লাতিন ভাষার কথা : ২৯

তবে খুব বেশি শিক্ষার্থী যে ‘quadrívium’ অব্দি পৌঁছুতে পারতো তা নয়। যারা পারতো তারা সম্ভবত পড়াশোনা থেকে তেমন একটা আনন্দ লাভ করতো না। ক্যাসিওদোরাসে বা পরে যেসব আরো বড় হ্যান্ডবুক পাওয়া যেতো সেগুলোতে এসব বিষয়ে পড়ার মতো উপাদান খুব কমই ছিল। [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

 

বিদ্যালয়ে লাতিন

(শেষ অংশ)

তবে খুব বেশি শিক্ষার্থী যে ‘quadrívium’ অব্দি পৌঁছুতে পারতো তা নয়। যারা পারতো তারা সম্ভবত পড়াশোনা থেকে তেমন একটা আনন্দ লাভ করতো না। ক্যাসিওদোরাসে বা পরে যেসব আরো বড় হ্যান্ডবুক পাওয়া যেতো সেগুলোতে এসব বিষয়ে পড়ার মতো উপাদান খুব কমই ছিল। ওখানে থাকতো মূলত বিভিন্ন গ্রীক পণ্ডিতের নানান ধ্যান-ধারণার ছোট আর অংশত ভুল-বোঝা সার-সংক্ষেপ। ধর্ম ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে মধ্য যুগে মানুষের জ্ঞান ছিল বেশ নিয়ন্ত্রিত, এমনকি তাদের জন্যেও যারা সে-সময়ে লভ্য শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। লাতিনের জ্ঞান ছাড়া — যার মধ্যে ছিল ব্যাকরণ আর লেখালেখির কিছু মৌলিক বিষয় — বাকিটার বেশির ভাগই ছিল যুক্তি বিদ্যা বিষয়ক প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা।

এটা যে খুব খারাপ ছিল তা নয়। নিশ্চয়ই ব্যাপারটা এমন ছিল যে যারা মঠভিত্তিক স্কুলে বিদ্যাশিক্ষা করেছে তারা প্রায়ই মঠ বা গির্জার বাইরেও তাদের সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারতো। আর তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। অন্য কোনো বিদ্যালয় যেহেতু ছিল না কাজেই লাতিন লেখার দরকার পড়ে এমন যে-কোনো চাকরির ক্ষেত্রে স্পষ্টতই তাদের মধ্যে থেকে লোক নিয়োগ করতে হতো যারা গির্জার স্কুলে পড়াশোনা করেছে। এবং সবসময়ই লিখতে জানা লোকের চাহিদা ছিল প্রধানত রাজা আর রাজপুত্রদের কাছে, কারণ প্রশাসনিক ও যোগাযোগের কাজে সাহায্য দরকার হতো তাদের, আর এমন লোকজন ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণেই, এমনকি অষ্টম শতকের মতো কঠিন সময়েও, যখন ইউরোপের বড় বড় এলাকা ফিরে যাচ্ছিল স্থানীয় সাবসিস্টেন্স ইকোনমিতে।

সময়ের সাথে সাথে বিদ্যালয়গুলোর উন্নতি ঘটল, এবং শিক্ষা যে কেবল দীর্ঘস্থায়ী-ই হলো তা নয়, সেই সঙ্গে তা আরো শক্তপোক্ত-ও হলো। কিন্তু তারপরেও, ভিত্তিটা সব সময়েই ছিল লাতিন, কারণ এই মৌলিক ভাষাগত হাতিয়ার বা উপাদানকে এড়িয়ে অন্য কোনো বিষয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল। আর একথা বলাই বাহুল্য যে লাতিনই ছিল শিক্ষাদানের ভাষা, এবং যে কোনো পাঠ্যপুস্তক-ই লেখা হতো এই ভাষায়।

