সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্বিক অনুসন্ধান

অনেকেই সমকামিতা নিয়ে বেজায় বিব্রত থাকেন। নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন। কাঠমোল্লারা তো গালি দিয়ে খালাস- সমকামীরা হচ্ছে খচ্চর স্বভাবের, কুৎসিৎ রুচিপূর্ন, মানসিক বিকারগ্রস্ত। এমনকি প্রগতিশীলদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম ওজর আপত্তি [...]

সমকামিতা কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ?

অনেকেই সমকামিতা নিয়ে বেজায় বিব্রত থাকেন। নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন। কাঠমোল্লারা তো গালি দিয়ে খালাস- সমকামীরা হচ্ছে খচ্চর স্বভাবের, কুৎসিৎ রুচিপূর্ন, মানসিক বিকারগ্রস্ত। এমনকি প্রগতিশীলদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম ওজর আপত্তি। যারা শিক্ষিত, ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, গে লেজবিয়ন ইত্যকার তথাকথিত ‘পশ্চিমা’ শব্দের সাথে কমবেশি পরিচিত হয়েছেন, তারাও খুব কমই ব্যাপারটিকে মন থেকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিতে পারেন। তাদের অনেকেই এখনো ব্যাপারটিকে ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’ মনে করেন, আর নয়ত ভাবেন – পুরো ব্যাপারটি উৎকট ধরনের ব্যাতিক্রমধর্মী কিছু, এ নিয়ে ‘ভদ্র সমাজে’ যত কম আলোচনা করা যায় ততই মঙ্গল। উপরে উপরে না বললেও ভিতরে ভিতরে ঠিকই মনে করেন সমকামীরা তো হচ্ছে গা ঘিন ঘিনে বিষ্ঠাকৃমি জাতীয় এঁদো জীব। মরে যাওয়াই মনে হয় এদের জন্য ভাল। সমাজ সভ্যতা রক্ষা পায় তাহলে।

সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান

আমি এই বছর বৈজ্ঞানিক দিক (মুলত জীববিজ্ঞান ও জেনেটিক্সের দৃষ্টিভঙ্গি) থেকে নির্মোহভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে একটি বই লিখেছি; নাম – ‘সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ (২০০৯)। বইটি প্রকাশ করেছে ‘শুদ্ধস্বর’। বইটির বেশ কিছু অংশ ইন্টারনেটের ব্লগসাইটগুলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় প্রকাশের সময় সুধীজনের আগ্রহ তৈরি করে। মুক্তাঙ্গন ব্লগের জন্য এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে আমার এবারকার বইয়ের উপর ভিত্তি করেই। আমি নিজে সমকামী নই, কিন্তু সমকামী বন্ধু-বান্ধবদের জীবন প্রত্যক্ষ করার এবং এ নিয়ে কিছু পড়াশুনা করার ও লেখালেখি করার সুবাদে কিছুটা ধারনা অর্জন করেছি। আমার এ প্রবন্ধটি সে চিন্তাভাবনারই ফসল বলা যেতে পারে। মুক্তাঙ্গন ব্লগের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে এ প্রবন্ধ ভিন্নমাত্রার আবেদন তৈরি করবে বলে মনে করি। তবে, এ নিয়ে পাঠকদের ভিন্নমত থাকলে আমি তা সদরে পর্যালোচনা করতে, এবং যুক্তিনিষ্ঠ হলে তা গ্রহণ করতেও আমি রাজী।

আমি প্রবন্ধটি শুরু করছি ভুল ভাবে ব্যবহৃত কিছু মন্তব্য দিয়ে, যা সমকামিতার বিরুদ্ধে প্রায়শই ব্যবহার করা হয় :

“সমকামিতা প্রাকৃতিক কোনোভাবেই হতে পারে না মূলত (নারী-পুরুষে) কামটাই প্রাকৃতিক”

কিংবা অনেকে এভাবেও বলেন –

“নারী আর পুরুষের কামই একমাত্র প্রাকৃতিক যা পৃথিবীর সকল পশু করে। যার মূল লক্ষ্য হলো বংশ বৃদ্ধি”

উক্তিগুলো স্রেফ উদাহরণ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। অনেকেই সমকামিতাকে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বা ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য উপরোক্ত ধরণের যুক্তির আশ্রয় নেন। আমি এই উক্তির পেছনের যুক্তিগুলো নিয়েই মূলতঃ আলোচনা করব।
আসলে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ , ‘অস্বাভাবিক’, ‘প্রাকৃতিক নয়’ –এই ধরণের শব্দচয়ন করার আগে এবং তা ঢালাওভাবে তা প্রয়োগ করার আগে কিন্তু খোলা মনে পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এই বাংলাতেই এমন একটা সময় ছিল যখন বাল্যবিবাহ করা ছিল ‘স্বাভাবিক’ (রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম সহ অনেকেই বাল্যবিবাহ করেছিলেন) আর মেয়েদের বাইরে কাজ করা ছিল ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’। সয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত মেয়েদের বাইরে কাজ করার বিপক্ষে একটা সময় যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন এই বলে –

‘যেমন করেই দেখ প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সেরকম অভিপ্রায় না হত, তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাতো। যদি বল, পুরুষদের অত্যাচারে মেয়েদের এই দুর্বল অবস্থা হয়েছে, সে কোন কাজেরই কথা নয়।‘

অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের যুক্তি এখন মানতে গেলে কপালে টিপ দিয়ে, হাতে দু-গাছি সোনার বালা পরে গৃহকোণ উজ্জ্বল করে রাখা রাবীন্দ্রিক নারীরাই সত্যিকারের ‘প্রাকৃতিক’, আর শত সহস্র আমিনা, রহিমারা যারা প্রখর রোদ্দুরে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে ইট ভেঙ্গে, ধান ভেনে সংসার চালাচ্ছে, কিংবা পোষাক শিল্পে নিয়োজিত করে পুরুষদের পাশাপাশি ঘামে শ্রমে নিজেদের উজার করে চলেছে – তারা সবাই আসলে ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’ কুকর্মে নিয়োজিত – কারণ, ‘প্রকৃতিই বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না’। বাংলাদেশের অখ্যাত আমিনা, রহিমাদের কথা বাদ দেই, আমেরিকার নাসা থেকে শুরু করে মাইনিং ফিল্ড পর্যন্ত এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে মেয়েরা পুরুষদের পাশাপাশি আজ কাজ করছেন না। তাহলে? তাহলে আর কিছুই নয়। নিজের যুক্তিকে তালগাছে তোলার ক্ষেত্রে ‘প্রকৃতি’ খুব সহজ একটি মাধ্যম, অনেকের কাছেই। তাই প্রকৃতির দোহাই পাড়তে আমরা ‘শিক্ষিত জনেরা’ বড্ড ভালবাসি। প্রকৃতির দোহাই পেড়ে আমরা মেয়েদের গৃহবন্দি রাখি, জাতিভেদ বা বর্ণবাদের পক্ষে সাফাই গাই, অর্থনৈতিক সাম্যের বিরোধিতা করি, তেমনি সময় সময় সমকামি, উভকামিদের বানাই অচ্ছুৎ। কিন্তু যারা যুক্তি নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করেছেন তারা জানেন যে, প্রকৃতির দোহাই পাড়লেই তা যুক্তিসিদ্ধ হয় না। বরং প্রকৃতির কাঁধে বন্ধুক রেখে মাছি মারার অপচেষ্টা জন্ম দেয় এক ধরণের কুযুক্তি বা হেত্বাভাসের (logical fallacy)। ইংরেজীতে এই ফ্যালাসির পুথিগত নাম হল – ‘ফ্যালাসি অব ন্যাচারাল ল বা ‘অ্যপিল টু নেচার ’ । এমনি কিছু ‘অ্যপিল টু নেচার’ হেত্বাভাসের উদাহরণ দেখা যাক –

১। মিস্টার কলিন্সের কথাকে এত পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। কলিন্স ব্যাটা তো কালো। কালোদের বুদ্ধি সুদ্ধি একটু কমই হয়। কয়টা কালোকে দেখেছ বুদ্ধি সুদ্ধি নিয়ে কথা বলতে? প্রকৃতি তাদের পাঁঠার মত গায়ে গতরে যেটুকু বাড়িয়েছে, বুদ্ধি দিয়েছে সেই অনুপাতে কম। কাজেই তাদের জন্মই হয়েছে শুধু কায়িক শ্রমের জন্য, বূদ্ধিবৃত্তির চর্চার জন্য নয়।

২। মারামারি, কাটাকাটি হানাহানি, অসাম্য প্রকৃতিতেই আছে ঢের। এগুলো জীবজগতের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কাজেই আমাদের সমাজে যে অসাম্য আছে, মানুষের উপর মানুষের যে শোষণ চলে তা খারাপ কিছু নয়, বরং ‘কম্পলিটলি ন্যাচারাল’।

৩। প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সেরকম অভিপ্রায় না হত, তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাতো।

৪। সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। প্রকৃতিতে তুমি কয়টা হোমোসেক্সুয়ালিটির উদাহরণ দেখেছ?
এমনি উদাহরণ দেওয়া যায় বহু।

উপরের উদাহরণগুলো দেখলে বোঝা যায়, ওতে যত না যুক্তির ছোঁয়া আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি লক্ষনীয় ‘প্রকৃতি’ নামক মহাস্ত্রকে পুঁজি করে গায়ের জোরে পাহাড় ঠেলার প্রবণতা। কাজেই বোঝা যাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ট ষাঁড়দের স্বভাবজাত অ্যপিল টু নেচার-এর শিকার হচ্ছে সমকামীরা। অনেক সময় সমকামিদের প্রতি সুপরিকল্পিত উপায়ে এবং সাংগঠিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘৃণা। সমকামিতাকে একটা সময় দেখা হয়েছে মনোবিকার, মনোবৈকল্য বা বিকৃতি হিসেবে। সমকামিদের অচ্ছুৎ বানিয়ে এদের সংস্রব থেকে দূরে থাকার প্রবণতা অনেক দেশেই আছে। শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার তো আছেই, কখনো এদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে আত্মহননের পথে। আর এগুলোতে পুরোমাত্রায় ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে ধর্মীয় সংগঠন এবং রক্ষণশীল সমাজ। সমকামিদের প্রতি হিংসাত্মক মনোবৃত্তির কারণে ইংরেজীতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন একটি শব্দ – হোমোফোবিয়া (Homophobia) । মানবাধিকারের দৃষ্টিকোন থেকে এটি নিতান্ত অন্যায়। মানবাধিকার এবং সমানাধিকারের প্রেক্ষাপট থেকে এগুলো নিয়ে পরে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করার আগে সমকামিতা বলতে আসলে কি বোঝায় তা আমাদের জানা দরকার।

সমকামিতা ব্যাপারটি আসলে কি?

সমকামিতার ইংরেজী প্রতিশব্দ হোমোসেক্সুয়ালিটি তৈরি হয়েছে গ্রীক ‘হোমো’ এবং ল্যাটিন ‘সেক্সাস’ শব্দের সমন্বয়ে। ল্যাটিন ভাষায়ও ‘হোমো’ শব্দটির অস্তিত্ব রয়েছে। তবে ‘ল্যাটিন হোমো’ আর ‘গ্রীক হোমো’ কিন্তু সমার্থক নয়। ল্যাটিনে হোমো অর্থ মানুষ। ওই যে আমরা নিজেদের হোমোস্যাপিয়েন্স ডাকি – তা এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে। কিন্তু গ্রিক ভাষায় ‘হোমো’ বলতে বোঝায় ‘সমধর্মী’ বা ‘একই ধরণের’। আর সেক্সাস শব্দটির অর্থ হচ্ছে যৌনতা। কাজেই একই ধরনের অর্থাৎ, সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার (যৌন)প্রবৃত্তিকে বলে হোমোসেক্সুয়ালিটি। আর যারা সমলিঙ্গের প্রতি এ ধরনের আকর্ষণ বোধ করেন, তাদের বলা হয় হোমোসেক্সুয়াল। সমকামিতার ইতিহাস প্রাচীন হলেও ইংরেজীতে শব্দটির ব্যাবহার কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। একশ বছরের কিছু বেশি হল শব্দটি চালু হয়েছে। শুধু ইংরেজী কেন, ইউরোপের বিভিন্ন ভাষাতেও সমকামিতা এবং সমকামিতার বিভিন্নরূপকে বোঝাতে কোন উপযুক্ত শব্দ প্রচলিত ছিল না। বাংলায় ‘সমকামিতা’ শব্দটি এসেছে বিশেষণ পদ -‘সমকামী’ থেকে। আবার সমকামী শব্দের উৎস নিহিত রয়েছে সংস্কৃত ‘সমকামিন’ শব্দটির মধ্যে। যে ব্যক্তি সমলৈঙ্গিক ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তাকে ‘সমকামিন’ বলা হত। সম এবং কাম শব্দের সাথে ইন প্রত্যয় যোগ করে ‘সমকামিন’ (সম + কাম + ইন্) শব্দটি সৃষ্টি করা হয়েছে। আমার ধারণা সমকামিতা নামের বাংলা শব্দটির ব্যাবহারও খুব একটা প্রাচীন নয়। প্রাচীনকালে সমকামীদের বোঝাতে ‘ঔপরিস্টক’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। যেমন, বাৎসায়নের কামসূত্রের ষষ্ঠ অধিকরণের নবম অধ্যায়ে সমকামীকে চিহ্নিত করতে ‘ঔপরিস্টক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও পরবর্তীকালে এ শব্দের বহুল ব্যবহার আর লক্ষ্য করা যায় নি, বরং ‘সমকাম’ এবং ‘সমকামী’ শব্দগুলোই কালের পরিক্রমায় বাংলাভাষায় স্থান করে নিয়েছে। কেউ কেউ সমকামিতাকে আরেকটু ‘শালীন’ রূপ দিতে ‘সমপ্রেম’ শব্দটির প্রচলন ঘটাতে চান , অনেকটা ইংরেজীতে আজকের দিনে ব্যবহৃত ‘গে’ বা ‘লেসবিয়ন’ শব্দের মত।

সমকামিতা কি জন্মগত নাকি আচরণগত?

এখন কথা হচ্ছে সমকামিতা কি জন্মগত নাকি আচরণগত? এটি বুঝতে হলে আমাদের যৌনপ্রবৃত্তিকে বুঝতে হবে। আজকের দিনের মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যৌন-প্রবৃত্তির ক্যানভাস আসলে সুবিশাল। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ (বিষমকামিতা) যেমন দৃষ্ট হয়, তেমনিভাবেই দেখা যায় সম লিঙ্গের মানুষের মধ্যে প্রেম এবং যৌনাকর্ষণ। বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি এরা কোন যৌন-আকর্ষণ বোধ করে না, বরং নিজ লিঙ্গের মানুষের প্রতি এরা আকর্ষন বোধ করে। এদের যৌনরুচি এবং যৌন আচরণ এগুতে থাকে ভিন্ন ধারায় । ব্যাপারটি অস্বাভাবিক নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে অথচ স্বাভাবিক এবং সমান্তরাল ধারায় অবস্থানের কারণে এধরনের যৌনতাকে অনেক সময় সমান্তরাল যৌনতা (parallel sex) নামেও অভিহিত করা হয়। সমান্তরাল যৌনতার ক্ষেত্র কিন্তু খুবই বিস্তৃত। এতে সমকামিতা যেমন আছে তেমনি আছে উভকামিতা, কিংবা দুটোই, এমনকি কখনো রূপান্তরকামিতাও। আমি আমার প্রবন্ধ মূলতঃ ‘সমকামিতা’ বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করব, যদিও অন্যান্য যৌন-প্রবৃত্তিগুলো (যেমন রূপান্তরকামিতা)ও বিভিন্ন সময় আলোচনায় উঠে আসবে। আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা বলেন, সমকামিতা নিঃসন্দেহে যেমন আচরণগত হত পারে, তেমনি হতে পারে জন্মগত বা প্রবৃত্তিগত। যাদের সমকামী যৌনপ্রবৃত্তি জন্মগত, তাদের যৌন-প্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করা যায় না, তা সে থেরাপি দিয়েই হোক, আর ঔষধ দিয়েই হোক। মানুষের মস্তিস্কে হাইপোথ্যালমাস নামে একটি অংগ রয়েছে, যা মানুষের যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। সিমন লিভের শরীরবৃত্তীয় গবেষণা থেকে জানা গেছে এই হাইপোথ্যালমাসের interstitial nucleus of the anterior hypothalamus, বা সংক্ষেপে INAH3 অংশটি সমাকামিদের ক্ষেত্রে আকারে অনেক ভিন্ন হয়। আরেকটি ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ডিন হ্যামারের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে। ডিন হ্যামার তার গবেষণায় আমাদের ক্রোমোজমের যে অংশটি (Xq28) সমকামিতা ত্বরান্বিত করে তা শনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। এছারাও আরো বিভিন্ন গবেষণায় মনস্তাত্বিক নানা অবস্থার সাথে পিটুইটরি, থাইরয়েড, প্যারা-থাইরয়েড, থাইমাস, এড্রিনাল সহ বিভিন্ন গ্রন্থির সম্পর্ক আবিস্কৃত হয়। যদিও ‘গে জিন’ বলে কিছু এখনো আবিস্কৃত হয়নি, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফলের অভিমুখ সমকামিতার জেনেটিক কারণ থাকার সম্ভাবনা অস্বীকার করে না (এ নিয়ে আমার বইয়ে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে) । এই ধরণের গবেষণা সঠিক হয়ে থাকলে বলতেই হয় সমকামী মনোবৃত্তি হয়ত অনেকের মাঝেই জন্মগত বা জেনেটিক, আরো পরিস্কার করে বললে, ‘বায়োলজিকালি হার্ড-ওয়্যার্ড’। জন্মগত সমকামিরা ‘বায়োলজিকালি হার্ড-ওয়্যার্ড’ হলেও আচরণগত সমকামিরা তা নয়। এরা আসলে বিষমকামী। এরা কোন ব্যক্তিকে বিষমলিঙ্গের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের সাথে যৌন-সংসর্গে লিপ্ত হয়। যেমন, জেলখানায় দীর্ঘদিন আটকে থাকা বন্দীরা যৌনসঙ্গীর অভাবে সমলিঙ্গের কয়েদীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেত পারে। কিন্তু, জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলেই দেখা যায়, এদের আচরণের পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজের ছেলেপিলেদের সম্পর্কেও এ ধরনের ধারণা প্রচলিত আছে। এই ধরণের যৌন প্রবৃত্তির বাইরেও আছে উভকামিতা, কিংবা আছে উভকামিতার সমকামিতা। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিন্সে এই ধরনের বিভিন্ন যৌনতাকে পরিমাপ করার জন্য ১৯৪৮ সালে ‘যৌনতা বিষয়ক স্কেল’ উদ্ভাবন করেন। এই স্কেলের এক প্রান্তে আছে পরিপূর্ণ বিষমকাম, অন্যপ্রান্তে পরিপূর্ণ সমকাম। দুই মেরুর মাঝামাঝি রিয়েছে বিভিন্ন পর্যায়- প্রধাণতঃ বিষমকাম, তবে প্রায়ই সমকাম; সমান সমান বিষমকাম এবং সমকাম; প্রধানত সমকাম তবে প্রায়ই বিষম কাম; প্রধাণত সমকাম, তবে মাঝে মধ্যে বিষমকাম ইত্যাদি। কিন্সের এ স্কেল নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও এটি অন্ততঃ বোঝা যায় যে, আমাদের যৌন-প্রবৃত্তির ক্যানভাস আসলে
খুবই বিস্তৃত, এবং যৌন প্রবৃত্তি একইভাবে সকলের মাঝে ক্রিয়াশীল হয় না।
এখানে আরো একটি বড় প্রশ্ন হয়তো অনেকের মনেই জাগবে – ‘জন্মগত’ বোলতে আমরা ঠিক কি বুঝব। জেনেটিক ফ্যাকটরকে যদি ‘জন্মগত’ ধরা হয়, তাহলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাশাপাশি পরিবেশের প্রভাবটিও থেকে যাচ্ছে পুরোমাত্রায়। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে মুখ্য কারণ হিসেবে প্রতিপন্ন করাটা এই মুহূর্তে আসলে সরলীকরণই হবে । অনেকেই মনে করেন, ব্যাপারটির খোলাসা এখনো হয় নি, অনেকে ভাবেন – এপিজেনেটিক্স নিয়ে অতি সাম্প্রতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে ভাল পথ দেখাবে। শুধু একটি জিনের টার্ণ অন বা অফের মাধ্যমেই যে জীবদেহে খুব বড় ধরনের পরিবর্তন হতে পারে এটা বিজ্ঞানীরা গবেষণা থেকে দেখেছেন। নোভা চ্যানেলে একবার একটা একটা ডকুমেন্টরী প্রদর্শিত হয়েছিলো – ‘গোস্ট ইন ইয়োর জিনস’ নামে। সেই ডকুমেন্টরীতে সদৃশ যমজদের একটা ঘটনা দেখানো হয়েছিলো যেখানে একই আইডেন্টিকাল টুইন (যারা ১০০% সদৃশ জিন দেহে বহন করে) হওয়া সত্ত্বেও , তাদের মধ্যে একজন খুব স্বাভাবিক হয়ে বেড়ে উঠেছিলো, অন্যজন হয়েছে মানসিক প্রতিবন্ধী। সব কিছুই যদি জিনকেন্দ্রিক হত, তবে এটার আসলেই কোন ব্যাখ্যা নেই। সব কিছু আসলে জিনকেন্দ্রিক নয়, কিংবা আরো পরিস্কার করে বললে- একই জিন হয়ত একেক জনের দেহে একেক ভাবে ক্রিয়া করে – পরিবেশ থেকে পাওয়া সিগন্যালের উপর ভিত্তি করে। এপিসেনেটিক্স সেই রহস্যের দুয়ারই উন্মোচন করছে ধীরে ধীরে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে – সদৃশ যমজ দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রে কেনো একজন সমকামী, আর অন্যজন আবার বিষমকামী – এপিজেনেটিক্সের প্রভাব গোনায় না ধরলে এর ভাল কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। এপিজেনেটিক্সের এই পরীক্ষাগুলো থেকে বোঝা যায় যে, জিনগত উপাদানের পাশাপাশি পরিবেশের প্রভাবও প্রবলভাবেই রাজত্ব করে প্রবৃত্তি নির্মাণে। পরিবেশের প্রভাব আছে বলেই জেলখানায় কিংবা বন্দি পরিবেশে অনেকে সমকামী প্রবৃত্তি প্রদর্শন করলেও জেল থেকে ছাড়া পেলে তাদের আচরণের পরিবর্তন ঘটে। শুধু মানুষ নয়, চিড়িয়াখানায় কিংবা বন্দি পরিবেশে বহু প্রজাতি মুক্ত অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি সমকামী আচরণ করে থাকে বলে প্রমাণ পেয়েছেন। কাজেই সমকামী আচরণ নির্মাণে পরিবেশ অনেকের মধ্যেই একটা খুব বড় নিয়ামক।

কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই যে পরিবেশ বদলে দিয়ে যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ভেবে নিলে ভুল হবে। সমকামিতার ব্যাপারটা আসলে একেকজনের কাছে একেক রকম। সমকামীদের সাথে কথা বললেই দেখা যাবে, এদের অনেকেই ছোটবেলা থেকেই তারা বিপরীতধর্মী লোকজনের প্রতি কোন আকর্ষণ অনুভব করতো না। এদের অনেকেই চেষ্টা করেও যৌনপ্রবৃত্তি পরিবর্তন করতে পারেনি। অনেকে আবার হতাশায় আত্মহত্যাও করেছে এমন উদাহরণও আছে অনেক ।

আমাদের মধ্যে অধিকাংশই ডানহতি, তারা ডান হাতেই অধিকাংশ কাজ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে যে কেউ এটাকে স্বাভাবিক বলতে পারেন। কিন্তু যারা ছোটবেলা থেকেই বা হাতে লেখে বা কাজকর্ম করে, তারাও কি স্বাভাবিক নয়? তাদের এই বাম হাতে লেখার প্রবৃত্তি কি জন্মগত নাকি পরিবেশের ফল বলা যাবে? অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই এটাকে জন্মগত বলেই রায় দেবেন। তারা চেষ্টা করলেও দুই হাতেই সমান দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন বলে মনে হয় না, যদিও খুঁজলে চেষ্টায় সব্যসাচী মানুষ হয়েছেন – এমন উদাহরণ পাওয়াও দুর্লভ হবে না। যৌনপ্রবৃত্তির ব্যাপারটাও অনেকেই ডান হাতি- বা হাতির মত প্রবৃত্তির ব্যাপার মনে করেন। কেউ কেউ চেষ্টায় বদলাতে পারেন, তবে অধিকাংশই বোধহয় পারেন না।

এমনো হতে পারে যে, যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলো অনেক ছোটবেলাতেই (অনেকের মধ্যে) স্থায়ী হয়ে যায়, অনেকটা আমাদের চোখের রঙ এর মত। আমরা পরিবেশ পরিবর্তন করে পরে আর তা আর পরে বদলাতে পারি না। চেষ্টা করেও যারা পরবর্তী জীবনে যৌনপ্রবৃত্তির পরিবর্তন ঘটাতে পারেন না তাদেরটা হয়ত এজন্যই। তবে, অনেকে যেমন কন্টাক্ট লেন্স পরে চোখের কালো মনিকে নীল করে ফেলেন, সেরমকম চেষ্টা যে যৌনপ্রবৃত্তি নিয়েও অনেকে করেন না তা নয়। অনেকে সফল হন, অনেকে হন না। আরো একটা ভাল উদাহরণ দেয়া যাক। আমরা যারা পরিণত বয়সে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছি, তাদের ইংরেজী উচ্চারণে মাতৃভাষার একটা টান থেকেই যায়। ভারত থেকে যারা পাড়ি জমান তাদের থাকে ইন্ডিয়ান এক্সেন্ট। যারা ছেলেবেলায় ব্রাজিলে বড় হয়েছে, তাদের আছে ব্রাজিলিয়ান উচ্চারণ। এখন পরবর্তী জীবনে আমরা দেশ বদল করে আমেরিকায় এসেও আমাদের একসেন্ট খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারি কি? ব্রাজিলিয়ানের সেই স্প্যানিশ-ব্রাজিলান একসেন্টের টান রয়েই যায়, আমাদের অনেকের মধ্যে যেমন ইন্ডিয়ান এক্সেন্টের প্রভাব। তবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত ‘আমেরিকানাজড’ হওয়াতে অন্যের চেয়ে বেশি পারদর্শী। এরা মাতৃভাষার উচ্চারণগত প্রতিবন্ধকতা অনেকদূর অতিক্রম করে পরদেশী ভাষাটা ভালই রপ্ত করতে পারেন, তারপরেও যারা খুব কেউকেটা তারা ধরে ফেলেন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এই প্রতিবন্ধকতা একদমই অতিক্রম করা হয়ে উঠে না – একটা শব্দ উচ্চারণ করলেও তা নিজের টিপিকাল মাতৃভাষার এক্সেন্ট নিয়ে বেড়িয়ে আসে। যৌনপ্রবৃত্তির ব্যাপারটাও হয়তো সেরকম। উচ্চারণের মতই সেই ছোটবেলাকার টান থেকেই যায় কারো কারো, কেউ কেউ হয়ত এটা অতিক্রমে বেশি পারদর্শী, কেউবা একদমই কম।

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে। সমকামিতাকে নিরুৎসাহিত করে বিষমকামিতাকে উৎসাহিত করার সামাজিক একটা চাপ সবসময়ই আমাদের সমাজে থেকে যায় । অনগ্রসর সমাজে এই চাপ অনেক বেশি প্রবল। এই চাপ অতিক্রম করেও যারা নিজেদের সমকামী হিসেবে নিজেদের পরিচিত করে রাখতে পারেন, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা জৈবিক হবার সম্ভাবনাই বেশি। সায়েন্টিফিক আমেরিকান মাইন্ডের ‘ডু গেস হ্যাভ এ চয়েস’ প্রবন্ধে (২০০৬) একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে যা হয়ত অনেক পাঠককে ভাবনার খোড়াক যোগাবে –

‘যেহেতু ছোটবেলা থেকেই বিষমকামী সমাজের সদস্যদের কাছ থেকে আসা অব্যাহত চাপ সহ্য করে সমকামীদের বড় হতে হয়, এদের মধ্যে যারা শেষ পর্যন্ত সমকামী হিসেবে টিকে থাকেন, এবং নিজেদের সমকামী হিসবেই সমাজে পরিচিত করেন তারা যে সমকামের প্রতি একটা জিনগত তাড়না থেকেই এটি করেন তা বোধ হয় বোঝা যায়। যদিও সমকামীদের একটা অংশ তাদের যৌনপ্রবৃত্তি পরিবর্তন করতে পারেন বলে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে, তারপরেও সমকামীদের একটা বড় অংশই তা পারেন না, কিংবা পারলেও স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে নয়।‘

যৌনতার উদ্ভব এবং যৌনপ্রজ বনাম অযৌনপ্রজরা
যৌন প্রবৃত্তি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবেই সেক্স বা যৌনতার উদ্ভব নিয়ে কিছু না কিছু বলতে হয়। রিচার্ড ডকিন্সের ‘ বিবর্তনীয় স্বার্থপর জিন’ (selfish gene) তত্ত্ব সঠিক হয়ে থাকলে বলতেই হবে যৌনতার উদ্ভব নিঃসন্দেহে প্রকৃতির একটি মন্দ অভিলাস (bad idea)। কারণ দেখা গেছে অযৌন জনন (asexual) প্রক্রিয়ায় জিন সঞ্চালনের মাধ্যমে যদি বংশ বিস্তার করা হয় (প্রকৃতিতে এখনো অনেক এককোষী জীব, কিছু পতংগ, কিছু সরিসৃপ এবং কিছু উদ্ভিদ- যেমন ব্ল্যাক বেরি অযৌন জনন প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধি করে থাকে) তবে বাহকের পুরো জিনটুকু অবিকৃত অবস্থায় ভবিষ্যত প্রজন্মে সঞ্চালিত করা যায়। কিন্তু সে বাহক যদি যৌন জননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে থাকে, তবে তার জিনের অর্ধেকটুকুমাত্র ভবিষ্যত প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার করলে এটি বাহকের জিনকে ভবিষ্যত প্রজন্মে স্থানান্তরিত করবার সম্ভাবনাকে সরাসরি অর্ধেকে নামিয়ে আনে। এই অপচয়ী প্রক্রিয়ার আসলে কোন অর্থই হয় না। কারণ, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মুল নির্যাসটিই হল – প্রকৃতি তাদেরই টিকে থাকার ক্ষেত্রে তাদেরকেই বাড়তি সুবিধা দেয় যারা অত্যন্ত ফলপ্রসু ভাবে নিজ জিনের বেশি সংখ্যক অনুলিপি ভবিষ্যত প্রজন্মে সঞ্চালিত করতে পারে। সে হিসাবে কিন্তু অযৌন জননধারীরা (আমরা এখন থেকে এদের ‘অযৌনপ্রজ’ নামে ডাকব) বহু ধাপ এগিয়ে আছে যৌনধারীদের (এদের ডাকব ‘যৌনপ্রজ’ নামে) থেকে।

কারণ অযৌনপ্রজদের যৌনপ্রজদের মত সময় নষ্ট করে সঙ্গী খুজে জোড় বাঁধতে হয় না। সংগম করে করে শক্তি বিনষ্ট করতে হয় না। নিজের বা সঙ্গির বন্ধ্যাত্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। বুড়ো বয়সে ভায়াগ্রা সেবন করতে হয় না। কিংবা সন্তানের আশায় হুজুর সাঈদাবাদীর কাছে ধর্ণা দিতে হয় না। যথাসময়ে এমনিতেই তাদের বাচ্চা পয়দা হয়ে যায়। কিভাবে? আমরা এখন যে ক্লোনিং –এর কথা জেনেছি, এদের প্রক্রিয়াটা অনেকটা সেরকম। এক ধরনের ‘প্রাকৃতিক ক্লোনিং’ এর মাধ্যমে এদের দেহের অভ্যন্তরে নিষেক ঘটে চলে অবিরত। ফলে কোন রকম শুক্রানুর সংযোগ ছাড়াই দেহের ডিপ্লয়েড ডিম্বানুর নিষেক ঘটে চলে। জীববিজ্ঞানে এর একটি গালভরা নাম আছে – পার্থেনোজেনেসিস (Parthenogenesis)।

পার্থেনোজেনেসিস

কাজেই পার্থেনোজেনেসিস নামধারী অযৌনপ্রজরা সত্যিকার অর্থেই অপারাজেয়, অন্ততঃ যৌনপ্রজদের তুলনায়। এদের কোন পুরুষ সঙ্গীর দরকার নেই। সবাই এক এক জন মাতা মরিয়ম – সয়ম্ভু যীশু উৎপাদনে পারঙ্গম। যৌনপ্রজরা যে সময়টা ব্যয় করে সংগি খুঁজে তোষামোদ, আদর সোহাগের পশরা খুলে ধুঁকতে ধুঁকতে জিন সঞ্চালন করে, সে সময়ের মধ্যে অযৌনপ্রজরা গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা পয়দা করে ফেলতে পারে – এবং বাইরের কারো সাহায্য ছাড়াই। ফলে ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে’ এরা বাড়তে থাকে গুনোত্তর হারে। নীচে এরকম একটি অযৌনপ্রজ প্রজাতি “হুইপটেল গিরগিটি”র ছবি দেওয়া হল।

হুইপটেল গিরগিটি
চিত্রঃ হুইপ্টেল গিরগিটি – অযৌনপ্রজ প্রজাতির হার্টথ্রব। এদের বংশবিস্তারের জন্য কোন পুরুষ সঙ্গির প্রয়োজন নেই।

মজার ব্যাপার হল এই হুইপটেল গিরগিটিকূলের সবাই মহিলা, আর তা হবে নাই বা কেন! তাদের তো কোন পুরুষ শয্যাসংগীর দরকার নেই। পুরুষেরা তাদের জন্য ‘বাহুল্যমাত্র’। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে সেক্স- সদৃশ একধরনের ব্যাপার ঘটে। দেখা গেছে এক গিরগিটি আরেক গিরগিটিকে যদি জড়িয়ে ধরে রাখে তাহলে তাদের ডিম পাড়ার হার বেড়ে যায় । প্রকৃতির সমকামী প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! তাই জীববিজ্ঞানী জোয়ান রাফগার্ডেন আমেরিকার দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে দেখতে পাওয়া এই গিরগিটিগুলোকে ‘লেজবিয়ন লিজার্ড’ হিসেবে তার ‘ইভল্যুশনস রেইনবো’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। আমাদের কাছে যত অস্বাভাবিক বা প্রকৃতিবিরুদ্ধই মনে হোক না কেন, হুইপটেল গিরগিটি বা এ ধরনের সরিসৃপদের কাছে কিন্তু এটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা, এবং এরা এভাবেই প্রকৃতিতে টিকে আছে, এবং টিকে আছে খুব ভালভাবেই। ২০০৬ সালে সরিসৃপকুলের আরেক প্রজাতি কমোডো ড্রাগন (Komodo Dragon) কোন পুরুষসঙ্গী ছাড়াই লন্ডনের চিড়িয়াখানায় বাচ্চা পয়দা করে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দেয় ।
বিজ্ঞানীরা ২০০১ সালে নেব্রাস্কার ডুরলি চিরিয়াখানার হাতুরীমুখো হাঙ্গরেরও (Hammerhead shark) প্রজনন লক্ষ্য করেছেন কোন পুরুষসঙ্গির সাহায্য ছারাই। এগুলো সবই পার্থেনোজেনেসিস-এর খুবই স্বাভাবিক উদাহরণ। পার্থেনোজেনেসিসের আরো ভাল উদাহরণ খুঁজতে চাইলে বাংলাদেশের খোদ ঢাকা শহরের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় চলে যেতে পারেন। শুনেছি, আঁশ পোকা নামে এক বদখদ পোকায় নাকি ছেয়ে গেছে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার গাছপালা। ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দারা রীতিমত আস্থির। প্রথম আলোতে এ নিয়ে রিপোর্ট পর্যন্ত হয়েছিল। বংশবৃদ্ধির জন্য এ পোকার কোন পুরুষ লাগে না, মাদী পোকাটি একাই হাজারে হাজার ডিম পেড়ে পঙ্গপালের মত বংশবৃদ্ধি করে আর আশেপাশের গাছপালাগুলোকে ছিবড়া বানিয়ে ফেলে।

রূপান্তরকামিতা, উভকামিতা এবং উভলিঙ্গত্বের জগৎ

কিছু মজার উদাহরণ পাঠকদের জন্য হাজির করা যাক। ঊত্তর আমেরিকার সমুদ্রোপুকূলে এক ধরনের ক্ষুদ্র প্রাণি খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এরা আটলাণ্টিক স্লিপার শেল (Atlantic Slipper Shell) নামে পরিচিত। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এরা হল ক্রিপিডুলা ফরমিক্যাটা (crepidula formicata)। এই প্রজাতির পুরুষেরা একা একা ঘুরে বেড়ায়। তারপর তারা কোন স্ত্রী সদস্যদের সংস্পর্শে আসে এবং সংগমে লিপ্ত হয়। যৌন সংসর্গের ঠিক পর পরই পুরুষদের পুরুষাংগ খসে পড়ে এবং এরা রাতারাতিও স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পর এরা আর একাকী ঘুরে বেড়ায় না, বরং স্থায়ী হয়ে বসবাস করতে শুরু করে। প্রকৃতিতে পুরুষ থেকে নারীতে পরিনত হবার এ এক বিচিত্র দৃষ্টান্ত। ক্রিপিডুলা নিয়ে গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে আরো নানা ধরনের বিচিত্র তথ্য। বিজ্ঞানীরা এই এই প্রজাতির একটি সদস্যকে খুব ছোট অবস্থায় অন্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। এবার পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, এর মধ্যে স্ত্রী জননাঙ্গের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু যদি একে কোন পরিণত ক্রিপিডুলার সাথে রাখা হয়, তবে সে ধীরে ধীরে পুরুষে রূপান্তরিত হরে থাকে।

উত্তর আমেরিকার ওই একই অঞ্চলের ‘ক্লিনার ফিশ’ নামে পরিচিত এক ধরনের মাছের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে রূপান্তরকামীতার পরিস্কার প্রমাণ পেয়েছেন। এ মাছগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাবারিডেস ডিমিডিয়াটাস (Laborides dimidiatus)। এ প্রজাতির পুরুষেরা সাধারণতঃ পাঁচ থেকে দশজন স্ত্রী নিয়ে ঘর বাঁধে (নাকি ‘হারেম বাঁধে’ বলা উচিৎ?)। কোন কারণে পুরুষ মাছটি মারা পড়লে স্ত্রীদের মধ্যে যে কোন একজন (সম্ভবতঃ সবচেয়ে বলশালী জন) সংসার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকেই ওই স্ত্রীমাছটির মধ্যে দৈহিক পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। দু সপ্তাহের মধ্যে সে পরিপূর্ণ পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে যায় (তার গর্ভাশয় ডিম্বানু উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, এবং নতুন করে পুরুষাংগ গজাতে শুরু করে) এবং এবং অন্যান্য স্ত্রী মাছদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। প্রাকৃতিক নিয়মে স্ত্রী থেকে পুরুষে রূপান্তরের এও একটি মজার দৃষ্টান্ত। রূপান্তরকামীতার উদাহরণ আছে এনিমোন (anemone) বা ‘ক্লাউন মাছ’দের (Clown Fish) মধ্যেও। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সামুদ্রিক প্রবাল প্রাচীরের কাছাকাছি বেড়ে ওঠা মাছদের মধ্যে পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অনু্যায়ী যৌনতার পরিবর্তন অতি স্বাভাবিক ঘটনা। মানুষের মধ্যেও রূপান্তরকামীতার অস্তিত্ব আছে। এ প্রসঙ্গে আমেরিকার পুরুষ রূপান্তরকামী জরগেন্সেনের লেখা “Christine Jorgensen: A Personal Autobiography” বইটির কথা বলা যায়। ক্রিস্টিন জরগেন্সেনের আগের নাম ছিল জর্জ জরগেন্সেন। তিনি সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। তিনি নিজেকে নারী ভাবতেন। তার রূপান্তরকামী মানসিকতার জন্য চাকরী চলে যায়। পরে ১৯৫২ সালে অস্ত্রপ্রচারের মাধ্যমে তিনি নারীতে রূপান্তরিত হন। এ ধরনের অজস্র ঘটনার উদাহরণ হাজির করা যায়। উদাহরণ দেওয়া যায় প্রখ্যাট জীববিজ্ঞানী জোয়ান রাফগার্ডেনের। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের এ অধ্যাপক ৫২ বছর বয়সে পুরুষ থেকে নারীতে (জনাথন রাফগার্ডেন থেকে জোয়ান রাফগার্ডেনে) রূপান্তরিত হন। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, জোয়ান অব আর্ক থেকে শুরু করে আজকের বাস্কেটবল লিজেন্ড ডেনিস রডম্যান সহ অনেকের মধ্যেই যুগে যুগে রূপান্তর প্রবণতা বিদ্যমান ছিল এবং এখনো আছে। আমি আমার বইয়ে আই আই টির আই আইটির এক ভদ্রলোকের কথা উল্লেখ করেছি আমার বইয়ে। ভদ্রলোকের নাম নৃসিংহ মন্ডল। খুব মেধাবী এক ছাত্র। কিন্তু পুরুষ হয়ে জন্মালে কি হবে, তিনি নিজেকে সবসময় নারী মনে করতেন। নারীদের সাথে থাকতে বা বন্ধুত্ব করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। ভদ্রলোকের নাম নৃসিংহ মন্ডল। দৈনিক আজকাল ১৯৯৯ সালের ১২ই আগাস্ট তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল এই শিরোনামে- “ছয় বছর ধরে মেয়ে হতে চাইছে আই আইটির কৃতি ছাত্র”। এগুলোর পেছনে সামাজিক ও মনস্তাত্বিক কারণকে অস্বীকার না করেও বলা যায় – এ ধরনের চাহিদা বা অভিপ্রায় প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। আর সে জন্যই, প্রখ্যাত রূপান্তরকামী বিশেষজ্ঞ হেনরী বেঞ্জামিন বলেন, আপাত পুরুষের মধ্যে নারীর সুপ্ত সত্তা বিরাজমান থাকতে পারে। আবার আপাত নারীর মধ্যে পুরুষের অনেক বৈশিষ্ট্য সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তিনি বলেন – “Every Adam contains the element of Eve and every Eve harbors traces of Adam, physically as well as psychologically.”

