হরতাল, তেল-গ্যাস, যুদ্ধাপরাধ

আগামীকাল সোমবার ঢাকা শহরে যে হরতাল হতে চলেছে, তাকে আমি, লেখাই বাহুল্য, ন্যায়সঙ্গত মনে করি। তবে আমি এ-ও বলতে চাই, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় আন্দোলন কমিটি আরও খানিকটা সময় নিতে পারত, সারা দেশে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সফর ও সভা অনুষ্ঠানের পর এ-ধরণের একটি হরতাল আরও কার্যকর হতো। তবে এই চিন্তা থাকার পরও আমি বলতে চাই, যে-প্লাটফর্ম থেকে এই ঘোষণা এসেছে, সেটি দেশের একমাত্র প্লাটফর্ম যা দেশের জাতীয় সম্পদ সমূহ রক্ষার জন্যে বেশ কয়েক বছর ধরে সংগ্রাম করছে এবং তাদের আন্তরিকতা পরিক্ষিত। এখন এই প্লাটফর্মকে আরও শক্তিশালী করার ওপরেও নির্ভর করছে আমাদের জাতীয় সম্পদ সমূহের ভবিষ্যত, আমাদের দেশের ভবিষ্যত।
অবশ্য এটা ভাবা ঠিক হবে না, এ-হরতাল সমর্থনকারীদের সবাই জাতীয় সম্পদ রক্ষার জন্যেই এর পক্ষাবলম্বন করছেন। আমরা দেখেছি, সৌদি আরবগামী খালেদা জিয়াকে বিদায় জানিয়ে বিমানবন্দরেই বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার এ-হরতালের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন ঘোষণা করেছেন। আমার মনে হয়, জাতীয় কমিটির উচিত তাদের এ-সমর্থনকে প্রত্যাখ্যান করা। বিএনপি-জামাত সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে তেল-গ্যাস নিয়ে যে-তামাশা চলেছে, তার সবই আমাদের জানা আছে। এখন তাদের ওই নৈতিক সমর্থনের জন্যে লালায়িত হওয়ার মানে এতদিন ধরে আন্দোলনের যে-ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে, তাকেই দুর্বল করে ফেলা, আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। বিএনপি-জামাত আবারও চাইছে, যে-কোনও একটি জনপ্রিয় আন্দোলনকে খড়কূটোর মতো চেপে ধরে নিজেরা রাজপথে নামার মতো অবস্থানে পৌঁছতে। জাতীয় আন্দোলন কমিটি যদি তাদের ওই নৈতিক সমর্থনের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার না করেন, তা হলে তাদের সাংগঠনিক শক্তিমত্তার জন্যে আগামী দিনগুলিতে চারদলের উপাঙ্গে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
আরও একটি মজার ব্যাপার। দেখতে পাচ্ছি, বিশিষ্ট সুশীল অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ একটি দৈনিক পত্রিকায় এ-হরতালের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন‍! বলাই বাহুল্য, এ-জাতীয় মানুষের সমর্থনও এ-হরতালের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করবে। কথিত সুশাসন ও নির্বাচনভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মুলো ঝুলিয়ে এ-ধরণের মানুষরাই দেশের স্বার্থবিরোধী একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গণভিত্তি গড়ে তোলার জন্যে গত কয়েক বছর তাদের যাবতীয় মেধাজ্ঞান ব্যয় করেছেন। তারা হরতালের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টাও চালিয়েছেন। এখন যখন এরা হরতাল সম্পর্কে বলেন, হরতাল আছে এবং থাকবে, তখন বুঝতে হবে মতলব একদম ভালো নয়।
ইতিমধ্যে, সংবাদের গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, দৈনিক আমাদের সময় খোলাখুলি তেল-গ্যাস সম্পর্কিত সাম্প্রতিক চুক্তির সপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আজ রবিবার পত্রিকাটিতে ছাপা হয়েছে এক মন্তব্য প্রতিবেদন। কে লিখেছেন, সেটি বড় ব্যাপার নয়। ক না লিখলে, খ লিখত,- লেখার মানুষের কি তেমন অভাব আছে? এতে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে জাতীয় আন্দোলন কমিটির অবস্থানের। বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দু দেশের, তার মানে ভারত ও মায়ানমারের উস্কানীতেই নাকি এ আন্দোলন চলছে! এ লেখা এ-ও বলছে, এশিয়া এনার্জির সঙ্গে কয়লা উত্তোলনের চুক্তি হলে দেশে নাকি বিদ্যুতের কোনও সংকটই থাকতো না আর! ফুলবাড়ির কয়লাখনি এশিয়া এনার্জির হাতে তুলে দিতে ব্যর্থ সাংবাদিকরা এখন কলম ধরছে কনোকো ফিলিপস আর তালোর পক্ষে!
বহুজাতিক কর্পোরেশন আজকাল সাংবাদিকদের কারণে-অকারণে বিদেশ সফরের ব্যবস্থা করে। তারা ফিরে এসে ওইসব কর্পোরেশনের পক্ষে সফরনামা লিখতে থাকে,- এটি কারোরই অজানা নয়। এশিয়া এনার্জি নিয়ে সাংবাদিকদের ওরকম অনেক সফরনামাই পড়েছি আমরা নিকট-অতীতকালে। এই মন্তব্য প্রতিবেদনও এরকম একটি উপসর্গ। এ প্রতিবেদন আমাদের জ্ঞান দিচ্ছে, এরকম চুক্তি নাকি এখন বিশ্বের সব দেশই করছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জার্মানী, মিয়ানমারেও নাকি হচ্ছে। খেয়াল করুন, হচ্ছে, মানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু ওসব দেশে কোনও আন্দোলন হচ্ছে কি-না, প্রতিবাদ হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে সাংবাদিকরা আমাদের জ্ঞান দিচ্ছে!

