সম্পূর্ণ মামলাটি হচ্ছিল একটি সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে। গোপন সেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ বাঙালী অফিসার ১৯৭১-এ দেশে অবস্থান করেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় নি। বরং সক্রিয়ভাবে সে পাকিস্তানীদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। ১নং সামরিক আদালত গঠিত হলেও শুরুতে তার ন্যূনতম আইনী বৈধতাও ছিল না। বিচার শুরুর কিছুদিন পর একটি অর্ডিন্যান্স জারী করে ওই ট্রাইবুনালকে বৈধ করা হয়। ওই অর্ডিন্যান্সকে পেছন থেকে ক্রিয়াশীল করা হয় মামলা শুরুর বেশ পরে এক সামরিক ফরমান বলে। অর্থাৎ পুরো বিচারের কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। কর্নেল তাহের ও আমাদের আইনজীবীরা বারবারই এসব বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ মামলা পরিচালিত হচ্ছিল গোপন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় এবং তা অত্যন্ত জবরদস্তিমূলকভাবে। মামলা চলাকালে বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী নানা কাজই জিয়া সরকার করেছে।

১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব

(পূর্ব প্রকাশিতের পর…)

সম্পূর্ণ মামলাটি হচ্ছিল একটি সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে। ১নং সামরিক আদালত গঠিত হলেও শুরুতে তার ন্যূনতম আইনী বৈধতাও ছিল না। বিচার শুরুর কিছুদিন পর একটি অর্ডিন্যান্স জারী করে ওই ট্রাইবুনালকে বৈধ করা হয়। ওই অর্ডিন্যান্সকে পেছন থেকে ক্রিয়াশীল করা হয় মামলা শুরুর বেশ পরে এক সামরিক ফরমান বলে। অর্থাৎ পুরো বিচারের কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। কর্নেল তাহের ও আমাদের আইনজীবীরা বারবারই এসব বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ মামলা পরিচালিত হচ্ছিল গোপন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় এবং তা অত্যন্ত জবরদস্তিমূলকভাবে।

মামলা চলাকালে বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী নানা কাজই জিয়া সরকার করেছে। যেমন কারাগারের অভ্যন্তরে কোনো অস্ত্রধারী থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল তার ব্যতিক্রম। জিয়া কর্তৃক সেসময় নবগঠিত সশস্ত্র আর্মড ব্যাটালিয়নকে ওই সময় কারাভ্যন্তরে আনা হয় আমাদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে। হ্যান্ডকাফ পরিহিত অবস্থায় বিচারালয়ে আসতে অস্বীকার করলে আমাদের তারা জোর করে শারীরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে আদালতে উপস্থিত করে। এছাড়া সেসময় কারাগারে এবং কারাগারের বাইরে ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকার কয়েকটি বাড়ির ছাদেও মেশিনগান পোস্ট বসানো হয়েছিল। এমনকি কারাগারের ভেতরে আদালত কক্ষের দরজা-জানালার বাইরেও হালকা মেশিনগানের পাহারা বসানো হয়। এসবই ছিল বেআইনী। তথাকথিত বিচারকদের বারবার এসব স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে আর্মড ব্যাটলিয়নের কর্তব্যরত সৈনিকদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি যে, তাদের জানানো হয়েছিল আমরা অত্যন্ত বিপদজনক রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। ভারতীয় বাহিনী হেলিকপ্টারে এসে আমাদের কারাগার থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারে। তাই এই সশস্ত্র প্রহরা।

গোপন সেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ বাঙালী অফিসার ১৯৭১-এ দেশে অবস্থান করেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় নি। বরং সক্রিয়ভাবে সে পাকিস্তানীদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। ট্রাইব্যুনালে বিমান বাহিনীর উইং কমাণ্ডার আব্দুর রশিদ ও নৌ বাহিনীর একজন কর্মকর্তাও সদস্য হিসাবে ছিলেন। আর ছিলেন দু’জন বেসামরিক ম্যাজিস্ট্রেট। কর্নেল ইউসুফ হায়দার ও উইং কমান্ডার রশিদ এখন আর বেঁচে নেই। দু’জনই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ মামলার অসারতা ও অবৈধতা সম্পর্কে অনেক কিছুই উল্লেখ করা যায়। যেমন প্রথমদিন আমাদের আদালত কক্ষে নেবার পূর্বে গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন এক জায়গায় আমাদের সবাইকে বসায়। তারপর তারা রাজসাক্ষীদের চেনাতে শুরু করে আমরা কে কোন জন। এটা তারা করেছিল প্রকাশ্যেই, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে। উল্লেখ্য ওই রাজসাক্ষীদের মধ্যেই আমি ফখরুলকে দেখি, যার সহযোগিতায় ডিএফআই আমাকে ধরতে সক্ষম হয়েছিল।

২১ জুন আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর ২৮ জুন পর্যন্ত বিচার মূলতবী করা হয়। যেসব ষড়যন্ত্রকারী এ গোপন মামলা সাজিয়েছিল তাদের কথা মতই সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিচ্ছিলো। যার মধ্যে মিথ্যাচার আর গরমিলের ছিল ছড়াছড়ি। যেমন রাজসাক্ষী ফখরুল এক পর্যায়ে বলে যে ড. আখলাকের মোহাম্মদপুরস্থ বাসায় সে কর্নেল তাহেরকে দেখেছে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা কর্নেল ভোরার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে। অথচ বাস্তব সত্য হলো ড. আখলাকের বাসায় কোনো ফোনই ছিল না। এ ধরনের জাজ্বল্যমান অনেক মিথ্যাচারেই অভিযুক্ত হয়েছিলাম কর্নেল তাহেরসহ আমরা। আমাদের আইনজীবীরা রাজসাক্ষীদের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করার পরও মামলার ফলাফল প্রভাবিত হয় নি। কার্যত পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি ছিল একটি প্রহসন। মামলাটি যথাযথভাবে সাজানোরও প্রয়োজনবোধ করে নি সরকার। কাকে কি দণ্ড দেয়া হবে তা ক্যান্টনমেন্টের ডিএফআই হেড অফিসে আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় ডিএফআই-এর প্রধান ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম। প্রধানত তার ভূমিকায় সমস্ত ষড়যন্ত্র এগোলেও রাষ্টের সকল গোপন নিরাপত্তা সংস্থার কর্তারাই যুক্ত ছিলেন এ পুরো প্রক্রিয়ায়। আর এদের সবার পুরোভাগে ছিলেন বিশ্বাসঘাতক জেনারেল জিয়া। স্বাভাবিক ভাবেই তথাকথিত অভিযুক্ত হিসাবে গোটা বিচারকেই অবজ্ঞা ভরে প্রত্যাখান করেছিলাম আমরা। শুনানি চলাকালে আমরা বিচারকদের দিকে পা তুলে বসে থাকতাম। কখনো বিচারকদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারীও উচ্চারণ করা হতো। যেমন রব ভাই তাঁর জবানবন্দীতে বিচারকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তোমরা মরে গেলেও কবর থেকে তুলে তোমাদের চাবকানো হবে’। বিচারকদের এ ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বানও জানানো হতো। যেমনটি করেছিলেন কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো তাঁর জবানবন্দিতে।

সে সময় ১৯৫৩ সালে সামরিক একনায়ক জেনারেল বাতিস্তার বিরুদ্ধে মানকাডা দূর্গ অভিযান ব্যর্থ হবার পর হাসপাতালের একটি কক্ষে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বিরুদ্ধে গোপন বিচার চলছিল। সব দিক থেকেই অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে এ দুটো বিচার প্রহসনের। পার্থক্য এখানেই যে বাতিস্তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কিউবার বিচারক ন্যায় ও সত্যের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। আর বাংলাদেশের ইউসুফ হায়দাররা মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না। কিউবা ও বাংলাদেশের বিচারকরা পুরস্কৃত হয়েছিলেন তাদের কর্মের জন্য। বিচারের ছয় বছর পর জেনারেল বাতিস্তার পতন হলে বিজয়ী ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁর গোপন বিচারের সেই বিচারককে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করেছিলেন বিপ্লব পরবর্তী কিউবার প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁকে নিয়োগ করে। আর বাংলাদেশে গোপন ষড়যন্ত্র মামলায় ক্রীড়নক কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে পুরস্কৃত করা হয় ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসের ট্রেড কমিশনার নিযুক্ত করে। রাজসাক্ষীদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়। কিন্তু যে কলঙ্কের বোঝা তারা নিজ স্কন্ধে নিলেন তা তাদের বহন করতে হবে অনাগত কাল ধরে।

গোপন বিচারে তথাকথিত আসামীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বৈধ সরকারকে উৎখাতের অভিযোগ এনেছিল জিয়া সরকার। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন ওঠে কোনো বৈধ সরকারকে উৎখাত করেছি আমরা? আমাদের কৌসুলী আতাউর রহমান খান, আমিনুল হক, জুলমত আলী খান, গাজীউল হক, আব্দুর রউফ প্রমুখ বারবার এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। সরকারি পিপিকে তারা বলেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে বৈধ সরকারকে উৎখাত করেছিল রশিদ-ফারুক চক্র। বর্তমান অভিযুক্তরা নয়। সেই বৈধ সরকারকে ষড়যন্ত্র ও হত্যার মধ্য দিয়ে যারা উৎখাত করেছে তাদের বিরুদ্ধে জিয়া সরকার তো কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেনি। বরং হত্যা ও উৎখাতের সাথে জড়িত খুনীদের পুরস্কৃত করেছে। খুনী মুশতাক সরকার কি বৈধ সরকার ছিল? রাষ্ট্রের তথাকথিত আইনী দৃষ্টিতে বৈধ এ সরকারকেও উৎখাত করেনি তাহের ও তার সহযোগীরা। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক ক্ষমতা দখলের সময়কালে বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকারই ছিল না। আমাদের কৌসুলীরা বলেন, তাহেরের নেতৃত্বে সংগঠিত সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের ফলশ্র“তিতে জেনারেল জিয়া ক্ষমতাসীন হন। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, সরকারি অভিযোগের বয়ান ও রাজসাক্ষীদের ভাষ্যে এটা পরিষ্কার যে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পরিচালিত সিপাহী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বন্দী জিয়ার জীবন রক্ষা হয় এবং কার্যত তিনিই সরকার গঠন করেন। ওই অভ্যুত্থান পরিচালনা কি একটি বৈধ সরকারকে উৎখাতের প্রচেষ্টা বলে গণ্য হবে? যদি তাই হয়, তাহলে কেন জিয়া সরকার ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসাবে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করেছেন? সুতরাং তাহের ও তার সহযোগীদের তো ওই কাজের জন্য অভিযুক্ত করা যায় না। বরং সিপাহী অভ্যুত্থান সম্পর্কে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এই অভ্যুত্থানের স্থপতি তাহেরকে পুরস্কৃত করার কথা।

আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। আমাদের আইনজীবীরা ধারাবাহিক উদাহরণ সহ যুক্তি প্রদর্শন করলেন এ প্রশ্নে। তারা উল্লেখ করলেন যে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে রশিদ-ফারুকের ক্যুদেতা ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের বড় নজির। এ ব্যাপারে জিয়া সরকার কি কিছু বলেছেন? ৭৫-এর ১৫ আগষ্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিরাজমান নৈরাজ্য ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের সাথে তো তাহের ও তার সহযোগিরা জড়িত নন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জিয়া সে সমস্ত শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেননি। তাহের তাঁর ঐতিহাসিক জবানবন্দীতে ঘোষণা করলেন যে, তিনিই সিপাহী অভ্যুত্থান পরিচালনা করেছেন। তার মধ্য দিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বিরাজমান প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বিশৃঙ্খলার অবসান সূচিত হয়েছিল। তাহের উল্লেখ করলেন যে, বাংলাদেশের নতুন মীরজাফর জিয়া সিপাহী অভ্যুত্থানের লক্ষ্যের সঙ্গে বেঈমানী করে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নতুন অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

সমস্ত সওয়াল-জবাবের পর অভিযুক্তদের জবানবন্দী প্রদানের প্রশ্ন এসেছিল। প্রথমে আমরা ঠিক করেছিলাম জবানবন্দী দেব না। কিইবা লাভ তাতে। কিন্তু আইনজীবীদের অনুরোধে জবানবন্দী দিতে রাজী হই আমরা। প্রায় সবাই কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই জবানবন্দী দেন। মেজর জলিল ইংরেজীতে অত্যন্ত উদ্দীপনাময় জবানবন্দী দেন। রব ভাই-এর বক্তব্যও ছিল বলিষ্ঠ। ইনু ভাই লিখিত জবানবন্দী দেন। জাসদ রাজনীতি, গণবাহিনী গড়ে তোলার অনিবার্যতা ও ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয়গুলো যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেন তিনি। আমাদের বক্তব্য ধৈর্য্য ধরে শোনার কোন ইচ্ছা সামরিক আদালতের ছিল না। কোর্ট থেকে বারবার তাগাদা দেয়া হচ্ছিল জবানবন্দী সংক্ষিপ্ত করার।

সবার শেষে তাহের ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। শুরু হলো বাঙালী জাতির এক অকুতোভয় বিপ্লবী বীরের ঐতিহাসিক জবানবন্দী। ৬ ঘন্টা তাহের বলে গেলেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দার বার বার বাধা দেন তাহেরের বক্তব্যে। মনে হচ্ছিল ওই সব বিচারকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে তাহেরের কথা শুনে। সংক্ষিপ্ততম সময়ে তাহেরের জবানবন্দী শেষ হোক – এই তারা চাইছিল। অন্যদিকে আমরা সহ সকল অভিযুক্ত, আইনজীবীবৃন্দ ও এমনকি সশস্ত্র প্রহরীরা সম্মোহিতের মত তাহেরের ‘শেষ কথা’ শুনি। বাঙালী জাতির গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, সাধারণ মানুষের বীরত্বগাঁথা, স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ার পথে অবস্থিত সেনাবাহিনীর প্রতিবন্ধকতা, গণবিচ্ছিন্ন এই বাহিনীর স্থলে জনগণের উৎপাদনশীল গণবাহিনী গড়ে তোলার অনস্বীকার্য প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি তুলে ধরেন তার বক্তব্যে। আমোঘ বাণীর মত কিছু কথা উচ্চারিত হয় তাহেরের জবানবন্দীর শেষ অংশে। ইংরেজীতে বলা সে সব উদ্দীপনাময় উচ্চারণের বাংলা অনুবাদ অনেকটা এ রকম –

‘সাড়ে সাতকোটি মানুষের এই জাতি মরে যেতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ বীরের জাতি। সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থান এ জাতিকে অদম্য সাহস যোগাবে। এ অভ্যুত্থানে থেকে যে শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা তারা পেয়েছে তা ভবিষ্যতে তাদেরকে সব কাজে পথ দেখাবে। আমি ভীত নই। আমার দেশ ও জাতিকে আমি ভালবাসি। এ জাতির অস্তিত্বে আমি মিশে রয়েছি। কার সাহস আছে আমাদের আলাদা করার। নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই’।

বিনা প্রস্তুতিতে বলা তাহেরের সেই জবানবন্দী ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় বিদেশে। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফৎশুলজ তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী তৎকালীন বাংলাদেশের সামরিক রাষ্ট্র প্রশাসনের ভেতরকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোনো একজনের কাছ থেকে তাহেরের জবানবন্দী পাওয়া যায়। তাহের ও ৭ নভেম্বরের সিপাহী অভ্যুত্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে লরেন্স লিফৎশুলজ সম্পর্কে কিছু বলতেই হয়। এই সাংবাদিক-গবেষক তার অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে অভ্যুত্থানকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ১৯৭৪-এ বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কঠিন দিনগুলোতে প্রথম এই সাংবাদিক তাহেরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কয়েকজন বাঙালী সাংবাদিক তাকে জানিয়েছিলেন যে আবু তাহের নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে খাল ও সেচ ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ‘বিচিত্রায়’ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। উৎপাদনশীল সেনাবাহিনীর ধারণাও তিনি তুলে ধরেছেন সে প্রবন্ধে। পরবর্তীকালে ৭ নভেম্বরের ওপর লিখিত তার বইয়ের বাংলা সংস্করণের ভূমিকায় লরেন্স বলেন, ‘প্রথম যখন আমি বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাহেরের সাথে আলাপ করতে গেলাম তখন আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে তিনি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। জানতামই না তিনি নেপথ্যে যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাই প্রকাশ পাবে ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানে’। অভ্যুত্থান সংঘটনের সাত দিন পর ঢাকায় পৌঁছে তিনি জানলেন তাহের এই অভ্যুত্থানের স্থপতি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছোট ভাই চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক জোনাবুল ইসলামের বাসায় তাহেরের সাথে আবারও সাক্ষাৎ হয় লিফৎশুলজের। ইউসুফ ভাই সে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। ততদিনে জিয়ার প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। হংকং থেকে প্রকাশিত ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ’ পত্রিকায় লিফৎশুলজের পাঠানো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাহেরের ছবি ছাপা হয় তাতে। তার নিচে লেখা হয় – ‘নভেম্বর বিপ্লবের স্থপতি’। ঢাকা কারাগারে আমাদের বিচার চলাকালেও লরেন্স ঢাকায় আসেন। কিন্তু সরকার অতিশীঘ্র তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়। আজ এ প্রসঙ্গে এ কথা বলতে চাই যে লরেন্স লিফৎশুলজের লেখা প্রবন্ধ ও তাহেরের উপর তার লেখা বইটি বিদেশ থেকে প্রকাশিত না হলে বাংলাদেশের সুশিল সমাজ হয়তো বিশ্বাসও করতো না যে তাহের ও জাসদ ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছিলেন আর জিয়া সংগঠিত করেছিলেন প্রতিবিপ্লব।

কারাগারের অভ্যন্তরে ওই গোপন বিচার চলাকালে নেতৃবৃন্দসহ আমাদের সকলেরই মনোবল অত্যন্ত শক্ত ছিল। কারও মধ্যে কোনোরূপ ভীতি কাজ করেনি। বস্তুত সকলেই ছিলেন বিপ্লবী আবেগ ও উদ্দীপনায় উজ্জীবিত। বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আমরা খুব একটা মনযোগীও ছিলাম না। বরং আদালতের বিরতিকালে কবিতা, গান ইত্যাদি নিয়েই মেতে থাকতাম আমার। তথাকথিত আসামীদের এ ধরণের কর্মকাণ্ডে শক্রপক্ষ নিশ্চয়ই আরও বেশি আতংকিত বোধ করে থাকবে। ১৭ জুলাই মামলার রায় পড়ে শোনান ইউসুফ হায়দার। প্রথমে ঘোষিত হয় ড. আখলাক, সাংবাদিক এবিএম মাহমুদ, মোহাম্মদ শাহজাহান, মাহমুদুর রহমান মান্না সহ ১৩ জন খালাস প্রাপ্তের নাম। এরপর যারা স্বল্প মেয়াদী দণ্ড পেয়েছিলেন তাদের নাম। আসম রব, ইনু ও আমার দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানা। মেজর জিয়াউদ্দিন-এর চোদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। এভাবেই এক পর্যায়ে নাম এলো মেজর এম এ জলিল ও আবু ইউসুফের। বলা হলো যে, তাদের জন্যে নির্ধারিত দণ্ড হলো ফাঁসি। তবে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্যে তাদের উভয়কে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। এখন তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করলেই চলবে, আর তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে। এ পর্যায়েই আমরা বুঝে ফেলি যে কর্নেল তাহেরের জন্যে কি শাস্তি নির্ধারিত হতে যাচ্ছে। বিচারক কম্পিত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো এবং তা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হবে। একথা বলেই বিচারকরা অনেকটা দৌড়ে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা সবাই হেসে উঠলাম। চারিদিকে শ্লোগান উঠলো ‘কর্নেল তাহের লাল সেলাম’। সবাই তাহের ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু শুনতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘আমি যখন আপনাদের সবার মাঝে থাকি সব ভয় দূরে চলে যায় ও আমি সাহসী হই। এক অপরাজেয় শক্তি আমার মধ্যে কাজ করে। আমাদের একাকীত্বকে বিসর্জন দিয়ে সবার মাঝে প্রকাশিত হতে চাই। সে জন্যেই আমাদের সংগ্রাম’

এরপর সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের নিজ নিজ সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। রায়ের পরও আমরা ধারণা করেছিলাম যে, কর্নেল তাহেরের দণ্ড নিঃসন্দেহে কার্যকর হবার নয়। একজন বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা, যিনি সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ যাঁর একটি পা কেড়ে নিয়েছে তাকে কিভাবে ফাঁসী দেয়া সম্ভব? এতটা নির্মমতা ও বিশ্বাসঘাতকতা নিশ্চয়ই জিয়া করবে না। কিন্তু মাত্র এক দিনের মধ্যেই আমাদের ভুল ভাঙতে শুরু করে। কারণ রায় ঘোষণার পরদিনই বহু বছর ধরে অকার্যকর ও অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকা জেলের ফাঁসীর মঞ্চ সংস্কারের কাজ শুরু হয়। কেবল তখনি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে, ফাঁসীর আদেশ কাগুজে নয়। শক্রপক্ষ সত্যি সত্যি কর্নেল তাহেরকে হত্যা করবে। গোপন বিচারে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেবার পরদিনই তড়িঘড়ি করে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের সংস্কার কাজ শুরু হয়। সেসময় সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়ার ডানহাত হিসাবে পরিচিত জেনারেল মীর শওকত নিজে কারাগারে এসে ফাঁসির মঞ্চের ওই সংস্কার কাজ তদারক করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, এ কাজ তার স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সেটা করেছিলেন এ কারণে যে, তাহেরের প্রতি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র তখন প্রতিহিংসায় উন্মত্ত। আরও একটি কারণ হয়তো এই যে, ১৯৭২ সালে এ্যাডজুটেন্ট জেনারেলের দায়িত্ব পালনকালে তাহের মীর শওকত সহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ কুক্ষিগত করার অভিযোগে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেন। চার বছর পর শওকত তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুযোগ পেলেন।

