন সেটি একদিকে যেমন লোমহর্ষক, অন্যদিকে মানবজাতির ইতিহাসে তার নজির খুব কমই রয়েছে। ২০০১ সালের ৩ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল ট্রাইব্যুনাল মিলোসেভিচের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পড়ে শোনায়। ১৯৮৮-৮৯ সালে তার শাসনকালে জেনেভা কনভেনশন লংঘন করে কসোভোর জাতিগত আলবানিয়ানদের যেভাবে মিলোসেভিচ হত্যা, নির্যাতন ও নির্বাসন করেছিলেন সেজন্যই ৫৯ বছর বয়স্ক এ সাবেক প্রেসিডেন্ট অভিযুক্ত হন। স্লোবোদান মিলোসেভিচকে ৩০ দিন সময় দেয়া হয়েছিল তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য, কিন্তু তিনি ১২ মিনিটের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন ন্যাটোর সদস্যরা যুগোশ্ল­াভিয়াতে যে যুদ্ধাপরাধ করেছিল তাকে বৈধতা দেয়াই হচ্ছে এ ট্রাইব্যুনাল গঠনের উদ্দেশ্য। ট্রাইব্যুনাল গঠনকে অবৈধ উল্লেখ করে তিনি তার পক্ষে এমনকি আইনজীবী নিয়োগ করতেও অস্বীকার করেন। ২০০২ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি মূল বিচার কার্যক্রমটি আরম্ভ হয়। ঐদিন জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক অভিযোক্তা (প্রসিকিউটর) কারলা ডেল পেন্ট (Carla Del Pente) বলেন যে, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও কসোভোতে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার দায়ে মিলোসেভিচ অপরাধী। উল্লেখ্য যে, ২০০৬ সালের ১১ মার্চ মিলোসেভিচকে তার সেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ফলে রায় প্রদানের আগেই তার যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।

রুয়ান্ডা ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

১৯৮০ এর দশকের শেষদিকে রুয়ান্ডাতে হুতুদের সঙ্গেঁ তুতসিদের জাতিগত বিরোধে তুতসিরা প্রায় ১ লক্ষ হুতুকে হত্যা করে। ১৯৯৪ সালের ৮ নবেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল রুয়ান্ডা ও আশপাশের রাষ্ট্রে যারা জেনেভা কনভেনশন ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গেঁ জড়িত ছিল তাদের শাস্তি প্রদান করা। নিরাপত্তা পরিষদ ট্রাইব্যুনালের জন্য জাতিসংঘ সনদের সপ্তম অধ্যায়ের অধীনে একটি সংবিধি অনুমোদন করে। সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় সেটি ইতিহাসে দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। ১৯৯৮ সালে ট্রাইব্যুনাল তার রায় প্রদান করে যাতে রুয়ান্ডার সাবেক প্রধানমন্ত্রি জ্যা কামবানন্দ (Jean Kambananda) ও টাবার সাবেক মেয়র জ্যা পল আকায়েশুকে (Jean Paul Akayesu) গণহত্যা ও মানতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

কম্ভোডিয়াতে সাবেক খেমাররুজ সরকার ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ব্যাপক গণহত্যা চালায়। গণহত্যার সঙ্গেঁ জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার জন্য কম্ভোডিয়া সরকার জাতিসংঘের পরামর্শ ও সহযোগিতায় একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। ২০০৭ সালের ২০ নবেম্বর ট্রাইব্যুনাল সাবেক খেমারুরজ প্রেসিডেন্ট খিউ সাম্পানকে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করে। এছাড়া, স্পেনের অনুরোধে চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট অগাস্টো পিনোচেটকে লন্ডনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তাকে স্বাস্থ্যগত কারণে মুক্তি দেয়া হয়।