দুই.
শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ যখন ৮০ শতাংশ গ্যাস বিদেশে রফতানির শর্তে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যে ব্লক বরাদ্দের চুক্তি করার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে, আরেক বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক কবির চৌধুরী তখন সরকারের প্রতি আহ্বান রাখছেন কমপক্ষে ১৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে দ্রুত গ্রেফতার করবার জন্যে।
কোনদিকে যাব আমরা?
দু’টোই জরুরি আমাদের জন্যে। আমরা চাই, বিদেশীদের সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যে চুক্তি করা হলেও তা যেন দেশের জন্যে সম্মানজনক হয়, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী না হয়। আমরা এ-ও চাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হোক, গত প্রায় তিন যুগ ধরে যে যন্ত্রণা আমরা বয়ে চলেছি, বিচারের মধ্যে দিয়ে তার অবসান না ঘটলেও আমরা অন্তত স্বস্তিবোধ করব এই ভেবে যে, আমাদের যন্ত্রণা উপশমের জন্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্তত একটি আইনী সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ-সব ব্যাপারে সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশার জায়গাগুলি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
এখন একদা যারা অবিশ্বাস করেছেন, তারাও ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন একটি রাজনৈতিক আবহ তৈরি করে দিতে চেয়েছে, যার ফলে জাতীয় সম্পদ যথাযথভাবে সদ্ব্যবহারের নামে বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়া হবে, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের গ্রহণযোগ্যকরণ প্রকল্পটিও বাস্তবায়িত হবে। এটি আসলে একটি কথিত জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা,- যাতে আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশের সমস্ত জাতীয় সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেবেন।
এখন আমরা দেখছি, কার্যত তাই হচ্ছে। মুখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামাত যাই বলুক না কেন, যে-সব সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক নিয়ে চলেছে, তার প্রতি বিএনপি ও জামাতেরও সূক্ষ্ম সমর্থন রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্যে একটি ‘সম্মানজনক’ প্রস্থানপথ তৈরি করে দিয়েছে এ দু দল। এখন তাদের দু পক্ষই মাঝেমধ্যে ‘মঈন-বিচারের’ নাটক করলেও তা আসলে লোক দেখানো মনের ঝাল ঝাড়ার খেলা ছাড়া কিছু নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। নির্বাচনে আমরা দেখেছি বিপুল জনশক্তি সমর্থন দিয়েছে তাদের। কিন্তু তারপরও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে এ-সরকারকে বহিঃশক্তিসমূহের সঙ্গে বোঝাপড়া করা এজেন্ডাগুলি বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপজেলা পরিষদ বিল আওয়ামী লীগ সরকার নাকচ করে দিতে পারে, কিন্তু তেল-গ্যাস নিয়ে ওই সরকারের যে-পরিকল্পনা, সেটি আর বাতিল করতে পারে না আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের খেলায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রাপ্তিও কম নয়। বিনিময়মূল্য হিসেবে তারা পাঁচ বছর ধরে যে কুৎসিত দুর্নীতি-অনিয়মের জগত তৈরি করে রেখে গেছে রেহাই পাচ্ছে এখন সেসবের দায় থেকে; এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, এ দল দু’টি নিশ্চিত যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রক্রিয়া আগামী দিনগুলিতে আরও স্থবির হয়ে পড়বে।
তিন.
এখন আমাদের নানা প্রক্রিয়াপদ্ধতির কথা শোনানো হচ্ছে; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুরক্ষিত ভবনে না করলে অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে- এইসব কেচ্ছা শোনানো হচ্ছে। কিন্তু একবার চিন্তা করুন ১৯৯৬ সালের কথা,- আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই শোকাবহ ১৫ আগস্টকে সামনে রেখে কর্নেল ফারুকসহ খুনীচক্রের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ছে, তখনও ইনডেমনিটি বিল বাতিল হয়নি। ২০০৯ সালের ২৫ মার্চকে সামনে রেখেও একইভাবে যুদ্ধাপরাধী বিচার অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এর সংশোধন কিংবা পরিমার্জন ছাড়াই যুদ্ধাপরাধীদের অনেককে গ্রেফতার করা সম্ভব ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। এমনকি কুখ্যাত দশ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলার সূত্র ধরেও বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করা যেতো। গ্রেফতার করা যেত তাদের অন্তত দু’জনকে অবৈধ বরাদ্দের ভিত্তিতে রাজউকের স্থানে ভবন নির্মাণের অভিযোগে। কিন্তু আইন প্রয়োগের এসব যৌক্তিক সুযোগগুলির সদ্ব্যবহার করা হয়নি।
এর বিপরীতে, তেল-গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধানের চুক্তি করতে আওয়ামী লীগ সরকারের তেমন কোনও দেরি হয়নি। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকারই নাকি তার কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। আমরা যতদূর জানি, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া অনেকদূর সম্পন্ন করে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সে-সবকে আর পর্যাপ্ত মনে হয়নি আওয়ামী লীগ সরকারের। তারা এতদিন আইন সংশোধনের বাহানায় দেরি করেছেন। এখন আইন সংশোধনের পর নতুন বাহানা খুঁজছেন। তারা ভাবছেন, এরকম বাহানা খুঁজতে-খুঁজতেই পার করে দেয়া যাবে পাঁচটি বছর।
ওদিকে দেখুন,- টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে প্রতিবাদ, মিছিল, সভা, সমাবেশ করতে কোনও দেরি না হলেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী চুক্তি হওয়ার পরও বিএনপি-জামায়াতের আর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। খালেদা জিয়া দ্রুত আনু মুহাম্মদকে দেখতে হাসপাতালে যেতে পারেন, হরতালে নৈতিক সমর্থন দিতে পারেন; কিন্তু এই ব্যাপারে নিজেরা আর মাঠ গরম করতে রাজি না। কইয়ের তেলে কই ভাজার দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি।
চার.
এরকম সব অনুকুল পরিস্থিতি আছে বলেই মরিয়ার্টির এখন হালকা চালে বলতে মুখে বাধে না : ‘একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করাটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দুঃখজনক ভুল’!
একাত্তরে তারা ‘দুঃখজনক ভুল’ করেছিল, এখন তারা ‘সুখজনক সঠিক কাজ’টি করতে চলেছে। তারা তেল-গ্যাস নিতে চলেছে। একজন সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে একটি পত্রিকা লিখেছে, ‘আরও কয়েকটি ব্লক এর আগে চুক্তির প্রক্রিয়ায় ছিল। তখন সেগুলি সম্পর্কে ভারত ও মায়ানমারের কোনও আপত্তিও ছিল না। কিন্তু তারা এখন আপত্তি তোলায় সেগুলি নিয়ে চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ বিরত রয়েছে। যে-তিনটি ব্লক অনুসন্ধানের জন্যে চুক্তি করা হয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে ওই দেশগুলি কোনও আপত্তি তোলার আগেই সরকার চুক্তি করে ফেলা সঠিক বলে মনে করেছে।’ এই ভাষ্য কতটা সঠিক তা বলার উপায় নেই, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে একা-একাই দু দিক থেকে দাবা খেলতে পারে, তার খানিকটা আভাস রয়েছে সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহে।
অবশ্য এটি আমরা দিব্যি দিয়ে বলতে পারি না যে, আওয়ামী লীগকে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের মনের আশা পূর্ণ হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা আমরা বুঝতে পারছি, তা হলো, শেখ হাসিনার বাঁচার আশা প্রবল। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তিনি উত্তেজিত হয়ে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন, ওরা তেল-গ্যাস চায়, তাই আমাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, কীভাবে ভারত উপমহাদেশের মানচিত্রকে পুনর্বিন্যস্ত করার একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর তাঁর গ্রেনেড হামলার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং তারপর মনে হচ্ছে মৃত্যু এড়িয়ে চলাকেই তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এইভাবে অবশ্য মৃত্যু এড়ানো যায় না। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলির জন্যে আশঙ্কার দিকটি হলো, কখনও কখনও শেখ হাসিনা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। এ আবেগ যদি ফের জেগে ওঠে, তা হলে তার প্রতিষেধক কি হতে পারে তাও যুক্তরাষ্ট্র ও বিদেশী কর্পোরেট শক্তিগুলি ভেবে রেখেছে। তাই ব্যর্থ ইউনূসকে নিয়ে তারা আমাদের বার বার স্বপ্ন দেখানোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পাঁচ.
যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীরা প্রতিষেধক যাই রাখুক, আপাতত আমরা যা দেখছি তা হলো তেলগ্যাস অনুসন্ধানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার একটি অসম চুক্তি করে ফেলেছেন।
এই অসম চুক্তিটিকে বাতিলের জন্যে যত ধরণের গণতান্ত্রিক পন্থা রয়েছে, তার সবই আমাদের প্রয়োগ করতে হবে এবং আরও কার্যকর গণতান্ত্রিক নতুন নতুন পন্থা খুজেঁ দেখতে হবে। আন্দোলন বিকশিত হলে এ ধরণের নতুন-নতুন পন্থা অবশ্য পরিপূরক হিসেবেই উদ্ভাবিত হতে থাকে।
আন্দোলন নিশ্চয়ই বিকশিত হবে, পল্লবিত হবে।

