ঘর পোড়ানো আগুনে আলু পোড়াবার ধুম!

মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হরিশ গোহিলকে জড়িয়ে কাঁদছে তার বোন নিতা।মুম্বাইয়ের রক্তপাত আমাদের যত হতবিহ্বল ও কাতরই করুক - ভারতের শাসকচক্রের চোখের কোণে একইসঙ্গে জেগে উঠেছে আশার আলো। কেননা এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের সূত্র ধরে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি শেষ পর্যন্ত তার আকাঙ্ক্ষিত চরিত্র পেতে চলেছে। ভারত এবার লাগসই সুযোগ পেয়েছে তার পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজানোর। যে-পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সুপ্ত বাসনা দেশটির শাসকচক্র দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন, এবার তারা পারবেন সেই পররাষ্ট্রনীতিটি বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসতে। কেননা এই পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা দাঁড় করাবার জন্যে তাদের প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি টু-ইন টাওয়ার ধ্বংসকারী নাইন-ইলেভেনের। ২৬ নভেম্বর থেকে টানা চারদিন মুম্বাইয়ে যে-সন্ত্রাসী তাণ্ডব সংঘটিত হলো, তারপর আমরা বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি, এবার তারা সেরকম একটি নাইন-ইলেভেন পেয়েছেন, কিংবা তাদের হাতে সেটি তুলে দেয়া হয়েছে। [. . . ]

মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হরিশ গোহিলকে জড়িয়ে কাঁদছে তার বোন নিতা।

মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হরিশ গোহিলকে জড়িয়ে কাঁদছে তার বোন নিতা

মুম্বাইয়ের রক্তপাত আমাদের যত হতবিহ্বল ও কাতরই করুক – ভারতের শাসকচক্রের চোখের কোণে একইসঙ্গে জেগে উঠেছে আশার আলো। কেননা এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের সূত্র ধরে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি শেষ পর্যন্ত তার আকাঙ্ক্ষিত চরিত্র পেতে চলেছে। ভারত এবার লাগসই সুযোগ পেয়েছে তার পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজানোর। যে-পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সুপ্ত বাসনা দেশটির শাসকচক্র দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন, এবার তারা পারবেন সেই পররাষ্ট্রনীতিটি বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসতে। কেননা এই পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা দাঁড় করাবার জন্যে তাদের প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি টু-ইন টাওয়ার ধ্বংসকারী নাইন-ইলেভেনের। ২৬ নভেম্বর থেকে টানা চারদিন মুম্বাইয়ে যে-সন্ত্রাসী তাণ্ডব সংঘটিত হলো, তারপর আমরা বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি, এবার তারা সেরকম একটি নাইন-ইলেভেন পেয়েছেন, কিংবা তাদের হাতে সেটি তুলে দেয়া হয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী ২৭ নভেম্বর বৃহষ্পতিবার থেকে যে-ভাষায় কথা বলছেন, কয়েকদিন আগেও সেটি চিন্তা করা যেত না। মুসলিম জঙ্গিদের এই হামলার ঘটনা ঘটলো ঠিক তখুনি, যার কিছুদিন আগে ভারতে হিন্দু জঙ্গি গোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সরকারিভাবেই অনুমান করা হয়েছে, যে-সব ভয়াবহ বোমা হামলার জন্যে এতদিন মুসলিম জঙ্গি মৌলবাদীদের দায়ী করা হয়েছে, সেগুলোর কোনও-কোনওটি সম্ভবত ওই হিন্দু সন্ত্রাসী চক্রের সংঘটিত কাজ। দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সূত্র থেকে গত ২৩ নভেম্বর যতদূর জানা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের মুসলিম অধ্যুষিত শহর মালেগাঁ-র কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনার সূত্র থেকে কমপক্ষে ১০ জন এ-ধরনের জঙ্গি হিন্দু সন্ত্রাসীকে ধরা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ধারণা করছে, এবং এই ধারণা প্রকাশ পাওয়ার পর সেখানকার বিজেপি নামের মৌলবাদী রাজনৈতিক দলটি যে-ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তা থেকে অনেকের ওই ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে যে, হিন্দু জঙ্গি চক্রটি আরও কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে; এমনকি এমন হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয় যে, গত বছরে ভারত-পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত রেলে যে নৃশংস ও রক্তপাতময় হামলাটি সংঘটিত হয়েছিল এবং যে-ঘটনায় ৬৮ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিলেন, সে-ঘটনাটিও এরাই ঘটিয়েছে।

