বরিশালে একদিন

বরিশালের এক বিদগ্ধজন ও মনস্বী শিক্ষক তাঁর নয়-দশজন ছাত্রীর সামনে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ওদের কিছু বলুন। আমি অভিভূত ও উৎফুল্ল, কত দিন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। শিক্ষকতা ছেড়ে বিদেশে চাকরিতে থাকাকালে বারবার স্বপ্নে দেখেছি, ক্লাস নিতে গিয়ে শ্রেণীকক্ষ খুঁজে পাচ্ছি না কিংবা পেলেও সেটা শূন্য। কিন্তু কী বলা যায় এদের? সবাই দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী, অনিশ্চিত উচ্চশিক্ষার আশা-নিরাশায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুকদের সংকট বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। কেননা, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার ফল মেধাবিচারের কোনো নিখুঁত বা নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড নয়। একবার আমরা নটরডেম কলেজের রেওয়াজ ভেঙে পরীক্ষামূলকভাবে দ্বিতীয় বিভাগপ্রাপ্ত কিছু ছাত্রকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করি এবং তারা সবাই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। আমাদের দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের অনেকেই শিক্ষার সর্বস্তরে প্রথম শ্রেণী না পেয়েও নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথের কথা বাদই দিলাম। লাডলী মোহন মিত্রের মতো একজন সাধারণ অধ্যাপকের কথা এ ক্ষেত্রে আরও প্রাসঙ্গিক, যিনি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণী পেয়েও উচ্চমাধ্যমিক রসায়নবিদ্যার একটি বই লিখে এতটাই খ্যাতি লাভ করেন যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অধ্যাপনায় আমন্ত্রণ জানায় এবং তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

কিন্তু এসব কথা এদের শোনানো নিরর্থক। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ শুরু। আমি ১৯৫৪ সালে প্রথম বরিশাল আসি এবং শহরের নিসর্গশোভা দেখে মুগ্ধ হই। সে কথাই শোনাই এবং তারা অবাক হয়। স্টিমারঘাট থেকে সাগরদি পর্যন্ত সুরকির মনভোলানো রাঙামাটির পথ, দুই পাশে পাম আর ঝাউয়ের সারি, চোখের সামনে কীর্তনখোলা নদী, বেলস পার্কের লাগোয়া আরএসএন কোম্পানির বাগানঘেরা আবাসন ইত্যাদি। তারা এসব কিছুই দেখেনি। সেকালে বরিশালীবাসী নিজ শহরেই থাকতে ভালোবাসত, জরুরি কাজ ছাড়া ঢাকায় যেত না। এখন সময় ও পরিস্থিতি পাল্টেছে। রাজধানীর কুহকী টানে সবাই ভূতগ্রস্ত। রাজনীতিকেরা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিরোধী, তাই জেলা- উপজেলার শহরগুলো অবহেলিত, নৈরাজ্যিক নির্মাণে সৌন্দর্যহীন, জরুরি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং অনেকটা সে জন্যও ঢাকার এই অস্বাস্থ্যকর মেদস্ফীতি।

নগর পরিকল্পনার কথা তাদের বলি এবং এটিও যে একটি পাঠ্য বিষয়, তাদের তা বোঝাই- শুনে তারা অবাক হয়। বুয়েটে পদার্থবিদ্যা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ব্রিডিং ও জেনিটিকসেও উচ্চতর ডিগ্রি লাভ সম্ভব সেটাও তাদের অজানা। পড়ার মতো কত কত বিষয় আছে। কোথায় কী পড়া যায় মফস্বলের ছাত্রছাত্রীরা এ সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ। শিক্ষকেরা কিছুই বলেন না, কোনো স্বপ্নও তাদের দেখান না। এ শিক্ষার্থীরা যেটুকু জানে সবই মোটা দাগের। আমি নিজেও এই অজ্ঞতার শিকার। অনার্স সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় স্নাতক পর্যায়ে পাস কোর্স পড়েছি কলকাতার সিটি কলেজে ১৯৫০ সালে। বরিশালের কৃতী সন্তানদের সম্পর্কেও তারা বিস্তারিত জানে না। অশ্বিনীকুমার, ফজলুল হক, বড়জোর মনোরমা মাসিমা। ব্রজমোহন কলেজের বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ শান্তিসুধা ঘোষও অচেনা। অরুণা আসফ আলী যে বরিশালের মেয়ে এই তথ্য তাদের জানার কথা নয়। কলকাতার গড়ের মাঠের তাঁর বক্তৃতা শুনেছি। মস্কোয় আমাদের বাসায়ও গেছেন, তাঁর কীর্তিকথা-গল্পকথা তাদের শোনাই। তারা কেবলই অবাক হয়। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা নেই। থাকার কোনো হেতু নেই। কেননা, স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে অনেক আগেই বাধ্যতামূলক ইতিহাস ও ভুগোল পাঠ উঠে গেছে। বিকল্প হিসেবে তারা পড়েছে সমাজবিদ্যা, যা বস্তুত অনেক বিদ্যার এক জগাখিচুড়ি- তাতে বিভ্রান্তি বাড়তে পারে, জ্ঞান বাড়ে না। আমরা পাঠশালায় মানচিত্র এঁকেছি প্রথমে নিজ গ্রামের, পরে ক্রমান্বয়ে থানা, মহকুমা ও প্রদেশের উচ্চবিদ্যালয়ে দেশ ও পৃথিবীর। স্থানীয় ইতিহাস অবশ্য পড়ানো হতো না (পড়ানো উচিত), পড়েছি ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস। এভাবে ছেলেবেলায়ই পৃথিবীর ভূগোল ও ইতিহাস সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মেছে। মানুষ যে একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত এবং তারা একই গ্রহের বাসিন্দা ইতিহাস ও ভূগোল পাঠ ছাড়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই বিশ্ববোধ তাহলে কিশোরমনে কীভাবে জম্মাবে? আমাদের শিক্ষা পরিকল্পকেরা এসব ভাবেন বলে মনে হয় না।

