তখন একটা না-শিশু-না-কিশোর বেলা ছিল। আঠারো বছর আগের কথা। আমার লম্বা-ঝুলের ফ্রক ছেড়ে কামিজ পরা উচিত কিনা, তাই নিয়ে নিশ্চয়ই তখন আমার মা সবেমাত্র ভাবা শুরু করেছিলেন[..]

তখন একটা না-শিশু-না-কিশোর বেলা ছিল। আঠারো বছর আগের কথা। আমার লম্বা-ঝুলের ফ্রক ছেড়ে কামিজ পরা উচিত কিনা, তাই নিয়ে নিশ্চয়ই তখন আমার মা সবেমাত্র ভাবা শুরু করেছিলেন। দাঁত দিয়ে নখ কাটা, কুঁজো হয়ে বসা, বেলা করে ওঠা, অন্যদের বাসার দাওয়াতে কেলেহ্যাংলার মত খাওয়া-- এসব তখন কড়া নিষেধ। জীবনের সূর্য তখনো রোদ ঝরানো শুরু করে নি; সে সবে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলছে। নতুন কিছুর সাথে আজীবনের সূত্র বাঁধার অনুকূল প্রহর। তাই আমি তাঁর কাছে গান শিখব বলে গেলাম। মা সাথে গেলেন যথারীতি। প্রতি মঙ্গলবার যেতাম। দেয়ালে টাঙানো দেখতাম সাদাকালো পাগড়ি-পরা ওস্তাদ আর স্যুট-পরা ওস্তাদকে। আবদুল করিম খাঁ সাহেব আর আমির খাঁ সাহেবকে চিনতাম না তখন। একপাশে আমার গুরুর বাবা, পণ্ডিত মিথুন দে’র পোর্ট্রেট। তাতে গাঁদাফুলের লম্বা মালার তিন লহর ঝোলানো। নিচু কাঠের তক্তোপোশ; ঘরের অনেকখানি জায়গা জুড়ে; লাল কাঁথাস্টিচের কাজ করা সুজনির মত দেখতে বেডকভার দিয়ে ঢাকা। দেয়ালের গায়ে সারিবদ্ধ নিখুঁত শৃংখলায় সমান দূরত্বে ঠেস দিয়ে রাখা গোটা পাঁচেক তানপুরা— ওদের দেখতে লাগত সমকোণী ত্রিভুজের মহিম অতিভুজের মত। প্রথম সেদিন তাঁর নির্দেশে বিশাল তানপুরাগুলোর একটাকে হাতে তুলে নিয়ে আহাম্মক বনে গেলাম। ওমা! এত ভয়াল ভারী জিনিসগুলো আসলে এত হালকা? এই নির্দোষ আহাম্মকি নিয়ে আমার লজ্জার শেষ রইল না। সহজ অংকের উত্তর না পারলে স্কুলে আমার এমন অবস্থা হত। দর্শককে বোকা বানানো ম্যাজিশিয়ানের মত তিনি হা-হা করে খোলাগলায় হাসলেন দেখে লজ্জায় মনে হল তক্তপোশের নিচে ঢুকে যাই। নীল রঙের শক্ত বাইন্ডিংএর গানের খাতা ছিল আমার। গুরুর নিজের হাতে গাণ্ডাবদ্ধ সাগরেদদের জীবনে নাকি সৌভাগ্যের তালা খোলে— বইটইতে সেরকমই লেখা থাকত। আমার হাতে অবশ্য গাণ্ডা-টাণ্ডা বাঁধা হল না। চটপট গুরুর নিজের হাতের মুক্তাক্ষরে লেখা গোটা দশেক বন্দিশের সাথে শ-খানেক তানের পাহাড় জমল; আর বিশটার মত পাল্টার পিরামিড গড়ে উঠল। পিরামিড দেখতে খানিকটা এরকম— স স র স স র গ র স স র গ ম গ র স স র গ ম প ম গ র স স র গ ম প ধ প ম গ র স স র গ ম প ধ ন ধ প ম গ র স স…

ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজের বর্তমান ছাত্রীদের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত। [...]