১৭ জুলাই আদালত কক্ষে সামরিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান রায় ঘোষণা করলে বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের আইনজীবীরাই স্তম্ভিত হয়ে যান। সরকারি পিপি এ টি এম আফজাল পরে জানান যে, তিনি এ সাজা চান নি। বাস্তবেও তিনি কোনো আসামীরই মৃত্যুদণ্ড দাবী করেন নি। কারণ আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তার জন্য সর্বোচ্চ সাজা ছিল যাবতজীবন কারাদণ্ড। কিন্তু আমি আগেই বলেছি যে, সবারই দণ্ড নির্ধারিত হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের ডিএফআই হেড অফিসে। বিচার ছিল আসলে একটি প্রহসন।
রায় ঘোষণার পরই আমাদের আইনজীবীরা ঠিক করেন যে, এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে তারা রীট করবেন। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফের জন্য তারা প্রেসিডেন্টের কাছে অনুকম্পা চেয়ে আবেদন করারও সিদ্ধান্ত নেন। সেখানেই তারা তাহেরের পক্ষে একটি চিঠি তৈরি করে ফেললেন। কিন্তু তাহের ভাই তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘মীর জাফরদের কাছে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, এ অসম্ভব’। আইনজীবীদের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও কর্নেল তাহের অনুকম্পার আবেদন জানান নি।

তবে তাঁর অজান্তে মিসেস লুৎফা তাহের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছে একটি আবেদন করেছিলেন। বিচারপতি সায়েম সে আবেদনে সাড়া দেননি। স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে মিসেস তাহের এসময় অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিলেন। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর তৎকালীন সিজিএস জেনারেল মঞ্জুরের নাম উল্লেখ করা যায়। জেনারেল মঞ্জুর তাহেরের সাথে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাহেরকে বাঁচাতে তিনি এগিয়ে এলেন না। মাওলানা ভাসানীর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। ভাসানী টেলিগ্রাম পাঠান মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার অনুরোধ জানিয়ে। জাতিসংঘ ও এ্যামন্যাস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বার্তা প্রেরিত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ শুরুর পূর্বেই তড়িঘড়ি করে জিয়া ফাঁসী দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করে ফেলেন। পরে শুনেছি আত্মগোপন অবস্থা থেকে কর্নেল জিয়াউদ্দিনও তার বন্ধু ও রাজনৈতিক দীক্ষাদাতা তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর না করার জন্যে জেনারেল জিয়াকে টেলিফোনে অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘don’t kill Taher’.

রায় ঘোষণার পর থেকে ফাঁসী কার্যকর পর্যন্ত তিন দিন পুরো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ছিল নিস্তব্ধ। সর্বত্র ছিল শোকের ছায়া। এর মধ্যেই ২০ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টা থেকে আমাদের তিন ভাইকে এক এক করে তাহের ভাই’র ফাঁসির সেলে নেয়া হলো শেষ সাক্ষাতের জন্য। প্রথমে ইউসুফ ভাই, এরপর বেলাল এবং সবশেষে গেলাম আমি। আমার পুরনো ২০ সেল থেকে ফাঁসীর সেলে যেতে নতুন বিশ সেলের সামনে দিয়ে যেতে হয়। যাবার সময় তার দোতলা থেকে মেজর জলিল আমাকে চীৎকার করে বলছিলেন, ‘তাহের ভাইকে বল তার মরে গেলে চলবে না। তিনি যেন ক্ষমা ভিক্ষার আবেদনে সই করেন’। আমি প্রতি উত্তরে বলেছিলাম, ‘জলিল ভাই আমি তা বলতে পারবো না এবং এটা করা ঠিকও হবে না’

ফাঁসির সেলে পৌঁছার পর লৌহ কপাট ঘেঁষে বাইরের দিকটায় বসলাম। তাহের ভাই ক্র্যাচে ভর করে এগিয়ে এসে দরজার ভেতরের দিকটায় আমার কাছ ঘেঁষে বসলেন।
ইতিমধ্যে ফাঁসির মঞ্চে সার্চলাইট লাগানো হয়েছে। ওজন দিয়ে সম্ভাব্য ফাঁসির কার্যকারিতাও পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমি এক পর্যায়ে জলিল ভাই এর কথাটি তাহের ভাইকে জানালাম। একই সঙ্গে আমি জলিল ভাইকে যা বলে এসেছি সেটাও বললাম। খুব খুশি হয়ে তিনি বললেন – তোমার কাছ থেকে আমি তাই আশা করি। আমি যেন বেশিক্ষণ তার সঙ্গে থাকতে পারি সে জন্যে প্রহরীকে আমার জন্যে চা তৈরি করতে বললেন। একে একে সমস্ত সাথীদের কথা জানতে চাইলেন তিনি। একই সঙ্গে তাহের ভাই জানালেন যে, মৃত্যুর জন্যে তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বললেন বহুবার আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। মৃত্যু আমাকে পরাজিত করতে পারেনি। প্রতিবারই আমি মৃত্যুকে পরাজিত করেছি। একটি খাতা বের করে সেখানে লেখা একটি চিঠি তিনি আমাকে পাঠ করে শুনান। এ’টি তাহেরের শেষ চিঠি হিসেবে বিখ্যাত হয়েছে।

ওই মুহূর্তে কর্নেল তাহেরের সঙ্গে কথা বলে মনে হয় নি যে, তাকে আমরা হারাতে যাচ্ছি। যদিও ইতিমধ্যে আমি জানি যে সেটাই হতে যাচ্ছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক, সাবলীল এবং প্রাণবন্ত ছিলেন তাহের ওই মুহূর্তে। সেদিন সে মুহূর্তে আমি নানাভাবে বুঝলাম যে, কত বড়, কত মহান ব্যক্তি ছিলেন আমাদের এই ভাইটি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবিচল ভাবে তার সহযোগীদের মধ্যে তিনি সাহস সঞ্চার করে গেছেন এবং নিজেও ছিলেন সমস্ত শংকা ও ভীতির উর্ধ্বে। তাহের ভাই’র ফাঁসী হয়ে যাচ্ছে এটা জেনেও আমরা মোটেও ভীত ছিলাম না। আমার তখন মনে হচ্ছিলো যে, একটি জাতির মুক্তির জন্য এরকম সাহস ও আত্মত্যাগের বোধহয় বড়ই প্রয়োজন। একদিন নিশ্চয়ই আসবে, যখন এ ধরনের আত্মত্যাগ সবাইকে নাড়া দেবে, উদ্বুদ্ধ করবে। সাক্ষাৎ শেষে আমি বললাম, ‘আমাদের আবার দেখা হবে’। আমাকে আশস্ত করে তিনি হাসলেন। নির্ভীক চিত্তে নিজের সেলে ফিরে এলাম আমি। সারাদিন স্তব্ধ অপেক্ষায় কাটালো সমগ্র কারাগার। রাতে কারাগারের কোনো বন্দীই ঘুমোয় নি। সবারই অপেক্ষা কখন সাহস আর বেদনায় মোড়ানো ওই মুহূর্ত আসবে। রাত ১২টার দিকে উজ্জ্বল আলোয় ফাঁসির মঞ্চ আলোকিত হয়ে উঠলো। সে আলোর ছটা দেখা যাচ্ছিলো আমার সেল থেকেও। রক্ষীরাও জানলো যে ঘাতকরা প্রস্তুত। ভোর রাত ৪ টায় ফাঁসি কার্যকর হলো। তার কিছুক্ষণ পরই একজন কারারক্ষী আমার সেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পানি পড়ছিল তার চোখ দিয়ে। কিছুই বলতে হলো না তাকে। আমি বুঝে ফেললাম কর্নেল তাহের আর আমাদের মাঝে নেই।

সকাল সাড়ে ৯ টায় জেলার এসে আমাকে জানালেন যে, আমি লাশ দেখতে যেতে পারি। কারা হাসপাতালে যাবার পথেই বুঝতে পারলাম যে সেদিন দিনের বেলাতেও সমগ্র কারাগার লক আপ করে রাখা হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছে স্ট্রেচারে শায়িত কর্নেল তাহেরকে দেখলাম। ইতিমধ্যে পোস্টমর্টেমও হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও তার মুখাবয়ব ছিল আশ্চর্যজনক ভাবে সুন্দর। সাধারণত ফাঁসী হলে মুখমণ্ডলে যে বিকৃতি আসে তাহেরের ক্ষেত্রে তা ছিল অনুপস্থিত। ফাঁসীর প্রচণ্ড ঝাঁকুনী যেন তার মুখমণ্ডলে কোনো পরিবর্তন আনতে না পারে, তার জন্যে তিনি নিশ্চয়ই প্রস্তুত করেছিলেন নিজেকে। কারাগারের ফুলের বাগান থেকে নেয়া কিছু ফুল আমি তার বুকের উপর রাখলাম। বিদায় নেবার সময় সামরিক কায়দায় স্যালুট জানালাম। আমার পূর্বে বেলাল ও ইউসুফ ভাই একইভাবে তাহের ভাইকে শেষবারের মতো দেখে গেছেন। ইউসুফ ভাই প্রথম এসে নিজের পাঞ্জাবীটি খুলে তাহেরের গা থেকে রক্ত মুছে নেন। রক্ত ভেজা সে পাঞ্জাবিটি এখনও সংরক্ষিত আছে।

কর্নেল তাহেরের মৃত্যু সংবাদ ওই দিনই আমাদের পরিবারকে অবহিত করা হয়। কিন্তু সরকার লাশ তাদের কাছে হস্তান্তর করেনি। ঢাকায় তাহেরকে সমাহিত করা হোক এই ছিল সবার ইচ্ছা। কিন্তু পরিবারের ওই ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী হেলিকপ্টারে করে আমাদের গ্রামের বাড়ি কাজলায় নিয়ে তাকে সমাধিস্থ করে। প্রায় এক কোম্পানী সশস্ত্র সৈন্য পূর্ব থেকে সেদিন কাজলায় মোতায়েন ছিল। এমনকি পরবর্তীতে প্রায় দু’মাস সৈন্যরা তাহেরের কবর পাহারা দিয়ে রাখে। তাহেরের হত্যার মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। ব্যর্থতায় মোড়ানো একটি অধ্যায় ছিল এ’টি। যে ব্যর্থতার শুরু ৭ নভেম্বর ভোর থেকে এবং যার শেষ তাহেরের হত্যার মধ্য দিয়ে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক সপ্তাহ পরে এর প্রতিবাদে জাসদ দেশব্যাপী হরতাল পালনের ডাক দিয়েছিল। সারাদেশে আমাদের আটজন সাথী প্রতিবাদী সে হরতালে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।