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

২০ comments

  1. মনজুরাউল - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (২:০৮ পূর্বাহ্ণ)

    আমি কি এই লেখাটি অন্য একটি ব্লগে প্রকাশ করতে পারি? লেখা বিষয়ে এখনই আলোচানায় যেতে চাইছি না।

    • অন্যরকম - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (২:৪৬ পূর্বাহ্ণ)

      একটি হরতাল গণ সচেতনতা সৃষ্টির জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে হাজ করবে!

      • অবিশ্রুত - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:৪২ পূর্বাহ্ণ)

        # অন্যরকম
        মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও এ টুকু বলা যায়, হরতাল গণসচেতনতা সৃষ্টির একটি বিশেষ ধাপ। কিন্তু গণসচেতনতা সৃষ্টির প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন না করেই যদি এ ধাপে পা রাখা যায়, তা হলে গণসচেতনতা সৃষ্টির সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিই বিঘ্নিত হতে পারে।
        প্রসঙ্গত জানাই আপনাকে, প্রথম আলোর ১২ সেপ্টেম্বরের একটি রিপোর্ট থেকে জানতে পারছি,জাতীয় কমিটির নেতারা হরতাল উপলক্ষে তাদের বিভিন্ন সমাবেশে বিএনপির নৈতিক সমর্থন সম্পর্কে জনগণকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলছে, জাতীয় সম্পদকে রক্ষার আন্দোলনকে যাতে কোনও অপশক্তি তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কাজে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্যে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
        এ তথ্যটি আমার আগে চোখে পড়েনি, তা হলে হয়তো এ-লেখার একটি অংশ একটু অন্যরকম হতো।

    • রায়হান রশিদ - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৩:৪১ পূর্বাহ্ণ)

