গত চোতবোশেখে বাড়ি গিয়ে ঝিঁঝিঁর গান শুনেছি তিনবেলা, মধ্যরাতে বউকথাকও-পাখির ডাকে উদাস হয়ে গেছে মন। ‘বউকথাকও’ তো কেতাবি নাম, আমরা চিনি ‘কাট্টলপাগানি’ নামে যার অবিরাম ডাকে পেকে ওঠে গেরস্তের কাঁঠাল। সেই পাখি আজও ডাকে, কিন্তু পাওয়া যায় না তেমন পাকা কাঁঠালের মউতাত। [...]

গত চোতবোশেখে বাড়ি গিয়ে ঝিঁঝিঁর গান শুনেছি তিনবেলা, মধ্যরাতে বউকথাকও-পাখির ডাকে উদাস হয়ে গেছে মন। ‘বউকথাকও’ তো কেতাবি নাম, আমরা চিনি ‘কাট্টলপাগানি’ নামে যার অবিরাম ডাকে পেকে ওঠে গেরস্তের কাঁঠাল। সেই পাখি আজও ডাকে, কিন্তু পাওয়া যায় না তেমন পাকা কাঁঠালের মউতাত। কাঁঠাল নিয়েও তো একটা খেলা ছিল আমাদের। বাড়ির বিশাল উঠোন ভরে যেত চৈতালি জ্যোৎস্নায় আর আমরা ভাইবোনেরা মিলে কাঁঠাল সেজে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতাম আলোছায়ায়। সামনেই গেরস্ত, আরেকজন বাইরে থেকে আসত ‘রাজার ব্রাহ্মণ’ হয়ে। গেরস্ত : কন লে বা কন? ব্রাহ্মণ : রাজারো ব’ন। গেরস্ত : এত কা রাইত? ব্রাহ্মণ : খাইতি দাইতি নিশুত রাইত রাজারো বউয়ে কইয়ি যে উগ্গ কা-ট্ট-লে-ল্লা-ই! এরপর ব্রাহ্মণ এসে একেকটি কাঁঠালের পেটে টোকা দিয়ে দেখত পেকেছে কি না, পছন্দসই একটিকে ধরে নিয়ে যেত আর হয়তো-বা তখনই কাট্টলপাগানি-পাখি ডেকে ডেকে উড়ে যেত উত্তর থেকে দক্ষিণ পাড়ার দিকে, ‘কাট্টল পাকো’ ‘কাট্টল পাকো’ বলে! কাঁঠাল খেলাই শুধু নয়, বউচি, লুকোচুরি, কানামাছি, হাডুডু, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, এক্কাদোক্কা―এমন বহু চলতি খেলার বাইরেও আমরা বানিয়ে নিতাম নানা রকমের খেলা, চটকাগজের বল দিয়ে খেলেও আনন্দের কমতি ছিল না। নানাবাড়ি থেকে নতুন লাটিমের সঙ্গে নিয়ে আসতাম কিছু অভিনব খেলার পদ্ধতি। বাড়িতে সেচমেশিনের একটা লোহার চাকতি ছিল, সেটা বাঁশের ফালিতে চালিয়ে একলা ঘুরে বেড়াতাম পাড়ার পথে-পথে। উচ্চ বিদ্যালয়ের এক ছুটিতে বাড়ি এসে সেই চাকতি চালাতে গিয়ে দেখি তাল কেটে যাচ্ছে বারবার। সেদিনই প্রথম টের পেলাম গ্রামবিচ্ছিন্নতার খাদ, আমার জন্যই যেন চোরকাঁটায় ভরে উঠতে লাগল সমস্ত মাঠ। বর্ষার দিনে দাওয়ায় বসে খেলতাম হাতগুটি কিংবা কাইম খেলা। ‘কাইম’ মানে বাঁশের পুরোনো ফালির টুকরো। সবচেয়ে প্রিয় ছিল বউচি, বউ পাহারা দেওয়ার উত্তেজনা ছিল বলেই কি? না, কারণ বইয়ের ভাষায় যাকে ‘বউচি’ বলছি, আমরা তা জানতাম ‘বুরি খেলা’। উতুরে দমদম দখিনার বিয়ে ভাঙ্গা নাইরকেল জোরা দিয়ে ‘ভাঙ্গা নাইরকেল’ মুখে নিয়ে দম ধরে দৌড়ে যেতাম প্রতিপক্ষের পিছু নিয়ে, কত বিচিত্র গৎ গেয়ে! উতুরে গেলাম কী দেখিলাম মক্কা-হিন্দুস্থান সারি-সারি বোয়াই এজ্জি আরবি কোরান গৎ-এর এই ‘দমদম’ ভারতের দমদম কি না কখনও ভাবিনি বা ভাবতে হয়নি। যে-দুরকমের ডাংগুলি আমরা খেলতাম খালের ধারের বিলে, তার একটা মাপ ছিল ছিল ‘ফাল্লং’। ‘এক…

অরুণদা-র কাছ থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াতাম। দূর থেকে তাঁকে দেখলেই অন্য ফুটপাত ধরে হাঁটতাম উদাস ভঙ্গিতে। কখনও-বা মুখ নামিয়ে কেটে পড়ার তালে থাকতাম। পিছন থেকে হঠাৎ কানে আসত চিরচেনা অথচ পিলেচমকানো ডাক, ‘এই যে সন্দেশ, একটা কথা শোনো তো ভাই!’ [...]