জাসদ রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন সিরাজুল আলম খান এবং এ দলের অবক্ষয় ও আত্মসমর্পণের সূচনা ঘটান তিনিই। তাহেরের হত্যাকাণ্ডের কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক জিয়ার কাছে মুচলেকা দিয়ে সিরাজুল আলম খান তার ও অন্যান্য জাসদ নেতৃবৃন্দের মুক্তি ত্বরান্বিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এ’টা তিনি করেছিলেন বিশেষ তত্ত্বকথাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। ময়মনসিংহ কারাগার থেকে জাসদ নেতৃবৃন্দের কাছে সিরাজুল আলম খান লিখেন, ‘আমরা পোশাক পরিবর্তন করতে পারি এবং আমাদের তা করা উচিত’। অর্থাৎ জাসদকে তার বিপ্লবী রাজনীতি ত্যাগ করে জিয়ার আনুগত্য স্বীকার করে নিতে হবে। তিনি এও বলেন যে, ‘বিপ্লবীরা শুধু নিচ থেকে নয়, উপর থেকেও আন্দোলন করে’। অর্থাৎ বুর্জোয়াদের সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব করে বিপ্লব ত্বরান্বিত করা যায়।

সিরাজুল আলম খানের এসব বক্তব্যের ফলেই রাজশাহী জেল হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে সে সময় গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ ও জাসদকে নিয়ে জিয়া-বিরোধী সম্ভাবনাময় ১০ দলীয় ঐক্যজোটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। জাসদ নেতৃত্বের কর্তব্য ছিল আপোসের পথে না গিয়ে বিপ্লবী রাজনীতির ধারা অক্ষুন্ন রেখে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা। বাস্তবে তা হলো না। জাসদের এ বিপর্যয়ে নেতৃত্বের আপোসকামিতার পাশাপাশি জেনারেল জিয়ার ক্রয়নীতিও ভূমিকা রেখেছিল। জিয়া তাঁর কুখ্যাত দল ভাঙার রাজনীতির শুরু করেছিলেন বস্তুত জাসদকে দিয়েই। অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও ন্যাক্কারজনকভাবেই তিনি সকল প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন কিংবা নিষ্ক্রিয় করেছিলেন।

এহেন জিয়াকে আস্থায় নেয়া এবং অভ্যুত্থানে সহযোগী হিসেবে পাওয়ার চিন্তা নিঃসন্দেহে কর্নেল তাহেরের জন্য ছিল এক গুরুতর ভুল। তাহেরের আরেকটি ভ্রান্তি হলো বিপ্লবের প্রতিপক্ষের প্রতি তিনি নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বিপ্লব তো একটা উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ। এক শ্রেণী কর্তৃক আরেক শ্রেণীকে পরাস্ত ও উৎখাত করার বিষয়। তাহের এ সত্যকে সঠিকভাবে অভ্যুত্থানে প্রতিফলিত করতে পারেননি। ফলে ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে তাকে এবং জাসদকে। তবে জাসদ ও তার ফ্রন্ট সংগঠনের নেতারা অভ্যুত্থানকালে পরিকল্পনা মতো তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করলে অর্থাৎ রাজপথে সংগঠিত শ্রমিক-ছাত্র-জনতার সবল উপস্থিতি বাস্তবায়ন করলে অবশ্যই ভুলের মাশুল কম দিতে হতো। সেক্ষেত্রে জিয়ার পক্ষে এত দ্রুত তার প্রতিবিপ্লব সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না। তাহেরের দু’টি পা থাকলে অর্থাৎ তিনি পুরো সচল থাকলে জাসদের সাংগঠনিক দূর্বলতা ও ঘাটতিগুলোও তার চোখ এড়াতো না।

তাহেরের শ্রেষ্ঠত্ব হলো এখানেই যে, ভুলের দায়ভাগ পরিশোধে তিনি কোনো দোদুল্যমানতা প্রদর্শন করেন নি। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েও তিনি রক্ষা করেছেন আদর্শ ও লক্ষ্যের প্রতি তার প্রতিজ্ঞা। এদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে আসা বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের মাঝে তাহেরের অনন্যতা এখানেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে যুগান্তকারী দু’টি ঘটনা আছে। একটি মুক্তিযুদ্ধ। অপরটি ৭ নভেম্বরের সিপাহী অভ্যুত্থান। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় বাঙালী জাতীয়তাবাদের পুরোধা অওয়ামী লীগ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী সেই নেতৃত্বের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার কারণে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম ও শোষণমুক্ত অর্থব্যবস্থা পত্তন করা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সেই অপূর্ণতাকে পূর্ণ করার লক্ষ্যে সংগঠিত হয় নভেম্বর অভ্যুত্থান। যা পরিচালিত হয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি বিপ্লবী সংগঠন দ্বারা। তাহেরের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল মেহনতী মানুষের পক্ষে ক্ষমতা দখলের একটি মহড়া। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো উপমহাদেশে এমন উদ্যোগ এই প্রথম। ক্ষমতা দখলের অভ্যুত্থানমূলক রণনীতির এই প্রয়োগের ব্যর্থতা ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার মতোই। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা তাদের ব্যর্থতাকে বিজয়ে রূপান্তরিত করেছিলেন ১২ বছরের ব্যবধানে। আমাদের অতো সময়ও প্রয়োজন ছিল না। তাহেরের ফাঁসির পর কারাগারের অন্তরীণ দিনগুলোতে এটাই ভাবতাম আমরা। সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতি চলছিল। আমাদের সামনে ছিল নভেম্বর অভ্যুত্থানের বাস্তব শিক্ষা আর তাহেরের বিপ্লবী আত্মত্যাগের গৌরবময় দৃষ্টান্ত। কিন্তু নীতিভ্রষ্ট নেতৃত্বের আপোসকামিতার কারণে তাহের ও হাজারো কর্মী-সংগঠকের আত্মত্যাগ আপাতত হলেও ব্যর্থই হয়েছে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাহের বলেছিলেন, ‘এ জনপদের লক্ষ কোটি নিরন্ন মানুষের মুক্তি ও তাদের জন্যে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন অবিনাশী’। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যারাই সে স্বপ্নের পথে আগুয়ান হবে, তাহেরের আত্মত্যাগ অনুপ্রাণিত করবে তাদের। তাহের নিজেই বলেছিলেন, তিনি মিশে আছেন সমগ্র জাতির মাঝে।

মৃত্যুর দুই দিন আগে পরিবারের প্রিয়জনদের কাছে পাঠানো শেষ চিঠিতে তাহের লিখেছিলেন,

‘আমরা দেখেছি শত সহস্র উলঙ্গ, মায়া-ভালবাসা বঞ্চিত শিশু। তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় আমরা গড়তে চেয়েছি। বাঙালি জাতির জন্য উদ্ভাসিত সূর্যের আর কত দেরী। না, আর দেরী নেই। সূর্য উঠলো বলে। এদেশ সৃষ্টির জন্য আমি রক্ত দিয়েছি। সেই সূর্যের জন্য আমি প্রাণ দেব যা আমার জাতিকে আলোকিত করবে, উজ্জীবিত করবে – এর চাইতে বড় পুরষ্কার আর কি হতে পারে’।

ঢাকা কারাগারের ফাঁসীর আসামীদের জন্য নির্দিষ্ট ৮ সেলে বসে তাহের তাঁর শেষ চিঠিতে যখন উপরের কথাগুলো লিখেছিলেন, তখন সেই সেলের লোহার দরজা, কারাগারের উঁচু দেয়াল অতিক্রম করে তাঁর দৃষ্টি নিশ্চয়ই প্রসারিত হয়েছিল তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ ও তার মানুষের উপর। একে একে চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছিল নানা স্বপ্ন। ঐসব স্বপ্ন যা তিনি দেখেছেন কৈশোরে, যৌবনে ও পরিণত বয়সে। তাঁর প্রিয় কর্ণঝোরা নিয়ে স্বপ্নও হয়তো তার চোখে ভেসে উঠেছিল সেই মূহুর্তে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সেইসব স্বপ্নকে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে।

লরেন্স লিফৎসুলজ তার লেখা Unfinished Revolution – Taher’s Last Testament গ্রন্থের বাংলা সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন,

‘নিকারাগুয়ায় যারা জেনারেল অগাস্টো সানডিনোর আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন, তারাই উনিশ শো চৌত্রিশে তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পর আবারো উঠে দাঁড়ান। তাহেরের মত সানডিনোও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন, তাঁকেও হত্যা করা হয়েছিল। … হয়তো তাহেরের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত অনুপ্রেরণার জোয়ার আনবে। চারপাশে নির্যাতিত মানুষের ভীড় দেখে যারা আত্মজিজ্ঞাসায় ব্রতী হবেন, জানতে চাইবেন তাদের মধ্যে কেউ কোন দিন পৃথিবী বদলে দিতে উঠে দাঁড়িয়েছিল কিনা। তাদের জন্য নতুন অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করবে হয়তবা’।

ফাঁসীর মঞ্চে তাহেরের আত্মদানের ৩৪ বছর পর গত ২৩ আগষ্ট ২০১০ তারিখে বাংলাদেশের মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গোপন বিচারে তাহের হত্যার রায়কে চ্যালেঞ্জ করে এবং তথাকথিত বিচারের নথিপত্র প্রকাশ করার দাবী জানিয়ে রিট আবেদনে সাড়া দিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতি রুলজারি করেছেন। সেখানে রুলজারির তিন সপ্তাহের মধ্যে বিচার সংক্রান্ত সকল নথী হাইকোর্টের কাছে হস্তান্তর এবং কেন গোপন সামরিক আইন আদালতের দেয়া রায় এবং তাহেরের ফাঁসীকে অবৈধ ঘোষণা করা হবেনা তা জানাতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের এই ঐতিহাসিক রুলিং দেশের সচেতন মানুষকে নতুন আশায় উদ্দীপ্ত করেছে। ৩৪ বছর অপেক্ষার পর সত্য প্রকাশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু হওয়া, সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল ’৭২-এর সংবিধান পুন:প্রতিষ্ঠা – এসবের সাথে তাহের হত্যা বিষয়ে হাইকোর্টের রুলিং স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে নতুন প্রজন্মকে। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। ‘সোনার বাংলা’ কায়েমের স্বপ্ন। যে স্বপ্ন দেখেছেন বঙ্গবন্ধু ও তাহেরসহ অগুনিত শহীদেরা। মনে হচ্ছে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। প্রস্তুতি পর্বের সেই সময়ে এবং ভবিষ্যতে তাহেরের বিপ্লবী শিক্ষা, সাহস ও আত্মদান তাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

