একটি তীব্র বেদনায় আবারও কেঁপে উঠল গোটা দুনিয়া। মুম্বাইয়ে যে বোমা এবং অস্ত্র হামলা হলো তা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে। ডেকান মুজাহিদীন নামের নব্য এই জঙ্গি সংগঠন ঘটনার দায় স্বীকার করলেও এর শেকড় কোথায় বিস্তৃত্ব তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ ঘটনার পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এই পদত্যাগের তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঘটনার জন্য পাকিস্তানের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেও তা কোন স্খায়ী সমাধান নয়, তা তিনিও জানেন। কারণ পরমাণু অস্ত্র যেমন ভারতের কাছে আছে, তেমনি আছে পাকিস্তানের কাছেও। ফলে আইএসআইয়ের প্রধান ঘটনার বাস্তবতা দেখার জন্য ভারত যাওয়ার কথা প্রথম দিকে বললেও পরে তা অজ্ঞাত কারণে বাতিল করা হয়।
যারা মুম্বাইয়ে আক্রমণ করেছে এরা খুবই সংগঠিত একটি গ্রুপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মৃত্যুর জন্য তারা ভীত নয়। আর নয় বলেই তারা যাচ্ছেতাই করার সাহস করেছে। সরলপ্রাণ মানুষকে হত্যার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। এসব জঙ্গিবাদী ইসলাম ধর্মের নামে গোটা বিশ্বে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। অথচ ইসলাম কখনই হানাহানিকে প্রশ্রয় দেয়নি। এই যে চরম সক্ষিণ, তাকে মদদ দেয়ার জন্যও বিশ্বে একটি মহল সদা তৎপর। এরা ক্ষমতা লুটে নেয়ার মধ্যস্বত্ব ভোগ করতে চায় জঙ্গিদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে। এরা জঙ্গি গোষ্ঠীকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।
দক্ষিণ-পর্ব এশিয়ার জন্য জঙ্গিবাদ একটি মারাত্মক বিষফোঁড়া। এই বিষাক্ত ছোবল থেকে কারও বাঁচা সম্ভব নয়, যদি এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায়। কিন্তু পরিতাপের কথা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজনীতিকরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছেন না। বরং কোন না কোনভাবে এরা ইন পাচ্ছে রাজনীতিকদের কাছ থেকেই।
মুম্বাইয়ের ঘটনার পর আসামেও ট্রেনে বোমা হামলা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে ভাস্কর্য ভাঙার নামে মৌলবাদী নব্য বিভিন্ন সংগঠনের জন্ম হচ্ছে। হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি ইত্যাদির সদস্যরা নতুন নতুন নামে আবির্ভূত হচ্ছে। তথাকথিত আল বাইয়্যিনাত নামক একটি মোল্লাবাদী সংগঠন মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্য ভাঙার সাহস দেখিয়েছে। তারা আরও বলেছে, বাংলাদেশে কোন ভাস্কর্যই তারা থাকতে দেবে না। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এমন হুঙ্কার! এরা এমন সাহস পাচ্ছে কোথেকে। দেশে জরুরি অবস্খা থাকার পরও এরা লালন ভাস্কর্য ভেঙেছে। এরপর বলাকা ভাস্কর্যের ওপর আঘাত হেনেছে। তারপর অপরাজেয় বাংলা শহীদ মিনার কিংবা জাতীয় স্মৃতিসৌধের ওপর এরা হামলা চালাতে পারে। ভেবে অবাক হতে হয়, সরকার এদের বিরুদ্ধে নামমাত্র মামলা করলেও কোন জোরালো অভিযান চালায়নি। অথচ বিজ্ঞ উপদেষ্টামণ্ডলী দেশের যত্রতত্র সুশীল উপাদান মিশ্রিত বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা কি বুঝতে পারছেন না, একসময় তারাও এই দেশে নিরাপদভাবে রাস্তায় হাঁটাচলা করতে পারবেন না। তখন তাদের কেমন প্রতিক্রিয়া হবে?
বলাকা ভাস্কর্যের ওপর হামলার পরও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সিরিয়াস কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তারা ব্যস্ত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ধান্দায়। জোট কিংবা মহাজোট গঠন করে নির্বাচনে জেতাই তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু এই জেতা কার জন্য? জিতে যদি মানুষের মঙ্গল সাধনই লক্ষ্য হয় তবে মৌলবাদী জঙ্গিহোতারা রাজনীতির মাঠে মদদ পাচ্ছে কীভাবে?
