লাতিন ভাষার কথা : ২১

|| আইন ও আইনের ভাষা || মুক্তিপ্রাপ্ত দাস একিওন চেয়েছেন তাঁর পুত্র আইন পড়ুক যাতে সেটা তার জীবিকার সহায়ক হয়। তাঁর এতোটা উচ্চাশা ছিল না যে নিজের পুত্রকে একজন বাগ্মী এবং অন্যের পক্ষ নিয়ে লড়াই করা একজন মানুষ হিসেবে কল্পনা করবেন, কিন্তু তাকে আইন সম্পর্কে খানিকটা জানতেই হতো। এই দিক থেকে তিনি সম্ভবত ঠিক ছিলেন। রোমক জগতে আইন ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। [. . .]

Tore Janson-এর সুইডিশ ভাষায় রচিত Latin: Kulturen, historien, språket গ্রন্থের Merethe Damsgård Sørensen ও Nigel Vincet-কৃত ইংরেজি অনুবাদ A Natural History of Latin-এর বাংলা ভাষান্তর

আইন ও আইনের ভাষা

মুক্তিপ্রাপ্ত দাস একিওন চেয়েছেন তাঁর পুত্র আইন পড়ুক যাতে সেটা তার জীবিকার সহায়ক হয়। তাঁর এতোটা উচ্চাশা ছিল না যে নিজের পুত্রকে একজন বাগ্মী এবং অন্যের পক্ষ নিয়ে লড়াই করা একজন মানুষ হিসেবে কল্পনা করবেন, কিন্তু তাকে আইন সম্পর্কে খানিকটা জানতেই হতো। এই দিক থেকে তিনি সম্ভবত ঠিক ছিলেন। রোমক জগতে আইন ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সিভিল সার্ভেন্টদের অনেকটা সময় কেটে যেত নানান বিষয়ে অভিমত প্রদানে, আর এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে যে লোকে যেন আইন মেনে চলে। যারা আইন ভাঙত তাদের সঙ্গে খুব নির্দয় আচরণ করা হতো, তবে আইন আবার মানুষকে সহিংসতা ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে রক্ষা-ও করত।

আইনের চোখে মানুষ সমান ছিল না। উল্টো, আইন একেবারে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিত কে কার ওপর খবরদারী করবে, কতটা করবে সে-সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দাসমালিকদের ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতা, এমনকি নিজ দাসদের খুন করার-ও অধিকার ছিল তাঁদের। অবশ্য সেই একচ্ছত্র ক্ষমতারও কিছু সীমা ছিল: বাড়াবাড়ি রকমের নিষ্ঠুরতার কারণে যে-দাস পালিয়ে যেতেন তাঁকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য করা সম্ভব ছিল মালিককে; কাজেই একথা বলা যেতে পারে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন দাসদের-ও সুরক্ষা দিত।

রোমের সমাজ ছিল খুবই পিতৃতান্ত্রিক, এবং পরিবারের কর্তা বা, ‘pater familiae’ পরিবারের সব সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, কিছু কিছু ক্ষেত্র ছাড়া। যেমন, তাঁর স্ত্রীর অর্থ-কড়ির ব্যাপারে কোনো কথা বলার অধিকার ছিল না তাঁর, এবং আইনগতভাবেই স্ত্রীর টাকা-পয়সা ছিল স্বামীর টাকা-পয়সা থেকে আলাদা।

