মহাশ্বেতা দেবীর চলে যাওয়ার সংবাদে কেন জানি প্রথমেই মনে হলো, ‘হাজার চুরাশির মা’-এর কথা... আবার পরক্ষণেই খালেদ চৌধুরীর আঁকা ওই বইয়ের প্রচ্ছদটি কেমন এক জলস্রোতে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল নবারুণের মুখ। [. . .]

মহাশ্বেতা দেবীর চলে যাওয়ার সংবাদে কেন জানি প্রথমেই মনে হলো ‘হাজার চুরাশির মা’-এর কথা... আবার পরক্ষণেই খালেদ চৌধুরীর আঁকা ওই বইয়ের প্রচ্ছদটি কেমন এক জলস্রোতে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল নবারুণের মুখ। নবারুণের মৃত্যুর পর কলকাতার কোনও এক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি, ‘আমাকে দুনিয়া হয়তো একজন নিষ্ঠুর মা হিসেবেই দেখবে।’ নিষ্ঠুরই কি? যাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ‘হাজার চুরাশির মা’ হিসেবে, তাঁকে কেন এই পৃথিবী দেখতে যাবে নিষ্ঠুর মা হিসেবে? নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এই ছোট্ট উপন্যাস আমাদের কেবল যে ওই আন্দোলনকেই নতুন করে চিনিয়েছিল, কেবল যে ওই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষগুলোর পরিবার-পরিজন আর কাছের মানুষের প্রতিপক্ষ-সময়কে অনুভব করিয়েছিল, তা তো নয় – আমরা মহাশ্বেতা দেবীকেও চিনেছিলাম নতুন করে। ইনি সেই মহাশ্বেতা নন যিনি কেবল আদিবাসীদের সঙ্গে নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ গেঁথে নিয়েছেন। ইনি সেই মানুষ – যিনি তাঁর সমসময়ের তারুণ্যের দীর্ঘ যাত্রা আর প্রলম্বিত রক্তপাতকেও নিজের কপালের টিপ করে তুলেছেন। তাই সেই দেবী যখন কোনও এক সময় লেখেন, ‘হাজার চুরাশির মা’র ‘ব্রতীর শৈশবচিত্র তো আমার ছেলে নবারুণেরই শৈশবচিত্র’ – তখন এই কথা থেকে উপন্যাসটি সম্পর্কেও চিন্তার নতুন দিগন্ত খুলে যায়। নবারুণও বিখ্যাত হয়েছিলেন, মার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল আন্তরিক, কিন্তু তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল আগেই। দুই বছর আগে এই জুলাই মাসেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। মহাশ্বেতাও চলে গেলেন প্রায় একই সময়ে। ঢাকাতে জন্ম – এই অর্থে ঢাকার মেয়ে তাঁকে আমরা বলতেই পারি। কিন্তু তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের – কেবল বাঙালির নন, কেবল ভারতের নন, সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন না – ‘যেথায় থাকে দীনের অধম, দীনের থেকে দীন, সেইখানেতে চরণ তোমার রাজে...।’ মহাশ্বেতার চরণ গিয়ে পৌঁছেছিল শবরের ঘরে, সাঁওতালের ঘরে – বঞ্চিত লাঞ্ছিত সকল আদিবাসীর ঘরে। এ বিশাল ভারতবর্ষের সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সঙ্গে চলতে চলতে তিনি বাঙালিত্বের যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে গেছেন, বাঙালিত্বের মনুষ্যত্ববোধকে যে পর্যায়ে উন্নীত করে গেছেন – তা হয়তো জাতিত্ববোধের ভারে ন্যুব্জ আমরা সারা জীবনেও বুঝতে পারব না। ‘ঝাঁসীর রাণী’ লিখতে গিয়ে নিজের জীবনের গতিপথও পাল্টে ফেলেছিলেন। ছোট্ট ছেলেকে বাবার কাছে রেখে সেই যে ঝাঁসী-গোয়ালিয়রে গিয়েছিলেন, তার পর ফিরলেও ঘর আর তাকে পারেনি বেঁধে রাখতে। ‘অরণ্যের অধিকার’-এর ভূমিকার কথা মনে পড়ছে;…

ওয়ালীউল্লাহ ‘অমীমাংসিত’ পর্ব ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন; সত্যি কথা বলতে গেলে, তিনি তো মীমাংসার পরিধিতে দাঁড়িয়েই লিখতে পেরেছিলেন ওই গল্প। [. . .]