অরুণদা-র কাছ থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াতাম। দূর থেকে তাঁকে দেখলেই অন্য ফুটপাত ধরে হাঁটতাম উদাস ভঙ্গিতে। কখনও-বা মুখ নামিয়ে কেটে পড়ার তালে থাকতাম। পিছন থেকে হঠাৎ কানে আসত চিরচেনা অথচ পিলেচমকানো ডাক, ‘এই যে সন্দেশ, একটা কথা শোনো তো ভাই!’ অদ্ভুত সব নামে সম্বোধন করতেন আমাদের, এমনকী চা-দোকানের ছেলেটিকেও। মুখ-ভার-করা রিকশাওয়ালাকে ‘দেখি তো, তোমার জিহ্বাটা দেখি’ বলে সম্মোহিত করে দিতে পারতেন মুহূর্তেই। দারুণ গাইতে পারতেন, হাসতে পারতেন হো-হো করে। কিন্তু তাঁর এমন বাজখাঁই গলার গান আর হেসে ওঠাকে বড় বেখাপ্পা লাগত এই কর্মব্যস্ত শহরে, ভদ্রলোকের ভিড়ে। গান আর অট্টহাসি তো কেবল নাটকেই মানায়! বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলেমেয়েদের কথা যখন বলতেন, তখন তিনি ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের রহমত। শুনে মনে হতো ওরা এখনও শিশুটি রয়ে গেছে। এক বৈশাখে মেয়েকে দেখতে গেছেন ছাত্রীনিবাসে। ফটকের কাছে বিশাল আমগাছ। অরুণদা দারোয়ানকে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াতে বললেন। দারোয়ান ভাবলেন বাপবেটির গোপন কথা আছে হয়তো। অরুণদা তখন মেয়েকে বললেন, ‘আচ্ছা মামণি, আমি যদি এই গাছ থেকে একটা আম চুরি করি, তাহলে দারোয়ান শাহেব কিছু মনে করবেন?’ মেয়ে মুখে হাত দিয়ে না কি বলেছিল, ‘খবরদার বাবা, আমার বান্ধবীদের সামনে অমন কথাবার্তা বোলো না। আমার মানসম্মান থাকবে না আর!’ আমাদের এই ‘মানসম্মান’ নিয়ে তিনি কৌতুক করতেন সবসময়। জোরাজুরি করতেন চা খাওয়ার জন্য, না খেতে চাইলে বলতেন, ‘চায়ের একটা মানসম্মান আছে না! না খেলে ও তো ভীষণ রাগ করবে!’ আরেক বৈশাখের খাঁ-খাঁ রোদ্দুরে তিনি আমার হাত ধরে নিয়ে চললেন অড়হরডালের খোঁজে, যেন পৃথিবীর কোথাও এই ডাল পাওয়া যায় না আর, তাই টেরিবাজার পেরিয়ে বখশিরহাট পেরিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন দূরের কোনও এক ‘মুকুন্দরামের হাট’-এর দিকে। ধলঘাটের কথা, যৌথপরিবারের ভাইবোনকাকাপিসিদের মধুর সব স্মৃতিকথা শোনাতে ভালোবাসতেন। বাঙালিজাতির বদমাইশির কথা বলতে গিয়ে খেপে উঠতেন, তখন অবধারিতভাবে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ কথাটা এসে পড়ত তাঁর ক্ষুব্ধ কম্পমান ঠোঁটে। আবার এই তো সেদিন, আন্দরকিল্লার মোড়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলছিলেন বিদ্যাসাগর আর মধুসূদনের কথা। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর অসামান্য স্মৃতিশক্তির প্রসঙ্গ তুলতেই দেখলাম কী এক শান্ত গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর তাম্বুলরসাচ্ছন্ন মুখে। বলছিলেন, ‘বড় ভালো লাগছে তাঁদের কথা বলতে আর শুনতে।’ একদিন, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, সত্যি-সত্যি…

যতদিন ছুটুমা-সোনাপিসে খালিশপুরের বাড়িতে ছিলেন, ১৪ ডিসেম্বর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে হাদিস পার্কে সারা রাত অনুষ্ঠান হত। এক রাত আমি ওই বাড়িতে ছিলাম, অনুষ্ঠান শেষে। এই রাত্রিদিন গুলি আমার জন্য রক্তের আখরে আঁকা। ছুটুমা বলতেন, ‘ওরা আসবে,’ — ‘ওরা দেখতে পাচ্ছে। তোর মনে হয় না?’ [. . .]