জঙ্গি হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর অনুসন্ধান পাওয়ার আগে পর্যন্ত মোটামুটিভাবে আমরা দেখে এসেছি, যখনই ভারতে কোনও জঙ্গি হামলা ঘটে, তখনই ভারতের সরকারি পক্ষ সে-সবের জন্যে মুসলিম জঙ্গিদের জন্যে দায়ী করে এবং পাশাপাশি এটিও জানানো হয়, পাকিস্তান না হয় বাংলাদেশ এসব জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির আশ্রয়স্থল। এভাবে ভারতের ভেতরেই যে জঙ্গিবাদ দানা বেধে উঠছে, সংগঠিত হচ্ছে সেসবের দিকে সেখানকার সরকার, প্রশাসন ও রাজনীতিবিদরা খুব কমই মনযোগ দিয়েছেন। কিন্তু ভারতের একটি অন্যতম ইতিবাচক দিক হলো, ভারতের সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বিকশিত এবং এই বিকাশ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জন্যে সহায়ক হয়েছে। যতদূর জানা গেছে, জঙ্গি হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি তদন্তের দায়িত্বভারও এই সামরিক বাহিনীর ওপরে বর্তেছে। কিন্তু বাংলাদেশে যেমন বাংলা ভাই আর মুফতি হান্নান মার্কা জঙ্গিদের রক্ষা করার জন্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মন্ত্রী ও নেতা-কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় দায়িত্ব পালন করে, ভারতেও ঠিক একই জাতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি। তাই মহারাষ্ট্রে হিন্দু জঙ্গি মৌলবাদীদের আটক করার পর বিজেপির পক্ষ থেকে হিন্দু গোষ্ঠীগুলিকে কঠোর হাতে দমন করার এবং তাদের নিয়ে সংবাদপত্রে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা হয়। ভারতীয় পুলিশ ওই সময় সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর নামের একজন হিন্দু নারী জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, বিজেপি-র নেতা আভদানী এই জিজ্ঞাসাবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। আভদানীর এই সমালোচনা এত বেশি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নিজে তাঁর এই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে সরাসরি টেলিফোন করে ইস্যুটিকে বা তদন্তকে রাজনৈতিকভাবে না দেখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

কিন্তু মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলা পুরো পরিস্থিতিকে পাল্টে ফেলেছে। সকলের সামনে আবারও উঠে এসেছে মুসলিম জঙ্গি প্রসঙ্গ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ-ঘটনার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ, আরও পরিস্কার করে বললে পাকিস্তানকে জড়িয়ে ফেলছেন। যে-আহ্বান মনমোহন রেখেছিলেন আদভানীর কাছে, সেই একই আহ্বান এখন ভারতের কাছে রাখছে পাকিস্তান। সেখানকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি মুম্বাইয়ের হামলা নিয়ে রাজনীতি না করার অনুরোধ জানিয়েছেন কাতরস্বরে। বলেছেন, আমরা এখন একই শত্রুর মুখোমুখি, এটি তাই যৌথ বিষয়। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি সবধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।

মুসলিমই হোক আর হিন্দুই হোক,- জঙ্গিদের হামলার জন্যে, সহিংসতার জন্যে, মানুষ খুন আর রক্তপাতের জন্যে কখনোই ভারতকে মৌলবাদের তীর্থস্থান বলা হবে না! খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গুজরাটে সহিংস সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালানোর জন্যে কখনোই ভারতকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বলা হবে না! কেননা মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা যত আস্ফালনই দেখাক না কেন, ভারত তো আর ইরাক নয়, আফগানিস্তান বা পাকিস্তান নয় কিংবা ইরানও নয়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের পারমাণবিক বোঝাপড়াও আছে। এবং, আমাদের এসবও মনে আছে, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় থমাস ফ্রিডম্যানের মতো বোদ্ধা ভারতের পুঁজিতান্ত্রিক সাফল্যের গল্প শুনিয়েছিলেন বিশ্ববাসীকে, ভারতের গায়ে সেঁটে দিয়েছিলেন পরবর্তী বৈশ্বিক পরাশক্তির তকমা। বোদ্ধাদের কাছে ভারত হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ, কেননা তাদের নাকে গুজরাটের নিরীহ মৃত মুসলিমদের পোড়া চামড়ার গন্ধ পৌঁছায় না; তারা বরং তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিকে পরামর্শ দেন ভারতের গণতন্ত্রকে একটি অন্যতম মডেল হিসেবে বিবেচনা করার।