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের স্মৃতিচারণায় পাই, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প তিনিই ছাপেন। মাসিক সওগাতে ১৩৪৮ সনের পৌষে (নভেম্বর–ডিসেম্বর, ১৯৪২) প্রথম প্রকাশ পায় সেই গল্প। অনেক বছর ওই ধারণাই ছিল আমাদের, ‘চিরন্তন পৃথিবী’ নামের সেই গল্পই তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প। কিন্তু তার পর উদঘাটিত হয়, এর আগেও গল্প লিখেছেন তিনি; ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়ার সময় থেকেই সাহিত্যচর্চায় জড়িয়ে পড়েন তিনি, ১৯৩৯ সালের কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশ পায় তাঁর গল্প ‘সীমাহীন এক নিমেষ’। লেখাই বাহুল্য, প্রধানত ‘লালসালু’ উপন্যাসের কারণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দেয় এবং তা ক্রমশই বাড়তে থাকে – এমন নয় যে, গবেষকদের কারণে পাঠকের কাছে নতুন করে উদ্ভাসন ঘটেছে ওয়ালীউল্লাহর। বরং পাঠকদের উৎসাহই বোধকরি গবেষকদের অনুপ্রাণিত করেছে তাঁর কর্মযজ্ঞকে নতুন করে খুঁজে দেখতে। এইভাবে গত কয়েক দশকে গবেষক ও পাঠকদের সম্মিলিত অনুসন্ধিৎসার মধ্য দিয়ে ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য এসেছে আমাদের সামনে। এসেছে তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নতুন নতুন লেখাও। কোনো কোনো একই লেখার দুই-তিন সংস্করণ আমাদের গবেষক ও লেখকদের তাঁর রচনাকৌশল ও রচনাশৈলী সম্পর্কে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। এমনকি তাঁর একটি

গল্প ‘না কান্দে বুবু’কে আবদুল মান্নান সৈয়দ যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তাতে আমাদের মধ্যে এমন চিন্তাও জন্ম নেয়, ষাটের দশকে পশ্চিম বাংলায় যে শাস্ত্রবিরোধী গল্প-আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল, সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, বলরাম বসাক, শেখর বসু, কল্যাণ সেন প্রমুখ ছিলেন যে স্রোতধারার লেখক, সেই আন্দোলনের ভিত্তিভূমি তৈরি করে গেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। শব্দ ও বাক্যের আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তি, স্বগতকথন, আঞ্চলিক সংলাপ ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে ‘না কান্দে বুবু’ গল্প এগিয়ে গেছে; লেখার এই ভঙ্গিটিকে লক্ষ করে আবদুল মান্নান সৈয়দ মন্তব্য করেছিলেন, ষাটের দশকের শাস্ত্রবিরোধী গল্পকাররাও ‘শব্দের ও বাক্যের অবিরল আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে’ নতুন একটি কাঠামো দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। অবশ্য শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের ওপর ওয়ালীউল্লাহর এই প্রভাব কতটুকু পরিব্যাপ্ত হয়েছিল কিংবা ওয়ালীউল্লাহ নিজেই বা তাঁর গল্পসমূহে শব্দের ও বাক্যের অবিরল আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তিকে কতটুকু ধারণ করেছেন, তা নিয়ে এখনও কোনও কাজ হয়নি। তাই আমাদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছানো। তবে এটি বলার জন্যে বোধকরি এই পর্যবেক্ষণটুকুই যথেষ্ট যে, পূর্ব বাংলায় কথাসাহিত্যে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্ম ওয়ালীউল্লাহর হাতে। তাই কালপ্রবাহে নিজের সময়কে তিনি কীভাবে দেখতেন, সমসাময়িক লেখায়…

জ্ঞানচর্চার স্পৃহা কখনও কখনও ‘অপরাধ’ হয়ে ওঠে। প্রচল রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে ওই ব্যক্তি শত্রু হয়ে ওঠে, যে কিনা কেবলই প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়ায়, কেবলই যুক্তি দিয়ে বুঝতে চায় সব কিছুকে। [. . .]