১ আমার পিসিদের তিনজনকে আমি ছোটবেলা থেকে আমি মা বলতে শিখেছি — রাঙামা, ফুলমা, ছুটুমা। সম্ভবত, তাঁদের জৈবিক অর্থে কোনো সন্তান ছিল না বলে, অন্য পিসিরা এবং আমার মাবাবা এই শিক্ষাটা দিয়েছিলেন। মার মতোই আমার পিসিরা, সবাই। মমতায় কাছে টেনেছিলেন তাই নয়, মানুষও করেছিলেন। যে যেভাবে পেরেছেন। প্রত্যেকের হাতেই দেয়ার মতো অজস্র সম্পদ ছিল যে! শেষের জন, মুক্তি মজুমদারের সান্নিধ্যে এসেছি অনেক ছোটবেলা থেকেই, তবে প্রবাস থেকে ফেরার পর সাড়ে দশ বছরের আমি থেকে পরিণত বয়েসি আমি পর্যন্ত আমার প্রত্যেক দিনই ইনি আমার চেতনার অংশীদার হয়ে রয়েছেন। ভালোবাসায়। ২ আসলে ছুটুমাই বোধ হয় আমাকে রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন চিনিয়েছেন, আর চিনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গান, নতুন করে, নতুন আঙ্গিকে। আমার যৌবনকে করেছেন টালমাটাল, অপূর্ব। শান্তিনিকেতনের পরিবেশের আভা তাঁর জীবনে, তাঁর ব্যক্তিত্বে; এটা তাঁর খোলস নয়, তাঁর ধাতু। আবার বাংলাদেশের সচেতন, সাহসী, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর সুবাস। আমি ওই সুবাসে আসক্ত হয়েছিলাম ছোটবেলায়, তাই ছুটুমার বাড়ি যেতে চাইতাম সুযোগ পেলেই। গেলেই বাবার আনা লংপ্লেতে ভারতীয় রাগসঙ্গীত, অথবা চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, অথবা নানা রঙের স্বাদের পুরনো রেকর্ড আমাকে শুনতে দিতেন। আমি সেই সব গান মন্ত্রের মতো বসে বসে শুনেছি, জয়নুল আবেদিন অথবা নন্দলাল বসুর স্কেচের বই হাতড়েছি। অদূরে ধানক্ষেত তখন সবুজ আভায় টুসটুস করছে। ‘আমার যায় বেলা বয়ে যায় বেলা কেমন বিনা কারণে’, শুনতে শুনতে সময় থমকে থেকেছে। সেসব দিনে ছুটুমার গলায় শুনেছি মায়াবী ব্যঞ্জনার গান, নিভৃতে, সেই গ্রামীণ বাংলাদেশের নির্জন, নিরালা সুস্বাদু পরিবেশে, ‘কী সুর বাজে আমার প্রাণে, আমিই জানি, মনই জানে’। উনি জেনেছেন, আমিও বোধ হয় জেনেছি তখন, সেই ছোটবেলাতেই। কেউ বাধা দেয়নি। বরং ছুটুমার কাছে গান শিখতে আসা প্রাণের মেলায় মিলতে আসা শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের ভিড়ে আমিও মিশে গিয়েছি, শিখেছি এমন সব গান যা আমি আগে শুনিনি, ‘মোরা সত্যের 'পরে মন আজি করিব সমর্পণ’ অথবা ‘জাগো নির্মল নেত্রে রাত্রির পরপারে, জাগো অন্তরক্ষেত্রে মুক্তির অধিকারে’ — প্রবাসে চার বছর কাটিয়ে আসার পর গান, বাংলা ভাষা আর সুমধুর পরিবেশের এই বন্যা, আমার কৈশোরকে, যৌবনকে কোনো বিশাল স্বপ্নকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করেছে। এর একটা কারণ বোধ হয় আমার জীবনের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে, অর্থাৎ আমার প্রাক-বয়ঃসন্ধির সময় থেকে শুরু…

সেই প্রথম বায়োস্কোপ দেখা, সেই প্রথম কালো বাক্সের ভেতর চোখ রেখে দেখা ক্ষুদিরামের ফাঁসি। আহা সেই প্রথম মন কেমন করে ওঠা, ইতিহাসের ভেতর পা রাখা। [. . .]

