২৯ অক্টোবর ২০১০, চটগ্রামে অনুষ্ঠিত 'কর্নেল তাহের স্মারক বক্তৃতা' হিসেবে এই প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কর্নেল তাহের এর অনুজ ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন। মুক্তাঙ্গন এর পাঠকদের জন্য বক্তৃতাটি পাঁচ পর্বে ভাগ করে উপস্থাপন করা হল।

[২৯ অক্টোবর ২০১০, চটগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘কর্নেল তাহের স্মারক বক্তৃতা’ হিসেবে এই প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কর্নেল তাহের এর অনুজ ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন। মুক্তাঙ্গন এর পাঠকদের জন্য বক্তৃতাটি পাঁচ পর্বে ভাগ করে উপস্থাপন করা হল]

১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব

*** *** ***

“আমি একটি সোনার বাংলার চিত্র দেখেছি। এই চিত্র কল্পনায় কেটেছে বহু বিনিদ্র রাত্রি। এই চিত্র আমাকে রোমাঞ্চিত করেছে, উত্তেজিত করেছে। এই কল্পনায় বার বার মনে হয়েছে জনগণের সঙ্গে একাত্ব হয়ে আমি এক অসীম শক্তির অধিকারী। সমস্ত জীর্ণতাকে ভেঙ্গে ফেলে এই চিত্রকে রূপ দিতে সক্ষম। এ চিত্র আমাকে সাহস যুগিয়েছে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে আমি জনগণের সাথে একাত্ব হয়েছি। বাংলার মানুষের নিবিড় সংস্পর্শে এসে আমি দেখেছি তাদের উদ্যম, কষ্ট সহিষ্ণুতা ও দেশপ্রেম। আমি বুঝেছি বাংলার এই শিক্ষাবঞ্চিত, প্রতারিত জনগণই হচ্ছে প্রকৃত প্রগতিশীল। তারাই বাংলার সুপ্ত শক্তি। বাংলার এই জনগণকে আমি আমার চিত্র কল্পনায় অংশীদার করতে চাই। আমি চাই তারা গভীরভাবে এই চিত্র উপলব্ধি করুক। রোমাঞ্চিত হোক, উত্তেজিত হোক। তাদের শক্তির পূর্ণ প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের যাদুঘরে বন্দী ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’ সোনার বাংলাকে মুক্ত করুক”

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে’ নামের একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম উপরের কথাগুলো লিখেন। ভূমিকায় বলা কথাগুলোর পর তাহের তাঁর চিত্রের সোনার বাংলার একটি ছবি উপস্থাপন করেছিলেন প্রবন্ধে। তাঁর আঁকা চিত্রের মূল উপজীব্য নদী ও মানুষ। সোনার বাংলার রূপ-কল্পটি তিনি শেষ করেছেন এই বলে, “নদীর বাঁধের উপর গড়ে ওঠা বাংলার এ জনপদ একটি নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী। সুশৃঙ্খল এই জনপদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রেরণা দেয় সমগ্র পৃথিবীকে”। আমরা দেখবো, বাংলাকে স্বাধীন করে সোনার বাংলায় রূপ দিতে তাহের তাঁর কিশোর বয়স থেকে স্বপ্ন দেখেছেন। তা লালন করেছেন, স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে গেছেন।

‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়’ – এই আকুতি, বেদনা এবং তা থেকে সঞ্জাত ক্ষোভ, প্রতিজ্ঞা ও স্থীর সংকল্প স্কুল জীবন থেকেই তাহেরকে আলোড়িত করেছে। এ প্রসঙ্গে মায়ের কাছ থেকে শোনা ১৯৫২ সালের একটি ঘটনার কথা বলি: আমাদের পিতা তখন চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। তাহের পড়েন হাট হাজারির ফতেহাবাদ স্কুলে। সে’টি ছিল বৃটিশ ভারতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সাথে যুক্ত বিপ্লবীদের অধ্যয়ন স্কুল। ১৯৫২ এর ২১ ফেবরুয়ারী ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ছাত্ররা বীরোচিত আত্মদান করেছেন। ভাষা আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তে। পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য মন্ত্রী মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিন রেলযোগে ষোলশহর অতিক্রম করছেন। তাহের-এর বয়স তখন তের পেরিয়েছে মাত্র। নুরুল আমিনের রেল কামরা লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়েছিল কিশোর তাহের। পরাধীন মাতৃভূমিতে শাসকবর্গের প্রতি তাহেরের প্রথম প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদের চেতনা আরও শানিত হয়েছে তাহেরের পরবর্তী শিক্ষা জীবনে – কুমিল্লার ইউসুফ হাইস্কুলে, যেখান থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং পরে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে। ইউসুফ স্কুলে পড়ার সময়ই তাহের প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সরাসরি সংস্পর্শে এলেন। কলেজে এসে তা পল্লবিত হলো। সেখানে তাঁর বন্ধু ও অনুসারী মোহাম্মদ হোসেন-এর কাছ থেকে শোনা গল্প, “কলেজে তাহের ছিলেন আমাদের নেতা ও নায়ক। তখনই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলতেন। বলতেন ভবিষ্যত সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা, তার জন্য প্রস্তুতির কথা, সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধবিদ্যা শেখার কথা”। এমসি কলেজে বিএ পরীক্ষা দেয়ার পর পর চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাই থানার অধীন দূর্গাপুর হাইস্কুলে তাহের শিক্ষকতা করেন কিছুদিন। সেখানে সংস্পর্শে আসেন ব্রিটিশ বিরোধী অগ্নিযুগের বিপ্লবী, মাষ্টারদা সূর্যসেনের প্রত্যক্ষ সহযোগী একজন শিক্ষকের। ইতোমধ্যে বিএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটে। ভাষা আন্দোলন, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক চেতনার আঁধার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহ তাহেরের স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ভূমিকাই পালন করেছে।

আমরা দেখি এ সময় ১৯৬০ সালে তাহের পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে। বেছে নিয়েছেন পদাতিক বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলিট কমান্ডো বাহিনী স্পেশাল সার্ভিস গ্র“প-এ জায়গা করে নিয়েছেন এর জন্মলগ্নেই। মনে তার স্বাধীনতার স্বপ্ন। গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে জনগণকে নিয়ে, তাই কমান্ডো বাহিনীতে তাঁর এই পরিকল্পিত যোগদান। বেশ কয়েকবছর পর একই বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন অপর বাঙ্গালি আনোয়ার হোসেন। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘হেল কমান্ডো’ নামে তাঁর লেখা পুস্তকে মেজর আনোয়ার তাহের সম্পর্কে লিখেন, সেই ১৯৬৭ সালের কথা, প্রথম পরিচয়ের কথা আজও মনে পড়ে আনোয়ারের। “তুমি কি বাঙ্গালি কমান্ডো”? তাহের প্রশ্ন করেন। কিছু কথার পর তাহের দৃঢ়কণ্ঠে বলেন “কমান্ডোতে যোগ দিয়েছ দেখে আমি বেশ খুশী হয়েছি। কিন্তু মনে রেখো দেশ স্বাধীন করতে হবে”। বাংলায় কথা হচ্ছিল। অবাক আনোয়ার বলে “স্যার পাকিস্তান তো একট স্বাধীন দেশ, তবে কোন দেশ আমাদের স্বাধীন করতে হবে”? তাহেরের প্রচণ্ড ধমক “গোল্লায় যাক পাকিস্তান। মনে রেখো তুমি একজন বাঙ্গালি। এখন বুঝতে পারছো, কোন দেশ স্বাধীন করতে হবে”? এরপর মেজর আনোয়ার লিখেছেন “সেই ১৯৬৭ সালে বাঙ্গালি রাজনৈতিক নেতাদের মুখেও স্বাধীনতার কথা শোনা যায়নি। অথচ সৈনিক হয়ে তাহের এ কথাটি বলেছিলেন”