পশ্চিমা প্রচার লুকিয়ে রেখেছে ভারতের হতদরিদ্র চেহারাকে, মৌলবাদ-ব্যাপ্তির দিককে। তবে এ-ও সত্য যে, ভারতীয়দের দেশপ্রেম ঈর্ষণীয়। জীবন-জীবিকার তাগিদে পৃথিবীর যেখানেই ভারতীয়রা যাক না কেন, নিজের দেশ, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সঙ্গে বহন করে; পরদেশে নাগরিকত্ব নেয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই, কিন্তু ব্যবসা-সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযোগ গড়ে তুলতে তারা খুবই যত্নশীল। দেশটি পারমাণবিক বোমার অধিকারী, মহাকাশযান নির্মাণেরও অধিকারী। কিন্তু এত সব অর্জনের পরও ভারত তার দরিদ্রতা ও পশ্চাৎপদতাকে লুকাতে পারছে না। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমাকে বেধে দিয়েছে নতুন করে, যে-সীমারেখা অনুযায়ী ভারতের প্রায় অর্ধেক মানুষই বসবাস করেন দারিদ্রসীমার নিচে। তার মানে একজন ভারতীয় প্রতিদিন সোয়া এক ডলারেরও কম আয় করেন। ভারতের জনসংখ্যা এখন এক দশমিক ১৩ বিলিয়ন। এর মধ্যে ৮২৮ মিলিয়ন মানুষ অর্থাৎ ৭৫ দশমিক ছয় শতাংশ মানুষের মাথাপিছু প্রতিদিনের আয় দুই ডলারেরও কম। এরকম বিপর্যয়কর অর্থনীতি থাকার পরও ভারত বিশ্ববাসীর কাছে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ, সেখানকার রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ও সামরিকতন্ত্রের কোনও হস্তক্ষেপ নেই। দ্বিতীয় আরেকটি কারণ, জনগণের একাংশে এবং এমনকি কোনও কোনও রাজনৈতিক দলের মধ্যেও ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা যত ক্রিয়াশীলই হোক না কেন, ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধর্মীয় রাজনীতি ও ধর্মকে ব্যবহার করার ও প্রশ্রয় দেয়ার পক্ষপাতি নয় এবং সেরকম কোনও ভূমিকাও রাখে না তারা। আরও একটি কারণ হলো, সমাজজীবনে যত সামন্ততান্ত্রিক অপভ্রংশই থাক না কেন পুঁজিতান্ত্রিক গোষ্ঠী সেখানে অর্থনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক। এর বিপরীতে, ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাঠামোগত চেহারা খুব করুণই বটে। বছরের পর বছর ধরে এইসব দেশগুলিতে সামরিক বাহিনী হয় প্রত্যক্ষভাবে না হয় অপ্রত্যক্ষভাবে নীতিনির্ধারণ করে আসছে। এমনকি এইসব দেশের সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ধর্মতন্ত্রকেও ইন্ধন যুগিয়ে আসছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো থেকে ১৯৭১ সালের পর ধর্মতন্ত্রকে বিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু দেশটির সামরিক বাহিনী সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথমে সংবিধানকে স্থগিত ও কয়েকটি ধারা পরিবর্তন করে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া অনুমোদন করে। পাকিস্তানের অবস্থা আরও করুণ, আইএসআই-এর ইচ্ছায় সরকার ও রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতন ঘটে সেখানে।

