লাতিন ভাষার কথা : ৩৪

|| সন্তবৃন্দ ও ধর্মদ্রোহীগণ (প্রথমার্ধ) || লিখতে পারতেন যাঁরা তাঁরা যেহেতু গির্জা-সম্পৃক্ত লোকজন, তাই এটা খুব-ই স্বাভাবিক যে তাঁরা যা লিখেছেন তার বেশ বড় একটা অংশ ধর্মীয় ও যাজকীয় বিষয়াদি সম্পর্কিত, এবং সেগুলোর অনেকগুলোর-ই আজ আর তেমন প্রাসঙ্গিকতা নেই। [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

সন্তবৃন্দ ও ধর্মদ্রোহীগণ

(প্রথমার্ধ)

লিখতে পারতেন যাঁরা তাঁরা যেহেতু গির্জা-সম্পৃক্ত লোকজন, তাই এটা খুব-ই স্বাভাবিক যে তাঁরা যা লিখেছেন তার বেশ বড় একটা অংশ ধর্মীয় ও যাজকীয় বিষয়াদি সম্পর্কিত, এবং সেগুলোর অনেকগুলোর-ই আজ আর তেমন প্রাসঙ্গিকতা নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাইবেলের বিভিন্ন বই তথা পর্বের টীকা-ভাষ্যদানকারী রচনাগুলো মধ্যযুগ জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এবং কিছু পরিশ্রমী ব্যক্তি বাইবেলের প্রতিটি বইয়ের ভাষ্য রচনা করেতে সক্ষম হয়েছিলেন। সবচাইতে নিবেদিতপ্রাণ আধুনিক পণ্ডিতেরাই কেবল এসব রচনার ছোট ছোট অংশের অতিরিক্ত কিছু পড়ে উঠতে পেরেছেন; যদিও, যে-সময়ে সেগুলো লেখা হয়েছে সেই কাল সম্পর্কে গুচ্ছ গুচ্ছ খুবই জরুরি তথ্য সেখানে মাঝে মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় ।

তার চাইতে কিছুটা মজার হল কিছু পুণ্য কিংবদন্তী। সেই প্রাচীন কালেই নামজাদা লোকজনের জীবনী লেখার চল ছিল। খৃষ্টানরা সেই স্বভাব রপ্ত করলেন, যদিও স্পষ্টতই তাঁরা পুণ্যবান পুরুষ আর নারীদের নিয়েই লিখতে পছন্দ করতেন, বিশেষ করে যদি তাঁরা তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে নিহত হয়ে থাকেন এবং তার ফলে শহীদ হয়ে থাকেন। এ ধরনের কিংবদন্তীতে সাধারণত সেই বিশেষ মানুষটির জীবনের বর্ণনা থাকে, থাকে জীবনের অজানা কাহিনী, তবে প্রথমত এবং প্রধানত সেগুলো হলো সে-সমস্ত আশ্চর্য কাজকর্ম ও অলৌকিক ঘটনা যা তাঁদের সন্ত হতে সাহায্য করেছে। প্রাচীনতম এবং সবচাইতে বিখ্যাত কিংবদন্তীগুলোর একটি হচ্ছে Tours-এর সন্ত মার্টিন সম্পর্কিত, এবং সেটার শুরু প্রসিদ্ধ একটা কাহিনী দিয়ে। মার্টিন তখনো সামরিক বাহিনীতে কর্মরত; শীতকালের এক দিনে তিনি অশ্বারোহনে কোথাও যাচ্ছেন, তখন এক দরিদ্র পুরুষ মানুষের সঙ্গে তার দেখা। প্রবল শীত থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো কোনো গরম পোশাক ছিল না তাঁর গায়ে। মার্টিন আগেই তাঁর সব অর্থ-কড়ি বিলিয়ে দিয়েছেন অন্য গরীব মানুষের মধ্যে, কাজেই, তখন আর কি করার ছিল তাঁর? নিজের তরবারিটা বের করে আলখাল্লাটি কেটে দুই অর্ধেক করলেন তিনি, তারপর এক অর্ধেক দান করে দিলেন দরিদ্র মানুষটিকে। এই গল্পটি সত্যি হতেও পারে কারণ লেখক সালপিসিয়াস সেভেরাস ছিলেন মার্টিনের সমসাময়িক, এবং তাঁর পরিচিত। কিন্তু তারপরেও এরপর যেসব অলৌকিকের বর্ণনা পাওয়া যায় — যেমন মারটিনের বহু মৃতকে জীবিত করছেন, কুষ্ঠরোগীদের সারিয়ে তুলছেন — এবং এই ধরনের আরো নানান কিছু — তা গলাধঃকরণ করা মুশকিল।