আমি আমার বইয়ে পরিস্কারভাবে দেখিয়েছি যে, যৌনতার ক্যানভাস আসলে সুবিশাল। এখানে এখানে বিষমকামতা যেমন আছে, তেমনি আছে সমকামিতা, উভকামিতা, উভকামের সমকামিতা কিংবা রূপান্তরকামিতা। এ যৌনপ্রবৃত্তিগুলোকে ঢালাওভাবে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ অভিধায় অভিহিত করার আগে আমাদের আরেকটিবার চোখ মেলে প্রকৃতির দিকে তাকানো উচিৎ। এরপর সামগ্রিকভাবে বোঝা উচিৎ যৌনতার উদ্ভবকে। প্রানীজগতের একেবারে গোড়ার দিকে কিছু পর্ব হল – প্রটোজোয়া, পরিফেরা, সিলেনটেরেটা, প্লাটিহেলমিনথিস, অ্যানিলিডা, মোলাস্কা ও কর্ডাটা। এই সমস্ত প্রাণিদের বেশিরভাগই উভলিংগ বা হার্মাফ্রোডাইট (Hermaphrodite), কারণ এদের শরীরে স্ত্রী ও পুরুষজননাঙ্গের সহবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এদের জন্য উভলিঙ্গত্ব কোন শারীরিক ত্রুটি নয়, বরং এটি পুরোপুরি ‘প্রাকৃতিক’। এরা এদের উভলিঙ্গত্ব নিয়েই স্বাভাবিক বংশবিস্তারে সক্ষম। অর্থাৎ, যে যৌনতার বিভাজনের জন্য আমরা যৌনপ্রজরা আজ গর্ববোধ করি, অবলীলায় অন্যদের ‘অ্যাবনরমাল’, ‘আননেচারাল’-এর তকমা এঁটে দেই- গোড়ার দিকে কিন্তু প্রকৃতিতে যৌনতার সেরকম কোন সুস্পষ্ট বিভেদ ছিল না। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, মানব সমাজেও উভলিঙ্গত্ব বিরল নয়। প্রাচীন গ্রীসে সমকামিতা, প্রাচীন রোমে খোজা প্রহরী (eunuch), নেটিভ ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ‘দ্বৈত সত্তা’ (two-spirits), আরব ও পার্সিয়ায় ‘বার্দাজ’ এবং ভারতবর্ষে ‘হিজরা’দের অস্তিত্ব সেই সাক্ষ্যই দেয়। পশ্চিমা বিশ্বে শেরিল চেজ, এরিক শেনিগার, জিম সিনক্লায়ারের মত ইন্টারসেক্স –সেলিব্রিটিরা বহাল তবিয়তে বাস করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ষাঁড়েরা এদের অনেককেই ‘অস্বাভাবিক’ হিসবে চিহ্নিত করবেন। যেমনি অস্বাভাবিক হিসেবে আমরা চিত্রিত করি আমাদের সমাজে ‘হিজড়া’দের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা আর কলমজীবী বুদ্ধিজীবীরা যেমন যৌনপ্রবৃত্তি হি্সেবে সমকামীতার স্বীকৃতি নিয়ে ভাবিত নয়, তেমনি ভাবিত নয় ‘হিজড়া’ নামে কথিত বাংলাদেশের উভলিঙ্গ মানবদের সমস্যা কিংবা তাদের অধিকার নিয়ে। উভলিঙ্গ মানবরা সমাজে অপাংক্তেয়, পরিত্যক্ত। বাংলাদেশে উভলিঙ্গ মানবদের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ বলে অনুমিত হয় । তবে এই সংখ্যাটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ অপ্রকাশিত উভলিঙ্গ মানবদের সংখ্যা বের করা কঠিন। আর্থিক সঙ্গতি যে সমস্ত পরিবারে আছে তাদের অনেকেই বিভিন্ন উপায়ে এই পরিচিতি সযত্নে ঢেকে রাখতে পারেন বলে বাইরের মানুষ তা অনেক সময়ই জানতে পারে না। যে সমস্ত জায়গায় লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে পরিচিতি আর ঢেকে রাখা যায় না কিংবা বাইরে থেকে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তখন তাদের সামনে আর কোন উপায় খোলা থাকে না। কেবল তখনই তারা ‘হিজড়া’ হিসেবে সমাজে আত্মপ্রকাশ করতে বাধ্য হয় এবং পরিবার থেকে বের হয়ে যেতে হয়। রাজধানী ঢাকাতে উভলিঙ্গ মানবের সংখ্যা প্রায় পনের হাজার বলে মনে করা হয়। আমি আমার বইয়ে এই হিজড়া বলে কথিত উভলিংগ মানবদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে এবং সমস্যা থেকে প্রতিকারের কিছু বাস্তবসম্মত উপায় নিয়ে বিস্তৃতভাবে লিখেছি। সেগুলো উল্লেখ পূর্বক পাঠকদের ধৈর্যচুতি না ঘটিয়ে বরং এখন ‘স্বাভাবিক’ মানুষদের কথা বলি ।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিবর্তনের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় আমরা গর্বিত ‘স্বাভাবিক’ মানুষেরাও নিজেদের দেহেই উভলিঙ্গত্বের বহু আলামত বহন করে চলেছি – নিজেদের অজান্তেই। যেমন, নারী জননাংগ পুরুষের মত না হলেও, পুরুষের শিশ্নের অনুরূপ একটি ক্ষুদ্র ও অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়, যাকে ভগাংগুর বা ক্লাইটোরিস বলে। আবার অন্যদিকে পুরুষ শরীরে স্ফীত স্তন না থাকলেও স্তন ও স্তনবৃন্তের সুপ্ত উপস্থিতি সব সময়ই লক্ষ্যনীয়। বলাবাহুল্য, বংশবিস্তারে এসমস্ত অংগের কোন ভূমিকা নেই, তবুও আমরা এসমস্ত ‘এবনরমালিটি’ বহন বহন করে চলেছি ‘প্রাকৃতিক ভাবেই’ – বিবর্তনের পথ ধরে। আরো কিছু উদাহরণ দেই। পুরুয শরীরের থেকে ব্যাপক পরিমানে অ্যান্ড্রোজেন (androgen) যেমন নিঃসৃত হয়, তেমনি অল্প পরিমানে হলেও এস্ট্রোজেন (estrogen) নিঃসৃত হয়ে থাকে। এই এস্ট্রোজেন ‘স্ত্রী হরমোন’ হিসেবে পরিচিত। ঠিক তেমনি, মেয়েরা স্ত্রী হরমোন নিঃসরণের পাশাপাশি সামান্য পরিমানে হলেও পুরুষ হরমোনও নিঃসরণ করে থাকে। এইভাবে বিপরীত লিঙ্গের অনেককিছুই আমরা প্রাণের উত্পত্তির ঊষালগ্ন হতে ধারণ করে চলেছি – এবং তা প্রাকৃতিকভাবেই। শুধু মানুষ কেন অনেক প্রানীর মধ্যেই এমনটি লক্ষ্যনীয়। আফ্রিকার নিশাচর মাংশাসী স্পটেড হায়নাদের কথা বলা যায়, যাদের নারী সম্প্রদায়কে দেখলে পুরুষ বলেই বিভ্রম হবার কথা। সায়েন্টেফিক আমেরিকানের জানুয়ারী ২০০৪ সংখ্যায় লেখা হয়েছে – “The large erectile clitoris of a female spotted Hyena closely resembles a male’s penis. Much like many male animals, female spotted hyenas use their clitorises in greeting displays and dominance interactions”. এ ধরনের ‘পুরুষাংগ সদৃশ’ দীর্ঘ ভগাংগুর শুধু স্পটেড হায়নাদের মধ্যে নয়, আছে কাঠবিড়ালী সদৃশ নিশাচর প্রাইমেট ‘বুশ বেবী’ এবং ‘স্পাইডার মাঙ্কি’ এবং ‘উলি মাঙ্কি’র মধ্যেও। আবার বিপরীতটাও (মেয়েদের মত যৌনাংগ) দুর্লভ নয়। পুরুষ ডলফিন এবং তিমিদের ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মত কোন ‘বহিস্থ পুরূষাংগ’ দেখা যায় না। এই জলজ স্তন্যপায়ীদের (Cetaceans) কোন অণ্ডাশয়ও নেই।

স্পটেড হায়না
চিত্রঃ আফ্রিকার নিশাচর মাংশাসী স্পটেড হায়নাদের নারী সম্প্রদায়ের পুরুষাংগ সদৃশ দীর্ঘ ক্লায়টোরিস দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে যাবেন

আবারো যৌনপ্রজ এবং অযৌনপ্রজদের গল্পে ফিরে যাই। বিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে যৌনপ্রজদের যাবতীয় কাজ-কর্ম যে বিধ্বংসী রকমের অপচয়ী তা আগেই উল্লেখ করেছি। মানুষের কথাই ধরা যাক। একটি সুস্থ ‘যৌনপ্রজ’ দম্পতি তাদের দীর্ঘ জীবনে গড়ে প্রতি সপ্তাহে একবার করে পঞ্চাশ বছর ধরে সঙ্গম করে থাকে। কিন্তু সে হিসেবে তাদের বাচ্চা কাচ্চার সংখ্যা থাকে নিতান্তই নগন্য – দুইটি কি তিনটি। উন্নত বিশ্বে এখন এমন দম্পতিও আছে যারা বাচ্চা কাচ্চা একেবারেই নেয় না। সে সব দেশে জন্মহার এখন পড়তির দিকে। কাজেই যৌনতার ‘একমাত্র’ উদ্দেশ্য যদি কেবল পরবর্তী প্রজন্মে ‘জিন সঞ্চালন’ হয়ে থাকে, তবে বলতেই হয় এই আনাড়ি পদ্ধতিটি নিসন্দেহে একটি ‘অকর্মার ধাড়ি’। শুধু মানুষ নয়, হাতী, গরিলা, শুয়োর, ঘোড়াদের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তারা যৌন সংসর্গে যে পরিমানে সময় ও শক্তি ব্যয় করে সে তুলনায় ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরি করতে পারে একদমই কম। সারা জীবনের নব্বইভাগ যৌনসংসর্গেই কোন ধরনের অযাচিত প্রেগনেন্সির ভয় থাকে না। আর সমকামিতার উদাহরণ হাজির করলে তো সেক্সের মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়। সেক্সের একমাত্র উদ্দেশ্য যদি কেবল ভবিষ্যত প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ‘জিন সঞ্চালন’ হয়ে থাকে, তবে সমকামিরা নিঃসন্দেহে “বায়োলজিকাল ডেড এন্ড”-এ। আর অনেক বিবর্তনবাদীরাই সেজন্য খুব যান্ত্রিকভাবে ডারউইনবাদকে সমকামিতার বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। আর এমন সমস্ত ‘যুক্তি’ উপস্থাপন করা শুরু করেন যখন মনে হয় তাদের জায়গা ওই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের সাথে একই বিছানায়! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই ‘যান্ত্রিক’ ডারউইনবাদীরা সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌন-নির্বাচনের ধুঁয়া তুলে সমকামিতাকে অস্বীকার করেন, কিংবা বলার চেষ্টা করেন এরা প্রকৃতির এক ধরনের বিচ্যুতি (aberration)। ভাবখানা যেন, ওই দু’চারটা সমকামিদের নিয়ে অতটা চিন্তা আমাদের না করলেও চলবে!

কিন্তু সত্যই কি তাই? তারা সমকামীদের সংখ্যা ‘দু-চারটি’ বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিন্সের রপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দশ জন ব্যক্তির একজন সমকামী । অর্থাৎ, জনসংখ্যার শতকরা প্রায় দশভাগই ওই যান্ত্রিক ডারউইনবাদীদের আভিলাসে ছাই দিয়ে অর্থাৎ জীন সঞ্চালনের ‘মহৎ’ প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করে টিকে আছে। কিন্সের গবেষণা ছিল সেই চল্লিশের দশকে। সাম্প্রতিক কালে (১৯৯০) ম্যাকহৃটার এবং স্টেফানি স্যান্ডার্স এবং জুন ম্যাকহোভারের গবেষনা থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে শতকরা প্রায় চোদ্দ ভাগের মত সমকামি রয়েছে । ১৯৯৩ সালে ‘জেনাস রিপোর্ট অন সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার’ থেকে জানা যায়, পুরুষদের মধ্যে প্রায় শতকরা নয় ভাগ এবং মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৪ ভাগ সমকামি রয়েছে । কাজেই সংখ্যা হিসেবে সমকামিদের সংখ্যাটা কিন্তু এ পৃথিবীতে কম নয়। সায়েন্টিফিক আমেরিকান মাইণ্ড-এর ২০০৬ এর একটি ইস্যুতে সমকামীদের সংখ্যা সমগ্র জনসংখ্যার ৩ থেকে ৭ ভাগ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে, পরিসংখ্যানগুলোর পরিসীমা একে অন্যের খুব কাছাকাছি (মোটামুটি ৫-১৫ ভাগ) হলেও কোনটাই হয়ত প্রকৃত অবস্থা নির্দেশ করছে না। কারণ সামাজিক একটা চাপ সবসময়ই থেকে যায় সমকামিতাকে নিরুৎসাহিত করে বিষমকামিতাকে উৎসাহিত করার। অনগ্রসর সমাজে এই চাপ আরো প্রবল। ফলে অনেক সময়ই দেখা যায় সমাজের চাপে একজন প্রকৃত সমকামি বিষমকামী হয়ে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্বামী কিংবা বঊ বাচ্চা নিয়ে সংসার করছেন। এদের বলা হয় নিভৃত সমকামী (closet gay)। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মীর কথা জানি যিনি নিভৃত সমকামী হয়ে তার স্ত্রীর সাথে বিবাহিত জীবনযাপন করছেন।

সমকামীদের উপর সামাজিক চাপ
চিত্র : আমাদের সমাজে সবসময়ই একটা চাপ থাকে সমকামীদের নিরুৎসাহিত করে বিষমকামের দিকে ঠেলে দেওয়ার।

আরেকজন ‘বিবাহিত সমকামীর’ কথা পড়েছিলাম একটি কেস স্টাডিতে। উনি দিল্লিতে বসবাসরত দন্ত চিকিৎসক। নাম রমেশ মন্ডল। নিজে সমকামি। কিন্তু পারিবারিক চাপে পড়ে তাঁকে একসময় বিয়ে করতে হয়। কিন্তু স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক স্রেফ যান্ত্রিক। তিনি তার যৌনচাহিদা নিরসন করেন গোপনে তার এ সমকামী বধুর সাথে। কখনো-সখনো জব্বলপুর, কোলাপুরে চলে যান। তার স্ত্রী আজো এ ব্যাপারটি জানেন না। সম্পূর্ন মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে রমেশের দাম্পত্য জীবন। আরেক সমকামি ভদ্রলোক নীতিন দেশাই স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই চলে যান মুম্বই-এর চৌপাট্টির সমুদ্র সৈকতে। কারণ সহজেই অনুমেয়।

অনেক পাঠক হয়ত পাকিস্তানী সমকামি কবি ইফতি নাসিমের ব্যক্তিগত জীবনের সমপ্রেমের মর্মন্তুদ কাহিনী জানেন। কবি নাসিম ছোটবেলা থেকেই তার সমবয়সী একটি ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তারপর দুই কিশোর কৈশোরকাল অতিক্রম করে বড় হলো। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে তারা তখন প্রতিষ্ঠিত হবার পথে। তখন স্বাভাবিকভাবেই বাসা থেকে এল বিয়ের চাপ। এমন কি ইফতির বন্ধুটির বাসার লোকজন মেয়ে টেয়ে দেখে তার বিয়ে পর্যন্ত ঠিক করে ফেলল। ইফতির বন্ধু সেদিন তার সমকামী মানসিকতার কথা বাসায় খুলে বলতে পারেন নি। আর তাছারা পাকিস্তানী গোড়া মুসলিম সমাজে বড় হবার কারনে সমাকামিদের প্রতি ঘৃণাউদ্রেককারী কোরাণের আয়াতগুলোর কথাও তার ভালই জানা ছিলো। ফলে যা হবার তাই হল। বেশ ধূম ধাম করে বিয়ে হল ওই বন্ধুর। সে বিয়েতে ইফতিও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং হাজিরও ছিলেন। ফুলশয্যার রাতে বন্ধুর বাড়িতে ইফতি ছিলেন। যে মানুষটির সাথে তার এতদিনের প্রেমের সম্পর্ক, সে মানুষটি সমাজের চাপে পড়ে এক অচেনা নারীর বাহুলগ্ন হবেন, এ চিন্তা তাকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলল – ‘আজকে রাতে তুমি অন্যের হবে, ভাবতেই চোখ জলে ভিজে যায়’! সারা রাত তিনি ঘুমাতে পারলেন না। এ পাশ ও পাশ করে কাটালেন। শেষ রাতে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলেন ইফতি। দরজা খুলে ইফতি দেখলেন- অসহায়ভাবে বাইরে তার বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনেই নির্বাক।

শুধু বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে কেন, খোদ আমেরিকাতেও একই অবস্থা। জেমস ম্যাকগ্রিভি তাঁর নিভৃত সমকামের কথা স্বীকার করে নিউজার্সির গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগ করেন ২০০৪ সাল । সমাজে ইফিতি নাসিম বা ম্যাকগ্রিভির মত লোকদের ‘কামিং আউট অব ক্লোসেট’ হিসবে বিবেচনা করা হয়।

ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব কি সমকামিতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে?
ডারউইনীয় বিবর্তনের দিক থেকে চিন্তা করলে সমকামিতার ব্যাপারটি জীববিজ্ঞানীদের জন্য সব সময়ই একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ ‘ওটা বায়োলজিকাল ডেড এন্ড’ – অন্ততঃ এভাবেই ভাবা হত কিছুদিন আগেও। বিবর্তনের কথা ভাবলে প্রথমেই প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের কথাটিই মাথায় সবার আগে চলে আসে। সে দিক দিয়ে চিন্তা করলে সমকামিতার লক্ষ্য যে বংশবিস্তার নয় – তা যে কেউ বুঝবে। তাহলে জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে সমকামিতার উদ্দেশ্য কি? আগে এমনকি জীববিজ্ঞানীদের মধ্যেও সমকামিতাকে ঢালাওভাবে ‘অস্বাভাবিকতা’ কিংবা ‘ব্যতিক্রম’ ভেবে নেওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক,তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই ধ্যান ধারনা অনেকটা বদলেছে।
প্রথম কথা হচ্ছে, সমকামিতার ব্যাপারটি কিন্তু নিখাঁদ বাস্তবতা। শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, পুরো প্রানীজগতের ক্ষেত্রেই। জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিল তার ‘বায়োলজিকাল এক্সুবারেন্স : এনিমেল হোমোসেক্সুয়ালিটি এন্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি’ বইয়ে প্রায় পাঁচশ প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্বের উদাহরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। সামগ্রিকভাবে জীবজগতে ১৫০০ রও বেশী প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর মেরুদন্ডী প্রাণীর তিনশ’রও বেশী প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্ব খুব ভালভাবেই নথিবদ্ধ । সংখ্যাগুলো কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে। উইকিপিডিয়ায় সমকামিতার আংশিক তালিকা পাওয়া যাবে এখানে। তালিকায় স্তন্যপায়ী প্রানী থেকে শুরু করে পাখি, মাছ, সরীসৃপ, উওভচর, কীটপতঙ্গ সবই আছে। বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন, পৃথিবীতে আসলে এমন কোন প্রজাতি নেই যেখানে সমকামিতা দেখা যায় না। এ প্রসংগে জীববিজ্ঞানী পিটার বকম্যানের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য –

“No species has been found in which homosexual behavior has not been shown to exist, with the exception of species that never have sex at all, such as sea urchins and aphids. Moreover, a part of the animal kingdom is hermaphroditic, truly bisexual. For them, homosexuality is not an issue.”

