ছিন্নস্মৃতি

সত্তর বছর আগের পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়, কেননা কিছু কিছু কৈশোরস্মৃতি মস্তিষ্কে আমৃত্যু ধৃত থাকে এবং হৃদয়েও। আমাদের গ্রামটি সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ঘেঁষা অন্য দশটি গ্রামের মতোই, আকারে ছোট, টিলাটালা ও গাছগাছালিতে ভরা, ছোট একটি স্রোতস্বিনী, সচ্ছল-অসচ্ছল জনগোষ্ঠী, সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান, আমার ছেলেবেলার স্বপ্নরাজ্য। [...]

সত্তর বছর আগের পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়, কেননা কিছু কিছু কৈশোরস্মৃতি মস্তিষ্কে আমৃত্যু ধৃত থাকে এবং হৃদয়েও। আমাদের গ্রামটি সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ঘেঁষা অন্য দশটি গ্রামের মতোই, আকারে ছোট, টিলাটালা ও গাছগাছালিতে ভরা, ছোট একটি স্রোতস্বিনী, সচ্ছল-অসচ্ছল জনগোষ্ঠী, সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান, আমার ছেলেবেলার স্বপ্নরাজ্য। পূর্ব কিনারে আসাম-বেঙ্গল রেলপথ, একটি স্টেশন ও সামান্য দূরে ঘাটাঘর আর ওখানেই আমাদের পাঠশালা—আবদুল লতিফ সিদ্দিকী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিখ্যাত মৌলানা, হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজামের সভাসদ, তাঁর মুরিদবর্গ ছিল সারা ভারতে।

প্রথম পাঠশালা-যাত্রা, মনে আছে, ইনাই চাচার কোলে চড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের সংসারেরই একজন। ছোটদের অভিভাবকের মতো, আমাদের সম্ভব-অসম্ভব আবদার মেটাতে কসুর করতেন না। মোটাসোটা গড়ন, হাতে লাঠি ইনাই চাচাকে গ্রামের লোকজন কেন জানি সমীহ করত, এমনকি পাঠশালার মাস্টারমশাইও। মাঝেমধ্যে স্কুলেও হানা দিতেন এবং মাস্টারমশাইকে শাসাতেন যেন আমাকে বকাঝকা না করেন। কিশোরকালের স্মৃতিভুবনে তিনি আছেন অনেকটা জায়গাজুড়ে, তাঁকে নিয়ে বড় একটা গল্প লেখাও যায়।

স্কুল বলতে একটিই টিনের ঘর, লম্বা বারান্দা, সামনে রাস্তা, তারপর একসার আমগাছ, পেছনে উঠোন, এক পাশে একটি কাঁঠালগাছ, অন্য পাশে নাগেশ্বর, শেষ মাথায় বাঁশ ও গাছগাছালির জঙ্গল। পুরো ঘরে একটিই শ্রেণীকক্ষ, প্রধান শিক্ষক নীরদচন্দ্র শর্মা, সর্বদাই অগ্নিশর্মা, সহকারী আছদ্দর আলী একেবারেই উল্টো, সর্বদাই স্নেহসিক্ত। ‘বেত নেই তো ছেলে নষ্ট’—আদর্শনির্ভর সেকালের পাঠশালাগুলো ছিল কিশোরদের জন্য আনন্দহীন অকুস্থল।

স্কুলে যেতাম শেক্সপিয়রের মতো ‘শম্বুকগতিতে পা দুটি টেনে টেনে’ একান্ত অনিচ্ছায়। বেঞ্চিতে বই-শ্লেট রেখেই রেললাইনে ছোটা, উত্তরমুখে একদৃষ্টিতে দাঁড়ানো, মনে দুরাশা—যদি তিনি না আসেন। কিন্তু বৃথা, অনিবার্য ছিল সেই আগমন। ক্ষণিক পরেই চোখে পড়ত পতপত উড়ছে সাদা ধুতির খুঁট, আখেরি নিশান। ছুটে গিয়ে বেঞ্চিতে বসতাম পাথরখণ্ডের মতো। কেন তাঁকে এত ভয় পেতাম? খুব যে মারধর করতেন তাও না। তবে? সেকালে গুরুজনদের ভয় পাওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল সম্ভবত সে জন্য। তবে এমন শিক্ষক সেকালেও ছিলেন, আজও আছেন, যাঁরা স্বভাবগুণেই নিষ্ঠুর।