আমার জ্যেষ্ঠ বন্ধু বরিশালের নিসর্গী এম আহমেদের কথাও ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করি। কেউ তাঁকে চেনে না, অথচ প্রয়াত হয়েছেন মাত্র ২৫ বছর আগে। দুর্লভ গাছপালা ও পাখপাখালিতে ভরা তাঁর বাড়িটি ছিল আমাদের গুরুগৃহতুল্য। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম জয়েন্ট আমাজন লিলির বীজ থেকে চারা জম্মান। বরিশালের অনেক পুকুর এবং ঢাকার বলধা উদ্যান ও রমনা লেকে সেগুলো লাগান। তাঁর কাছ থেকেই অর্কিড ও ক্যাকটাস চিনতে শিখি। এককালে তাঁকে নিয়ে টিভিতেও অনুষ্ঠান হয়েছে। এই মেয়েরা ‘আমাজন লিলি’ চেনে না, নামও শোনেনি কোনো দিন। অথচ বিদেশে শিশুপাঠ্য বইয়েও এই লিলির ছবি আছে, প্রায় সবাই অন্তত নামে চেনে। যাহোক, এসব কথা শুনে তারা ফকিরবাড়ির রোডে এম আহমেদের বাড়িতে একবার যাওয়ার আগ্রহ দেখায়।

আমার শিক্ষকতাকালে উচ্চমাধ্যমিকের জীববিদ্যা কোর্সে ডরউইন ও বিবর্তনবাদ অবশ্যপাঠ্য ছিল। অতীব আগ্রহসহকারে পড়াতাম। কেননা, বিবর্তনবিদ্যা শুধু বিজ্ঞান নয়, একটি দর্শনও, যা বিভিন্ন জ্ঞান শাখায় এমনকি সাহিত্যেও আত্তীকৃত হয়েছে। কয়েক বছর থেকে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে এটি পড়ানো হয় না, পরিবর্তে এসেছে জীবপ্রযুক্তি। অথচ এও যে ডারউইনের বিবর্তনবাদেরই সম্প্রসারণ, প্রায়োগিক ফল- এটা কি পাঠ্যবিষয়ক প্রণেতারা জানেন না, নাকি তাঁরা প্রয়োগকে তত্ত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন? ইচ্ছা ছিল বিষয়টি মেয়েদের বোঝাই, কিন্তু তাদের আর সময় নেই, আছে ক্লাস ও কোচিং। অগত্যা ওদের বিদায় দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরি।

দ্বিজেন শর্মা

জন্ম ১৯২৯, সিলেট। উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক (ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল ও নটর ডেম কলেজ, ঢাকা); অনুবাদক, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক। বসবাস ঢাকায়। শখ : উদ্যান পরিকল্পনা।

৩ comments

  1. ইমতিয়ার - ১৮ নভেম্বর ২০০৮ (৬:৩৫ অপরাহ্ণ)

    অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়ার সুযোগ হলো। ভাল লাগল। শিক্ষার এত ক্ষেত্র ছড়িয়ে রয়েছে, সে তুলনায় আমাদের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলার উদ্যম সত্যিই খুব কম। জীবপ্রযুক্তি সংযোজনের ব্যাপারটি নিয়ে ভবিষ্যতে আপনার কাছ থেকে লেখা প্রত্যাশা করছি।