এখানেই পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিল সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ অফিসার এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে ধারণ করা একজন অফিসার-এর মধ্যে। ১৯৬০ থেকে পরবর্তী দশ বছরে পূর্ববাংলায় ছাত্র-জনতার চেতনায় বড় পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করে কারাবরণ করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর এবং তাঁর সহযোগী অনেকের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। অভিযুক্তদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ছাড়াও আছেন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ। ১৯৬৯-এ সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ছাত্র-জনতার দুর্বার গণ-অভ্যূত্থান। শাসকবর্গ বাধ্য হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে। আয়ুব খানের পতন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মার্শাল-ল, ক্ষমতা গ্রহণ ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা এসেছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭০-এর নির্বাচন।

পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ম্যান্ডেট লাভের আহ্বান জানিয়ে ছয় দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছেন। গোটা বাঙ্গালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাঁর ডাকে। নিরঙ্কুুশ বিজয় অর্জিত হয়েছে নির্বাচনে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকুরীরত তাহেরের চেতনা ও কর্মে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে এ সময়ে। মেজর আনোয়ার-এর পুস্তকে ১৯৬৭ সালে মেজর তাহেরের মনোভাব আমরা জেনেছি। আরও একটি ঘটনার কথা বলি। একই বছর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছি। সে বছরই শীতে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করতে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে আমরা প্রায় ১৫ জন লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টেকনাফ অঞ্চলে ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলার জন্য গমন করি। আমাদের আরও উদ্দেশ্য ছিল বার্মায় সশস্ত্র বিপ্লবে রত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। আমরা তা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তারপরও আমাদের বিপ্লবী উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বেশ কয়েক মাস পর আমরা ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। ১৯৬৭ সালে আমাদের এই বিপ্লবী তৎপরতা গ্রহণকালে তাহের ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৬৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে চট্রগ্রাম সেনানিবাসে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের কাজে নেমে পড়াকে তাহের ভাই দোষের বলে তো মনেই করেন নি বরং পরবর্তী উদ্যোগে তাঁকে যেন আমরা যুক্ত রাখি সে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর কারণও ছিল। ছুটিতে যখনই তিনি বাড়িতে আসতেন, তখন আমাদের ভাই-বোনদের শিক্ষা দিতেন প্যারা কমান্ডো পিটি ও অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশল। কলেজে পড়বার সময় আমাকে পড়তে দিয়েছেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো এবং মাও সেতুং-এর সামরিক রচনাবলী।

১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন আমলে আমি দ্বিতীয় বারের মত লেখাপড়া ছেড়ে বান্দরবানের গহীন অরণ্যে আদিবাসী মুরংদের এলাকায় ঘাঁটি অঞ্চল গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করি। এবারে আমাদের উদ্যোগে সরাসরি যুক্ত হন তাহের। সিরাজ সিকদার-এর নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন-এর রাজনৈতিক থিসিস “পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং জাতীয় দ্বন্দই এখানে মূখ্য। তাই সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করতে হবে”- এর সাথে তাহের একমত হলেন। আমার উদ্যোগে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাশে সরকারি সায়েন্স ল্যাবোরেটরিতে কর্মরত ড. হুমায়ুন আব্দুল হাই-এর বাসায় তাহের ও সিরাজ সিকদারের মধ্যকার বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে একটি বিপ্লবী ধারা যা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য তখন একটি নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করছিল তার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের জানা ছিল না। রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে এই উভয় ধারাই যে একই লক্ষ্যে কাজ করছিল, পরবর্তী ঘটনাবলীতে তা জানা যায়।

১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের মধ্যেই তাহের ছুটি নিয়ে ঢাকায় কলাবাগানে আমাদের অপর ভাই আবু ইউসুফের বাসায় প্রতিদিন তিনটি ব্যাচে স্বাধীনতা প্রত্যাশি যুবকদের রাজনৈতিক-সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের কর্মসূচি শুরু করেন। বলা বাহুল্য এই কার্যক্রম ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ। প্রশিক্ষণার্থীদের সবাই তাহেরের অপরিচিত। যে-কোনোভাবেই গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হতে পারতো। সরকার জানতে পারলে একজন সেনা অফিসারের এ ধরনের বিপ্লবী রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার পরিণাম হতো ভয়াবহ।

আমাদের সে প্রশিক্ষণ কিন্তু বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। যৌথ নেতৃত্বের বদলে নিরঙ্কুুশ ব্যক্তি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা সিরাজ সিকদারের মধ্যে কাজ করলো। তিনি চীনা বিপ্লব দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। অথচ মাও সেতুং যেভাবে মার্শাল চুতে ও চৌ এন লাই-এর সঙ্গে কিংবা ভিয়েতনামে হো চি মিন যেভাবে জেনারেল গিয়াপের সঙ্গে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে কাজ করেছেন, সিরাজ সিকদার তা করতে ব্যর্থ হলেন। একমাসও অতিক্রম হয়নি, সিরাজ সিকদার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেন। তিনি এই হাস্যকর তত্ত্ব দিলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন পেটি বুর্জোয়া অফিসারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া নীতিগতভাবে ঠিক নয়। প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে গেল। সিরাজ সিকদারের সিদ্ধান্ত তাহেরকে অত্যন্ত— ব্যথিত করেছিল। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য আমাদের প্রস্তুতির এক পর্যায়ে তাহের পরিকল্পনা করেছিলেন তার অধীন বাঙ্গালি সেনাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করবেন। তাহেরের সে স্বপ্ন ফলবতী হলো না।

এর মধ্যে ১৯৬৯ পেরিয়ে ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ছয় দফায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ম্যান্ডেট চেয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আপামর বাঙ্গালি জাতি নিরঙ্কুুশ নির্বাচনী বিজয় এনে দিয়েছে তাঁকে। ১৯৭১-এর পয়লা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে বলে স্থীর হয়, বঙ্গবন্ধুর অনমনীয় দাবী ও দৃঢ়তার মুখে। কিন্তু শুরু হয় নানা যড়যন্ত্র। প্রবল আপত্তি আসে ভুট্টোর কাছ থেকে। শেষ পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণে অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙ্গালি ছাত্র-জনতা। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায় রচিত হওয়ার ক্ষণ উপস্থিত হয়। ছাত্রদের ১১ দফা বা আওয়ামী লীগের ৬ দফা আর নয়। জনতার কণ্ঠে তখন ১ দফা। বাংলার স্বাধীনতা। ‘বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ শ্লোগানে উত্তাল বাংলাদেশ। ছাত্রদের মধ্যে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের জোর তাগিদ তখন। এ সময় ১ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আমরা সূর্যসেন স্কোয়াড গড়ে তুলি। নামটি আমারই দেয়া। ১৫ সদস্যের প্রায় সকলে ছিল ছাত্রলীগের বিপ্লবী ধারার সদস্য। এই স্কোয়াডের অধিনায়ক মনোনীত করা হয় আমাকে। এর আগে ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে দেশকে স্বাধীন করার জন্য তাহেরের অনুপ্রেরণায় আমার লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টেকনাফ এবং রুমার গহীন অরণ্যে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা ছাত্রলীগে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানতো। তাহেরের দেয়া প্রশিক্ষণ আমরা কাজে লাগাই। ২ মার্চ রাত থেকে ফজলুল হক হলে তৈরি করা হয় মলোটভ ককটেল ও উচ্চশব্দ সৃষ্টিকারী বোমা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে প্রতিরাত্রে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে সূর্যসেন স্কোয়াডের বানানো বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ’টি করা হয় মুলতঃ জনগণকে এই বার্তা দিতে যে, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ প্রস্তুতিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য সূর্যসেন স্কোয়াডের সদস্যরা বাসে, ট্রেনে জনগণকে উদ্দেশ্য করে তাহেরের অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশলের নানা দিক বোধগম্য ভাষায় বক্তৃতা আকারে তুলে ধরত, যাতে তারা স্বউদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বান – ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবেলা করতে হবে’ – কার্যকর করতে পারে।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন কর্নেল তাহের পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা ইনফেন্ট্রি স্কুলে সিনিয়র ট্যাকটিক্যাল কোর্স করছিলেন। সে সময়ে তাঁর অনুভূতি আমরা জানতে পারি স্বাধীনতার অল্প দিন পরে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘এবোটাবাদ থেকে দেবী গড়’ প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, ‘‘২৬ মার্চ রেডিওতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতা শোনার পর আমি জানতে পারি বাংলাদেশে কী বিভীষিকা নেমে এসেছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও ও বিবিসির খরব শুনে বাংলাদেশের ঘটনাবলী আরও জানতে পারলাম। সারারাত কোয়েটার নির্জন রাস্তায় পাঁয়চারী করে কাটলো। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ব্যর্থ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যের আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা আমি দেখতে পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালাবার সংকল্প নিলাম”