আজকাল অনেক ছেলেমেয়েরই বাড়ির চেয়ে স্কুলের প্রতি অধিক পক্ষপাত দেখি। আমাদের সময় কিন্তু এমনটি একেবারেই ছিল না। অভিভাবকেরা ছেলেদের শিক্ষকের হাতে সঁপে দিয়ে বলতেন—প্রাণটা আমার, শরীরটা আপনার। এমন বন্দোবস্ত যেখানে, সেখানে কার যেতে ইচ্ছে হবে! তাই স্কুল ফাঁকি দেওয়ার নানা অজুহাত খুঁজতাম আর মোক্ষম ছিল পেটব্যথা ও জ্বরজ্বর ভাব। এগুলো শনাক্তির কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় না থাকায় রেহাইও মিলত, কিন্তু পরিণতি সর্বদা শুভ হতো না। এমনটি একাধিকবার ঘটেছে—মা সামান্য পরীক্ষা করে স্কুলে না-যাওয়ার আরজি মঞ্জুর করেছেন, একসময় পালিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে খেলায় বিভোর, তখনই মায়ের হাঁকডাক, একান্ত অনিচ্ছায় ঘরে ফিরে দেখি উঠোনে জনাতিনেক গাট্টাগোট্টা ছাত্র, যথার্থ যমদূত, স্কুলে নাকি ‘বাবু’ অর্থাৎ পরিদর্শক আসবেন, তাই হাজিরা একান্ত আবশ্যক। নিদয়া মা অসুখের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে প্যান্ট-জমা পরিয়ে ওদের হাতেই যখন তুলে দিতেন, মরে যেতে ইচ্ছে হতো।

সে ছিল এক দুঃসহ যাত্রা, পা চলত না, বুক ধড়ফড় করত, গলা শুকিয়ে যেত, চলতাম হাড়িকাঠে নেওয়া বলির পাঁঠার মতো। স্কুলের কাছে পৌঁছালে একটা গুনগুন আওয়াজ কানে আসত, সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যে নীরদ শর্মার তর্জন-গর্জন। শরীর ঠান্ডা হয়ে যেত, দাঁড়িয়ে পড়তাম। সঙ্গীরা ঠেলে, কখনো পাঁজাকোলা করে সেই যমালয়ে হাজির করত। অভ্যর্থনা কেমন ঘটত বলাই বাহুল্য। বাবু আসা, জানতাম আগেই, সব মিথ্যা। এমনই ছিল আমাদের সময় স্কুল ফাঁকির ‘অপরাধ ও শাস্তি’।

বাবু আসার সত্যিকার ব্যাপার ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম। দু-তিন দিন তখন সে রকম পড়াশোনা হতো না, তর্জন-গর্জন না, ছাত্রদের কিছু প্রশ্নোত্তর শেখানো হতো বাবু যেগুলো জিজ্ঞেস করতে পারেন। একসময় আমাদের আমতলায় পাঠানো হতো ক্লাসের ফার্স্টবয় মাখমদের জিম্মায়। সে আমাদের নামতা শেখাত এক একে এক, দুই একে দুই…। কখনো চলত মানসাঙ্কের মহড়া। মাস্টারমশাই স্কুলঘর সাজাতেন নিজের আঁকা চমৎকার সব ছবি দিয়ে। তাতে থাকত গ্রাম, থানা, মহকুমা, জেলা, উপত্যকা, প্রদেশ এবং বর্মা ও সিংহলসহ ভারতবর্ষের রঙিন ম্যাপ আর সেই সঙ্গে ফুল-ফল, জীবজন্তু, পাখপাখালির ছবি। সারা ঘর ঝলমলিয়ে উঠত। ভেবে অবাক হতাম, কীভাবে ছাপার মতন এমন ছবি আঁকেন তিনি। নির্দিষ্ট দিনে স্যুটকোট পরা বাবু আসতেন, দেখতাম শিক্ষকেরাও তাঁকে ভয় পান, খাতাপত্র দেখাতে তাঁদেরও হাত কাঁপে, সর্বক্ষণ জড়সড় থাকেন। ছাত্রদের তিনি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন, ভালো ছাত্ররাই আগবেড়ে উত্তর দিত। ব্যাপারটা প্রায় সর্বদাই নির্বিঘ্নে শেষ হতো এবং একদিনের ছুটির ঘোষণা দিয়ে বাবু বিদায় নিতেন।