১ জ্ঞানচর্চার স্পৃহা কখনও কখনও ‘অপরাধ’ হয়ে ওঠে। প্রচল রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে ওই ব্যক্তি শত্রু হয়ে ওঠে, যে কিনা কেবলই প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়ায়, কেবলই যুক্তি দিয়ে বুঝতে চায় সব কিছুকে। অথচ ব্যক্তির সেই স্পৃহা হয়ত জেগে ওঠে অন্তর্গত নিষ্পাপ বিহ্বলতা থেকে। জাগতে পারে অসহায় বিস্ময় ও ক্রন্দন থেকে। যেমন জেগেছিল আরজ আলী মাতুব্বরের ভেতর। সে ঘটনা সকলেরই জানা। ‘মাকে আমি আর কোনওদিনই দেখতে পাব না! মিশে যাবেন তিনি মৃত্তিকার ভেতর!’ হয়ত এমনই এক প্রতিকারহীন কষ্ট থেকে মাতুব্বর ১৩৩৯ সনে তাঁর মৃত মার ছবি তুলেছিলেন এক আলোকচিত্রীকে নিয়ে এসে। কিন্তু তাতে বেঁকে বসে সমাজের কর্তাব্যক্তিরা। কারণ ছবি তোলা তো ধর্মে নিষেধ। তার ওপর নারীর – মৃত নারীর! তাঁর মার জানাজা আর দাফন করেনি তারা। কয়েকজন নিকটাত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ী নিয়ে মায়ের শবদেহের সৎকার করেন তিনি। বাল্যকাল থেকেই সত্যের অনুসন্ধানে একাগ্র মাতুব্বরকে সমাজপতিদের সংস্কার, যুক্তি ও বুদ্ধিহীনতা অস্থির করে তোলে। এ ঘটনায় হৃদয়-মনন জুড়ে যে আলোড়ন ওঠে, তাই তাঁকে নিয়ে যায় নিরাসক্ত জ্ঞানচর্চার দিকে। এরপর তাঁকে আর ফেরানো যায়নি সে-পথ থেকে। দীর্ঘ ১৮ বছর জ্ঞানসাধনার পর তিনি তাঁর সত্যানুসন্ধান নিয়ে মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। সে কথা জেনে ১৩৫৮ সনের ১২ জ্যৈষ্ঠ বরিশাল শহরের তদানীন্তন ল-ম্যাজিস্ট্রেট ও তবলিগ জামাতের আমির এফ. করিম তাঁকে জামাতভুক্ত করার জন্যে সদলে তাঁর বাড়িতে তসফির নেন। মাতুব্বর তাঁকে বলেন ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান এই তিন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়ের চিন্তা করতে গিয়ে তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি সেগুলোর উত্তর খুঁজছেন। তবলিগ জামাতের আমির যদি তাঁকে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, তা হলে তিনি জামাতে শরীক হবেন। এফ. করিম তাঁর কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। তবে প্রশ্নগুলোর লিখিত তালিকা নিয়ে যাওয়ার সময় বলেন, ‘কিছুদিন পরেই এর উত্তর পাবেন।’ কয়েকদিন পর তিনি ‘কম্যুনিজমের অপরাধে একটি ফৌজদারি মামলার ওয়ারেন্ট’ পেলেও আর উত্তর পাননি। কারাগারে যেতে হয় তাঁকে। কিন্তু সেখানে আটকে রাখা যায়নি তাঁকে। আদালতে তিনি যে জবানবন্দি দেন তার শিরোনাম ছিল ‘সত্যের সন্ধানে’। আদালত তাঁকে মুক্তি দিলেও নির্দেশ দেন, ‘সত্যের সন্ধানে’ কখনও প্রকাশ করতে পারবেন না তিনি। মাতুব্বর তাঁর সে গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন স্বাধীন বাংলাদেশে, ২২…

আলেক্সিস সিপ্রাসকে গ্রিসের মানুষ বেছে নিয়েছিলেন বোধ হয় এ কারণে যে, তিনি একজন বামপন্থী। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, ২০০৮ সাল থেকে ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রিসে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, একজন বামপন্থীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারই পারবে তা সামাল দিতে [....]