আন্তর্জাতিক আইন ও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ লড়াই করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশের সহযোগীদের পরাজিত করে। পর্যুদস্ত ও বিধ্বস্ত পাকিস্তানী বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু ৯০ হাজারের অধিক পাকিস্তান সেনাবাাহনীর কর্মকর্তা ও সেপাইদের তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের না থাকায়, তাদেরকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসার পর থেকেই বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের যারা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গেঁ জড়িত ছিল তাদের বিচারের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সময়ে সময়ে যে তালিকা করা হয়েছিল তাকে কাটছাট করে চূড়ান্তভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জনের একটি তালিকা করা হয় যাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস-এর (ওঈঔ) কাছে এব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করে। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি সভা হয় যেখানে সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশ উল্লেখিত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে না যাদেরকে পরে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংরাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রি ও বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ডঃ কামাল হোসেন সম্প্রতি এব্যাপারে বলেছেন, ঐ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে পাকিস্তান উদ্যোগ নেবে এ প্রতিশ্র“তির প্রেক্ষিতে তাদেরকে তখন পাকিস্তানে যেতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে পাকিস্তান তাদের বিচার করেনি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যেসকল সদস্য ১৯৭১ সালে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের সঙ্গেঁ জড়িত ছিল, তাদের বিচারের ব্যাপারে বার বার দৃঢ় প্রতিশ্র“তি ব্যক্ত করার পরও বঙ্গঁবন্ধু সরকার নানারকম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ ও বাস্তবতার কারণে তাদের বিচার করতে পারেনি। তবে বঙ্গঁবন্ধু সরকার পাকিস্তানী বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের বিচারের ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাজাকার, আল বদর, ও আল শামস বাহিনীর যেসকল সদস্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সঙ্গেঁ জড়িত ছিল, তাদের বিচার করার জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ জারি করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ৩৭ হাজার ৪শ’৭১ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের পর ৭৫২ জন দালালকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ বাতিল করে দেয়া হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মত যুদ্ধাপরাধীরা পলাতক থাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকার তাদের বিচার করতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে এসকল যুদ্ধাপরাধীরা আবার রাজনীতির মাঠে ফিরে আসে। বিশেষ করে জামাতে ইসলামী ও এর অঙ্গঁ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য দিতে থাকে। ক্রমাগত এদের বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য, হিংস্র ও বর্বর কর্মকান্ড সাধারণ মানুষকে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তোলে। ১৯৯১ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সারাদেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ধর্মভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। শহীদ জননীর নেতৃত্বে জনতার আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কোন সরকারই গণ আদালতের রায় কার্যকর করেনি। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডঃ ফখরুদ্দিন আহমদ ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ডঃ এটি এম শামসুল হকের ইতিবাচক মন্তব্য এবং সেক্টরস কমান্ডারদের সম্মিলিত উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ব্যাপক জনমত গঠিত হয়েছে।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উত্থাপিত হওয়ায় জামাতে ইসলামী ও তাদের প্রতি যাদের সহানুভূতি রয়েছে তাদের পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সুশীল সমাজের মধ্যে অবস্থান নিয়ে একশ্রেণীর বর্ণচোরা বুদ্ধিজীবী জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। তারা বলছেন; ১। বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই; ২। বঙ্গঁবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না; ৩। মুক্তিযুদ্ধের ৩৬ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধুমাত্র পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যেসকল সদস্য গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের সঙ্গেঁ জড়িত ছিল তারাই শুধু যুদ্ধাপরাধী বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ এর ২ নম্বর ধারায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী কারা তা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ এর ৩ ধারায় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ দুটো আইনকে এক সঙ্গেঁ পড়লে এবং শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্য কারা ছিলেন তার সরকারি নথি দেখলেই এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, জামাতে ইসলামীর এখনকার নেতৃত্বের অনেকেই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গেঁ জড়িত ছিলেন।

দ্বিতীয় যে কথাটি জামাতী নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধজীবীরা বঙ্গঁবন্ধুর উদ্বৃতি দিয়ে বলতে চান সেটি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গঁবন্ধুর সরকার পাকিস্তানী বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের বিচারের জন্য বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ জারি করেছিলেন। এব্যাপারে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল তাদের ক্ষমা করা হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ বাতিল করে দেন।