এশিয়ার রাজনৈতিক ও ভৌগলিক অবয়বের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কাছে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ যে-ভূমিকা প্রত্যাশা করছিল এবং ভারতও যে-ভূমিকা পালনের জন্যে আগ্রহী ছিল, তার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের পারমাণবিক চুক্তিটুকুই যথেষ্ট ছিল না; তার জন্যে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল একটি নাইন-ইলেভেনের। ভারতের নীতিনির্ধারকদের সেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে, তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র মুম্বাইয়ের সবচেয়ে অভিজাত ও ব্যয়বহুল দুটি হোটেল তাজ ও ওবেরয়তে হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। হামলা চালিয়েছে আরও বেশ কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ অভিজাত স্থাপনাতে। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে খুবই স্পষ্ট-যে, ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজানোর সুযোগ পাবে। ভারতের কোনও কোনও সংবাদপত্র এ-ঘটনাকে যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ও সবাইকে উস্কানোর চেষ্টা করে চলেছে। এসব ব্যাপার কেবল ভারতের পররাষ্ট্রীয় মনোবাঞ্ছাই পূর্ণ করবে না; বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মহামন্দা চলছে এবং ভারতে তার যে প্রভাব পড়তে চলেছে, তাকে সামাল দেয়ার জন্যেও নতুন এ-পররাষ্ট্রনীতি ভূমিকা রাখবে। এবং তা, বলাই বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার একটি মনোবাসনাও পূর্ণ করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে থেকেই বারাক ওবামা পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালানোর ইচ্ছে প্রকাশ করে আসছেন। ইরাকের ক্ষেত্রে যেমন,- সামরিকভাবে ইরাকের নিরস্ত্র অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল, পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটতে চলেছে। সেখানে সামরিক বাহিনীর হিংস্র নখরগুলি সযত্নে ছেটে ফেলে একটি নির্বাচিত সরকার নিয়ে আসা হয়েছে, যে-নির্বাচিত সরকারটির পরিচালকরা পূর্ব-দুর্নীতির কারণে নৈতিকভাবে খুবই দুর্বল। কয়েকদিন আগে সেখানকার সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাটি ইন্টারসার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স-এর রাজনৈতিক শাখা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পাইলটবিহীন বিমানের মাধ্যমে মার্কিনী হামলা এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ইরাকের ক্ষেত্রে সরাসরি আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে যে বিপজ্জনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে, তা থেকে এটিই স্বাভাবিক যে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে ঢাল হিসেবে কাউকে ব্যবহার করতে। সে-ক্ষেত্রে ভারত একটি পরিপূরক ভূমিকা রাখবে বলেই মনে হচ্ছে।

ঘটনাপ্রবাহ থেকে পরিস্কার, ভারত এটি চিন্তা করছে না, দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদ বিকাশের দিকে যথেষ্ট মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে তার। বরং সে বাইরের কারণগুলিকেই বড় করে দেখছে এবং তাই মনযোগী হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজানোর দিকে, পরাশক্তি হয়ে ওঠার দিকে। আর তাই তার নজরে পড়ছে না, মৌলবাদ ভারতের মধ্যেই ক্রমশই থাবা বসাচ্ছে। কারও কারও ধারণা, ভারত এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে বিরাজিত দারিদ্র ও অশিক্ষা এসব দেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের পেছনে ভূমিকা রাখছে। মুম্বাই হামলার পরও এ-কথাটি শোনা যাচ্ছে নতুন করে। বলা হচ্ছে, ভারতের বঞ্চিত দরিদ্র মানুষ জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে। যে-হোটেল তাজ বা ওবেরয়-তে জঙ্গিরা গত বুধবার হামলা করেছে, সেগুলোর যে-কোনও একটি হোটেলে একরাত কাটানোর নুন্যতম খরচ হলো ১৭,৫০০ রুপি বা ৩৫৫ ডলার। এর বিপরীতে, ভারতে একজন মানুষের বার্ষিক গড়পড়তা আয়ের পরিমাণ ২৯,০৬৯ রুপি বা ৫৯০ ডলার। এই প্রতিতুলনা অনুযায়ী, প্রতি বছর সেখানকার ১৮ মিলিয়ন মানুষের নীরব অর্থনৈতিক দারিদ্র্যজনিত মৃত্যু ঘটছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক থমাস পোগ এ ব্যাপারে বলেছেন, যদি উন্নততর পশ্চিমা দেশগুলি ভারতের মৃত্যু, ভয়াবহ দারিদ্রকে আনুপাতিকভাবে ভাগ করে নেয়, তা হলে দেখা যাবে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩,৫০০ ব্রিটনস এবং ১৬,৫০০ আমেরিকানকেও একইভাবে মারা যেতে হচ্ছে। ভারতে প্রায় ১০০ মিলিয়নের একটি মধ্যশ্রেণি রয়েছে, যারা বেশ সুখেই আছে, কিন্তু এর পাশাপাশি রয়েছে ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি জনগণ, যারা বসবাস করে অবর্ণনীয় অবস্থাতে। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় সেখানে সুপরিকল্পিত বৈষম্যের শিকার, তাদের বিরুদ্ধে ভায়োলেন্সগুলিও সুচিন্তিত আর এই ভায়োলেন্সে গতি এনেছে ২০০২ সালের মুসলিম বিরোধী প্রপাগান্ডা। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদি পর্যন্ত প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন সেই সুপরিকল্পিত ভায়োলেন্সকে। কিন্তু ৮০ শতাংশ হিন্দু আর ১৪ শতাংশ মুসলিম থাকার পরও ভারতে এথনিং ক্লিনসিং চালানো তেমন সহজ নয়; কেননা শতাংশের হিসেবে যাই হোক না কেন, ভারত এক দশমিক ১৩ বিলিয়ন মানুষের একটি বিশাল দেশ এবং তাই কার্যকারণও অনেক বেশি। তা ছাড়া ভারতে সেক্যুলার শক্তির স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ ও সংগঠন বিকশিত করার অধিকারও অনেক বেশি। ভারতে তাই অনেক ক্ষেত্রে মানুষের দরিদ্রতার সুযোগ নেয়া সহজ, অশিক্ষাকে কাজে লাগানো সহজ, কিন্তু দরিদ্রতা আর অশিক্ষাই জঙ্গিবাদকে সংগঠিত করছে এরকম ভাবা বোধকরি বেশি যৌক্তিক নয়।