আলেক্সিস সিপ্রাসকে গ্রিসের মানুষ বেছে নিয়েছিলেন বোধ হয় এ কারণে যে, তিনি একজন বামপন্থী। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, ২০০৮ সাল থেকে ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রিসে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, একজন বামপন্থীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারই পারবে তা সামাল দিতে। এরই ধারাবাহিকতায় জুনের শেষ সপ্তাহে সিপ্রাস যে গণভোটের ডাক দিয়েছিলেন, তাতেও গ্রিসের জনগণ ভোট দিয়েছিলেন ত্রৈকা তথা ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর না করার পক্ষে। জোসেফ স্টিগলিজ ও পল ক্রুগম্যানের মতো অর্থনীতিবিদরাও গ্রিসের নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁদের নিজস্ব মুদ্রা দ্রাখমা আবারো চালু করে সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে গ্রিসের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলতে। কিন্তু সেসব করতে গেলে ইউরোর পিছুটান ঝেড়ে ফেলতে হতো গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাসকে, যা করার সাহস ছিল না তাঁর। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে তাই তৃতীয়বারের মতো গ্রিসকে তার ঋণসংকট থেকে উদ্ধার করার নামে আরো ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে ইউরোজোন। ইউরো ব্যবহারকারী ১৯টি রাষ্ট্রের জয় হয়েছে, জয় হয়েছে গ্রিসের অস্বাভাবিক ধনীদের। ব্রাসেলসে এমন একটি চুক্তি হয়েছে, যা সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯১৯ সালের কথা—ভার্সাইয়ের কথা। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর পুরো ইউরোপ তাদের বাধ্য করেছিল ভার্সাই চুক্তি করতে। যার ফলে পরবর্তী সময়ে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ব্রাসেলস চুক্তি যদি সত্যিই বাস্তবায়ন হয়, তা হলে অবশ্যম্ভাবীভাবেই গভীর এক সংকটের দিকে ইউরোপ এগিয়ে যাবে। দ্য গার্ডিয়ানে একজন মন্তব্য করেছেন, ভার্সাইয়ের ওই চুক্তির চেয়েও অবমাননাকর নতুন এই চুক্তি। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান এ চুক্তিকে অভিহিত করেছেন ‘প্রতিহিংসাপরায়ণ’ হিসেবে। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও এই চুক্তি হওয়ার মাস দেড়েক আগে নিউ স্টেটসম্যানে গ্রিসের অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রসাধনায় কোনো লাভ হবে কি না, তা নিয়ে নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে তিনি বিরোধিতা করেছেন চাপিয়ে দেওয়া এই কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচির। প্রসঙ্গত, তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ১৯১৯ সালের ৫ জুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জকে উদ্দেশ করে লর্ড ম্যানিয়ার্ড কেইন্সের একটি উদ্ধৃতি, যার মাধ্যমে অর্থনীতিবিদ কেইন্স নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন প্রথম মহাযুদ্ধের পরে সম্পাদিত ভার্সাই শান্তিচুক্তির দৃশ্যপট থেকে। কেননা কেইন্সের মতে, কৃচ্ছ্রসাধনার মধ্য দিয়ে এ ধরনের সংকটের সমাধান করা যায় না; বরং তা আরো ঘনীভূত হয়। পরে তিনি এ প্রসঙ্গে একটি…

...কথা ইশারা এক বিষণ্ণ শক্তি হয়ে আমাদের ইন্ধন জোগায় প্রসন্ন হতে, সামনের দিকে এগোতে। মামুন হুসাইনের এ-গ্রন্থ আমাদের তাড়িত করে অতীতকে নতুন করে দেখতে, নতুন উপনিবেশের মুখোমুখি হতে, জিজ্ঞাসু হতে। যে-মুখ আমরা লুকিয়ে রেখেছি আমাদের থেকে, সে-মুখের উদ্ভাসে যেন হঠাৎ করেই শিমুল তুলোর বাউরি ওড়ে। উড়তে উড়তে রোদ পিঠে করে, পাঁচ আঙুলে চোখ বাঁচিয়ে আরো হাঁটতে ডাক দেয় আমাদের।