তৃতীয় যে কথাটি জামাতীরা বলতে চান সেটি হচ্ছে, আদর্শিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তারা কোন ভুল করেননি। মুক্তিযুদ্ধের ৩৬ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারের কথা বলে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা এমন এক দুর্ভাগা জাতি যে, যে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা জামাতে ইসলামী নেতৃবৃন্দ করেছিলেন, সেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসেই তারা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে মূল বিষয় হচ্ছে ৩৬ বছরের দোহাই দিয়ে তারা বিচারের দায় এড়াতে চান, যদিও এ বিষয়ে আইন তাদের সহযোগিতা করবে না। কেননা দণ্ড আইনের সাধারণ নীতি হচ্ছে কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে তার বিচার সময় দ্বারা তামাদি হয়ে যায় না। উপরন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শাস্তির ব্যাপারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন আরও কঠোর। ৩৬ বছর কেন, ১০০ বছর পরেও বাংলাদেশ বা বিশ্বের যে কোন দেশের আদালত অথবা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে।

বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ বাতিল হয়ে গেলেও, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ এখনও বলবৎ রয়েছে। এ আইনের অধীনে বর্তমান সরকার অফিসিয়াল গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একাধিক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অনতিবিলম্বে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ আরম্ভ করতে পারেন।

উপসংহার

আন্তর্জাতিক আইনে এবং সকল সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের জাতীয় আইনে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে বর্বরতম অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকে এ পর্যন্ত গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গেঁ জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। অনেক দেশের আদালত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অথবা উভয় আইন প্রয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দিয়েছে।

গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বিভিন্ন আইন, চুক্তি ও সংবিধিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তির জন্য ১৯৪৮ সালের কনভেনশন, ১৯৪৬ সালের নুরেমবার্গও টোকিও ট্রাইব্যুনালের সংবিধি, যুদ্ধের আইন ও প্রথা বিষয়ক ১৯৪৯ সনের জেনেভা কনভেনশন, বৃটেন কর্তৃক গৃহীত জেনেভা কনভেনশন এ্যাক্ট, ১৯৫৭, সাবেক যুগোশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সংবিধি, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈৎরসরহধষ ঈড়ঁৎঃ) সংবিধি ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩।

উপরের আইনগুলোতে সুস্পষ্টভাবে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলতে কি বোঝায় তা বলা হয়েছে। এসকল অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের ব্যাপারে স্থান ও কালের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। এবিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক বা জাতীয় যে কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল যে কোন সময়ে ঐসকল ব্যক্তির বিচার করতে পারে। রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যে যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ প্রাণ দিয়েছেন, ২ লক্ষ বাঙ্গালী নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেই জামাতে ইসলামীর তৎকালীন নেতারা বসে ছিলেন না, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করে তারা গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজে অংশ নিয়েছিলেন। এখনও তারা বাংলাদেশের মাটিতে বসে সদম্ভে বাংলাদেশ বিরোধী কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন।

এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে কয়েকটি প্রস্তাব আমি উত্থাপন করছি :

১। কম্বোডিয়া সরকার যেভাবে গণহত্যার সঙ্গেঁ জড়িত খেমাররুজ নেতাদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের পরামর্শ ও সহযোগিতায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে, বাংলাদেশ সরকারও তেমনি করে জাতিসংেঘর পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারেন। অথবা;

২। নুরেমবার্গ বা টোকিও ট্রাইব্যুনাল অথবা অন্য কোন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মত কোন ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বর্তমান সরকার উদ্যোগ নিতে পারেন। এব্যাপারে জাতিসংঘের সহযোগিতায় প্রাথমিকভাবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিশন গঠন করা যেতে পারে যারা পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবেন। অথবা;

৩। সরকার জাতিসংঘের পরামর্শ ও সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, ইন্টারপোল ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করবেন। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেবেন।