ছবিগুলো আরও কয়েকদিন দেয়ালে ঝুলত। ময়নার একটি ছবি ছিল আমার বেঞ্চির সামনের খুঁটিতে। ওটি থেকে কেন যেন চোখ ফেরাতে পারতাম না। পাখিটি ধীরে ধীরে আমাকে জাদু করে ফেলল। ঘরে বিকেলে আলো ছড়িয়ে পড়লে মনে হতো সে জীবন্ত হয়ে উঠছে, নড়াচড়া শুরু করেছে। একসময় ছবির ময়না ঘরে উড়তেও লাগত, ওর ডাকও স্পষ্ট শুনতে পেতাম। কেউ কোথাও নেই, আমি সম্বিতহারা। তারপর মাথায় মাস্টারমশায়ের হাতের স্নেহ স্পর্শে হুঁশ হতো। ‘কী দেখছিস পাগলের মতো, স্কুল কখন ছুটি হয়ে গেছে, বাড়ি যা।’ এখন ভাবি ছবির ওই পাখিটিই কি প্রকৃতির সঙ্গে সারা জীবনের মতো আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিয়েছিল?

পাঠশালায় আমারও বৃত্তিপরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। মাস্টারমশায় আমি আর মাখমদকে অনেক দিন ধরে ছুটির পর নিয়মিত পড়িয়েছিলেন। কিন্তু আমার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। যন্ত্রজগৎ সম্পর্কে অবিশ্বাসী পিতৃদেব কেন জানি নিশ্চিত ছিলেন যে শহরে গেলে গাড়িচাপা পড়ে আমার অপঘাতমৃত্যু অনিবার্য। নীরদ শর্মার অনুনয়-বিনয়, অনুরোধ-উপরোধ কোনো কাজেই আসেনি। মাস্টারমশায়ের এই প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় মনে বড় একটা আঘাত পেয়েছিলেন। মাখমদ শহরে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে নিরাপদেই ফিরে এসেছিল, বৃত্তি অবশ্য পায়নি, আমি গেলেও পেতাম না। সেকালে বৃত্তিলাভের সৌভাগ্য মোটেও সহজ ছিল না। আমি ও মাখমদ ছাড়া আমাদের ক্লাসে আরও কজন ভালো ছাত্র ছিল। মুচদ্দর ও মখদ্দচের কথা মনে আছে। সবাই পাঠশালা ভালোই পাস করেছিল, কিন্তু আমি ছাড়া কেউই হাইস্কুলের আঙিনা মাড়ায়নি। তখনকার গ্রামাঞ্চলের কৃষিনির্ভর নিম্নবিত্ত সমাজে ইংরেজি শিক্ষার তেমন কদর ছিল না। মায়ের অনমনীয় জেদের জন্যই আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছিল, নইলে আমাকেও কোনো টোলে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত পারিবারিক কবিরাজি পেশা জোয়ালে জুতে দেওয়া হতো।