তাহেরের সংকল্প ফলবতী হয়েছিল। পালাবার কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ জুলাই ১৯৭১ তারিখে মেজর তাহের (সে সময় তাহের ছিলেন মেজর), মেজর এম এ মঞ্জুর (পরে চট্টগ্রামের জি ও সি থাকাকালে ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়), মেজর জিয়াউদ্দিন (পরবর্তীতে লে. কর্নেল এবং ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার থাকাকালে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত), ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী (পরে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত) এবং একজন সিপাহীকে সাথে নিয়ে এবোটাবাদ ও শিয়ালকোট হয়ে ভারতের দেবীগড়ে পৌঁছান। ১৯৭১ -এ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণকালে তাহের কাজলার গ্রামের বাড়ীতে মাকে একটি চিঠি ডাকে পাঠান। চিঠিটি ‘একাত্তরের চিঠি’ বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঐ চিঠিতে নানা করণীয় সম্পর্কে তিনি ইঙ্গিতে লিখেন। তার কিছু অংশ, “গ্রামে যা আছে তা নিয়েই আপনাদের বাঁচতে হবে। আশা করি সে মতোই আপনারা ভেবে চলবেন। কবে পর্যন্ত যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে বলা যায় না। আজকাল অবশ্য আপনাদের বিশেষ কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মাছ পাওয়া যায়, ধান পাকা শুরু হয়েছে। এখন গ্রামে অনেকে এসেছে। ছোটদের পড়াশুনা কবে শুরু হবে লিখেছেন। গ্রামে এখন এত শিক্ষিত লোক। আপনার এক বৌ ইউনিভার্সিটি পড়া। স্কুল-কলেজ বাড়িতে শুরু করে দেন। খাওয়া দাওয়া ও পানির প্রতি খেয়াল রাখবেন। আজকাল তো আবার ডাক্তার পাওয়া মুশকিল হবে। আমাদের জন্য আপনারা ভাববেন না। ভেবে কী লাভ হবে। যখনই সম্ভব হবে আমি আপনাদের কাছে পৌঁছব। আপনারা সাহস হারাবেন না”

কেউ সাহস হারায়নি। তাহেরের স্বপ্নের অংশীদার হয়ে পরিবারের সকলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। ১৯৭১-এর ২৫ জুলাই তাহের শিয়ালকোট সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের দেবীগড় এবং ২৭ জুলাই দিল্লী ও আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে কোলকাতার মুুজিব নগরে পৌঁছান। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী তাঁকে বিভিন্ন সেক্টর পরিদর্শনের নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল গেরিলা যুদ্ধের একজন সমর বিশারদ হিসেবে মেজর তাহের যুদ্ধপরিকল্পনার খুঁত ও দুর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করে আরও সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল প্রণয়নে পরামর্শ দেবেন। প্রথমেই তিনি আসেন ময়মনসিংহ-এর উত্তর সীমান্তে। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ও রংপুরের রৌমারী নিয়ে বিস্তৃত বিশাল এলাকা জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের এই অঞ্চল তখন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বাধীন কোন সেক্টরের আওতায় ছিল না। ভারতীয় সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং-এর নেতৃত্বে এসব অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু যুদ্ধ তৎপরতা চলছিল। তাহেরের আবেদনে মুজিব নগর সরকার এ অঞ্চলকে নতুন ১১ নং সেক্টর হিসেবে নামকরণ করেন এবং তাহেরকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেন।

১৯৭৬ সালে ঢাকা কারাগারের অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত গোপন বিচার ট্রাইবুনালে তাহের তাঁর জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন,

“রণকৌশলগত দিক দিয়ে ঢাকা আক্রমণ করার জন্য এই সেক্টরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আমি ঘুরে ঘুরে গোটা সেক্টর পরিদর্শন করতে থাকলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আমি মিশে গেলাম; তাদের সাথে আমার চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করলাম। আমাদের যুদ্ধকৌশলের দুর্বলতাগুলো খুব সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল।

প্রথমত: আমরা গোটা জাতি এক জনযুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। অথচ আমাদের সামনে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ কখনো বিকশিত হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত: গেরিলা যুদ্ধের তাত্ত্বিক কাঠামো সম্বন্ধে সামরিক নেতৃত্বের কোন ধারণাই ছিল না। কর্নেল ওসমানী, মেজর জিয়া, মেজর খালেদ ও মেজর শফিউল্লাহর মতো অন্যান্য যারা নিয়মিত সামরিক বাহিনীর অফিসার তাদের মধ্যে এমন খুব কমই ছিলেন, যারা গেরিলা যুদ্ধ কিভাবে সংগঠন ও পরিচালনা করতে হয় সে সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। গেরিলা যুদ্ধের বিকাশের পথে বড় বাঁধা ছিল এইসব প্রচলিত অফিসার এবং তাদের প্রচলিত কায়দায় সামরিক চিন্তা-ভাবনা।

তৃতীয়ত: স্বাধীনতা যুদ্ধে সামরিক নেতাদের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য ও অফিসারদের কয়েকটি নিয়মিত ব্রিগেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠা মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাই প্রয়োজনীয় সামরিক নেতৃত্ব ও কলাকৌশল অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর নেতাদের মুক্তি সংগ্রাম সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় ধারণার বড় অভাব ছিল। তাদের একমাত্র চিন্তা ছিল কিভাবে একটা নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলে নিজেদের ক্ষমতার ভিত পাকাপোক্ত করা যায়। ঠিক এভাবেই বিকাশমান একটি জাতীয় গণযুদ্ধের গতি রুদ্ধ ও বিপথগামী করা হচ্ছিল। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তি সেনারা বীরের মতো লড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার মত কেউ ছিল না। বাইরে থেকে বাঁধা না আসলে হয়তো দেশের ভেতরেই স্বাভাবিকভাবে যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারতো। আগরতলা আর মেঘালয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ ও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যে দুই ব্রিগেড সুশিক্ষিত সৈন্য গড়ে উঠছিল তাদের যদি সঠিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত করা হতো, তাহলে সাত-আট মাসের মধ্যেই দেশের মাটিতে ক্ষেতমজুর-কৃষকদের নিয়ে বিশ ডিভিশনের এক বিশাল গেরিলা বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যেত। আমার কথা শুনে কর্নেল ওসমানী যথেষ্ট বিরক্তই হয়েছিলেন। তখন তাঁর কাজ কর্ম খুব সহজই ছিল। ঘুমানোর জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় এবং ভারতের অভ্যন্তরে সেক্টর সদরদপ্তরগুলো ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করার অবারিত সময়। আসলে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের নামে এক প্রহসন। গেরিলা যুদ্ধ ও নিয়মিত যুদ্ধের মধ্যে অনেক তফাৎ। কিন্তু কর্নেল ওসমানী কখনই তা বুঝতে চাননি। গেরিলা যুদ্ধের একদম শুরুতে নিয়মিত বাহিনী গঠনের চিন্তা একেবারে ঠিক হয়নি। ঠিক সময় এলে অর্থাৎ ঝটিকা আক্রমণ, চলমান গেরিলা যুদ্ধ এবং তারপর নিয়মিত যুদ্ধ – এই ধারাবাহিকতায় একটি গেরিলা বাহিনী নিজেই নিয়মিত বাহিনীতে পরিণত হয়।

