যুদ্ধ হলো রক্তপাতময় রাজনীতি, রাজনীতি হলো রক্তপাতহীন যুদ্ধ…

‘যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর রাজনীতিকরণ’ বলতে ঠিক কী বোঝায় আসলে?
গত বছর বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকেই এরকম একটি বিষয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সবাইকে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একটি অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচনের সময় স্বাধীনতাবিরোধীরা তেমন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে আর তখন থেকেই কেউ কেউ ছবক দিতে শুরু করেছেন, বিষয়টির ‘রাজনীতিকরণ’ ঠিক হবে না।
লক্ষণীয় বিষয়, এ কথা যারা বলছেন, তারা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক দলের সদস্য। আর কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী যখন একটি ইস্যু সম্পর্কে মন্তব্য করেন, নিঃসন্দেহে তাতে একটি রাজনৈতিক বার্তা থাকে এবং সেকারণে এর রাজনৈতিক একটি মাত্রাও থাকে। এরকম কথা বলার মধ্যে দিয়ে প্রকারান্তরে জনগণের সবার কাছে একটি রাজনৈতিক বার্তাই পৌঁছে দেয়া হয়। লোকে বলে, ‘জ্ঞানী বোঝে ইশারা পেলে, মুর্খ বোঝে অণ্ডকোষে লাথি পড়লে।’ জ্ঞানী কিংবা মুর্খ, আমাদের যেটাই ভাবা হোক না কেন, যুদ্ধাপরাধের শিকার একটি জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে একটা বার্তাই পাই আমরা তাঁদের ওই দাবির মধ্যে থেকে। সে-বার্তাটি হলো : তাদের দলের কাউকে যেন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত না করা হয়, শাস্তি দেয়া না হয়। এ-বার্তার আরেকটি অর্থ হলো, সত্যিকার যুদ্ধাপরাধী কাউকেও যদি অভিযুক্ত করা হয় তা হলে তা ‘যুদ্ধাপরাধের রাজনীতিকরণ’ হবে, কেননা তিনি তাদের দলীয় নেতা, কেননা তিনি তাদের রাজনৈতিক মিত্র।

স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীরা যুদ্ধের সময়েও কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল অথবা সরকারের আজ্ঞাবহ ছিল। যুদ্ধের পর তাদের অবস্থানগত সংকট প্রকট হয়ে ওঠে এবং নিজেদের গরজেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি সরকারি দল আওয়ামী লীগেও এদের অনেক আশ্রয় নিয়েছেন তখন, তারও চেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও ভাসানী ন্যাপে। কারণ বেঁচে থাকার জন্যে, নিরাপদ থাকার জন্যে একটি অবস্থান দরকার হয় তাদের সবার; আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় সেই অবস্থান রাজনৈতিক হলে। মানবতার বিরুদ্ধে যে-অপরাধ করা হয়, তা ঢাকার জন্যে এর চেয়ে বড় বর্ম আর কিইবা হতে পারে! ১৯৭৫ সালের পর এরা রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার পায়। তখন এদের কপাল খুলে যায়।
এখন, যারা বলছেন যে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর রাজনৈতিকীকরণ ঠিক হবে না, তারা নিজেরাই যে ইস্যুটি নিয়ে রাজনীতির জল ঘোলা করছেন, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক দেনদরবারও শুরু করেছেন, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ মেলে তিনটি ঘটনায়।

প্রথম ঘটনাটি হলো, এ ধরনের বিচারপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান। ফেব্রুয়ারিতে দূত পাঠিয়ে পাকিস্তান এ ব্যাপারে প্রথমে বাংলাদেশকে সতর্ক করার চেষ্টা করে। পাকিস্তানের বিশেষ দূত মির্জা জিয়া ইস্পাহানী তখন সাংবাদিকদের কাছে বলেও যান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উপযুক্ত সময় এটি নয়। এরপর জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ হোসেন হারুন তাদের সরকারের ‘উদ্বেগের’ কথা জানিয়ে জাতিসংঘের প্রতি লিখিতভাবে আহ্বান জানায় ‘এরকম একটি স্পর্শকাতর’ ইস্যুতে জাতিসংঘকে না জড়ানোর। পাকিস্তানের এ ধরণের জঘন্য আন্তর্জাতিক তৎপরতায় অবশ্য বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলিকে বিমর্ষ মনে হয়নি।

দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, গত ৫-৭ মে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার এক বৈঠক হয় আল কায়েদাকে পরাস্ত করা ও প্রত্যেক দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন কৌশল নিয়ে। এই আলোচনার পরেই ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হোসেইন হাক্কানী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবিরের সঙ্গে বৈঠক করেন, যে বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয়সূচি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশের তৎপরতা। এ ব্যাপারে ২০ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব তৌহিদ হাসানের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির লিখেছেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় তার কাছে মনে হয়েছে যে, এটি একটি পুরানো অধ্যায় এবং এ ধরণের উদ্যোগ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে শীতল করতে পারে।
তৃতীয় ঘটনাটি হলো, গত ১৫ জুন মাত্র দুইদিনের জন্যে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক। ফিরে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের জানিয়ে গেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি ‘রাজনীতিকরণ করা’ ঠিক নয়। ‘কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে দুর্বল ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মসূচি সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা উচিত হবে না’ বলে মত দেন তিনি। ওই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি জবাবদিহিতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে,- যদিও ইরাক, আফগানিস্তানসহ পৃথিবীর অসংখ্য দেশে গণহত্যার জন্যে তাদের কোনও জবাবদিহির প্রয়োজন পড়ে না বলেই জানি আমরা। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সরকারের সঙ্গে তার আলোচনার বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, তিনি একে রাজনৈতিক ইস্যু না করার জন্য সরকার পক্ষকে আহবান জানিয়েছেন।
কেন যুক্তরাষ্ট্রের এই পাতিমন্ত্রীর মনে হলো যে, বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটিকে রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে? কারণ বাংলাদেশের কেউ কেউ তাই মনে করছেন এবং পাকিস্তানও তাই মনে করছে। আর কে না জানে, এই ত্রয়ী অপশক্তির সম্মিলনেই ১৯৭১-এ গড়ে উঠেছিল একটি অক্ষজোট, যারা চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

পত্রিকাতে খবর বেরিয়েছে, জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ হোসেন হারুন সেখানকার বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন, যাতে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সহায়তা করতে দ্বিধান্বিত হয় অথবা এ-সংক্রান্ত বিচারকাজে এমন ভূমিকা পালন করে, যাতে ‘বেনিফিট অব ডাউট’-এর ফাঁক গলিয়ে উতরে যায় যুদ্ধাপরাধীরা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ স্থায়ী মিশন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো রিপোর্টে পাকিস্তানের এসব কর্মতৎপরতা তুলে ধরা হয়েছে। পাকিস্তান জাতিসংঘের কাছে এরকম যুক্তিও দেখাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সেসময় পাকিস্তানের অঙ্গরাষ্ট্র ছিল এবং অঙ্গরাজ্যের নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনও অভিযান যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। আর এটিকে যদি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনাই করা হয়, তা হলে সোয়াত উপত্যকায় পাকিস্তান যে-জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে, সে অভিযানকেও কেউ ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।