ন্যাশনাল জিওগ্রাগিক চ্যানেলে সম্প্রতি ‘Out in Nature: Homosexual Behavior in the Animal Kingdom’ নামের একটি ডকুমেন্ট্রিতে প্রানীজগতের অসংখ্য সমকামিতার উদাহরণ তুলে ধরা হয় । ইউটিউবে ভিডিওটি ছয় পর্বে রাখা আছে। পাঠকদের জন্য ভিডিওটির প্রথম পর্বটি নীচে দেয়া হল –

বাকী পর্বগুলো দেখা যাবে এখান থেকে ( পর্ব-২ | পর্ব-৩ | পর্ব -৪ | পর্ব -৫ | পর্ব -৬ )

প্রাইমেট বর্গের মধ্যে সাধারণ শিম্পাঞ্জিদের প্রজননহীন যৌনতা খুবই প্রকট। মানুষের মতই তারা কেবল ‘জিন সঞ্চালনের’ জন্য সঙ্গম করে না, সম্ভবতঃ করে আনন্দের জন্যও। কাজেই তাদের মধ্যে মুখ-মৈথুন, পায়ু মৈথুন থেকে শুরু করে চুম্বন, দংশন সব কিছুই প্রবলভাবে লক্ষ্যনীয়। তারা খুব সচেতনভাবেই সমকাম, উভকাম এবং বিষমকামে লিপ্ত হয়। শিম্পাঞ্জীদের আরেকটি প্রজাতি বনোবো শিম্পাঞ্জী (প্রচলিত নাম পিগমী শিম্পাঞ্জী)দের মধ্যে সমকামি প্রবণতা এতই বেশি যে, ব্যাগমিল বলেন, এই প্রজাতিটির ক্ষেত্রে ‘Homosexual activity is nearly as heterosexual activity …. ’। একেকটি গোত্রে এমনকি শতকরা ৩০ ভাগ সদস্য উভকামিতার সাথে যুক্ত থাকে। এরকম সমকামি এবং উভকামি প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে গরিলা, ওরাং-ওটান, গিবন, সিয়ামাং, লঙ্গুর হনুমান, নীলগিরি লঙ্গুর, স্বর্ণ হনুমান, প্রবোসিক্স মাঙ্কি ইত্যাদি প্রাইমেটদের মধ্যেও। প্রাইমেট ছাড়াও সমকামি আচরণ লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্ন স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রেও। এদের মধ্যে হাতি, সিংহ, চিতাবাঘ, হায়না, ক্যাঙ্গারু, হরিণ, জিরাফ, পাহাড়ি ভেড়া, আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকার মোষ, জেব্রা উল্লেখযোগ্য। পাখিদের মধ্যে পেঙ্গুইন, ধুসর পাতিহাঁস, কানাডা পাতিহাঁস, কালো রজহাঁস, বরফী পাতিহাঁস, মিউট রাজহাঁস, শকুন সহ অনেক প্রাণীর মধ্যে সমকামিতার সুস্পষ্ট উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সরীসৃপের মধ্যে সমকামিতার আলামত আছে কমন অ্যামিভা, অ্যানোল, গিরগিটি, স্কিনক, গেকো মাউরিং, কচ্ছপ, রাটেল স্নেক প্রভৃতিতে। সমকামিতার অস্তিত্ব আছে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ, স্যালাম্যান্ডারের মত উভচর এবং বিভিন্ন মাছেও।

শুধু প্রাণিজগৎ নয়, মানুষের মধ্যে শতকরা প্রায় ৫ ভাগ থেকে ১২ ভাগ সমকামিতার সাথে যুক্ত বলে পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে। কাজেই সমকামিতার এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা বোকামি। এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হল, সমকামিতাকে ব্যাখ্যা করার সঠিক বৈজ্ঞানিক মডেল জীববিজ্ঞানে আছে কিনা, নাকি কেবল ‘সমাকামিতা অস্বাভাবিক’ কিংবা ‘ব্যতিক্রম’ ইত্যাদি বলেই ছেড়ে দেয়া হবে? এ প্রসঙ্গে জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক জোয়ান রাফগার্ডেনের উক্তিটি খুবই প্রাসঙ্গিক –

‘My discipline teaches that homosexuality is some sort of anomaly. But if the purpose of sexual contact is just reproduction, then why do all these gay people exist? A lot of biologists assume that they are somehow defective, that some development error or environment influence has misdirected their sexual orientation If so, gay and lesbian people are mistake that should have been corrected a long time ago (thru Natural selection), but this hasn’t happened. That’s when I had my epiphany. When a scientific theory says something wrong with so many people, perhaps the theory is wrong, not the people’.

সমকামিতাকে যদি বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেয়া হয়, তবে আমাদের বের করতে হবে – ডারউইনীয় দৃষ্টিকোন থেকে এর উপযোগিতা কি। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে কঠিন বলে কেউ হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিদিনই। কিছু যোগসুত্র পাওয়া গেছে প্রাণী জগতে ‘স্টেরাইল ওয়ার্কার’ বা ‘বন্ধ্যা সৈন্যের’ -এর উদাহরণ থেকে। পিঁপড়ে, মৌমাছি, উই পোকা কিংবা বোলতার মত প্রজাতিতে এই ধরণের ‘বন্ধ্যা সৈন্যের’ উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। এরা বংশবৃদ্ধিতে কোন ভুমিকা রাখে না। কিন্তু নিজেদের গোত্রকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে জনপুঞ্জ টিকিয়ে রাখে। মানুষের জন্যও কি এটা খাটে? বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার আলোকে একটু চিন্তা করা যাক। এমন কি হতে পারে যে, সমকামী পুরুষেরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই আদিম শিকারী-সংগ্রাহক সমাজে (hunter gatherer societies) বাচ্চা লালন পালনে কোন বিশেষ ভুমিকা রেখেছিলো? নিজেদের মধ্যে মারামারি না করে যখন একাধিক পুরুষ দলবদ্ধ হয়ে গোত্রের দায়িত্ব নিতো আর শিকারের সন্ধান করত, সেই গোত্র হয়ত অনেক বেশী খাবারের যোগান পেত, কিংবা হয়ত বহিঃশত্রুর হাত থেকেও রক্ষা পেত অন্যদের চেয়ে বেশী। ফলে টিকে থাকার প্রেরণাতেই হয়ত কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষে পুরুষে সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো –যা গোত্রে এনে দিয়েছিলো বাড়তি নিরাপত্তা। কিংবা হয়ত এমনও হতে পারে – যখন শক্তিশালী পুরুষ শিকারে যেত, হয়ত সেই গোত্রের কোন ‘গে চাচা’ রক্ষা করার দায়িত্ব নিত ছোট ছোট ছেলেপিলেদের। আর পুরুষটিও শিকারে বের হয়ে স্ত্রীর ‘পরকীয়া’র আশঙ্কায় ভাবিত থাকতো না! ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায়, বহু রাজা বাদশাহরা তাদের হারেম সুরক্ষিত রাখতে ‘খোঁজা প্রহরী’দের নিয়োগ দিতো। আরো সমীক্ষায় দেখা গেছে পশ্চিমে মেয়েরা অফিসে সমকামী পুরুষদের সাথে কাজ করতে অনেক নিরাপত্তা অনুভব করে। এটার কারণও অবোধ্য নয়। হয়ত জিন সঞ্চালন ছাড়াও অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আমাদের প্রজাতিটিকে টিকেয়ে রাখতে সমকামী সদস্যদের একটা ভূমিকা ছিলো। সেজন্য এডয়ার্ড ও উইলসন ‘কিন সিলেকশন’-এর মাধ্যমে হোমোসেক্সুয়ালিটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন সেই ১৯৭৮ সালেই ।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক চিন্তা করা যেতে পারে। সমকামী প্রবৃত্তিটি হয়ত বিবর্তন প্রক্রিয়ার উপজাত বা সাইড ইফেক্ট। বিবর্তনের অনেক কিছুর কথাই আমরা জানি যেগুলো কোন বাড়তি উপযোগিতা তৈরি করে না। কিন্তু এগুলো উৎপন্ন হয়েছে বিবর্তনের উপজাত হিসবে। এই বৈশিষ্টগুলো যদি টিকে থাকার ক্ষেত্রে বাড়তি কোন অসুবিধা তৈরি না করে তাহলে তারা উপজাত হিসেবে রয়ে যেতে পারে বংশ পরম্পরায়। বিজ্ঞানী স্টিফেন যে গুল্ড উপজাতের ব্যাপারটা বোঝাতে আমাদের বাড়ির উদাহরণ হাজির করতেন। যে কোন বড় বাড়ি কিংবা ইমারতের দিকে দেখলে দেখা যাবে – এর ধনুকাকৃতির দু’টি খিলানের মাঝে স্থান করে নিয়েছে ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতির স্প্যান্ড্রেল বা মাঝখানের একটা খোলা জায়গা। বাড়ীর ইমারত বানাতে খিলান থাকা অত্যাবশক, কিন্তু খিলান বানাতে গেলে বাড়তি উপজাত হিসবে স্প্যান্ড্রেল এমনিতেই তৈরী হয়ে যায়, যা ইমারতটির ভিত্তির জন্য অত্যাবশকীয় কোন কিছু হয়ত নয়, কিন্তু এটি এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আমাদের শরীরের হাড্ডির সাদা রঙের কথা ধরা যেতে পারে। এই সাদা রঙ বিবর্তনে কোন বাড়তি উপযোগিতা দেয় না। এই সাদা রঙ তৈরি হয়েছে হাড়ে ক্যালসিয়াম থাকার উপজাত হিসেবে। তেমনি কারো কারো চোখের নীল কিংবা বাদামী রঙও হয়ত কোন বাড়তি উপযোগিতা দেয়া না – এটা প্রকৃতিতে আছে বিবর্তনের সাইড ইফেক্ট হিসবে। সমাকামিতাও বিবর্তনের সেরকম কোন উপজাত হতে পারে ।

ইতালীর একটি সমীক্ষায় (২০০৪) দেখা গেছে, যে পরিবারে সমকামী পুরুষ আছে সে সমস্ত পরিবারে মেয়েদের উর্বরতা (fertility) বিষমকামী পরিবারের চেয়ে বেশি থাকে । আন্দ্রিয়া ক্যাম্পেরিও-সিয়ানির ওই গবেষণা থেকে জানা যায়, বিষমকামী পরিবারে যেখানে গড় সন্তান সন্ততির সংখ্যা ২.৩ সেখানে গে সন্তানবিশিষ্ট পরিবারে সন্তানের সংখ্যা ২.৭। তার মানে যে জেনেটিক প্রভাব মেয়েদের উর্বরা শক্তি বাড়ায় – সেই একই জিন আবার হয়ত ছেলেদের মধ্যে সমকামী প্রবণতা ছড়িয়ে দেয় – বিবর্তনের উপজাত হিসেবে। সেজন্যই ডঃ ক্যাম্পেরিও ক্যানি বলেন –

“We have finally solved the paradox … the same factor that influence sexual orientation in males promotes higher fecundity in females’

বিজ্ঞানী ডীন হ্যামারও প্রায় একই কথা বলেছেন একটু অন্যভাবে –

‘The answer is remarkably simple : the same gene that causes men to like men, also causes women to like men, and as a result to have more children’

বিবর্তন তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে সামাজিক নির্বাচন। আমরা দেখেছি প্রানীজগতে সমকামিতার প্রবৃত্তি একটি বাস্তবতা। শুধু মানুষের ক্ষেত্রে সমকামিতা নেই, ছড়িয়ে আছে প্রাণিজগতের সকল প্রজাতির মধ্যেই। আসলে প্রকৃতিতে সবসময়ই খুব ছোট হলেও একটা অংশ ছিল এবং থাকবে যারা যৌনপ্রবৃত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু কেন এই ভিন্নতা? এর একটি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় ইকোলজিস্ট জোয়ান রাফগার্ডেন রোথসবর্গ তার “Evolution’s Rainbow: Diversity, Gender and Sexuality in Nature and People.” বইয়ে । তিনি বলেন, যৌনতার উদ্দেশ্য সনাতনভাবে যে কেবল ‘জিন সঞ্চালন করে বংশ টিকিয়ে রাখা’ বলে ভাবা হয়, তা ঠিক নয়। যৌনতার উদ্দেশ্য হতে পারে যোগাযোগ এবং সামাজিকীকরন। তিনি বলেন :

‘যদি আপনি সেক্স বা যৌনতাকে যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে দেখেন, তাহলে আপানার কাছে অনেক কিছুই পরিস্কার হয়ে যাবে, যেমন সমকামিতার মত ব্যাপার স্যাপারগুলো – যা জীব বিজ্ঞানীদের বছরের পর বছর ধরে বিভ্রান্ত করে রেখেছিল। বনোবো শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে সমকামী সংশ্রব বিষমকামীদের মতই দেদারসে ঘটতে দেখা যায়। আর বনোবোরা কিন্তু প্রকটভাবেই যৌনাভিলাসী। তাদের কাছে যৌনসংযোগের (Genital contact) ব্যাপারটা আমাদের ‘হ্যালো’ বলার মতই সাধারণ। এভাবেই তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। এটি শুধু দলগতভাবে তাদের নিরাপত্তাই দেয় না, সেই সাথে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য আহরণ এবং সন্তানদের লালন পালনও সহজ করে তুলে’।

শুধু বনোবো শিম্পাঞ্জীদের কথাই বা বলি কেন, বাংলাদেশেই আমরা যেভাবে বড় হয়েছি সেখানে ছেলেদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হলে একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে, হাতে হাত ধরে কিংবা ঘারে হাত দিয়ে ঘোরাঘুরি করে। ঝগড়া-ঝাটি হলে বুকে জড়িয়ে ধরে আস্থা পুনর্প্রতিষ্ঠিত করে। মেয়েরাও তাই। এই আচরণ একটু প্যাসিভ তবে এ ধরনের প্রেরনা কিন্তু মনের ভেতর থেকেই আসে। বলা বাহুল্য, এই প্রেরণার মধ্যে কোন জিন সঞ্চালনজনিত কোন উদ্দেশ্য নেই, পুরোটাই যোগাযোগ এবং সামাজিকীকরনের প্রকাশ।

যোগাযোগ আর সামাজিকরণের কথা মাথায় রেখেই জোয়ান রাফগার্ডেন তার বিবর্তনবিদ্যা সংক্রান্ত ‘ইভ্যলুশনস রেইনবো’ (পূর্বে উল্লিখিত) বইয়ে ‘যৌনতার নির্বাচন’ (sexual selection)-এর বদলে ‘সামাজিক নির্বাচন’ (social selection) – এর প্রচলন ঘটানোর প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেন, প্রানীজগতের সাংগঠনিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে তাদের খাবার, সঙ্গী প্রভৃতির সঠিক নির্বাচনের উপর। প্রাণিজগতের এই নির্বাচনই কখনো রূপ নেয় সহযোগিতায়, কখনো বা প্রতিযোগিতায়। এবং এটাই শেষ পর্যন্ত সমস্ত পারিবারিক বিবিধ সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে। কোন কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে সেই সম্পর্ক একগামিতা বা মনোগামিতে রূপ নিতে পারে (মানুষ ছাড়াও কিছু রাজহাঁস, খেঁকশিয়াল, কিছু পাখির মধ্যে একগামী সম্পর্ক আছে), কখনো বা রূপ নেয় বহু(স্ত্রী)গামিতা বা পলিগামিতা (সিংহ, বহু প্রজাতির বনের মধ্যে এরকম হারেম তৈরি করে ঘোরার প্রবণতা আছে), কখনোবা বহু(পুরুষ)গামিতা বা পলিঅ্যান্ড্রি (কিছু সিংহ, হরিণ এবং প্রাইমেটদের মধ্যে)তে। এমনকি অনেকসময় দলে একাধিক ‘জেন্ডারের’ মধ্যেও সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যেমন, ব্লু গ্রীন সানফিশ নামের একপ্রজাতির মাছ আছে যেখানে এক একটি ঝাঁকে দুই পুরুষ মাছের মধ্যে সমধর্মীযৌনতার বন্ধন (same-sex courtship) গড়ে উঠে। এখানে মুখ্য পুরুষ মাছটি (এদের ‘আলফা মেল’ বলা হয়) একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে তুলে আর তারপর অপর পুরুষ মাছটিকে সাথে নিয়ে তাদের যৌথ সাম্রাজ্যে স্ত্রীমাছগুলোকে ডিম পাড়তে আমন্ত্রণ জানায়। অনেকসময় দ্বিতীয় পুরুষ মাছটি স্ত্রী মাছের অনুকরণ করে স্ত্রী মাছের ঝাকের সাথে মিশে যায় – যা অনেকটা আমাদের সমাজে বিদ্যমান ক্রস-জেন্ডার প্রতিনিধিদের মতই। ড. রাফগার্ডেনের মতে, যৌন-প্রকারণ এবং সমধর্মী যৌনতা এভাবে প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে, যা অনেক সময়ই মোটা দাগে কেবল শুক্রানুর স্থানান্তর নয়। সামাজিক নির্বাচন হচ্ছে সেই বিবর্তন যা সামাজিক সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখে। ড. রাফগার্ডেনের মত সামাজিক নির্বাচনের ধারণাকে সমর্থন করেন ব্রুস ব্যাগমিল এবং পল ভ্যাসি সহ অনেক বিজ্ঞানীই।

তবে বেশিরভাগ জীববিজ্ঞানীই এখনই ‘যৌনতার নির্বাচনকে’ সরিয়ে দিয়ে ‘সামাজিক নির্বাচন’কে গ্রহণ করার পক্ষপাতি নন, কারণ প্রকৃতিজগতের বেশিরভাগ ঘটনাকেই ‘যৌনতার নির্বাচন’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবাদী জীববিদ জেরি কয়েন রাফগার্ডেনের সমালোচনা করে বলেন :

‘She ignores the much larger number of species that do conform to sexual selection theory, focusing entirely on the exceptions. It is as if she denies the generalization that Americans are profligate in their use of petrol by describing my few diehard countrymen who bicycle to work.’।

নেচার পত্রিকায় রাফগার্ডেনের বইটির ভুয়সী প্রসংশা করার পরও তার ‘সামাজিক নির্বাচন’ তত্ত্বের সমালোচনা করে নৃতত্ত্ববিদ সারাহ হর্ডি বলেন – ‘(তার) এ (উদাহরণ) গুলো যৌনতার নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য উপযুক্ত কারণ নয়, বরং এগুলো হতে পারে জীব-বৈচিত্রকে (সামাজিকভাবে) গ্রহণযোগ্য করার অনুপ্রেরণা’। এর কারণ আছে। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমেই হোমসেক্সুয়ালিটিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সমকামিতার জিন (যদি থেকে থাকে) যোগাযোগ ও সামাজিকতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে উপযোগী তা বনোবো শিম্পাঞ্জীদের ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রেও এটি সত্য হতেই পারে । আবার এমনো হতে পারে মানুষের মধ্যে ‘গে জিন’-এর ভূমিকা পুরুষ এবং স্ত্রীতে ভিন্ন হয়। ইতালীর একটি সমীক্ষার (২০০৪) কথা আমরা আগেই জেনেছি – যা থেকে বেরিয়ে এসেছে, যে প্রকরণটি পুরুষদের মধ্যে সমকামিতা ছড়াচ্ছে সেটাই মেয়েদের ক্ষেত্রে আবার উর্বরাশক্তি বাড়াচ্ছে। এছাড়া ‘কিন সিলেকশন’-তত্ত্বের সাহায্যেও সমকামিতাকে বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব বলে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন। ইন্টারনেটের বহুল-প্রচারিত টক-অরিজিনের একটি লিঙ্কেও বিবর্তনের আধুনিক তত্ত্বের মাধ্যমে সমকামিতার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কাজেই যে কারনেই সমাজে হোমোসেক্সুয়ালিটির অস্তিত্ব থাকুক না কেন, এবং সেগুলোকে উপস্থাপনের সঠিক মডেল নিয়ে বিবর্তনবাদীদের মধ্যে যত বিতর্কই থাকুক না কেন (বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানে এধরনের বিতর্ক খুবই স্বাভাবিক), এটি এখন মোটামুটি সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, সমকামিতার মত যৌন-প্রবৃত্তিগুলো ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ নয়, বরং বৈজ্ঞানিক উপাত্ত ও তত্ত্বের সাহায্যেই এই ধরনের যৌন-প্রবৃত্তিগুলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে; জীববিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা কিন্তু সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। আজ আমি যখন এ বইটি লিখতে বসেছি তখন সারা পৃথিবী জুড়ে চারশ’রও বেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ‘গে জিন’ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। কাজেই সমকামিতার ব্যাপারটি এখনো জীববিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার সজীব একটি বিষয় – যে কোন সম্ভাবনার এক অবারিত দুয়ার!