      অনেক ধন্যবাদ মনজু ভাই লেখাটা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। লেখক অবিশ্রুত’রও তাতে আপত্তি থাকার কথা না। বরং আমাদের প্রত্যেকেরই আপনার মতো উদ্যোগ নিয়ে এই লেখাটা যত দূরে সম্ভব ছড়িয়ে দেয়া দরকার। এই সময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো, সেগুলোর যোগসূত্র, আর অব্যক্ত আশংকাগুলো খুব সহজ কথায় সাবলীলভাবে লেখক ব্যাখ্যা করেছেন।

      অবিশ্রুতকেও ধন্যবাদ।

    • অবিশ্রুত - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৪:৪৬ পূর্বাহ্ণ)

      ধন্যবাদ মনজুরাউল লেখাটি ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে। নির্মাণ ব্লগের, জানেনই তো, ওই হরতাল আহ্বানকারী ক্ষুদ্র সংগঠনগুলির মতোই অবস্থা; একটি স্থির লক্ষ্য আছে, কিন্তু এখানে হাজার হাজার মানুষ হিট করে না। হাতে গোণা সমর্থক নিয়ে হরতাল আহ্ববানকারী জাতীয় কমিটি কী করতে পারবে জানার পরও আমার মনে হয়েছে, একে সমর্থন করে জানানো উচিত, জাতীয় সম্পদ নিয়ে সরকার সংসদকে উপেক্ষা করে যা করছে তা সঠিক নয়। ঠিক তেমনি নির্মাণ ব্লগে লেখাটি কম মানুষের চোখে পড়বে জানার পরও আমার মনে হয়েছে, লেখাটি এখানেই থাকা উচিত। আপনি লেখাটি ছড়িয়ে দিয়ে চিন্তার পরিসর আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন; অনেকের মত জানার সুযোগ হলো এবং হবে এর ফলে। আর তা নিশ্চয়ই আমার জানার পরিধিকেও আরও বাড়িয়ে দেবে।
      আবারও ধন্যবাদ।

      • মনজুরাউল - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:২০ পূর্বাহ্ণ)

        লেখার জন্য অভিনন্দন। আমি আশা করছি কিছুদিনের ভেতর বেশ কয়েকজন এখানে রেজিষ্ট্রেশন করবেন। আজ একজন করেছেন।

        রায়হান রশীদ এবং আপনাকে ধন্যবাদ।

  2. ত্রিশোনকু - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৪:১২ পূর্বাহ্ণ)

    অতি সংক্ষেপে, সহজ কথায়, জটিল বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে পারার জন্য সাধুবাদ।

    আচ্ছা, যদি ১/১১ এর তত্তাবধায়ক সরকার যদি না আসতো তাহলে কি কি হতে পারতো। আবার মইত্তার বাংলাদেশী পতাকার অপমান?
    যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ওপর আমার কিছু ভাবনা আছে। দেখতে পারেন:
    http://www.somewhereinblog.net/blog/Trishonku/29009544

    • মনজুরাউল - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:০৯ পূর্বাহ্ণ)

      আরে আরে ত্রিশোনকু ! আপনি রেজিষ্ট্রেশন করে ফেলেছেন? থ্যাংকস বস। এখানেও লিখুন। আমরা এই সাইটটা আরো প্রাণবন্ত রাখার চেষ্টায় যার যার অবস্থান থেকে যৎসামান্য কাজ করে যাচ্ছি।

      • মুক্তাঙ্গন - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৮:০৩ পূর্বাহ্ণ)

        @ ত্রিশোনকু
        আপনাকে আরও নিয়মিতভাবে এখানে পেলে সত্যিই ভাল লাগবে। সময়-সুবিধেমতো এক সময় নিবন্ধন করে ফেলবেন আশা করি।

      • ত্রিশোনকু - ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১০:১৮ অপরাহ্ণ)

        এখন করলাম। এখানে লিখতে চেষ্টা করছি। পরিবেশটা কেমন যেন শান্তিময়।

        ভাল থাকুন।

        দেখা হওয়া প্রয়োজন ঈদের আগে।

  3. অবিশ্রুত - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:২৩ পূর্বাহ্ণ)