পাকিস্তানের এই যুক্তি বোধকরি যুক্তরাষ্ট্রেরও মনে ধরেছে। নইলে খবরটি প্রকাশে কয়েকদিন পরেই রবার্ট ও ব্লেক কেন দু’দিনের জন্যে বাংলাদেশে যাবেন এবং ছবক দেবেন, বলুন?
তা হলে দেখা যাচ্ছে, আমরা চাই বা না-চাই, যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুটি রাজনীতির বাইরে থাকতে পারছে না। দেশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে এর পরিধি। আর আমরা তীব্রভাবে অনুভব করতে পারছি মাওসেতুং-এর একটি কথার সত্যতা। মাওসেতুং বলেছিলেন,- যুদ্ধ হলো রক্তপাতময় রাজনীতি আর রাজনীতি হলো রক্তপাতহীন যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে আমরা একটি রক্তপাতময় রাজনীতি করেছি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলো সেই রাজনীতির ফসল। অনেকেই আছেন, যারা মনে করেন, এটি ছিল গৃহযুদ্ধ; যে-বিবেচনা থেকে তারা ওই কথাটি বলেন, সেই নিরিখে তা হলে পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধই আর স্বাধীনতার যুদ্ধের পর্যায়ে পড়ে না। পাকিস্তান এখন বুঝাতে চাইছে, ১৯৭১-এর সময়টি ছিল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা; কিন্তু কে না জানে ওই অমোঘ সত্যটি,- বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকেই দেখা দেয় গুণগত পরিবর্তন? ডিম ভাঙলে তো কুসুম আর শাদা পদার্থ ছাড়া আর কিছুই আমাদের চোখে পড়ে না; অথচ সেই ডিমই একটি নির্দিষ্ট তাপে একসময় জীবন্ত ছানা হয়ে বেরিয়ে আসে। আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল ওই জীবন্ত ছানা বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা। যারা সেই রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ায় বাধা দিতে চেয়েছে, তারা এটিকে গৃহযুদ্ধ বললেই কি তা গৃহযুদ্ধ হয়ে যায়? যে-যুদ্ধের শুরুই হয়েছে নতুন গৃহ প্রতিস্থাপনের উদ্দেশে, সে যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে কেবল তারাই, যারা যুদ্ধের মাধ্যমে চেয়েছিল পুরানো গৃহটিকেই বিদ্রোহীদের ওপর চাপিয়ে দিতে। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। অতএব ওই যুদ্ধকে আর কোনওভাবেই গৃহযুদ্ধ বলা যায় না, এটি একটি যুদ্ধ, রক্তপাতময় রাজনীতি। এটিকে দুই ভাইয়ের বিবাদও বলা যায় না, এটি পৃথক-পৃথক জাতি-রাষ্ট্রীয়-নাগরিক সত্ত্বার সংঘাত, যার জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে লাখ লাখ মুক্তিকামী বাংলাদেশিকে, হাজার হাজার ভারতীয় সৈনিককে।
যুদ্ধাপরাধ যারা করেছিল, তারা তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বাধীনতার পর প্রথমেই দু’টি বিষয় প্রচারণায় নিয়ে আসে। একটি হলো, ভারত তার নিজস্ব স্বার্থ থেকে এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। তাদের প্রচারণার দ্বিতীয় অংশটি ছিল, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হয়েছে; এ যুদ্ধে মোটেও ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়নি, যেন ৩০ লাখের বদলে তিন হাজার মানুষ শহীদ হলেই পাকিস্তানীদের ওই গণহত্যা হালাল হয়ে যায়!
প্রথম প্রচারণাটি খেয়াল করুন,- এই প্রচারণার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত-যে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, আমাদের বন্ধু হিসেবে সহায়তা করেছিল সেটি ভুলে যাওয়ার ও ইতিহাসগত দিক থেকে অকৃতজ্ঞ হওয়ার মনস্তত্ব তৈরির অপচেষ্টা করা হয়েছে। ভারত একটি আলাদা রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করার পেছনে নিশ্চয়ই তাদের একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, বাংলাদেশের মানুষই চেয়েছিল বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র হোক; বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে না নামলে কি ভারতের পক্ষে কখনো সম্ভব হতো বাংলাদেশকে যুদ্ধের জন্যে সহযোগিতা করা? কোটি শরণার্থী মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে, এর জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরেও কি শেখ মুজিবুর রহমান ফিরিয়ে দেননি ভারতীয় সৈনিকদের বাংলাদেশের মাটি থেকে? ‘বাংলাদেশ আলাদা হলে পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়বে বলেই ভারত যুদ্ধে সাহায্য করেছে’ বলে কি প্রকারান্তরে বাংলাদেশের মানুষদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকেই ছোট করে দেখা হয় না? প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ওয়ারসিমেট্রিগুলিতে গেলে হাজার হাজার নিহত যোদ্ধার ভিড়ে আমরা ভারতীয় যোদ্ধারও নাম পাই, ওই নামগুলি রাখতে ইংরেজরা তো কুণ্ঠিত হয় না, অথচ আমাদের লাখ লাখ শহীদের ভিড়ে আমাদেরই জন্যে শহীদ ভারতীয়দের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে এরকম একটি বাক্যের প্রয়োগ যারা করতে পারেন, তারা আসলে কোন জাতের মানুষ, আপনারাই বলুন!