বরং বলা চলে, শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের শিক্ষিত শ্রেণীর একটি অংশই জঙ্গিবাদ সংগঠনে বড় ভূমিকা রাখছে এবং ইন্ধন দিচ্ছে। এর একটি কারণ হতে পারে, বিশ্বায়নের যুগে বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মধ্যেকার দৃষ্টিগ্রাহ্যতা এত বেশি স্পষ্ট যে, প্রতিটি দেশের শিক্ষিত মানুষই নিজের সংস্কৃতির অসহায়তায় আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছেন। এবং তারা তাদের আত্মপরিচয় ধারণ করতে চাইছেন ধর্মীয় পরিচয়টিকেই সবচেয়ে বড় করে তুলে ধরে। আরও একটি কারণ, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞানমনস্কতা বিদায় দেয়ার প্রক্রিয়া বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানে তো অবশ্যই, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ভারতের মতো দেশেও খুবই ক্রিয়াশীল। ফ্যাসিবাদের একটি শাদামাটা সংজ্ঞা হলো সেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামীর সঙ্গে যুক্ত হয় বিজ্ঞানের নিছক কৃৎকৌশলগত জ্ঞান। এসব দেশে এখন তাই ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টান মৌলবাদীরা তাদের বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষায় ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন বিষয়টি যুক্ত করার কাজে ভয়ানক সক্রিয়। একই ধরনের কার্যক্রম বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্নভাবে ক্রিয়াশীল। তাই কোনও কোনও শিক্ষিত মানুষই এখন হয়ে উঠেছেন মৌলবাদের সবচেয়ে বড় ধ্বজাধারী। এই প্রক্রিয়ায়, যুক্তরাষ্ট্রে যেমনটি দেখা যাচ্ছে, অনেক ডেমোক্র্যাট সেখানকার কনজারভেটিভদের চেয়েও অনেক বেশি রক্ষণশীল ও পাঠ্যক্রমে ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন যুক্ত করতে অনেক বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমনি দেখা যাচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক হানিফ-জাতীয় নেতাকর্মী গজিয়ে উঠেছেন, যারা জামায়াতে ইসলামীর চেয়েও অনেক বেশি ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী। জ্ঞানতাপস ব্যক্তিজীবনে ধর্মপরায়ণ ড. শহীদুল্লাহ একসময় বলেছিলেন, মুসলমানিত্ব বা হিন্দুত্বের চেয়েও আমাদের বড় পরিচয় হলো আমরা বাঙালি। বাংলাদেশ ও ভারতের কয়জন মুসলমান ও হিন্দু এইভাবে ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বড় করে দেখেন তা এখন নতুন অনুসন্ধানের বিষয়। মুম্বাইয়ের হামলার ধরণ থেকে অন্তত এটুকু বলা যায়, নতুন এ-জঙ্গিবাদের সঙ্গে এত বেশি আধুনিক প্রযুক্তিগত দিক জড়িয়ে রয়েছে, এত বেশি অর্থনৈতিক প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে যে, দারিদ্য ও অজ্ঞতার নিরিখে একে পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।