(শেষ)

১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব

মো. আনোয়ার হোসেন

অধ্যাপক, প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনুজ, শহীদ কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)।

১৯ comments

  1. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (দ্বিতীয় পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  2. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (চতুর্থ পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  3. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (তৃতীয় পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  4. Pingback: মুক্তাঙ্গন | তাহেরের স্বপ্ন (প্রথম পর্ব) | মো: আনোয়ার হোসেন

  5. রায়হান রশিদ - ২১ নভেম্বর ২০১০ (১:৩৭ পূর্বাহ্ণ)

    গোপন বিচারে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেবার পরদিনই তড়িঘড়ি করে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের সংস্কার কাজ শুরু হয়। সেসময় সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়ার ডানহাত হিসাবে পরিচিত জেনারেল মীর শওকত নিজে কারাগারে এসে ফাঁসির মঞ্চের ওই সংস্কার কাজ তদারক করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, এ কাজ তার স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সেটা করেছিলেন এ কারণে যে, তাহেরের প্রতি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র তখন প্রতিহিংসায় উন্মত্ত। আরও একটি কারণ হয়তো এই যে, ১৯৭২ সালে এ্যাডজুটেন্ট জেনারেলের দায়িত্ব পালনকালে তাহের মীর শওকত সহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ কুক্ষিগত করার অভিযোগে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেন। চার বছর পর শওকত তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুযোগ পেলেন।

    কিছুক্ষণ আগে (২০ নভেম্বর ২০১০, শনিবার, বাংলাদেশ সময় – সন্ধ্যা) মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর এর মীর শওকত ঢাকায় তার গুলশানের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এই দু’জন কি একই ব্যক্তি?

  6. অবিশ্রুত - ২১ নভেম্বর ২০১০ (৩:৩৫ পূর্বাহ্ণ)

    হ্যাঁ, একই ব্যক্তি। কিছুদিন আগে মীর শওকত আমাদের সময় পত্রিকায় এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত বয়ান দিয়েছেন :

    রক্তাক্ত নভেম্বর নিয়ে আলাপচারিতায় লে. জেনারেল বীরউত্তম মীর শওকত আলী আরো বলেছেন, কর্নেল তাহের বীরউত্তমকে ফাঁসি দেয়ার রাতটি তিনি এবং জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশ ক্যান্টনমেন্টে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ছিলেন। জিয়াকে তারা জীবনরক্ষার অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন, তাহের মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো একজন বীরযোদ্ধা। জিয়ার উত্তর ছিল, আমি কি তাহেরকে ফাঁসি দিতে চাই? চাই না। কিন্তু দি ল অব দ্য ল্যান্ড শোড কেরি ইটস কোর্স। সে তো মার্সি পিটিশন দেয়নি। মীর শওকত খালেদ মোশাররফের মৃত্যু সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেন- হি ডাইড লাইক এ হিরো, তাহের লাইক অলসো হিরো। তিনি এককথায় বলেন, খালেদ, তাহের ও জেনারেল মঞ্জুরের মৃত্যু বীরের মতোই হয়েছে। কারণ সেক্টর কমান্ডারদের মৃত্যু ভয় নেই। তিনি বলেন, জেনারেল খালেদকে যখন মারতে নেয়া হয়, তখন হুদা কাঁদছিল। খালেদ তাকে ধমক দিয়ে বলেছিল ‘মেয়েদের মতো কাঁদছ কেন? ক্যু করেছ, হেরে গেছ। বীরের মতোই মৃত্যুকে বরণ করেছেন খালেদ। তেমনি জেনারেল মঞ্জুর জড়িত থাকা দূরে থাক, জিয়া হত্যার ব্যাপারে কিছুই জানত না। সে তার ট্রুপসকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। ঢাকায় ৩ নভেম্বর খালেদ যখন অভ্যুত্থান করেছেন, মীর শওকত তখন যশোর ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেড কমান্ডার। প্রতিদিনের রুটিন ওয়ার্কের মতো ওইদিন সকাল বিধায় জিয়াকে ফোন করতে গিয়ে পাননি।

    দেখা গেল সেনা ও সিভিল টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এক অফিসার জানাল বিডিআরের টেলিফোন সংযোগ সচল। ব্রিগেড মেজর এসে জানাল, জিয়া আটক। বিকেলে জিয়াকে না পেয়ে মীর শওকত ওসমানীকে ফোন করলেন। বললেন, আমার চিফের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। এখন দায়িত্ব মোভ করে দেখা করা এবং চিফের নির্দেশ নেয়া।
    ওসমানী রেগে গিয়ে বললেন, আমি এখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি, এই সময়ে তুমি আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়িওনা। জিয়া ইজ ওকে। আশা করি তাড়াতাড়ি তুমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে খালেদ ফোন করে বলল, তুমি কাল ঢাকায় এসো। কথা আছে। উত্তরে জানালাম, কাল পারব না। শরীর ভালো নয়। তবে মনে রেখ জিয়াকে যদি কিছু করা হয় তাহলে ব্রিগেড নিয়ে ঢাকায় আসব। ৫ নভেম্বর খালেদ ফোনে আবারো শওকতকে ঢাকায় যেতে বললেন। শওকত হ্যাঁ বা না কিছু না বলে সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। অফিসাররা ঢাকায় যেতে মানা করে বলল, জিয়া যখন গ্রেপ্তার আপনি গেলেও তাই- না হয় মেরে ফেলবে।
    এদিকে সেদিনই ঢাকা থেকে জেট ফাইটার প্লেন যশোর ক্যান্টনমেন্টের ওপর এসে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কয়েক দফা ড্রাইভ করে চলে গেল। খালেদকে ফোন করে শওকত জানতে চাইলেন এই ভয় দেখানোর কারণ কি? জবাবে খালেদ বলেন, এটা তার সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু ঢাকায় না এলে অফিসারদের বাড়িতে বম্বিং হবে। তবে ৬ নভেম্বর সকাল নয়টায় যশোর বিমানবন্দরে প্লেন পাঠানো হবে বলে খালেদ তাকে প্রস্তুত হয়ে যেতে বললেন। শওকত বলেন, বম্বিংয়ের কথা ভেবে তিনি ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৬ নভেম্বর সকাল নয়টা যশোর বিমানবন্দরে ফ্লাইংক্লাবে সেনা প্লেন অবতরণ করল। উঠতে গিয়ে দেখলেন চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার পরবর্তী সেনাপ্রধান জেনারেল আতিকুর রহমান বসা। আতিক ও ঘটনা কী বলতে পারলেন না।

    ঢাকায় নেমে আতিক গেলেন এক আত্মীয়ের বাসায়। তাকে তরুণ অফিসার আর্মি হেডকোর্য়াটারের উল্টোদিকে, গেস্ট হাউসে নিয়ে গেলেন। শওকত জানতে চান খালেদ কোথায়? তরুণ অফিসার জানালেন বঙ্গভবনে। লাগেজ রেখে বললেন, চলো বঙ্গভবনে। গিয়ে দেখেন দরবার হলে বিদেশি রাষ্ট্রদূত, সিভিল মিলিটারি সবাই সেখানে। সেনাপ্রধান হিসাবে খালেদের অভিষেক হচ্ছে। শওকত আর ভিতরে গেলেন না।

    শওকত বেরিয়ে আসার সময় লক্ষ্য করলেন, দরবার হলের বাইরে যারা- তারা যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। একটা গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে। সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নেমেছে। গেস্ট হাউসে ফিরে শোনলেন টেলিফোন অবিরাম বাজছে, কেউ রিসিভ করছে না। তিনি রিসিভার তুললেন। ও প্রান্ত থেকে কেউ জানতে চাইল সব ঠিক আছে কিনা। বললেন ঠিক আছে। লাইন কেটে গেল। গোয়েন্দা চাকরির সুবাদে শওকতকে ফোনটা বিচলিত করল। তাকে ভিআইপি রুমের বাইরে ৩ অস্ত্রধারী সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। তার পকেটে পয়েন্ট টু পিস্তল। ভিআইপি রুমে না থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।

    রাতের অন্ধকার নামতে না নামতেই হঠাৎ অজস্র গুলির আওয়াজ আসতে লাগল। ৩ সেন্ট্রি ভয়ে ভিআইপি রুমে ঢুকে কাঁপছে। শওকত তাদের বললেন, অস্ত্র আমার কাছে দিয়ে পিছন দিকে পালিয়ে যাও। তারা সানন্দে জমা দিয়ে ইউনিটে ফিরে গেল। শওকত তিন রাইফেল ও গোলাবারুদ পেয়ে সাহসী হলেন। রুম ছেড়ে রাস্তার পাশে স্কোয়াস কোর্টের অন্ধকার গ্যালারিতে অবস্থান নিলেন। বুঝলেন বিভিন্ন ইউনিট থেকে গুলি হচ্ছে। এ সময় হঠাৎ ১০ সৈনিক বেয়নেট লাগানো রাইফেল নিয়ে গেস্ট হাউসে তার রুমটিতে প্রবেশ করল। লাইট জ্বালিয়ে রুম তছনছ করল। স্কোয়াস গ্যালারি নিরাপদ মনে করলেন না। কোর্টের উল্টো দিকে জেনারেল এরশাদের কোয়ার্টার। তিনি তখন ভারত। শওকত দু’কারণে এ বাসা নিরাপদ ভাবলেন। এক. এরশাদ নেই জেনে কেউ যাবে না। দুই. তার ভাষায়, ডেইজি ভাবি (রওশন) স্বস্তি বোধ করবেন। এরশাদের বাসায় পুরনো আরদালি মাজুর সঙ্গে দেখা। বলল, বেগম সাহেবাকে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রেখেছে। তিনিও একটি রুমে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ হলেন। বললেন, কেউ এলে বলবে সাব ভারতে, বেগম সাহেবা আত্মীয়ের বাসায়। এভাবে সময় যাচ্ছে, গুলির শব্দ আসছে না। মধ্যরাতের পর কিছু লোক ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’ ‘মীর শওকত জিন্দাবাদ’ সে­াগান দিচ্ছিল। এটাকে শওকত চতুরতা ভাবলেন। নীরবে ঘরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ওরা মাজুকে মারধর করে তার সম্পর্কে জানতে চাইল। একসময় তালা এলএমজি দিয়ে উড়িয়ে ৭/৮ জন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল। হঠাৎ দেখে গুলি করতে পারে ভেবে শওকত বললেন, আমি এখানে, তোমরা কী চাও, দাড়িওয়ালা এক লোক তাকে জড়িয়ে ধরল। তারা তাকে জিপের বনেটে বসিয়ে রওনা হলো। তিনি ভাবলেন তাকে মারার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আগেই সুরা ফাতেহা ও সুরা এখলাছ পাঠ করেছেন। এই বিদ্রোহ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এবং রাত ১টার মধ্যে তারা ক্যান্টনমেন্ট নিয়ন্ত্রণে নিল। তারা তাকে সেকেন্ড আর্টিলারি ফিল্ড হেডকোয়ার্টারে মুক্ত জিয়ার সামনে নিয়ে গেল।

    মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

    • রায়হান রশিদ - ২২ নভেম্বর ২০১০ (৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ)

      ২১ নভেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় বিএনপি’র নয়া পল্টন কার্যালয়ের সামনে (লে জে অব) মীর শওকত এর দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মৃতের পরিবার বিএনপি’র এই দলীয়-রাজনৈতিক আয়োজনে সম্মত হয়েছে বলে জানি। ভাবছি, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠান এমন একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের সামনে তাদেরই আয়োজনে হতে দেয়াটা কতটুকু সমীচিন হল, বিশেষ করে দলটি যখন মাঠে-ঘাটে-আদালতে-সংসদে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে সর্বতোভাবে (এবং সাংগঠনিকভাবে) বিচার বিরোধী একটা অবস্থান গ্রহণ করেছে! আর দলটি যে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের দলীয় নেতৃত্বলাভের শেষ বাধাটিও অপসারণ করেছে, সে কথা না হয় বাদই দিলাম। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এর পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট বক্তব্য আশা করছি আমরা।

  7. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৪ নভেম্বর ২০১০ (১১:২৩ অপরাহ্ণ)

    আমরা একসময় শ্লোগান দিতাম_
    কর্নেল তাহের শিখিয়েছে/ লড়াই করে বাঁচতে হবে।
    ছিয়াত্তরের ক্ষুদিরাম/ কর্নেল তাহের লাল সালাম।
    আমাদের প্রিয়তম চিঠি হচ্ছে জেলখানা থেকে লেখা তার সর্বশেষ চিঠিটি। এমন কাব্য আমার জনমে আর হয়ত দেখা মিলবে না!
    সেই তাহেরকে এখন কতভাবেই না দেখানো হচ্ছে। লেখকের আকাঙ্খা মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আর জাসদ ক্রমে ক্রমে বিপ্লবের সমস্ত কাজগুলি সমাধানের ধারায় আছে।
    তবে তাহের এত নমিত, বিনীত, লালায়িত স্বপ্ন দেখতেন বলে মনে করার কোনোই কারণ নাই। তার কাজে ব্যর্থতা আছে, তবে তার বিপ্লবী স্পিরিটকে মনোজগতে লালন করা এবং তার জন্য কাজ করাই প্রকৃত অর্থে তাকে ভালোবাসার দরকারি পন্থা।

    • এম. সানজীব হোসেন - ২৮ নভেম্বর ২০১০ (৭:৩২ পূর্বাহ্ণ)

      ‘আওয়ামী লীগ আর জাসদ ক্রমে ক্রমে বিপ্লবের সমস্ত কাজগুলি সমাধানের ধারায় আছে।’ – এই ধারনা লেখার কোথায় পেলেন বুঝলাম না।

      বরং, লেখার নানা জায়গায় আওয়ামী লীগ আর জাসদ এর বেলায় লেখক কে বেশ critical বলেই মনে হল আমার কাছে। Infact, লেখক শেষ করেছেন এই বলে,’মনে হচ্ছে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। প্রস্তুতি পর্বের সেই সময়ে এবং ভবিষ্যতে তাহেরের বিপ্লবী শিক্ষা, সাহস ও আত্মদান তাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’ তাহের এর স্বপ্নের সাথে আওয়ামী লীগ বা জাসদ (post 1975) এর political ideology’র কোন মিল নেই।

      আপনার কথা দিয়েই শেষ করি। আপনি লিখেছেন,’আমরা একসময় শ্লোগান দিতাম_কর্নেল তাহের শিখিয়েছে/ লড়াই করে বাঁচতে হবে। ছিয়াত্তরের ক্ষুদিরাম/ কর্নেল তাহের লাল সালাম।’ হয়ত ভুল করেই লিখেছেন ‘দিতাম’। আশা করি আপনি শ্লোগানটা এখনো দেন। তাহের এর স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়ন হবেই।

      • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৮ নভেম্বর ২০১০ (৪:২৪ অপরাহ্ণ)

        আপনার কথা দিয়েই শেষ করি। আপনি লিখেছেন,’আমরা একসময় শ্লোগান দিতাম_কর্নেল তাহের শিখিয়েছে/ লড়াই করে বাঁচতে হবে। ছিয়াত্তরের ক্ষুদিরাম/ কর্নেল তাহের লাল সালাম।’ হয়ত ভুল করেই লিখেছেন ‘দিতাম’। আশা করি আপনি শ্লোগানটা এখনো দেন। তাহের এর স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়ন হবেই।

        না ভাই, এখন আমি এই শ্লোগান প্রকাশ্যে দেয়ার কথা বলতে বা লিখতে পারি না_এ শুধু আমার ছাত্রজীবনের স্মৃতিকথা। এ আমার পরাজয় বা একধরনের লজ্জাই বলতে পারেন_বাস্তবতা এমনই নিষ্ঠুর। তবে তার স্বপ্ন এখনও লালন করি আমি। তাকে নিয়ে একটা গল্পও লিখেছি, যার শিরোনাম ‘সেই এক কর্নেলের গল্প’।
        আসলে তাহেরকে নিয়ে কম লীলাখেলা তো হচ্ছে না। জাসদের ইনু যদি একসময় বলে বসেন, তাহের চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে_তাহলে আমি অন্তত অবাক হব না। কারণ জাসদের এই গ্রুপটি জাসদের সবই বিক্রি করে খাচ্ছে। এইসব ভাবতে থাকলে নিজের মাংস নিজেই ছিঁড়েখুড়ে খেতে ইচ্ছা করে!

        • এম. সানজীব হোসেন - ২৯ নভেম্বর ২০১০ (৩:১৭ পূর্বাহ্ণ)

          ভাই, আমি আমার ছাত্রজীবনেই এখনো আছি। তাই হয়তো রক্ত বেশ গরম। আমি এখন দেশের বাইরে। ‘সেই এক কর্নেলের গল্প’ যদি আমাকে email করে দেন, আমি পড়তাম। (sanjeeb.hossain@gmail.com) ভালো থাকবেন।

          • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৯ নভেম্বর ২০১০ (৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ)

            ধন্যবাদ। অবশ্যই গল্পটি পাঠাব। এটি আমার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ, কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প, যা সামনের একুশে মেলায় বার হবে, তাতে যাচ্ছে।

  8. মোহাম্মদ মুনিম - ২৫ নভেম্বর ২০১০ (৪:০৯ পূর্বাহ্ণ)

    এই লেখাটার মাধ্যমে ঘটনাবহুল ৭৫ এর অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের অনেক কথাই জানা গেল। যেটা বোঝা গেল সেটা হচ্ছে বংগবন্ধুর শাসনামলে যা ঘটেছিল তাতে কর্ণেল তাহের মোটেই খুশি ছিলেন না। তাই তিনি জাসদের মাধ্যমে বিপ্লবী পন্থায় চলে যান। বংগবন্ধু নিহত হবার পরে দেশে যে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয় সেই সুযোগে সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাসদ ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, জেনারেল জিয়াও সেই বিপ্লবের একটি অংশ ছিলেন। ক্ষমতা দখলের পরে জিয়াউর রহমান দক্ষিনপন্থীদের কব্জায় চলে যান এবং কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসী দেবার মাধ্যমে বাংলাদেশে জাসদীয় বিপ্লবের সম্ভাবনাকে কবর দেন।
    জাসদের বিপ্লব সফল হলে এবং কর্ণেল তাহের জীবিত থেকে বিপ্লবী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিলে আজকের বাংলাদেশ কি অবস্থায় থাকতো? সত্তরের দশকে দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে বেশ কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্ম হয়েছিল। স্বপ্নবান, সাহসী বিপ্লবীরা এই সব সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্ম দিয়েছিলেন। তবে ক্ষমতা দখলের পরে বিপুল সংখ্যক নিরীহ মানুষ হত্যা আর বিপুল সংখ্যক রিফিউজি তৈরি করা ছাড়া এই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো তেমন কিছুই করতে পারেনি। জাসদও কি সেরকম কিছু করতো, নাকি স্বপ্নময় বাংলাদেশ তৈরি করতো, সেই নিয়ে আবেগী বিতর্ক চলতে পারে। তবে ষাট এবং সত্তরের দশকে এশিয়া এবং আফ্রিকাতে প্রতিটি ক্ষুদ্র সমাজতান্ত্রিক দেশের আজকের দশা দেখলে প্রথম আশঙ্কাটির কথাই মনে হয়। স্বপ্নবান হয়ে অভিমানী হওয়া যায়, বংগবন্ধুর উপর রেগে যাওয়া যায়, তাঁর লাশের উপর দাঁড়িয়ে আরও স্বপ্ন দেখা যায়, কিন্তু দেশ চালানো যায় না। কর্ণেল তাহেরও সম্ভবত কম্বোডিয়ার মত বুর্জোয়া আর সেনাবাহিনীতে পাকিস্তানী দালাল সাফ করতে গিয়ে দেশই সাফ করে ফেলতেন।
    ডঃ আনোয়ার হোসেন এই সিরিজ়ে কর্ণেল তাহের ছাড়া আরো অনেক বিপ্লবীর কথা বলেছেন, যাদের অনেকেই কর্ণেল তাহেরের মতই স্বপ্ন ধারণ করেছেন, ৭৫ এ প্রায় সবারই বয়স ছিল বিশের কোঠায়, তাঁদের কেউই অকালে ফাঁসীতে ঝুলেননি, তবে ৭৫ এর পরে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করেও বিপ্লবের কিছুই করতে পারেননি। কেউ আ ফ ম মাহবুবুল হকের মত গুরুত্বহীন রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছেন, আসম আব্দুর রবের মত চালাক চতুরেরা অবশ্য ঠিকই আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। এতজন বিপ্লবীর ব্যর্থতা কি তবে শুধুই কর্ণেল তাহেরের অকাল মৃত্যুর ফল, নাকি বিপ্লবীদের রাজনীতিকেই ভুল প্রমাণ করে?
    সদ্য প্রয়াত সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীকে কয়েক মাস আগে এক টিভি অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম কয়েকটি শিশুকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছেন। মীর শওকত আলী তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক জল ঘোলা করেছেন, তেলের ড্রামসহ অনেক গল্প শুনিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গল্পের সেই অনুষ্ঠানে তাঁকে মনে হচ্ছিল কোন এক রোমান মহাকাব্যের বৃদ্ধ সৈনিকের মত, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে শিশুদের যুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছেন। বাংলাদেশে জন্মের চল্লিশ বছর পরে এসে পিছনে তাকালে অনেক কিছু ভুল মনে হতে পারে, কিন্তু মীর শওকত আলীর আয়েশ করে শিশুদের গল্প শোনানো দেখে সমস্ত ভুলকেই তুচ্ছ মনে হল, এতকিছুর পরেও যখন একজন বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা তাঁর তরুণ বয়সের বীরত্বের গল্প বুক ফুলিয়ে শিশুদের বলতে পারেন, তখন মনে হয় আমরা ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে যতটা হতাশাচ্ছন্ন, ততটা হতাশাচ্ছন্ন হওয়া বোধহয় উচিত নয়।
    মীর শওকত আলীর মতই কর্নেল তাহের ৭১ এ তরুণ বয়সী ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সবাই ছিলেন তরুণ, এঁরাই হারিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের পরিণত বয়সী জেনারেলদের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এঁরাই দিয়েছেন মহাকাব্যের চরিত্র।
    কিশোর বয়সে সামরিক পোষাক পরিহিত কর্নেল তাহেরের বিখ্যাত ছবিটি দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, এখনও রোমাঞ্চিত হই। আমার মনে হয় মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরই প্রকৃত কর্নেল তাহের, সেটাই হোক তাঁর মুখ্য পরিচয়, ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের ক্ষমতা নিয়ে খেয়াখেয়ির কর্ণেল তাহের নন।