এবার দ্বিতীয় প্রচারণাটি খেয়াল করুন। এর আরেক অর্থ শহীদদের নিছক সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে উপহাস করা। তা ছাড়া প্রকৃত সত্যও গোপন করা। বিষয়গুলি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন তরুণ গবেষণার ভিত্তিতে আলোচনা করেছেন। আমি সেসব লেখা থেকেই কিছু তথ্য নিয়ে কয়েকটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করব। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে একদল বুদ্ধিজীবীর প্রকাশ ঘটেছে, যাদের কাজই হলো বিশ্বে সংগঠিত গণহত্যা বা হলোকস্টগুলিকে হেয় করে দেখা। বিভিন্ন গণহত্যাকে যারা অতীতে সমর্থন করেছেন, যারা সেসবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা এবং তাদের উত্তরাধিকাররা অলিখিত এক সমঝোতার ভিত্তিতে, কেউ আবার নতুন রাজনৈতিক স্বার্থে এই গবেষণাগুলি করে চলেছেন। এই বুদ্ধিজীবীদের দলে রয়েছেন ইরানের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমেদিনেজাদ, ডেভিন হগান, ভেডিভ আরভিং, বার্নার্ড লুইস, গুন্টার লিউই, জাসটিন ম্যাককার্থি, সিমোন পেরেস, ব্যাডলি স্মিথ থেকে শুরু করে ভারতের শর্মিলা বোস পর্যন্ত বিভিন্নজন। রাষ্ট্রপতি আহমেদিনেজাদ কয়েক বছর আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, সময় এসেছে ইহুদি হলোকস্টকে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার। কী সেই ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি? না, ঘটনাটি যে অতিরঞ্জন, সেটিই এখন তুলে ধরতে হবে। প্রশ্ন হলো, প্যালেস্টাইন, ইরান, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে যে গণহত্যা চলছে সেটিকে বড় করে দেখার জন্যে কি আদৌ ইহুদি হলোকস্টকে ছোট করে দেখার প্রয়োজন রয়েছে? কিন্তু সত্য উদ্‌ঘাটনের নামে সেটিই করছেন আহমেদিনেজাদ। কেননা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তেমন ইহুদি মারা যায়নি এটি দেখানোর মধ্যে দিয়ে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইসরাইলকেই ঘায়েল করা যায় না, সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও তুলে ধরা যায় যে তারা ইতিহাস ও তথ্য বিকৃত করছেন!
শর্মিলা বোসের মিশনও একই রকম। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধে শহীদ ও ধর্ষিতার সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। অথচ জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা অনেক আগেই ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের ভোটারের সংখ্যার পার্থক্য থেকে, মুক্তিযুদ্ধের আগের ও পরের আদমশুমারী ও জনসংখ্যার হারবৃদ্ধির প্রবণতা পর্যালোচনা করে প্রমাণ করেছেন, ৩০ লাখ মানুষ-যে গণহত্যার শিকার হয়েছে, বাংলাদেশের এই দাবি মোটেও অমূলক নয়। একইভাবে ইতিহাসবিদরা এ-ও বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের যুদ্ধকালীন সময়ের নিরিখে পাকিস্তানের ৯০ হাজার সদস্যের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে বাংলাদেশে ওই নারীধর্ষণ ঘটানোর তথ্য সঠিক। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে নারী ধর্ষণের সাম্প্রতিক ভয়াবহ ঘটনাগুলি ঘটে রুয়ান্ডাতে। সেখানে মাত্র ১০০ দিনে আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ নারী ধর্ষিতা হন। কিন্তু শর্মিলা বোস তার গবেষণায় প্রথমেই যে কাজটি করেছেন, তা হলো, যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনা সদস্যের সংখ্যা কমিয়ে দেখিয়েছেন!
তা হলে নেতাজি সুভাষ বোসের আত্মীয়া শর্মিলা বোস এরকম দাবি করছেন কেন? এর জন্যে আরেকটি তথ্য জানা জরুরি : শর্মিলা বোস যখন ওই গবেষণাকর্ম করছিলেন, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল জোট সরকার আর শিল্পমন্ত্রী ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। এই শিল্পমন্ত্রীর পিছনে একটি বিনিয়োগ চুক্তির জন্যে ঘুর ঘুর করছিল টাটা কোম্পানী। আর ওই টাটা কোম্পানির ব্রিটিশম্যান, টাটা সনস-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, টাটা গ্রুপ সেন্টারের অন্যতম সদস্য ডিরেক্টর ছিলেন অ্যানাল রোসলিং,- যিনি শর্মিলা বোসের স্বামী।
এ প্রসঙ্গে একটি বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘শর্মিলা বোসের একাডেমিক জ্ঞানচর্চা ও সাংবাদিকতার অনেকটাই নাকি হয়ে থাকে তাঁর স্বামী অ্যানাল’এর কোম্পানি স্বার্থে। জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিজামী কেন টাটার বিনিয়োগপ্রস্তাবকে সমর্থন করবেন না, যদি মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও ধর্ষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নিশ্চয়তা দেয়া হয় টাটার পক্ষ থেকে?’’
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
এখন, আপনারাই বলুন, ‘যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটির রাজনীতিকরণ’ আসলে কী? আর কারাই বা সেটা করছে? ১৯৭১ সালে আমরা রক্তপাতময় রাজনীতি করেছি, এখনও কি সময় আসেনি রক্তপাতহীন যুদ্ধ করার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার?