মানুষের অধিকার এবং বাধ্যবাধকতাগুলোর স্বরূপ কেমন ছিল এই নিয়মগুলো তার উদাহরণ। অবশ্যই নিয়ম-কানুন আরো মেলা ছিল, কেনা-বেচার নিয়ম, বাদ-বিসংবাদ-ক্ষয়ক্ষতি আর অতি অবশ্য-ই অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ক নিয়ম-কানুন। কার্যকর যে-কোনো সমাজে এধরনের নিয়ম-কানুন থাকতেই হয়, কিন্তু রোমকরা তাদের আগের (এবং পরের-ও বটে) যে-কোনো সমাজের চাইতে বেশি সময় বিনিয়োগ করেছিল স্বচ্ছ, পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধি-নিষেধ তৈরি আর সেগুলো যাতে কাজ করে তা নিশ্চিত করতে। সেই সঙ্গে তারা তাদের আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধের পেছনের নীতি বা যুক্তি নিয়েও লেখালেখি করেছে অনেক, এবং বলা যেতে পারে তারাই আইনের বিজ্ঞান ও দর্শন বা ‘jurisprudence’ (irus prudentia ‘আইনের প্রজ্ঞা’ থেকে) আবিষ্কার করেছে। মূল নীতিটা হলো ‘ius’ ‘অধিকার’ বা, ‘আইন’, আর সেটাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এইভাবে: ‘Ius est ars boni et aequi’ ‘আইন হলো ভালো বা শুভ এবং অধিকারের বিদ্যা বা শিল্প’। যারা আইনজ্ঞ নয় তাদের নিশ্চয়ই এ-ব্যাপারে সন্দেহ জাগে মাঝে মাঝে, কিন্তু যেসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন সেসব বিষয়ে বিধি-নিষেধ তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি রোমক আইন প্রণেতারা, ন্যায্য বিচার ও তার প্রয়োগের ভিত্তিমূলের ব্যাপারেও নানান চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণা ছিল তাদের। আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের নীতিও প্রণয়ন করেছিলেন তাঁরা, এবং সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন অসংখ্য মৌলিক ধারণার। বিখ্যাত বহু জুরির কল্যাণে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করা রোমক আইন পূর্বের সমস্ত সিস্টেমকে ছাপিয়ে যায় এক সময়। আর তার নিদর্শন রয়ে গেছে ‘Corpus iuris’-এ, যা কিনা ৬ষ্ঠ শতকে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে বাইজেন্টিয়ামে সংকলন করা অজস্র আইন ও আরো নানান টেক্সট-এর একটি সংগ্রহ।

পশ্চিম ইউরোপে রোমক সাম্রাজ্যের পতনের পর লিগ্যাল সায়েন্স (‘আইন বিজ্ঞান’? বাংলা কি হবে বুঝতে পারছি না, ‘আইনের মানুষ’-রা এ-ব্যাপারে যদি সাহায্য করতে পারেন অনুগ্রহ করে। তবে তা দেওয়ানী আইন — civil law — ট্র্যাডিশনের অংশ। অনুবাদক) এবং আইনপ্রয়োগ বা বিচার বিধান (administration of justice) দুটোই দৈন্যদশায় পড়ে, তবে একাদশ শতক থেকে যথাযথ ভিত্তিসম্পন্ন আইন শিক্ষা ফের চালু হয় বোলোনিয়াতে, ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলে যেটাকে ধরা হয় সেটিতে। এই শিক্ষার পুরো ভিত্তিই ছিল রোমক আইন, এবং এরপর বহু শতাব্দী ধরে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশে রোমক আইন-ই ছিল আইনব্যবস্থার বুনিয়াদ। এমনকি উনবিংশ শতকেও, পর্তুগাল থেকে জার্মানি অব্দি দক্ষিণ ও পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশের আইনব্যবস্থায় রোমক আইন প্রায় পুরোপুরি-ই বিদ্যমান ছিল। অধিকাংশ আইন অনুষদে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে পাঠ্য রোমক আইনের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা এখনো পশ্চিমা জগতের আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য লাযীম বা গুরুত্বপূর্ণ।

তার একটি কারণ হলো রোমকরা বিভিন্ন পরিভাষা আর ধ্যান-ধারণার একটি সুচিন্তিত ও সহজে প্রয়োগযোগ্য সম্পূর্ণ ব্যবস্থা দাঁড় করতে সক্ষম হয়েছিল। আইনের বিজ্ঞান ও দর্শন বা ‘jurisprudence’-এর ভিত্তি রচন করেছে তারা দুহাজার বছর ধরে, এবং আধুনিক নানান তর্ক-বিতর্কে এখনো প্রায়ই তাদের প্রসঙ্গ চলে আসে। এর একটি উদাহরণ ‘ius naturale’ বা, প্রাকৃতিক আইন। ‘Corpus iuris’-এর একটি টেক্সট-এ সেটাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে: ‘Ius naturale est quod natura omnia animilia docuit’, মানে, ‘প্রাকৃতিক আইন হলো তাই যা প্রকৃতি সকল জীবন্ত প্রাণীকে শিখিয়েছে।’ ‘প্রাকৃতিক আইন’ বলে কোনো কিছুর ধারণা আদৌ আছে কিনা তা আজও সমাজ বিজ্ঞানের একটি মৌলিক প্রশ্ন। তবে সর্ব পরিস্থিতিতেই ‘ius civil’ বা, ইংরেজিতে যাকে সাধারণত ‘civil law’ বলে (বাংলায় বলে ‘দেওয়ানী আইন’ — অনুবাদক) তা বর্তমান। এ হচ্ছে সেই আইন যা কোনো দেশের সব নাগরিক বা ‘cives’ -এর জন্য প্রযোজ্য হতো বা হয়। এসব ধারণা অনুবাদ করা খুব সহজ নয়। লাতিন ‘culpa’ হলো মোটামুটিভাবে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘guilt’ বা ‘fault’। কিন্তু তার বিপরীতে, লাতিন শব্দ ‘stipulátio’ ইংরেজিতে ধারকৃত ‘stipulation’-এর চাইতে অর্থের দিক থেকে অনেক সীমিত। ‘Stipulato’ হচ্ছে একটা মৌখিক চুক্তি যা সম্পাদিত হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে। এই যেমন, ‘stipulator’ বলছে, ‘আপনি আমাকে ৫০ পাউন্ড দিতে রাজি আছেন?’ আর তখন ‘promissor’ বা ‘respondent’ বলছেন, ‘রাজি আছি।’ ইংরেজি ভাষায় আইনের আলোচনায় এই রোমক ধরনের চুক্তির উল্লেখ হয়ত ‘stipulation’ শব্দটা দিয়ে সারা যাবে, কিন্তু দৈনন্দিন ইংরেজিতে ‘stipulation’-এর বেশিরভাগ ব্যবহার ‘stipulatio’-এর উদাহরণ হিসেবে ধোপে টিকবে না।