  9. রায়হান রশিদ - ৫ ডিসেম্বর ২০১০ (৫:০৮ পূর্বাহ্ণ)

    এ সপ্তাহ থেকেই শুরু হচ্ছে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদন্ড চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট মামলার পূর্ণ শুনানি। ইতোপূর্বে গত আগস্ট মাসে মামলাটিতে হাইকোর্টের পক্ষ থেকে রুল-নিশি জারি হয়েছিল এবং সরকার পক্ষকে সময় দেয়া হয়েছিল জবাব তৈরীর জন্য। আমাদের সময় এর আজকের রিপোর্ট:

    কর্নেল তাহের হত্যা মামলার শুনানি এ সপ্তাহে শুরু

    সুলতান মাহমুদ: চলতি সপ্তাহে শুরু হতে যাচ্ছে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলার রিটের শুনানি। রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেছেন, কাউকে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণ করতে নয়, বরং যে আইনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল তা সাংবিধানিক ছিল কিনা তা নিষ্পত্তি করতেই এই মামলা। তথ্য প্রমাণের অভাবে সুবিচার পেতে অন্তরায় হবে না। চ্যানেল আই

    ১৯৭৬ সালে ১৬ নম্বর আইনানুযায়ী বিশেষ ট্রাইবুনাল স্থাপন করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গোপনে বিচার করে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কেউ কোনো তথ্য প্রকাশ করলে শাস্তির বিধানও নিশ্চিত করা হয় ওই আইনে। আর এ আইন চ্যালেঞ্জ না করার জন্য সুরক্ষতা দেয়া হয় ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে।

    সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলে তাহেরের পরিবার ওই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করলে রুল জারি করে হাইকোর্ট। মামলার রিটকারী পক্ষের আইনজীবী শাহদীন মালিক আরো বলেন, মামলার শুনানির দিন ধার্য করার জন্য আজ মামলাটির কোর্টের কার্য তালিকায় আসবে। তিনি আশা করেন মামলাটির শুনানির কার্যক্রম এ সপ্তাহের শেষে শুরু হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তাহেরের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে যথার্থ তথ্য পাওয়া না গেলেও শুনানি করতে কোনো বাধা নেই। বিচারের ঘটনা সংক্রান্ত কোনো তথ্য না পেলেও মামলার শুনানিতে কোনো সমস্যা হবে না এবং মামলায় সুবিচার পেতেও কোনো সমস্যা হবে না। সমস্যা না হওয়ার কারণ হলো এই যে, কেননা যে আইনে বিচার করা হয়েছিল সে আইন বা ট্রাইবুনালটা সংবিধানসংগত ছিল কিনা অথবা এই মামলার সঙ্গে কোনো ব্যক্তির দোষণীয় কোনো কিছু ছিল কিনা সেটাই বিষয়। তিনি বলেন, এ মামলার সঙ্গে রাজনৈতিক কোন প্রশ্নও আসবে না। কেননা এটা সম্পূর্ণ আইনি ব্যাখ্যার মামলা। আইনকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, তা সম্ভব না হলে নতুন আইনি সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

    প্রিয় সানজীব,
    শাহদীন ভাইয়ের সাথে কথা বলে মামলার পিটিশনটি যদি কোনভাবে আমাদের জোগাড় করে দিতে পারো তাহলে খুব উপকৃত হই। মামলার বিস্তারিত গ্রাউন্ডগুলো এবং আনুষঙ্গিক তথ্যাবলী সম্বন্ধে আরও জানতে আমাদের এখানকার পাঠকদের অনেকেই আগ্রহী হবেন বলে আমার বিশ্বাস। পিটিশনটি হাতে পেলে ইমেইল করতে পারো, তাহলে মুক্তাঙ্গন এর সার্ভারে স্থায়ীভাবে আপলোড করে রাখা যাবে; গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক দলিল হতে যাচ্ছে এটি। প্রসঙ্গত, এই মামলাটির কাজের সাথে যুক্ত থাকার জন্য তোমাকে এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ এবং আন্তরিক অভিনন্দন।

  10. অবিশ্রুত - ১২ জানুয়ারি ২০১১ (৭:০৬ অপরাহ্ণ)

    কর্নেল তাহেরের গোপন বিচারকারীদের খোঁজ করেছে হাইকোর্ট :

    কর্নেল তাহেরের বিচারে গঠিত সামরিক আদালতের চার সদস্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে জড়িত তৎকালীন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের অবস্থান জানাতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

    এছাড়া তাহেরের বিরুদ্ধে ওই সময় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা মামলার নথিও তলব করেছে আদালত।

    বুধবার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।

    আদালত ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে ‘৭৬ এর অগাস্ট পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে কর্মরত মেজর জেনারেল নূরুল ইসলাম শিশুসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের নাম, ঠিকানা ও অবস্থান আগামী ১৮ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছে।

    এছাড়া ওই সামরিক আদালতের সদস্য ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল আলী ও হাসান মোরশেদ এবং উইং কমান্ডার আব্দুর রশিদ ও অ্যাকটিং কমান্ডার সিদ্দিক আহমদের অবস্থানও এ সময়ের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে সংস্থাপন ও প্রতিরক্ষা সচিবকে।

    ১৯৭৬ সালের ৪ জুন তাহেরের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা মামলার এজাহার আদালতে জমা দিতেও নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

    ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে অভ্যূত্থান-পাল্টা অভ্যূত্থান চলে। এরই এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এমএ তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই সাজা দেওয়া হয়। এরপর ২১ জুলাই ভোররাতে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

    ওই বিচারের বৈধতা নিয়ে তাহেরের ভাই ও স্ত্রীর রিট আবেদনে গত ২৩ অগাস্ট হাইকোর্ট সামরিক আদালতে তার গোপন বিচারের নথি তলব করে।

    পাশাপাশি তাহেরের গোপন বিচারের জন্য সামরিক আইনে জারি করা আদেশ ও এর আওতায় গোপন বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না- তা জানাতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

    কর্নেল তাহেরের ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন, তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ২৩ অগাস্টই ওই রিট আবেদন করেন।

    এই কলঙ্কজনক ফাঁসি, আরও সঠিকভাবে বললে, হত্যাকাণ্ডটির বিভিন্ন দিক বিচারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেশ খানিকটা জানা যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এ হত্যাকাণ্ডটি সম্পর্কে আমরা যত জানতে পারব, ততই জানা যাবে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের মনোস্তত্ব সম্পর্কেও এবং জনগণ বুঝতে পারবে, তিনি কত বড় মাপের একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনী ছিলেন।

    তিন নভেম্বরে জিয়া যখন গৃহবন্দি হন, তখন সেই বাসায় কি খালেদা জিয়াও ছিলেন? যদি থেকে থাকেন, তা হলে ঘটনার তদন্তের স্বার্থে, জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাকেও তলব করা প্রয়োজন।

  11. রেজাউল করিম সুমন - ২৩ মার্চ ২০১১ (৭:১৬ পূর্বাহ্ণ)

    কর্নেল তাহেরের প্রহসনমূলক গোপন বিচারকে অবৈধ ও বেআইনি বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।

    তাহেরের গোপন বিচার অবৈধ
    প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১১

    ১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ তাহেরের গোপন বিচার অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, তাহেরসহ অন্যদের বিচার ছিল লোক দেখানো ও প্রহসনের নাটক। এটা কোনো বিচার হয়নি। তাই বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচার-প্রক্রিয়া ও সাজা ছিল অবৈধ। বিচার ও সাজা বাতিল করা হলো।

    গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালত অভিমতে বলেছেন, ওই বিচার প্রথম থেকেই অবৈধ, আর পুরো বিচারটি ছিল একটি বিয়োগান্ত নাটক ও বানানো বিচার।

    বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, তাহেরের তথাকথিত বিচার ও ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। ওই বিচার ও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ছিলেন জিয়াউর রহমান। একই সঙ্গে তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি কথিত ওই সামরিক আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

    কর্নেল তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ও অন্যদের রিটের ওপর শুনানি শেষে আদালত রায় ঘোষণা করলেন।

    ঘটনার বর্ণনা করে রায়ে বলা হয়, ১৯৭৬ সালের ১৪ জুন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৭ জুলাই তাহেরকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। এরপর ২১ জুলাই তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু তাহেরকে যে আইনে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সে আইনে ওই সময় মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান ছিল না। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ’৭৬-এর ৩১ জুলাই মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। তাই আইনগতভাবে ওই দণ্ড ছিল অবৈধ। তথাকথিত ওই আদালতের বিচারক আবদুল আলী ও অন্যরা বলেছেন, বিচারের সময় তাঁদের সামনে কোনো কাগজ বা নথিপত্র ছিল না। এ ছাড়া আসামিরা জানতেন না যে তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ। তাঁদের পক্ষে বক্তব্য দিতে কোনো আইনজীবীও দেওয়া হয়নি। এসব বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল ও এর কার্যক্রম ছিল অবৈধ। তথাকথিত ওই বিচার সংবিধানের ২৭, ২৯, ৩০, ৩২, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পরিপন্থী।

    এজলাসের ঘড়িতে বেলা পৌনে ১১টা। এজলাসে আসেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। সঙ্গে ছিলেন জাসদের সভাপতি ও রিট আবেদনকারী হাসানুল হক ইনুসহ অন্যরা। এরপর আসেন কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, ছেলে আবু কায়সারসহ পরিবারের সদস্যরা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহ্দীন মালিক ও তৌহিদুল ইসলাম। রায় দেওয়ার আগে গতকাল অ্যাটর্নি জেনারেল, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, শাহ্দীন মালিক ও অ্যামিকাস কিউরি আক্তার ইমাম ও আবদুল মতিন খসরু শুনানিতে অংশ নেন। বেলা একটা থেকে রায় দেওয়া শুরু হয়, শেষ হয় একটা ২৭ মিনিটে। তখন এজলাসে পিনপতন নীরবতা। এ সময় আদালতকক্ষে তিল ধারণের জায়গা ছিল না।