পাঠশালা পেরিয়ে হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় টপকে, শেষে বহু দূরে চাকরি, তারপর বিদেশে। বহুদিন পর বাড়ি ফিরেছি। স্টেশনে আমার সঙ্গেও নামল কয়েকজন। কেউ আমাকে চেনে না। প্লাটফর্ম খালি হলে হাঁটতে শুরু করি এবং একসময় আমাদের পাঠশালার কাছে পৌঁছে রেললাইনে দাঁড়িয়ে উত্তরে তাকাই। না, সাদা ধুতির কোনো খুঁট চোখে পড়ে না। জানি পড়বে না কোনো দিন। স্কুলের সামনে এসে থামি। নামটি বদলে গেছে, বাদ পড়েছেন এককালের নমস্য মৌলানা সাহেব। কী আশ্চর্য! হঠাৎ শুনতে পাই মাখমদের গলার আওয়াজ—এক একে এক…তারপর আমরা দুজনে গলাগলি করে হাঁটি, গল্প করি, দেখি ছবির ওই ময়নাটিও জুটে গেছে, উড়ে চলেছে আমাদের সঙ্গে। আমরা পৌঁছে যাই বারোয়ারি গোরস্থানে। শেষ রাতে ট্রেন ধরার সময় কতবার জায়গাটা চোখবুঝে দৌড়ে পার হয়েছি। সম্বিত ফিরলে দেখি কেউ নাই, মাখমদ ও ময়না আমাকে ফেলে চলে গেছে। ভাবি মাখমদ বেঁচে আছে তো! আবার হাঁটি। দশ মিনিটের পথ আর ফুরোয় না, বাড়িটা যেন যোজন যোজন দূর।

(প্রথম আলো-র সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত)

দ্বিজেন শর্মা

জন্ম ১৯২৯, সিলেট। উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক (ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল ও নটর ডেম কলেজ, ঢাকা); অনুবাদক, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক। বসবাস ঢাকায়। শখ : উদ্যান পরিকল্পনা।

৫ comments

  1. সৈকত আচার্য - ৫ ডিসেম্বর ২০১০ (২:৫৬ পূর্বাহ্ণ)

    শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন শর্মা লিখেছেনঃ

    স্কুলে যেতাম শেক্সপিয়রের মতো ‘শম্বুকগতিতে পা দুটি টেনে টেনে’ একান্ত অনিচ্ছায়। বেঞ্চিতে বই-শ্লেট রেখেই রেললাইনে ছোটা, উত্তরমুখে একদৃষ্টিতে দাঁড়ানো, মনে দুরাশা—যদি তিনি না আসেন। কিন্তু বৃথা, অনিবার্য ছিল সেই আগমন। ক্ষণিক পরেই চোখে পড়ত পতপত উড়ছে সাদা ধুতির খুঁট, আখেরি নিশান। ছুটে গিয়ে বেঞ্চিতে বসতাম পাথরখণ্ডের মতো। কেন তাঁকে এত ভয় পেতাম? খুব যে মারধর করতেন তাও না। তবে?

    অনেকদিন আগে লেখা রবি ঠাকুরের প্রবন্ধেও আমাদের শিক্ষার এই একই চিত্র খুঁজ়ে পাই। “শিক্ষাসমস্যা” প্রবন্ধে তিনি লিখছেনঃ

    ” ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তার পর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়।”

    তিনি আরো বলছেনঃ

    ” দশটা হইতে চারটে পর্যন্ত যাহা মুখস্থ করি, জীবনের সঙ্গে, চারি দিকের মানুষের সঙ্গে, ঘরের সঙ্গে তাহার মিল দেখিতে পাই না। বাড়িতে বাপমা-ভাইবন্ধুরা যাহা আলোচনা করেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে তাহার যোগ নাই,বরঞ্চ অনেক সময়ে বিরোধ আছে। এমন অবস্থায় বিদ্যালয় একটা এঞ্জিন মাত্র হইয়া থাকে—তাহা বস্তু জোগায়, প্রাণ জোগায় না।”

    মাঝে মাঝে ভাবি, এই স্কুল নামক প্রতিষ্ঠানটি আমাদের দেশে চিরকাল কি একটা কলের পুতুল তৈরীর কারখানা-ই হয়ে থাকবে। স্কুলের এই “ভীতির শাসন”-সংস্কৃতি থেকে আমরা কবে বেরিয়ে আসতে পারবো?

    • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৫ ডিসেম্বর ২০১০ (৭:১১ পূর্বাহ্ণ)

      এ লেখা অনেকেরই হয়ত নিজস্ব ছেলেবেলাকে স্পর্শ করবে_খুবই ভালো লাগল।

  2. নওরীন তামান্না - ৫ ডিসেম্বর ২০১০ (৭:২৮ অপরাহ্ণ)

    চমৎকার এই লেখাটি পড়ে বহু আগে পড়া একটি কবিতা মনে পড়ে গেল, বিশেষ করে শেষাংশে অম্বিকা মাস্টারের সাথে কবির বিনিময়টুকু।

    ছেলেটা
    (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পূনশ্চ)

    ছেলেটার বয়স হবে বছর দশেক —
    পরের ঘরে মানুষ।
    যেমন আগাছা বেড়ে ওঠে ভাঙা বেড়ার ধারে —
    মালীর যত্ন নেই,
    আছে আলোক বাতাস বৃষ্টি
    পোকামাকড় ধুলোবালি —
    কখনো ছাগলে দেয় মুড়িয়ে,
    কখনো মাড়িয়ে দেয় গোরুতে —
    তবু মরতে চায় না, শক্ত হয়ে ওঠে,
    ডাঁটা হয় মোটা,
    পাতা হয় চিকন সবুজ।

    ছেলেটা কুল পাড়তে গিয়ে গাছের থেকে পড়ে,
    হাড় ভাঙে,
    বুনো বিষফল খেয়ে ওর ভির্মি লাগে,
    রথ দেখতে গিয়ে কোথায় যেতে কোথায় যায়,
    কিছুতেই কিছু হয় না —
    আধমরা হয়েও বেঁচে ওঠে,
    হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসে
    কাদা মেখে কাপড় ছিঁড়ে —
    মার খায় দমাদম,
    গাল খায় অজস্র —
    ছাড়া পেলেই আবার দেয় দৌড়।

    মরা নদীর বাঁকে দাম জমেছে বিস্তর,
    বক দাঁড়িয়ে থাকে ধারে,
    দাঁড়কাক বসেছে বৈঁচিগাছের ডালে,
    আকাশে উড়ে বেড়ায় শঙ্খচিল,
    বড়ো বড়ো বাঁশ পুঁতে জাল পেতেছে জেলে,
    বাঁশের ডগায় বসে আছে মাছরাঙা,
    পাতিহাঁস ডুবে ডুবে গুগলি তোলে।

    বেলা দুপুর।
    লোভ হয় জলের ঝিলিমিলি দেখে —
    তলায় পাতা ছড়িয়ে শেওলাগুলো দুলতে থাকে,
    মাছগুলো খেলা করে।
    আরো তলায় আছে নাকি নাগকন্যা?
    সোনার কাঁকই দিয়ে আঁচড়ায় লম্বা চুল,
    আঁকাবাঁকা ছায়া তার জলের ঢেউয়ে।
    ছেলেটার খেয়াল গেল ওইখানে ডুব দিতে —
    ওই সবুজ স্বচ্ছ জল,
    সাপের চিকন দেহের মতো।
    ‘কী আছে দেখিই-না’ সব তাতে এই তার লোভ।
    দিল ডুব, দামে গেল জড়িয়ে —
    চেঁচিয়ে উঠে, খাবি খেয়ে, তলিয়ে গেল কোথায়।
    ডাঙায় রাখাল চরাচ্ছিল গোরু,
    জেলেদের ডিঙি নিয়ে টানাটানি করে তুললে তাকে —
    তখন সে নিঃসাড়।

    তার পরে অনেক দিন ধরে মনে পড়েছে
    চোখে কী করে সর্ষেফুল দেখে,
    আঁধার হয়ে আসে,
    যে মাকে কচি বেলায় হারিয়েছে
    তার ছবি জাগে মনে,
    জ্ঞান যায় মিলিয়ে।
    ভারি মজা,
    কী করে মরে সেই মস্ত কথাটা।
    সাথিকে লোভ দেখিয়ে বলে,
    ‘একবার দেখ্‌-না ডুবে, কোমরে দড়ি বেঁধে,
    আবার তুলব টেনে। ‘
    ভারি ইচ্ছা করে জানতে ওর কেমন লাগে।
    সাথি রাজি হয় না;
    ও রেগে বলে, ‘ভীতু, ভীতু, ভীতু কোথাকার। ‘