সহায়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ তালিকা এবং তথ্যসূত্রঃ
১. Malcolm M. Shaw, International Law, Cambridge University Press, 1997.
২. J.G. Starke, Introduction to International Law, Butterworth and Co (Publishers) Ltd., First Indian Reprint 1994.
৩. H.O. Agarwal, International Law and Human Rights, Central Law Publications, 2002.
৪. S.K. Kapoor, International Law and Human Rights (Nutshell), Central Law Agency, 2003.
৫. M. Shah Alam, “Prosecuting the 1971 perpetrators of genocide, crimes against humanity and war crimes,” The Daily Star, January 5, 2008.
৬. Harun Ur Rashid, “International Laws and trials in Bangladesh,” The Daily Star, January 12, 2008.
৭. একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আহ্বান সম্বলিত একাত্তরটি সংগঠনের যৌথ ঘোষণা, ডিসেম্বর, ২০০৭।
৮. Md. Rahmat Ullah, “Trial of 1971 War Criminals: A Political Legal Fiasco,” Human Rights and Domestic Implementtion Mechanism, Empowerment through Law of the Common People (ELCOP), 2006, pp. 127-142.
৯. আইজ্যাক রবিনসন ও জাভেদ হাসান মাহমুদ, “যুদ্ধাপরাধ এবং জেনেভা কনভেনশনঃ বাংলাদেশ প্রেক্ষিত”, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার (সম্পাদক: শাহরিয়ার কবির), মে ২০০৭, পৃ. ১৬১-১৭২।
১০. জাভেদ হাসান মাহমুদ, “চৌধুরী মঈনউদ্দিন, যুদ্ধাপরাধ ও প্রাসঙ্গিঁক আইন”, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার (সম্পাদকঃ শাহরিয়ার কবির), মে ২০০৭, পৃ. ১৭৩-১৭৭।
১১. আবু সাইয়িদ, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা প্রেক্ষিত ও গোলাম আযম, পৃ. ৫৫।

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

৬ comments

  1. রায়হান রশিদ - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ)

    অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক মুহূর্তে এই লেখাটা পড়ার সুযোগ হল আমাদের সবার। কারণ আজই, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত “মুক্তাঙ্গনের বিশেষ ফোরাম” সাইটটি সবার অংশগ্রহণের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ফোরামটির ঠিকানা:

    http://www.nirmaaan.com/forums

    মুক্তাঙ্গনের পক্ষ থেকে সবাইকে দ্বি-ভাষিক এই ফোরামটিতে রেজিস্টার করার এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। কেবল সবার অংশগ্রহণ এবং মূল্যবান মতামতের মাধ্যমেই আমরা সম্মিলিতভাবে যুদ্ধাপরাধ বিচারের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রয়োজনীয় চিন্তার হাতিয়ারগুলো খুঁজে পাবো এবং তাকে আরো শাণিত করে নিতে পারবো। (যদিও এখনো কিছু টুকিটাকি কাজ বাকি আছে সাইটটিতে, তবে আলোচনা শুরু করে দেয়া যেতে পারে আজ থেকেই।)

    আর এই লেখাটি আমাদেরকে তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত প্রেক্ষাপট জোগাবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কার্জন স্যারকে অশেষ ধন্যবাদ।

  2. সৈকত আচার্য - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (২:১০ অপরাহ্ণ)

    অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু আইনগত তথ্য সমৃদ্ধ এই লেখাটি এই সময়ে বেশ জরুরী ছিল। কার্জন স্যারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনি লিখেছেন,

    কেননা দণ্ড আইনের সাধারণ নীতি হচ্ছে কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে তার বিচার সময় দ্বারা তামাদি হয়ে যায় না।

    কথাটির সাথে যোগ করতে চাই,

    শরীরে বহন করা পুরোনো রোগ চিকিৎসা সহায়ক পরিবেশ পেলেই প্রত্যেকে সারিয়ে নিতে চায়, একটু ভাল ও সুস্থ থাকার আশায়, এ ক্ষেত্রে সময় গড়িয়ে গিয়েছে বলে, কেউ কখনও চিকিৎসা নিতে আপত্তি করে না।