    ধন্যবাদ ত্রিশঙ্কু। আপনার ভাবনাগুলিও পড়লাম। পড়তে পড়তে একটি প্রশ্ন মনে জাগল, আওয়ামী লীগ সংসদে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বললে ভুল হবে, নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল; আমাদের বর্তমান সংবিধান ফ্লোরক্রসিং অনুমোদন করে না; কিন্তু তারপরও এ-সরকার কোন ভূত দেখেছিল যে, সংসদে এ নিয়ে আলোচনার পথে পা না বাড়িয়ে সরাসরি চুক্তির পথে গেল!
    তা হলে কি এই সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কোনও ফাঁকি আছে? আওয়ামী লীগ সরকার কি মনে করেছিল, ফ্লোর-ক্রসিং থাকার পরও তাদের দলীয় এমপিরা সম্ভাব্য চুক্তির বিপক্ষে কথা বলবে?
    এমনকি, চুক্তি হয়ে যাওয়ার পরও কি সেই একই ভয় কাজ করছে, যে-কারণে সংসদে এ নিয়ে কোনও আলোচনা উন্মুক্ত করা হচ্ছে না?
    আপনার ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার না এলে কি হতো’ প্রশ্নের জবাবে আমার ছাত্রাবস্থায় পড়া এক কবিতার কথা মনে হচ্ছে। কবিতাটি আছে সলিমুল্লাহ খানের ‘এক আকাশের স্বপ্ন’ নামের কবিতার বইটিতে সম্ভবত। এটি তার লেখা প্রথম কবিতার বই। তখন সলিমুল্লাহ প্র্যাক্সিস করেন এবং দেশের অনেকে তাকে একনিষ্ঠ মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী মনে করেন। যাই হোক, সেটি অন্য প্রসঙ্গ। কবিতাটির বিষয়বস্তু এরকম :মার্কসকে কূটতর্কে বিপত্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্যে একজন তাঁকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা, আপনার সাম্যবাদী সমাজে তো সবাই সমান হয়ে যাবে। তা হলে সেখানে জুতা সারাই করবে কে? শুনে মার্কস বললেন, ওই কাজটি নিয়ে যখন আপনার এত চিন্তা তখন ওটা না হয়, আপনিই করবেন!
    মজা করার জন্যে ঘটনাটা লিখলাম। এবার আমার চিন্তাটা বলি, কি হতো সেটা আমাদের সবারই অনুমানের বিষয় এখন। তবে আমার মনে হয়,একটি রক্তক্ষয়ী নির্বাচন হতো এবং বিএনপি সরকার গঠন করতো। সেই সরকারও তেল-গ্যাস দিতো, উপরন্তু যুদ্ধাপরাধী বিচারের কথা মুখেই আনতো না। কিন্তু তফাৎটি হলো, ওই সরকারের প্রতি প্রকৃতপক্ষে কোনও জনসমর্থনই থাকত না এবং আওয়ামী লীগকেও তখন একটি রক্তক্ষয়ী বিকল্প সাময়িকভাবে হলেও চিন্তা করতে হতো।
    আর বাংলাদেশী পতাকার অপমান? সে তো এখনও হচ্ছে, যদিও আমরা কেউই তা চাই না। এবং যদিও দিনবদলের সরকার রয়েছে! কওমী মাদ্রাসা কি প্রস্তুত জাতীয় পতাকা ওড়াতে তাদের প্রতিষ্ঠানে? প্রস্তুত কি প্রতিদিন শিক্ষার্থী সমাবেশ করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে ও শপথ নিতে দিতে। এ ব্যাপারেও আমাদের একটি পরিষ্কার অবস্থানে যেতে হবে। এই তো সংবাদপত্রে পড়লাম, একটি সংগঠন (যতদূর নামটি মনে আসছে, বেফাক) আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটি ‘হিন্দুর লেখা’ এবং এরকম একটি জাতীয় সঙ্গীত এ দেশের হতে পারে না বলে বিবৃতি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা প্রস্তাব রেখেছে, এ দেশে একাধিক জাতীয় সঙ্গীত রাখা উচিত, যাতে যার যেটি পছন্দ সেটি গাইতে পারে! এই সংগঠন প্রস্তাবিত দু’টি জাতীয় সঙ্গীতের একটি ইনকিলাবের এক মালিকের লেখা, আরেকটিও সেরকমই একজনের! অবশ্য পরিস্থিতির একটু হলেও উন্নতি ঘটেছে,- তা হলো, অন্তত রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এ জাতীয় বিষয়গুলিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না, পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে না। কিন্তু এ টুকুতেই কি আমরা সীমিত থাকব?
    আবারও ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার চিন্তা-জাগানিয়া মন্তব্যের জন্যে।

    • অবিশ্রুত - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:২৮ পূর্বাহ্ণ)

      #দু:খিত আপনার নামের বানান ভুল হয়ে গেছে, ত্রিশোনকু! তবে বোঝাই যাচ্ছে, আপনি ভারী মজার মানুষ, এই ভুলটা পয়লা বলে নিশ্চয়ই উপেক্ষা করবেন…

      • ত্রিশোনকু - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৮:০৪ পূর্বাহ্ণ)

        এ ব্যাপারগুলো আমি ধরতেই পারিনা। I’m not a good observer.

    • ত্রিশোনকু - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ)

      আপনি আমার ব্লগ ও মন্জুরের লেখার প্রত্যুত্তর দুটো মন দিয়ে পড়েছেন। ধন্যবাদ।
      ১।আমার মনে হয়না বা আমি বিশ্বাস করতে পারিনা যে ৮ কোটি + ভোট গাপ করে দিয়েছে কোন এক শক্তি। আমি এও মনে করিনা যে শেখ হাসিনা সাংসদদের ভয়ে এটা সংসদে আলোচনায় আনেননি। শেখ হাসিনার হ’ল নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতারও অনেক বেশী আসন পাওয়ার গর্ব। তাছাড়া বংগবন্ধু কন্যা তিনি তাও ভুলতে পারেননা। বোনসহ জনগনের টাকায় আহার বাসস্থান ও নিরাপত্তার বিধান তিনি করেছেন রেকর্ড সময়ে। এই অহংকার থেকেই তিনি গনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বুড়ো আংগুল দেখাচ্ছেন, নিজ দলের ভেতরে তিনি যা সবসময়ই করে থাকেন।

      ২। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে আপনার মতামত যুক্তিগ্রাহ্য।

      আনু মোহাম্মদ পেটানো নিয়ে আমার একটা পোষ্ট আছে যেখানে আপনার ওঠানো যুক্তির কিছুটা আলোচনা হয়েছে। দেখতে পারেন:

      http://www.somewhereinblog.net/blog/Trishonku/29003830

  4. রায়হান রশিদ - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ)

    @ অবিশ্রুত#৪

    কিন্তু তারপরও এ-সরকার কোন ভূত দেখেছিল যে, সংসদে এ নিয়ে আলোচনার পথে পা না বাড়িয়ে সরাসরি চুক্তির পথে গেল!

    গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সাংবিধানিক প্রাধান্যের দেশ। আর সে সংবিধানকে ধরে নেয়া হয় ‘আপামর জনগণের পরম অভিব্যক্তির প্রকাশ’ হিসেবে (অনু#৭)। অর্থাৎ “প্রজা”গণই এই প্রজাতন্ত্রের সমস্ত ক্ষমতার সত্যিকারের মালিক; সম্পদের মালিক তো বটেই। আর তেল গ্যাস বিষয়ে আমাদের সংবিধান বলছে – ভূগর্ভস্থ সকল খনিজ সম্পদের মালিকানা প্রজাতন্ত্রের হাতে ন্যস্ত (অনু#১৪৩)। আর সে সম্পদকে ঘিরে চুক্তি, বন্টন ইত্যাদি করার ক্ষমতা প্রজাতন্ত্রকে দেয়া রয়েছে (অনু#১৪৪)। সুতরাং সরকার চুক্তি করার ক্ষমতা রাখেন – খুব তাত্ত্বিকভাবে যদি বিষয়টা দেখতে চাই আমরা, তাহলে বিষয়টা তেমনই।

    কিন্তু এখানে প্রশ্ন আছে। প্রজাতন্ত্রের এই ক্ষমতা কিন্তু “প্রজা”-দের দ্বারাই ন্যস্ত। আর প্রজাতন্ত্রের পক্ষে সরকার যেন এই “প্রজাদের” স্বার্থের সর্বোচ্চ সংরক্ষণ করে ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন, সে লক্ষ্যেই সংবিধানের এই অনুচ্ছেদগুলো। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই জায়গাটাতেই মনে হয় আমাদের সরকারগুলো তাদের নিজেদের অবস্থান বিস্মৃত হন। জনগণের স্বার্থই‍‍ যদি রক্ষা না হয়, তাহলে (সরকারের) ক্ষমতার প্রয়োগের কথা আসে কেন? এখন জনস্বার্থ সত্যিই লঙ্ঘিত হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা নিয়ে একেক জন একেক কথা বলতেই পারেন। সে বিতর্কে এমুহুর্তে‍ যাওয়ার মনে হয় প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রচলিত ধারণা বা perception হল – এই চুক্তিগুলোতে জনস্বার্থ লঙ্ঘিত হচ্ছে। সমাজতাত্ত্বিকমাত্রই জানেন – perception এর একটা মজার ব্যাপার হল – সেটা সঠিক perception না বেঠিক perception সে প্রশ্নটা অবান্তর। তেল গ্যাস চুক্তিগুলো নিয়ে ঠিক যে মুহুর্তেই প্রশ্ন উঠেছে, তা সে যে perception থেকেই উঠুক না কেন, সেই মুহুর্তেই কিন্তু সরকারের ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। সে দায়িত্ব জবাবদিহিতার, সে দায়িত্ব স্বচ্ছার। কারণ প্রজাতন্ত্র এবং জনগণের পক্ষে সরকারের ভূমিকা এখানে মালিকের না, ট্রাস্টির। আমার (মানে জনগণের) সম্পদ আমারই নিযুক্ত ট্রাস্টি কিভাবে ব্যবহার করছে আর কি উদ্দেশ্যে করছে, সেটা জানার অধিকার তো আমার আছেই। প্রশ্ন করার অধিকারও আছে। আর কাঠগড়ায় তুলে প্রশ্ন যদি নাও করি, নিদেন পক্ষে, বিস্তারিত অবগত হবার অধিকার তো রয়েছেই। কোনো তাত্ত্বিকের তত্ত্বালোচনার দরকার নেই, নিতান্ত সাধারণ জ্ঞান দিয়ে এটাই তো আমরা বুঝি!

    যাকগে। সরকার যে সংসদে চুক্তিগুলো নিয়ে উম্মুক্ত আলোচনা করেনি, তাতে কিন্তু খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই সেক্টরে সামান্য কিছু গবেষণায় জড়িত থাকার সুযোগ হয়েছিল একসময়। তখন হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করেছি কি পরিমাণ গোপনীয়তার সংস্কৃতি বিরাজ করছে এই পুরো তেল গ্যাস সেক্টরটিতেই। গবেষণার সময় বহুবারই এমন হয়েছে যে – প্রাথমিক বা সরাসরি তথ্য (primary source) হাতে পাওয়া দূরে থাক, এমনকি দূরবর্তী বা কয়েক ধাপ দুরের তথ্যও (tertiary source) কোনভাবে হাতে পেলে নিজেকে রীতিমত ভাগ্যবান মনে হোতো। গোপনীয়তার এই সংস্কৃতি (আমি বলবো ‘অপসংস্কৃতি’) কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিদ্যমান। জ্বালানী ইস্যুগুলোকে সামরিক নিরাপত্তা ইস্যুগুলোর মতো করে দেখবার এই প্রবণতা প্রায় সবখানেই কমবেশী রয়েছে। আমার আশংকা – আগামী দিনগুলোতে, বৈশ্বিক জ্বালানী সংকট, জ্বালানী নিরাপত্তা – ইত্যাদি ইস্যুকে ঘিরে আঁটুনি আরও শক্ত হবে।

    এই গোপনীয়তার সংস্কৃতির মোকাবেলা করতে আজ থেকে প্রায় আট বছর (দশ বছরও হতে পারে) আগে বৈশ্বিক একটা প্লাটফর্ম তৈরী হয়েছে; পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দুই শতাধিক সংগঠনকে পতাকা তলে নিয়ে। এই আন্দোলনটির নাম: “Publish What You Pay Movement”. এরই একটা শাখা হল “Publish What You Earn Campaign”। আমাদের প্রত্যাশা – এমন এক দিন নিশ্চয়ই আসবে যখন এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা কারিগরি দিক থেকে ততোটাই প্রফেশনালিজম অর্জন করবেন‍ যখন তারা বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করে দাবী তুলতে পারবে “Publish How and Where you Spend”।