    বক্সিদের ফলের বাগান, সেখানে লুকিয়ে যায় জন্তুর মতো।
    মার খেয়েছে বিস্তর, জাম খেয়েছে আরো অনেক বেশি।
    বাড়ির লোকে বলে, ‘লজ্জা করে না বাঁদর?’
    কেন লজ্জা?
    বক্সিদের খোঁড়া ছেলে তো ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ফল পাড়ে,
    ঝুড়ি ভরে নিয়ে যায়,
    গাছের ডাল যায় ভেঙে,
    ফল যায় দ’লে —
    লজ্জা করে না?

    একদিন পাকড়াশিদের মেজো ছেলে একটা কাঁচ-পরানো চোঙ নিয়ে
    ওকে বললে, ‘দেখ্‌-না ভিতর বাগে।’
    দেখল, নানা রঙ সাজানো,
    নাড়া দিলেই নতুন হয়ে ওঠে।
    বললে, ‘দে-না ভাই, আমাকে।
    তোকে দেব আমার ঘষা ঝিনুক,
    কাঁচা আম ছাড়াবি মজা ক’রে —
    আর দেব আমের কষির বাঁশি। ‘

    দিল না ওকে।
    কাজেই চুরি করে আনতে হল।
    ওর লোভ নেই —
    ও কিছু রাখতে চায় না, শুধু দেখতে চায়
    কী আছে ভিতরে।
    খোদন দাদা কানে মোচড় দিতে দিতে বললে,
    ‘চুরি করলি কেন। ‘
    লক্ষ্মীছাড়াটা জবাব করলে,
    ‘ও কেন দিল না। ‘
    যেন চুরির আসল দায় পাকড়াশিদের ছেলের।

    ভয় নেই ঘৃণা নেই ওর দেহটাতে।
    কোলাব্যাঙ তুলে ধরে খপ ক’রে,
    বাগানে আছে খোঁটা পোঁতার এক গর্ত,
    তার মধ্যে সেটা পোষে —
    পোকামাকড় দেয় খেতে।
    গুবরে পোকা কাগজের বাক্সোয় এনে রাখে,
    খেতে দেয় গোবরের গুটি —
    কেউ ফেলে দিতে গেলে অনর্থ বাধে।
    ইস্কুলে যায় পকেটে নিয়ে কাঠবিড়ালি।

    একদিন একটা হেলে সাপ রাখলে মাস্টারের ডেস্কে —
    ভাবলে, ‘দেখিই – না কী করে মাস্টারমশায়। ‘
    ডেক্‌সো খুলেই ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে দিলেন দৌড় —
    দেখবার মতো দৌড়টা।

    একটা কুকুর ছিল ওর পোষা,
    কুলীনজাতের নয়,
    একেবারে বঙ্গজ।
    চেহারা প্রায় মনিবেরই মতো,
    ব্যবহারটাও।
    অন্ন জুটত না সব সময়ে,
    গতি ছিল না চুরি ছাড়া —
    সেই অপকর্মের মুখে তার চতুর্থ পা হয়েছিল খোঁড়া।
    আর, সেইসঙ্গেই কোন্‌ কার্যকারণের যোগে
    শাসনকর্তাদের শসাখেতের বেড়া গিয়েছিল ভেঙে।
    মনিবের বিছানা ছাড়া কুকুরটার ঘুম হত না রাতে,
    তাকে নইলে মনিবেরও সেই দশা।
    একদিন প্রতিবেশীর বাড়া ভাতে মুখ দিতে গিয়ে
    তার দেহান্তর ঘটল।