    ফলে, এই রাষ্ট্র ও সমাজকে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে গেলে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিকল্প নাই। এখানেও সময় দণ্ড আইনের সেই নীতির মতোই কোন ফ্যাক্টর নয়।

    এই ব্লগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু নিয়ে বেশ কয়েকটি পোষ্ট ইতিমধ্যেই লিখা হয়েছে। এই পোষ্টের সম্মানিত লেখকগণ বিচারের ন্যায্যতা নিয়ে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছেন এবং পদ্ধতিও আলোচনা করেছেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে। একটা বিষয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন মত এসেছে। বিষয়টি হল জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ও সহযোগিতায় বিচারের ব্যাপারে লেখক গণ ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।

    পত্র পত্রিকার ভাষ্য অনু্যায়ী, বিচার প্রক্রিয়া যদি শুরু হয়ে যায়, তাহলে, জামাতের অন্যান্য ভাবনার বাইরে আরেকটি অবস্থান হবে, জাতিসংঘের মাধ্যমে ও মধ্যস্থতায় যাতে তা নিষ্পন্ন হয়, তার জন্য লবিং করা। জামাতের এই অবস্থান অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছে। অনেকে মনে করছে, এতে হয়তো তাদের পার পেয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা খোলা আছে। যেমনঃ এই ব্লগে একজন পোস্ট লেখক, জনাব হাসান মাহমুদ এ বিষয়ে তার ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন। এখানে দেখুন।

    অবিশ্রুতের পোষ্ট পড়ে মনে হলো, তিনিও বিষয়টিকে প্রায় একইভাবে দেখছেন। এখানে দেখুন।

    মনে হচ্ছে, এই আলোচনা একটি নতুন দিকে মোড় নিয়েছে, ইতিমধ্যেই। আপনার এই পোষ্টে, আপনি যে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, তার প্রতিটিতেই এই বিশ্ব সংস্থার ইনভলবমেন্টের বিষয়টি এনেছেন।

    এ বিষয়ে আপনার আরো মতামত জানার আগ্রহ রইল, যাতে করে পরবর্তীতে আমরা এই আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি। মুক্তাংগনের নতুন গঠিত যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত বিশেষ ফোরামে এই আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

    আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।

  3. অলকেশ - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (৬:২৮ অপরাহ্ণ)

    এছাড়া সুশীল সমাজের মধ্যে অবস্থান নিয়ে একশ্রেণীর বর্ণচোরা বুদ্ধিজীবী জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন।

    এই শ্রেনীভুক্ত বুদ্ধিজীবিগনের একটি তালিকা করে রেখে দেয়া এবং এরা কোন মিটিংয়ে বা সেমিনারে বক্তৃতা করলে ছবিসমেত তা রেকর্ড করে রাখা বা কোন পত্রিকায় এই ইস্যুতে লিখলে, তা সংরক্ষন করে রেখে দেয়া যেতে পারে।

    এদেরকে জনগণের সামনে EXPOSE করাটাও একটা জরুরী কাজ বলে মনে হয়।

  4. জিজ্ঞাসু - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (৬:৪৩ অপরাহ্ণ)

    বিগত জোট সরকারের এক ধূরন্ধর আমলা ও চতুর বুদ্ধিজীবি জনাব মাহমুদুর রহমান কিছুদিন আগে (দিন তারিখ স্মরণে নাই) বিবিসি-বাংলাদেশ টেলিভিশন সংলাপে বলেছিলেন, ১৯৫ জন পাকিস্তানীকে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করা হয়েছিল শেখ মুজিব আমলে, এর পরে আর কাউকে যুদ্ধাপরাধী বলার সুযোগ নাই। সেদিন তার পাশে বসা ছিলেন, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা জনাব নজরুল ইসলাম খান।

    এই তালিকার শুরুর দিকে আমি সেই কুখ্যাত মাহমুদুর রহমানের নাম প্রস্তাব করতে চাই।

  5. অলকেশ - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (২:০৫ অপরাহ্ণ)