স্পর্শের জালে বিভোর হয়ে মুখবই দেখতে দেখতে বই হারিয়ে যাওয়ার উল্লাস তুলতে তুলতে সবাই যখন নিজেরাই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য গহিন এক উপনিবেশে, মামুন হুসাইন তখন নিজেকে ফিরে দেখছেন কথা ইশারায়; নিজেকে, - কিংবা অতীতজাড়িত বিপন্ন ভবিষ্যতের দিকে ইঁদুরদৌড়ে ছুটে চলা আমাদেরও। কথা ইশারা তাঁর নিজের কথায়, ‘তাদেরই টিপসই এবং জলছাপ’ ‘বিবিধ উদ্বিগ্নতা এড়ানোর জন্যে যেসব মানুষের সঙ্গে দল বেঁধে’ একদিন হেঁটেছেন তিনি। অসমাপ্ত অবয়ব নিয়ে তারা দেখা দেয় আমাদের কাছে, কিন্তু তাদের সামগ্রিকতা ধরা পড়ে আমাদের কান্নার শক্তির মুঠোতে, স্বপ্নভঙ্গের বেদনাতে, যে-পথের শেষ জানা নেই অথচ যে-পথে যেতেই হয় সে-পথের প্রতিটি পদক্ষেপে। অনেক আগে ঈশ্বরের কাছে কাঁদবার শক্তি না হারাতে প্রার্থনারত এক ঋজুমানবও ডাক দিয়েছিলেন কথা ইশারায়। ‘পুরাতন হয় নতুন পুনরায়’ - তাই আমরা আবারো কথা ইশারার হাতছানি পাই। পাই ‘নিজস্বতা’ প্রমাণ করার যে উন্মাদনা চলছে অথবা চলছে ‘নিজেকে প্রতিস্থাপন করার যে ইঁদুর-দৌড়’ তার ভয়ংকর কথাচিত্র। এর ফাঁকফোকর গলেই আবার উঁকি দেয় মামুন হুসাইনের মামুন হুসাইন হয়ে ওঠার আয়োজন, যা তাঁর অন্য কোনো গ্রন্থের পাঠ থেকে পাওয়া কখনো সম্ভব নয়। নিজের কথাই লিখেছেন বটে মামুন, খুঁজেছেন তাঁর বিবিধ পদচিহ্ন; নিজের নিরীহ সাদামাটা জন্মবৃত্তান্তের খানিকটা ডিমেন্টিক হতে থাকা মায়ের দাদির কাছে শুনতে শুনতে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন পাখিহীনতার কষ্টে আচ্ছন্ন শিশুপুত্রের। তবু ব্যক্তিগত গদ্য হয়েও তা ব্যক্তিগত নয়। শেষ পর্যন্ত কথা ইশারা সমকালের যৌথ কোরাস, উত্তর-অন্বেষা। যে-শনাক্তকরণ চিহ্ন তিনি তুলে ধরেন, শুরুর যে-পাঁচালি বয়ন করেন, কিংবা সমসময়ের মানুষের সঙ্গে চলতে চলতে নিরুপায় বাজার-সদাইয়ে শামিল হন, সেসবের সবকিছুতেই ঘটতে থাকে সামাজিক সংখ্যালঘুত্বের ব্যক্তিক উদ্ভাস। একটু একটু করে সময়কে চিনতে থাকি আমরা, চিনতে থাকি মামুনকেও, যিনি শেষ পর্যন্ত ভাবতে শুরু করেন, ‘এখন মনে হয়, লেখায় আধুনিকতার চেয়ে ট্র্যাডিশন আবিষ্কার করাই বড় সমস্যা!’ মামুনের লিখনশৈলীর আধুনিকতায় যাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেন, গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকেন, সংগুপ্ত ঈর্ষাও বয়ে বেড়ান, তাঁরা এবার নতুন করে ভাবতে পারেন, ট্র্যাডিশনের অন্বেষণ কত গভীর হলে আধুনিকতারও বাক বদলায়। দুর্বলচিত্তের মানুষ হিসেবে নিজেকে গ্রন্থিত করতে থাকলেও একটি প্রস্ত্ততিপর্বের আখ্যানও পেতে থাকি আমরা। সেই প্রস্ত্ততিপর্বে থাকে আলাদা হওয়ার নয়, বরং মেলানোর প্রস্ত্ততি, ‘সহস্র বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ’ নেওয়ার প্রস্ত্ততি। খাতায় তিনি লিখে…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.