    মরণান্তিক দুঃখেও কোনোদিন জল বেরোয় নি যে ছেলের চোখে
    দু দিন সে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে বেড়ালো,
    মুখে অন্নজল রুচল না,
    বক্সিদের বাগানে পেকেছে করম্‌চা —
    চুরি করতে উৎসাহ হল না।
    সেই প্রতিবেশীদের ভাগ্নে ছিল সাত বছরের,
    তার মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে এল এক ভাঙা হাঁড়ি।
    হাঁড়ি-চাপা তার কান্না শোনালো যেন ঘানিকলের বাঁশি।

    গেরস্তঘরে ঢুকলেই সবাই তাকে ‘দূর দূর’ করে,
    কেবল তাকে ডেকে এনে দুধ খাওয়ায় সিধু গয়লানী।
    তার ছেলেটি মরে গেছে সাত বছর হল,
    বয়সে ওর সঙ্গে তিন দিনের তফাত।
    ওরই মতো কালোকোলো,
    নাকটা ওইরকম চ্যাপ্টা।
    ছেলেটার নতুন নতুন দৌরাত্মি এই গয়লানী মাসীর ‘পরে।
    তার বাঁধা গোরুর দড়ি দেয় কেটে,
    তার ভাঁড় রাখে লুকিয়ে,
    খয়েরের রঙ লাগিয়ে দেয় তার কাপড়ে।
    ‘দেখি-না কী হয়’ তারই বিবিধ-রকম পরীক্ষা।
    তার উপদ্রবে গয়লানীর স্নেহ ওঠে ঢেউ খেলিয়ে।
    তার হয়ে কেউ শাসন করতে এলে
    সে পক্ষ নেয় ওই ছেলেটারই।

    অম্বিকে মাস্টার আমার কাছে দুঃখ ক’রে গেল,
    ‘শিশুপাঠে আপনার লেখা কবিতাগুলো
    পড়তে ওর মন লাগে না কিছুতেই,
    এমন নিরেট বুদ্ধি।
    পাতাগুলো দুষ্টুমি ক’রে কেটে রেখে দেয়,
    বলে ইঁদুরে কেটেছে।
    এতবড়ো বাঁদর।’

    আমি বললুম, ‘সে ত্রুটি আমারই,
    থাকত ওর নিজের জগতের কবি
    তা হলে গুবরে পোকা এত স্পষ্ট হত তার ছন্দে
    ও ছাড়তে পারত না।
    কোনোদিন ব্যাঙের খাঁটি কথাটি কি পেরেছি লিখতে,
    আর সেই নেড়ি কুকুরের ট্রাজেডি।’

  3. শুভজিৎ ভৌমিক - ১১ ডিসেম্বর ২০১০ (২:০৭ পূর্বাহ্ণ)

    ভালো লাগলো লেখাটা।

  4. নিরাভরণ - ২০ ডিসেম্বর ২০১০ (১:৫৬ পূর্বাহ্ণ)

    ছোটবেলার ঘটনাগুলো যেমন মায়াবি নষ্টালজিয়া হয়ে মনে গেঁথে থাকে তেমনি করে চলে এসেছে আপনার লেখায়। অনেক দিন আগের কথা বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের সৌভাগ্য এমন একটা লেখা ব্লগে পড়তে পারছি। যে শৈশব আমরা কাটিয়েছি সেখানকার পৃথিবীটা অনেকটাই আলাদা — সেখানে বাবু নেই, আমতলা নেই, টিনের ঘরের স্কুল থেকে পাশ করা দ্বিজেন শর্মারা নেই, গুরুজনদের প্রতি ভয়ভিতিও হয়ত ক্ষেত্রবিশেষে কম ছিল। তবে একটুকরো কাগজে আকা একটা ময়না পাখিকে ক্লাশরুম জুড়ে ওড়ানোর মত মন হয়ত এখনো লুকিয়ে আছে শিশুদের মনে — ছেলেবেলার ক্লাশরুম থেকে একটা ছোট অভিজ্ঞতা হয়ত এখনো কাউকে বলে দিতে পারে সে জীবনভর কি করতে চায়। এই বন্ধনটা আদতে অনেক বড় মুক্তি যে কারো জন্য।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.