  2. অবিশ্রুত - ১৮ নভেম্বর ২০০৮ (৬:৪৪ অপরাহ্ণ)

    ডারউইনের বিবর্তনবাদকে পাশ কাটানোর এই প্রবণতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বোধকরি শিক্ষাকে মৌলবাদসম্পৃক্ত করার প্রবণতা, এবং এটি মূলত একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য। কেননা বিজ্ঞানমনস্কতা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার পথও রুদ্ধ করে দেবে, যার জন্যে মৌলবাদীরা চায় না মানুষ এ সম্পর্কে অবগত হোক। কেবল ইসলাম ধর্মের মৌলবাদীরাই নয়, খ্রীস্টিয়ান মৌলবাদীরাও দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনও কোনও স্কুলে তো এই মৌলবাদীরা গিয়ে বসে থাকে, জীববিদ্যার টিচার কীভাবে বিবর্তনতত্ত্ব পড়ায় তা শুনে ও দেখে আশ্বস্ত হবার কিংবা অভিযোগ করবার জন্যে।
    দ্বিজেন শর্মা-র মতো পথিকৃৎ ও প্রাজ্ঞ মানুষদের কাছে আমাদের দাবি প্রকৃতি ও মানুষের প্রকৃত চিত্র ও ইতিহাস, ডারউইনবাদের অনিবার্যতা তুলে ধরার লক্ষ্যে বড় আকারের একটা উদ্যোগ নিন। আমরা আপনার পাশে আছি।

  3. রেজাউল করিম সুমন - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৮ (৯:২৪ অপরাহ্ণ)

    ইমতিয়ার শামীম ও অবিশ্রুত দু’জনের সঙ্গেই সহমত পোষণ করছি। ছোট কিন্তু অসাধারণ এই লেখাটার জন্য অনেক ধন্যবাদ লেখককে।

    […] স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে অনেক আগেই বাধ্যতামূলক ইতিহাস ও ভূগোল পাঠ উঠে গেছে। বিকল্প হিসেবে তারা পড়েছে সমাজবিদ্যা, যা বস্তুত অনেক বিদ্যার এক জগাখিচুড়ি — তাতে বিভ্রান্তি বাড়তে পারে, জ্ঞান বাড়ে না। আমরা পাঠশালায় মানচিত্র এঁকেছি প্রথমে নিজ গ্রামের, পরে ক্রমান্বয়ে থানা, মহকুমা ও প্রদেশের; উচ্চবিদ্যালয়ে দেশ ও পৃথিবীর। স্থানীয় ইতিহাস অবশ্য পড়ানো হতো না (পড়ানো উচিত), পড়েছি ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস। এভাবে ছেলেবেলায়ই পৃথিবীর ভূগোল ও ইতিহাস সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মেছে। মানুষ যে একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত এবং তারা একই গ্রহের বাসিন্দা ইতিহাস ও ভূগোল পাঠ ছাড়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই বিশ্ববোধ তাহলে কিশোরমনে কীভাবে জন্মাবে? আমাদের শিক্ষা পরিকল্পকেরা এসব ভাবেন বলে মনে হয় না।

    এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনোই অবকাশ নেই। তবে ভূগোল ক্লাসে মানচিত্র আঁকার ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকটাই আলাদা। স্কুলের উঁচু ক্লাসে বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশের মানচিত্র এঁকেছি আমরাও। এ কাজটাতে খুব যে উৎসাহ পেতাম তা নয়। উৎসাহ না পাওয়ার একটা বড়ো কারণ অবশ্য আমাদের ভূগোল শিক্ষকের অতৃপ্তি। একটা মজার ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমাদের এক বন্ধু একবার ক্লাসে অক্সফোর্ড অ্যাটলাস থেকে ছাপ মেরে এশিয়ার মানচিত্র এঁকেছিল। ক্লাসের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভূগোল স্যার ইরেজার দিয়ে ঘষে এর অনেকখানি অংশ মুছে ফেলেছিলেন, তারপর একটা টু-বি পেনসিল দিয়ে নতুন করে দেগে দিয়েছিলেন মহাদেশের সীমানা!

    স্কুলের নিচু ক্লাসে আপনাদের মতো নিজ গ্রাম বা মহকুমার ছবি আঁকতে হয়নি আমাদের। নিজের গ্রামের চৌহদ্দি সম্পর্কে এখনো আমার ভালো ধারণা নেই; মানচিত্র আঁকতে পারার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যারা শহরে পড়াশোনা করেছি তারা গ্রামের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করার সত্যিকার শিক্ষা পাঠ্যবই থেকে ছাত্রজীবনের কোনো স্তরেই পাইনি। শিক্ষা পরিকল্পকেরা এ বিষয়েও কিছু ভাবেন বলে মনে হয় না।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.