চতুর্থত: বাংলাদেশের মাটিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাদের সিদ্দিকী, মেজর আফসার, খলিল, বাতেন ও মারফতের মত আরও অনেক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক বিশাল দল গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধরত শক্তিগুলোর এটাই ছিল স্বাভাবিক বিকাশ। দুর্ভাগ্যবশত কর্নেল ওসমানীর নিয়মিত সামরিক কমান্ড ও প্রবাসী সরকার এই স্বাভাবিক শক্তির বিকাশকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তার ফলে নিয়মিত বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়নি।

পঞ্চমত: ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর অশুভ প্রভাবে মুক্তিবাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্যের মাথায় ব্যক্তিগত লোভ লালসার চিন্তা ঢুকে যায়। এদের আদর্শগত ভিত্তি ছিল দুর্বল।

এসব সমস্যা সমাধানের পথ ছিল একটাই। তা হচ্ছে বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তাঞ্চলে প্রবাসী সরকারকে নিয়ে আসা। আমি সামরিক নেতৃত্বকে বোঝাতে চেষ্টা করি যেন ভারতীয় এলাকা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোথাও সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়”।

তাহেরের পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি। তরপরও তাহের তাঁর ১১ নং সেক্টরে আপন ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজ চালিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধে সকল সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল ভারতের অনেক ভিতরে। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতীয় অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং তাহেরকে সীমান্ত থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে তুরা শহরে ১১নং সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের পরামর্শ দেন। তাহের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কামালপুরে পাকিস্তানী শত্র“ ঘাঁটির আটশ গজের মধ্যে মহেন্দ্রগঞ্জে সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন করেন। ১৯৭৬-এ ঢাকা কারাগারে জবানবন্দীতে তিনি বলেন, “আমি ভালভাবেই জানতাম আমাকে সেই পথের উপর জোর দিতে হবে, যা আমাদের এনে দেবে চূড়ান্ত বিজয়। আর এই পথ হবে কামালপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল হয়ে শেষে ঢাকা। কামালপুর ছিল ঢাকার প্রবেশ দ্বার”

১১নং সেক্টরে তাহেরের নেতৃত্বে অবিস্মরণীয় বহু যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম চিলমারী রেইড ও কামালপুর শত্র“ঘাঁটির উপর আক্রমণ। ‘চিলমারী রেইড: যুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিস্ময়’ ও ‘কামালপুর অভিযান’ শীর্ষক দু’টো লেখায় তাহের সে ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেছেন। যার ছত্রেছত্রে উঠে এসেছে যুদ্ধে সাধারণ মানুষের অসাধারণ বীরত্ব গাঁথা। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি ‘চিলমারী রেইড’ কে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাহের সে আক্রমণ সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘‘এ ধরনের আক্রমণ শুধু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মিত্রবাহিনীর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের ঘটনার সাথে তুলনীয়। ঐ যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে কয়েক ডজন জেনারেল অংশগ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পারে চিলমারী বন্দর আক্রমণ বাংলার সোনার ছেলেদের নিয়ে গঠিত আমার সেক্টরের অনিয়মিত বাহিনী দ্বারা সংঘঠিত হয়েছিল”। ১১ নং সেক্টরে সেক্টর অধিনায়ক মেজর তাহের আমাকে মাহেন্দ্রগঞ্জের হেড কোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ করেন। ভাই হিসেবে নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সচেতন ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার সুবাদেই এই নিয়োগ। অপারেশন রুমে যুদ্ধ ম্যাপ সাজিয়ে রাখা, সর্বক্ষণ অধিনায়কের সাথে থাকা এবং রাতে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারের জন্য যুদ্ধের ‘সিচুয়েশন রিপোর্ট’ তৈরি করা – এই ছিল আমার কাজ। আরও একটি কাজ ছিল যুদ্ধকালে অধিনায়ক তাহেরের অস্ত্রটি (একটি চীনা এস এম জি) বহন করা।

মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শনে তাহেরের সাথে যাই। শুনি তার বক্তৃতা। দৃঢ় ও আবেগময় কণ্ঠে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে ভাষণ দিতেন। একজন সামরিক অধিনায়ক নয় তাঁকে মনে হতো একজন গণনেতা। বলছেন, কেন এ যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ? কাদের জন্য যুদ্ধ? বলতেন, এ যুদ্ধ প্রচলিত যুদ্ধ নয় – এ জনযুদ্ধ। এ জনযুদ্ধে জনগণই যে প্রধান শক্তি, প্রধান ভরসা, তাই থাকতো তার সকল বক্তৃতার মূল সুর। অস্ত্র নয়, সাধারণ মানুষের উপর নির্ভর করতে বলতেন তাঁর যোদ্ধাদের। বলতেন এ যুদ্ধ অস্ত্রের নয়, আদর্শের, সাহসের আর কৌশলের। বিভিন্ন ফ্রন্টের যুদ্ধের সাফল্যের সংবাদ বলতেন। তুলে ধরতেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের কথা। আহ্বান জানাতেন আরও বিরাট, আরও মহান আত্মত্যাগে এগিয়ে আসতে। তাঁর বক্তৃতা মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগে উদ্বেলিত করতো। এতো বক্তৃতা নয়, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। মনে হতো আর এক মুহুর্ত দেরী নয়, এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বো শত্র“র উপর। জীবন বিলিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কোন ভয়, সংশয়, দ্বিধা আর থাকতো না।

মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানে পাঠাবার আগে তাঁর চূড়ান্ত নির্দেশনাবলীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক থাকতো এ রকম: “আক্রমণ স্থলের চরপাশের সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে। তোমাদের বিপ্লবী আচরণ দ্বারা তাদের হৃদয় জয় করবে। শত্র“ সংবাদ জানবার ব্যাপারে তাদের তথ্যের উপর নির্ভর করবে। তাদের কাছ থেকে আক্রমণ পরিকল্পনা জানতে চাইবে। তারাই তোমাদের এমন নিখুঁত পরিকল্পনা বলে দেবে যা প্রচলিত সেনাবাহিনীর জেনারেলরাও উদ্ভাবন করতে পারবে না”