এটি এখন একটি বড় প্রশ্ন, সত্যিই কি এসব দেশ চায়, জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতে? না কি কারও ক্ষেত্রে তা পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজানোর জন্যে প্রয়োজনীয়, কারও ক্ষেত্রে আবার প্রয়োজন সংবিধানকে ঢেলে সাজানোর জন্যে, কারও ক্ষেত্রে প্রয়োজন কথিত জাতীয় ঐক্য গড়বার জন্যে? একেকটি জঙ্গি হামলায় দেশ জ্বলবে, রক্তপাত ঘটবে, মানুষ তার প্রিয় পরিজন হারাবে আর রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা তাদের রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ করবেন? এভাবে রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ করায় পাকিস্তানকে এখন মাশুল দিতে হচ্ছে, বাংলাদেশকে এখন মাশুল দিতে হচ্ছে, ভারতও এবার পা বাড়াচ্ছে একই পথে! এদের ঘর পুড়ছে, আর এরা মেতে উঠেছে তাদের সেই ঘর পোড়ানো আগুনের মধ্যে আলু পুড়িয়ে সৌখিন বৈকালিক নাস্তার আয়োজনে। এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে!

২৯ নভেম্বর ২০০৮

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

৬ comments

  1. অলৌকিক হাসান - ১ ডিসেম্বর ২০০৮ (৩:৫৮ অপরাহ্ণ)

    পরদেশে নাগরিকত্ব নেয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই,

    উহু। এই ব্যাপারে তাদের সদিচ্ছা পুরোমাত্রাতেই আছে। তবে তাদের পরদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও তাদের চিন্তা চেতনা ভারতে প্রতি কাজ করে। সেটাই মূল … আমাদের যেটার অভার রয়েছে।

    • অবিশ্রুত - ২ ডিসেম্বর ২০০৮ (১২:২২ পূর্বাহ্ণ)

      ভারতীয়দের নাগরিকত্ব বিধি সম্পর্কে আমার তেমন কিছু জানা নেই। তবে শুনেছিলাম, তাদের দ্বৈত নাগরিকত্বের কোনও সুযোগ নেই। তবে সম্ভবত দু হাজার তিন সাল থেকে তারা ওভারসিজ ইন্ডিয়ান হিসেবে নথিভুক্ত হতে পারে। এবং এ ক্ষেত্র তাদের ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে হয়। তার বদলে তারা একটি রেজিস্ট্রেশান সার্টিফিকেট পায়। এর ফলে কী অসুবিধা হয়, কী সুবিধা হয়, তা ঠিক জানা নেই; তবে শুনেছি, তারা তা নিতে উৎসাহবোধ করেন না। সম্ভবত তাদের ভোট দেয়ার অধিকারও থাকে না। কারও ব্যাপারটি সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকলে আওয়াজ দেবেন, প্লিজ।
      নাগরিকত্বের ব্যাপারটি যেরকমই হোক, আপনি ঠিকই বলেছেন, তাদের চিন্তাচেতনা ভারতের প্রতি কাজ করে। এ কারণেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা হয়ে বাংলাদেশের পাটশিল্পবিরোধী প্রেসক্রিপশন প্রণয়ন করা। এর বিপরীতে বাংলাদেশের নাগরিক বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তারা কী করেছেন, তা বলাই বাহুল্য।

  2. শামীম ইফতেখার - ৭ ডিসেম্বর ২০০৮ (২:২৩ পূর্বাহ্ণ)

    ভারত দেশটাকে বুঝতে পারিনা। এত বেশী ভিন্ন স্রোত, এত বেশী অনর্দ্বন্দ্ব যে দেশটাকে কোন ছকেই ফেলা কঠিন মনে হয় মাঝে মাঝে। বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে যে গুনগুলো না থাকলে তাদের আমরা প্রতিক্রিয়াশীল বলে সন্দেহ করি, পরিচিত ভারতীয়দের যাদের মধ্যে সে সব গুণের উপস্থিতি দেখেছি তাদের বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে আবিষ্কার করেছি। যেমন ধরা যাক, দেশপ্রেম বা জাতীয়তা চেতনা বা সংস্কৃতিবোধ একজন বাঙ্গালীকে যেমন “অধিকাংশ ক্ষেত্রেই” প্রগতিশীলদের কাতারে আনে, ভারতীয়দের ক্ষেত্রে বরং উল্টোটা হতে দেখেছি। একজন দেশপ্রেমী, সংস্কৃতি অভিমানী, জাতীয়বাদী ভারতীয়ের বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আধিপত্যবাদের পক্ষে, মুক্ত পূঁজির পক্ষে, সামরিক ও পারমানবিক পেশীশক্তির এবং কর্পোরেট ভারতের পক্ষে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা বেশী। এটা খুবই মোটা দাগের অবজার্ভেশন, জানি। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এরই বারবার পুনরাবৃত্তি দেখেছি পরিচিত ভারতীয়দের মধ্যে। অভিজ্ঞতা বলে, যে ভারতীয় বলবেন “আমার কোন দেশ বা সুনির্দিষ্ট আইডেন্টিটি নেই, দেশপ্রেম বা দেশের জন্য আলাদা কোন টান নেই, আমি নিজেকে বিশ্বের নাগরিক মনে করি, আমার সাথে একজন ভারতীয়ের ততটাই মিল যতটা মিল লাতিন আমেরিকার একজন শ্রমিকের সাথে” – তার বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সর্বহারার পক্ষে, মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা। কি অদ্ভুত না? ভারত কি আসলে “একটা” দেশ?