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

৭ comments

  1. রেজাউল করিম সুমন - ৭ জুলাই ২০০৯ (১২:২১ অপরাহ্ণ)

    … শর্মিলা বোস তার গবেষণায় প্রথমেই যে কাজটি করেছেন, তা হলো, যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনা সদস্যের সংখ্যা কমিয়ে দেখিয়েছেন!
    তা হলে নেতাজি সুভাষ বোসের আত্মীয়া শর্মিলা বোস এরকম দাবি করছেন কেন? এর জন্যে আরেকটি তথ্য জানা জরুরি : শর্মিলা বোস যখন ওই গবেষণাকর্ম করছিলেন, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল জোট সরকার আর শিল্পমন্ত্রী ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। এই শিল্পমন্ত্রীর পিছনে একটি বিনিয়োগ চুক্তির জন্যে ঘুর ঘুর করছিল টাটা কোম্পানী। আর ওই টাটা কোম্পানির ব্রিটিশম্যান, টাটা সনস-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, টাটা গ্রুপ সেন্টারের অন্যতম সদস্য ডিরেক্টর ছিলেন অ্যানাল রোসলিং, — যিনি শর্মিলা বোসের স্বামী।
    এ প্রসঙ্গে একটি বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘শর্মিলা বোসের একাডেমিক জ্ঞানচর্চা ও সাংবাদিকতার অনেকটাই নাকি হয়ে থাকে তাঁর স্বামী অ্যানাল’এর কোম্পানি স্বার্থে। জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিজামী কেন টাটার বিনিয়োগপ্রস্তাবকে সমর্থন করবেন না, যদি মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও ধর্ষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নিশ্চয়তা দেয়া হয় টাটার পক্ষ থেকে?’’

    শর্মিলা বসুর গবেষণা-উপাত্ত, টাটার বিনিয়োগ-প্রস্তাব আর যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর ‘রাজনীতিকরণ’ তত্ত্ব – এই তিনের অদৃশ্য যোগসূত্রটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

    ‘রক্তপাতহীন যুদ্ধ’র কোনো বিকল্প নেই আমাদের সামনে।

  2. Mohammed Munim - ৮ জুলাই ২০০৯ (১১:০০ অপরাহ্ণ)

    In recent past, several people were prosecuted and still being prosecuted in international court with charges of crimes against humanity. Rwandan genocide was not part of a war, but charges were brought and justice was delivered.
    It does not matter whether our liberation war was a classical war between two nations or a civil war. Millions were killed, hundreds of thousands were raped and perpetrators went unpunished and some of them are still active in BD politics.
    I think the AL should make hard effort to take the cases to international court. It’s not about hanging or imprisoning few old people like Nizami or Golam Azam, it’s about killing their ideology. The longer the trial, the longer people will know about their crimes. Jamaat recruitment will stop and Jamaat politics will either die or become a fringe movement.