সমকামিতা ও মানবাধিকার

আধুনিক চিকিৎসকেরা এবং মনোবিজ্ঞানীরা এখন সমকামিতাকে একটি স্বাভাবিক যৌনপ্রবৃত্তিই মনে করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর American Psychiatric Association (বহু চিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন) বিজ্ঞান্সম্মত আলোচনার মাধ্যমে একমত হন যে সমকামিতা কোন নোংরা ব্যাপার নয়, নয় কোন মানসিক ব্যধি। এ হল যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ১৯৭৫ সালে American Psychological Association একইরকম অধ্যাদেশ দিয়েছিলেন। সকল আধুনিক চিকিৎসকই আজ এ বিষয়ে একমত। তারপরও বাংলাদেশ সহ অনেক রাষ্ট্রেই সমকামিতা স্বীকৃত নয়, অনেক জায়গাতেই এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানে সমকামীদের হয় লুকিয়ে থাকতে হয়, কিংবা অভ্যস্ত হতে হয় ‘ক্লোসেট গে’ হয়ে ‘বিবাহিত’ জীবন যাপনে। পশ্চিমা বিশ্ব কিছুটা হলেও এ ব্যাপারে উদার হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। সেখানে গে এবং লেসবিয়ানরা বিশ্বের বহু দেশে সামাজিক স্বীকৃতি ও আইনগত বৈধতার জন্য কয়েক যুগব্যাপী আন্দোলন করছেন, অংশ নিচ্ছেন ‘গে-প্রাইড’ মার্চে। তাদের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আমেরিকার কয়েকটি স্টেটে সমকামী বিয়ে আজ স্বীকৃত। ব্রিটেনেও বিগত টনি ব্লেয়ারের সরকার কয়েক বছর আগে প্রথম সমকামী যুগলদের স্বীকৃতি দিয়েছে। পশ্চিমে সমকামী-অধিকার আন্দোলনের সাফল্য এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার কয়েকটি প্রধান দেশ তাদের আইন সংস্কারে এগিয়ে এসেছে। চীনে আগে মাও সে তুংয়ের আমলে মনে করা হতো, সমকামিতা হচ্ছে ‘পুঁজিবাদের বিকৃতি’। কিন্তু আশির দশক থেকে তাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। নেলসন ম্যানডেলার নেতৃত্বে সাউথ আফ্রিকায় বর্ণবাদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে নতুন সংবিধান হয় তাতে শুধু ধর্মই নয়, যৌনতা বিষয়ে কোনো বৈষম্য করা হবে না এমন ধারা সংযোজিত হয়। আমাদের দেশে সমকামীরা সত্যিকার অর্থেই ‘হিডেন মাইনোরিটি’, তাদের অস্তিত্বই এখানে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্বীকৃত, যদিও বিভিন্ন নিরপেক্ষ গবেষণায় দেশে ৬ থেকে ১২ মিলিয়ন সমকামীর অস্তিত্বের কথা উঠে এসেছে নানা সময়েই। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজ নারী অধিকার, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান কিংবা বড়জোর পাহাড়ি কিংবা আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আজ কিছুটা সচেতনতা দেখালেও তারা এখনো যৌনতার স্বাধীনতা কিংবা সমকামীদের অধিকার নিয়ে একদমই ভাবিত নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সম্প্রতি নয়াদিল্লির হাইকোর্ট সমকামিতা অপরাধ নয় বলে রায় দিয়েছে (জুলাই, ২০০৯) । ১৪৮ বছরের পুরোনো ঔপনিবেশিক আইনে সমকামিতাকে যেভাবে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনতা’ হিসেবে গণ্য করে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো – এ রায়ের মধ্য দিয়ে সেটির অবসান ঘটেছে। এর ফলে সমকামিতা নামক যৌনপ্রবৃত্তিটি ভারতের মত দেশে প্রথম বারের মত পেল কোন ধরণের আইনী স্বীকৃতি। দিল্লি হাইকোর্ট সমকামিতা নিষিদ্ধ আইনকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়েছে, সুস্পষ্টভাবে একে মানুষের ‘মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন’ বলে রায় দিয়েছে।

ভারতে সমকামিতার বৈধতা
চিত্রঃ দিল্লী হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পর সমকামী অধিকার কর্মীদের উল্লাস (সৌজন্য – নিউইয়র্ক টাইমস)

নিঃসন্দেহে এ এক ঐতিহাসিক যাত্রা, শুধু সমকামীদের জন্য নয়, সার্বিকভাবে মানবাধিকারের জন্যও। পাকিস্তানের মত রক্ষণশীল রাষ্ট্রেও উভলিঙ্গ মানবদের জন্য সমানাধিকারের আইন পাশ করা হয়েছে। আমরা আশা করব, যুগের দাবীর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও একটা সময় সমকামিতার প্রতি সহিষ্ণু মনোভাব গড়ে উঠবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ষাঁড়দের যাতাকলে নিয়ত পিষ্ট সংখ্যালঘু যৌনপ্রবৃত্তির মানুষগুলোর আইনী অধিকার স্বীকৃত হবে। আর সেজন্য দরকার আমাদের সবার বিজ্ঞানমনস্ক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। নির্মাণের মত প্রগতিশীল ব্লগসাইটগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনন গঠনের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ
১। রমাবাই এর বক্তৃতা উপলক্ষে, জৈষ্ঠ, ১২৯৬, রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী সুলভ সংস্করণ।
২। Dylan Evans & Howard Selina, Introducing Evolution, Icon Books, UK, 2001
৩। Joann C. Gutin, Why Bother? Sex seems like an unnecessary complicated means of reproducing. So how did it ever started? And why did it catch on? Discover, June, 1992.
৪। David Crews, Animal Sexuality, Scientific American, January, 1994
৫। অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু, সমপ্রেম, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৫।
৬। Wardell B. Pomeroy, Clyde E. Martin, Alfred C. Kinsey Paul H. Gebhard , Sexual Behavior in the Human Female, AND Sexual Behavior in the Human Male, W. B. Saunders Company , 1953
৭। David P. McWhirter, Stephanie A. Sanders and June Machover Reinisch, Homosexuality/Heterosexuality: Concepts of Sexual Orientation, Oxford University Press, USA, 1990
৮। John Maynard Smith, The Evolution of Sex, Cambridge University Press; 1978।
৯। Bruce Bagemihl, Biological Exuberance: Animal Homosexuality and Natural Diversity, Stonewall Inn Editions, 2000
১০। Simon Levay and Dean H. Hamer, Evidence for a Biological Influence in Male Homosexuality, Scientific American, May 1994.
১১। Joan Roughgarden, Evolution’s Rainbow: Diversity, Gender, and Sexuality in Nature and People, University of California Press, May 17, 2004।
১২। Sarah Blaffer Hrdy, Sexual diversity and the gender agenda, Nature 429, pp 19 – 21, 06 May 2004
১৩। Talk Origin, Claim CB403: Evolution does not explain homosexuality; http://www.talkorigins.org/indexcc/CB/CB403.html
১৪। Leslie Feinberg, Transgender Warriors : Making History from Joan of Arc to Dennis Rodman, Beacon Press, 1997.
১৫। Indian Court Overturns Gay Sex Ban, The New York Times, July 2, 2009
১৬। Historic Decision: Pakistan’s Supreme Court Orders Equal Rights for Transgender Pakistanis, Dawn, Wednesday, 15 Jul, 2009
১৭। অভিজিৎ রায়, ‘সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’, শুদ্ধস্বর (২০০৯)।

অভিজিৎ

মূলতঃ বিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রান্তিক বিষয় নিয়ে লেখালিখি করি।

৪৪ comments

  1. অভিজিৎ - ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৬:৪১ অপরাহ্ণ)

    নির্মাণে এটাই আমার প্রথম লেখা। আমি আশা করবো এখানে আলোচনা সমালোচনায় সময়গুলো ভাল কাটবে।
    আমার বৈজ্ঞানিক এবং সমাজমনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে লেখা বইটা বেরুচ্ছে এই বই মেলায়। কিছু স্যাম্পল অধ্যায় রাখা আছে এখানে –

    সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (কিছু স্যাম্পল অধ্যায়)

    আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

    • স্বপ্নময় চক্রবর্তী - ৯ মে ২০১২ (৬:৪৬ অপরাহ্ণ)

      আমি কি আপনার মেইল আই ডি পেতে পারি? আপনার সঙ্গে অনেক দরকার।

      স্বপ্নময় চক্রবর্তী

      • স্বপ্নময় চক্রবর্তী - ১২ সেপ্টেম্বর ২০১২ (৭:২২ অপরাহ্ণ)

        swapnoc@rediffmail.com আপনাকে ধন্যবাদ।

        • অভিজিৎ - ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ (৭:২৬ পূর্বাহ্ণ)

          অনেক ধন্যবাদ। অনেকদিন মুক্তাঙ্গন ব্লগে না আসার কারণে আপনার প্রতিক্রিয়াটি দেখিনি। আমার সাথে ঠিক কি দরকারে যোগাযোগ করতে চান তা জানলে ভাল হত। যা হোক, আপনার ইমেইলে একটি ইমেইল পাঠিয়েছি। আশা করছি যোগাযোগ হবে।

  2. রায়হান রশিদ - ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:১৬ অপরাহ্ণ)

    লেখককে অশেষ ধন্যবাদ এমন একটি বিষয় নিয়ে এমন বিশ্লেষণধর্মী একটা লেখা আমাদের উপহার দেহার জন্য। বিষয়টি আসলেই একটি অচ্ছুৎ বিষয়। খুব কম প্রগতিশীল মানুষকেই জানি যারা নিজের নিকট-পরিচিত মন্ডলের বাইরে এই বিষয়টি নিয়ে বলবার কিংবা লিখবার সাহস রাখেন। পাছে লোকে আবার তাদের ‘কিছু একটা’ ভেবে বসে, এই ভয়েই হয়তো! দিল্লী হাইকোর্টের রায়টির পরপরই বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়ের পক্ষে আইনী লড়াই নিয়ে জনস্বার্থ আইনজীবি এক সহকর্মীর সাথে কথা হচ্ছিল বিষয়টি নিয়ে। কথা হচ্ছিল আর সকল বিষয়ে মুক্তমনের অথচ এই বিষয়টিতে এসে থমকে যাওয়া প্রগতিশীল মানুষদের অবস্থান নিয়ে। কথায় কথায় মজার একটা টার্ম স্থির করা সম্ভব হয়েছিল সেদিন, আর তা হল: ‘progressive bigot’। এটা আসলেই কোন oxymoron কিংবা অসম্ভব অভিধা না, এটা অত্যন্ত বাস্তব এক পরিস্থিতি। (এই রায়ের পরপরই মুক্তাঙ্গনে ছোট পরিসরে হলেও একটা আলোচনা শুরু হয়েছিল। এখানে লিন্ক)।

    হয়তো এর পেছনে – আজন্ম লালিত সংস্কার (কুসংস্কারও এর অন্তর্ভূক্ত), গোঁড়ামি, আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিলব্ধ অনুসিদ্ধান্তগুলোতে প্রত্যয়ের অভাব – ইত্যাদি বিষয়গুলো কাজ করে। পরিবারের ধারণা, এবং তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পুরুষতান্ত্রিক, জৈবিক মূল্যবোধের যে দেয়াল সেটাই হয়তো ভেঙ্গে পড়তে চায়, বৃত্তের বাইরে চিন্তাকে বিস্তৃত করতে গেলে! কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা প্রাকৃতিক, কোনটা ‘নর্মাল’ – সে সব বিষয়ে আঁকড়ে ধরার মতো আমাদের কিছু বদ্ধমূল ধারণা চাইই চাই, তা নাহলে কি আর জীবন চলে! কোনটা ‘নর্মাল’ আর কোনটা norm, তা নিয়ে আলোচনায় এক বন্ধু সেদিন গায়ত্রী স্পিভাক এর লেখার প্রসঙ্গ ধরে heteronormativity সমালোচনা-তত্ত্বের খবর জানিয়েছিল। (এখনো পড়ার সৌভাগ্য হয়নি লেখাগুলো; তবে পড়ার ইচ্ছে আছে)। এ বিষয়ে আপাতত উইকিভূক্তির লিন্কটি দেয়া হল উপরে। এটা যথেষ্ট নয় জানি, তবে এখান থেকেও আমরা সবাই মিলে বিষয়গুলোর আরও গভীরে যাওয়া শুরু করতে পারি মনে হয়। আর এর মধ্যে সদয় কেউ যদি প্রাসঙ্গিক আরও কোনো লেখার লিন্ক দিয়ে দেন এখানে তাহলেও একটা সামষ্টিক পাঠ হয়ে যেতে পারে।

    সমকামিতা ইস্যুতে সঠিক অবস্থান কেবল বিজ্ঞান কিংবা নীতিশাস্ত্রেরই দাবী না। এটি জননীতিরও (public policy) দাবী। সমকামিতা ইস্যুতে দিল্লী হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে পোস্টে। এই রায় পড়লে বোঝা যায় চিন্তাকে আবদ্ধ করে রাখার ফলাফল কত যে ভয়াবহ হতে পারে। লোকচক্ষুর আড়ালে, সমাজের আড়ালে, মূলধারার আলোচনার বাইরে এইডস রোগীদের দুরবস্থা এবং এইডস মহাব্যাধির বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লী হাইকোর্টের রায়ে সেই বিষয়গুলোই উঠে এসেছে। পাঠকের সুবিধার্থে পুরো রায়ের কপিটি এখানে দেয়া হল:
    সরাসরি ডাউনলোডের লিন্ক

    লেখককে আবারও ধন্যবাদ।

    • অভিজিৎ - ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১০:৫০ অপরাহ্ণ)

      রায়হান,

      অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং দরদী মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আপনি ঠিকই বলেছেন – সমকামিতা ইস্যুতে সঠিক অবস্থান কেবল বিজ্ঞান কিংবা নীতিশাস্ত্রেরই দাবী না। এটি জননীতিরও (public policy) দাবী। সেজন্যই আমি আমার বইয়ে অসংখ্য কেস স্টাডি উপস্থাপন করেছি। আর মানবিকতার দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করে পুরো একটা চ্যাপ্টার লিখেছি – যেটা পড়া যাবে এখান থেকে। আমি সমকামিতার অইনী অধিকার এবং অন্যন্য অধিকারের একটা ধারাবাহিক ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি এখানে। আপনি দেখতে পারেন।

      বিভিন্ন জটিলতা আর পরিস্থিতির কারণে বাংলাদশে সমকামী আন্দোলনের কর্মীরা নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং সংকটের মুখোমুখি। কোন সংগঠনই প্রকাশ্যে এ নিয়ে কাজ করে সাহস করে না, তা বলাই বাহুল্য্য। তারপরেও আশার কথা এই যে, বয়েস অব বাংলাদেশ (বব), বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর গেস (ব্যাগ) নামে দুটি গ্রুপ বাংলাদেশে সমকামিতার উপর মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে কাজ করে যাচ্ছে। সখিনী এবং সপ্রভা নামের দুটি সংগঠন কাজ করছে নারী সমকামিতার উপর। বাঁধন হিজড়া সংগঠন কাজ করছে উভলিংগ মানবদের পশ্চিম বঙ্গে স্যাফো, প্রত্যয়, প্লাস, পাম, কোমল গান্ধার, প্রান্তিক বনগাঁ সহ বহু সংগঠন সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইন্টারনেটে LGBTI Bangladesh, Global Gayz Bangladesh, bengayliz.com, প্রভৃতি সাইট বাংলাদেশী সমকামীদের অধিকার নিপীড়ন, ব্যথা বেদনা নিয়ে লিখছে। তবে আমরা মনে করি সমপ্রেমীদের মানবাধিকার অর্জনের লড়াই, শুধু তাদের একারই নয়, এ লড়াইয়ে বিষমকামীদেরও সামিল হওয়া প্রয়োজন। আসলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষদের এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে না পারলে আন্দোলন পূর্ণতা পাবে না।

  3. মনজুরাউল - ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১০:৩৮ অপরাহ্ণ)

    “মার্কসবাদ কি বিজ্ঞান” এর মত আরো একটি “ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব কি সমকামিতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে?” এর মুখোমুখি হলাম।ধারণা করি শেষে এসে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে যে ‘ডারউইনের বিবর্তনবাদ এখন আর ধোপে টেকে না’! সে পর্যন্ত বিদগ্ধজনদের আলোচনা পড়ি আর অপেক্ষায় থাকি——

    মুক্তাঙ্গন-এ স্বাগতম।

    • অভিজিৎ - ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১১:০৮ অপরাহ্ণ)

      আপনার প্রথম দুটো বাক্যে অনাবশ্যক শ্লেষের সুর লক্ষ্য করলাম। আপনি সম্ভবতঃআমার লেখা পুরোটা না পড়েই মন্তব্য করছেন। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব জীববিজ্ঞানের একটি প্রমাণিত বিষয়। এ নিয়ে আমি বহু প্রবন্ধ লিখেছি। যেমন, এই প্রবন্ধটি দেখতে পারেন – এক বিবর্তনবিরোধীর প্রত্যুত্তরে। আপনার এ লেখা থেকে কেন মনে হল যে, আমি বলতে চেয়েছি – “ডারউইনের বিবর্তনবাদ এখন আর ধোপে টেকে না” তা সত্যই আমার বোধগম্য হলো না। বরং আমি তো সেজন্যই ডঃ ক্যাম্পেরিও ক্যানির উক্তি উদ্ধৃত করেই বলেছি –

      “We have finally solved the paradox … the same factor that influence sexual orientation in males promotes higher fecundity in females’

      এটা তো পার্ফেক্ট ডারউইনীয় সমাধান। নয় কি?

      আর বিবর্তনের দৃষ্টিকোন থেকে সমকামিতা যে সব সময়ই একটি ধাঁধার মত, তা জানতে চাইলে আপনি জীববিজ্ঞানের জার্নালগুলোতে সার্চ দিলেই পাবেন। এনিয়ে বহু বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। সেই প্রান্তিক গবেষনার ফলাফল উল্লেখ করা কি ভুল? নাকি অন্যায়? আপনি জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিলের লেখা ‘বায়োলজিকাল এক্সুবারেন্স : এনিমেল হোমোসেক্সুয়ালিটি এন্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি’ কিংবা জোয়ান রাফগার্ডেনের ‘ইভোলুশন রেইনবো‘ বইদুটো পড়তে পারেন। আমার কথার সত্যতা পাবেন।

      আপনি পুরো লেখাটা না পড়েই অযথা (সম্ভবতঃ পূর্ব রাগ থেকে 🙂 ) আমার উপর ঝাপিয়ে পড়েছেন। মনজুরাউল, আমি ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে চিনি না। যতদূর মনে পড়ে ব্লগে আমাদের মোলাকাৎও খুব কমই হয়েছে। আমার কোন লেখা নিয়ে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু একটি বিশ্লেষণমূলক লেখার উত্তরে চটকদার এবং শ্লেষাত্মক মন্তব্য কি অভিপ্রেত? আর মার্ক্সিজমের প্রসঙ্গটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক, নয় কি (আবারও পূর্বরাগের কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে 🙂 ) । এ লেখার সাথে তো কোন সম্পর্ক নেই।

      আমি এই ব্লগে লেখা নিয়ে বিষয়গতভাবে সুস্থ আলোচনা প্রত্যাশী, অনর্থক খোঁচাখুঁচি নয়।

      আপনার মন্তব্যের শেষ উক্তিটির জন্য ধন্যবাদ।

      • মনজুরাউল - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:১৪ পূর্বাহ্ণ)

        লজ্জায় ফেলে দিলেন দাদা। আমি খোঁচাখুচিঁ বা শ্লেষ-ব্যঙ্গ কোনটাই করার চেষ্টা করিনি। তেমনটি মনে হলে ক্ষমা করবেন। ২০০৮ সালের জুন-জুলাইতে সচলায়তনে আপনার “মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?” এবং ফারুক ওয়াসিফ এর “পুনশ্চ অভিজিত: কার্ল পপারের মার্কস দর্শন কী মতে সঠিক?” লেখা দুটি মনোযোগ সহ পড়েছিলাম। ওই দুটি পোস্টে আমার কোন কমেন্ট নেই, কারণ এর কিছুদিন আগেই আমি সচল ছেড়ে এসেছিলাম, কিন্তু অভ্যেস বশে যেতাম। শেষ দিকে আপনার, সুবিনয় মুস্তফী’র শ্লেষ আর আক্রমনাত্মক কমেন্ট দেখে ভয় পেয়েছিলাম। ভয়টা এখনো আছে।

        মার্কস আর ডারউইন আসছে একারণেই যে, সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষণে এই দুই মণিষীকে টানতেই হয়।ফারুক, পি মুন্সী, তরিকুল হুদা, রাসেল,সুবিণয় মুস্তফী প্রমুখেরা বিতর্ক করেছিল। আমি ছিলাম ‘গ্যালারির’ দর্শক। আজও তাই।

        আপনি পুরো লেখাটা না পড়েই অযথা (সম্ভবতঃ পূর্ব রাগ থেকে 🙂 ) আমার উপর ঝাপিয়ে পড়েছেন। মনজুরাউল, আমি ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে চিনি না। যতদূর মনে পড়ে ব্লগে আমাদের মোলাকাৎও খুব কমই হয়েছে। আমার কোন লেখা নিয়ে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু একটি বিশ্লেষণমূলক লেখার উত্তরে চটকদার এবং শ্লেষাত্মক মন্তব্য কি অভিপ্রেত? আর মার্ক্সিজমের প্রসঙ্গটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক, নয় কি (আবারও পূর্বরাগের কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে 🙂 ) । এ লেখার সাথে তো কোন সম্পর্ক নেই।
        আমি এই ব্লগে লেখা নিয়ে বিষয়গতভাবে সুস্থ আলোচনা প্রত্যাশী, অনর্থক খোঁচাখুঁচি নয়।

        ব্লগে লিখতে বা বিতর্ক করতে হলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতেই হয় এমন কিছু বোধহয় নেই।না, আপনার সাথে আমার কোন পূর্ব যোগাযোগ নেই, ছিলও না। আবারও বলছি দাদা, ‘চটকদার এবং শ্লেষাত্মক মন্তব্য মনে হলে মার্জনা করবেন। তবে আমি প্রায় নিশ্চিত এই বিষয়ে বিস্তারে আলোচনায় গেলে ওই দুই ‘বুড়ো’ এসেই যাবে। সেক্ষেত্রে বলা যায় মার্কস খুব অপ্রাসঙ্গিক বোধহয় নয়।