একদিন রাতে খবর এল জামালপুর জেলার হাতিভাঙ্গা এলাকার সবুজপুরে মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটির পতন হয়েছে। পাকিস্তানিরা নির্বিচার হত্যা চালাচ্ছে, ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দিচ্ছে। সারাদিন কয়েকটি সাব-সেক্টর ঘুরে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে তাহের মাত্র ফিরেছেন। কিন্তু এ খবর শোনার পর কোন বিশ্রাম না নিয়েই রাতের মধ্যে তিনি অভিযান দল ঠিক করে ফেললেন। শেষ রাতেই তাদের নিয়ে রওয়ানা হলেন। চীনা এস এম জি নিয়ে আমি চললাম সাথে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৩৫ মাইল পথ আমরা হেঁটে পাড়ি দিলাম। লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি এসে দলের প্রধান অংশকে একটি নদীর ধারে অবস্থান ঠিক করে দিয়ে, ছোট্ট একটি স্কাউট টিম নিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন। আশপাশের বাড়ী থেকে কয়েকজন চাষী এগিয়ে এল। তাদের কাছ থেকে তিনি জেনে নিলেন পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা নদীর ধারে যে স্কুল ঘরটিতে ক্যাম্প করেছিল, সেটাই পাকিস্তানিরা দখল করে নিয়েছে। গ্র্রামবাসীদের একজন আমাদের পথ দেখিয়ে সেদিকে নিয়ে চললো। জলমগ্ন ধান ক্ষেতের মধ্যদিয়ে ঘরবাড়ী ও ঝোপের আড়ালে আড়ালে আমাদের নিয়ে চললো সে। আমরা মাত্র ক’জন। এ লোকটি শত্র“চর তো নয়? আমাদের ফাঁদে ফেলবে না তো? এ ভাবনাগুলো আমায় পেয়ে বসলো। ইঙ্গিতে তা প্রকাশও করলাম। তিনি হেসে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন “মানুষকে চিনতে শেখ, বিশ্বাস করতে শেখ”। আমি লজ্জা পেলাম, আর ভয় ঝেড়ে ফেলার জন্য তাঁর এ কথাগুলোই ছিল যথেষ্ট। আমাদের চাষী গাইড শত্র“ অবস্থানের খুব কাছে আমাদের নিয়ে এল। চারদিকের ঘরবাড়ীতে তখনও আগুন জ্বলছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা লুটের মাল নিয়ে লঞ্চে উঠছে। নদীর ধারে যে অবস্থানে তাহের মুক্তিযোদ্ধাদের রেখে এসেছেন, সেই পথেই লঞ্চটি ফিরে যাবে। এত কাছে শত্র“ সৈন্যদের দেখে আমাদের হাত নিশপিশ করছিল, কিন্তু আমাদের গুলি করতে বারণ করলেন তিনি। লঞ্চটি কিছুদূর এগিয়ে গেলে পেছন থেকে গুলি করবো আমরা। লঞ্চ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং ফাঁদে পড়বে। লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার পর পরই চারদিক থেকে দু’একজন গ্রামের লোক বেরিয়ে আসতে লাগলেন। তাদের মধ্যে এক বৃদ্ধ আমাদের কাছেই এক বাঁশ বাগানে নিয়ে এলেন। সেখানে আবর্জনা ও বাঁশপাতা সরিয়ে কয়েক বাক্স গ্রেনেড ও গুলি তিনি বের করলেন। পাকিস্তানী আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা এগুলো ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে যাতে এগুলো না পড়ে সেজন্য এই বৃদ্ধ তা বাঁশ ঝাড়ের আবর্জনার নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। অধিনায়ক তাহের আমাদের বললেন: “আমি এজন্যই বলি সাধারণ মানুষের উপর নির্ভর করো। তোমাদের প্রতি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সহযোগিতা গড়ে উঠছে। তোমাদের আদর্শ আচরণ দিয়ে তাকে সক্রিয় সহযোগিতায় পরিণত কর। যুগে যুগে অস্ত্রধারীরা সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করেছে, আধিপত্য করেছে। তাই অস্ত্রধারীদের মানুষ ভয় পায়, বিশ্বাস করতে চায়না। তাদের বিশ্বাস অর্জন কর। তারা যেন মনে করতে পারে তোমরা তাদেরই সৈনিক, তাদের অগ্রবাহিনী”

তাহের স্মারক বক্তৃতার নাম দিয়েছি “তাহেরের স্বপ্ন”। প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করবার স্বপ্ন তাহের দেখেছেন তার কৈশোরে, যৌবনে এবং পরিণত বয়সে। শয়নে, স্বপনে এবং জেগে থেকেও তিনি সে স্বপ্ন দেখেছেন। সবাই কম বেশী স্বপ্ন দেখে। কিন্তু স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে কতজন? এ প্রসঙ্গে মহামতি লেনিনের লেখা মনে পড়লো। স্বপ্ন দেখতে তিনি বারণ করেন নি বরং বলেছেন বিপ্লবীদের স্বপ্নচারী হতে হয়। সাধারণ মানুষ থেকে তাদের পার্থক্য হলো বিপ্লবীরা তাদের স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে, বিশ্বাস করে, তা বাস্তবায়নে তারা সচেতন পদক্ষেপে এগিয়ে যায়; স্বপ্ন পূরণে তাঁরা মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তিনিই পরিপূর্ণ বিপ্লবী যিনি স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে সার্থক সেতুবন্ধন রচনা করতে পেরেছেন।

মাতৃভূমিকে নিয়ে বিপ্লবী তাহেরের একটি অপূর্ব স্বপ্নের কথা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে আমার চোখে ধরা পড়েছিল। তা এবারে বলবো। এ বিষয়ে গত বছর বিজয় দিবসে আমার ক্ষুদ্র লেখা ‘কর্ণঝোরা’ যা দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা থেকে উদ্ধৃতি দেব।

‘‘গারো পাহাড়ের গা গড়িয়ে একটি ঝর্না নেমে এসেছে। হয়তো এই পাহাড়ী ঝর্নার নামেই বাংলাদেেেশর উত্তর সীমান্তের পাহাড়ী জনপদটির নাম হয়েছে কর্ণঝোরা। ১৯৭১ এর অক্টোবরের শেষে এক অপরাহ্নে সেক্টর অধিনায়ক তাহের নিজে জীপ চালিয়ে আমাকে নিয়ে এলেন কর্ণঝোরায়। ভারত সীমান্তে জীপটি রেখে তিনি হেঁটে নেমে এলেন বাংলাদেশের এক অপরূপ ভূখণ্ডে। সমতল ভূমি পেয়ে পাহাড়ী ঝর্না বিস্তৃত হয়েছে। তখন হেমন্ত। তির তির স্বচ্ছ পানি বয়ে চলেছে। শুধু পায়ের পাতা ভেজে। আমরা হেটেই তা পার হলাম। তাহের বললেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বেশ আগে স্বপ্নে তিনি ঠিক এই জায়গাটি দেখেছেন। ছবির মতো পরিষ্কার তার মনে আছে। এই তো সেই ছবি। তাই সময় পেলেই তিনি কর্ণঝোরায় চলে আসেন। থাকেন কিছুটা সময়। ছবিটি দেখেন। অক্টোবরের সেই বিকেলে কোন যুদ্ধ ছিলনা। তাহের আমাকে নিয়ে এসেছেন স্বপ্নে দেখা এক স্বর্গীয় ভূমিতে। কর্ণঝোরার কথা বলতে বলতে তাহের যেন মাতৃভূমি বাংলার এক স্বপ্নের ভূবনে প্রবেশ করেন। পাহাড়ের গা ঘেসে সমতল ভূমি, ঝর্না, ছড়ানো বৃক্ষরাজী ও ছোট ছোট ঘরবাড়ী। অপরূপ ভূপ্রকৃতি। কী সুন্দর আমাদের বাংলাদেশ। স্বপ্নে দেখা কর্ণঝোরায় তাহের বারবার গিয়েছেন মাতৃভূমি বাংলাদেশেরই ছবি দেখার জন্য”।