    • অবিশ্রুত - ১১ জুলাই ২০০৯ (১২:০২ অপরাহ্ণ)

      আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,- তা হলে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করার বদলে আমরা কেবল তাদের আদর্শের বিরোধিতা করতে থাকব, এবং এ টুকুই যথেষ্ট হবে? ট্রায়াল যত দীর্ঘমেয়াদী হবে, তাদের সম্পর্কে মানুষ তত বেশি জানবে,- তার মানে কি এই যে, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব বিচারপ্রক্রিয়া অযথাই দীর্ঘমেয়াদী করতে, যাতে যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ সম্পর্কে মানুষজন জানতে থাকে এবং জামাতের রিক্রুটমেন্ট কমতে থাকে এবং সেই সূত্রে তাদের আদর্শের মৃত্যু ঘটে (মানে, আপনার মন্তব্য অনুযায়ী)?
      আমার মনে হয়, এর মাধ্যমে বরং ছাড় দেয়াই হবে এবং কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাই যদি হতো, ৩৮ বছর ধরে তো বিচার হয়নি, এবং এ সময়ে জামাত দলগতভাবে, তাদের নেতারা ব্যক্তিগতভাবে কত অপরাধ করেছে তাও কম উন্মোচিত হয়নি। শুধু তাই নয়, নব্য জামাতীদের নৃশংসতাও তো এ জাতি কম দেখেনি। সেই হিসাবে এতদিনে তো জামাত নামের দলটির রিক্রুটমেন্ট শূন্য হওয়ার কথা। সেটি তো হয়ই নি, বরং এবার সারা দেশে জামাতের সংগঠন শিবির সারা দেশে ঘটা করে এসএসসি-র মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের অভ্যর্থনা দিয়েছে, রজনীগন্ধা ও মিষ্টি পৌঁছে দিয়েছে সবার বাড়ি বাড়ি। আমি একজনের কথাও সংবাদপত্রে পড়িনি যে অথবা যার পরিবার ওই রজনীগন্ধা ও মিষ্টি প্রত্যাখ্যান করেছে!
      তারচেয়ে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত হোক, এটাই কাম্য আমাদের। আদর্শের মৃত্যুর স্বার্থেও তা খুবই জরুরি।

  3. শামীম ইফতেখার - ১০ জুলাই ২০০৯ (১০:৫৪ অপরাহ্ণ)

    ধন্যবাদ অবিশ্রুত। নীচে উদ্ধৃত আপনার বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত।

    পাকিস্তান জাতিসংঘের কাছে এরকম যুক্তিও দেখাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সেসময় পাকিস্তানের অঙ্গরাষ্ট্র ছিল এবং অঙ্গরাজ্যের নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনও অভিযান যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। আর এটিকে যদি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনাই করা হয়, তা হলে সোয়াত উপত্যকায় পাকিস্তান যে-জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে, সে অভিযানকেও কেউ ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। পাকিস্তানের এই যুক্তি বোধকরি যুক্তরাষ্ট্রেরও মনে ধরেছে। … ১৯৭১ সালে আমরা একটি রক্তপাতময় রাজনীতি করেছি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলো সেই রাজনীতির ফসল। অনেকেই আছেন, যারা মনে করেন, এটি ছিল গৃহযুদ্ধ; যে-বিবেচনা থেকে তারা ওই কথাটি বলেন, সেই নিরিখে তা হলে পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধই আর স্বাধীনতার যুদ্ধের পর্যায়ে পড়ে না। পাকিস্তান এখন বুঝাতে চাইছে, ১৯৭১-এর সময়টি ছিল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা; কিন্তু কে না জানে ওই অমোঘ সত্যটি,- বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকেই দেখা দেয় গুণগত পরিবর্তন? ডিম ভাঙলে তো কুসুম আর শাদা পদার্থ ছাড়া আর কিছুই আমাদের চোখে পড়ে না; অথচ সেই ডিমই একটি নির্দিষ্ট তাপে একসময় জীবন্ত ছানা হয়ে বেরিয়ে আসে। আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল ওই জীবন্ত ছানা বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা। যারা সেই রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ায় বাধা দিতে চেয়েছে, তারা এটিকে গৃহযুদ্ধ বললেই কি তা গৃহযুদ্ধ হয়ে যায়? যে-যুদ্ধের শুরুই হয়েছে নতুন গৃহ প্রতিস্থাপনের উদ্দেশে, সে যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে কেবল তারাই, যারা যুদ্ধের মাধ্যমে চেয়েছিল পুরানো গৃহটিকেই বিদ্রোহীদের ওপর চাপিয়ে দিতে। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। অতএব ওই যুদ্ধকে আর কোনওভাবেই গৃহযুদ্ধ বলা যায় না, এটি একটি যুদ্ধ, রক্তপাতময় রাজনীতি। এটিকে দুই ভাইয়ের বিবাদও বলা যায় না, এটি পৃথক-পৃথক জাতি-রাষ্ট্রীয়-নাগরিক সত্ত্বার সংঘাত, যার জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে লাখ লাখ মুক্তিকামী বাংলাদেশিকে, হাজার হাজার ভারতীয় সৈনিককে।