স্কুল ছুটির দিনগুলোতে কাঁধে বাক্সটা ঝুলিয়ে নিয়ে লোকটা আসতো আমাদের পাড়ায়। তখন ছুটির দিনের সকালটা হয়তো গড়াতে শুরু করেছে কেবল। অদ্ভুত একটা স্বরে বায়োস্কোপ দেখার আমন্ত্রণ। সেই প্রথম বায়োস্কোপ দেখা, সেই প্রথম কালো বাক্সের ভেতর চোখ রেখে দেখা ক্ষুদিরামের ফাঁসি। আহা সেই প্রথম মন কেমন করে ওঠা, ইতিহাসের ভেতর পা রাখা। প্রথমবার তাজমহল, লালকেল্লা, চারমিনার ভ্রমণ শেষে মাথাটা বাক্সের বাইরে খেলার মাঠে স্থির হলেও মনটা তখনো পরিব্রাজক। পরিব্রাজক হতে পারিনি, তবু সেই প্রথম দেখা বায়োস্কোপের বাক্সের ভেতর থেকে লোকটাকে না জানিয়ে চুরি করেছি এই পরিব্রাজক মন। তাই বিশেষত্বহীন সেই বায়োস্কোপ দেখানো লোকটাকে ভুলিনি কখনো। মুখটা মনে নেই কি আছে — ঝাপসা! মনে আছে শুধু উদাসীন একঘেয়ে গলার সেই ‘আহা দেখো বাহার দেখো’র এক মিনিটের গান। চার আনায় কিনে নেয়া চার কোটি টাকার আনন্দ! আনা আধুলির হিসেব থেকে টাকায় পৌঁছাতে যে সময় লাগে, তার খানিকটা আগেই বন্ধ হয়ে গেছে বায়োস্কোপের বাক্স। লোকটা কোথা থেকে এসে কোথায় ফিরে যেত, জানা হয়নি। তবু লোকটা আর না এলেও জানলায় একজোড়া চোখ ছুটির দিনগুলোতে মরিয়া হয়ে বাক্সটার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো। একটা বাক্সের জন্য প্রতীক্ষার ভেতর ছেলেবেলার দৌড় কি আর থামে? বরং বড়োবেলার দিকে ছুটতে ছুটতে পেছনে ছেড়ে আসে অসংখ্য মুখ, যাদের বেশিরভাগ আর মনেই থাকে না। তবু কেউ কেউ থাকে, ঘুরে ফিরে আসে ছোটবেলার রঙমহল থেকে বড়োবেলার উঠোনে। মাঝে মাঝেই ফিরে আসে আমার দেখা প্রথম ভাস্করের মুখ। বাঁশের মাথায় একটা পাতলা পলিথিনে ঢেকে তার ওপর একটা কাপড়ের পাগড়ি মুড়ে নিয়ে আসতো, সাদা আর গোলাপির নানান শেডের রঙ মাখানো চকলেট ফেরি করতে। মায়ের বদৌলতে পেয়েছিলাম একজোড়া বড় চোখ, বিস্ময়ে সেটা আর চোখ না থেকে গলফ খেলার বল হয়ে যেত! লোকটা সুকুমার রায়ের সেই ফেরিওয়ালার মতোই জানতে চাইতো, ‘তোমার কী চাই?’ তারপর গল্পে গল্পেই কেমন গড়ে দিত ফুল, পাখি, মাছ অথবা বাহারি গয়না। অবাক হবার পালা শেষ হবার আগেই চকোলেটের ভাস্কর্য মুখের ভেতর মিলিয়ে যেত। আর লোকটা তার সামানা গুটিয়ে নিয়ে অন্যপথে ছুট। কেবল আমরা জনাকয় আরো কিছুক্ষণ চকোলেট না মূর্তি , মূর্তি না চকোলেট করতে করতে দুপুর ডেকে আনতাম। বিস্ময়ে প্রাণ জেগে উঠতো কিনা জানি…