অনেকেই আমাদের বলেন আমরা নাকি ‘প্রিভিলেজড গ্রুপ’। সমাজের 'ফরচুনেট' অংশের প্রতিনিধি। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সন্তানই আমাদের অধিকাংশ। বিত্তবান না হলেও সচ্ছল বলা চলে আমাদের অনেককেই। খাওয়া-পরা-পড়াশোনা-টিভি দেখা-ঘুরে বেড়ানো এসব খাতে হিসেবের মধ্যে থেকেও আমাদের জন্য কিছুটা বিলাসি খরচ মাঝে-মাঝেই হয়তো করেন আমাদের অভিভাবকেরা। আবদার-আহ্লাদ করে খেলনা-জামাকাপড়-গল্পের বই দশবার চাইলে পাঁচবার তো নিদেনপক্ষে মিলেই যায়! কিন্তু সচ্ছলতার নির্ভরতার চেয়েও বড় ‘প্রিভিলেজ’ হল আমাদের জীবনের এক পুঁজি যা থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েশিশু বঞ্চিত -- সেই পুঁজির নাম ‘স্বপ্ন’। আমাদের মা কিংবা বাবা যেদিন প্রথম আমাদের নির্ভরতার-আঙুল-পেলেই-মুঠি-মুড়ে-ধরে-ফেলার ছোট্ট হাত ধরে এই বিশাল চত্বরের মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেদিন প্রথম নিজেদের স্বপ্ন আমাদের মাঝে সংক্রমিত করেছেন তাঁরা। তাঁদের মেয়েদের রয়েছে স্বপ্ন দেখার অধিকার, ব্যক্তিত্ববিকাশের অধিকার, বড় হয়ে সমাজ-গড়ায় নিজ নিজ হাতের ছাপ রাখার অধিকার -- তাঁরা জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন! বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক, প্রায়-নিষ্ঠুর পরীক্ষা—প্রথম শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার ভয়-ভীতি-বাধার তীব্রতা অতিক্রম করে অবলীলায় মা’কে স্কুলগেটের বাইরে পিছে ফেলে এসে নতুন বন্ধুর পাশে এসে বসতে পেরেছি আমরা শুধু ওই স্বপ্ন-সংক্রমণের কারণে। ওই সংক্রমণ আমাদের পুতুলের মত ঠুনকো শিশুশরীরে সঞ্চার করেছে অপার শক্তি। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে মায়ের শ্রমে শিখে আসা বাংলা বর্ণমালা আর ইংরেজি এলফাবেট দিয়ে দুনিয়াটাকে দেখতে শিখেছি; পড়তে শিখেছি ক্লাসের আপার দেওয়া পাঠ; কাঁড়ি-কাঁড়ি হোমওয়ার্কের বোঝা বহন করেছি; সমাধান করেছি বীজগণিতের খটোমটো ফরমুলা; চোখ গোল করে গল্প শুনেছি ইতিহাসের; পাবলিক পরীক্ষার ভুতুড়ে সকালে চুলে তেল দিয়ে টান-টান করে বেণি বেঁধে কলমের খস-খসানিতে পৃষ্ঠা ভরিয়েছি; কেমিস্ট্রি ল্যাবের বীকারে সবজে-নীল অধঃক্ষেপ দেখে পৃথিবীকে রঙিন ভেবেছি; বিতর্কের মঞ্চে প্রতিপক্ষের তার্কিক আর বিচারক প্যানেলকে চমৎকৃত করেছি বৈশ্বিক অর্থনীতির ভরাডুবির খতিয়ান দেখিয়ে; বিশাল কাঠের বোর্ডে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে মেধাবী সিনিয়ার আপুদের নাম, সেই ১৯৬১ সাল থেকে; ঘাড় কাত করে সেই নামগুলো দেখেছি আর ভেবেছি ওদের মত হতে পারব কিনা। আর বাড়ি এসে মাকে দিয়েছি তাচ্ছিল্যের ভর্ৎসনা -- “ধ্যুত, আমাদের আপা বলেছেন এটাই ঠিক। মা, তুমি কিচ্ছু জানো না!” মা নিশ্চয়ই খুশি হয়ে ভাবতেন, “ছোট্ট মেয়েটা কত বড় হয়ে যাচ্ছে!” বাবাকে বলতেন, “জানো তোমার মেয়ে স্কুলে কী কী করে? কী কী শেখে?” বাবা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসতেন। মুখে বলতেন না, কিন্তু মনে…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.