        হ্যাপি ব্লগিং।

        • অভিজিৎ - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৯:১৩ পূর্বাহ্ণ)

          মনজুরাউল,
          আসলে আমার এই লেখার বিষয় মার্ক্সিজম নয়। কাজেই আমার আগের লেখা আর ফারুক ওয়াসিফ কি লিখেছিলেন, সেটা আমার এই লেখার প্রসঙ্গে একেবারেই বেনানান। মার্ক্সিজম ছাড়াও আমি বহু বিষয় নিয়ে বহু জায়গায় লিখেছি। কিন্তু আমি কিছু লিখলেই যদি গরু রচনার মত গরুকে নদীতে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা দেখি, তাতে বিরক্তই লাগে। অন্যরাও হয়তো বিরক্ত বোধ করেন।

          আর তাছাড়া, আপনি যেমন ভাবছেন, আমার কিন্তু মার্ক্সের প্রতি কোন বিরাগ নেই। এমনকি এবারের সমকামিতার বইটিও আমি শুরু করেছি দান্তের এবং মার্ক্সের উদ্ধৃতি দিয়ে। আপনি বইয়ের উৎসর্গ পাতাটা খুলে দেখবেন, অথবা অনলাইনে দেখতে পারেন এখান থেকেও (২য় পাতা দেখুন)।

          সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষণে অবশ্যই মার্কস গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বটুকু উল্লেখ করে আপনিও আলোচনা শুরু করতে পারেন। আমি কেবল আপত্তি জানিয়েছি ধান ভানতে শীবের গীতের মত সমকামিতার লেখায় – “মার্কসবাদ কি বিজ্ঞান” এর মত আরো একটি “ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব কি সমকামিতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে?” এর মুখোমুখি হলাম। – এ ধরণের চটুল উক্তি ব্যবহার করে আমাকে গুতো দেয়ার অযথা অপচেষ্টা দেখে। এ উক্তি দেখে বোঝা যায় আপনি আসলে প্রবন্ধটি ঠিকমত পড়েননি। পড়লে বুঝতেন যে পুরো প্রবন্ধটি আসলে ডারউইনীয় দৃষ্টিকোন থেকেই সমকামিতাকে ব্যাখ্যার প্রয়াস।

          আর মার্কসবাদ নিয়ে আগের লেখাটায় সুবিনয় মুস্তফী’র আর আমার শ্লেষ আক্রমনাত্মক কমেন্ট ছিলো নাকি পি মুন্সি আর অন্যান্যরা ‘ছাগল’ বলে গাল দিয়েছিলো কিনা – সেগুলো না হয় আলোচনা নাই করলাম এই থ্রেডে। গরুকে তো অলরেডী নদীর কিনারায় নিয়ে গেছেন, এবারের মত গোবেচারা গরুটাকে না হয় একটু রেহাই দিলেন। 🙂

          আপনার সহযোগিতা কামনা করছি। আপনার মঙ্গল হোক।

          • মনজুরাউল - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:৪৫ পূর্বাহ্ণ)

            আর মার্কসবাদ নিয়ে আগের লেখাটায় সুবিনয় মুস্তফী’র আর আমার শ্লেষ আক্রমনাত্মক কমেন্ট ছিলো নাকি পি মুন্সি আর অন্যান্যরা ‘ছাগল’ বলে গাল দিয়েছিলো কিনা – সেগুলো না হয় আলোচনা নাই করলাম এই থ্রেডে। গরুকে তো অলরেডী নদীর কিনারায় নিয়ে গেছেন, এবারের মত গোবেচারা গরুটাকে না হয় একটু রেহাই দিলেন। 🙂
            আপনার সহযোগিতা কামনা করছি। আপনার মঙ্গল হোক।

            ‘রেহাই’,’সহযোগিতা’,’মঙ্গল’……..এই বিষয়গুলি মাথায় রেখে গুডবাই।

        • সৈকত আচার্য - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৮:৫৪ অপরাহ্ণ)

          @ মনজুরাউলঃ
          অভিজিৎকে করা আপনার প্রথম মন্তব্যটা শ্লেষাত্নক-ই মনে হয়েছে। যদিও বলেছেন, আপনি সেভাবে আসলে বলেননি। তাছাড়া, কেউ যখন নিজের অবস্থান পরিস্কার করে ব্যাখ্যা দেন সে ব্যাপারে second guess করা উচিত নয় বলেই মনে করি। কারন এটা পারস্পরিক সৌজন্য ও শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়। কিন্ত তারপরও একটা কথা বলতে হয়। “মার্কসবাদ কি বিজ্ঞান” এই শিরোণামে যে লিখাটি তিনি লিখেছিলেন এবং তার পালটা যে জবাবগুলো ফারুক ওয়াসিফ এবং অন্যরা দিয়েছিলেন সে বিষয়ে আমি নিজে সম্যক অবগত। ওই আলোচনাগুলো মন দিয়ে পড়েছিলাম। পরিচিতজনদের লিংক পাঠিয়েছিলাম। যারা লিংক পেয়ে পড়েছেন মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই আমাকে বলেছেন, আলোচনাটা শুরু হয়েছিল সুন্দরভাবে, কিন্ত একটা পর্যায়ে এসে প্রচন্ড ব্যক্তি আক্রমন শুরু হয়ে যায়। একারনে আলোচনাটি সুন্দরভাবে সমাপ্ত হতে পারেনি।

          কথাটি বললাম এ কারনে যে, এখানে ব্যক্তি আক্রমন প্রবনতার ঝোঁক থেকে যেন আমরা মুক্ত থাকতে পারি। এই আলোচনাটি আমরা অনেকেই মনযোগ দিয়ে পড়ছি। এখানে আপনার নিজের আলোচনা, নিজের দৃষ্টীভংগী এবং নানা বিরুদ্ধ মত নিয়ে আপনি লিখতে পারেন। আমরা সেগুলো পড়ে একটা দারুন বির্তকের ঝড় তুলতে পারি। সমকামিতা, মার্ক্স এবং ডারউইন নিয়ে কেউ যদি একটা সমালোচনামূলক লেখা উপহার দেন তাতে কারো বিষন্ন হওয়ার কিংবা ক্ষেপে যাওয়ার কিছু আছে বলে মনে করি না। যদি ক্ষেপতেই হয়, তাহলে এ জাতীয় পোস্টে পালটা শাণিত যুক্তি দিয়ে মসী যুদ্ধে অবতীর্ন হওয়াটাই কাম্য। বলা বাহুল্য যে, এই ব্লগের পাঠকেরা সেটাই দেখতে পছন্দ করেন বৈকি!

          • মনজুরাউল - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:৫৩ পূর্বাহ্ণ)

            অভিজিৎকে করা আপনার প্রথম মন্তব্যটা শ্লেষাত্নক-ই মনে হয়েছে। যদিও বলেছেন, আপনি সেভাবে আসলে বলেননি। তাছাড়া, কেউ যখন নিজের অবস্থান পরিস্কার করে ব্যাখ্যা দেন সে ব্যাপারে second guess করা উচিত নয় বলেই মনে করি।

            আপনার মনে করাকে সন্মান জানালাম।

            সমকামিতা, মার্ক্স এবং ডারউইন নিয়ে কেউ যদি একটা সমালোচনামূলক লেখা উপহার দেন তাতে কারো বিষন্ন হওয়ার কিংবা ক্ষেপে যাওয়ার কিছু আছে বলে মনে করি না। যদি ক্ষেপতেই হয়, তাহলে এ জাতীয় পোস্টে পালটা শাণিত যুক্তি দিয়ে মসী যুদ্ধে অবতীর্ন হওয়াটাই কাম্য।

            আমার ‘ভীত হওয়াকে’ ক্ষেপে যাওয়া মনে করা ঠিক না।

          • অভিজিৎ - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৮:০৮ পূর্বাহ্ণ)

            সৈকত আচার্য,
            আমি খেয়াল করিনি যে, ২৯ জুলাই ২০০৯ তারিখের “সমকামিতা অপরাধ নয়”, দিল্লী হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়” শীর্ষক চমৎকার পোস্টটিতে মন্তব্য করতে গিয়ে (৩ নং মন্তব্য) আপনি আমার অনলাইনে রাখা “সমকামিতা কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ?” সিরিজটির উল্লেখ করেছিলেন। আসলে নির্মাণে নবাগত হিসেবে অংশগ্রহণের খেসারত হিসেবে আগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট আমার অগোচরে থেকে গিয়েছিলো। আজ রায়হানের দেয়া প্রথম মন্তব্যে লিঙ্কটি থেকে মন্তব্যগুলো পড়তে গিয়েই এটি চোখে পড়লো। আপনাকে এবং অন্যন্য সতীর্থদের সঙ্গে থাকার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

  4. মনজুরাউল - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:২০ পূর্বাহ্ণ)

    @ লেখক। রায়হান এর দেওয়া পিডিএফ এটাচমেন্টটা পোস্ট খুলতে সমস্যা করছে (সবার করছে কিনা বলতে পারব না)। খুব প্রয়োজনীয় মনে না হলে ওই অংশটুকু মুছে দিলে ভাল হয়।

  5. অস্মিতা - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ)

    @ অভিজিৎ
    তথাকথিত ভদ্র সমাজে প্রায় অস্পৃশ্য একটি বিষয় নিয়ে এই তথ্যবহুল চমৎকার বিশ্লেষণটির জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আপনার দেয়া বইয়ের চাপ্টারগুলোর লিনক অনুসরণ করছি। সময় নিয়ে পড়ে মন্তব্য করার ইচ্ছে রাখি।

    @ মনজুরাউল
    লেখক আগের ব্লগে কি লিখেছিলেন, কোন্ প্রেক্ষাপটে কার মন্তব্যে কেমনভাবে প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ এখানে টেনে আনার যৌক্তিকতা স্পষ্ট হলো না। এই আলোচনায় মার্কস এসে যাবেন কিনা, এসে গেলেও লেখক তার বিষয়ে কি মন্তব্য দেবেন, সেটি আগে ভাগেই কল্পনা করে নেয়াটা অনেকটাই জর্জ বুশীয় কায়দায় প্রিএম্পটিভ এটাক হয়ে গেল মনে হয়। অন্য ব্লগে লেখকের সাথে তরিকুল হুদা, সুবিনয় মুস্তফী, ফারুক ওয়াসিফ, পি মুন্সী ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের কি ঘটেছিল সেটি জানবার তেমন আগ্রহ বোধ করছি না। বরং অনেক বেশী আগ্রহী হচ্ছি সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় এই পোস্টের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে আপনার কোন ভাবনা বা আলোচনা থেকে থাকলে সেটি জানতে। লক্ষ্য করলাম, তিনটি মন্তব্য দিয়েছেন পোস্টের মূল বিষয়বস্তুকে স্পর্শ না করেই! বলেছেন “তবে আমি প্রায় নিশ্চিত এই বিষয়ে বিস্তারে আলোচনায় গেলে ওই দুই ‘বুড়ো’ এসেই যাবে। সেক্ষেত্রে বলা যায় মার্কস খুব অপ্রাসঙ্গিক বোধহয় নয়।” মার্কসকে যেহেতু সমকামীতা বিষয়ক আলোচনায় প্রাসঙ্গিক মনে করছেন, তাই মনে হল আপনিই হয়তো সমকামীতার “মার্কসীয় বিশ্লেষণ” টি শুরু করতে পারেন এখানেই। তাতে এই আলোচনাটি একটি ইন্টারেস্টিং জায়গায় যেতে পারে মনে হয়।

    • অভিজিৎ - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৯:৪১ পূর্বাহ্ণ)

      অস্মিতা,
      প্রথমেই আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপনার চমৎকার মন্তব্য এবং আলোচনা নিঃসন্দেহে পোস্টটির মান অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

      আপনার দেয়া বইয়ের চাপ্টারগুলোর লিনক অনুসরণ করছি। সময় নিয়ে পড়ে মন্তব্য করার ইচ্ছে রাখি।

      অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি আপনার ফীডব্যাকের অপেক্ষায় থাকবো। তবে ইন্টারনেটে রাখা চ্যাপ্টারগুলো (আর সবগুলো চ্যাপ্টার অনলাইনে দেওয়াও হয়নি) আসলে বইয়ের প্রুফ রীড করার আগেকার। মূল বইয়ে কিছু পরিবর্তন আছে। আছে আরেকটু ঘষামাজা। কাজেই বানান এবং আনুষঙ্গিক ভুলভাল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে বাধিত হবো।

      আবারো অনেক ধন্যবাদ – সুন্দর এই মন্তব্যের জন্য।

  6. বস্তুবাদী - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (২:২২ অপরাহ্ণ)

    খূব ভালো লেগেছে লেখাটী পড়ে। ঃ)

    • অভিজিৎ - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:২০ পূর্বাহ্ণ)

      পড়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

  7. স্নিগ্ধা - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:৪৬ অপরাহ্ণ)

    অভি, আগেই এতোসব ভালো কথা বলে ফেলেছি এই লেখাটা নিয়ে, যে এই ব্লগে নতুন করে যোগ করার মতো আর কিছু পাচ্ছি না! আবারও অভিনন্দন জানাচ্ছি – বিষয় নির্বাচন যেমন দারুণ, তেমনি তোমার বর্ণনা 🙂

    • অভিজিৎ - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:২৩ পূর্বাহ্ণ)

      হেঃ হেঃ :)) । বইয়ের পরিশিষ্টে যেহেতু তোমার প্রতিক্রিয়াও সন্নিবেশিত আছে, কাজেই এই বইয়ের পাঠকদের গালিগালাজের কিছু ভাগ তোমারও প্রাপ্য হবে, তা বলাই বাহুল্য। আর যাবতীয় প্রশংসা (যদি এ ধরনের কিছু আদৌ ঘটে) যে শুধুই আমারভাগে তা তো জানই।

  8. ব্লাডি সিভিলিয়ান - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:১০ অপরাহ্ণ)

    অভিজিৎ,
    আপনার বইয়ের বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়েছে আগেই। ভাবছিলাম বইটা কোথায় পাওয়া যায়। যাহোক, এই ব্লগে আপনাকে স্বাগতম। আর, আপনার লেখার সাথে আমি পরিচিত অবশ্য আগে থেকেই। আমি নিশ্চিত আমার শহরে আপনার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটির প্রথম দিককার ক্রেতা এবং পাঠকদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। এরপর ব্লগে এসে আপনার আরো কিছু লেখালেখির সাথে পরিচিত হলাম। মুগ্ধতা আরো কিছুটা বাড়লো। তবে, যথারীতি আপনার কিছু সমালোচ্য দিকও চোখে পড়েছে। যাহোক, সেসব বলে আর মন্তব্যের কলেবর বাড়াবো না।
    আপনার এই কাজটি যথারীতি আপনার অন্য কাজের মতোই পরিশ্রমী, পাঠসুখকর এবং যুক্তিঋদ্ধ। পুরো বইটা যেহেতু পড়া নেই, তাই এর (সমকামিতার) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কতটুকু আলোচনা করেছেন, তা জানা নেই। বিষয়টি আদিকাল থেকেই কিছুটা প্রচলিত থাকাটা নেহাৎ অস্বাভাবিক নয়।
    একটা উদাহরণ দেই।
    ভারতীয় পুরাণের একটি চরিত্রের জন্মই হয় দুই নারীর সঙ্গমে, শিবের আশীর্বাদে, এবং তাঁর নামেই ব্যাপারটি স্বপ্রকাশ। তিনি পৃথিবীতে গঙ্গা আনয়নের মতো মহদাশয় কাজ করেছিলেন বলে কিম্বদন্তী। তিনি ভগীরথ। ভগে ভগে তাঁর জন্ম হয়েছিলো বলেই এই নাম। কাজেই, ব্যাপারটি একেবারে অগ্রাহ্য ছিলো না তৎকালেও। মনে হয় না, তাঁর মায়েদের কেউ ‘সমকামী’ হিসেবে ক্রুদ্ধ আক্রমণ করেছিলো।
    ঠিকই বলেছেন যে, সমকামীরা আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজে ধর্মীয় এবং সামাজিক অন্ধত্ব ও আক্রমণাত্মক মানসিকতার শিকার। এটাও স্বীকার করছি যে, যৌনতা ব্যাপারটিই একান্ত রকমভাবে ব্যক্তিগত। এখনও আমাদের সমাজে পায়ুকাম (এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও) ধর্মীয় দিক থেকে ট্যাবু। তাই, আমাদের সমাজে ‘সডোমি’ কোন পর্যায়ের মর্যাদা পায়, তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ সংক্রান্ত জটিলতা তো আছেই। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘সিটি অব জয়’ উপন্যাসে ‘হিজড়া’ হওয়ার একাধিক দুঃখজনক (পরিবারের ভূমিকার কারণে) বিবরণ। খুশবন্ত সিং-এর ‘দিল্লি’ উপন্যাসটি আনছিই না হিসেবে। যাহোক, এটা মূলত সংখ্যালঘু হওয়ার যন্ত্রণা। সংখ্যাগুরুদের স্রেফ ‘ষাঁড়’ উপাধি দিয়ে এই বেদনার কতটুকু নিরাকরণ সম্ভব? আপনার লেখায় এই তথ্য পেয়ে অবাক হলাম যে, পাকিস্তানেও এই ব্যাপারটির একটি আইনি ভিত্তি আছে, অবশ্য নিরাপত্তা তাতে কতটুকু নিশ্চিত হয়, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। কারণ, “সাত ডিগ্রি এক দখল”। আর বাংলাদেশে যেখানে আজও অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাই নিশ্চিত করা যায় নি, সেখানে এটা আর কী-ই বা এমন তাৎপর্য বহন করে?
    পরিশেষে একটা বিনীত প্রশ্ন। আশা করি বুঝবেন। আপনি বসবাস করেন পৃথিবীর রাজধানীর কাছাকাছি। সেখানে মানবাধিকার তো বটেই, পশুপাখিদের অধিকার নিয়েও গণমাধ্যম আর জনতা অনেক সচেতন ও সোচ্চার। কিন্তু, আমাদের দেশে যেখানে মুক্তবুদ্ধির কথা বলতে গেলেও ছদ্মনামও রক্ষার নিশ্চয়তা দেয় না বা ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর পরিচয়ও, সেখানে আপনার এতো শ্রম আর যুক্তিতর্ক কার স্বার্থে? সমকামীদের বেদনার নিরসনের চাইতে কি অনেক বেশি প্রয়োজনীয় নয় অন্য অনেক ব্যাপার নিয়ে সচেতনতা জাগানো, যা আপনার এবং সমমনা অনেকের লেখায় তীব্রভাবে উঠে আসতে দেখি? ব্লগ, আপনি জানেন, বড় সংকীর্ণ এক মাধ্যম। পৌঁছায় খুব কম লোকেদেরই কাছে, বিশ্বাস বদলায় আরো কম জনের। কিন্তু, আপনার বইটি অনেকের হাতেই পৌঁছায়। তাই, ‘প্রিন্টেড মিডিয়া’-র আরেকটু শক্তিশালী সহায়তা কি অন্য অনেক ‘টপ প্রায়োরিটি’ ব্যাপারে ব্যবহার করা যেতো না? আমি মানছি, অ্যাকাডেমিক্যালি আলোচনা এসব ব্যাপারে জরুরি। কিন্তু, কোনটি আগে রাখবো আলোচনার খাতে? বুঝছি যে, সহনশীলতার সংস্কৃতি নির্মাণে আপনার অবদান রাখার ইচ্ছের কথা। চাইছেন কিছু চলতি মিথ খারিজ করতে যার অনেকগুলো বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে সহিংসতাবিস্তারী এবং মানবাধিকারহারী। হয়তো ডকিন্সের ভাষায় একটা ‘conscious raiser’ তৈরি করারও বাসনা আপনার।
    কিন্তু, তারপরও, অভিজিৎ, সব বুঝে তারপরও, একটা প্রশ্ন মনে থাকছেই, থাকবেই।
    ধন্যবাদ আপনাকে অজস্র।

    • অভিজিৎ - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ)

      প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আপনার দীর্ঘ কিন্তু চমৎকার মন্তব্যের জন্য। আপনি আমার লেখা সম্বন্ধে এবং বই সম্বন্ধে যে প্রশংসা বাক্য বর্ষণ করেছেন তাতে যে কেউই খুশি হবে বলাই বাহুল্য। আমার আরো ভাল লেগেছে যে, আপনি শুধু প্রশংসাই করেননি সেই সাথে কিন্তু প্রশ্নও করেছেন, সামান্য হলেও বিপরীত কিছু মত দিয়েছেন। ভাল ভাল কথাগুলো নিয়ে গদ গদ চিত্তে তো আলোচনা করাই যায়, কিন্তু সেগুলোতে গিয়ে আত্মম্ভরিতা তৈরি করে বোধ হয় লাভ নেই। বরং আপনি যেগুলো বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন বা অন্যমত প্রকাশ করেছেন সেগুলোই আলোচনায় আনা যাক।

      শুরু করছি, আপনার শেষদিকে করা একটি উক্তিকে তুলে ধরে। আপনি লিখেছেন –

      আপনি বসবাস করেন পৃথিবীর রাজধানীর কাছাকাছি। সেখানে মানবাধিকার তো বটেই, পশুপাখিদের অধিকার নিয়েও গণমাধ্যম আর জনতা অনেক সচেতন ও সোচ্চার। কিন্তু, আমাদের দেশে যেখানে মুক্তবুদ্ধির কথা বলতে গেলেও ছদ্মনামও রক্ষার নিশ্চয়তা দেয় না বা ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর পরিচয়ও, সেখানে আপনার এতো শ্রম আর যুক্তিতর্ক কার স্বার্থে?