তাকে স্বাধীন করতে কর্ণঝোরারই অদূরে কামালপুর রণক্ষেত্রে রক্ত দিয়েছেন। সেই কামালপুর যুদ্ধের কথা বলবো। ১৪ নভেম্বর আমাদের অধিনায়ক তাহেরের জন্মদিন। এ দিনটিকেই ঢাকা দখলের প্রবেশ দ্বার কামালপুর শক্রঘাটি দখলের জন্য জন্য স্থীর করেছেন অধিনায়ক। ভোর রাত ৩ টায় চতুর্দিক থেকে ৫ টি কোম্পানী নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেন তাহের। মুক্তিবাহিনীর সেকেন্ড লে. মিজান, লে. মান্নান এবং আমার অপর ভ্রাতা আবু সাইদের নেতৃত্বে তিনটি কোম্পানী এবং ভারতীয় বাহিনীর দু’টি কোম্পানী মিলে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। ভারতীয় আর্টিলারী আমাদের সাহায্য করে। চশমা ভেঙ্গে যাওয়ায় আমাকে এই অভিযান থেকে বাদ দেয়া হয়। অন্যান্য সময় অভিযান কালে আমি অধিনায়কের অস্ত্রটি নিয়ে তার সাথেই থাকি। তবে আমাদের ব্রাদার্স প্লাটুনের পাঁচজন অংশ নেয় এই অভিযানে। তারপরও অধিনায়কের অজান্তে ছোট্ট ওয়াকিটকি নিয়ে আমি ও আমার ছোট বোন ডালিয়া যুদ্ধক্ষেত্রের কাছেই অবস্থান নেই। অধিনায়কের জন্য দু’টি ফ্লাক্সে চা ও পানি নিয়ে এসেছি।

ওয়াকিটকিতে যুদ্ধের খবর ভেসে আসছে। আমাদের তীব্র আক্রমণে যার পুরোভাগে ছিল মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানী – পাকসেনাদের একজন মেজরসহ দু’টি কোম্পানী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভোরের দিকে স্পষ্ট হয়ে যায় শত্র“ ঘাটির পতন আসন্ন। সবচেয়ে অগ্রবর্তি কোম্পানীর অধিনায়ক সদ্য কমিশন প্রাপ্ত সে.লে. মিজানের খবর পাচ্ছিলেন না তাহের। তাই আমাদের ছোট দুই ভাই বাহার, বেলালসহ আরও কয়েকজন স্কাউটকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এগিয়ে যান মিজানের খোঁজে। ওয়াকিটকিতে শুনতে পাই, এইমাত্র একটি বাঙ্কার দখল হয়েছে, অগ্রবর্তি দলটিরও সন্ধান মিলেছে। তাহের শত্র“ ঘাঁটির দ্বার গোড়ায়। বেঁচে থাকা পাকিস্তানীরা তাদের ঘাঁটি ছেড়ে দিয়ে পাশ্ববর্তি জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন অবস্থানের মুক্তিযোদ্ধারা ওয়াকিটকিতে অধিনায়ক তাহেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে ওয়ারলেস সেটে। সবকিছুই শুনতে পাচ্ছি আমার সেটে। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেও একটি খুশির আমেজ আমিও টের পাচ্ছি।

এর মধ্যেই হঠাৎ করে সেটে বেলাল, বাহার-এর চিৎকার শুনলাম, “কর্তা মারা গেছেন”। সেই অভিযানে তাহেরের সাংকেতিক নাম ছিল কর্তা। আমি দৌড়ে চললাম যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। একটি পরিত্যক্ত স্কুল ঘরের মেঝেতে একটি ভাঙ্গা বেড়ার উপর তিনি শুয়ে ছিলেন। হাঁটুর উপর থেকে তার বাম পা উড়ে গেছে। আহত হওয়ার পর স্কাউট টিমটি তাকে পাশ্ববর্তি ক্ষেতের একটি বেড়ার উপর শুইয়ে প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে তা টেনে এনে স্কুল ঘরে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে আসে। আমি তাঁর সামনে দাঁড়াই। আমার দিকে তাকান তিনি। একটু অবাকও হন। আজতো এ যুদ্ধে আমার থাকার কথা নয়। প্রচুর রক্তক্ষরণে চেহারা সাদা হয়ে গেছে। পানি চাইলেন। আমি নিজ হাতে তার মুখে পানি দিতে চাইলাম। শোয়া অবস্থায় মাথা একটু উঁচু করে তিনি নিজের হাতে পানির গ্লাসটি নিলেন। বললেন, “আমার হাততো ঠিক আছে”

উদ্ধারকারী দুই ভাই ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সবাই রক্তাক্ত। অধিনায়কের পবিত্র রক্ত তাদের সর্বাঙ্গে। কাঁদছিল সবাই। সবার উদ্দেশ্যে তিনি পরিস্কার দৃঢ় কন্ঠে বললেন, “তোমাদের আমি সব সময় বলেছি, পাকিস্তানীরা আমাকে মারতে পারবেনা। আমার মাথায় তারা গুলি লাগাতে পারেনি। আমি মরবোনা। তোমরা ফ্রন্টে ফিরে যাও। চারদিকে খবর পাঠাও কর্তার কিছু হয়নি। আমি তোমাদের অল্প সময়ের জন্য ছেড়ে যাচ্ছি। কিন্তু ফিরে এসে যেন দেখি কামালপুর দখল হয়েছে। আর ঢাকা যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার”। কান্না, শোক ভুলে গিয়ে আমরা তখনই এগিয়ে চল্লাম শক্রঘাটি অভিমুখে।

(চলবে)
১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব

মো. আনোয়ার হোসেন

অধ্যাপক, প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনুজ, শহীদ কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)।

১৪ comments

  1. মাসুদ করিম - ১৮ নভেম্বর ২০১০ (১:৪৯ অপরাহ্ণ)

    ইংরেজি শব্দ Front line, an area where the enemies are facing each other during a war and where fighting take place, শব্দই ছিল এতদিন আমার কাছে। শব্দটাকে প্রত্যক্ষ করছি।

  2. রায়হান রশিদ - ১৯ নভেম্বর ২০১০ (৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ)

    একাধিক কারণে এই সিরিজটি অমূল্য। মুক্তাঙ্গন এর আলোচনায় আগেও যে বিষয়টি উঠে এসেছে এবং অনেকেই যে বিষয়টির সাথে একমত হয়েছেন তা হল – বাংলাদেশের ইতিহাসের সম্ভবত সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ সময় হল ১৯৭৫ সাল। বিশেষ করে বছরটির দ্বিতীয়ার্ধের গুরুত্বের কথা তো বলাই বাহুল্য। কারণ, এই সময়টিতে যা কিছু ঘটেছে এবং যে কারণে ঘটেছে এবং সে সব ঘটনায় মূল পাত্রপাত্রীদের ভূমিকা কি ছিল তার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের পরবর্তী দশকগুলোর রাজনৈতিক পটভূমি গড়ে উঠেছে। কর্নেল তাহের, তাঁর জীবন, সাংগঠনিক কর্মকান্ড এবং প্রহসন-বিচারের মাধ্যমে তার মৃত্যু – সব এই সময়ের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এই সময়টুকু নিয়ে মিথ্যাচার যেমন হয়েছে, তেমনি চলেছে লাগাতার প্রোপাগান্ডা। এসব কিছুর ভীড়ে প্রকৃত সত্যানুসন্ধান পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে উঠেছে। অথচ এই সময়টুকুর সঠিক মূল্যায়ন জরুরী, এখন আরও বেশী আগের যে কোন সময়ের তুলনায়।

    আমরা দেখি এ সময় ১৯৬০ সালে তাহের পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে। বেছে নিয়েছেন পদাতিক বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলিট কমান্ডো বাহিনী স্পেশাল সার্ভিস গ্র“প-এ জায়গা করে নিয়েছেন এর জন্মলগ্নেই। মনে তার স্বাধীনতার স্বপ্ন। গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে জনগণকে নিয়ে, তাই কমান্ডো বাহিনীতে তাঁর এই পরিকল্পিত যোগদান।

    ড মোঃ আনোয়ার হোসেন এর স্মৃতিচারণে অনেক অজানা তথ্যের সাথে প্রথমবারের মতো পরিচয় ঘটছে। ১৯৬০ সালেই কর্নেল তাহের যে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের কথা ভাবতে পেরেছিলেন, এবং ভেবেই যে শুধু ক্ষান্ত দেননি – নিজে উদ্যোগী হয়ে সে বিষয়ে সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ লাভের উচ্চাভিলাষ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে এলিট কমান্ডো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন – এই তথ্যটি জানা ছিল না। কর্নেল তাহের এর জীবন এবং রাজনীতির সার্বিক মূল্যায়ন তাঁর সামরিক প্রস্তুতি এবং প্রশিক্ষণ এর ঘটনাগুলো বিবেচনায় না আনলে অসম্পূর্ণই থেকে যেতো হয়তো।