পঞ্চমীর চাঁদ তখনো ডুবে যায়নি। তার আলোয় প্রথম যা নজরে পড়লো তা একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল। শীতের ঠাণ্ডা এখন স্বস্তিদায়ী। তারপরও নদীর খোলা হাওয়ায় একটু শীত অনুভব করি আমরা। আমরা যে নৌকাটিতে উঠেছি তা ঠিক সাম্পান নয়। যদিও নাফ নদীতে প্রায় সব নৌকাই ছই তোলা সাম্পান। এ নৌকাটি ছিপ নৌকার মত। লম্বা ও খোলা। তার দু’পাশে দু’জন করে চারজন যুবক বৈঠা নিয়ে বসেছিল। নৌকার পাটাতনে বিছানো ছিল রাইফেলটি। মোক্তারের নির্দেশে ঐ যুবকেরা আমাদের ব্যাকপ্যাকগুলো এমনভাবে গুছিয়ে রাখছিল যাতে নৌকার ভারসাম্য ঠিক থাকে। আমরা পনের জন যুত হয়ে বসেছি। নৌকা চলতে শুরু করেছে। সঁপাসপ বৈঠা পড়ছে। নাফ নদীর নোনা পানি কেটে নৌকা চলছে তীরবেগে। জামার সাইড পকেটে হাত ঢোকাল মোক্তার। তারপর বের করা হাত যখন মেলে ধরল, তখন চাঁদের আলোয় পাঁচটি বুলেট চকচক করে উঠল। আমরা চলেছি অজানা গন্তব্যে। মোক্তার আমাদের গাইড। সুঠাম চার যুবকের আটটি হাতের ছন্দময় আন্দোলনে নৌকা এগিয়ে চলেছে। সাম্পানের গতি মন্থর। আমাদের এপারে যেমন আছে ই পি আর ঠিক তেমনি ওপর পারে সীমান্তরক্ষী নাসাকা বাহিনী। দ্রুত গতির গানবোট আছে তাদের। ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ওপারে পৌঁছাতে হবে। এই নিশুথি রাতে লম্বা ছিপ নৌকা বেছে নেয়ার কারণটি বোঝা গেল। খোলা রাইফেল ও তাজা বুলেট কেন দেখালো মোক্তার? তা কি একথা বোঝাতে যে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অস্ত্র আছে আমাদের সাথে। না কি আমাদের মনে ভয় সঞ্চার করা তার উদ্দেশ্য? টেকনাফ বাজারের পশ্চিমে পাহাড় পেরিয়ে মোক্তারের বাড়ি। আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আরাকানে। চার যুবকের সাথে তার কথোপকথন আমরা সামান্যই বুঝতে পারি। তবে আমাদের সাথে যখন সে কথা বলে, তখন তা ভিন্ন। ঠিক চট্টগ্রামেরও নয়। পনের জনের এই দলে সাঈদ ভাই ও আমি চট্টগ্রামের ভাষা বেশ বুঝতে পারি। আমাদের স্কুল জীবনের একটা সময় কেটেছে মিরেশ্বরাই স্টেশনে। তবে মোক্তারের কথা অন্যেরাও বুঝতে পারে। মোক্তার বহু জায়গা ঘুরেছে। শুনেছে নানা ভাষা। সবার বোধগম্য করে কথা বলার কায়দাটি সে ভালই রপ্ত করেছে। আমরা যখন ওপারে পৌঁছেছি, তখন চাঁদ প্রায় ডুবে গেছে। আরও যুবকদের আমরা অপেক্ষমাণ দেখি। মোক্তারের নির্দেশে ওরা টপাটপ ব্যাকপ্যাকগুলো মাথায় উঠিয়ে নেয়। ওদের সাথে মোক্তারের স্বল্প বাক্যবিনিময় আমরা ধরতে পারি…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.