    • রায়হান রশিদ - ৭ ডিসেম্বর ২০০৮ (১১:১৪ পূর্বাহ্ণ)

      এটা খুবই মোটা দাগের অবজার্ভেশন, জানি।

      মোটা দাগের বিশ্লেষণ, সন্দেহ নেই। তবে আপনার বক্তব্যের মধ্যে যে সত্যের সুর রয়েছে, তা সীমিত অভিজ্ঞতাতে মাঝে মাঝেই ধরা দিয়েছে। এর কোন সমাজতাত্ত্বিক ভিত্তি বা ব্যাখ্যা থাকলেও থাকতে পারে। Economic and Political Weekly তে অমর্ত্য সেন এর ‘Is Nationalism a Boon or Curse’ লেখাটিতে কিছুটা আলোকপাত রয়েছে এই বিষয়টির উপর। এই লিন্কে লগিন করে পুরো আর্টিকেলটি পড়া যেতে পারে।

      ভারত দেশটাকে বুঝতে পারিনা। এত বেশী ভিন্ন স্রোত, এত বেশী অনর্দ্বন্দ্ব যে দেশটাকে কোন ছকেই ফেলা কঠিন মনে হয় মাঝে মাঝে। . . . ভারত কি আসলে “একটা” দেশ?

      সুন্দর বলেছেন। হয়তো এটি এক দেশের শরীরে লুকোনো অনেকগুলো দেশ। হয়তো সে কারণেই সেখানে ‘দেশ’, ‘জাতি’, ‘জাতিসত্ত্বা’ বিষয়গুলোকে কোন সহজ থিওরীর মধ্যে ফেলা এত কঠিন। ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্ত্বা আর সংস্কৃতির মানুষদের এক পতাকাতলে আনার বিষয়টি ইতিহাসের সব বড় বড় nation builder দেরই ভাবিয়েছে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাটা এখানে মনে পড়ছে বিশেষ করে।

      অবিশ্রুত’র লেখার আলোচনা করতে গিয়ে আমরা বোধ করি একটু অফট্র্যাকে চলে যাচ্ছি। আলোচনাটা কিভাবে যেন শুরু হয়ে গেল, একেবারে চায়ের কাপের বারোয়ারী আড্ডায় যেমনটি হরহামেশাই ঘটে। ক্ষমা করবেন, অবিশ্রুত। তবে “দেশ”, “জাতি”, “জাতিসত্ত্বা”, “দেশপ্রেমের ধারণা”, “ঐক্য-সংহতির সাধারণ সূত্র” এই বিষয়গুলো নিয়ে কিন্তু দারুণ আলোচনা হতে পারে। কেউ পৃথক পোস্ট দিয়ে আলোচনাটা আরেকটু উসকে দেবেন?

      • অবিশ্রুত - ১০ ডিসেম্বর ২০০৮ (১২:১১ পূর্বাহ্ণ)

        তা ঠিক, আলোচনা অফট্র্যাকে চলে যাচ্ছে; কিন্তু কলামের ধর্মই তো তাই মনে হয়, অনেক কিছু অহেতুক ডেকে আনে সে, কিন্তু দেখা যায় আসলে সেসবও প্রাসঙ্গিক ! সত্যিই আলাদা পোস্ট হওয়ার মতো বিষয় এসব, আর তাই কেউ আলোচনা করলে খুবই ভালো হয়।
        তবে আপাতত যদি চায়ের কাপে ঝড় ওঠে, উঠতে থাকুক। আড্ডা ফ্রান্সকে রক্ষা করেছিল, ফরাসী বিপ্লব ডেকে এনেছিল, আড্ডা আমাদেরও রক্ষা করুক।