    অধীর আগ্রহে পরবর্তী চারটি পর্ব পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। লেখকের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।

  3. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (দ্বিতীয় পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  4. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (পঞ্চম ও শেষ পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  5. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (তৃতীয় পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  6. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (চতুর্থ পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  7. মুক্তাঙ্গন - ২০ নভেম্বর ২০১০ (৩:৫১ পূর্বাহ্ণ)

    মুক্তাঙ্গন এ কর্নেল তাহের প্রসঙ্গে পূর্বের আলোচনা:
    উদয়ের পথে শুনি কার বাণী (লিখেছেন – আরমান রশিদ)। ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন এর এই বিশ্লেষণী সিরিজটিতে সেখানে উত্থাপিত অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাবে হয়তো।

  8. প্রনব পাল - ২১ নভেম্বর ২০১০ (১:০৯ অপরাহ্ণ)

    খুব ভাল লাগল লেখাটি
    মানব সভ্যতার বিকাশের জন্য কর্নেল তাহেরদের বারবার ফিরে আসতে হবে

  9. অবিশ্রুত - ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ (৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ)

    তাহেরের সোনার বাংলা গড়তে হলে সরাসরি পুরানো বিচিত্রার পাতায় সৌভাগ্য হয়েছে আমার-এটি পরে সংকলিত হয় জাসদের সমগ্র জনতার মাঝে আমি প্রকাশিত একটি পুস্তিকায়। এবোটাবাদ থেকে দেবিগড় লেখাটিও আমি পড়েছি সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিজয় দিবস সংখ্যা ১৯৭৩(২?)-এ। এ লেখাটি কি তা হলে আনোয়ার হোসেনের ভাষ্যানুযায়ী দৈনিক বাংলাতেও ছাপা হয়েছিল?
    দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন আলাদা-আলাদা অবস্থান থেকে অনেকেই দেখতে শুরু করেছিলেন এবং রাজনৈতিক ঘটনার আবর্তে একসময় এইসব স্বপ্নচারীরা কাছাকাছি এসেছিলেন। তাদের সেই সখ্য কারও কারও ক্ষেত্রে অনেকদূর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে; কারও কারও ক্ষেত্রে বেশিদূর স্থায়ী হয়নি। যেমন, সিরাজ শিকদারের সঙ্গে তাহের বা আনোয়ার হোসেনদের সখ্য বেশি স্থায়ী হয়নি। কিন্তু একটি ব্যাপার নিশ্চয়ই মেনে নেয়া ভালো, আলাদা আলাদা রাজনৈতিক অবস্থানে থাকলেও শেখ মুজিবুর রহমান,আবু তাহের, খালেদ মোশাররফদের মতো সিরাজ শিকদারও বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সে-অনুযায়ী কাজও করেছেন।
    তাহের-এর জবানবন্দির সূত্রে এবং আরও কয়েকটি সূত্র থেকেও নিশ্চিত, মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি ওসমানী গেরিলা যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা এবং গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য সংগ্রহের গুরুত্ব সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু একটি ব্যাপারে ওসমানীকে স্বীকৃতি দিতেই হয়-জিয়া যে একজন অবিশ্বস্ত মানুষ, সেটি তিনি ১৯৭১-এই বুঝেছিলেন-যা বুঝতে তাহেরের ১৯৭৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। মজার ব্যাপার, যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই একবার তাহেরকে বাহিনী দিয়ে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিয়া তা রক্ষা করেননি-তারপরও জিয়াকে তাহের আস্থায় রেখেছিলেন! এটি এখন বেশ কিছু ভাষ্য ও ডকুমেন্টস থেকে সুস্পষ্ট যে, ওসমানীর পক্ষ থেকে জিয়াকে সামরিক নেতৃত্ব থেকে বহিষ্কারের উদ্যোগ বেশ কয়েকবার নেয়া হয়েছিল। সামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে জিয়াই প্রথম বিভিন্ন সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধপ্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে আলাদা ফোর্স (জেড ফোর্স) গড়ে তোলেন এবং তাতে ওসমানী ক্ষিপ্ত হয়ে জিয়াকে সাসপেন্ড করতে চাইলে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে প্রবাসী সরকার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে ফোর্স এবং শফিউল্লাহ-র নেতৃত্বে এস ফোর্স গঠন করেন। এই বিষয়গুলি সম্পর্কে তাহেরের মনোভাব কী ছিল, তা জানা গেলে তাহেরকে বুঝতেও আমাদের সুবিধা হবে।
    যেমন, আরও একটি ব্যাপার পরিষ্কার নয়, মেধা এবং মত-পথের বিবেচনায় সামরিক বাহিনীতে তাহেরের সবচেয়ে কাছের মানুষ হওয়ার কথা ছিল খালেদ এবং মঞ্জুরের-কিন্তু তার বদলে কি না তার সবচেয়ে কাছের মানুষটি ছিলেন জিয়াউর রহমান!এর কারণও অস্পষ্ট।
    তাহেরের জবানবন্দিতে আরও একটি বিষয় পাওয়া যায়। তিনি মনে করতেন

    আমরা গোটা জাতি এক জনযুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। অথচ আমাদের সামনে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ কখনো বিকশিত হতে পারে না।

    এর অর্থ কি এই নয় যে, প্রবাসী সরকারকে তিনি ঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে রাজি ছিলেন না?

  10. অবিশ্রুত - ১৯ ডিসেম্বর ২০১০ (৩:০৯ পূর্বাহ্ণ)

    খালেদ মোশাররফকে যে জিয়াই হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন সে-ব্যাপারে একটি সাক্ষাতকার দিয়েছেন তখনকার ডিজিএফআই প্রধান জিয়াউদ্দিন :