    ঠান্ডা মাথায় হত্যা: তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, তাহেরের তথাকথিত বিচার ও ফাঁসি ছিল ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। ওই বিচার ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জিয়াউর রহমান। দুর্ভাগ্যজনক হলো, জিয়া আজ আর জীবিত নেই। তবে ওই বিচারে জড়িত ও সহযোগী অন্তত একজন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুল আলী এখনো জীবিত আছেন। ওপরের নির্দেশে ও প্রয়োজনের তাগিদে ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে এমন যুক্তি খাটে না। আবদুল আলীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়েরের কথাও বলেন আদালত।

    জিয়া জড়িত: রায়ে লিফশুলজ ও অন্যদের বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ এসেছে। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা এ মামলার বিচার্য বিষয় নয়। ওই সময় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। সঠিক ইতিহাস ও সত্যের খাতিরে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এটা খতিয়ে দেখতে পূর্ণাঙ্গ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে তা যাচাই করতে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হলো। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজ্ঞ, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং অবসরপ্রাপ্ত বেসামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তার সমন্বয়ে ওই কমিটি গঠন করতে বলা হয়।

    তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ডে স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা স্লোগান মুছে ফেলেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের স্থান রেসকোর্স ময়দানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পরিণত করেন এবং সেখানে শিশুপার্ক স্থাপন করেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেন জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতাবিরোধী কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানকে দেন মন্ত্রীর পদ। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সেনা কর্মকর্তাদের উচ্চপদে আসীন করেন তিনি।

    তাহেরকে শহীদের মর্যাদা: ইতিহাস ও বিভিন্ন নথিপত্র থেকে ওই প্রহসনের বিচার এবং দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত তাহেরসহ অন্যদের নাম বাদ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, তাহেরসহ অন্যরা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের ক্ষোভের শিকার ছিলেন বলেই মৃত্যুবরণ ও কারাবরণ করেছিলেন। তাঁরা জিয়ার স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠায় পাশে না থেকে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাহেরকে দেশদ্রোহের অভিযোগ মুছে দিয়ে মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত করে শহীদের মর্যাদা দিতে নির্দেশ দেওয়া হলো। কথিত বিচারের মুখোমুখি হাসানুল হক ইনু, মাহমুদুর রহমান মান্না, মেজর জিয়াউদ্দিনসহ অন্যদের দেশপ্রেমিক হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার কথাও রায়ে বলা হয়।

    আর্থিক ক্ষতিপূরণ বিবেচনা: রায়ে আদালত তাহেরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত বলেন, ওই সময় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অনেকেই সেনা কর্মকর্তা এবং সরকারি চাকরিতে ছিলেন। কিন্তু গোপন বিচারের কারণে তাঁদের সাজা হয় এবং অনেকে চাকরিচ্যুত হন। যাঁদের সাজা হয়েছিল, তাঁদের পেনশনসহ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলা হয়।

    শেষ পর্যায়ে: রায়ের শেষ পর্যায়ে আদালত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বিবেকের তাড়নায় স্বেচ্ছায় লিফশুলজ বক্তব্য দিতে এসেছেন। সরকারের নয়, আদালতের আহ্বানে তিনি এসেছেন। এ নিয়ে রাজনীতিকেরা বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এটা অনভিপ্রেত। আদালত সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বিচারাধীন বিষয় সম্পর্কে না জেনে এরূপ মন্তব্য সমীচীন নয়।

    প্রতিক্রিয়া: রায়ের একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে, এ আশা প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্দুক চিরদিন কারও হাতে থাকে না। একদিন না একদিন তা চলে যায়। এতে তাঁর সংঘটিত অবৈধ কর্মকাণ্ড মুছে যায় না, তা বিচারের আওতায় আসে। তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁকে কোনো দিন ফিরে পাওয়া যাবে না। তাঁর অবদান ও স্মৃতির প্রতি এই শ্রদ্ধা তাঁর পরিবারের জন্য সান্ত্বনা।

    তাহেরের পক্ষে করা রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী শাহ্দীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, আদালত তাহেরের গোপন বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচার ও দণ্ড কার্যকর অবৈধ ঘোষণা করেছেন। দেরিতে হলেও সব সময় সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বেআইনি হত্যাকাণ্ড যেকোনো মোড়কেই হোক না কেন, সেটা উন্মোচিত হবেই। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অন্যায় কোনো সমাজই কখনো মেনে নিতে পারে না। এ সত্যটি ৩৫ বছর পর হলেও প্রমাণিত হয়েছে।

    ফিরে দেখা: তাহেরসহ ১৭ জনকে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের গোপন বিচারে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই সাজা দেওয়া হয়। এরপর ২১ জুলাই ভোররাতে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কর্নেল তাহেরের ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন, তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ গত বছরের আগস্টে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ আগস্ট আদালত তাহেরের বিচারের জন্য সামরিক আইনের মাধ্যমে জারি করা আদেশ এবং এর আওতায় গোপন বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এ ছাড়া চলতি বছরের শুরুতে ওই সময় গোপন বিচারের মুখোমুখি অন্য ছয় ব্যক্তি হাইকোর্টে পৃথক তিনটি রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রুল জারি করেন। এই ছয় ব্যক্তি হলেন হাসানুল হক ইনু, রবিউল আলম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউদ্দিন, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, করপোরাল শামসুল হক ও আবদুল মজিদ।

    রিটের শুনানিকালে ১৪ মার্চ মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ, এর আগে ঢাকার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম এম শওকত আলী, বর্তমান জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মহিবুল হক, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় উপস্থিত তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার ফজলুর রহমানও আদালতে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল নূরুল ইসলাম। তাহেরের সঙ্গে সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি কয়েকজনও আদালতে বক্তব্য দেন। চূড়ান্ত শুনানিতে আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, এম জহির, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আক্তার ইমাম, এ এফ এম মেসবাউদ্দিন, আবদুল মতিন খসরু, জেড আই খান পান্না ও এম আই ফারুকীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে রাখা হয়।

    একনজরে কর্নেল তাহের
    কর্নেল আবু তাহের ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের আসামের বদরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে।
    শিক্ষা: শিক্ষাজীবন শুরু হয় চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ স্কুল থেকে। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক পাস শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯৬০ সালে। ওই বছর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

    মুক্তিযুদ্ধ: মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কর্নেল তাহের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১১ নম্বর সেক্টরের তিনি ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। জামালপুরে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে আক্রমণ পরিচালনার সময় আহত হন। পরবর্তী সময়ে ‘বীর উত্তম’ খেতাব পান।

    রাজনীতি: সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তিনি সিপাহি-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেন।

    গ্রেপ্তার ও মৃত্যু: ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর ফাঁসি হয়। (সূত্র: বাংলাপিডিয়া)

  12. প্রাকৃতজন - ২৫ মার্চ ২০১১ (৪:০৯ অপরাহ্ণ)

    এই লেখাগুলো তো আমাদের ইতিহাসের ‘অকথিত’ ভাষ্য, তাই সবখানে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। আর এই শেষ কিস্তির সাথে অন্য কিস্তিগুলোর লিঙ্ক দিয়ে দিলে পুরো লেখাটি পাঠকের নাগালে চলে আসে! ধন্যবাদ।

    • প্রাকৃতজন - ২৫ মার্চ ২০১১ (৪:১৪ অপরাহ্ণ)

      মার্জনা, লিঙ্কগুলো প্রথমে আমার ব্রাউজারে ‘কেন’ জানি দেখায় নি!!!!!

  13. মাসুদ করিম - ১১ নভেম্বর ২০১৩ (১০:২৮ পূর্বাহ্ণ)

    কখন যে সাতই নভেম্বরকে বুঝতে পারব?

    ‘৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল বঙ্গবন্ধু খুনীদের বিরুদ্ধে’

    রোববার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘৭ নভেম্বর ও নুর হোসেন দিবস: সর্বদলীয় সরকার গঠনে বিরোধী দলের ভূমিকা, জন দুর্ভোগের হরতাল, আগামী দিনের সংসদ’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন তিনি।

    বক্তব্যের শুরুতে ৭ নভেম্বরের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন, “দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে সেদিন সিপাহী-জনতা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলো যার নায়ক ছিলেন কর্ণেল তাহের। মুলত বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিরুদ্ধে এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এ অভ্যুত্থান ঘটানো হয়।”

    “পরে জিয়াউর রহমান কর্ণেল তাহের ও হাজার হাজার সৈনিককে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। তিনি এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের পুর্ণবাসন করেন।”

    এর আগে একই অনুষ্ঠানে ৭ নভেম্বর সম্বন্ধে বক্তব্য দেন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তার বক্তব্যেও ছিলো ৭ নভেম্বর প্রসঙ্গ। কামরুলের বক্তব্যের সময় ইনু মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন না।

    কামরুল বলেন, “মূলত সেনাবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধা শূন্য করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয় যাতে পরে অভ্যুত্থান আখ্যা দেয়া হয়। এ ঘটনায় জিয়া ক্ষমতায় এসে আরো কয়েকশ দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যকে বিনা বিচারে হত্যা করেন।”

    বক্তব্য শেষ করে কামরুল সভা ত্যাগ করার কিছুক্ষণ পরে সভায় উপস্থিত হন তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর সভাপতি হাসানুল হক ইনু।

    ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর টালমাটাল পরিস্থিতির এক পর্যায়ে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর মুক্ত হন। সেদিন নিহত হন খালেদ মোশাররফসহ অনেক সেনা কর্মকর্তা।

    ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জিয়া, হন দেশের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক।

    এরপর থেকে দিনটিকে বিএনপি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’, আওয়ামী লীগ ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান’ দিবস হিসেবে দিনটি পালন করে আসছে।

    ’৭৫ এর নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সঙ্গে যুক্ত মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের পাল্টা অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে সেনাপ্রধান জিয়াকে মুক্ত করেন, যাতে যুক্ত ছিলেন জাসদের নেতা-কর্মীরাও।

    জাসদ দিনটিকে ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে। পরে তাহেরকে সামরিক আদালতে ‘বিচার’ করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। আদালত এ ঘটনাকে হত্যাকান্ড অভিহিত করে জেনারেল জিয়াকে এজন্য দায়ী করেন।

    সেনা শৃংখলা ফিরিয়ে আনার কথা বলে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান হয়। ওই সময়ের উপ-সেনাপ্রধান জিয়াকে আটক করা হয়।

    ৭ নভেম্বরই মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারসহ অনেকে নিহত হন। আওয়ামী লীগ দিনটিকে পালন করে ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ হিসেবে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.