রমজান ডাকাতের দার্শনিক সমস্যা

লোকটা ডাকাত সর্দার, ময়মনসিংহ অঞ্চলের একদার যাত্রার হিরো। শেষ তাকে দেখি ঢাকা জেলখানার হাজতিদের ওয়ার্ডের পাহারার দায়িত্বে। আমরা তার অধীন ছিলাম। তার প্রাণে গান ছিল এবং তার যাবজ্জীবন হয়েছিল। ডাকু রমজানের জন্যই রাতটা মা‍ঝেমধ্যে রঙ্গিন হয়। অ্যালুমিনিয়ামের থালায় আঙুল ঠুকে গান গাওয়া ছিল তার রাতের মেরাজ। চোখ বন্ধ করে গাইতে গাইতে সে লুপ্ত হতো নিজের মধ্যে। কোনোদিন সে গাইতো মৈমনসিংহ গীতিকার ‘আলোমতি ফুলকুমার’ থেকে,

‘রাজার ফুল বাগানে যাই, একটু হাঁটিয়া বেড়াই….আমার মনে শান্তি নাই।’

গাইতো,

‘বন্ধু থাকো, বন্ধু থাকো,
বন্ধু থাকো আমার সনে
বন্ধু থাকো ও বন্ধু থাকো
বন্ধু থাকো তোমার ঢংয়ে।’

আবার কোনোদিন গাইতো এই বিষন্ন ব্যালাড,

‘যে আমারে আদর করে রে,
নাম রাইখ্যাছে আদরিণী
আমি কী তার আদর জানি-ই-ই-ই…’

যার অর্থ আমার নাম, ‍তার নাম কী তা আমি জানি? আত্মপ্রেমে ‘আমি’ মাত হয়ে থাকি, কিন্তু আমার ‘আত্ম’ কী তা কি আমি জানি? তাহলে কার জন্য ‘আমি’ প্রাণপাত করি? একদা ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ৩২ নং খাতা ওয়ার্ডের সর্দার রমজান ডাকাত এই সমস্যায় জাগ্রত হতো; আমি আজ সেই সমস্যায় লুপ্ত।

ফারুক ওয়াসিফ

চৌখুপি থেকে বেরিয়ে দিকের মানুষ খুঁজি দশদিকে।

১০ comments

  1. মিঠুন দস্তিদার - ৫ অক্টোবর ২০০৯ (১০:২৬ অপরাহ্ণ)

    লেখাটা পড়ে তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের “কবি” এর কথা মনে পড়লো…

  2. ফারুক ওয়াসিফ - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (১১:০৬ পূর্বাহ্ণ)

    রমজানের রেফারেন্স এসেছে আমার এই লেখাটায় ৩২ নং খাতার প্রথম গল্প
    http://www.sachalayatan.com/faruk_wasif/15979

    ”ডাকু রমজানের জন্যই রাতটা রঙ্গিন রঙ্গিন হয়। রমজান ডাকু ছিল, আবার যাত্রার নায়কও ছিল। সারারাত রমজানের পাট দেখে শ’খানেক মুগ্ধ পুলিশ ভোরবেলা ওকে হাতকড়া পরাতে গেলে রমজান বলে, ‘ওসি সাব, পালার গানগুলান কিন্তু আমরারই, নাগছে ক্যামুন’? ওসিরা সাধারণত আহাম্মক হয়। কিন্তু ইনি অন্যরকম। রমজান ডাকু বিনা হাতকড়ায় রাতজাগা যাত্রাপালার দর্শকের ফ্যালফ্যাল চাহনির সামনে দিয়ে পুলিশের সঙ্গে চলে যায়। সেই রমজান এখন যাবজ্জীবন নিয়ে ৩২ নং ওয়ার্ডের গায়েন কাম প্রক্টর। রাতে সে যখন ওল্টানো থালিতে আঙ্গুল টুকে গান ধরে, ‘যে আমারে আদর কইরে গো-ও-ও, নাম রাইখ্যাছে আদরিনী-ইই, আমি কী তার আদর জানি’ গায়;
    কোনাকাঞ্চি থেকে কেউ হয়তো তখন ডুকরে ওঠে। আর রমজান পাহারা আওয়াজ দ্যায়, ‘মাঙ্গির পুত, শাউয়ার কাঠি ভাঙুম নিহি’।”

    এই হলো লোকটা, তাকে খুব মনে পড়ে। এরাও কবি, এরাই হয়তো সত্যিকারের নায়ক।

  3. রায়হান রশিদ - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৬:২১ অপরাহ্ণ)

    আর ছবি বানানোর জন্য আমাদের নির্মাতাদের কিনা গল্প খুঁজে বেড়াতে হয়!