    এ তো গেল তেল গ্যাস সেক্টরকে ঘিরে গোপনীয়তার সংস্কৃতির কথা। এই সংস্কৃতির অচলায়তন কেবল (পিএসসি) চুক্তির confidentiality clause দিয়েই সংরক্ষিত হয় না, এমনকি রাষ্ট্রীয় আইন (Official Secrets Act) এবং বিভিন্ন প্রথা দিয়েও একে টিকিয়ে রাখা হয়। তেল গ্যাস সেক্টরে প্রচলিত এবং স্বীকৃত বিভিন্ন প্রথাগুলোর (industry practices) কথাও ভুলে গেলে চলবে না। গত একশো বছরে তেল-গ্যাস-খনিজ চুক্তির ধরণে বিবর্তন এসেছে। একসময় ছিল “কনসেশন” ব্যবস্থা (মালিকানা কোম্পানীর, সরকারের শুধু রয়েলটি), এর পর এল “লাইসেন্সিং”। চুক্তির ধরণও বদলেছে। জয়েন্ট ভেন্চার চুক্তি থেকে আজকের ‘পিএসসি’, সেই পিএসসি-ও ষাটের দশকে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে অবধি বহুবার নিজের খোল নলচে বদলেছে। বর্তমানের পিএসসি-গুলো ঠিক কোন জেনারেশনের, সেটা জানতে হলে এখন আবার লাইব্রেরিতে যেতে হবে। তবে ষষ্ঠ জেনারেশনের পরের, সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। এসব উত্থাপন করলাম এ কারণে যে – মালিকানা, ভাগের বন্টন – ইত্যাদি ইস্যুতে বহুবার স্কেলের এদিকে ওদিকে নাড়াচাড়া হয়েছে। জ্বালানী-অর্থনীতির হিসেব নিকেশগুলো‍ যতদূর জানি বেশ জটিল ধরণের। আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে সরকারের কূশীলবরা বিদেশী কোম্পানীগুলোর সাথে বোর্ডরুমে বসে কঠিন দরকষাকষি করার‍ বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা আদৌ রাখেন কিনা। যোগ্য ব্যক্তি যে হাতে গোণা দু’একজন ছিলেন তাঁদের যে প্রতিটি সরকারই তফাতে রেখেছিল, সেটা নিশ্চিত জানি। বেশ কিছু উদাহরনও জানা আছে। আর সরকার এখন যাদের “উপদেশ” নেন তাদের মধ্যে তো তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর মতো মানুষদেরও দেখি। ইনিই কি সেই ব্যক্তি নন যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান আমলা হিসেবে মাগুরছড়া বিস্ফোরনের পরবর্তীতে অত্যন্ত সন্দেহজনক আচরণ করেছিলেন? আমরা তো এখনো ভুলিনি কিভাবে তিনি সংসদীয় কমিটির নথি তলবকে “দুই রত্তির” আমলা (দুঃখিত, এভাবে না লিখে পারলাম না!) হয়েও আটকে দেয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। আবার সে সব করেও বহাল তবিয়তে এখনো পর্যন্ত টিকে আছেন; এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য হচ্ছেন! (দুঃখের বিষয় হল – এই ব্যক্তিটি নাকি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন!!)…

    আলোচনা চলতে থাকুক। পরে আবার সময় করে ঢুঁ দেবো। ধন্যবাদ লেখককে।

  5. মোহাম্মদ মুনিম - ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১২:০২ অপরাহ্ণ)

    তেল গ্যাসের ব্যাপারটি আমি যতদুর বুঝি, তাতে আমার মনে হয় বিদেশী কোন কোম্পানির সাথে চুক্তি করে তাদেরকে দেশী বাজারে আমাদের বেঁধে দেয়া কোন দামে গ্যাস বা তেল সরবরাহে বাধ্য করা সম্ভব নয়। আনু মোহাম্মেদ স্বয়ং যদি তেল কোম্পানী নির্বাচনের দায়িত্বে থাকেন, তাঁর পক্ষেও এ রকম কোন চুক্তি করা সম্ভব নয়। তাঁরা তেল বা গ্যাস উত্তোলন করবে, বাংলাদেশ সরকারকে রয়্যালটি দেওয়ার পর তারা সেই তেল বা গ্যাস বিশ্ববাজারে বিক্রি করবে, যার ক্রেতা বাংলাদেশ সরকার নিজেই হতে পারে। কতখানি রয়্যালটি তারা দেবে, সেটাই দরাদরির ব্যাপার। এছাড়া এই চুক্তিতে মেয়াদ কত বছর, পরিবেশগত কোন ক্ষতি হলে তার দায়বদ্ধতা কতখানি, এসব ব্যাপার আছে। তেল গ্যাস নিয়ে চুক্তি সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে, কোম্পানীগুলোর সাথে দরাদরি করার জন্য ঝানু উকিলরাও আছেন।
    এটা কোন সরকারী সচিবের কাজ নয় তেল কোম্পানীর সাথে চুক্তির সারমর্ম বুঝে তাদের সাথে দরাদরি করা।
    তেল এবং গ্যাস যে কত বড় অভিশাপ হতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরন সম্ভবত নাইজিরিয়া। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সামান্য কিছু উপহার দিয়ে আর সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে দেশটির তেল সম্পদ শুষে খেয়েছে তেল কোম্পানিগুলো। তেলের রয়্যালটি প্রায় পুরোটাই গেছে সেনাবাহিনী আর সরকারি এলিটদের পকেটে। দেশটির অবকাঠামোগত উন্নতি বা দারিদ্রবিমোচন কিছুই হয়নি। সুশাসন এবং জবাবদীহিতা বলতেও কিছু নেই। তেল কোম্পানীগুলো তেল কুপ নিয়ে খেয়াখেয়ি করতে গিয়ে আমাদেরকে অতিদ্রুত নাইজিরিয়ার অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। কোন বিদেশী কোম্পানির সাথে অসম চুক্তি হলে একটা আর্থিক ক্ষতির ব্যাপার থাকে, কিন্তু সেই চুক্তিটি যদি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয়, তাতে সুশাসন এবং জবাবদীহিতার ব্যাপারটি থাকে না, সেটা আরও অনেক বড় ক্ষতি।