    ‘৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল এটিএম হায়দার ও কর্নেল নাজমুল হুদাসহ ৩ মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিলেন সেনাবাহিনীর ৩ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুজন কর্মকর্তা। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র তৎকালীন কর্মকর্তা মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন দেশ টিভিকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়ে আরো বলেছেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা ক্যাপ্টেন জলিল ও ক্যাপ্টেন আসাদ জেনারেল জিয়ার নির্দেশেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটান।
    ‘৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতক চক্র ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে। সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) খালেদ মোশাররফ সেই সেনা কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জ করেন। পরে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আটক করে নিজেই সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন।
    ‘৭৫ সালের ৩-৭ নভেম্বরের ঘটনাবহুল সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিলেন-এ কথা জানিয়ে মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন বলেন, কিন্তু ৩ দিনের মাথায় আরো আরো দুই মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা কর্নেল এটিএম হায়দার ও কর্নেল নাজমুল হুদাসহ নিহত হন তিনি।
    তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীর কমান্ড স্ট্রাকচারটা পুনঃউদ্ধারের জন্যই, এই মিশন নিয়ে জেনারেল খালেদ মোশাররফ অগ্রসর হয়েছিলেন। জেনারেল খালেদের মতো একজন জেনারেল, একজন মুক্তিযোদ্ধা, এতবড় সাহসী একজন সৈনিক মুশতাকের সরকারকে বিচ্যুত করার জন্য, ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কেন তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নিয়েছিলেন, এটাই বড় দুর্ভাগ্যজনক।‌”
    কিন্তু খালেদ মোশাররফ ৪ নভেম্বর দায়িত্ব নিয়ে ৩ দিনও পার করতে পারেননি-এ কথা জানিয়ে সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ৭ নভেম্বরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন কর্নেল তাহের আর মুক্ত হন জিয়া।
    তিনি বলেন, এর অল্প সময়ের মধ্যেই খুন হন খালেদ মোশাররফ, এটিএম হায়দার ও নাজমুল হুদা।
    জিয়াউদ্দিন বলেন, “এরা ৩ জন যাচ্ছিলেন বগুড়ার দিকে, বগুড়ার দিকে তারা চলে যাচ্ছিলেন কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দারের রেজিমেন্টের দিকে। এ সময় তারা শেরেবাংলা নগরে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের চেকপোস্টে অ্যারেস্ট হয়ে যান। ৩ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা তাদেরকে দোতলায় অফিসার্স মেসে নিয়ে ওনাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করেন। ঘণ্টা দেড়েক অতিক্রান্ত হয়ে যায়, কিংবা তারও বেশি, তখন আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে একটা ফোন আসে, ‘এদেরকে এখনও বসিয়ে রেখেছ?’ এবং ফোনটা বিশেষ করে করা হয়, ক্যাপ্টেন জলিল নামের একজন জুনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও ক্যাপ্টেন আসাদ নামের আরেকজন অফিসারকে। তখন ক্যাপ্টেন জলিল এবং ক্যাপ্টেন আসাদ ওই অফিসার্স মেস থেকে ওনাদেরকে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসেন, নিচে নামিয়ে এনে তারা নিজেরাই সাব-মেশিনগান দিয়ে ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে।”
    সেনাসদর থেকে কে তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন-এ প্রশ্নের জবাবে এ মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলেন, “ফোনটা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। বলেছিলেন, এদেরকে এখনও বসিয়ে রেখেছ?
    কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের কারণ কী-এ সম্পর্কে জিয়াউদ্দিন বলেন, “এখানে ক্যাপ্টেন জলিলের একটা জিঘাংসা ছিল, প্রতিশোধ ছিল কর্নেল হায়দারের বিরুদ্ধে, তা হচ্ছে যে কর্নেল হায়দার জলিলকে একবার কোর্ট মার্শালে পানিসমেন্ট দিয়েছিলেন। তরুণ অফিসার, মুক্তিযোদ্ধা এই ভেবে কর্নেল হায়দারের সাজাটা কিন্তু কম দিয়েছিলেন। একটা লঘু সাজা দিয়ে ক্যাপ্টেন জলিলকে চাকরিতে রেখেছিলেন। কিন্তু এই প্রতিশোধটা জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন জলিল এবং ক্যাপ্টেন আসাদকে দিয়ে কিন্তু ঠিকই গ্রহণ করলো।‌”
    এ ঘটনার ২১ বছর পর ‘৯৬ সালের ৬ নভেম্বর রাজশাহী আইন কলেজের ছাত্র মোঃ তৌহিদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো.মোহসিনুল হক রাজধানীর তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। কিন্তু জিডি হলে তদন্ত শেষে প্রাথমিক রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও এখন সেই জিডিটিরই সন্ধান কেউ দিতে পারেনি।
    সাবেক এ ডিজিএফআই কর্মকর্তা আরো বলেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সরকারের ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যার বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
    তিনি বলেন, “এরা (২ হত্যাকারী) আছে আমেরিকায়, ছদ্মভাবে আছে। কিন্তু ট্র্যাক করা খুব কষ্টকর নয়, এদের খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর হবে না। এদের নামে মামলাটা হয়ে গেলেই আমেরিকান গর্ভনমেন্ট এদেরকে হ্যান্ডওভার করতে বাধ্য হবে।”

  11. সৈকত আচার্য - ১৯ ডিসেম্বর ২০১০ (১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ)

    বেশ গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, অবিশ্রুত। কেউ কি আলোচনা চালিয়ে যাবেন প্লিজ, এবং যদি উত্তরগুলোও দেয়ার চেষ্টা করেন তাহলে অনেক উপকৃত হই।

    নানা কারনেই এই পোস্ট দারুন গুরুত্ববহ আমার কাছে, হয়তো অনেকের কাছেই। সে কারনে, শুরু থেকেই আমি নিজে এবং আমার অনেক বন্ধুবর্গ এই পোস্ট এবং এর উপর আলোচনাগুলো অনুসরন করে আসছি।

    একসময় একটি রাজনৈতিক দলের সাথে ছিলাম। জাসদের ভাংগন থেকে সে দলের জন্ম হয়েছিল। সে দলের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের কাছে এই বিষয়ের ভালো কোন পাঠ পাইনি। তবে তাদের বলতে শুনেছি, তাহের একজন অকুতোভয় বিপ্লবী ছিলেন। কিন্ত তাকে নিয়ে কোন দিবস উদযাপন করা বা অন্ততপক্ষেঃ তার রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারনগুলোর কোন ধারাবাহিক বিশ্লেষন কিংবা ৭ নভেম্বর বাস্তবে কি হয়েছিলো বলে তারা মনে করেন, সেটা ভুল ছিল কিনা, থাকলে কেন সেটা ভুল ছিল, কিংবা অন্য কোন দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টিকে দেখেন কিনা এসব বিষয়ে তাদের সুনির্দ্দিষ্ট কোন মুল্যায়ন আছে কিনা, আমার জানা নাই। শুধু জানতাম, তাও মোটা দাগে যে, জাসদের রাজনৈতিক লাইনে দারুন ত্রুটি ছিলো। পরবর্তীতে নতুন দলের জন্ম দিয়ে ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা চলেছে। এছাড়া নিজের চেষ্টায়ও কিছু জানতে চাইনি। তার কারন, দলীয় আবহে থাকার কারনে জ়ানতে চাওয়ার মতো আগ্রহ তৈরী হয়নি। শুনেছি, সঠিক ‘মার্ক্সীয় শিক্ষার’ ভিত্তিতে দল তৈরী না করার কারনে সবাই বিভ্রান্ত এবং অতঃপর দিকভ্রান্ত হয়েছিলেন। ফলতঃ নতুন দলের সৃষ্টি।

    ৭ নভেম্বর নিয়ে ইতিহাস নির্ভর একটি আলোচনা এবং সে সময়ের ঘটনা প্রবাহের বাস্তব একটি চিত্র খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য জরুরী। এই আলোচনা চলতে থাকুক। আমরা পাঠ নিতে থাকি…এবং অতীত থেকে জানতে থাকি…যা কিনা ভবিষ্যতে যাওয়ার একটা রাস্তা হয়তো আমাদের দেখাতে পারে।

  12. আরেফীন - ২০ ডিসেম্বর ২০১০ (১০:৪৩ অপরাহ্ণ)

    স্মারক বক্ততা কি আপ্নাদের পরিবার থেকে আয়জন করা হয়াছিল ? রাজশাহি তে করবেন কি ?

    • রেজাউল করিম সুমন - ২৪ ডিসেম্বর ২০১০ (১:০৬ পূর্বাহ্ণ)

      চট্টগ্রামে কর্নেল তাহের স্মারক বক্তৃতা আয়োজিত হয়েছিল সমাজ সমীক্ষা সংঘের উদ্যোগে।

  13. তাপস ঠাকুর - ২৬ ডিসেম্বর ২০১০ (১১:৫০ অপরাহ্ণ)

    ‘সব কালো আইন ভাঙবো বলে, ভাঙতে হবে বার্তা পেলুম, চৈত্রের শেষে ঝড়ো বৈশাখে তাই জন্ম নিলাম…’ — কবিতাটি বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন আমার বাবা কোকন ঠাকুর। তিনি তাহেরের সহযোদ্ধা।

    আমিও একজন স্বাধীন মানুষ হতে চাই, তাহের আর আমার বাবার মতো। আর শাসকের গলায় পরিয়ে দিতে চাই মৃত্যুকবচ।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.