  4. ফারুক ওয়াসিফ - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৭:১৩ অপরাহ্ণ)

    ৩২ নং খাতার প্রতিটি চরিত্রই একেকটা করে গল্প, জেলখানা ও পাগলাগারদে যেমন হয়।

  5. রেজাউল করিম সুমন - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৭:৫১ অপরাহ্ণ)

    ডাকু রমজানকে ভালো করে চেনার জন্য ‘৩২ নং খাতার প্রথম গল্প’টাও পড়লাম। পেয়ে গেলাম আরো অনেককেই। … অজানা রয়ে গেল রাজু আর সিরাতের শেষ পরিণতি …

    আচ্ছা, ‘৩২ নং খাতা’ কথাটার মানে কী?

    কোনোই মিল নেই, কিন্তু কয়েদখানার কাহিনি বলেই এর অনুষঙ্গে মনে পড়ছে ননী ভৌমিকের একটা লেখার কথা – ‘তারপর বক্সা’। ঠিক গল্প নয়, রিপোর্টাজ, ছাপা হয়েছিল ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে। প্রথমদিকের খানিকটা অংশ উদ্ধৃত করি :

    আমরা জানতাম, প্রত্যাশিত আদেশ শীগগিরই আসবে। অপেক্ষা করতাম গুজবের, টুকরো খবরের। ‘তাহলে কথাটা সত্যি?’

    যাকে জিজ্ঞেস করতাম সেও আমার চেয়ে নিশ্চিন্ত [নিশ্চিত?] ছিল না। তবু উত্তর দিত – ‘মনে হচ্ছে সত্যি। মনে হচ্ছে এবার সত্যিই পালে বাঘ পড়ল’ … কেউ একজন জানাতেন – ‘এসকল কয়েদীকে সেদিন বক্সায় পাঠিয়ে দেয়া হল ক্যাম্পটা তৈরী রাখার জন্যে …’।

    কয়েক মুহূর্ত আমরা চুপ করে থাকতাম। তারপর অবধারিত ভাবে কেউ কপট বিদ্রূপে চিৎকার করে উঠত – ‘ও হো হো –।’ কপট বিলাপে একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরত – ‘ওরে দাদারে!’

    আর আমরা খুব হাসতাম। হল্লা করতাম। একসঙ্গে অনেক লোক একই ভাগ্যের সরিক [শরিক] হতে অভ্যস্ত হলে একই সাধারণ দুশ্চিন্তাকে যেভাবে উপহাস করে উড়িয়ে দিতে পারে, সেইভাবে উপহাস করতাম পরস্পরকে।

    বাইরে থেকে সহসা কেউ গিয়ে পড়লে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যেত এই আপাতচিন্তাহীন তুচ্ছতা ও ফুর্তির বহিরঙ্গ দেখে। আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমিও ছিলাম তুলনায় নতুন।

    সে-লেখায় আছে ২২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের গল্প …

  6. ফারুক ওয়াসিফ - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৯:১১ অপরাহ্ণ)

    রাজুর ফাঁসির আদেশ পর্যন্ত জানি, তারপরে সূত্র হারিয়ে ফেলেছি। সেই সূত্র রাজ্জাক ভাই। সব কথা আজ কব না। রাজ্জাক ভাই এই শহরেই হয়তো আছেন। মাঝে মাঝে আমাকে খুঁজে বের করে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। আমিও তাঁর আলিঙ্গনে শান্তি পেতাম। এই শহরে তিনি হয়তো অভিমানে আর খোঁজেন না আমাকে, আমি খুঁজেও পাই না।

    আরমান-সোহাগ হয়তো ফিরে গেছে মালিবাগ-খিলগাঁও এর ছিনতাই চক্রে। রমজানের যাবজ্জীবন হয়তো মরণের আগে শেষ হবে, হয়তো হবে না। রোগ এসে নিয়ে যাবে। আমরা বাবুরা আরো বাবু হব।

    কিছু না ভেবেই এক সকালে অফিসে বসে লেখা একটানে। গল্প নয়, কিন্তু গল্পের বীজকে জমিনের অভাবে টবে রোওয়া আর কি!