    • অবিশ্রুত - ৯ ডিসেম্বর ২০০৮ (১১:৫৫ অপরাহ্ণ)

      সত্যিই ভারত এক বিচিত্র দেশ এবং কিসের স্বার্থ একে এক করে রেখেছে চিন্তা করতে গেলে মাথা ঘোরায়। শুনেছি, ভারতের কোনও কোনও রাজ্যের মানুষরা ইংরেজি ভাল জানে, কেননা তাদের নিজস্ব ভাষাপ্রীতি এত বেশি যে তারা হিন্দি শেখে না, তাই স্বদেশের মানুষের সঙ্গে কম্যুনিকেশনের জন্যেই মনযোগ দিয়ে ইংরেজি শেখে তারা; আবার ওটাও সত্য, কেন জানি না পশ্চিম বঙ্গে হিন্দির প্রসার ঘটছে দ্রুত, বাংলা সংকুচিত হয়ে আসছে। কিন্তু এরকম অনেক বৈপরীত্যময় উদাহরণ থাকার পরও ভারতের ভৌগলিক সীমানা পাল্টায়নি, কেননা তার অর্থনৈতিক মানচিত্র অনেক বেশি শক্তিশালী।
      আপনার অবজারভেশানটা যতটা ভাবছেন, ততোটা সীমিত নয়। তবে এই পর্যবেক্ষণ এটাও বোঝাচ্ছে, সর্বহারার পক্ষে, মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো তত সহজ নয়। তাই যদি হতো ভারতে অনেক আগেই সফল বিপ্লব ঘটতো। আমার মনে হয়, একজন অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে নিজের ভূগোল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে; কিন্তু ব্যাপারটা অতিথি পাখি হওয়ার মতোই। কবে কোনকালে অতিথি পাখিরা বাংলাদেশে ছিল জানি না আমরা, কবে ইলিশের দল লোনা পানিতে চলে গেছে তাও জানি না, তবে কেন চলে গেছে সেটা অনেকটাই বুঝি আর এটাও জানি, প্রজননঋতু এলে তারা আবার দেশে ফিরে আসে। নতুন জায়গাটি তাদের বসবাসের জন্যে যত ভালোই হোক না কেন, বংশবৃদ্ধির জন্যে তত অনুকুল নয়। ভারতবাসীর বিদেশবাসী হওয়া (আমাদেরও) বোধকরি অনেকটাই ওরকম। আর দেশপ্রেমের জন্য একটা পর্যায়ে যেমন স্বাধীনতা ও মুক্তির স্পৃহা কাজ করে, আরেকটা পর্বে আবার আধিপত্যের স্পৃহা কাজ করে। তাই দেশপ্রেমও কখনও কখনও প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে ওঠে মনে হয়।
      আমার ব্যক্তিগত ধারণাটা বলি : আমার পর্যবেক্ষণে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি অনুযায়ী দেশ আর রাষ্ট্রের মধ্যে খানিকটা তফাৎ আছে। সেই হিসেবে, ভারত যতটা না দেশ, তারও চেয়ে বেশি রাষ্ট্র। তবে দেশ হিসেবে তার রক্তক্ষরণও কম নয়, সাতচল্লিশের স্মৃতি আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি থেকে আমাদের মধ্যে এখনও জাগ্রত। বাংলাদেশের এক বরিশালবাসীর কথা শুনেছি, তাকে পেয়ে উদ্বাস্তু হয়ে কোলকাতায় যাওয়া এক বাঙালির ছেলে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল আর বলেছিল : দেশটাকে কোনওদিন দেখি নাই, আপনার গা থেকে দেশের গন্ধ পেলাম।
      এরকম ঘটনা বোধকরি কোরিয়া (দক্ষিণ ও উত্তর) এবং জার্মানিতেও অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে।
      রাষ্ট্র দানব হয়, দেশ কি তত দানব হতে পারে? বোধহয় সেজন্যই আমরা রাষ্ট্রের চেয়ে দেশ তাড়াতাড়ি ত্যাগ করে অন্য দেশে যেতে পারি, কিন্তু তারপরও দেশের জন্যে কাঁদি।
      ধন্যবাদ আপনাকে এ লেখা পড়বার জন্যে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.