রোমক আইনী সিদ্ধান্তগুলো সংক্ষিপ্ত হতো প্রায়ই, এবং সেগুলো বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখত। এখানে একটি ছোট উদাহরণ দেয়া হলো। প্রধান বিচারপতি নিচের সিদ্ধান্তটি দিচ্ছেন :

Nautae, caupones, stabulari quod cuiusque salvum fore receperint nisi restituent, in eos iudicum dabo.

নাবিক, হোটেলওয়ালা আর সরাইওয়ালারা যদি তাদের জিম্মায় রাখা মাল-সামান অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে না দেয় তাহলে আমি তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অনুমতি দেবো।

‘Corpus iuris’- বইটির একটি অংশ ‘Digesta’-তে পাওয়া যাবে এই দুই লাইনের সিদ্ধান্তটি। সফররত যেসব মানুষ তাঁদের মাল-পত্তর নিয়ে জাহাজে বা সরাইখানায় উঠতেন তাঁদের নিরাপত্তাবিধান-ই ছিল এটার লক্ষ্য। তো, সিদ্ধান্তটির পরে এন্তার জিনিস ব্যাখ্যা-করা প্রায় তিন পৃষ্ঠা দীর্ঘ মন্তব্য আছে।

‘নাবিক আর সরাইওয়ালা’ বলতে এখানে আসলে জাহাজের কাপ্তান আর সরাইখানার মালিককে বোঝানো হয়েছে। সিদ্ধান্তটির আসল কথাটা হলো মনিব বা ওপরওয়ালাই সব দায়-দায়িত্ব বহন করবে। তাছাড়া, যেসব জিনিস আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে সেগুলো যে গচ্ছিত রাখা ব্যক্তির নিজের-ই হতে হবে তা নয়; আর তাতে করে পরিবর্তনশীল মালিকানা এবং আরো নানান কিছু বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে ভিন্ন ভিন্ন নানান ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তটি প্রয়োগ করা হয়েছিল, এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতাগুলো আইনবেত্তারা সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল করেছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই নতুন মন্তব্য জুড়ে দিয়েছিলেন। আর এভাবেই তাঁরা নতুন এক ধরনের রচনা ও চিন্তা-ভাবনার সৃষ্টি করেন ধীরে ধীরে, আজ অবধি যা টিকে আছে এবং তার পূর্ণ ব্যবহার করা হচ্ছে। দাঁতের দাক্তারের কাছে যেতে যেমন আমাদের ভালো লাগে না, তেমনি উকিলের কাছেও নয়। কিন্তু একটা সমাজে আইন না থাকলে চলে না, আর রাষ্ট্রেরও এটা নিশ্চিত করার ক্ষমতা থাকতে হয় যে আইনগুলো কাজ করছে আর লোকে সেগুলোকে সমীহের চোখে দেখছে। একারণেই একটা সেনাবাহিনী আর বেশ কিছু যোগ্য আইনজ্ঞ ছিল রোমকদের। আর দেখা গেছে যে সেনাপতি ও সৈন্যারা যা করতে পেরেছিল তার চাইতে ঢের সুদৃঢ় ও স্থায়ী জিনিস তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন আইনবেত্তারা।

(ক্রমশ)

জি এইচ হাবীব

জন্ম ১০ই মার্চ ১৯৬৭। পেশা: শিক্ষকতা।

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.