    ২. এ মুহূর্তে মনে না পড়া উপন্যাসের বাইরে কয়েদখানার কোনো কাহিনীই প্রায় পড়িনি। ফলে অবচেতন থেকে উঠে আসার সুযোগ নাই। পরিস্থিতির অভিন্নতা আর সর্বমানবিক সংরাগ হয়তো মিল ঘটিয়ে দেয়।

    ৩. নামের বেলায় হয়তো চেকভের ৬ নং ওয়ার্ড মনে থেকে থাকবে। কিন্তু আমরা যে ভবনে ছিলাম জেলারের রেজিস্টারে সেটা ছিল ৩২ নং খাতা। অন্য নাম কিছু একটা ছিল, তবে এটাই চালু হয়ে যায়। সেই খাতায় আমাদের সবার নাম আজো থেকে থাকবে। অন্য গারদগুলোর নাম ছিল খুবই সুন্দর সুন্দর। সে কথা আজ নয়। সামান্যই বলতে পেরেছি, কিন্তু তারা মনে হানা দেয়।

    • রায়হান রশিদ - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৯:৩৭ অপরাহ্ণ)

      নামের বেলায় হয়তো চেকভের ৬ নং ওয়ার্ড মনে থেকে থাকবে।

      কিংবা দস্তয়েভস্কির Notes from Underground…? সেদিকেই যেন এগুচ্ছে।

    • রেজাউল করিম সুমন - ১১ অক্টোবর ২০০৯ (৭:৩২ অপরাহ্ণ)


      ধন্যবাদ, ফারুক। উচ্চারিত-অনুচ্চারিত প্রায় সব প্রশ্নেরই উত্তর পেয়ে গেলাম আপনার মন্তব্যগুলো থেকে। ‘খাতা’য় নাম লেখানোর ইচ্ছে নেই, তবে ওরকম কোনো গানের আসরে অন্তত একটা রাত কাটিয়ে আসবার কথা ভেবে রেখেছি আবদুল লতিফ সরকারের গানের অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখার পর থেকেই; আপনার বর্ণনা পড়ে আরো উৎসাহিত হলাম।

      গল্প নয়, কিন্তু গল্পের বীজকে জমিনের অভাবে টবে রোওয়া আর কি!

      দারুণ করে বললেন কিন্তু কথাটা!


      ইতিমধ্যে তারাশঙ্কর, চ্যেখভ্, দস্তইয়েভ্‌স্কির নাম এসে পড়েছে – ডাকাতের কবিত্ব, লেখার শিরোনাম আর জীবনদৃষ্টির সূত্রে। আর ননী ভৌমিকের ‘তারপর বক্সা’ আমি প্রথম পড়ি মাত্র মাস কয়েক আগে, সে-কারণেই হয়তো ‘৩২ নং খাতার প্রথম গল্প’র অনুষঙ্গে চট করে মনে পড়ে গিয়েছিল এ-লেখাটার কথা। দুই লেখকের ‘পরিস্থিতির অভিন্নতা আর সর্বমানবিক সংরাগ’ই যে আমার স্মৃতিকে চালিত করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই; লেখা দুটির মধ্যে কোনো বাড়তি সাদৃশ্য আবিষ্কারের চেষ্টা আমার দিক থেকে ছিল না।

      কথা ব’লে বুঝি ভুল, লিখে বুঝি, হাত রেখে বুঝি
      এ রকম নয় ঠিক, এ তো আমি চাইনি বোঝাতে।

  7. ফারুক ওয়াসিফ - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৯:২৫ অপরাহ্ণ)

    এবং আরো অদ্ভুত যে রাজার ফুল বাগানে যাই, গানটা শুনেছিলাম কফিল ভাইয়ের কাছে, আর আদরিনী শুনেছিলাম এক রাতে বংশী-কংস দিয়ে অনেক দূর গিয়ে তারাকান্দার এক গহীন গ্রামে বয়াতি সাধক বিজয় সরকারের শিষ্য আবদুল লতিফ সরকারের ওরসে। রেকর্ড আছে বোধহয় এখনো। চামচিকে ভরা প্রাচীন দরদালান, হাজার খানেক কৃষকের জমায়েত, শীত, ঢাকার চতুর তরুণ‍ আমরা কজন, সাধকের মায়াবি কন্যারা, অনুপস্থতি লোকটির না থাকা থাকা। এমন পরিবেশে যেন কিছু একটা ঘটবে। ঘটেছিল মাঝরাতে, তিন নদীর সংগমে_ ভরা জোছনার নৌকায়।

  8. ফারুক ওয়াসিফ - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (৪:৩৩ পূর্বাহ্ণ)

    ওপরে আমার মন্তব্যে ‌’বিজয় সরকারের শিষ্য আবদুল লতিফ সরকারের’ না হয়ে হবে আবুল কাশেম তালুকদার। তার সাগরেদ হবেন আব্দুল লতিফ সরকার।

    আর জেলখানার আরেকটি ওয়ার্ডের নাম মনে পড়েছে, ‘মণিহার’। সুন্দর না ?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.