  6. অবিশ্রুত - ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৪:০৫ পূর্বাহ্ণ)

    ইতিমধ্যেই আমরা হরতাল পেরিয়ে এসেছি। দেখা যাচ্ছে, হরতালটি তেমন সফলতা পায়নি এই অর্থে যে, যে-সমস্ত ঘটনা ঘটলে মিডিয়া একটি হরতালকে সফল বলে, তেমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি; কেউ নিহত হয়নি, সারা ঢাকায় কোনও ভাংচুর হয়নি; একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, সেজন্য যতদূর জানি, জাতীয় কমিটি দুঃখপ্রকাশ করেছে।
    এরকম ঢিলে তালের হরতাল আওয়ামী লীগও করেছে বিভিন্ন সময়, কিংবা বিএনপিও; কিন্তু অসফলতার দায় শুধু তাদের কাঁধেই চাপে, যাদের সাংগঠনিক পরিসর একটু ছোট। জাতীয় কমিটির ঘাড়েও সেরকম দায় চেপেছে।
    কিন্তু যারা জনজীবনে বিঘ্ন ঘটবে বলে আহাজারি করেছিলেন,আমি নিশ্চিত তাদের আহাজারি বিফলে গেছে। অবশ্য সরকারি-জীবনে বিঘ্ন ঘটেছে, ঘটেছে ব্যবসায়ী-জীবনেও; এবং এ কারণে হরতালের বার্তাটি ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে গেছে। এখন সংসদীয় কমিটিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, তারা জাতীয় কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বসবে; এখন সংসদীয় কমিটিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, তারা সংসদে এটি নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানাবে। অবশ্য এটি সময়ক্ষেপনের চেষ্টা কি না, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়।
    মুনিম ঠিকই বলেছেন, যারা চুক্তি করবেন, তাদের ঝানু পেশাদার হওয়া প্রয়োজন। আনু মুহাম্মদরা ভাল আন্দোলন করতে পারেন, কিন্তু দর কষাকষির টেবিলে ভাল না-ও হতে পারেন। কিন্তু সে-জন্যে আনু মুহাম্মদদের উপহাস করারও কিছু নেই। তাঁরা তাঁদের অবস্থানে থেকে এই চুক্তির নেতিবাচকতা বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করছেন, না হলে তো আমরা টেরও পেতাম না, একটা অসম চুক্তি হয়ে গেছে! মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী সারা জীবন চোখ নিচু করে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন, এখন অবসর জীবনে গিয়ে হাতে কলম তুলে নিয়েছেন, প্রতিবাদ জানাতে মাঠে নেমেছেন; এরকম অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আমরা হাতে গুণতে পারি। এদের এই শেষ বয়সের নিষ্ঠা ও উদ্দীপনা তো এ দেশের অনেক তরুণেরও নেই।
    এ দেশের বর্তমান তরুণদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কিছুদিন আগে মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, এখনকার তরুণরা ক্ষমতায় থাকলে বাঘ, আর ক্ষমতার বাইরে গেলে বেড়াল। বলাই বাহুল্য, তিনি ক্ষমতাসীন ও একদা-ক্ষমতাসীন দলগুলির তরুণ কর্মী নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু মুশকিল হলো, এই তরুণদের সংখ্যাই এখন বেশি।
    জনতার ক্ষোভ উপলব্ধি করার শক্তি অনেকেরই থাকে না। তাই তারা ক্ষুদ্র-কে নিয়ে উপহাস করতে থাকেন, কিন্তু দেখা যায়, কখনও ওই ক্ষুদ্র কত রুদ্র হয়ে জেগে ওঠে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অগাস্ট বিক্ষোভ ঘটবে এটা কে ধারণা করেছিল? সরকার? আওয়ামী লীগ? বিএনপি? না, তারা বিস্মিতই হয়েছিল। এবং নিজেরা যে এ-ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়, তা প্রমাণ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল।
    এত কথা লিখছি, এ-কারণে, জাতীয় কমিটির এই প্রতিবাদকে অনেকেই দেখছি মানতে পারছেন না। এবং তারা তাদের এই না-মানার ক্ষোভ প্রকাশের জন্যে যা বলছেন, তার সারমর্ম হলো, তোমাদের তো হাতে গোণা যায়, তোমরা আর কী ছিড়বে!
    আসলেই হয়তো আমরা ছিঁড়তে পারব না। কিন্তু এটুকু আমরা বলতে পারব, আমরা বিষবৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালিনি।

  7. আরমান রশিদ - ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১:৫৭ অপরাহ্ণ)

    চমৎকার লেখাটার জন্যে লেখককে ধন্যবাদ জানাই। সেই সাথে সব প্রাসঙ্গিক মন্তব্য আর গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্কগুলির জন্য অন্য সবাইকে অভিনন্দন।

    এই যে চুক্তিটির কথা বারংবার বলা হচ্ছে তার কোন কপি কি প্রকাশ করা হয়েছে? কেউ কি জানাবেন কোথায় চুক্তিটি পেতে পারি?

  8. রায়হান রশিদ - ২৯ অক্টোবর ২০০৯ (৪:১১ অপরাহ্ণ)

    অফ্-শোর তেল গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, চুক্তির মান এবং হরতাল নিয়ে এখানেও কিছু আলোচনা চলছে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.