    গুগলে এ ১৯৭১ কে গৃহযুদ্ধের আলোকে দেখানো লেখাগুলোকে খুঁজতে গিয়ে তথাকথিত প্রগতিশীল শিবিরের কয়েকজনকেও পেলাম সেখানে। ২০০৮ সালে ভারত থেকে প্রকাশিত Economic & Political Weekly জার্ণালে (VOL 43 No. 04 January 26 – February 01, 2008) দেখতে পাচ্ছি নাঈম মোহাইমেন এর তেমনই একটি লেখা যেটির শিরোনাম: “Accelerated Media and the 1971 Civil War in Bangladesh”। লেখাটিতে শিরোনাম ছাড়াও ভেতরে সর্বমোট ৮ বার ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে “civil war” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য একটি সাইটেও (সম্ভবত লেখকের নিজের) শিরোনাম ঈষৎ পরিবর্তন করে একই লেখার একটি বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে “civil war” ব্যবহার করা হয়েছে সর্বমোট ২৩ বার। এই ২৩ বারের মধ্যে সবচেয়ে চমকে যাওয়ার মত প্রয়োগগুলো এরকম (যেগুলো জার্ণালের লেখাটিতেও বর্তমান):

    1. “By contrast, when the Bangladesh civil war began…”
    2. “The 1971 civil war and subsequent genocide in Bangladesh…”
    3. “When the 1971 civil war broke out…”
    4. “In the matter of establishing India’s right to intervene in the civil war…”
    5. “Bangladesh’s first years were plagued by all the unresolved tensions of the 1971 civil war…”
    6. “…several key trends emerged in coverage of the Bangladesh civil war…”

    জার্ণালটির পরবর্তী সংখ্যায় লেখকের একটি প্রতিবাদপত্র অবশ্য ছাপানো হয়েছিল দেখা যাচ্ছে – শিরোনাম সংশোধন বিষয়কে কেন্দ্র করে। কিন্তু মূল লেখার কলেবরে ৮ বার “গৃহযুদ্ধ” বাধানোর, কিংবা অন্য সাইটে পূনঃপ্রকাশিত লেখায় ২৩ বার একই কান্ড করার কোন ব্যাখ্যা মিলছে না। জার্ণালে ছাপানো মূল লেখাটি এখান থেকে ডাউনলোড করে নেয়া যাবে। চিন্তিত হবার মত ব্যাপার এগুলো।
    [লেখাটি আপলোড করতে পারছি না। ইমেইল দিয়েছি]

    • অবিশ্রুত - ১১ জুলাই ২০০৯ (১২:১০ অপরাহ্ণ)

      বোঝা যাচ্ছে, অনেক এলেমদার মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে! এর আগের মন্তব্যটি পড়ুন, সেখানেও বলা হয়েছে, এটি দু জাতির লড়াই ছিল কি না, গৃহযুদ্ধ ছিল কি না, এগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়!
      হায় বাকস্বাধীনতা! তথ্য জানবার ও জানাবার স্বাধীনতা!

  4. রায়হান রশিদ - ১১ জুলাই ২০০৯ (২:৩০ অপরাহ্ণ)

    @ অবিশ্রুত # ৩.১

    এটি দু জাতির লড়াই ছিল কি না, গৃহযুদ্ধ ছিল কি না, এগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়!