      আপনি আরো লিখেছেন,

      সমকামীদের বেদনার নিরসনের চাইতে কি অনেক বেশি প্রয়োজনীয় নয় অন্য অনেক ব্যাপার নিয়ে সচেতনতা জাগানো, যা আপনার এবং সমমনা অনেকের লেখায় তীব্রভাবে উঠে আসতে দেখি?

      প্রথম বাক্যটির উত্তরে কি বলব? প্রায় দুহাজার পাঁচশ বছর আগে এক গ্রীক দার্শনিক উচ্চারণ করেছিলেন – “I am not a citizen of Greece or Athens; I am a citizen of the world.” আমি কোন গ্রীসের দার্শনিক নই, নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু আমিও নিজেকে সাড়া বিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে দেখতেই পছন্দ করি, তা আমি যেখানেই বসবাস করি না কেন। সাড়া বিশ্বের চলমান ঘটনা, রাজনীতি, অর্থনীতি, নিপীড়ন, নির্যাতন ইত্যাদি আপনার কিংবা অন্য দশজনের মতো আমাকেও স্পর্শ করে। সেজন্যই বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করার ক্ষুদ্র ‘অপচেষ্টা’।
      এবার মূল প্রশ্নটায় আসি। আপনি বলেছেন, সমকামীদের বেদনার নিরসনের চাইতে কি অনেক বেশি প্রয়োজনীয় নয় অন্য অনেক ব্যাপার নিয়ে সচেতনতা জাগানো? আমার চোখে এই গুরুত্বের বিষয়টা একেবারেই আপেক্ষিক। আপনি যে ইস্যুগুলোকে ‘সমকামীদের বেদনার চেয়েও বেশী প্রয়োজনীয়’ বলে উল্লেখ করেছেন, সেগুলো নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন, অতীতেও করেছেন ভবিষ্যতেও করবেন। যারা এই ‘সমকামীদের বেদনার চেয়েও বেশী প্রয়োজনীয়’ ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করছেন তাদের প্রতি আমার সবসময়ই পূর্ণ সমর্থন থাকে এবং থাকবে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, সবসময়ই কেবল ‘চর্বিত চর্বন’ই করে যেতে হবে, নতুন কিছু যোগ করা যাবে না। আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছি যে, বিভিন্ন নিরপেক্ষ গবেষণায় আমাদের দেশে ৬ থেকে ১২ মিলিয়ন সমকামীর অস্তিত্বের কথা উঠে এসেছে । অথচ, তাদের অস্তিত্বই সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে অস্বীকৃত। আমি আমার বইয়ে দেখিয়েছি, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজ নারী অধিকার, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান কিংবা বড়জোর পাহাড়ি কিংবা আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আজ কিছুটা সচেতনতা দেখালেও তারা এখনো যৌনতার স্বাধীনতা কিংবা সমকামীদের অধিকার নিয়ে একদমই ভাবিত নয়। আমি জানি না, আপনি বিষয়টির কতটুকু গভীরে ঢুকে চিন্তা করেছেন, কিংবা আপনি সত্যই স্রেফ ‘পশুপাখিদের অধিকার নিয়ে সচেতনতা’কে সমকামী অধিকারের সমার্থক মনে করছেন কিনা আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তবে আমার কাছে বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। খোদ ইরানেই ১৯৭৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪০০০ ব্যক্তিকে সমকামিতার অযুহাতে হত্যা করে হয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনা সাড়া বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলো। ইরানে বছর কয়েক আগে (২০০৫ সালে) দুজন কিশোরকে সমকামিতার অপরাধে ফাঁসি দেয়া হয় তারপর সেই লাশ শহরের সাড়া রাস্তায় ট্রাকে করে ঘোরানো হয়। উইকিতে এ সংক্তান্ত খবর আছে এখানে। নীচে ছবি দেয়া হল –

      ইরানে সমকামিদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন

      এবং

      ইরানে সমকামিদের ফাঁসী

      তালিবান নিয়ন্ত্রিত সময়কার আফগানিস্তানে ১৯৯৮ সালে কান্দাহারে তিনজন পুরুষকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে হত্যা করা হয়। তাদের অপরাধ ছিলো সমকামিতা । ২০০৯ সালে ইরাকে গুপ্ত হত্যায় সাত মাসে বিরাশিজন সমকামী প্রাণ হারায় । সমকামিতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন নৃশংসতার ঘটনা মরোক্কো, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সুদান, বাংলাদেশ সহ প্রায় প্রতিটি মুসলিম প্রধান দেশে অহরহই ঘটছে। ইরাকে সমকামীদের এভাবে রাস্তায় পিটিয়ে মারা হয়েছ, এখনো হচ্ছে

      আর ইরাকে সমকামীদের এভাবে রাস্তায় পিটিয়ে মারার মর্মান্তুদ ছবি পাওয়া যাবে এখানে –
      ইরাকে সমকামিদের পিটিয়ে মারার দৃশ্য

      আমি ঠিক জানি না উপরের ছবিগুলো আপনার মনে কোন রেখাপাত করে কিনা, আমার যথেষ্টই করে। শুধু ভিন্ন যৌনপ্রবৃত্তি থাকার কারণেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সামাজিকভাবে সমকামীদের উপর যে লাগাতার অত্যাচার চলেছে তা আসলে রূপকথাকেও হার মানায়। আমার বইয়ে আমি এ ধরণের বহু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছি।

      এমনকি সমকামী মনোবৃত্তি থাকার কারনেই কিভাবে একটি ছেলেকে নিজের পরিবার থেকেই কিভাবে অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়, তার বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যাবে ২০০৯ সালে জনের লেখা এই চিঠিটি থেকে। আমি এই চিঠিটির বাংলা অনুবাদ আমার বইয়ে সন্নিবেশিত করেছি –

      প্রিয় বন্ধুরা,

      আশা করি তোমরা ভাল আছ, কিংবা অন্ততঃ ভাল থাকার অভিনয় করে যেতে পারছ। আমি জন, বাংলাদেশের ব্যাগ (বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর গে’স)-এর কো- মডারেটর। আমি সমকামী এবং এজন্য আমি গর্বিত। কিন্তু আমি মোটেই সুখি নই। কারণ আমার বাসার সবাই আমার সমকামী প্রবৃত্তির ব্যাপারটা জেনে গেছে। তারা প্রথমে এ ব্যাপারটিতে তেমন গা করেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের মুখোশ খুলে গেছে। আমি তোমাদের গ্রুপে বেশ অনেকদিন হল লিখতে পারছি না। কারণ আমাকে আমার পরিবার থেকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। আমি আহত হয়েছি। নিরূপায় হয়ে আমি একদিন পুলিশ স্টেশনে গেলাম। কিন্তু পুলিশ কোন কেস ফাইল করতে কিংবা জিডি করতে দেয়নি। আমাকে উলটো বলল -‘তুমি তো দেখছি একটু মেয়েলী ধরণের। ঠিক করে বল – তুমি কি কোতি ,ড্রাগসেবী নাকি বেশ্যা? আমরা তোমাকে কোন ফাইল-টইল কিংবা জিডি করতে দেব না।এগুলো তোমাদের মামুলী পারিবারিক ব্যাপার। এ সমস্ত ফালতু বিষয়াদি নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনা।’তারপর তারা আমার বাবাকে ফোন করে বলল আমাকে বাসায় (মানে নরকে) নিয়ে যেতে। বাসায় নিয়ে যাওয়ার পথেই আমার বাবা, মা বোন এমনকি আমার ছোটভাই পর্যন্ত আমাকে মারতে শুরু করে। আমি হয়তো মরেই যেতাম যদি না আমার পাশের বাসার এক বন্ধু এসে বাঁচাতো। এখন আমার অবস্থা একটু ভালর দিকে। তারা আমাকে এখন বলছে বাসা ছেড়ে চলে যেতে। আমাকে সাত দিন সময় দিয়েছে বাসা ছাড়ার। আমার পার্টনার এ দেশে থাকে না। সুতরাং সে এ ব্যাপারে একেবারেই নিরূপায়। এখন আমাকে তোমরা বল – সমকামী মানে কি সুখি নাকি অসুখি? তোমাদের মধ্যে কি কেউ বলতে পারে, কবে এই গৃহস্থালীর অত্যাচার আর নিপীড়ন বন্ধ হবে? কখন আমরা সোনার বাংলা আর গে-বাংলা পাব, বলতো? বন্ধুরা, আমাদের অনেক পথ যেতে হবে। আমাদের যাত্রা কিন্তু শেষ হয়নি বরং কেবল শুরু, এবং আমরা এখনো আমাদের গন্তব্য কোথায় তা জানি না। বন্ধুরা তোমরা নিজেদের যত্ন নিও, আর ভাল থাকার অভিনয় করে যেও এমনকি তোমার নিজের পরিবার, সমাজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্র দ্বারা নির্যাতিত হবার শেষ সময়গুলোতেও। এখন যাই। তোমাদের পিঙ্ক স্যালুট,

      সলিডারিটি
      জন, কোমডারেটর।

      এ নিয়ে অশোক দেব লিখেছেন এলজিবিটি বাংলাদেশ ফোরামে

      আমি নিশ্চিত আপনিও এ ধরনের বহু ঘটনার সাথেই পরিচিত। এছাড়া পাশাপাশি আছে আত্মহননের ঘটনা। আমার বইয়ে আমাদের স্কুলে ছোটবেলায় একটা ছেলে পড়তো আমাদের সাথে সে রকম একজন ছেলের কথা লিখেছি। পরে ক্যাডেট কলেজে চলে যায়। তার ঘনিষ্ট বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতাম ছেলেটি নাকি সমকামী মনোভাবাপন্ন। এর কিছুদিন পরেই মাসুদের আত্মহত্যার খবর পাই। আমি ছেলেবেলায় যে এলাকাতে বড় হয়েছি, সেখানে একটি ছেলে ছিলো, আমার চেয়ে দু চার বছরের বড়। ছেলেটিকে এলাকায় ‘একটু মেয়েলী’ বলে খোঁটা দেয়া হতো। ছেলেটি ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সাথে থাকতে এবং তাদের সাথে খেলাধূলা করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি ছেলেটি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। আমরা চক্ষু মুদে থেকে এগুলো ঘটনাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করি না কেন, এগুলো কিন্তু ঘটছেই। আপনি বা অন্যান্যরা না হয় অনেক বেশি প্রয়োজনীয় নয় অন্য অনেক ব্যাপার নিয়ে লিখুন, কিন্তু এই মর্মা্ন্তিক ঘটনাগুলো যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে কেবল ঢাকাই পড়ে না থাকে, সেজন্যই আমার এবারকার ছোট প্রচেষ্টা (এর বাইরেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা করে, ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে কিংবা কানসাটের কৃষকবিদ্রোহ ফোকাস করে বহু লেখাই আমি আগে লিখেছি, সার্চ করলেই তা পাবেন)।

      পুরো বইটা যেহেতু পড়া নেই, তাই এর (সমকামিতার) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কতটুকু আলোচনা করেছেন, তা জানা নেই। বিষয়টি আদিকাল থেকেই কিছুটা প্রচলিত থাকাটা নেহাৎ অস্বাভাবিক নয়। একটা উদাহরণ দেই। ভারতীয় পুরাণের একটি চরিত্রের জন্মই হয় দুই নারীর সঙ্গমে, শিবের আশীর্বাদে, এবং তাঁর নামেই ব্যাপারটি স্বপ্রকাশ। তিনি পৃথিবীতে গঙ্গা আনয়নের মতো মহদাশয় কাজ করেছিলেন বলে কিম্বদন্তী। তিনি ভগীরথ। ভগে ভগে তাঁর জন্ম হয়েছিলো বলেই এই নাম। কাজেই, ব্যাপারটি একেবারে অগ্রাহ্য ছিলো না তৎকালেও। মনে হয় না, তাঁর মায়েদের কেউ ‘সমকামী’ হিসেবে ক্রুদ্ধ আক্রমণ করেছিলো।

      হ্যা শুধু ভাগীরথ নয়, আমি আমাদের প্রাচীন সাহিত্য এবং পুরাণ ঘেটে এ ধরণের অজস্র উদাহরণ সামনে নিয়ে এসেছি। আমি প্রাচীন গ্রীসে Paiderastia র উদাহরণ হাজির করেছি, হাজির করেছি এরাস্তেস এবং এরোমেনোস -এর সম্পর্ক, বিশ্লেষণ করেছি হোমারে বর্ণিত আকিলিস এবং পেট্রোক্লুসের সম্পর্ক, প্লেটোর দার্শনিক গ্রন্থ সিম্পোজিয়ামে (Symposium) ফায়াডেরাস (Phaedrus), পসানিয়াস (Pausanias), এগাথন (Agathon), অ্যারিস্টোফেনেস (Aristophanes), এরিক্সিমাচুসের (Eryximachus) নানা বক্তব্য, সক্রেটিসের সাথে আলকিবিয়াডসের প্লেটোনিক সম্পর্ক। এসেছে স্যাপোর কথা। বলা হয়েছে রোমান সভ্যতার সময় সমকামিতা, এমনকি চোইনিক সভ্যতায় তংঝি কিংবা রেনেঁসার সময় দোনাতেল্লো, বত্তিচেল্লী, লিওনার্দো এবং মাইকেলেঞ্জেলোর সমকাম প্রীতির নানা উপকরণ।
      তবে যে জিনিসটি আমি স্পষ্ট করতে চেয়েছি বইয়ে তা হল, সমকামিতা কি কেবল পশ্চিমা বিশ্বের বিকৃতি ছিলো না। সমকামিতার ইতিহাস আসলে অনেক পুরনো। প্রাচীন গ্রীসের ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণে সমকামীতার স্পৃহার কথা জানা যায়। ধর্মীয়ভাবে সমপ্রেম এখানে স্বীকৃত ছিল। ‘ভেনাস’ ছিলেন তাদের কামনার দেবী। এই দেবীই আবার সমকামীদের উপাস্য ছিলেন। এছাড়া ‘প্রিয়াপ্রাস’ নামেও আরেক দেবীকেও সমকামীরা আরাধনা করত বলে শোনা যায়। তাহিতির বিভিন্ন জায়গায় সমকামে আসক্ত ব্যক্তিদের আরাধ্য দেবতার মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। আনাতেলিয়া, গ্রীস এবং রোমার বিভিন্ন মন্দিরে ‘সিবিলি’ এবং ‘ডাইওনীসস’ এর পুজো ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল। সিবিলির পুরোহিতেরা গাল্লি নামে পরিচিত ছিলেন। এরা নারীবেশ ধারণ করতেন। মাথায় নারীর মত দীর্ঘ কেশ রাখতে পছন্দ করতেন। এরা সমকামী ছিলেন বলেও অনুমিত হয়। পরে এশিয়া মাইনর থেকে সিবিলি পুজো পারস্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। পারস্য সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে এ সমস্ত প্রথা পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। পারস্য সাহিত্যে অনেক কবি তাদের প্রেমিকাকে পুরুষ নামে ডাকতেন –তবে এটি সম্ভবতঃ অঞ্চল ভিত্তিক কোন প্রথা। আরব সমাজে বয়ষ্ক পুরুষ এবং বালকের মধ্যে যৌন সম্পর্ক গ্রহনযোগ্য তো বটেই মধ্যযুগে (ইসলামের বিস্তৃতির সময়) বহুল প্রচলিতও ছিল। সাকী বলতে এখন আমাদের চোখের সামনে সুরাপাত্র হাতে যে মোহনীয় লাস্যময়ী নারীর ছবি ভেসে উঠে, প্রাচীন আরবে সাকী বলতে তা বোঝানো হত না। গবেষকরা বলেন, সাকী বলতে আরবে নারীর পাশাপাশি সুদর্শন কিশোরও বোঝানো হত। তারা শুধু পানপাত্রে দ্রাক্ষারসই পরিবেশন করতো না, পাশাপাশি অন্যান্য পার্থিব সেবাও পরিবেশন করতো। এর উল্লেখ পাওয়া যায় আরবের বহু সমকামী কবিদের রচনায় । এমনকি কোরানের কিছু আয়াতে বেহেস্তে উদ্ভিন্নযৌবনা হুরীর পাশাপাশি ‘মুক্তা-সদৃশ’ কিশোর বালকের সেবা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আসলে সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই সমকামিতা সবসময়ই মানব সমাজে ছিল। গ্রীক, রোমান, চৈনিক, পাপুয়া নিউ গিনি অথবা উত্তর আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতায় সমকামীতার অজস্র উদাহরণ আছে। সমকামিতা ছিল অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতায়। হিন্দু পুরানেও উল্লেখ পাওয়া যায় পুরুষীনি অথবা তৃতীয় প্রকৃতির। আপনি ভাগীরথের উদাহরণ দিয়েছেন। সগরবংশীয় অংশুমানের পুত্র মহারাজা দিলীপ নিঃসন্তান হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জন্ম রক্ষায় সমস্যা দেখা দেয়। শিব সে সময় আবির্ভূত হয়ে রাজার দু-জন বিধবা স্ত্রীকে আদেশ করেন সন্তান লাভের জন্য পরষ্পর দেহমিলন করতে। তাদের মিলনে সন্তান জন্মায় বটে কিন্তু সে সন্তান ছিল অস্থিহীন। পরে ঋষি অষ্টাবক্রের বরে সেই সন্তান সুস্থ এবং উত্তমাঙ্গ হন এবং ভগীরথ নামে রাজ্যশাসন করেন। আরো কিছু উদাহরণ দেই, আপনার ভাবনার খোরাক যোগাবে। রাম ও সুগ্রীভ তাঁদের বন্ধুত্বকে সুগভীর করার উদ্দেশ্যে অগ্নি প্রদক্ষিণ করে সাত চক্কর দিয়েছিলেন। নর-নারীর ‘শারীরিক’ মিলন ছাড়াও সন্তান জন্ম নেওয়ার উপকথার সন্ধান মিলে রামায়ন এবং মহাভারতের মত বৈদিক সাহিত্যগুলোতে। এসব কাহিনীতে বর্ণিত বিভিন্ন চরিত্রের জন্মের ক্ষেত্রে কখনও সখনো সমকামিতারও আভাস মেলে, আবার কখনও একেবারেই প্রকৃতি নির্ভর; যেমন, সীতার জন্ম মাটি থেকে আর দ্রৌপদীর জন্ম যজ্ঞের অগ্নি থেকে। জরাসন্ধের জন্ম হয় দু-জন পৃথক নারীর গর্ভে জন্ম নেয়া অর্ধ অংগবিশিষ্ট পৃথক সন্তানের সংমিশ্রণে। ইন্দ্র এবং স্কন্ধের মধ্যে যুদ্ধের সময় ইন্দ্রের বজ্রাঘাতে স্কন্ধের দক্ষিন পার্শ্ব হতে জন্ম হয় বিশাখের। কার্তিকের জন্ম হয় শিবের পুরুষরস অগ্নি পান করার ফলে। অয়াপ্পানের জন্ম হয় শিব ও বিষ্ণুর মিলনে। গণেশের জন্ম হয় আবার জন্মস্থলির বাইরে । দ্রোন কিংবা কৃপ-কৃপী কারো জন্মই স্ত্রী পুরুষের ‘স্বাভাবিক’ মিলনে হয়নি। বালখিল্য মুনিদের জন্ম হয়েছিলো ব্রহ্মার লোম থেক

      • ব্লাডি সিভিলিয়ান - ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:১৬ অপরাহ্ণ)