দুই
রমনা বটমূলে জঙ্গি হামলার আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। মুফতি হান্নান কিংবা তার কিছু চেলাচামুণ্ডা এই মামলার আসামি হলেও নেপথ্যের গডফাদাররা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাংলাভাই কিংবা শায়খ রহমানকে ফাঁসি দিয়ে দিলেই যে জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না সেই প্রমাণটি ক্রমশ করছে নব্য নামধারী জঙ্গিরা। মূলত তাদের শিকড় এক। এবং বাংলাদেশের কিছু উগ্রবাদী ধর্মীয় রাজনৈতিক দল এদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ভারত, পাকিস্তান কিংবা ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত রয়েছে বিভিন্ন নামে তাদের সহযোগী সংগঠন। আর এ সংগঠনগুলো পরিচালিত হচ্ছে একই নেটওয়ার্কে। একই লক্ষ্যবিন্দুকে সামনে রেখে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, মাওলানা মিসবাহুর রহমানের ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে একটি সভা করেছেন। সে দৃশ্য ও বক্তব্য টিভিতে দেখলাম। শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি এবং তার দল ক্ষমতায় গেলে ‘সাউথ এশিয়ান টাস্কফোর্স’ নামে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠনের জন্য সার্কভুক্ত দেশগুলোর কাছে প্রস্তাব করবেন। মুম্বাইয়ে হামলার পর, ভারতের বর্তমান সরকার বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগ ইতিমধ্যে নিয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে যৌথ আলোচনার জন্য প্রতিনিধি পাঠাতে রাজি হয়েছে। সবমিলিয়ে পাক-ভারত একটি দ্রুত সিদ্ধান্ত ও কর্মপথ তৈরি করবে প্রত্যাশা করা যায়।
এর সঙ্গে বাংলাদেশকেও যুক্ত হওয়া জরুরি। কারণ গেল এক দশকে বাংলাদেশ জঙ্গিদের শক্তিশালী চারণভমিতে পরিণত হয়েছে দেশের রাজনীতিকদের গাফিলতির কারণেই। আজ যারা নবম জাতীয় সংসদে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা সংসদে দাঁড়িয়েই বলেছিল, দেশে বাংলাভাই নামক কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই। জামায়াতের দুই মন্ত্রী অনেকটা প্রত্যক্ষভাবেই বাংলাভাই ও শায়খ রহমানের পক্ষ নিয়েছিল। আর এভাবে দেশের রাজনীতিকে একটি সশস্ত্র অপশক্তির হাতে জিম্মি করার চেষ্টা ছিল অব্যাহত। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার অভিযুক্ত মন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে মনোনয়ন দিতে চাইছে বিএনপি। পিন্টুর মনোনয়ন টিকবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।
তবু বিএনপি আমলে এদেশে কি চায়তা খুব ষ্পষ্ট হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কারণ বিএনপির যারা মনোনয়ন পেয়েছে, তাদের মাঝে প্রকৃত দুর্নীতিবাজ, লুটেরা শ্রেণী এবং জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় গডফাদার কতজন তা দেশবাসীর অজানা নয়। বিএনপি এখন চাইছে, তারা যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে নাও পারে তবু বিরোধী দল হিসেবে আগামী টার্মে থেকে তাদের কালিমা কিছুটা হলেও মোচন করতে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তারেক রহমানসহ আরও পতিত অনেককেই প্রার্থী করবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এই নিশ্চয়তার গ্যারান্টি পাকাপোক্ত করার জন্য যে কোন অপশক্তির সঙ্গে হাত মিলাতে বিএনপি আপস করবে না। তা এর মধ্যেই পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
কিন্তু এই যে দু:সময়ের ঘর্ণিচক্র এ সময়ে আওয়ামী লীগ তথা চৌদ্দ দলীয় মহাজোট কতটা শক্তি নিয়ে এগুতে পারবে? ধর্মীয় রেনেসাঁর একাংশকে মহাজোটে যুক্ত করে শেখ হাসিনা কি তার স্বপ্নের বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে যেতে পারবেন? পতিত স্বৈরশাসক এরশাদকে রাষ্ট্রপতি কিংবা ঐক্যজোটের সঙ্গে চুক্তিনামা করে নিজেদের দুর্বলতার পরিচয়ই দেবে আওয়ামী লীগ। সবচেয়ে বড় অপশক্তি জঙ্গিবাদ ঠেকাতে এটা যথাযথ কৌশল ছিল কিনা তা সময়ই বলে দেবে। তবে এর আগে বাংলাদেশে আবারও বড় ধরনের নাশকতা আক্রান্ত হয় কিনা সে শঙ্কা থাকছেই।
নিউইয়র্ক ৩ ডিসেম্বর ২০০৮