    @ শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনঃ
    আপনি লিখেছেন যে,

    ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর দালাল আইনে আটক যে সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই তাদের জন্য সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। তবে সাধারণ ক্ষমার প্রেসনোটে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে – ‘ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজ-অগ্নিসংযোগের দায়ে দন্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমাপ্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।’

    তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সাধারন ক্ষমার ঘোষনাটা অপরাধী নির্বিশেষে প্রযোজ্য ছিলনা বা বিশেষ বিশেষ গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযুক্তগণ এই সাধারন ক্ষমার আওতাভুক্ত ছিল না। সেক্ষেত্রে আপনি সরকারী প্রেস নোটের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, কোন কোন অপরাধ এই ক্ষমা ঘোষনার আওতায় আসবে না।

    আমার প্রশ্ন হলঃ

    ১। প্রেসনোটের এই বক্তব্য বা পরিভাষার আইনগত গুরুত্ব/ফলাফল কি?

    ২। সাধারন ক্ষমা ঘোষনার আইনি ফলাফল তাহলে কিভাবে নির্ধারিত হবে?

    তাছাড়া নীচের এই লেখাটিতে লেখক স্পষ্টভাবে বলছেনঃ

    ………..”Unfortunately, for whatever reasons, no action was taken against those named in the list. Sheikh Mujibur Rahman provided blanket amnesty to all Bangladeshis who collaborated with the Pakistani army irrespective of the nature of the collaboration. Later on after Sheikh Mujib’s assassination, Ziaur Rahman rehabilitated the collaborators by offering them higher political positions in his administration.”

    Bangladesh War of Independence: A Moral Issue : Mokerrom Hossain

    About the Author: Mokerrom Hossain (mhossain@vsu.edu) is with the Department of Sociology, Social Work and Criminal Justice, Virginia State University.

    অর্থাৎ ঐ সাধারন ক্ষমার ঘোষনা ছিল অপরাধ নির্বিশেষে, সকলের প্রতি। এই বক্তব্যকে খন্ডন করবেন কিভাবে? বিষয়টির আইনগত প্রক্ষাপট ও প্রয়োগ নিয়ে একটা পরিস্কার ধারনা পাওয়াটা জরুরী বলেই মনে হচ্ছে। কারন আপনার লেখার সাথে উপরের লেখকের ঐ মন্তব্য সম্পূর্ন ভিন্ন মনে হয়েছে।

  6. মাসুদ করিম - ১৫ মে ২০২৩ (৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ)

    আইএজিএস কর্তৃক বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি এক অনন্য ঘটনা
    https://bangla.bdnews24.com/opinion/yyrk7meyos
    এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে যে সকল বিভ্রান্তি, কুতর্ক ও তথ্যবিভ্রাট আছে, তার পরিপূর্ণ অবসান হবে।

    সম্প্রতি (গত ২৪ এপ্রিল) ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স (আইএজিএস) ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন-এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন; কেননা, জাতিসংঘের কাছ থেকে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে এটি আমাদের ভালো সহযোগিতা দেবে। আর এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে যে সকল বিভ্রান্তি, কুতর্ক ও তথ্যবিভ্রাট আছে, তার পরিপূর্ণ অবসান হবে।

    ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগিরা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনেকের দাবি। আর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে সারা বাংলাদেশে অসংখ্য গণহত্যা হয়েছে। বিষয়টি দিবালোকের মতো সত্য হলেও, এখনও আমাদের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করার জন্য দেশে-বিদেশে কাজ করতে হচ্ছে। অনেকে অবাক হতে পারেন এই ভেবে যে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগিরা গণহত্যা করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন, ৪০ বছর পরে হলেও ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সহযোগিদের বিচার হয়েছে, তাহলে বায়ান্ন বছর পরে গণহত্যার স্বীকৃতি কেন প্রয়োজন হয়ে পড়ল? এর সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে, গণহত্যার স্বীকৃতিটি প্রয়োজন, যারা গণহত্যার শিকার হয়েছেন তাদের আত্মত্যাগের আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির জন্য, সকল অপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য।

    দুই.

    মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে– জেনোসাইডের বাংলা গণহত্যা নয়। যদিও আমি ইতোমধ্যে গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করেছি এবং এটি করেছি জনপরিসরে বিষয়টির সহজ বোধগম্যতার কথা মনে রেখে। কিন্তু জেনোসাইডকে বাংলায় জেনোসাইডই বলতে হবে; কেননা, ‘জেনোসাইড’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন পোলিশ অ্যামেরিকান আইনের পণ্ডিত রাফায়েল লেমকিন (Raphael Lamkin)। তাঁর এই নামকরণের পূর্বে আর্ন্তজাতিক এই অপরাধের কোনো নাম ছিল না। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মানুষের ইতিহাসে হাজার হাজার জেনোসাইড হলেও, লেমকিন কর্তৃক ‘জেনোসাইড’ নামকরণের পূর্বে মানুষের ইতিহাসের নৃশংস এই অপরাধটি ছিল ‘নামবিহীন একটি অপরাধ’! আরেকটি চমকপ্রদ (কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক) তথ্য হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নাজি ও জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পূর্বে পৃথিবীর ইতিহাসে নিয়মাবদ্ধ বিচারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কখনো হয়নি।

    জেনোসাইডকে কেন বাংলায় জেনোসাইড বলতে হবে, সেটিকে একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছিল ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’। জেনোসাইড কনভেনশনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে অনুযায়ী, “জেনোসাইড বলতে কোনো জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে করা নিম্নোক্ত কাজগুলোকে জেনোসাইড বলে গণ্য করা হবে – (ক) ওই গোষ্ঠী (বা দলের) সদস্যদের হত্যা করা; (খ) ওই গোষ্ঠীর সদস্যদের মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা; (গ) ইচ্ছাকৃতভাবে ওই গোষ্ঠীর জীবনের ওপর এমন অবস্থা আরোপ করা যাতে এটির সম্পূর্ণ বা আংশিক শারীরিক ধ্বংস সাধিত হয়; (ঘ) ওই গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন (শিশুর) জন্ম বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা; এবং (ঙ) জোরপূর্বক ওই গোষ্ঠীর শিশুদেরকে অন্য গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করা।”

    এই সংজ্ঞাটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে, শুধু গণহত্যা নয়, জেনোসাইডের সংজ্ঞার ব্যাপ্তি আরও বড় এবং সূক্ষ্ম। ফলে কোনো একটি জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠী অন্য কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা না করেও জেনোসাইডের অপরাধ করতে পারে। জেনোসাইডের এই সর্বজনীন সংজ্ঞাকে বিবেচনায় রেখে বলা যেতে পারে যে, ১৯৭১ সালে যারা বাঙালি জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যাই শুধু নয়, মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করেছিলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিকভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস সাধন করেছিলেন, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা যাবে।

    তিন.

    ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন’ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আইএজিএস কর্তৃক বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি সহজ কোনো কাজ ছিল না। বিষয়টিকে আইজিএস-এ উত্থাপন করা, রেজল্যুশন ড্রাফট করা, ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়াটির পেছনে লেগেছিলেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর। তাঁকে সার্বক্ষণিক সমর্থন এবং যথাযথ সহযোগিতা দিয়ে গেছেন অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যান্টন, ড. হেলেন জার্ভিস, অধ্যাপক এডাম জোন্স, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, অধ্যাপক এলিসা ভন জোয়েডেন-ফর্জে, ড. শাহরিয়ার ইসলাম ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর সহকারি অধ্যাপক ইমরান আজাদ। এর বাইরে আইরিন ভিক্টোরিয়া ম্যাসিমিনো এবং থেরেসা ল্যাং নানাভাবে সহায়তা করেছেন।