দ্বাদশ শতকের দিকে, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দুই অর্থেই একটা সমৃদ্ধির কাল এসেছিল পশ্চিম ইউরোপে। এটা তেমনই এক সময় যখন প্যারিসের নতর-দেম বা Chartes-এর ক্যাথীড্রাল-এর মতন দুর্দান্ত ভজনালয় তৈরি করার মতো যথেষ্ট অর্থ-কড়ি ও প্রযুক্তি ছিল। এসব শহরের ক্যাথীড্রাল বিদ্যালয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রকৃত কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছিল; সেখানে ছিল উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা; শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলে পারতেন অবাধে। সেরা বিদ্যালয়গুলোতে ধর্ম ও প্রাচীনকালের দর্শনের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে রীতিমত তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। আর এসব বিদ্যালয় থেকেই বিকাশ লাভ করে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেমন প্যারিস ও অক্সফোর্ড, এবং শিগগিরই অন্যান্য স্থানেও প্রতিষ্ঠিত হয় আরো বেশ কিছু।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাইতে বিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট অগ্রসর হলেও তারা বিদ্যালয়ের ভাষাই বহাল রেখেছিল। গোড়া থেকে লাতিন-ই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একমাত্র ভাষা, এবং পরবর্তী বেশ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত তা বজায় ছিল। এমনকি ষোড়শ শতকের রিফর্মেশন-ও এদিক থেকে সেরকম কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। প্রোটেস্টান্ট দেশগুলোতে পাদ্রীদেরকে অবশ্য স্থানীয় ভাষাতেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করতে হতো, কিন্তু তারপরেও লাতিন পড়তে, লিখতে ও বলতে শিখতে হতো তাঁদের, কারণ, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা শিক্ষাগ্রহণ করেছেন সেখানের ভাষা লাতিনই ছিল। অষ্টাদশ শতকের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেনি, কিন্তু কিছু কিছু স্থানে বিংশ শতকেও শিক্ষাদানের মাধ্যম লাতিনই ছিল।

বিদ্যালয়গুলোতে কিন্তু ব্যাপারটা একই রকম ছিল না। সেখানে চতুর্দশ শতক অব্দি সাধারণত লাতিনই ছিল একমাত্র বিদ্যায়তনিক ভাষা, কিন্তু ততদিনে গির্জাভিত্তিক বিদ্যালয়গুলোয় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে, কারণ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে জাতীয় ভাষা পড়তে লিখতে জানা মানুষের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই ধীরে ধীরে এসব ভাষাও প্রবেশ করতে লাগল গির্জাভিত্তিক বিদ্যালয়গুলোতে। ফলে শিক্ষাদানের একমাত্র ভাষা থেকে লাতিন হয়ে দাঁড়াল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী ভাষা। উচ্চশিক্ষায় লাতিন যতোদিন প্রয়োজন ছিল ততোদিনই এই অবস্থানটি বজায় ছিল ভাষাটির, যার অর্থ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উনবিংশ শতক পর্যন্ত। এরপর থেকে ইউরোপের বিদ্যালয়গুলোতে লাতিন যথেষ্ট কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে, যদিও লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ভাষাটি অধ্যয়ন করে থাকে। আর এখন তারাই এই ভাষাটিকে বেছে নেয় যারা ইউরোপের গত কয়েকটি বাদে অন্যান্য শতকের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আরো ভালো একটি ধারণা পেতে চায়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অবশ্যই এই আগ্রহটি সবচাইতে বেশি ইতালি আর ফ্রান্স-এর মতো দেশেই, কারণ সেসব দেশের জাতীয় ভাষা লাতিন থেকেই আগত, এবং সেই রোমকদের সময় থেকে ভাষাটি একটানা ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেখানে। ব্রিটেনে অবশ্য ভাষাটি এতো দীর্ঘ সময় ধরে তার গুরুত্ব ধরে রাখতে পারেনি, মোটামুটিভাবে সপ্তম থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্তই ছিল সেই গুরুত্ব। অন্যদিকে, সম্ভবত লাতিন-ই প্রধান ভাষা যার মাধ্যমে লোকে এসব দেশের আদিতম ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। আর তাহলে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী মানুষের ক্ষেত্রেও ভাষাটির গুরুত্ব রয়েছে।

 

পরবর্তী অধ্যায়: ‘বাচন ও বানান’

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.