        ধন্যবাদ, অভিজিৎ।
        আমার মন্তব্যের উত্তরে আপনার বিশাল তথ্যের ভারে আমার মুখ বন্ধ! তাই, মুখবন্ধ ছাড়াই বলি সবিনয়ে, আমি শুধু প্রাধিকারের কথাটা একটু আনতে চেয়েছিলাম। ব্যাপারটা হচ্ছে কি, আমাদের পূর্বতন কবিরা যেমন বলে গেছেন, “হাতের সামনের বদ্ধ মুষ্টি দূরের হিমালয়ও ঢেকে দেয়”।
        আমি নেহাৎ ছা-পোষা মানুষ। নুন আর পান্তা সবসময় খেতে হয় না। কিন্তু, আমি যেগুলো আসলেই সামগ্রিকভাবে বৃহৎ দৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে করি, সেগুলোর প্রতি জোর বেশি দেয়া উচিত বলে মনে করি, এ-ই আর কি। ‘চর্বিতচর্বন’-এর মাধ্যমে ওসব ক্ষতিকর দিকের চর্বি ঝরানোই মূল লক্ষ্য বলে মনে করি। সমকামিতা এবং আরো অনেক ব্যাপারের (যেমন: সাম্প্রদায়িকতা) মূলে থাকে সহনশীলতার অভাব। হেলেন কেলার বলেছিলেন, “শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো সহনশীলতা”। সেই শিক্ষার এবং সেই সহনশীলতার জন্যেই আমার মূল আকাঙ্ক্ষা। কারণ, আমার মতে সমকামিতা এবং এরকম আরোকিছুর বিরোধিতার গোড়ায় আছে অজ্ঞতা এবং সহ্যশক্তির অভাব।
        সরাসরি আমি কখনো মাঠে নামি নি এবং ২০০১-এর পরে আপনারা যখন অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে সরাসরি জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন, তখন বেদনাবিষে আচ্ছন্ন হয়ে দেখেছি কিভাবে নিষ্প্রতিমা পূজামণ্ডপ অদ্ভুত সুররিয়ারিস্টিক চালচিত্র তৈরি করে। তারও আগে ১৯৯১-এও সরাসরিই অনেকটা শিকার হয়েছি সাম্প্রদায়িকতার। আর, আজও নষ্ট রাজনীতি, নগ্ন ও প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতা, সনদধারী জ্ঞানহীন শিক্ষার বড়াই আর আত্মম্ভরিতার চর্চা থেকে দূরে থাকতে চাই, আর খুব সামান্য লড়াই করে যাই অন্যভাবে। নতুন প্রজন্মের কাছে অসহনশীলতার চর্চা দূর করার আহ্বান জানিয়ে। কারণ, মনে করি, জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে ‘প্রচুরতম লোকের প্রভূততম সুখসাধন’ করতে গেলে জ্ঞান, বিবেক এবং সহনশীলতা জরুরি। আপনারা যখন কাণ্ড বেয়ে, পাতার পর ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন বা অন্যকে তা দেখানোর চেষ্টা করছেন, তখনও আমি মূলেই।
        সারাদিন কাজ করে এরপরও হৃদয়ের টানে যে লেখালেখি করছেন মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, মুক্তজ্ঞান বিকাশে, জানি তা কত কষ্টকর, আর বুঝি তা সমাজের জন্যে কত প্রয়োজনীয়।
        তাই, আমার মতো ক্ষুদ্রমতির কথা উপেক্ষা করবেন; শুধু সম্ভব হলে মনে রাখবেন যে, আমি শুধু বেশিরভাগ মানুষের যেদিকে ভালো হতে পারে বলে মনে করি, তার কথাটাই তুলতে চাইছিলাম। সব তো আর একদিনে হবে না।
        শুভেচ্ছা। আশা করি এই ব্লগে আপনাকে নিয়মিত পাবো। আর দেশে এলে যদি কখনো আমার শহরে আসেন তাহলে আমার ক্ষুদ্র গৃহকোণে আপনাকে সপরিবার অগ্রিম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম।

        • অভিজিৎ - ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৯:৩১ অপরাহ্ণ)

          ব্লাডি শিভিলিয়ান,
          আপনার মন্তব্যের জন্য আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এবারে নিজেকে সংকুচিতই লাগছে। আসলে ‘বিশাল তথ্যের ভারে মুখ বন্ধ’ করার কোন অভিপ্রায় আমার ছিলো না। আসলে বিগত কয়েক বছর ধরে আমি এই ইস্যুটি নিয়ে ক্রমাগত ভাবছি, লেখালিখি করছি। তাই নিজের অজান্তেই হর হর করে অনেক কথা বলে ফেলি। আপনাকে উত্তর দেয়ার পরে বুঝেছি – এত কিছু আসলে না লিখলেও চলতো। 🙂

          আপনার সাথে আলোচনা করতে আসলেই খুব ভাল লেগেছে। সত্যই – আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজনীয় ইস্যুগুলো নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। আমরা সবাই মিলে কাজ করলে আমি তো মনে করি অনেক ইস্যুই খুব সহজ হয়ে যাওয়ার কথা। সাম্প্রদায়িকতা, দারিদ্র, শিক্ষা প্রভৃতির পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের বিচারও একটা ভাল প্ল্যাটফর্মের দিকে যাচ্ছে – এটাতে আশাবাদী হতে মন চায়। ওয়ার ক্রাইম্‌স স্ট্র্যাটেজিক ফোরাম সংক্রান্ত পোস্টে আমার সক্রিয় অংশগ্রহনের কথাও জানিয়েছি। দেখেছেন নিশ্চয়। কাজেই, এই সমকামিতা নিয়ে লিখেছি বলে অন্য ইস্যু গুলো নিয়ে যে কাজ করতে পারবো না তা ত নয়। ব্যাপারগুলো মিচুয়ালি এক্সক্লুসিভ তো আর নয়।

          দেশ থেকে দিন কয়েক আগেই ঘুরে আসলাম। আগে জানলে সত্যই আপনার ‘ ক্ষুদ্র গৃহকোণে’ যেতাম। জানিনা আপনি দেশের কোন শহরে থাকেন, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চয় দুয়ার বন্ধ করে দিচ্ছেন না। দেখা হবেই। আর সপরিবার অগ্রিম আমন্ত্রণ জানাওর জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
          আর আপনিও এই বারাক রাজার দেশের দিকে কখনো আসার পরিকল্পণা করলে আওয়াজ দেবেন। যথাসাধ্য করবো।

          • অভিজিৎ - ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৯:৩৪ অপরাহ্ণ)

            অত্যন্ত দুঃখিত – নামের বানানটা কোন ফাঁকে তালেব্য শ লিখলাম খেয়াল করি নি। এখন তো দেখতেই বাজে লাগছে। সিভিলিয়ান হবে, শিভিলিয়ান নয়।

  9. অভিজিৎ - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:৩১ অপরাহ্ণ)

    আমার প্রকাশক (আহমেদুর রশীদ) এইমাত্র ফোনে জানালেন যে, বইটা আজকেই (এইমাত্র) বেরিয়েছে এবং শুদ্ধস্বরের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে।

    যারা বইটির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

  10. বিপ্লব রহমান - ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৯:২৮ অপরাহ্ণ)

    আমি দীর্ঘ দিন ধরেই অভিজিৎ-এর বিজ্ঞান সর্ম্পকিত নানান লেখার একনিষ্ঠ পাঠক। বিজ্ঞানের কঠিন সব বিষয় খুব সুন্দর করে সহজ ভাষায় উপস্থাপনা করতে পারায় লেখকের তুলনা মেলা ভার। একই সঙ্গে তিনি সাধারণ পাঠকের মনে যেসব প্রশ্ন আসতে পারে বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে সব প্রশ্ন প্রচলিত আছে, তা-ও ধারালো যুক্তিতে উপস্থাপন করেন, ব্যাখা দেন, এমন কি ছিন্ন করেন এ সংক্রান্ত অজ্ঞতা ও কুসংস্কার।

    লেখকের কাছে আমার সবিশেষ ঋণ এই শেষোক্ত কারণেই। এ দিক থেকে সমকামিতা বিষয়ক লেখাটিও ব্যতিক্রম নয়। সমকামিতা বিষয়ক নিজস্ব কৌতুহল ও নানা প্রশ্নের জবাবও মিলেছে এ লেখায়।

    ‘শুদ্ধস্বর’ থেকে বই প্রকাশের আগাম খবর পেয়েছিলাম প্রকাশকের কাছ থেকে। এ জন্য লেখককে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

    খুব খারাপ লাগলো মন্তব্যের ঘরে লেখকের দেয়া ছবি ও তথ্যগুলো পড়ে। অজ্ঞতা মানুষকে কত নীচে নামিয়ে দেয়, আর বরাবরই শরিয়ত এসে দাঁড়ায় অজ্ঞতার ধর্মতলায়!

    এমন কি জনের লেখা চিঠি বা এর অংশ-বিশেষ

    বন্ধুরা, আমাদের অনেক পথ যেতে হবে। আমাদের যাত্রা কিন্তু শেষ হয়নি বরং কেবল শুরু, এবং আমরা এখনো আমাদের গন্তব্য কোথায় তা জানি না। বন্ধুরা তোমরা নিজেদের যত্ন নিও, আর ভাল থাকার অভিনয় করে যেও এমনকি তোমার নিজের পরিবার, সমাজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্র দ্বারা নির্যাতিত হবার শেষ সময়গুলোতেও। এখন যাই। তোমাদের পিঙ্ক স্যালুট…

    সমকামীদের বেদনাটুকু কিছুই হয়তো প্রকাশ করে না, তবু খানিকটা ধারণা দেয় মাত্র।

    ‘মুক্তাঙ্গন’এ নিয়মিত লেখার বিনীত অনুরোধ। অনেক ধন্যবাদ।

    • অভিজিৎ - ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১০:৩২ পূর্বাহ্ণ)

      অনেক ধন্যবাদ বিপ্লব। আমার লেখাটি যে সমকামিতা বিষয়ক আপনার কৌতুহল ও প্রশ্নের কিছুটা হলেও জবাব দিতে পেরেছে, সেজন্য ভাল লেগেছে।

      মুক্তাঙ্গনে নিয়মিত লিখতে চেষ্টা করবো। অনুরোধ করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

  11. অভিজিৎ - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:৪৪ অপরাহ্ণ)

    দেশ থেকে আক্ষরিক অর্থেই অর্ধগোলার্ধ দূরে থাকার কারণে বইমেলার কোন আপডেটই সময়মত পাওয়া হয় না। এমনকি বই বেরুনোর পর বইয়ের চেহারা আমার নিজের পক্ষেও দেখা সম্ভব হয় না। এবারের বইটির ক্ষেত্রেও হলো তাই। আমার বই আমি এখনো দেখিনি 🙂
    তবে রণদীপমদার (রণদীপম বসু)’র কল্যাণে কিছু ছবি পাওয়া গেছে। এটা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো কিনা জানি না, তবে ছবিগুলো সুন্দর। আর সেগুলো দেখে একটু আবেগতাড়িতই হলাম।

    ছবিগুলো রাখা আছে এখানে এবং এখানে

    (পাঠকদের বিরিক্তির কারণ ঘটালে অগ্রিম ক্ষমা চাইছি)

    • রায়হান রশিদ - ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:২১ পূর্বাহ্ণ)

      ধন্যবাদ, আপডেটটুকুর জন্য। কৃতজ্ঞতা রণদীপম দা’র প্রতিও।
      বইটি হাতে পেতে ইচ্ছে করছে। কড়কড়ে কাগজে নতুন বই হাতে নেয়ার অনুভুতির সাথে আর কিছুরই বুঝি তুলনা চলে না। প্রচ্ছদ ভালো লেগেছে। বইটির কোন ই-বুক সংস্করণ প্রকাশের পরিকল্পনা আছে?

      • অভিজিৎ - ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৮:১১ পূর্বাহ্ণ)

        রায়হান,
        মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সত্যি কথাই বলেছেন – কড়কড়ে কাগজে নতুন বই হাতে নেয়ার অনুভুতির সাথে আর কিছুরই বুঝি তুলনা চলে না।
        না, এই মুহূর্তে ই-বুকের কথা চিন্তা না করলেও পরে এ নিয়ে একটা পরিকল্পনা আছে। দেখা যাক।
        বইটির প্রতি আগ্রহ প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ।

  12. মোহাম্মদ মুনিম - ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৯:৩৪ অপরাহ্ণ)

    আমি তখন বুয়েটে শেষ বর্ষে, আহসানউল্লাহ হলে থাকি। একদিন হলে চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করলাম, খোঁজ নিয়ে জানলাম হলের এক রুমে ‘হোমো’ ধরা পরেছে। হলের এক ছেলে আরেক ছেলেকে প্রেমপত্র লিখেছে, সেই প্রেমপত্র উদ্ধার হয়েছে, এবং কোন কোন ছাত্রের দাবী, তাদেরকে প্রেমরত অবস্থায় দেখা গেছে। এই যুগলকে হল থেকে অবিলম্বে বহিষ্কারের জন্য প্রভোস্ট স্যারের কাছে দাবী গেল। প্রভোস্ট স্যার বললেন হলের নীতিমালার কোথাও বলা নেই যে সমকামিতার কারণে ছাত্র বহিষ্কার করা যায়। তবে ছাত্রদের দাবীর মুখে কোন এক ছুতো ধরে তাদেরকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয় (অথবা তারাই হল ছেড়ে চলে যায়, আমার ঠিক মনে নেই)।
    এমন ঘটনা নিশ্চয় বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ঘটেছে এবং ঘটছে। সমকামিদের বাংলাদেশে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় না বটে, তবে প্রতি পদে পদে তারা ব্যাপক সামাজিক হেনস্তার শিকার হয়। যে দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া প্রকাশ্যে খুন করার চেয়ে বড় অপরাধ (প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের ভাষায়), সেই দেশে সমকামীতা খুব শীঘ্রই মেনে নেওয়া হবে, এই আশা করাটা বাড়াবাড়ি। তারপরও অভিজিৎ এই বিষয়ে বই লিখে সচেতনতা জাগিয়ে তোলার প্রক্রিয়াটি শুরু করেছেন, এ কারণে তাঁকে অভিনন্দন। আমরা দেশ হিসাবে দরিদ্র হতে পারি, সমকামিতার চেয়ে অন্যান্য অনেক বড় বড় ‘সমস্যা’ আমাদের থাকতে পারে, কিন্তু যারা সংখ্যালঘু (ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, sexual orientation যেভাবেই হোক না কেন), তাদের পূর্ণ অধিকার এবং অহঙ্কার নিয়ে বাঁচতে দিতে হবে।

    • অভিজিৎ - ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ)

      ধন্যবাদ মুনিম চমৎকার মন্তব্যের জন্য। খুব চমৎকার একটি কথা বলেছেন – যারা সংখ্যালঘু তাদের পূর্ণ অধিকার এবং অহঙ্কার নিয়ে বাঁচতে দিতে হবে। সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বই আমাদের সবার।

  13. Pingback: Samakamita: The first Bengali book analysing the issues of homosexuality « LGBTI Bangladesh

  14. নুর নবী দুলাল - ৯ সেপ্টেম্বর ২০১০ (৭:০১ পূর্বাহ্ণ)

    সমকামীতা সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষনধর্মী নিবন্ধটি আমি খুব ধৈর্যসহকারে পড়লাম। কিঞ্চিৎ আলোড়িত হলাম, নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করলাম। প্রবন্ধটি ও সমকামিতা সম্পর্কিত লেখকের প্রকাশিত বইটি অবশ্যই বাংলাদেশে প্রতিকুল পরিবেশে বসবাসরত সমকামীদের প্রতি সহমর্মিতা হিসাবে বিবেচিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। একজন মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে আমি বলতে পারি,লেখকের প্রবন্ধটি ও প্রকাশিত বইটি বাংলাদেশের সমকামী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির সমকামীধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মাইল ফলক হিসাবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে। লেখকের জন্য রইল শুভ কামনা।

  15. নাবিলা - ১০ অক্টোবর ২০১১ (৮:১১ অপরাহ্ণ)

    আমি স্থাপত্য শেষ বর্ষের ছাত্রী।আমার থিসিস হিসেবে হিজরাদের কীভাবে সমাজের মূলস্রোতের সাথে মিশানো যায় সেটা নিয়েছি।আমি মান্ডা তে গিয়েছিলাম ওদের সার্ভে করতে।ওখানে ওদের কেউ কেউ নাচ গান আর নাটকের সাথে জড়িত।কিন্তু তারপর ও তারা অসুখী।কেননা তারা তাদের বাসস্থান আর পরিবেশ নিয়ে খুশিনা।তার স্বাভাবিক মানুষের মত সম্মান চায়।এইক্ষেত্রে আরেক্টা ব্যপার হল ওদের অনেকেরি কোন জীবনসংগী নাই।তাই তার সারা জীবনে তার মত মানুষরাই তার সব।কাজেই আমি এখন খুজছি ওদের জন্য আসলেই বাসযোগ্য পরিবেশ কী হবে?শুধু সামাজিক স্বীকৃতি পেলে তো হবে না, কেননা সমাজের মানুষের মনে আর তাদের পরিবারেরমনে তাদের নিয়ে এই ঘৃণা আর জল্পণা আর কল্পনা এর অবসান হবে না।ঠিক সময়ে কাউন্সেলিং পেলে আজকে তারাও স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসত।রাস্তায় পুলিশের কাছে মার খেতো না।এখন আমি যা করছি তার নিজের যা প্রয়োজন সেরকম একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ এর কথা ভাবাতে সবাইকে, যেখানে আমি ডিজাইন করব ওদের অস্থায়ী বাসস্থান, কাউন্সেলিং ভবন, সামাজিক ভাব আদানপ্রদান করার কমন স্পেস।ওদের দ্বৈততা এখানে রুপকভাবে ফূটে উঠবে স্থাপত্য নকশায়!কেননা সবসময় নারী পুরুষ চিন্তা করে কাজ হয়, তাহলে ওদের জায়গা কোথায়?এখানে আমার চিন্তা আছে কীভাবে ওদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা যায়।সেইজন্য একটা ধারাবাহিক নিয়মের আওতায় ওদের আনা হবে, যেখানে প্রশিক্ষণ শেষে ওদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ওদের কাজের প্রর্দশণী গ্যলারি থাকবে।আর বাবা মা আর সমাজ যেন তাদের ফিরিয়ে নেয় এই জন্য দুপক্ষের নিয়মিত কাউন্সেলিং এবং দেখা সাক্ষাত আর অংশগ্রহণমূলক কাজের মাধ্যমে তা করা হবে স্বতস্ফুর্তভাবে!…এই সময় আপনার লেখা পড়ে আমার এই কাজের ব্যপারে মতামত জানতে আমি খুব আগ্রহী!যেহেতু ওদের নিয়ে আপনি সচেতন আমি মনে করি আপনার যেকোন দৃষ্টিকোন অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য।আমি ব্লগ লিখিনা, কাজেই মতামত আমাকে মেইল করে পাঠালে অনেক খুশি হব।মেইল ঠিকানা তো দিয়েই দিলাম!
    ধন্যবাদ আপনার লেখার জন্য!

  16. রেজাউল করিম সুমন - ৭ ডিসেম্বর ২০১১ (২:৩৫ পূর্বাহ্ণ)

    মার্কিন বিদ্যালয়ের জনৈকা সংগীত-শিক্ষয়িত্রীর এই কাণ্ডকে কী বলা যাবে? রক্ষণশীল সমাজ-মনস্তত্ত্বের প্রকাশ?

    Michigan’s Cherry Knoll Elementary School Under Fire For Removing ‘Gay’ From ‘Deck The Halls’

    A Michigan music teacher’s decision to censor the word “gay” from a traditional Christmas carol is being met with a frosty response.

    The teacher, who has not yet been named in any of the published reports, allegedly removed “gay” from “Deck The Halls” after 1st and 2nd grade students kept giggling during preparations for a Christmas concert at Cherry Knoll Elementary School in Traverse City. Instead of the traditional lyric, the students were taught to sing “don we now our bright apparel,” according to UpNorthLive.com.

    The school’s Facebook page has since been inundated with reactions from infuriated parents and fellow educators. “By taking the word ‘gay’ out of ‘Deck The Halls’ you are making it a big deal, one word can have different meanings,” wrote one user. “Your personal opinions should not reflect what you teach other people’s children. Please teach the children the classic song the way it was written.” Another added: “Essentially, this teacher has now taught the elementary school children, including children as young as five, that gay means homosexual sex.”

    One user even incorporated a clever parody of the song’s 19th century lyrics: “See the crazy school before us/Fa la la la la, la la la la/Prejudice with a thesaurus.”

    The story also caught the eye of famed sex columnist Dan Savage, who noted, “Someone had to straighten out that carol—can’t have children donning gay apparel.”

    As television station WPBN has reported, however, Principal Chris Parker has said he is disappointed in the music teacher’s decision to change the lyrics to the song, and the students are, in fact, now back to singing the original version.

  17. সবুজ পাহাড়ের রাজা - ৭ অক্টোবর ২০১২ (১:২১ পূর্বাহ্ণ)

    সমোয়পোযোগী লেখা।

  18. মাসুদ করিম - ১১ ডিসেম্বর ২০১৩ (১১:১৬ পূর্বাহ্ণ)

  19. মাসুদ করিম - ২০ ডিসেম্বর ২০১৩ (১২:৩২ অপরাহ্ণ)

  20. মাসুদ করিম - ২৭ জুন ২০১৫ (১১:০৪ পূর্বাহ্ণ)

    One giant step from the US Supreme Court, towards even greater leaps for mankind, for human rights and human dignity….

    Posted by Rayhan Rashid on Friday, June 26, 2015

    একদিন আমার পৃথিবীও নিশ্চয়ই এতোটা এগোবে। অভিজিৎদাকে খুব মনে পড়ছে। এমন একটা দিনের জন্যই আপনি লিখতেন। আর এদিকে চার মাস পেরিয়ে গেল। এখনো চার মাস আগের সেই দিনে আটকে আছি আমরা সবাই।

    • মাসুদ করিম - ২৭ জুন ২০১৫ (১:০৬ অপরাহ্ণ)

Reply to অভিজিৎ

Cancel reply
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.