    এ ব্যাপারে সম্প্রতি লেখা এক কলামে তৌহিদ রেজা নূর জানাচ্ছেন যে, জেনোসাইডের স্বীকৃতি অর্জনের কাজটি মসৃণ নয়। যেহেতু আইনি সংজ্ঞার দ্বারা জেনোসাইড সংজ্ঞায়িত, তাই ঘটে যাওয়া অথবা ঘটমান অপরাধসমষ্টিকে কেউ ইচ্ছে হলেই জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে ঘোষণা দিতে পারেন না। ইতিহাসের আলোকে নানা কার্যকারণ বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি আইনের কষ্টিপাথরে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এ ব্যাপারে। জেনোসাইড নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, এ বিষয়ে যাঁরা পড়ান, আইনি লড়াই লড়েন, তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করেন কোথাও জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে, কি হয়নি।

    ২৪ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের (আইএজিএস) পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতির মাইলফলকে এসে পৌঁছানোর দীর্ঘ পথটি ছিল বন্ধুর। পদে পদে কখনো আইএজিএসের গঠনতন্ত্রে থাকা বিধি-উপবিধিজনিত প্রতিবন্ধকতা, কখনোবা বোঝাপড়াজনিত প্রতিবন্ধকতায় শ্লথ হয়েছে এই রেজল্যুশন বিষয়ে আইএজিএসের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। বিষয়টি খোলাসা করে বলতে গিয়ে তৌহিদ লিখেছেন যে, “স্পেনের বার্সেলোনায় ২০২১ সালের ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের (আইএজিএস) দ্বিবার্ষিক কনফারেন্স হয়েছিল। আমি সেই কনফারেন্সে ‘ফিফটি ইয়ারস অব বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড আফটারম্যাথস’ শীর্ষক এক প্যানেল সেশনের প্রস্তাব করেছিলাম, যেখানে বাংলাদেশের চারজন গবেষক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আইএজিএস যেন বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিয়ে এই কনফারেন্স থেকে একটি রেজল্যুশন প্রকাশ করে সে দাবি উত্থাপন করা হলে অধ্যাপক এডাম জোন্স পূর্ণ সমর্থন করেন। কনফারেন্সের শেষ দিন আইএজিএসের বিজনেস মিটিংয়ে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাদের গোচরে আনা হলে তাঁরা গঠনতন্ত্র মোতাবেক ড্রাফট রেজল্যুশন জমা দিতে পরামর্শ দেন … পরে ২ আগস্ট ২০২১ বাংলাদেশের শহীদদের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে আইএজিএসে ড্রাফট রেজল্যুশন জমা দিই।”

    আইএজিএসের নির্বাহী কমিটি তৌহিদ রেজা নূরের প্রস্তুত করা ড্রাফটটি গ্রহণ করার পরে বিধি মোতাবেক প্রেরণ করে রেজল্যুশন কমিটির কাছে। এর সাড়ে চার মাস পরে ১৭ ডিসেম্বর রেজল্যুশন কমিটি বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। রিভাইজড ডকুমেন্টটি তাদের কাছে পাঠানো হয় ২৬ ডিসেম্বর। এর পরে আইএজিএসের নির্বাহী কমিটি রেজল্যুশনের সংযুক্তি হিসেবে সেকেন্ডারি বিভিন্ন দলিলের তালিকা জমা দিতে বলে। ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রয়োজনীয় সংযুক্তি পাঠান তৌহিদ রেজা নূর। রেজল্যুশন কমিটি জমা দেওয়া সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে এবং তা গ্রহণ করে নির্বাহী কমিটিতে ভোটাভুটির জন্য পাঠায়। এরপরও নানা প্রক্রিয়া শেষ করে শতকরা ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন’ পাশ হয়।

    এই প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে জেনোসাইড এক্সপার্ট ও স্কলারদের বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আইএজিএস ঘোষণা দিল যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস ঘটনাসমূহ ছিল জেনোসাইড। বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে এই ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অর্জন। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকে বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে কাজ করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং অনেক তরুণ গবেষক ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বসে বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে গবেষণা করছেন। এদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের কাছ থেকে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃত আদায় করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে বলে জোর প্রত্যাশা রইল।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.