কিন্তু “Vita Sacncti Martini” বা “সন্ত মার্টিনের জীবন” একটি ধারার সৃষ্টি করল। লাতিনে হাজার হাজার সন্ত-জীবনী লেখা হয়েছে, তার সবগুলোই সন্তদের নানান ভালো আর অলৌকিক কাজ-কর্মের নৈতিক উন্নতিসাধনমূলক বর্ণনায় ভরপুর। সেগুলোর কিছু কিছু সুলিখিত, অন্যগুলোতে হয়তো রয়েছে সে-কাল সম্পর্কিত বেশ কিছু আকর্ষক বর্ণনা, কিন্তু বেশির ভাগই নেহাতই একঘেয়ে। সন্ত ছিলেনও ভূরিভূরি, কারণ কোনো অঞ্চলেরই অন্তত একজন সন্ত না হলে চলত না, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই জানা যেতো না সেই সন্তদের কীর্তি ঠিক কি। কিন্তু তারপরেও একটা জীবনী তো থাকতেই  হতো, অন্তত বর্ষপঞ্জিতে সেই সন্তের জন্য নির্দিষ্ট দিবসে সেটা উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করবার জন্য হলেও। সন্ত ভদ্রলোক সম্পর্কে লেখকের কিছু জানা না থাকলে কিছু অলৌকিক কাহিনী আর ধর্মনিষ্ঠ কার্যকলাপের কথা তাঁকে আবিষ্কার করতে হতো, বা অন্য কোনো জীবনী থেকে কোনো ঘটনার বিবরণ ধার করতে হতো, আর তাতে করে এক সন্তের জীবনকে আরেক সন্তের জীবন থেকে প্রায়ই  আলাদা করা যেতো না।

কখনো কখনো আবার লেখক কিছু রঙও চড়াতেন। সন্ত ডেনিস ফ্রান্সের রক্ষাকর্তা সন্ত, ধারণা করা হয় প্যারিসের প্রথম বিশপ ছিলেন তিনি এবং নিজের মাথা বিসর্জন দিয়ে শহীদত্ব অর্জন করেছিলেন তিনি। কিংবদন্তী বলে, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, তারপর নিজের মাথাটা হাতে নিয়ে কিছুদূর হেঁটে চলে গিয়েছিলেন সেখান পর্যন্ত যেখানে আজ তাঁর নামাঙ্কিত গির্জাটি দাঁড়িয়ে আছে, প্যারিসের একটু উত্তরে। আপনি ভাবছেন এটাই যথেষ্ট অলৌকিক, কিন্তু বর্ণনাটা আরো ভালো করার উপায় আছে। পরবর্তী জীবনীগুলোতে কিছু সন্ত ঠিক এই কাজটিই করেন, কিন্তু তাঁরা আরো দূরে হেঁটে যান বা তাঁদের সঙ্গে থাকে যার যার মাথা নিজ হাতে বহনকারী কর্তিত-মস্তক আরো বেশ কজন শহীদ। সত্যি বলতে কি, এই মোটিফটা এতোই সাধারণ হয়ে ওঠে যে এধরনের সন্তদের জন্য বিশেষজ্ঞদেরকে একটা বিশেষ নাম উদ্ভাবন করতে হয়েছিল: cephalophores। শব্দটা এসেছে গ্রীক ভাষা থেকে, এবং, অবশ্যই সেটার মানে হচ্ছে, ‘মস্তক বহনকারী’।

কিন্তু সন্তরা সব সময় এমন কোনো ছায়াচ্ছন্ন চরিত্র নয় যাঁদের নামে যে-কোনো কিছু বলা যাবে। নিজেদের লেখা রেখে গেছেন এরকম প্রকৃত ঐতিহাসিক চরিত্রদের একটা দীর্ঘ সারি রয়েছে যাঁদেরকে তাঁদের মৃত্যুর পর সন্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এঁদের একজন হলেন পোপ মহান গ্রেগরি, ৬০০ খৃষ্টাব্দের দিকে এই ধরাধামে বাস করে গেছেন তিনি। চিঠিপত্রের এক বিশাল সংগ্রহ রেখে গেছেন ভদ্রলোক যেখানে লিপিবদ্ধ আছে পশ্চিম ইউরোপের সব গির্জার ওপর রোমের আধিপত্য স্থাপনে তাঁর সংগ্রামের ইতিহাস, এবং কিভাবে তিনি রোমক সন্ন্যাসী অগাস্তিনকে ক্যান্টারবেরির প্রথম আর্চ বিশপ হওয়ার জন্য কেন্টে পাঠিয়ে ইংল্যান্ডের ধর্মান্তরকরণের গোড়াপত্তন করেছিলেন। গ্রেগরি ও অগাস্তিনের মধ্যেকার চিঠিপত্র এখনো বিদ্যমান, এমনকি পোপের এরকম একটা চিঠিও সেখানে রয়েছে যেটাতে তিনি কেন্টের রাজা এথেলবার্টকে হত্যার আদেশ দিচ্ছেন।

(ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

১ comment

  1. Pingback: লাতিন ভাষার কথা : ৩৩ | জি এইচ হাবীব

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.