স্বদেশে কর্মসংস্থানের অভাব, তাই কাজ করে কিছু অর্থ উপার্জনের আশায় মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা। মালয়েশিয়ায় বৈধ পথে যেতে এজেন্টকে দিতে হয় বেশ বড় অংকের অর্থ, তার ওপর রয়েছে বিমান ভাড়া, সব মিলিয়ে বেশ কয়েক লাখ টাকার ধাক্কা। এত টাকা জোগাড় হবে কোত্থেকে? সেকারণেই হয়ত অবৈধ পথে কম খরচে মালয়েশিয়া যাবার কথা ভেবেছিলেন তারা। জায়গা, জমি বিক্রি করে সঞ্চিত অর্থ ভেঙে যা পাওয়া গিয়েছে দালালদের হাতে সে যৎসামান্য টাকা তুলে দিতে দ্বিধা করেননি। স্বপ্ন ছিল বিদেশে আয় রোজগারে সংসারের অভাব ঘুচবে, চালের ফুটোটো সারানো যাবে। ছেলে-মেয়ে, ছোট ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচটাও হয়ত যোগান দেয়া যাবে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নের সলিল সমাধি হল বঙ্গোপসাগরের আন্দামান উপকূলে। টাকা নিয়ে দালালরা ইঞ্জিন চালিত নৌকায় উঠিয়ে দিয়েছিলেন তাদের। হতভাগ্য এই মানুষগুলোকে নিয়ে ছয়টি ইঞ্জিন নৌকা প্রায় দু’মাস ভেসেছে সাগরে। এরপর অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেফতার হন তারা থাই পুলিশের হাতে। ১৫দিন একটা নির্জন দ্বীপে আটকে রাখার পর নির্মম থাই কর্তৃপক্ষ একটি মাত্র নৌকায় ৪০০ জনকে উঠিয়ে মাঝ সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে আসে। প্রায় ১৮ ঘণ্টা থাই-নৌবাহিনীর জাহাজ ইঞ্জিন-বিহীন বাংলাদেশী যাত্রী বোঝাই নৌকাটিকে টেনে নিয়ে যায় মাঝ সমুদ্রে। সম্ভবত তারা বাংলাদেশী বলেই এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পেরেছিল থাই কর্তৃপক্ষ। ইঞ্জিনবিহীন ৪০০ জন মানুষবাহী নৌকা সাগরে খুব বেশিক্ষণ টিকবে না এমনটাই হয়ত ভেবেছিল তারা। বাস্তবে ঘটেও ছিল সেটাই। আন্দামান উপকূলে নৌকাটি ভাসতে ভাসতে এলে অধিকাংশ যাত্রীই ঝাঁপ দিয়েছিল সমুদ্রে, তীরে পৌঁছাবার আশায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১০৫ জন ছাড়া বাকী যাত্রীরা সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছে এমন আশংকাই করছেন তারা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উদ্ধার অভিযান চালিয়ে গেলেও জীবিত আর কারো সন্ধান পাওয়ার আশা প্রায় শূন্যের কোঠায়। কারা এই হতভাগ্য বাংলাদেশী? ৮৪ হাজার গ্রাম, ৬৪ জেলা, ৬টি বিভাগীয় শহরের কোথাও না কোথাও তো তারা বাস করত। অথচ এদেশের আদম ব্যাপারী, দালাল চক্র, সরকারের জনশক্তি দপ্তর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আচরণ দেখে মনে হয় হতভাগ্য এই মানুষগুলো এদেশের কেউ নয়। এই সব ভাগ্যান্বেষী মানুষ নিয়ে ব্যবসা চলতে পারে, তাদের পাঠানো অর্থ (রেমিটেন্স) দিয়ে দেশ চলতে পারে কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে তারা অকাতরে মারা পড়লে কিছু এসে যায় না। এই মনোভাবের কারণেই বাংলাদেশী শিশুরা উটের জকি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, এদেশের মেয়েরা পাচার হয়েছে বিদেশের পতিতা পল্লীতে। বিদেশে মাসের পর মাস প্রতিশ্র“ত বেতন না পেয়ে যখন আন্দোলনে নেমে পুলিশের গুলি খেয়ে মরেছে বাংলাদেশী শ্রমিক, তখনও কিছু যায় আসেনি আমাদের। এদেশের লক্ষ কোটি দরিদ্র প্রবাসী শ্রমিক আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অব্যাহত নিজের রক্ত ঢেলে যাচ্ছেন। কিন্তু মহাসমুদ্রে, মরুভূমিতে কিংবা সবজিবাহী গাড়ি ডিপ ফ্রিজের ভেতর তারা মরে পড়ে থাকলেও এদেশের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নির্বিকার থাকতে দেখা যায়। দুর্বৃত্ত আদম ব্যাপারি, মানব ব্যবসায়ীদের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা এ-যাবৎ শোনা যায়নি। শোনা গেছে কেবল ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশীর মর্মান্তিক বেদনাদায়ক কাহিনী।

বিনম্র মানুষ

Rational and tolerant ...

১ comment

  1. মাসুদ করিম - ৩ জানুয়ারি ২০০৯ (৪:১১ পূর্বাহ্ণ)

    নিম্নবর্গীয়দের নিয়ে আমাদের উঁচু মুনাফাখোর আদমচক্রের কী নির্মম ব্যবসায়ী বুদ্ধি! থাইল্যান্ড এখানে যে নিষ্ঠুরতাটা করেছে তা শুধুই মানবাধিকার লঙ্ঘন, কিন্তু আমাদের আদমচক্র দিনে দিনে যে বীভৎস উদ্ভাবনায় দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের নামে তাদের নিষ্ঠুর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তার প্রতিকারে এ পর্যন্ত কোনোদিন আমাদের রেমিটেন্সখোর সরকার কাউকে যে আজও চিহ্নিত করতেই পারলেন না, তাকে কী বলল? এক চরম আশ্চর্য ‘না শোনা’, না কি সরকারই এসব উদ্ভাবনা তুলে দিচ্ছেন আদমচক্রের হাতে? আমাদের নতুন সরকার কি মন দেবেন গ্রামীণ অর্থনীতি ও জন্মশাসনে এবং সেই সাথে আদম ব্যবসার পূর্ণ নজরদারির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তাঁরা ব্যবসায়ীচক্রের চেয়ে শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করবেন কি?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.