    সাধারণ বিচারে এই পার্থক্যগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ না, দ্বিমত নেই তাতে। কিন্তু আরেকটু গভীর বিচারে, বিশেষতঃ আইনগত ফলাফল বিচারে বিষয়গুলোর কিছুটা গুরুত্ব তো আছেই। কারণ, আইনের দৃষ্টিতে – কোনটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, কোনটা গৃহযুদ্ধ, কোনটা বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ, কোনটা সমাজ পাল্টে দেয়া বিপ্লব – তার ওপর নির্ভর করে বদলে যায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অধিকার, দায়, দায়বদ্ধতা এবং বিচারিক বিষয়গুলো। আইনের কথাটা তুললাম, কারণ, ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি এখন কিন্তু আর সভা সেমিনারের এক দফা দাবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সত্যিকারের বিচার প্রক্রিয়ার চাকাগুলো এখন বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে শুরু করেছে, গভীর বিষয়গুলো ধীরে ধীরে উঠে আসছে উপরিতলে। আর আমরা যাই বলি না কেন, অভিযুক্ত গোষ্ঠীরা কিন্তু বহু আগে থেকেই সংজ্ঞা এবং আইনের এই সব জটিল পার্থক্যগুলোর ব্যাপারে সচেতন হয়েছে; অন্তত অবস্থাদৃষ্টে তা-ই মনে হয়। শর্মিলা নিজামী রাজ্জাক থেকে শুরু করে এঁদের সবার সুরে কিন্তু কখনোই লক্ষনীয় কোন পার্থক্য চোখে পড়েনি, বিশেষ করে জরুরী সংজ্ঞাগত বিষয়গুলোর ব্যাপারে।

    এই সব সংজ্ঞাগত পার্থক্যের গুরুত্বের ব্যাপারে আরও জানতে এই বই দু’টোতে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয়া যেতে পারে:

    ১. Liberation struggles in international law
    By Christopher O. Quaye

    ২. International law and the use of force by national liberation movements
    By Heather A. Wilson

    দু’টো বই‌-ই গুগলে বেশ অনেকটুকু পড়ে নেয়া যাবে, বিনামূল্যে। লিন্ক দিয়ে দেয়া হল। এ সব বিষয়ে আরও আলোচনা হওয়া দরকার আসলে।

    অনেক ধন্যবাদ যুদ্ধাপরাধের বিচারের সাথে রাজনীতির অমোঘ যোগসূত্রের মত এমন একটি সময়োপযোগী বিষয় নিয়ে লিখবার জন্য।

  5. Mohammed Munim - ১৩ জুলাই ২০০৯ (১১:৪০ অপরাহ্ণ)

    আমি বলতে চেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের তাত্ত্বিক সংজ্ঞা ‘যুদ্ধ’ না হয়ে ‘গৃহযুদ্ধ’ হলে পাকিস্তানিদের বা জামাতিদের পাপের বোঝা হালকা হয়ে যায়না। ১৯৭১ এ তারা যেটা করেছে সেটা ethnic cleansing এবং জামাতিদের এতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল, এটাই হওয়া উচিত বিচারের মুল বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের তাত্ত্বিক সংজ্ঞা নয়।
    জামাতি আদর্শের মৃত্যু না হবার কারন আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারার দুটি দলই জামাতের pivotal position কে ব্যবহার করেছে, প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে। ১৯৯৩ সালে শেখ হাসিনা নিজামি আর জাতীয় পার্টির এক নেতাকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেন, সেটা নিয়ে খালেদা জিয়ার কাব্যিক মন্তব্যটি এখনো মনে আছে (ওদের ডানে রাজাকার, বামে স্বৈরাচার, সামনে অন্ধকার)। ২০০১ এ নিজামিকে খালেদা জিয়া মন্ত্রীত্ব দিলেন। SSC পাশ করা অবোধ কিশোরেরা আর তাদের ছা পোষা মা বাবারা কোন ভরসায় বা কার ভরসায় রজনীগন্ধা প্রত্যাখান করবে?
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রীটিশরা বলল জার্মান সেনাবাহিনীর ঊচুঁ পর্যায়ের সবাইকে মেরে ফেলতে, স্তালিন আগ বাড়িয়ে বললেন মোটামুটি ১ লাখ জার্মান মেরে ফেলা দরকার, রুজভেল্ট রসিকতা করে বললেন, ৪৯ হাজার মারলেই হবে। শেষে নূর‌্যেমবার্গে বিচার হলো মোটে ২২ জনের। তাদের কেউই হয়ত নিজ হাতে একটা খুন ও করেনি, কিন্তু ওরাই ছিলো মুল হোতা। যেমন ছিলো গোলাম আযম আর নিজামি। জামাতের শীর্ষ দশ নেতা আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, আর শিবির লোকজনকে রজনীগন্ধা পাঠাচ্ছে, এটার সম্ভাবনা খুব বেশী নয়। জামাতের বিরুদ্ধে রাজপথের লড়াই অনেক হয়েছে, আইনী লড়াই খুব বেশী হয়নি, এটা হওয়া খুব জরুরী।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.